কুকুর ও মানুষের গল্প
কেবিন থেকে বেরিয়ে , নার্সিং হোমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুচোখ ভিজে গেল অব্যয়ার । রেলিং –এ হাত রেখে সে নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে । এই মুহূর্তে ভিতরে ভয়ংকর ঝড় বইছে , সব কিছু উল্টো –পাল্টা করে দেবে ! নিজেকে থামাতে হবে । সে জানে এই সময়টুকু নিজের সাথে লড়তে পাচ্ছে না , গোটা রাত তার জন্য অপেক্ষা করছে । শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনের ভিতর , নার্সিংহোমের বিছানায় যে লোকটি শুয়ে রয়েছে , তার সারা শরীর ব্যান্ডেজ , চ্যানেল , নলে বিদ্ধ । হুঁশ এখনো ফেরেনি । সে জানতেও পারবেনা অব্যয়ার যন্ত্রণার গভীরতা ।
দু’ চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা । আঙুল দিয়ে মুছল । নিজেকে শক্ত করতেই হবে । সে নিজের মনে নিজে বলল - এতো ভেঙে পরলে চলবে না । প্রতিদিন কত মানুষের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটছে । তাদের অনেকেই আর সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেনা ; সংসারের শেষ আর্থিক সম্বলটুকু চলে যায় !
অব্যয়াই নিজেকে সামলে নিচ্ছে । এখন ওর অনেক কাজ । ভিতরে কেবিনে ভাঙাচোরা দেহ নিয়ে , খাদ্যবহনকারী নলে বিদ্ধ -- যে মানুষটা , জীবন –মৃত্যু নিয়ে লড়ছে ; সেই মানুষটা জানতেও পারছে না -- তার কেবিনের বাইরেও যুদ্ধের আঁচ এসেছে ! দু’জন মানুষ এখন পরিস্থিতিগত ভাবে আলাদা অথচ তাদের ভিতরকার লড়াই একই কেন্দ্রে , আবার এই লড়াইয়ের শেষে জীবনের গতিবিধিও একই ভাবে ঘুরবে ।
পিছনে বছর চল্লিশের একজন লোক এসে দাঁড়ালো । বলল – মিসেস শুক্লা , ফিরবেন তো ?
অব্যয়া মাথা তুলে দেখল , নিবেদিতার স্বামী ! এখন আর অলকেশ বাবুকে দেখলে বিরক্তি লাগেনা , এই নার্সিংহোমেই নিবেদিতা ভর্তি রয়েছে । হয়ত কাছাকাছি কেবিন আছে । অলকেশ দেখতে পেয়েছে , তাই কথা বলতে এসেছে । এখন মনের অবস্থা এতটাই এলোমেলো , কথা বলতে মন চাইছে না । তাও নিজেকে জোর করেই কিছুটা একঘেয়ে পরিবেশ থেকে পালানোর তাগিদ নিয়েই , অব্যয়া বলল – অলকেশ , নিবেদিতা কেমন আছে ?
নিবেদিতাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ঘাঁটাঘাঁটি করবার ইচ্ছা তার নেই । এই বিষয়টা নিয়ে আর ভাবতেও মন চাইছে না । অব্যয়া বলল – ওকে নিয়ে বিজি রয়েছি , একদিনও দেখা করতে পারিনি । খুব লজ্জিত ।
-লজ্জার কিছু নেই । এতবড় একটা অ্যাক্সিডেন্টের সব ঝামেলা আপনাকেই সামলাতে হচ্ছে । এখানে আপনাকে সাহায্য করবার মতন তেমন কেউ নেই । অফিস আর বাড়ি সবটাই আপনি সামলাচ্ছেন । আমি বুঝি , মিসেস শুক্লা । ও দুঃখিত অভ্যাসবশত আপনাকে শুক্লা সারনেমে ডাকছি ।
-ভুল কোথায় ? বিয়ের পরে মেয়েরা শ্বশুর বাড়ির পদবী ব্যবহার করে ।
-সে ঠিকাছে । কিন্তু আমি জানি , আপনি বিবেক বাবুকে ডিভোর্স দেবেন ।
কিছুক্ষণ চুপ থাকল । অব্যয়ার হাতে যে রুমাল আছে , কপালের ঘাম মুছল । বলল – দেখুন অলকেশ আপনি আমার থেকে এই ব্যাপারে এতো শিওর কেমন ভাবে জানিনা ! দেখুন কিছু মনে করবেন না , এই নার্সিংহোমে আমিই বিবেকের স্ত্রী । ভর্তির সময়ে যে ফর্ম ফিলাপ করেছি , স্ত্রী হিসেবে আমার নামই উল্লেখ করা আছে । এখন ডিভোর্স নিয়ে ভাবছি না । ওকে সুস্থ করে তুলতে হবে । যত দ্রুত সম্ভব । তারপর না হয় ভাবা যাবে ...
-আপনি ভুল বুঝলেন । দেখুন আপনাদের ডিভোর্স পেপারে কিন্তু বিবেক বাবুর সই আছে । আর ঘটনার দিন বিবেক শুক্লা এই নিয়ে খুব উল্লাসিত ছিলেন ।
অব্যয়ার গলা শুকিয়ে আসছে । খুব কাঁদতে চাইছে । বুকের ভিতর কষ্টের গোলা আটকে আছে , দমবন্ধ হয়ে আসছে । বিবেক তাকে যে অপমান করেছে তার থেকেও , পুরুষের কাছে সকল ভারতীয় নারীর ব্যবহার এমনই ! সংবাদপত্রে এত খবর ছাপা হয় , এত নারীর প্রতি বঞ্চনার কথা বলা হচ্ছে --- সব কিছু সত্যি বলে মন মানতে চায়না । অথচ নিজের জীবন থেকে বুঝতে পারছে , ভারতীয় সংস্কৃতি নারীকে দেবী রূপে পুজো করলেও , মানুষ ভেবে সম্মান দেয়না ! সে এতটাই অবজ্ঞার পাত্র ? নাকি সিংহভাগ পুরুষই ডিভোর্সের সই করে তার সঙ্গিনীকে বলতে ভুলে যায় , বদলে মদ্যপানের আসরে বুঁদ হয়ে থাকে । সে ঝগড়া চায়নি । খোরপোষ দাবি করেনি । বিবেকের কাছ থেকে একফোঁটা সম্মান চেয়েছিল ।
এই ছোট্ট শব্দটা সামান্য , উচ্চারণ করতে খুব অল্প সময় নষ্ট হয় ; অথচ অনেকের পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায় সামান্য শব্দটার বাস্তব অনুভূতির জন্য । অব্যয়া তেমনই কাঙাল । বিবেক তাকে কম কষ্ট দেয়নি , তাই নতুন করে এমন ব্যবহার খুব একটা যন্ত্রণা দিচ্ছে না । অলকেশের মুখের ভাবে নিজেকে অপমানিত মনে হচ্ছে । চোখ ফেটে যাবে দুঃখে , একফোঁটা জল গড়াবে না ; কেননা সে জানে তার চোখের জল অসহায় নারীর দুর্বলতাই প্রমাণ করবে । এই কয়েকদিনে , সে বুঝে গিয়েছে বিবেকের সাথে রাগারাগি করে নতুন চাকরিতে নিয়ে সে সেই সব মানুষদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে , যারা নারীদের এই সময়েও আর্থিক ভাবে দুর্বল দেখতে চায় । অলকেশ যেমনই হোক , সেই দলের সার্থক প্রতিনিধি --- এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ।
মুখ তুলে অব্যয়া বলল - আপনি এখন ফিরছেন ?
ঘাড় নামিয়ে অলকেশ বাঁ –হাতে ঝুলে থাকা ঘড়িতে দেখল , বিকেল ছটা ।
-হ্যাঁ , রাতে আর আসবনা আয়া আছে । ডাক্তাররা বলল , এখন অবস্থা ঠিকাছে । আগের থেকে অনেকটাই ভালো । তাই ভাবছিলাম সাতদিন ভালোই টেনশনে কাটল ।
অব্যয়া ভাবল , আজকে অলকেশের সাথে কথা বলে বিবেকের আগামী দিনের পরিকল্পনার জানবে । বিবেক নিজের মুখে কিছু বলেনি । তারা ঠিক করেছে আলাদাই থাকবে । বিবাহ বিচ্ছেদ ফাইল করে । দীর্ঘ সময় বাদে , দু’পক্ষকেই কাগজ পাঠানো হয় । বিবেক আগেই সই করেছে । অব্যয়া স্বাক্ষর করেনি । এখন উল্টোটা ভাবছে । বিবেকের দুর্ঘটনা যখন ঘটল , তার অবস্থা দেখে সে সই করবার কথা ভুলে যায় । এখন সব কিছু তাকেই করতে হবে । বিবেকের দুই ভাই এই ঝামেলা নেবে না বলেছে । বৃদ্ধ মা অপারগ । তাই স্ত্রী হয়ে আইনি ভাবেই সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিয়েছে ।
এইসব কথা ভাবতেই চখ চোখ জলে ভরেছে । খেয়াল করল , অলকেশ বলল – চলুন , ক্যান্টিনে গিয়ে কফি নিতে -নিতে কথা বলা যাবে । এমনিতে বাড়িতে ফিরতে ভালো লাগছে না । নিবেদিতার ফাঁকা ঘরটা দেখলেই , বুক টনটন করে ওঠে ।
সন্ধ্যা ছটায় ওরা , নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেতে ঢুকল । মুখোমুখি বসে রয়েছে । অলকেশ কফি আর হাল্কা স্নাক্সের অর্ডার দিল ।
শুরু প্রথমে অলকেশ করল । - আপনার প্ল্যান কী ?
অব্যয়া বলল - জীবনটা বড্ড ভঙ্গুর । প্রতি সময়ে যে কোন স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে । এখন আর পরিকল্পনা করিনা । জীবনকে নিজের মতনই দেখতে শিখছি । ভালোই লাগছে । আগে থেকে প্ল্যান করে লাভ আছে বলে মনে হয়না ।জীবনে যা হবে --- তা হবেই । তাকে হতে দেওয়া বা না- দেওয়া , আমাদের হাতে নেই। তবে সেই হওয়াটা হয়ে যাওয়ার পর , নিজেকে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলাটাই জীবনের সংগ্রাম । লড়াই ।
-আপনি দেখছি , জীবন নিয়ে অনেক অভিজ্ঞ ।
-আগে ছিলাম না । এখন হয়েছি । অভিজ্ঞতা কম হলনা । পঁয়ত্রিশ বছর বয়স ।
-আপনি চাকরি করছেন , আপনার চারপাশের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি । বিবেক বাবু নিজেও চাইতেন না।
-বিবেকের চাওয়াটা আমার কাছে ইদানীং কোন গুরুত্ব হারিয়েছে । সত্যি বলতে আজ আমি শুধু মাত্র নিজেকেই গুরুত্ব দিচ্ছি । আর দিয়ে যাব । অন্যের বোঝা হতে চাইনা । আর এর জন্যই নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা কে ব্যবহার করছি । আমি চাইনি আর্থিক দিক দিয়ে বিবেকের উপর নির্ভর করতে ।
-আমি জানি । এতটুকু বুঝি , আপনি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেবেন না । আর আপনি বিবেকের বিশ্বাস ভাঙবেন না ।
-আমি এতকিছু বুঝিনা । জীবনে এখন যেই সিদ্ধান্তে আমি এসেছি , সেখান থেকে ফিরে যাব না । কিছুর বিনিময়েও নয় ।
অলকেশ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল – বিবেক আর নিবেদিতা একসাথে থাকবে । যদিও আপাতত তাদের সুস্থতার উপর নির্ভর করছে । আমি নিবেদিতাকে ছেড়ে দেব । আমাদের ডিভোর্স শুধুই আমার সম্মতির জন্য আটকে ছিল । আমি সই করে দিয়েছি ।
অব্যয়া তাকিয়ে রয়েছে । অলকেশ একদিন সকালে নিজে এসে , বিবেককে শাসিয়ে গিয়েছিল । বউয়ের সাথে অন্য পুরুষের সম্পর্ক মেনে নেবে না । বিবেকের কথা সেই দিন অব্যয়া সরল ভাবে বিশ্বাস নিয়েছিল । মেয়েরা যাকে ভালোবেসে ফেলে , তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে । ভারতীয় মহিলাদের এই চারিত্রিক দুর্বলতা (বিশ্বাস করাটা যদি নিজের ক্ষতি করে )তাদের পুরুষেরা ভালোভাবে অপব্যবহার করে । বিবেকের মতন পুরুষরা তাই নির্ভাবনায় নিজের প্রেম চালিয়ে গিয়েছে । একজন মানুষ জীবনে একাধিক মানুষকে ভালবাসতেই পারে ,এই ভালোবাসাকে পরকীয়া বলা যায় না ; তা যখন মিথ্যার আশ্রয় নিতে থাকে -- তখনই পরকীয়া হয়ে ওঠে । বিবেক আর নিবেদিতার সম্পর্ক ক্রমশই তেমনই দিকে এগিয়েছে । তখনো অলকেশ সব কিছু জেনেও নিজের স্ত্রীর প্রতি শক্ত হতে পারেনি । আর অব্যয়ি ভেবেছে এইবার তার সব কিছু না মেনে প্রতিবাদ করবার কথা । বিবেক অন্য নারীর প্রতি নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়েছে , তার ভাগে কিছুই নেই । অনেক রাতে বাড়ি ফেরা , দীর্ঘ সময় ধরে বিবেকের অবহেলা --- সবকিছু মেনে নিয়েও বাড়িতে থেকেছে অব্যয়ি ! কেন ? সবটাই চারপাশের লোকনিন্দার জন্য ? ভারতে বিবাহিত মহিলাদের স্বামীর ঘরে অত্যাচারিত হওয়া তেমন একটা আলোড়িত ঘটনা নয় , যতটা বিবাহ বিচ্ছেদ নেওয়া । লাথি খাও , বিষ খাও , খিস্তি খাও --- তাও স্বামীর ঘরে খাও । স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা মানেই , সে অন্য পুরুষের ভোগের বস্তু ; তাকে সমাজের বাকী পুরুষেরা নিজের চাহিদায় ব্যবহার করবে । তাই হয়ত অব্যয়া বিবাহ বিচ্ছেদ এড়িয়ে থাকতে চেয়েছে ।
চোখ ভিজে গিয়েছে । চোখের পলকে অতীতের স্মৃতি ভীড় করছে -- বিবেকের জ্বর ছিল , সারারাত সে নিজে না ঘুমিয়ে মাথায় ভেজা কাপড় দিয়েছিল । এইসব ন্যাকামো বড্ড সেকেলে , একদিন ঝগড়ায় বিবেকে বলেও ছিল।
অব্যয়ির গলা ভারি হয়ে আসছে । সে ঢোক গিলে বলল
-আপনি , নিবেদিতাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে তাকে মেনে নিতে চেয়েছিলেন । আর এখন মেয়েটার এইরকম অবস্থায় , সই করে দিলেন ! তাড়াহুড়ো করলেন মনে হল ।
অলকেশের চোখ দুটো শক্ত হয়ে এলো । - দেখুন , ভালো আমি এখনো বাসি । কিন্তু নিবেদিতার পেটে আপনার স্বামীর বাচ্চা ছিল । মানে যদিও দূর্ঘটনায় সে ভ্রূণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে । খুবই দুঃখের । আপনি আপনার স্বামীকে মাপ করে দিলেও , আমি নিবেদিতার সাথে থাকতে পারব না । সেইদিন ওরা একসাথেই গাড়ি করে আসছিল , দুজনেই মদ্যপ ছিল । দুর্ঘটনা ঘটবার পিছনে সেটাও একটা কারণ । আর নিবেদিতা কনসিভ করেছে – জেনেই ওরা হোটেলে গিয়ে সেলিব্রেট করেছিল । খুব কাছের দু’একজন ছিল । আমি তাদের একজনের থেকেই জেনেছি । এইসব কিছু জেনে , আমি নিবেদিতার স্বামী হওয়ার অভিনয় করব না । আর আমি চাইছি , কোর্ট যেনও অসুস্থতার ছুতোয় ডিভোর্স দিতে দেরী না করে ।
অব্যয়া খেয়াল করছে , চোখের কোণায় পাতলা জলের রেখা নামছে ; খুব সরু আর আপাতাত নিরীহ । এই রেখা আঙুলের তলা দিয়ে মুছে দিল । এমনটা করল , কেননা পাছে অলকেশ তাকে দুর্বল ভেবে বসে !
গলা শক্ত করে বলল - অলকেশ আপনাকে কে বলল , আমি বিবেককে মাপ করে দেব ? দেখুন আমি ডিভোর্স দেব । আর খুব তাড়াতাড়িই তা জানতে পারবেন ।
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অব্যয়ি বলল – আজ উঠি ।
অলকেশ বলল – ম্যাডাম আপনার সিদ্ধান্ত আপনার । তবে আপনি যদি ডিভোর্স দিয়েদেন তাহলে এখনই আমার নিবেদিতার হাত থেকে রেহাই পেতে সুবিধা হয় । যদিও ওদিকে কেউ কিছু এখনো বলেনি । তাও যদি নিবেদিতা কর্মক্ষমতা হারিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে । যদি বিবেক সুস্থ হয়ে ওকে ভুলে যায় বা বিবেকের অবস্থাও একই রকম থাকে , হয়ত নিবেদিতার বোঝা আমাকেই টানতে হবে । স্যরি , আমি ঠিক তেমন ভাবে বলতে চাইনি । মানে বুঝতেই পারছেন , আমার কিছু চাহিদা...
ঘাড় ঘুরিয়ে অব্যয়া বলল – থাকুক না , আমি বুঝেই গিয়েছি । এতদিন আপনি নিবেদিতাকে সহ্য করতেন কারণ ওর মোটা মাইনের বেতনের জন্য । এখন সে সব নেই যখন বোঝা বইবেন কেন ? আমার এইসব ব্যাপারে আলোচনা করতে ভালো লাগছে না । তবে এতটুকু বলব , আপনার নিবেদিতার উপর যে রাগ রয়েছে আমার বিবেকের প্রতি ঘৃণা তার থেকেও বেশি । আমি নিজের সবটুকু দিয়ে ওকে ভালবেসেছিলাম । আর বিবেকে আমাকে ঠকিয়েছে ! তাও আমি ওর সাথে জড়িয়ে আছি , শুধুই মানবিক কারণে । তবে এটাও হয়ত আর বেশি দিন নয় । আসছি ...
২
নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে , ক্যাব ভাড়া করে নিল । গাড়িটা এলগ্রিন রোডের দিকে এগিয়ে চলেছে । অব্যয়া ঘামছে । বিবেক তাকে ঠকিয়েছে , সে এই কষ্ট মেনে নিলেও নিজেকে অসহায় আর প্রতারিত ভাবতে রাজি নয় । এটা তার নিজের জীবন , এখানে সে অন্য কোন মানুষের দ্বারা চালিত হবে না । কোন ভাবেই নয় ।
নিজেকে তাও কেন ঠকাচ্ছে ? এই যে প্রতিদিন বিবেকের মিথ্যা পরিচয় নিয়ে নার্সিং হোমে যাওয়া , সব দায়িত্ব নেওয়া আবার দিনের শেষে বাড়ি ফিরে আসা সেই লোকটির প্রতি প্রবল ঘৃণা নিয়ে ! এমন ভাবে সে নিজেই ঠকছে । শেষ একমাস অনেক কিছুই ভেবেছে , অলকেশের মুখে যখন সব কিছু জানতে পারল , নিজেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিবেকের সাথে দেখতে রাজি নয় ।
গাড়িটা এসে থামল ।
অব্যয়া গাড়ি থেকে নেমে টাকা মিটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে চলেছে । আজ সে বিবেকের ফ্ল্যাটে যায়নি । এই এক কামড়ার ফ্ল্যাটটা নতুন নিয়েছে । ব্যাঙ্কের লোণ নিয়ে কিনেছে । এই একমাস সে এখান থেকেই যাতায়াত করছে নার্সিং হোমে । অফিস যাচ্ছে ।
কলিং বেল টিপতেই অম্বিকা দেবী দরজা খুললেন । তাঁকে দেখে অব্যয়ি বলল - মা , তুমি ফোন করেছিলে ? আমি কথা বলছিলাম বলে ধরতে পারিনি । অবশ্য পরে ফোন করতাম । ভাবলাম বাড়িতে এসেই না হয় বলব ।
-তুই হাতমুখ ধুয়ে আয় । আমি ভিতরের ঘরে আছি । আজ বিনয়ের বড়দিদি ফোন করেছিল । ওর মায়ের সাথেও কথা হল ।
অব্যয়ার শরীর জুড়ে ক্লান্তি । তারউপর এইসব কথা এখন শুনতে চাইছিল না । সে ইচ্ছা করেই বলল –এখন নয় ,অফিসের কাজ আছে ।
রাতে খাওয়ার পর নিজের ঘরে শুয়ে আছে । একপাশে টেবিলল্যাম্প জ্বলছে , হাল্কা আলো অব্যয়ির মুখে ম্যশ্চারাইজার ক্রীমের মতন মেখেছে । সেই দিকে তাকিয়ে অব্যয়া একটা দৃশ্য ভাবছিল ।
বছর তিরিশের এক রমণী কাঁদছে । এখন গভীর রাত । পাতা ঝরবার শব্দ শোনা যায় । চারপাশের আলো নিভে গিয়েছে । যে রমণী কাঁদছে সে কে ? অব্যয়া এইসব কিছু খুব কাছ থেকে দেখছে । এই রমণীর মুখ খুব চেনা । সে ঘোরের মধ্যে থাকে । এটা একটা স্বপ্ন , অব্যয়া এই সবপ্নে স্বপ্নে আগেও থেকেছে । তা অসম্পূর্ণ ছিল । মেয়েটা তার বয়সী । মুখ তুলে বলল - আমি হেরে গিয়েছি । তুমি কিন্তু হারবে না ।
অব্যয়া বলল – মানে ? কি হারবার কথা বলছ ? আমি যে হারতে পারি , তা কেন বললে ?
মেয়েটির দুচোখ জলে ভিজে গিয়েছে । অব্যয়া বুঝতে পেরেছে , সব মেয়েরই মুখ কষ্ট পেলে এমন হয়ে যায় । মেয়েটি কাঁদছে কেন ? এই কান্নার অন্তরালে কোন রহস্য লুকিয়েছে ! সে এই স্বপ্নকে কখনই সম্পূর্ণ দেখেনি । আজ দেখবে ?
মেয়েটি বলল – ওরা আমায় বলেছিল , আমি অন্যায়ের প্রতিকার চাইব না । এই সমাজে পুরুষকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার শুধুই পুরুষের । আমি নারী , শুধু প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি ।
অব্যয়া কিছুই বুঝতে পারল না ! এই মেয়ে যে ভাষায় কথা বলছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই পরিবেশ তার চেনা নয় ।
-তুমি অত্যাচারিত ?
-আমি নই আমরাই বঞ্চিত । আমাকে কেউ সুবিচার দিতে পারেনি । সকলেই ফিরিয়ে দিয়েছে । কথা দিয়েছে , অন্যায়ের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগ করলেই দেবী হয়ে যাব !
-দেবী !!
-সকলেই দেবীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মানুষের নয় । আমি মানুষের সম্মান পেতে চেয়েছি । তাই চোখে ঘুম নেই । সারা দেহ যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে ।
আচমকাই ঘুম ভেঙে যেতে অব্যয়া উঠে বসল । তার বুক , বোগল ঘামে ভিজে গিয়েছে । এতক্ষণ একটা স্বপ্নই দেখছিল । সে ভাবছিল এই স্বপ্নের মেয়েটিকে খুব চেনা মুখ মনে হচ্ছিল !
এখন রাত দুটো । আর তিনঘণ্টা । তারপরেই ভোরের আলো ফুটবে । পাখির কোলাহল শুরু হবে । একা , ক্লান্ত , নির্জন রাস্তার বুকে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা যাবে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেই অব্যয়ার মন চাইছে । সামনে একা –একা দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টের ম্রিয়মাণ আলোর দিকে তাকিয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে । মায়ের সাথে ঘুমাবার আগে কথা কাটাকাটি হয়েছে । বিবেকের বাড়ির লোক চাইছে , বাকী জীবনটা অব্যয়া বিবেকের দায়িত্ব নিক। কেননা বাকী জীবন বিবেকে হয়ত সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে না । অবশ্য মিরাকেল ঘটতেই পারে। আর এটা ঘটাবার সাধ্য আছে একমাত্র অব্যয়ার ---- অন্তত বিবেকের বাড়ির দিকের লোকের তাই ধারণা । বিবেকের সম্পত্তির মালিক হবে অব্যয়া ।
সে অবশ্য নিজে এটা চাইছে না । বিবেককে আপাতত সুস্থ করবে । সাথে নিজের চাকরিও চালিয়ে যাবে । অব্যয়ার মা , অম্বিকা দেবী নিজেই চাইছেন মেয়ে এই সম্পর্ক মেনে নেয় । এতে মান থাকবে কূলও থাকবে ।ভারতীয় বিবাহিত মহিলা স্বামী পরিত্যক্তা হলে , সমাজ অন্য চোখে দেখে । মেয়েদের স্বাধীনতা থেকে তাদের পরাধীন সম্ভ্রম অনেক বেশি দামী ।নির্ভরশীল আশ্রয় অনেক বেশি কাঙ্খিত ।
অব্যয়া ভাবছিল , স্বপ্নে ভাসা –ভাসা মেয়েটির করুণ মুখ আর অব্যয়ার অসহায়তা মিলে যাচ্ছে ! এই মেয়েটির সাথে তার কোন সম্পর্ক রয়েছে ? এই স্বপ্নের ভিতরের গল্পটার তার খুব জানা । হ্যাঁ , ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা । অব্যয়া ভাবছে ...
রাতের পানপাত্র থেকে গভীর নিস্তব্ধতা ক্রমশই ছড়িয়ে যাচ্ছে । একটি মেয়ে লেখার টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে হলুদ আলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছে । সাদা কাগজ নিয়ে লিখতে শুরু করল মায়ের উদ্দেশ্যে ----
এখন চারপাশ খুব শান্ত । তাই তোমাকে মনের কথা খুলে বলছি । তুমি ছোট বেলায় আমাকে একটা গল্প শুনিয়ে ছিল । পুরাণের গল্প । এক ব্রাহ্মণী কে ঠকিয়েছে তার পুরুষ । সেই পুরুষ শেষে রোগে ভুগে মারা যান । মৃত্যুর পরেই যমপুরীতে ব্রাহ্মণের বিচার চলে । অভিশাপে তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল । এদিকে ব্রাহ্মণী পত্নী নিজের উপর ঘটে চলা অন্যায়ের বিচার চাইল না। সে ভারতীয় নারী । বিবাহিতা । সে কেমন করে স্বামীকে ছাড়বে ! তার থেকে নিজেই স্বামীর পাপ মোচনের জন্য চেষ্টা করবে । কাঁদছে । তারপর নারদ তাকে যোগবলে মৃত স্বামীর চিতায় এনে হাজির করে । ব্রাহ্মণ পত্নী সহমরণ বেছে নেয় । এরপর গল্প এগিয়ে চলে । ব্রাহ্মণ অভিশপ্ত হয়ে কুকুরে পরিণত হল । একসময় সে নিজের পরিত্যাগ করা পত্নীর সতীত্বের জোরেই নিজের পাপ মোচন করে এবং শিবের খুব কাছের ভক্ত হয়ে ওঠে ! এখানেই অব্যয়ার প্রশ্ন , সে মেয়ে এমন আত্মত্যাগ করল তাঁর স্থান কোথায় ? পত্নীর প্রতি যে অবিচার হয়েছে , শাস্তি পত্নী দেয়নি , দেবতারাই দিয়েছে । সমাজ বা পুরুষের বিচার পুরুষমুখী সমাজ করবে কেন ? নারী নিজের স্বামীকে ত্যাগ দিলনা কেন ? সে কি স্বতন্ত্র জীবন বেছে নিতে ভয় পেয়েছিল ? নাকি ভারতীয় মূল্যবোধ চেয়েছে নারীদের চিরটাকাল স্বামীমুখী করে রাখতে ! সেই রমণীই স্বপ্নে এসে বলেছে , আর যেনও অব্যয়ারা পিছনে না হাঁটতে থাকে । সময় এসছে নতুন রুপকথা রূপকথা লিখবার ।
অব্যয়া মনে – মনে বলল --- বিবেকের সম্পত্তি বা সম্পর্ক --- কোনটির প্রতিই বিন্দু মাত্র মোহ নেই । আমার লোভ আমার স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রতি । এটাই আমার অস্তিত্ব । আমি হারব না। আমি জানি তোমরা আমাকে মেনে নিতে পারবে না , কেননা তোমাদের ভারতীয় মূল্যবোধে যেখানে নারী আসলে পুরুষমুখী – আমি মানতে পারব না । কেননা আমি আজকের পরিবর্তিত ভারতীয় মূল্যবোধ --- নারী স্বতন্ত্র ব্যাক্তি । তার এই দিক তোমরা মানবে না । নারী সত্ত্বা আর তোমাদের একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব নিতে গিয়ে যে টানাপোড়েন , তাতে আমি ক্লান্ত । আমার মৃত্যুর জন্য তোমরা দায়ী নও । সে দায় , ভারতীয় পুরুষ কেন্দ্রীক মূল্যবোধের ............
চিঠিটা লিখবার পর , অব্যয়া বাথরুমে গেল । এখনো মা ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি । ভোর হতে দেরী নেই । আত্মহত্যা করলে , পাশের থানা থেকে পুলিস আসবে তাড়াতাড়ি । পোস্ট মর্ডাম ক্রতেও করতেও খুব বেশি সময় নেবেনা । সন্ধ্যার মধ্যেই সব কিছু শেষ ।
অব্যয়া বাথরুম থেকে এসেই , মায়ের ঘরের দিকে গেল । সত্তর বছরের মহিলাটি ঘুমিয়ে কাদা । মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ফুটে উঠেছে । মা ধরেই নিয়েছে , মেয়ে শ্বশুর বাড়ি ফিরছে । আর স্বামী পরিত্যক্তা নয় । এই মেয়েই যখন মৃতদেহে পরিণত হবে ! অব্যয়া মুচকি হাসল ...
এইবার মরতে হবে । গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়বে । অফিসে তার কাজের খুব নাম হয়েছে । বিবেকের বাকী জীবনটা বিছানায় শুয়েই কাটবে , অব্যয়ার দয়ায় বেঁচে থাকতে কেমন লাগবে ? যারা তাকে সংসারে বাতিল নোট ভেবেছিল --- তাদের চোখে আচমকাই সে লটারি । কেননা স্বামীর আশ্রয়ে নয় , স্ত্রী নিজের আশ্রয়ে স্বামীকে বাঁচিয়ে রেখেছে ।
আচ্ছা এখন যদি না আত্মহত্যা করে , বেঁচে থাকে ! সে দেবতা হবে নিশ্চিত । এই কথাটুকু ভাবতেই অব্যয়ার খুব আনন্দ হচ্ছে ।
অব্যয়া ভাবল এই এতকিছুর বদলে নিজের চাকরি করবার জেদ সে রাখতেই পারে । আর বাকীরা তা শুনতে বাধ্য । অন্তত এই কারণের জন্য আত্মহত্যার মতন এত ছোট একটা সিদ্ধান্ত পাল্টানোই যায় ।
খুব দ্রুত গিয়ে টেবিলের উপর রাখা চিঠিটা নিজের হাতে নিয়ে নিল । খুব দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে ...
( গল্পে বর্ণিত পুরাণ ঘটনা ‘পদ্ম পুরাণ ’ - এ সম্পূর্ণ উল্লেখ রয়েছে । আমি সামান্য অংশ লিখলাম । মাধুর্য নষ্ট হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন । এর বিষদ বর্ণনা পুরাণেই পেয়ে যাবেন । আমার লেখা কোন সম্প্রদায়কে আঘাত করে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী । )