নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

পিনাকি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
পিনাকি লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

পিনাকি






কুকুর ও  মানুষের গল্প  

        


                                   ১

কেবিন থেকে বেরিয়ে , নার্সিং  হোমের  বারান্দায় দাঁড়িয়ে  দুচোখ  ভিজে  গেল  অব্যয়ার   রেলিং –এ হাত রেখে  সে   নিজেকে  শান্ত  করবার  চেষ্টা  করছে  ।  এই  মুহূর্তে  ভিতরে  ভয়ংকর  ঝড়  বইছে , সব  কিছু  উল্টো –পাল্টা  করে  দেবে  ! নিজেকে থামাতে  হবে  ।  সে  জানে  এই  সময়টুকু  নিজের  সাথে  লড়তে পাচ্ছে  না , গোটা রাত  তার জন্য  অপেক্ষা  করছে ।   শীততাপ  নিয়ন্ত্রিত  কেবিনের  ভিতর ,   নার্সিংহোমের  বিছানায়  যে   লোকটি  শুয়ে  রয়েছে ,  তার  সারা  শরীর  ব্যান্ডেজ , চ্যানেল  , নলে  বিদ্ধ । হুঁশ  এখনো  ফেরেনি  । সে   জানতেও পারবেনা  অব্যয়ার  যন্ত্রণার  গভীরতা ।   
দু’ চোখ  বেয়ে  নেমে  আসছে  জলের  ধারা । আঙুল  দিয়ে  মুছল ।   নিজেকে  শক্ত  করতেই  হবে  । সে  নিজের  মনে  নিজে  বলল -  এতো  ভেঙে পরলে  চলবে  না । প্রতিদিন  কত মানুষের জীবনে  দুর্ঘটনা  ঘটছে । তাদের  অনেকেই  আর সুস্থ জীবনে  ফিরতে পারেনা ; সংসারের  শেষ আর্থিক  সম্বলটুকু  চলে যায় !
অব্যয়াই  নিজেকে  সামলে  নিচ্ছে  । এখন ওর অনেক  কাজ  ।  ভিতরে কেবিনে  ভাঙাচোরা  দেহ  নিয়ে  ,  খাদ্যবহনকারী নলে  বিদ্ধ --  যে  মানুষটা ,  জীবন –মৃত্যু নিয়ে  লড়ছে ;  সেই মানুষটা জানতেও পারছে না --  তার   কেবিনের  বাইরেও  যুদ্ধের  আঁচ এসেছে ! দু’জন  মানুষ  এখন  পরিস্থিতিগত  ভাবে  আলাদা  অথচ  তাদের  ভিতরকার লড়াই  একই  কেন্দ্রে , আবার  এই  লড়াইয়ের  শেষে  জীবনের  গতিবিধিও একই  ভাবে  ঘুরবে । 
পিছনে  বছর  চল্লিশের  একজন  লোক  এসে  দাঁড়ালো ।  বলল – মিসেস  শুক্লা , ফিরবেন  তো ?
অব্যয়া  মাথা  তুলে  দেখল , নিবেদিতার  স্বামী ! এখন  আর অলকেশ বাবুকে  দেখলে  বিরক্তি  লাগেনা , এই  নার্সিংহোমেই  নিবেদিতা  ভর্তি রয়েছে ।  হয়ত  কাছাকাছি কেবিন  আছে  । অলকেশ  দেখতে  পেয়েছে  , তাই  কথা  বলতে এসেছে ।  এখন  মনের অবস্থা  এতটাই  এলোমেলো ,  কথা  বলতে  মন চাইছে  না । তাও  নিজেকে  জোর  করেই কিছুটা  একঘেয়ে  পরিবেশ থেকে  পালানোর তাগিদ  নিয়েই  , অব্যয়া  বলল – অলকেশ  , নিবেদিতা  কেমন  আছে  ?
নিবেদিতাকে  নিয়ে  বিন্দুমাত্র  ঘাঁটাঘাঁটি  করবার  ইচ্ছা   তার  নেই  ।  এই  বিষয়টা  নিয়ে  আর ভাবতেও    মন চাইছে  না । অব্যয়া  বলল – ওকে  নিয়ে  বিজি    রয়েছি , একদিনও  দেখা  করতে পারিনি  ।  খুব  লজ্জিত  । 
-লজ্জার  কিছু  নেই  । এতবড়  একটা  অ্যাক্সিডেন্টের  সব  ঝামেলা আপনাকেই  সামলাতে  হচ্ছে । এখানে  আপনাকে  সাহায্য  করবার মতন তেমন কেউ   নেই  ।  অফিস আর বাড়ি  সবটাই  আপনি সামলাচ্ছেন । আমি বুঝি  , মিসেস  শুক্লা ।  ও  দুঃখিত অভ্যাসবশত  আপনাকে  শুক্লা  সারনেমে  ডাকছি ।
-ভুল  কোথায় ?  বিয়ের পরে  মেয়েরা    শ্বশুর  বাড়ির  পদবী  ব্যবহার করে ।
-সে  ঠিকাছে ।  কিন্তু আমি জানি  , আপনি   বিবেক বাবুকে  ডিভোর্স  দেবেন ।

 কিছুক্ষণ চুপ থাকল ।  অব্যয়ার   হাতে  যে  রুমাল আছে  ,  কপালের  ঘাম  মুছল ।  বলল – দেখুন  অলকেশ  আপনি  আমার থেকে  এই  ব্যাপারে  এতো  শিওর  কেমন  ভাবে  জানিনা  ! দেখুন  কিছু  মনে  করবেন  না , এই নার্সিংহোমে  আমিই  বিবেকের  স্ত্রী ।  ভর্তির  সময়ে  যে  ফর্ম  ফিলাপ  করেছি , স্ত্রী  হিসেবে  আমার  নামই উল্লেখ  করা  আছে  । এখন  ডিভোর্স  নিয়ে  ভাবছি না । ওকে  সুস্থ  করে  তুলতে  হবে । যত  দ্রুত  সম্ভব । তারপর  না  হয়  ভাবা  যাবে ...
-আপনি  ভুল  বুঝলেন ।  দেখুন আপনাদের  ডিভোর্স  পেপারে  কিন্তু  বিবেক  বাবুর  সই আছে  । আর  ঘটনার  দিন  বিবেক শুক্লা  এই  নিয়ে  খুব  উল্লাসিত ছিলেন  ।
অব্যয়ার  গলা  শুকিয়ে  আসছে ।  খুব  কাঁদতে  চাইছে  ।  বুকের  ভিতর কষ্টের  গোলা আটকে  আছে  , দমবন্ধ  হয়ে  আসছে । বিবেক  তাকে  যে  অপমান  করেছে  তার  থেকেও , পুরুষের  কাছে  সকল  ভারতীয়  নারীর  ব্যবহার  এমনই !   সংবাদপত্রে  এত  খবর ছাপা  হয় , এত নারীর প্রতি  বঞ্চনার  কথা  বলা  হচ্ছে ---  সব  কিছু  সত্যি  বলে মন  মানতে  চায়না । অথচ  নিজের  জীবন  থেকে  বুঝতে  পারছে  ,  ভারতীয়  সংস্কৃতি  নারীকে  দেবী রূপে  পুজো  করলেও ,  মানুষ ভেবে  সম্মান  দেয়না  ! সে  এতটাই  অবজ্ঞার  পাত্র  ? নাকি  সিংহভাগ পুরুষই  ডিভোর্সের  সই  করে  তার   সঙ্গিনীকে  বলতে  ভুলে  যায় ,  বদলে  মদ্যপানের  আসরে  বুঁদ  হয়ে  থাকে  ।  সে  ঝগড়া  চায়নি । খোরপোষ  দাবি করেনি ।  বিবেকের  কাছ  থেকে  একফোঁটা  সম্মান  চেয়েছিল ।
এই  ছোট্ট  শব্দটা সামান্য , উচ্চারণ করতে  খুব  অল্প সময়  নষ্ট হয় ;  অথচ অনেকের  পুরো জীবনটাই  নষ্ট হয়ে  যায়  সামান্য  শব্দটার  বাস্তব   অনুভূতির জন্য  ।  অব্যয়া    তেমনই  কাঙাল । বিবেক  তাকে  কম কষ্ট  দেয়নি , তাই  নতুন করে  এমন ব্যবহার  খুব একটা   যন্ত্রণা দিচ্ছে  না ।  অলকেশের  মুখের ভাবে  নিজেকে  অপমানিত মনে হচ্ছে । চোখ  ফেটে যাবে দুঃখে ,  একফোঁটা জল  গড়াবে না ; কেননা  সে  জানে  তার  চোখের জল    অসহায়  নারীর  দুর্বলতাই  প্রমাণ  করবে । এই কয়েকদিনে , সে  বুঝে  গিয়েছে  বিবেকের  সাথে  রাগারাগি  করে  নতুন চাকরিতে  নিয়ে  সে  সেই সব  মানুষদের কাছে  চ্যালেঞ্জ  ছুঁড়ে  দিয়েছে  , যারা  নারীদের  এই   সময়েও   আর্থিক ভাবে  দুর্বল  দেখতে  চায় ।  অলকেশ  যেমনই  হোক , সেই  দলের  সার্থক প্রতিনিধি --- এটা  বুঝতে  অসুবিধা  হয়নি । 
মুখ  তুলে  অব্যয়া বলল -  আপনি  এখন  ফিরছেন ?
ঘাড়  নামিয়ে   অলকেশ  বাঁ –হাতে  ঝুলে  থাকা  ঘড়িতে  দেখল , বিকেল  ছটা । 
-হ্যাঁ , রাতে  আর আসবনা  আয়া আছে  ।  ডাক্তাররা  বলল , এখন  অবস্থা  ঠিকাছে । আগের  থেকে  অনেকটাই  ভালো ।  তাই  ভাবছিলাম   সাতদিন  ভালোই  টেনশনে কাটল  । 
অব্যয়া ভাবল , আজকে অলকেশের   সাথে  কথা  বলে  বিবেকের  আগামী  দিনের  পরিকল্পনার  জানবে । বিবেক   নিজের  মুখে  কিছু  বলেনি । তারা  ঠিক করেছে   আলাদাই  থাকবে  ।  বিবাহ বিচ্ছেদ ফাইল  করে । দীর্ঘ   সময়  বাদে  , দু’পক্ষকেই কাগজ  পাঠানো হয় ।  বিবেক  আগেই  সই করেছে । অব্যয়া স্বাক্ষর করেনি ।   এখন উল্টোটা  ভাবছে  ।  বিবেকের  দুর্ঘটনা যখন  ঘটল , তার  অবস্থা  দেখে  সে  সই করবার কথা  ভুলে  যায় । এখন সব  কিছু তাকেই  করতে হবে  ।  বিবেকের দুই ভাই এই  ঝামেলা  নেবে না  বলেছে ।  বৃদ্ধ মা   অপারগ । তাই স্ত্রী  হয়ে আইনি ভাবেই   সমস্ত দায়িত্ব  তুলে  নিয়েছে ।
এইসব  কথা  ভাবতেই  চখ চোখ জলে  ভরেছে ।  খেয়াল  করল ,  অলকেশ  বলল – চলুন , ক্যান্টিনে  গিয়ে  কফি  নিতে  -নিতে  কথা  বলা যাবে । এমনিতে  বাড়িতে  ফিরতে  ভালো লাগছে  না ।  নিবেদিতার  ফাঁকা   ঘরটা  দেখলেই , বুক  টনটন করে ওঠে ।


সন্ধ্যা  ছটায় ওরা , নার্সিং  হোম  থেকে  বেরিয়ে  উল্টো  দিকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত  ক্যাফেতে  ঢুকল ।  মুখোমুখি  বসে  রয়েছে ।  অলকেশ  কফি  আর হাল্কা স্নাক্সের  অর্ডার  দিল ।
শুরু  প্রথমে  অলকেশ  করল । - আপনার  প্ল্যান  কী ? 
অব্যয়া  বলল  -  জীবনটা  বড্ড  ভঙ্গুর । প্রতি  সময়ে  যে  কোন  স্বপ্ন  ভেঙে যেতে পারে  ।  এখন আর  পরিকল্পনা করিনা ।  জীবনকে  নিজের  মতনই  দেখতে  শিখছি ।  ভালোই লাগছে  ।  আগে  থেকে  প্ল্যান  করে  লাভ আছে  বলে  মনে  হয়না ।জীবনে যা  হবে  --- তা হবেই । তাকে  হতে  দেওয়া বা না- দেওয়া , আমাদের হাতে  নেই। তবে  সেই  হওয়াটা  হয়ে  যাওয়ার পর  , নিজেকে মানিয়ে  নিয়ে  এগিয়ে  চলাটাই জীবনের সংগ্রাম ।  লড়াই ।
-আপনি দেখছি  , জীবন নিয়ে  অনেক অভিজ্ঞ ।
-আগে ছিলাম না  । এখন  হয়েছি ।  অভিজ্ঞতা কম হলনা । পঁয়ত্রিশ  বছর  বয়স । 
-আপনি  চাকরি  করছেন ,  আপনার  চারপাশের  অনেকেই  মেনে  নিতে  পারেনি  ।  বিবেক বাবু  নিজেও  চাইতেন না।
-বিবেকের  চাওয়াটা  আমার কাছে  ইদানীং কোন  গুরুত্ব হারিয়েছে ।  সত্যি  বলতে  আজ  আমি শুধু মাত্র  নিজেকেই   গুরুত্ব  দিচ্ছি ।  আর  দিয়ে যাব ।  অন্যের বোঝা হতে  চাইনা । আর এর  জন্যই  নিজের  শিক্ষাগত  যোগ্যতা কে  ব্যবহার করছি ।  আমি  চাইনি আর্থিক  দিক  দিয়ে  বিবেকের  উপর  নির্ভর করতে । 
-আমি  জানি  । এতটুকু বুঝি  , আপনি  নিজের আত্মসম্মান  বিসর্জন দেবেন না । আর আপনি  বিবেকের    বিশ্বাস ভাঙবেন না ।
-আমি  এতকিছু  বুঝিনা  । জীবনে এখন  যেই সিদ্ধান্তে  আমি  এসেছি , সেখান  থেকে  ফিরে  যাব না । কিছুর  বিনিময়েও নয় ।


অলকেশ  কফিতে  চুমুক  দিয়ে  বলল – বিবেক  আর  নিবেদিতা একসাথে  থাকবে  ।  যদিও  আপাতত  তাদের  সুস্থতার  উপর  নির্ভর করছে । আমি  নিবেদিতাকে  ছেড়ে  দেব  ।  আমাদের  ডিভোর্স  শুধুই  আমার   সম্মতির  জন্য আটকে  ছিল  । আমি  সই করে  দিয়েছি ।  
অব্যয়া  তাকিয়ে  রয়েছে ।  অলকেশ একদিন  সকালে  নিজে  এসে  ,   বিবেককে  শাসিয়ে  গিয়েছিল ।  বউয়ের সাথে  অন্য  পুরুষের  সম্পর্ক  মেনে  নেবে না ।  বিবেকের  কথা সেই দিন  অব্যয়া  সরল   ভাবে  বিশ্বাস    নিয়েছিল  ।  মেয়েরা  যাকে  ভালোবেসে  ফেলে  , তাকে  সম্পূর্ণ  বিশ্বাস করে । ভারতীয়  মহিলাদের  এই  চারিত্রিক  দুর্বলতা  (বিশ্বাস  করাটা  যদি   নিজের   ক্ষতি  করে )তাদের  পুরুষেরা  ভালোভাবে  অপব্যবহার করে । বিবেকের  মতন  পুরুষরা  তাই  নির্ভাবনায়   নিজের  প্রেম  চালিয়ে  গিয়েছে ।   একজন   মানুষ  জীবনে  একাধিক  মানুষকে  ভালবাসতেই  পারে  ,এই   ভালোবাসাকে  পরকীয়া    বলা  যায় না  ;  তা  যখন মিথ্যার  আশ্রয় নিতে  থাকে --  তখনই পরকীয়া  হয়ে ওঠে ।  বিবেক  আর  নিবেদিতার  সম্পর্ক  ক্রমশই  তেমনই  দিকে  এগিয়েছে ।  তখনো  অলকেশ  সব  কিছু  জেনেও   নিজের  স্ত্রীর  প্রতি  শক্ত  হতে  পারেনি । আর  অব্যয়ি  ভেবেছে  এইবার তার সব  কিছু  না  মেনে  প্রতিবাদ  করবার কথা  ।  বিবেক অন্য  নারীর প্রতি  নিজের  সবটুকু   ঢেলে  দিয়েছে ,  তার  ভাগে  কিছুই  নেই  ।  অনেক  রাতে  বাড়ি  ফেরা  ,  দীর্ঘ  সময়  ধরে  বিবেকের  অবহেলা  --- সবকিছু  মেনে  নিয়েও  বাড়িতে  থেকেছে  অব্যয়ি ! কেন ? সবটাই চারপাশের  লোকনিন্দার  জন্য ? ভারতে  বিবাহিত  মহিলাদের  স্বামীর  ঘরে অত্যাচারিত  হওয়া তেমন একটা আলোড়িত  ঘটনা নয় , যতটা   বিবাহ বিচ্ছেদ  নেওয়া  । লাথি  খাও  ,  বিষ  খাও  ,  খিস্তি  খাও  --- তাও   স্বামীর  ঘরে  খাও ।  স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা  মানেই  , সে   অন্য  পুরুষের  ভোগের  বস্তু ; তাকে  সমাজের  বাকী  পুরুষেরা নিজের  চাহিদায়   ব্যবহার  করবে  ।   তাই  হয়ত অব্যয়া বিবাহ বিচ্ছেদ   এড়িয়ে  থাকতে চেয়েছে  ।   
চোখ  ভিজে  গিয়েছে । চোখের  পলকে   অতীতের  স্মৃতি  ভীড়  করছে  --    বিবেকের  জ্বর ছিল , সারারাত সে নিজে   না  ঘুমিয়ে মাথায় ভেজা কাপড়  দিয়েছিল  । এইসব ন্যাকামো  বড্ড  সেকেলে , একদিন  ঝগড়ায়  বিবেকে  বলেও  ছিল। 
অব্যয়ির  গলা  ভারি হয়ে  আসছে । সে  ঢোক  গিলে  বলল
-আপনি , নিবেদিতাকে  এতটাই  ভালোবাসতেন  যে তাকে  মেনে  নিতে চেয়েছিলেন । আর  এখন  মেয়েটার এইরকম অবস্থায় , সই করে  দিলেন  ! তাড়াহুড়ো  করলেন মনে  হল ।
অলকেশের  চোখ  দুটো  শক্ত   হয়ে  এলো । - দেখুন , ভালো  আমি এখনো বাসি । কিন্তু  নিবেদিতার পেটে  আপনার  স্বামীর   বাচ্চা ছিল ।   মানে    যদিও    দূর্ঘটনায়   সে  ভ্রূণ   নষ্ট  হয়ে গিয়েছে  ।   খুবই  দুঃখের ।   আপনি  আপনার স্বামীকে মাপ করে  দিলেও , আমি  নিবেদিতার সাথে  থাকতে  পারব না । সেইদিন   ওরা  একসাথেই  গাড়ি করে   আসছিল , দুজনেই  মদ্যপ  ছিল । দুর্ঘটনা  ঘটবার  পিছনে  সেটাও একটা কারণ । আর নিবেদিতা কনসিভ  করেছে – জেনেই  ওরা   হোটেলে  গিয়ে সেলিব্রেট করেছিল । খুব কাছের দু’একজন  ছিল । আমি তাদের একজনের   থেকেই জেনেছি । এইসব কিছু  জেনে , আমি নিবেদিতার  স্বামী হওয়ার  অভিনয় করব না । আর আমি চাইছি , কোর্ট  যেনও  অসুস্থতার ছুতোয়  ডিভোর্স  দিতে  দেরী  না  করে ।
অব্যয়া  খেয়াল  করছে , চোখের  কোণায় পাতলা  জলের রেখা নামছে   ; খুব সরু  আর আপাতাত  নিরীহ । এই  রেখা  আঙুলের  তলা  দিয়ে  মুছে  দিল ।  এমনটা  করল , কেননা  পাছে  অলকেশ  তাকে  দুর্বল  ভেবে  বসে ! 
গলা  শক্ত করে  বলল  - অলকেশ  আপনাকে  কে  বলল , আমি  বিবেককে  মাপ  করে  দেব ?  দেখুন  আমি  ডিভোর্স  দেব । আর  খুব তাড়াতাড়িই  তা  জানতে  পারবেন  ।
ঘড়িতে  সন্ধ্যা  সাতটা ।  ঘড়ির  দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়ি  বলল – আজ  উঠি ।
অলকেশ  বলল – ম্যাডাম    আপনার সিদ্ধান্ত  আপনার ।  তবে  আপনি  যদি  ডিভোর্স  দিয়েদেন  তাহলে  এখনই আমার  নিবেদিতার  হাত  থেকে  রেহাই  পেতে   সুবিধা  হয় । যদিও ওদিকে কেউ  কিছু   এখনো  বলেনি । তাও  যদি  নিবেদিতা  কর্মক্ষমতা  হারিয়ে  বিছানায়  শুয়ে  থাকে  । যদি  বিবেক  সুস্থ  হয়ে ওকে  ভুলে  যায় বা  বিবেকের  অবস্থাও  একই রকম থাকে  , হয়ত নিবেদিতার  বোঝা  আমাকেই টানতে হবে  । স্যরি , আমি   ঠিক তেমন  ভাবে  বলতে  চাইনি ।  মানে  বুঝতেই পারছেন , আমার  কিছু চাহিদা...

ঘাড়  ঘুরিয়ে   অব্যয়া  বলল – থাকুক  না , আমি  বুঝেই  গিয়েছি  । এতদিন  আপনি  নিবেদিতাকে  সহ্য করতেন কারণ ওর  মোটা  মাইনের   বেতনের  জন্য  । এখন  সে সব  নেই  যখন  বোঝা বইবেন কেন  ? আমার এইসব  ব্যাপারে  আলোচনা করতে  ভালো  লাগছে  না ।  তবে এতটুকু  বলব , আপনার  নিবেদিতার  উপর  যে  রাগ  রয়েছে আমার  বিবেকের  প্রতি  ঘৃণা  তার  থেকেও  বেশি । আমি   নিজের  সবটুকু  দিয়ে  ওকে  ভালবেসেছিলাম । আর বিবেকে  আমাকে  ঠকিয়েছে ! তাও আমি ওর  সাথে   জড়িয়ে আছি  , শুধুই  মানবিক কারণে । তবে  এটাও  হয়ত আর  বেশি  দিন  নয় । আসছি ...





                                   ২




নার্সিংহোম থেকে  বেরিয়ে , ক্যাব ভাড়া করে নিল । গাড়িটা  এলগ্রিন  রোডের  দিকে  এগিয়ে  চলেছে ।  অব্যয়া   ঘামছে ।  বিবেক  তাকে  ঠকিয়েছে , সে  এই  কষ্ট মেনে  নিলেও  নিজেকে  অসহায়  আর  প্রতারিত  ভাবতে  রাজি নয় । এটা  তার  নিজের  জীবন , এখানে  সে অন্য কোন মানুষের দ্বারা  চালিত  হবে  না । কোন  ভাবেই  নয় ।
নিজেকে  তাও কেন  ঠকাচ্ছে ?  এই  যে  প্রতিদিন  বিবেকের  মিথ্যা  পরিচয় নিয়ে  নার্সিং হোমে যাওয়া ,  সব  দায়িত্ব  নেওয়া  আবার  দিনের শেষে   বাড়ি  ফিরে  আসা  সেই  লোকটির প্রতি  প্রবল  ঘৃণা  নিয়ে  ! এমন  ভাবে  সে  নিজেই  ঠকছে ।  শেষ  একমাস  অনেক  কিছুই  ভেবেছে  , অলকেশের  মুখে  যখন  সব  কিছু জানতে পারল ,  নিজেকে  এক  মুহূর্তের জন্যও  বিবেকের  সাথে  দেখতে  রাজি  নয় ।
গাড়িটা  এসে  থামল । 


অব্যয়া  গাড়ি  থেকে  নেমে   টাকা   মিটিয়ে নিজের  ফ্ল্যাটের  দিকে  চলেছে । আজ  সে  বিবেকের  ফ্ল্যাটে  যায়নি । এই  এক কামড়ার  ফ্ল্যাটটা  নতুন  নিয়েছে ।  ব্যাঙ্কের  লোণ   নিয়ে  কিনেছে । এই একমাস  সে  এখান থেকেই  যাতায়াত করছে নার্সিং হোমে । অফিস যাচ্ছে ।   

কলিং  বেল টিপতেই   অম্বিকা  দেবী  দরজা খুললেন । তাঁকে  দেখে  অব্যয়ি  বলল -  মা , তুমি  ফোন করেছিলে ? আমি কথা  বলছিলাম  বলে ধরতে  পারিনি ।  অবশ্য  পরে  ফোন করতাম ।  ভাবলাম  বাড়িতে  এসেই  না  হয় বলব ।
-তুই হাতমুখ  ধুয়ে আয়  । আমি  ভিতরের  ঘরে    আছি ।  আজ বিনয়ের  বড়দিদি  ফোন করেছিল । ওর মায়ের সাথেও  কথা  হল । 
অব্যয়ার  শরীর জুড়ে ক্লান্তি । তারউপর  এইসব  কথা এখন  শুনতে  চাইছিল  না । সে  ইচ্ছা  করেই বলল –এখন নয়  ,অফিসের কাজ  আছে  । 


রাতে খাওয়ার  পর  নিজের  ঘরে  শুয়ে  আছে   । একপাশে  টেবিলল্যাম্প জ্বলছে , হাল্কা  আলো অব্যয়ির  মুখে  ম্যশ্চারাইজার  ক্রীমের  মতন  মেখেছে  ।  সেই দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়া একটা  দৃশ্য  ভাবছিল ।    

বছর তিরিশের  এক  রমণী কাঁদছে । এখন  গভীর রাত  ।  পাতা  ঝরবার  শব্দ  শোনা যায় । চারপাশের আলো নিভে গিয়েছে ।   যে  রমণী কাঁদছে সে  কে ? অব্যয়া  এইসব  কিছু  খুব কাছ  থেকে  দেখছে ।  এই  রমণীর মুখ খুব চেনা । সে ঘোরের  মধ্যে  থাকে   ।  এটা  একটা  স্বপ্ন ,  অব্যয়া এই  সবপ্নে স্বপ্নে আগেও  থেকেছে ।  তা  অসম্পূর্ণ  ছিল ।  মেয়েটা  তার  বয়সী । মুখ  তুলে  বলল -  আমি  হেরে  গিয়েছি  । তুমি  কিন্তু হারবে না ।
অব্যয়া  বলল – মানে ? কি হারবার  কথা  বলছ ? আমি যে  হারতে  পারি , তা কেন  বললে ?
মেয়েটির  দুচোখ জলে  ভিজে  গিয়েছে ।  অব্যয়া  বুঝতে  পেরেছে  , সব  মেয়েরই   মুখ  কষ্ট পেলে  এমন হয়ে  যায় ।  মেয়েটি  কাঁদছে  কেন  ? এই কান্নার  অন্তরালে কোন  রহস্য  লুকিয়েছে  ! সে  এই স্বপ্নকে  কখনই  সম্পূর্ণ  দেখেনি । আজ দেখবে ?
মেয়েটি বলল – ওরা  আমায়  বলেছিল , আমি  অন্যায়ের  প্রতিকার চাইব না । এই সমাজে  পুরুষকে   শাস্তি দেওয়ার  অধিকার  শুধুই  পুরুষের । আমি নারী  , শুধু  প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি  ।
অব্যয়া   কিছুই  বুঝতে  পারল  না   ! এই মেয়ে যে ভাষায়  কথা  বলছে তা  বুঝতে  অসুবিধা  হচ্ছে  না, এই  পরিবেশ  তার  চেনা  নয় । 
-তুমি অত্যাচারিত ?
-আমি  নই  আমরাই  বঞ্চিত । আমাকে কেউ সুবিচার  দিতে  পারেনি । সকলেই  ফিরিয়ে  দিয়েছে  । কথা  দিয়েছে , অন্যায়ের  বিরুদ্ধে  আত্মত্যাগ  করলেই  দেবী  হয়ে যাব !
-দেবী !!
-সকলেই  দেবীর  প্রতিশ্রুতি  দিয়েছে  মানুষের নয় । আমি মানুষের সম্মান  পেতে চেয়েছি । তাই চোখে  ঘুম  নেই । সারা  দেহ  যন্ত্রণায়  ফেটে  যাচ্ছে ।
আচমকাই  ঘুম  ভেঙে  যেতে  অব্যয়া  উঠে  বসল । তার  বুক  ,  বোগল   ঘামে  ভিজে  গিয়েছে । এতক্ষণ  একটা  স্বপ্নই  দেখছিল । সে  ভাবছিল  এই   স্বপ্নের  মেয়েটিকে খুব  চেনা  মুখ  মনে  হচ্ছিল !





                                        ৩



এখন  রাত দুটো । আর তিনঘণ্টা । তারপরেই  ভোরের আলো  ফুটবে ।  পাখির  কোলাহল  শুরু  হবে  । একা , ক্লান্ত , নির্জন  রাস্তার বুকে  মানুষের পায়ের  শব্দ  শোনা  যাবে । বারান্দায়  দাঁড়িয়ে  থাকতেই অব্যয়ার  মন  চাইছে ।  সামনে  একা –একা   দাঁড়িয়ে  থাকা  লাইটপোস্টের   ম্রিয়মাণ  আলোর  দিকে  তাকিয়ে  খুব কাঁদতে ইচ্ছা  হচ্ছে । মায়ের সাথে  ঘুমাবার  আগে  কথা কাটাকাটি  হয়েছে ।  বিবেকের বাড়ির লোক  চাইছে  , বাকী জীবনটা  অব্যয়া  বিবেকের দায়িত্ব নিক।   কেননা বাকী জীবন বিবেকে  হয়ত সুস্থ  হয়ে উঠতে পারবে  না । অবশ্য  মিরাকেল ঘটতেই পারে। আর এটা  ঘটাবার   সাধ্য আছে  একমাত্র অব্যয়ার ---- অন্তত  বিবেকের বাড়ির  দিকের  লোকের  তাই  ধারণা । বিবেকের সম্পত্তির  মালিক  হবে  অব্যয়া । 
সে  অবশ্য  নিজে  এটা  চাইছে  না ।  বিবেককে আপাতত  সুস্থ  করবে । সাথে  নিজের  চাকরিও  চালিয়ে  যাবে ।  অব্যয়ার মা  , অম্বিকা  দেবী নিজেই  চাইছেন মেয়ে  এই  সম্পর্ক  মেনে  নেয় । এতে  মান থাকবে  কূলও         থাকবে  ।ভারতীয়  বিবাহিত  মহিলা  স্বামী পরিত্যক্তা হলে , সমাজ  অন্য   চোখে দেখে ।   মেয়েদের  স্বাধীনতা থেকে  তাদের  পরাধীন  সম্ভ্রম অনেক  বেশি  দামী  ।নির্ভরশীল  আশ্রয়  অনেক  বেশি  কাঙ্খিত  । 
অব্যয়া ভাবছিল ,  স্বপ্নে ভাসা –ভাসা  মেয়েটির  করুণ মুখ আর  অব্যয়ার  অসহায়তা  মিলে  যাচ্ছে ! এই মেয়েটির  সাথে  তার  কোন  সম্পর্ক  রয়েছে ?  এই স্বপ্নের  ভিতরের  গল্পটার তার  খুব   জানা । হ্যাঁ , ছোটবেলায়  মায়ের  মুখে  শোনা  । অব্যয়া    ভাবছে ...

রাতের পানপাত্র   থেকে  গভীর  নিস্তব্ধতা ক্রমশই  ছড়িয়ে  যাচ্ছে ।  একটি  মেয়ে  লেখার টেবিলে  মাথা ঝুঁকিয়ে  হলুদ আলোর  দিকে  তাকিয়ে  ভাবছে । সাদা কাগজ  নিয়ে  লিখতে  শুরু  করল   মায়ের  উদ্দেশ্যে ----   



এখন  চারপাশ  খুব শান্ত । তাই  তোমাকে  মনের কথা  খুলে  বলছি । তুমি ছোট   বেলায় আমাকে  একটা  গল্প  শুনিয়ে ছিল । পুরাণের  গল্প । এক  ব্রাহ্মণী কে   ঠকিয়েছে  তার  পুরুষ । সেই  পুরুষ   শেষে  রোগে  ভুগে  মারা যান ।  মৃত্যুর  পরেই    যমপুরীতে  ব্রাহ্মণের   বিচার  চলে ।  অভিশাপে  তাকে  শাস্তি পেতে  হয়েছিল ।  এদিকে ব্রাহ্মণী পত্নী   নিজের  উপর  ঘটে  চলা   অন্যায়ের  বিচার  চাইল না। সে  ভারতীয়  নারী ।  বিবাহিতা  । সে  কেমন  করে  স্বামীকে  ছাড়বে ! তার থেকে  নিজেই স্বামীর পাপ  মোচনের  জন্য  চেষ্টা করবে  । কাঁদছে ।  তারপর  নারদ  তাকে  যোগবলে  মৃত  স্বামীর   চিতায় এনে  হাজির  করে । ব্রাহ্মণ   পত্নী   সহমরণ  বেছে  নেয়  ।   এরপর  গল্প  এগিয়ে  চলে  । ব্রাহ্মণ   অভিশপ্ত  হয়ে কুকুরে  পরিণত হল ।   একসময়  সে  নিজের  পরিত্যাগ  করা পত্নীর   সতীত্বের   জোরেই     নিজের পাপ  মোচন করে  এবং  শিবের   খুব কাছের   ভক্ত  হয়ে  ওঠে  !  এখানেই   অব্যয়ার   প্রশ্ন  , সে  মেয়ে  এমন  আত্মত্যাগ   করল  তাঁর  স্থান   কোথায় ?  পত্নীর  প্রতি  যে  অবিচার  হয়েছে , শাস্তি  পত্নী  দেয়নি  , দেবতারাই  দিয়েছে । সমাজ  বা   পুরুষের   বিচার   পুরুষমুখী   সমাজ  করবে  কেন  ?   নারী নিজের  স্বামীকে    ত্যাগ  দিলনা  কেন  ?  সে  কি  স্বতন্ত্র  জীবন  বেছে  নিতে  ভয়  পেয়েছিল  ? নাকি  ভারতীয়  মূল্যবোধ চেয়েছে  নারীদের  চিরটাকাল   স্বামীমুখী  করে রাখতে  ! সেই রমণীই   স্বপ্নে  এসে    বলেছে  , আর  যেনও   অব্যয়ারা  পিছনে  না  হাঁটতে  থাকে  । সময়  এসছে  নতুন  রুপকথা রূপকথা লিখবার ।
অব্যয়া   মনে – মনে    বলল  ---   বিবেকের  সম্পত্তি  বা   সম্পর্ক --- কোনটির  প্রতিই  বিন্দু  মাত্র  মোহ  নেই ।  আমার  লোভ আমার  স্বতন্ত্র  পরিচয়ের  প্রতি  ।  এটাই  আমার  অস্তিত্ব । আমি হারব  না।   আমি জানি  তোমরা  আমাকে  মেনে  নিতে পারবে  না  , কেননা  তোমাদের ভারতীয়   মূল্যবোধে  যেখানে   নারী আসলে পুরুষমুখী – আমি মানতে পারব না  । কেননা  আমি আজকের  পরিবর্তিত  ভারতীয়  মূল্যবোধ ---   নারী  স্বতন্ত্র  ব্যাক্তি  । তার এই দিক তোমরা মানবে না ।  নারী   সত্ত্বা  আর   তোমাদের  একমাত্র  সন্তানের  দায়িত্ব  নিতে   গিয়ে  যে  টানাপোড়েন  , তাতে আমি  ক্লান্ত ।  আমার  মৃত্যুর জন্য   তোমরা  দায়ী নও । সে দায় , ভারতীয় পুরুষ কেন্দ্রীক  মূল্যবোধের ............ 

চিঠিটা  লিখবার  পর  , অব্যয়া  বাথরুমে গেল  । এখনো  মা  ঘুম  থেকে  জেগে  ওঠেনি ।   ভোর  হতে  দেরী  নেই  ।   আত্মহত্যা  করলে , পাশের থানা  থেকে  পুলিস  আসবে  তাড়াতাড়ি । পোস্ট মর্ডাম  ক্রতেও করতেও খুব বেশি  সময়  নেবেনা । সন্ধ্যার  মধ্যেই  সব  কিছু  শেষ ।
অব্যয়া   বাথরুম  থেকে  এসেই  , মায়ের  ঘরের  দিকে  গেল  । সত্তর  বছরের  মহিলাটি  ঘুমিয়ে  কাদা । মুখে  এক  অদ্ভুত  শান্তি ফুটে উঠেছে । মা  ধরেই  নিয়েছে , মেয়ে  শ্বশুর  বাড়ি  ফিরছে । আর স্বামী পরিত্যক্তা নয় । এই মেয়েই  যখন  মৃতদেহে  পরিণত হবে  ! অব্যয়া মুচকি  হাসল ...

এইবার  মরতে  হবে  । গলায়  ফাঁস  দিয়ে   ঝুলে  পড়বে । অফিসে  তার কাজের  খুব নাম হয়েছে । বিবেকের  বাকী  জীবনটা    বিছানায়  শুয়েই  কাটবে    , অব্যয়ার দয়ায়  বেঁচে থাকতে  কেমন লাগবে  ? যারা তাকে  সংসারে  বাতিল  নোট  ভেবেছিল --- তাদের  চোখে  আচমকাই  সে  লটারি । কেননা  স্বামীর  আশ্রয়ে নয় , স্ত্রী  নিজের আশ্রয়ে  স্বামীকে  বাঁচিয়ে  রেখেছে  । 
আচ্ছা  এখন  যদি  না আত্মহত্যা  করে , বেঁচে  থাকে  ! সে  দেবতা  হবে  নিশ্চিত । এই  কথাটুকু  ভাবতেই অব্যয়ার  খুব আনন্দ  হচ্ছে  ।  
অব্যয়া ভাবল এই এতকিছুর  বদলে  নিজের চাকরি  করবার  জেদ সে রাখতেই পারে । আর বাকীরা তা শুনতে  বাধ্য । অন্তত  এই কারণের জন্য  আত্মহত্যার  মতন  এত  ছোট একটা  সিদ্ধান্ত পাল্টানোই  যায় ।
  খুব  দ্রুত  গিয়ে   টেবিলের  উপর  রাখা  চিঠিটা  নিজের  হাতে  নিয়ে  নিল  । খুব  দ্রুত  সরিয়ে     ফেলতে  হবে ...

( গল্পে  বর্ণিত   পুরাণ  ঘটনা  ‘পদ্ম পুরাণ ’  - এ  সম্পূর্ণ  উল্লেখ    রয়েছে ।  আমি সামান্য  অংশ লিখলাম । মাধুর্য  নষ্ট হয়ে  থাকলে  ক্ষমা  করবেন ।  এর  বিষদ   বর্ণনা  পুরাণেই  পেয়ে  যাবেন ।  আমার লেখা  কোন  সম্প্রদায়কে  আঘাত  করে  থাকলে  ক্ষমা প্রার্থী ।  ) 

পিনাকি






ছেঁড়া পালকের  ঠিকানা 
 
                         


                        ১

হাওড়া স্টেশনের  বাইরে  ট্রলি  নিয়ে   প্রায় একঘণ্টা  দাঁড়িয়ে  আছে  ।  বাইরে  রোদ ।সকাল  দশটা । সামনের  রাস্তা  দিয়ে  অনবরত  বিরামহীন  জন স্রোত , ঠিক  যেন  নদীর  জলধারা । এই স্রোতের  একপাশেই অপেক্ষা    করছে  বনিতা  । ট্রেন  থেকে  নেমেই  এই  শহর    তার কাছে   অপরিচিত  হয়ে  উঠেছে !
 কুড়ি   বছর  আগে  এখানেই সে  এসে  দাঁড়িয়েছিল ;   সন্ধ্যা ছিল  ; সূর্য  ডুব দিয়েছে ।  কলকাতার  আকাশে  নিভে  যাওয়া  সূর্যের  জন্য  কেউ  অপেক্ষা  করেনা । এতো  সময় নেই  ।  বনিতা  অপেক্ষা  করেছিল । পাঁচ  বছর  আগে  ,   সেইদিন  সে  একা ছিলনা । পাশে  একজন  ছিল । বনিতাকে  নিয়ে  ট্রেনের   বগিতে  বসিয়ে দিয়েছিল  ।  ট্রেন  ছাড়তে   তখনো  আধ ঘণ্টা  বাকী  , নিজের হাতে  বাকী  রাস্তা  যাতে  বনিতার   ক্ষিধে  না  পায় – তারজন্য  পাউরুটি   , কলা , তিনটে  ডিম  আর   জলের  বোতল  কিনে  দিল । যাওয়ার  সময়  বনিতার  চোখে  জল ছিল । 
ঘড়ির  দিকে  তাকিয়ে  , বনিতা   দেখল  এখন  দশটা  কুড়ি ।এই সময়  সামনে  অনেক মানুষ   নিজেদের  গন্তব্যের দিকে    ছুটে চলেছে । এদের  দিকে তাকিয়ে  মনে –মনে  বলল – আজ  শুধু  আমিই  কোন কাজ করব না !বনিতা   ধাবিত  উল্কাদের  দিকে  তাকিয়ে -- এক  স্থির  শান্ত  গ্রহাণু হয়ে   পর্যবেক্ষণ  করছে ! জীবন  চলমান । এখানে  কেউই   থামতে  রাজী  নয় ।  মেয়েটা  ছুটে  চলা  মানুষের মুখে  অদ্ভুত আলো  দেখতে  পায় । স্থির  জীবন  আসলে পরাজয়ের নাম । 
এখানে  ছুটি  কাটাতে  আসেনি ।  শিলিগুড়িতে   বনিতার  নিজস্ব  এন জি ও  রয়েছে ;  অনাথ  পথ শিশু  আর   আশ্রয়হীন  বয়স্ক  মানুষের  হয়ে  কাজ করে  । সেই  সূত্রে  নানা রকমের প্রোজেক্ট  তাদের  করতে  হয় । এমনই  একটা  প্রোজেক্ট  নিয়ে  কলকাতার  কিছু  ব্যবসায়ী   মহলের  সাথে  মিটিং  হবে  ।   তারাই   গেস্ট  রুমের  ব্যবস্থা   করে  দিতে  চেয়েছিল ।বনিতা  নিজেই  সেই  প্রস্তাব  ফিরিয়ে  দিয়েছে  ।   একা-একা   কাউকে  না  জানিয়ে  কলকাতা  ঘুরে  বেড়ানোর  একটা  মজা  রয়েছে । প্রায়  কুড়ি  বছর বাদে এই শহরে  ফিরে  আসা  ।  এই  শহরে  শ্বাস  নেওয়া । এই  শহরের  চীৎকার কান পেতে  শুনে  নেওয়া । এটাই জীবন । শিলিগুড়িতে  বনি  খুব  পরিচিত । কলকাতায়  ব্যবসায়ী  মহল  তাকে  চিনলেও , শহরের  মানুষের  কাছে  অপরিচিত । সে চাইছে , তিনদিনের  ট্যুর  তাকে  কুড়ি  বছর  আগের   মুহূর্তে   ফিরিয়ে  নিয়ে  যাক । সেই  উন্মাদনা , উত্তেজনা , স্বপ্ন ----  এই সব  কিছু  আজও বনিতার  কাছে  খুব দামী । 
‘বনি ’---  চেনা স্বর কানে আসতেই , স্মৃতি থেকে  ফিরে  এলো বনিতা ।     হারিয়ে  যাওয়া মন  গুটিয়ে  নিয়েছে  ।  সামনে  লম্বা   মধ্যবয়সী  উজ্জ্বল  বর্ণের পুরুষ  দাঁড়িয়ে । তার  দিকে  তাকিয়ে  হাসল ।  বলল – দেরী  হয়ে  গেলো ! আসলে ...
বনিতা   পুরুষটির  দিকে  তাকিয়ে  বলল – থাক , ফোন  করে  আমায়   যেতে  বলনি , তাই  ভাগ্য  ভালো ।
-রেগে গেলে ?
- শিলিগুড়ি  থেকে   জার্নি  করে  আমি এমনিতেই  ক্লান্ত ।  এখানে  মানে  এই রোদের  মধ্যে  দাঁড়িয়ে  ,   আমার  ঝগড়া  করতে ভাল লাগছে  না । প্লিজ  গেস্ট  হাউস ঠিক  হয়েছে ?
-একদম ।  দু’দিন আগেই  সব  ব্যবস্থা  হয়ে  গিয়েছে । যেমন বলেছিলে , একদম অচেনা ।  তোমার  রুমের  জানলা থেকে  দেখা  যাবে সামনের   সবুজ মাঠ , বাগান ।  লোকের  ভিড়  নেই  ।   নির্জন  গলি ।
-এখন আমরা  যাব কোথায় ?
-সল্টলেক ।   আজ সারাদিন   ঘুরব ।  তারপর   গেস্ট হাউস ।
-মানে  , এই ট্রলি  নিয়ে  ঘুরব !
-আচ্ছা  তাহলে  , আগে  চলো  গেস্ট হাউসে  গিয়ে  ফ্রেশ  হয়ে  তারপর  না হয়     বাকী প্ল্যান ।
-গেস্ট হাউসটা  কোথায় ?
-সল্টলেকে । অফিসের  গাড়ি  ইচ্ছা  করেই  আনিনি  । আমি চাইছি  আজ আমরা  আমাদের  কুড়ি  বছর  আগের  জীবনটা  উপলব্ধি করব । তাই  দেখো  হলুদ  ট্যাক্সি  নিয়ে  এসেছি  !

বনি  দেখল , ট্যাক্সিটা  দাঁড়িয়ে  আছে  ।  সময়  নষ্ট  না  করে  দু’জনেই  উঠে  বসল ।




                               ২


গাড়ি  ছুটছে। কলকাতার  রাস্তা , ফুটপাত ,  কোলাহল , দূষণ , বিজ্ঞাপন ,  স্বপ্ন  , স্বপ্নবিলাসী  মানুষের   ছুটোছুটি    নিয়ে  ছুটে  চলেছে ।  এত  কিছু দেখে  , বনিতা  বলল – আবির , আমাদের  প্রথম  দেখা  কোথায়  হয়েছিল ?
-রবীন্দ্রভারতী । বুধবার ।  বিচিত্র  ভবনের  সামনে । ভুলে যাইনি । মানুষ ভোরে  সুন্দর  স্বপ্ন  দেখলে ,  ঘোরটুকু  চোখে  লেগে  থাকে  , দিনের  শেষেও  তা  মুছতে  পারেনা ।
-মুছতে চায়না । মানুষ খুব  চালাক , ভালো  স্বপ্ন  মনে  রেখে  দেয় ।
-যেমন আমরা দিয়েছি  !
কথাটা  বলেই  বনিতার  হাতের  নরম  আঙুল গুলো ,  পুরুষটি  নিজের  হাত দিয়ে   ধরল । চোখের ঈশারা  করে বনিতা বুঝিয়ে  দিল  , এখন  নয় ; ড্রাইভার  আছে ।
ছোট্ট নিঃশ্বাস  ফেলে  বলল -  দিবাকর  আমাদের  কত  বয়স  হল ?
-আমার  চল্লিশ  ।  তোমারটা  বলতে  পারব না । দেখে   কুড়ি  -পঁচিশ  মনে  হয় ।
বলেই  দিবাকর হাসল ।  বনিতা  দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – আমি  বুড়ি । মেয়েরা  কুড়িতেই  বুড়ি ।

দিবাকর পকেট  থেকে  সিগারেট   বের করতেই ,  বনিতা চোখে  নিজের  আপত্তি  বুঝিয়ে  দিল । জানালা থেকে  বাইরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল -   দিবু ,  শহরটা  আর আগের  মতন নেই ।
-পৃথিবীতে কখনই কোন  জায়গা  আগের  মতন  থাকেনা বনি । পরিবর্তন  আসবেই । তবে  এখনো  শীতে  গঙ্গার  ধারে  সদ্য  যুগলেরা রোদ পোহায় ।  ময়দানে ভীড়  হয় ।  ভিক্টোরিয়াতে  কোন  বেকার সাহসী  যুবক  তার  সদ্য  প্রপোজ   করে  আপন করে  নেওয়া  প্রেমিকার  ঠোঁটে  ঠোঁট  রাখে ।
-সে  ঠোঁট নিশ্চই  কাঁপে ।  জীবনের প্রথম  চুমুটাও অনেকে  ঠিক করে  দিতে  পারেনা ।  চুমু  দিতে  গিয়ে  কামড় 
হয়ে যায় !
দিবাকরের  ফর্সা মুখ লাল  হয়ে  গেল  ।  কুড়ি  আগের    যুবক  ,তার  প্রথম  চুমু  ব্যর্থতার জন্য  আজো লজ্জিত ; মেয়েটির  বয়স  এখন  চল্লিশ , পাশে  বসে আছে  , সে  ভুলতে  পারেনি  ।  কোন মেয়েই  হয়ত প্রথম  ভালোবাসার  চুম্বনের  স্মৃতি   ভুলতে পারেনা  । 
-তুমি সত্যি , এখানেই  এইসব বলতে হত !
দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বনিতা   শব্দ  করে  হেসে  উঠল । এতক্ষণ  এমন  এক  বিস্ফোরণের জন্যই  সময় অপেক্ষা  করে  ছিল ।   থুতনিতে  হাত রেখে  বলল -  নদের  চাঁদ  নিমাই আমার । লজ্জা  করছে না ?  এদিকে  একা  পেলেতো  নির্লজ্জের  মতন  সারা  মুখ  কামড়ে  দাও ।
বলেই  আবার  হাসতে  শুরু  করল । 

গাড়ি  সেক্টর  ফাইভে  ঢুকে  পড়েছে ।  নিক্কোপার্ক কাছেই  ,  ছোট্ট  গলি । সেখান  থেকে  ঢুকছে । একটা  তিনতলা  রিসর্টের   সামনে  এসে  থামল ।  গাড়ি  থেকে  নেমেই  দিবাকর  ট্রলি  ব্যাগটা  হাতে  নিয়ে  , ড্রাইভারকে  টাকা  দিতে  গেলেই  বনিতা  বলল – এই  ফেয়ারটা  আমিই  দেব । সারাদিনের  দায়িত্ব তোমার । 
দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল -  সোনা , প্লিজ   ইগোতে  নিও না।  এমন কথাই  ছিল  । 
-ঠিকাছে । মনে থাকে  যেনও । তা ফ্রেশ  হয়ে  নাও  । তারপর  গল্প করা যাবে ।
বনিতা  তাকিয়ে  রয়েছে , তারপর নরম আঙুল  চালিয়ে   দিবাকরের   এলোমেলো  ঘাড়ের  কাছে   লুটিয়ে পড়া  চুল ঠিক  করে  বলল – আজ  অফিস  থেকে  ছুটি । আমি ছাড়বনা ।  কিছুতেই না। 
-কিন্তু ?
-দিবা  , আবার  সেই  কবে  দেখা  হবে  ঠিক  নেই  ।  আজ  গোটা  দিন   আমার সাথে  থাকো ।  এখানে  এসেছি  শুধু  তোমার সাথে   কিছু সময়  কাটাবো  বলে । একদিন  আমাকে সময়  দিতে  পারবে না ?
-তা নয় । কোম্পানি  একটা  বড় প্রোজেক্ট  পেয়েছে । দিন-রাত  আমরা  স্টাফেরা  চেষ্টা  করে  চলেছি । অন্তত  এক ঘণ্টার জন্য  , আমাকে  ছাড়ও  ডার্লিং । তারপর  কথা  দিচ্ছি  লাঞ্চের  পর বিছানায়  তোমাকে  পুষিয়ে  দেব ।

দিবাকর ভীষণ  দুষ্টু ।    কলেজের  দিন গুলোতে  সে  এর থেকেও  বেশি  বেয়াদপ  ছিল  । অসভ্য  ছিল  । বর্বর  ছিল। এমন  হয়েছে , বৃষ্টির  দিনে  ; মেঘলা  আকাশের  নীচে  সকলেই  আকাশ  ভাঙা  বৃষ্টির  ভয়ে  আশ্রয়  খুঁজতে  ব্যস্ত । ক্যান্টিনের  পিছনে  ,  ফাঁকা  জায়গা দেখে  ---  দিবাকর  দ্রুত  চুমু  খেয়ে  নেয়  ! বনিতা  কিছু  বুঝে  উঠবার  আগেই  টের পায়  থুতু  মেখে  গিয়েছে  !ঠোঁট  মুছে  বলেছিল  - অসভ্য ।
  দিবাকর  চুমু  খায় না  , দিবাকর   ঠোঁটে  ঠোঁট  রেখে  চোষে । 
পুরানো    দৃশ্য  ভাসতেই  লজ্জা  পেয়ে  গেল  ।  দিবাকর  বলল – অনেক হয়েছে । রুমে খাবার আসবে  ? নাকি গিয়ে  খাবে ?
বনিতা হাসল । বলল – রুমেই ।
                                                           
                            ৩


হোম  ডেলিভারির   খাবার ভর্তি  বাক্স  গুলো কাঁচের  টেবিলের  উপর রয়েছে ।  পাশের বিছানায়  ওরা  শুয়ে  আছে । দুজনেই  নগ্ন । নরম  সাদা  বিছানার  উপর   দুই  পুরুষ  আর নারী  শুয়ে  রয়েছে । ঘড়িতে  দুপুর  তিনটে । বিছানার পাশে বিয়ারের  বোতল ।
বনিতা  চিত হয়ে  শুয়েছে   । দিবাকর  তার  বুকের  উপর  উপুড়  হয়ে  স্তনের   খাঁজে  নাক ঘষছিল । কিছুক্ষণ আগে  জিভ দিয়ে  স্তনবৃন্ত  ভিজিয়ে  দিয়েছিল ।  বনিতা হাত দিয়ে  মাথার চুল  টানছে ।  ঠোঁটে ঠোঁট  ছোঁয়ালো ।
-বনি , তুমি এখনো  সেই আগের  মতন  আছো !
-তুমিও ।  অথচ আমরা  আর সেই আগের সময়ে  নেই ।
-তোমার জন্য খারাপ লাগছে ।
কিছুক্ষণ  বনিতা দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – যা  হয়েছে , তা  ভুলে যাও । আমিও  গিয়েছি  । জীবনে  সবাই  সব  কিছু পায়না । সব  কিছু  পেলে,   না  পাওয়ার আক্ষেপই  থাকবেনা    । জীবনকে  রোমাঞ্চকর  রাখবার  জন্য  এই  না-পাওয়া গুলোই অনুঘটকের  কাজ  করে । দিবা , আমরা দু’জনেই  যখন  এই  এতটুকু পাওয়া নিয়ে  বেঁচে  রয়েছি , কেন  আমাদের ব্যর্থতাকে   স্বীকার করব ?
-আমার বাড়ির লোক তোমাকে  মেনে নেবে না । তাই  বিয়ে  করলাম  না । আমি জানি , তুমি  বলবে  আমাদের  কিছু  করবার  ছিল  না । সত্যিই  ছিল না ? নাকি আমি কাপুরুষের মতন  পালিয়ে  গেলাম !
-পালিয়ে  কেন যাবে ? বিশ্বাস করো  আমি  বিয়ে  করিনি  , তাতে আমার  বিন্দুমাত্র  দুঃখ নেই  । এটা আমার  নিজের  ইচ্ছা । তোমার পরিবারের দায়িত্ব  তুমি  নিয়েছো  । আমি জানি  তুমি  দায়িত্ব   থেকে  পালিয়ে  যাওয়ার মানুষ  নও ।
দিবাকর পাশ  ফিরে  শুয়ে  পড়ল ।  দু’জনের  শরীর  এই  অনন্ত  তৃপ্তিতে  ভরে  গিয়েছে । বনিতা গভীর নিঃশ্বাস   নিল ।  ঘড়িতে  চারটে কুড়ি । বন্ধ কাঁচের জানালার  ওই পাড়ে  সোনালী আলোর  বিকেল ।  সবাই  যেন অপেক্ষমান  দর্শক , সুযোগ  দিলেই  ওদের জড়িয়ে  ধরবে ।
দিবাকর  বিছানা থেকে  নেমে  ট্রউজার  পড়ে  নিল । বনিতা  পাতলা  নাইটি পড়ে  নিয়েছে ।


 ঘরের  দরজা খুলে  বারান্দায়  এসে  , সিগারেট  ধরিয়ে  দিবাকর বলল -   চারপাশে  বিকেলের সুর ছড়িয়ে পড়ছে । পাখিরা সুর  করে  গেয়ে  চলেছে । এদের   মনে  আমাদের  মতন  এতো জটিলতা  নেই ।
পিছনে  দাঁড়িয়ে  বনিতা  শুনছিল । কাঁধে হাত রেখে  বলল – মানুষ  এতো  স্বাধীন নয় । তাকে  অনেক  হিসেব  কষতে হয় , বুঝলে  ?
মাথাটা  দিবাকরের  কাঁধে  ছুঁইয়ে  বলল -  এই পাঁচ  বছর  আমরা এখানে  দেখা  করছি ।  তোমার  বাড়ির লোক  জানেনা । তুমি  ভীতু নও ।  দেখো   যারা অন্যকে   কষ্ট  দিতে  পারেনা , তাই  নিজের  কষ্ট বুকে  লুকিয়ে  রাখে  -- তাদের  দুর্বল  ভাবা  ঠিক নয় । দায়িত্ব জ্ঞানহীন কাপুরুষ  ভেবে নেওয়াটাও  ঠিক  নয় । 
-আমাকে সান্ত্বনা   দিচ্ছো  ? 
-না । আমি  বলছি , আমাকে  ভালবাসছো এটাই অনেক । বিয়ে  হলে  আমরা  এক সাথে  থাকতে  পারতাম।
-ভালোবাসার  মর্যাদা  পেতাম ।
দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – তারমানে  , আমাদের  প্রেমের  স্বীকৃতি  দেবে  চারপাশের  মানুষজন  ! এই প্রেম আমাদের   কাছে  ততটা  গুরুত্বপূর্ণ  নয় , যতটা  সমাজের  কাছে  ?
-আমি  বলিনি । তবে  তোমার  জীবনে  আমার পাশে  দাঁড়ানো দরকার  ছিল  ।
-মানে  ?  দিবাকর  আমাদের  মেয়েদের  এতটাই  অসহায়  ভাবো ?  বিয়ে  করলেই  পাশে  দাঁড়ানো  হবে  । সারাজীবন  শুধুমাত্র  পরস্পরকে  ভালবেসে   পথ চলা  যাবে  না ! তোমার  নিজের  আলাদা  পরিবার  আছে  । জানি সেখানেও  তোমার  দায়বদ্ধতা  রয়েছে ।  তুমি  নিজের বিবাহিতা  স্ত্রীকে  নিয়ে  থাকতেই পারো । আমি আসব না ।
-আমার থেকে  তুমি আলাদা হতে পারবে  ? এত দিন চেষ্টা করেছি । ভুলতে পারিনি । তুমিও পারনি । আমি জানি , তুমি সব কিছু  ছাড়তে  চেয়েছিলে । আমিই  পারলাম না !
-দেখো  আমি জানি , তুমি আমাকে সম্মান করো । একজন  ভালোবাসার  মানুষ  এই সম্মানটুকুই  চায় তার কাছের জনের  থেকে ।
-তুমি  বলতে পারলে । খুব সহজেই বললে । শুধু আমি জানি , প্রতিদিন  আমার ভিতরে ঝড় উঠছে । ভিতরটা তোলপাড় করে , লণ্ডভণ্ড করে  দিচ্ছে  আমার  নৈতিক যন্ত্রণা ।
-আমার ভালবাসনা  ? তাই হয়ত , আমার ভালোবাসা তোমাকে  শান্ত করতে পাচ্ছে  না ।

দিবাকর দেখল , মেয়েটার চোখে  চাপা  যন্ত্রণা ।



বাইরে  বিকেল  ফুরিয়েছে । সন্ধ্যার  আলো  আকাশের  বুকে  মেখে   রয়েছে  এখনো ; এই  রঙ একেবারে  নিজের  ।  বনিতার  বুকে  চাপা  কষ্ট  হচ্ছে  । খুব কাঁদতে ইচ্ছা  করছে ।  দিবাকর  দেখল ,  দুচোখ  ভরা প্রতীক্ষা ; এখনই হয়ত চোখের জল  নেমে  আসবে  ! দিবাকর  , নরম  ফোলা গালে হাত দিয়ে  বলল – তোমাকে  ভালোবাসতে   না পারলে  এমন  ভাবে  ছুটে  আসতাম  সোনা ?
বনিতা আলতো করে  দিবকরের  বুকে  মাথা  রেখে  বলল – ভিতরে  চলো ...পাখিরা বাসায় ফিরছে ।
চোখ  দুটো  অভিমানী মেয়ের  মতন । বোঝাই যায়না , এই মহিলা  অনেক  পুরুষেরই  কাঙ্ক্ষিত । 




                             ৪

 রাত  দশটা  বাজতে  দশ  মিনিট বাকী । বিছানায়  দিবাকরের  বুকের  উপর  মাথা  রেখে  শুয়ে  ছিল বনিতা । আজ ওদের  বাইরে  ঘুরবার  পরিকল্পনা  ছিল  , ভেস্তে  গেল  ।  বনিতাই  বলল , বাইরে  গিয়ে সময় নষ্ট করতে  হবেনা। এই  যে  নিবিড় হয়ে , দু’জনেই  বুকে  বুক  ঠেকিয়ে , দিবাকরের  বুকে  মুখ  রেখে  শুয়ে  রয়েছে ; এক মুহূর্ত  তৈরি    হয় । অনেক  মানুষ গোটা জীবনে  এমন  অনুভূতির  জন্য  অপেক্ষা  করে  থাকে  !

বনিতা  চেয়ারে  বসে , সিগারেট  ধরিয়ে  পা  বিছানার  উপর  দিয়ে  লম্বা  নিঃশ্বাস  ছেড়ে বলল -  তুমি টাকাটা  চেকে  না  ক্যাশে  নেবে  ?
উল্টো  দিকে  পুরুষটি , যাকে  এতক্ষণ  দিবাকর  বলছিল  সে  জুতোর  ফিতে  লাগিয়ে  বলল – ম্যাডাম  চেকেই  দিন । 
- তিরিশ  হাজার  চেকে  , আর  এক্সট্রা  তিরিশ  ক্যাশে  দিচ্ছি  । 

ছেলেটি  বলল – অতিরিক্ত  কেন ?
-আজ  তুমি  আমাকেই  সময়  দিয়েছো । দেখো  ডিয়ার  রাত  বারোটা  হয়েছে  । তোমাকে   দশটা পর্যন্ত থাকবার   জন্যই হায়ার  করা  হয়েছিল ।
 ছেলেটি মনে – মনে  বলল – এমনিতেও  এই ক্লাইন্টের   সাথে  থাকবার  সময়  , মানসিক চাপ এতটাই  থাকে  যে  নতুন  খরিদ্দারের  প্রতি  মনোযোগ  দিতে  পারেনা । তাই  সে   আর  কোন খরিদ্দারের কাছে  যায়  না । 
তার  কাজ   টাকার  বিনিময়ে  যৌন আনন্দ  দেওয়া । যারা  তাকে  টাকা  দিয়ে  ভাড়া করেন , অনেক  সময়ই মুডের উপর  নির্ভর করতে  হয় ।  যৌন  আনন্দের  সাথে  মানসিক  আনন্দ দিতে  হয় । প্রথম  যখন  বনিতার সাথে  কথা   হয় ,আর পাঁচজন   খরিদ্দারের মতনই  ভেবেছিল । বনিতা  এক অদ্ভুত  শর্ত রাখে  ।  অবশ্য এরজন্য সে  অতিরিক্ত  পারিশ্রমিক পাবে । ব্যাপারটা হচ্ছে  অনিমেশকে  অন্য একটি  চরিত্রে অভিনয়  করতে  হবে  ।  শুধু অভিনয় করলেই  হবেনা , বনিতা বর্মণকে  বিশ্বাস করাতে  হবে  । আজথেকে  পাঁচ  বছর  আগে  বনিতার  সাথে  অনিমেশের  পরিচয় ।
এই পাঁচবছর ধরে  এই  বিশেষ  দিনটিতেই  দিবাকরের  চরিত্রে  অভিনয়  করে  অনিমেশ । দিবাকরের  মুখ দিয়ে  যে কথা  গুলো  বলতে হয় , তা  বনিতার  লেখা  চিত্রনাট্য । পাঁচ  বছর  একই  চিত্রনাট্য বলতে –বলতে , অনিমেশ  বুঝতে পেরেছে , সে  নর্তক  না  হয়ে  অভিনেতা  হতে  পারত ।
পাঁচ  বছরে  সে  বনিতাকে  জিজ্ঞেস  করতে পারেনি ,  দিবাকর  চরিত্রের  পিছনের  রহস্য । কেনই বা  এই  বিশেষ  দিনেই  দিবাকর  ফিরে আসে  ? আজ ঠিক  করে  নিল  জিজ্ঞেস  করবেই ।  যদিও খরিদ্দারকে  কোন কিছুই  ব্যক্তিগত  কথা জিজ্ঞেস করা  যায় না , তাও আজ  একটু  সাহস  নিয়ে  অনিমেশ  বলেই ফেলল ...



বনিতা  চোখ  বন্ধ  করে , সিগারেটের   শেষ  ধোঁয়া  ছেড়ে  বলল – তাহলে  নাছোড় বান্দা ? আমি আমার দুঃখ   অন্যজনের কাছে  ভাগ  করতে  রাজী  নই । তুমি  টাকার জন্য  আমাকে  সঙ্গ  দিয়েছো । তাও আমি  তোমাকে  আজ  বলব । তুমি  একদিনের  জন্য  হলেও  দিবাকর । আমার দিবাকর । আমি  তোমার ঠোঁট ,  বুক  , ঘামের  গন্ধে ... আমার পাঁচ  বছর  আগের  দিবাকরকে  খুঁজে  পেয়েছি ।
-দিবাকর কে ?
-আমার  কলেজ প্রেম । বলতে পারো প্রথম আর শেষ প্রেম । আমাদের  বিয়ে  হয়নি ।  আমরা আজও                প্রেমিক –প্রেমিকা। কলেজে  প্রথম  দেখা । যা অভিনয় করেছো , সব  সত্যি । আমার লেখা  চিত্রনাট্যে  মনগড়া সংলাপ  লেখা নেই  ।  সবটাই জীবন থেকে  নেওয়া ।
-আপনারা  যখন  পরস্পরকে  এতো ভালোবাসতেন বিয়ে  করলেন না !
-না। দিবাকরের  বাড়ির লোক  আমাকে  মেনে  নিতে  চায়নি । আমি বাড়ি থেকে  ওকে  আলাদা  করতে  চাইনি । দিবাকর  না  চাইলেও ,  আমার চাপেই  বাড়ির কথায়  বিয়ে  করতে হল ।
অনিমেশ বলল – তার মানে  আপনি একা , আর দিবাকর বাবু  এখন  নিজের  বউ  সংসার  নিয়ে  আনন্দে  রয়েছেন । আপনি এখনো  তাঁর প্রেমে   ডুবে রয়েছেন !
বনিতার  দু’চোখ  জলে  ভেজা । নাক টানল । অনিমেশ  দেখছিল ।  মেয়েটাকে  কেন জানি আদর করতে ইচ্ছা  করছে । দিবাকরের ঠোঁট  দিয়ে  নয় ,  অনিমেশ হয়ে । 
বনিতা  বলল – অনিমেশ , তোমার  সাথে  প্রথম  যেই  বছর  দেখা  করলাম । তার একবছর  আগেই  দিবাকর  আত্মহত্যা  করেছিল ।

কথাটা  শুনেই ,  অনিমেশ  চমকে  উঠল । গল্প আচমকাই  গতিপথ  পাল্টেছে !
বনিতা  চোখ মুছে  বলল – আমার  কথায়  বিয়ে  করলেও , নিজেকে  ঠকাতে  পারেনি  । আত্মহত্যা করবার  আগের দিন আমরা এই  রুমেই  ছিলাম ।  এগারোটা পর্যন্ত । যাওয়ার  আগে  আমাকে  একটা  চিঠি  দিয়ে  গেল  ।   বলেছিল  সে  চলে গেলে  , আমি যেন চিঠিটা পড়ি । 
-আপনি  পড়েছিলেন ?
-সেই রাতে  পড়া  হয়নি ।  পড়ের  দিন আমাদের  কাছের  বন্ধুদের  থেকেই  খবরটা পেলাম  , দিবাকর   বাড়িতেই  ঘুমের  ওষুধ খেয়েছে । ডাক্তার  চেষ্টা করেও  বাঁচাতে পারল  না।
কথা  থামিয়ে  , জল ঢালল  গলায় । আবার  বলতে  শুরু  করল – চিঠি খুলে  দেখলাম , দিবাকর  নিজেকে  ঠকানোর যন্ত্রণা  মেনে  নিতে  পাচ্ছিল না  । নিজেকে  কাপুরুষ  আর  দায়িত্বহীন  ভাবছিল ।এই  পৃথিবী  থেকে  নিজেকে  সরিয়ে  দেবে  । তার  এই  অবস্থার  জন্য  দিবাকরের  চোখে  আমিই  দায়ি ।
অনিমেশ দেখল , বনিতা  বাচ্চা  মেয়ের  মতন  ফুঁপিয়ে কাঁদতে  শুরু  করেছে ।  বনিতা  বলল – সেই  দিন  থেকে  ঠিক করলাম  আমি  নিজেই  নিজেকে   ঠকাবো । দিবাকর  চিঠিতে  লিখেছিল  ----   সাহস  থাকলে  অন্য  মানুষ কে  দিবাকর  ভেবে  ভালবেসে  দেখব । সত্যিই আমি পারিনি । ঠিক করলাম  একদিন  , ওর মৃত্যু দিনে  নিজেকে  ঠকাবই ।  দেখব , দিবাকর  প্রতিদিন  নিজের কাছে  নিজে  ঠকে  যে  যন্ত্রণা পেয়েছে , তার  প্রায়শ্চিত্ত আমি  আমার  যন্ত্রণা  দিয়ে  করতে  পারি  । অনিমেশ  দিবাকরের  শেষ  চিঠিতে উল্লেখ  করা কথা কে  মাথায় রেখেই  আমার এই  নাটকের  চিত্রনাট্য । বিশ্বাস করো অনমেশ , আমি  দিবাকরকে  ভালো  দেখতে  চেয়েছিলাম ।

বনিতা  কাঁদছে ।  মুখে  দু’হাত দিয়ে  ফুঁপিয়ে –ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।
অনিমেশ  ভাবছিল , পাখির  দেহ থেকে   যে   পালক  ছিঁড়ে যায় , তা সারা  জীবন উড়ে  চলে  । পাখির কাছে  ফিরে  আসেনা । অনিমেশ  চাইলেও  দিবাকর  হতে পারবেনা ।  বনিতা  নিজেকে  ঠকিয়েও , ছেঁড়া পালকের  ঠিকানা খুঁজে  পাবেনা............