নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

পায়েল খাঁড়া




বোধন




ভোরের শঙ্খধ্বনির সাথেই বোধনের পুজা শুরু হল।মন্ডপের সামনেই বেলতলায় পুজার বেদি।তারই সামনে নৈবেদ্য  সাজিয়ে পুরোহিত পুজায় বসেছেন।চারপাশে ঘিরে রয়েছে পাড়ার মেয়ে-বউরা...একটু পরেই ষষ্ঠীর অঞ্জলি। পাড়ার সবচেয়ে বড় পুজো নবারুন সঙ্ঘের শারোদোৎসব এবারে দশ বছরে পা দিল।আলোর বাহার আর থিমের রকমারিতে প্রতি বছরই এরা নতুন চমক দেয়।বিগত ন-বছরে এই এলাকার সেরা পুজোর পুরস্কার প্রতিবারই এরাই জিতে এসেছে।প্রায় পনের-বিশ লাখ টাকার খরচা হয় প্রতিবছর......এবছর বাজেট দাঁড়িয়েছিল পুরো পঁচিশলাখ। শোভা আর গুঞ্জন এবছর পুজোকমিটির সেক্রেটারি।ওরা ঠিক করেছিল এবছর শারদিয়া আয়োজনে এমন কিছু করবে যাতে শুধু এই পাড়া নয় সারা শহর কখনও ভুলতে না পারে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে ওদের এবারকার শারোদোৎসব। আর হলও তাই......অঙ্গীকারটা ওদের একই রইল শুধু পালটে গেল আঙ্গিকটা।
     হুল্লোড় আর শোরগোলের মধ্যে দিয়ে কখন যেন দিনটা কেটে গেল।বিদায়ি সূর্য মিশে গেল পশ্চিমের লালে। তিলোত্তমা কলকাতা ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়।মন্ডপে মন্ডপে উপছে পড়ছে দর্শকের ভিড়।আজ ব্যাতিক্রম শুধুই নবারুন সঙ্ঘ।এখানে কোন বাহ্যিক চাকচিক্য নেই।অতি সাদামাটা ঘরোয়া মন্ডপ__সাবেকি সাজের প্রতিমাপ্রয়োজন মতই আলো আর বাজনার আয়োজন।আর আছে তাদের আন্তরিক নিষ্ঠা
শোভা আর অখিল মন্ডপের বাইরে দাঁড়িয়ে।ভিতরে ও বাইরে পাড়ার লোকেদের ভিড়।রাস্তার বাঁক ঘুরে একটা গাড়ি এসে থামল ওদের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এল মনোরমা,তার সাথে আরও দুজন লোক।মনোরমা শোভার সামনে এসে দাঁড়ালো।ওর চোখে কৃতঞ্জতা মাখা দৃষ্টি।
     প্রায় মাসচারেক আগে হটাৎই একদিন মনোরমার সাথে এদের দেখা হয় কলেজ স্কোয়ারে।মনোরমা শোভার কলেজের বন্ধু।আর সেখানেই ওরা আজকের এই ঝাঁ-চকচকে আধুনিক সমাজের এক নিষ্ঠুর মানসিকতার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে পরিচিত হয় মনোরমার কাছে।মনোরমা উত্তর কলকাতায় একটা বিদ্ধাশ্রমের দেখাশোনা করে।সমাজের বয়ঃজ্যেষ্ঠ মা-বাবা,যারা কোন একদিন নিজের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা,উন্নত ভবিষ্যত আর সুন্দর সামাজিক জীবন দেওয়ার জন্য প্রানপনে খেটেছেন অথচ আজ তাদের শেষবেলায় সেবা তো দূরে থাক দুবেলা খেতে দেওয়াটুকুও সেই সন্তানদের কাছে আতিশয্য বলে মনে হয়......সেই সব বৃদ্ধ মানুষদের মাথা গোঁজার এমনই এক ঠাই ‘আপন ঘর বৃদ্ধাশ্রম।’ মনোরমা বলে ওই বৃদ্ধাশ্রমের জায়গাটা নাকি দান করেছিলেন কোন এক কোম্পানির মালিক কিন্তু তাঁর বর্তমান উত্তরাধিকারী গৌতম দত্ত ওই জমির উপর ক্লেইম করছেন।ছ-মাসের মধ্যে ৪০লাখ টাকা না দিতে পারলে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। ১৬লাখ টাকার ব্যবস্থা কোন মতে হয়েছে কিন্তু এখনও প্রয়োজন আরও ২৪লাখ।কোথায় পাবে অত টাকা?
সেদিন ফিরে এসে শোভা সংঘের সবাইকে শোনায় ঘটনাটা।পরেরদিন সকালে ওরা সবাই যায় ‘আপন ঘর বৃদ্ধাশ্রম’এ।ব্যাপারটা ভীষনভাবে দাগ কাটে ওদের মনে। অত গুলো বয়স্ক মানুষ আরও একবার ঘরছাড়া হবেন শুধুমাত্র মানুষের লোভ আর অমানবিকতার দায়! কিছুতেই নয়।ওরা ঠিক করে পুজোর বাজেটের ২৪লাখ টাকা ওরা দান করবে ‘আপন ঘরের’ জন্য।একটা বছর নাই বা হল ওদের মন্ডপের জাঁকজমক,নাই বা হল চোখধাঁধানো আলোকসজ্জা।মাটির প্রতিমার বদলে এবার ওরা রক্ত-মাংসে গড়া মাতৃমুর্তিদেরই শ্রদ্ধার্ঘ অর্পন করবে।
গুঞ্জন এগিয়ে এল শোভা আর অখি্লের পাশে।সঙ্ঘের বাকি সদস্যরাও এসে দাঁড়ালো। ২৪লাখ টাকার একটা চেক নবারুন সঙ্ঘের তরফ থেকে তুলে দিল মনোরমার হাতে।কাঠ-পাথরে তৈরি নকল মন্ডপের নয় আজ ওরা বোধন করল প্রকৃত অর্থেই একটা মন্দিরের যেখানে জীবন্ত ইশ্বরের প্রতিমুর্তিরা থাকেন।
মায়ের সন্ধ্যা-আরতি চলছে।গুঞ্জন আশ্চর্য চোখে শোভার কাঁধে হাত রেখে ইশারা করে দেখাল।শোভা তাকিয়ে দেখল মায়ের মুখের দিকে।মায়ের চোখদুটো যেন আনন্দে ঝলমল করছে।আজ বাজারের কেনা আলোয় নয় মঙ্গলময়ীর মঙ্গল আলোকে ভরে উঠেছে ওদের মন্ডপ।

কোন মন্তব্য নেই: