নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

অমৃতা রায় চৌধুরী





সমাজ-পুরাণ




শৈশবের ছোট্ট পাড়া, শৈশবের বাড়ি,
বর্তমানে পুকুর ঘিরে নতুন ফ্ল্যাটের সারি।
ফ্ল্যাটের নতুন বারান্দাতে নতুন নতুন মুখ;
স্কোয়ার-ফিটের মাপা ঘরে একলা থাকার সুখ!
ছোটো ফ্ল্যাটে সবই মাপা 'রোদ-হাওয়া-জল',
মৃদু হাসি, চাপা কান্না, মাপা হট্টগোল ।
একই সাথে বাস করা আজ খেয়াল পুরাতন,
এখন শুধু দেখা হলে, মৃদু সম্ভাষণ -
ছোট্ট 'হ্যালো', হালকা হাসি, অল্প কথা বলা;
সযতনে দূরে থাকার জন্য এড়িয়ে চলা। 
একলা থাকতে চায় যে মানুষ, এক‌লা সংসার, 
একলা তুমি, একলা আমি, একলা চারিধার!
একলা থাকতে চাইতে চাইতে বাবা-মা'ও পর,
নানান মাপের বৃদ্ধাশ্রমই তাঁদের নতুন ঘর।
একবিংশ শতক আজ কানে দিয়েছে মন্ত্র; 
মানুষ এখন আবেগহীন, হৃদয়বিহীন যন্ত্র ।
সবখানেই প্রতিযোগিতা, সবাই প্রতিযোগী,
ত্যাগমন্ত্র জানে'না কেউ, সবাই চরম ভোগী।
হানাহানি ও হিংসা তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আজ,
ভালোবাসা-মমতা-স্নেহ'ই  শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ।। 

পায়েল খাঁড়া








দেওয়ালি




আলোয় আলোয় ঝলমল করছে মন্ডপ।বৈদ্যুতিন সজ্জা মাকড়সার জালের মতো শাখা ছড়িয়েছে রাতের কালচে দেওয়াল জুড়ে।চারপাশে পোড়া বারুদের গন্ধ আর থেকে থেকে শব্দ বাজির বিকট উল্লাস বুঝিয়ে দিচ্ছে আজটা অন্য পাঁচটা দিনের চেয়ে আলাদা।
অমাবস্যাটা অবশ্য পুরোদস্তুর লোপাট হয়নি।তার আপাতত ঠিকানা বড় রাস্তার উল্টো দিকে ফুটপাতের একচিলতে উদ্বাস্তু সংসারটায়।একটা টিমটিমে লুন্ঠনের আলো কোনো রকমে পাল্লা দিচ্ছে মধ্য কার্তিকের ঠান্ডার সাথে।তার বিষন্ন আভা একটা ফ্যাকাসে প্রশ্নচিহ্নএর মতো লেপে আছে শীর্ণ কচি মুখটায়।
"মা, আমাদের দেয়ালি কবে আসবে?"
"আসবে রে আসবে, একদিন ঠিক দেয়ালি আসবে --দেখিস; আর সেদিন চারদিক শুধ আলো আর আলো!"
সহসা একজোড়া বেপরোয়া তীক্ষ্ণ আলোয় ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।সেদিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অস্ফুটে বলে উঠল মেয়েটা-- "মা, ওই দেখ_দেয়ালি_আসছে....."
মায়ের আর্তনাদ হারিয়ে গেল উৎসব মুখর শহরের শব্দের ভিড়ে।


চৈত্রী চৌধুরী





পূজো





পূজো কিন্তু সবার কাছে খুশির পুজো হয়না। 
তোমাকে কি পুজো এলেই হাতছানি দেয় আয়না? 
নতুন শাড়ি, নতুন জুতো, জামাকাপড় আর গয়না? 
সবার কিন্তু এত খুশি, এত মজা সয়না। 
পূজো কিন্তু সবার কাছে খুশির পুজো হয়না।।

যে ট্রেনটা পিষে দিলো এত লোকের দেহ।
যে বন্যা কেড়ে নিলো মা-বাবার স্নেহ।
যে ঝড়টা তান্ডব হয়, শুধুমাত্র বয়না।
পূজো কিন্তু সবার কাছে খুশির পুজো হয়না।।

যে ছেলেটার মাথা ন্যাড়া, মা মরেছেন স্ট্রোকে,
যে মেয়েটা ভুগছে এক কঠিন জরা রোগে,
যে লোকটা ভিক্ষা করে, খায় কিংবা খায়না! 
পূজো কিন্তু তাদের কাছে খুশির পুজো হয়না।।

যে ছেলেটা গুলি খেয়ে বুকে এখন মৃত।
যে মেয়েটা রেডলাইটের নিচে অনাবৃত। 
বনের পাখি কয়েদ করে পুষছ ঘরে ময়না?
পূজো কিন্তু তাদের কাছেও খুশির পুজো হয়না।।


আমার বাবার পা ভেঙেছে, তাতে কার কি?
ঢাকির গায়ে নেইতো জমা, নোংরা কত! ছিঃ!! 
সবাই ব্যস্ত দুগ্গা নিয়ে, কেউতো ফিরে চায়না।
পূজো কিন্তু সবার কাছে খুশির পুজো হয়না।।


প্রণব রায়





গদ্যে ভরা আলাপী সন্ধ্যায়




অনন্ত  গদ্যে ভরা 
   এক আলাপী সন্ধ্যায় খুব জানার ইচ্ছে...
    ফন্দিবাজ আশার আলো একবার জ্বলে
    একবার নেভে একান্ত আলাপচারিতায়,
    নিজেকে উদ্ধারে ব্যস্ত আমার সময় ঘড়ি
    টিক টিক জীবন খাতায় খরচের আঁচড় 
             কেটে রক্তাক্ত করে ,
      নিজেকে ঘষা কাঁচে অস্পষ্ট মনে হয় ,
      কখনও বা স্বচ্ছ শিশিরে আলোর জ্যোতি 
                          প্রতিসরিত হয়.....
       যাকে দেখার ছিল তাকে পাইনি এখনো
       স্বপ্নের পালক খুঁজে তাই
                            এতগুলো বসন্ত বাড়ন্ত ;
       কখনও মরীচিকায় ভরা ব্যাথিত মন 
                         ভাবে বসন্ত আগত দ্বারে 
      কখনো ভাবে...
      না, এ যে বসন্তের মাঝে পাতা ঝরানোর 
                     অভিসন্ধি শীতের পদধ্বনিতে
      যার নেই কোন স্বীকৃতি এ মনে 
      পেলনা এক চিলতে হাসির আলিঙ্গন 
     শুনেছে অবিরত দুঃখের গাথা রোজনামচা,
      জুড়িয়েছি প্রাণ হৃদয় বাতাসে ,
      সুখের দিনে যে ছিল নিষেধ পাহাড় 
             আমার অমরাবতী তে
       সেই যে প্রকৃত নিষেধ ভালোবাসা ছিল,
       যার প্রয়োজন ছিল এ পূজারীর
       কিন্তু ভক্তি বিনা সে পূজার নৈবেদ্য 
       সাজানোই থাকলো পেলনা রাঙা চরণ 
       এ পূজারী শুন্য দেবাঙ্গনে 
                      শুন্য থাকলো ..............।

সুধাশ্রী মণ্ডল




প্রেমময় তোমাকে




আমার মন কেমনের মেঘলা বেলায়,
বৃষ্টি ধোয়া ভিজে শরতের আকাশ
মেঘ বৃষ্টির খেলায় অনিমেষ মোহময় !
নিশীথ রাতে অমাবস্যার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ,
ঝোড়ো হাওয়ার ইন্দ্রজালে প্রেমময় তোমার
পথ হারানোর কথা ভাবতে গেলেই
আকুল এ মন হাহাকারের তীব্রতায় স্তব্ধ হয়ে রয়
আমার ঘুমহীন অভিমানী অকাল আষাঢ়ের
কাজল ঘন মেঘে
ক্রমাগত শুধু জল থই থই শাঁওন.....
দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরতেই থাকে ;
দেখি, সহসা বিষাদ আগুনে
সাতরঙা রামধনুর শ্যামলিমাটুকুও পুড়ে
মিশমিশে কালো ছাই ,
এলোমেলো চুল অগোছালো মন
মৃদু সুগন্ধ এ হৃদি জুড়ে
উদাস ব্যাকুল আমি তখন শুধু দুহাত ভরে
পথের বাঁকে পড়ে থাকা
ঝরা ফুল দলের দুঃখ কুড়োই !
অশ্রু রাঙা তুলিতে দিগন্ত পারে ঐ যে  সুদূর
আকাশের  নিস্তব্ধ  আঁধারের নৈঃশব্দ্যের বুকে
চাঁদের ছবি আঁকি....
মেঘবতী জোছনাকে চুপিচুপি  বলি
আমাদের আকুল  ভালোবাসার গল্প ,
ভাবি, দূর গগনের সহস্র লক্ষ  তারার মাঝে
ও চাঁদ  " তুমি " কি আর কারো নয় ?
শুধু কি মোর একার হবে ?

রাত্রি আরো গভীর হলে ,
দুচোখ যখন  ঘন হয়ে আসে ঘুমের চাদরে,
ঘনায়মান আঁধারে ডুবে যায় ঐ মগ্ন চরাচর, 
বেহায়া রাত পাখিটা ও হয়তো গেয়ে ওঠে
ছন্দহীন কোনো তান
হয়তো তখন " গান হয়ে " মোর অস্থিরতায়,
হৃদয় মাঝে তুমি ও এলে , মেখলা বিছানো পথ ধরে
ঠিকানার ভুলে ভুল পথে আবেগের ব্যাস্ত পারাপারে
অমনি শুরু হল
' আমার  ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে '
দিগ্বিদিকে
ঝমঝমিয়ে মুষল ধারে  বৃষ্টি  পাগল পারা ,
আমিও তখন  সেই সৃষ্টি ছাড়া তুমুল বৃষ্টির তোড়ে
উদ্ভ্রান্ত দিশাহারা ,
ভীষণ জ্বরে কাঁপছি, শুধু তোমাকে ছাড়া....
ঠিক তখনই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে
হয়তো দূরে তোমার পাড়ায় বিদ্যুতও যে চমকালো ,
আমি তখন মনকেমনিয়া  কষ্ট মেখে
বুকের আরো গভীরে গুমরে মরা কান্না  রাখি  ,
চূড়ান্ত অপ্রেমে অবহেলায় উপেক্ষায়
বিষাদে বন্য  নিষাদে
খুব কাছেতে তোমায় অনুভব করতে পারি

তারপর ধরো,
সেই মুষল ধারে বরিষণ ধারায় তোমার সাথে ভিজে
আবার আমার  ঠান্ডা লেগে গেল !

আমার আবহমান হাহাকারে কবিতায় ঝরে পড়া
চোখের জলের আড়ালে , তোমাতে বিমুগ্ধ
এ পোড়া মন আজও যে
শুধু তোমাকেই খোঁজে বর্ষাস্নাত ... !

তুমি কি এখনো আমার অরূপকথার চুপকথায়
শিউলি ফোটা ভোরের আকাশ হবে ?


অক্ষয় কুমার সামন্ত





কবি হতে পারো নি 




এখনও যদি মাসিক কিছু রোজগারের ভেতর
নিজেকে হাঁটা চলা করতে দ্যাখো
মাথার মধ্যে চলা কিছু হিসেব নিকেশ
তোমাকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়
তাহলে বলবো দারিদ্রতা দোষী নয়, তুমিই দোষী
তুমি কবি হতে পারো নি --
কবিত্বের মধ্যে কোন দারিদ্রতা নেই।

এখনও যদি প্রতিবাদী কথায়
তোমার কলম চুম্বন না করে
সমাজ ফোটাতে তুলি না ধরো
বুলেটের সামনে নিজেকে ছুঁড়ে দিয়ে
বলতে না পারোঃ এই ধরো কবিতার পাতা
আমাকে মেরে ফেলার আগে আগুন ধরাও
আর তার উত্তাপে বাষ্প হোক
তোমাদের রক্তে মিশে থাকা সব সাধ --
তাহলে বলবো তুমি কবি হতে পারো নি
কবিত্বের মধ্যে কোন ভয় নেই।

এস. কবীর






জয় হোক 
*********

                                        

জীবনের প্রতিনিয়ত বালখিল্যতায়-
অদম্য দেউল পাখি ফুঁরুৎ উড়ে চিলেকোঠায়;
শীতল ঠান্ডা হাত  নগ্ন হয় শীতের দিনে,
একবার কাছে টেনে নেওয়া মানে-
মরা গাঙে বান আসা-
দরিয়ার ঢেউ - এ গা ভাসানো, গা ভেজানো,
উথাল - পাথাল মর্ত্যতল;
তবে কিসের নেশায় উজান স্রোতে হাঁটা?
প্রাচীন দেবতার ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় কি?
কাঁকড়ের রাস্তা বেয়ে পথে হাঁটা মানে-
তোমার টানে বিচালির  মাচান খোঁজা;
উলুবন থেকে একদল পাখি ডেকে ডেকে সারা-
চৈতালী রোদে.....।
কারা যেন বলেছিল - ভালোবাসার যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই? সে না থাকুক!
একনিষ্ঠ প্রেমি হিসাবে তোমার বক্ষে -
উঠুক আমার খদিত নাম;
জিন্দাবাদের বদলে - ভালোবাসার জয় হোক -
জীবনের ইতিহাসে...। 

অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়






এক্স




অধৈর্য লাগছে বড্ড। সাথে অস্বস্তিও খুব। প্রায় মিনিট চল্লিশ হতে চলল তিতাস ক্যাফে’তে বসে আছে। সৌম আসবে আজ। অনেকদিন পর একটা আশার আলো দেখেছে আবার তিতাস। গতকাল রাতে ফোনটা আসার পর, বাঁধভাঙা নদীর মতন স্রোত ছুটিয়েছে তার দুচোখ। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও বেশ খানিকটা সময় চোখের উপর একটু ব্যথা ব্যথা ভাব টের পেয়েছিল সে। শরীরটা বেশ দুর্বলও লাগছিল ওর কিন্তু তাই বলে সৌমের সাথে ডেটিংটা মিস করা যায় না। আর তাও যখন এতগুলো বছর পর, তিতাস ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কটা জোড়া লাগানোর একটা রাস্তা পেয়েছে তখন প্রয়োজনে রামসেতু বানাতে হলেও তাকে আসতে হবে। তাই সেই প্রাক্তন প্রেমিকের চোখে মুগ্ধতা আর জৌলুস ফিরে পেতে, খুব করে সেজেছে আজ। মাস্কারা, আই লাইনার, আই শ্যাডো, নেল পলিশ, লিপ স্টিক আর সাথে সুগন্ধি পারফিউমের মিশ্রণে নিজেকে লোভনীয় করে তুলেছে যতটা সম্ভব। স্লিম চেহারাটা আরও আকর্ষণীও করে ফুটিয়ে তুলতে ব্ল্যাক কালারের অফ শোল্ডার ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়েছে তিতাস। অল্প একটু ফ্লেশ ফ্ল্যাশিং আর চোখ ধাঁধানো গায়ের রঙ দেখে নিশ্চয়ই সৌম চোখ ফেরাতে পারবে না ওর থেকে, এ বিশ্বাস তিতাসের আছে। যদিও এইভাবে সাজতে খুব একটা স্বচ্ছল নয় ও, তবু সে সেজেছে। একটি মাত্র মানুষের জন্য সেজেছে। শুধু এটা বোঝাতে যে একদিন যাকে সৌম ছেড়ে গিয়েছিল, সে এখন কতটা পাল্টে গেছে। আজও কি তিতাস যোগ্য হবে না? এত গুলো বছর পাগলের মতন ভালোবেসেছে সে। এক তরফা প্রেম। অনেকেই বলেছে, এ তোর বড্ড বাড়াবাড়ি। কিন্তু তারা তো আর বোঝেনি ওর যন্ত্রণাটা।

গতকাল রাত্রে তিতাস যখন রোজ রাতের মত মানসিক যন্ত্রণাগুলো ভেঙে ভেঙে ঘুমের পথে ছুটছিল, তখন বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা একটা অচেনা নম্বরে কেঁপে উঠল। তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে তিতাস অস্পষ্ট একটা “হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠের পুরুষালি গাম্ভীর্যে, তার ঘুম সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছিল।
-আমি সৌম বলছি।
ব্যস এটুকুই যথেষ্ট ছিল তিতাসের বুকে হড়কা বান ডাকতে। কোনো রকমে সামলে নিয়েছিল সে নিজেকে। তারপর...
-সৌম?
-হ্যাঁ। ভালো আছো?
-হুম
-ঘুমাচ্ছিলে?
-হুম
-সরি। আসলে একটু কথা ছিল...
তিতাসের ইচ্ছে করছিল সে চিৎকার করে বলে, একটু কেন তোমার যত ইচ্ছে তুমি কথা বলো। সারারাত ধরে বলো। তোমার কথা শোনার জন্য আমি যে বিরহ কাতর রাধা হয়ে এতদিন চাতকের মতন অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু সমস্ত শব্দ গলার কাছে কেবল আঁটকে আসতে লাগল আর অস্পষ্ট স্বরে সে বলল...
-হ্যাঁ
-দেখা করতে পারবে প্লিজ?
কথাটা শোনা মাত্রই তিতাসের মনে দপ করে একটা আশার আলো জ্বলে উঠেছিল। হয়তো আবার একবার গল্পটা শুরু হতে চলেছে, ঠিক যেখানে অসম্পূর্ণ হয়ে পড়েছিল, সেখান থেকে। তিতাস’কে চুপ থাকতে দেখে সৌম আবার বলল...
-হ্যালো, বলছি কাল একবার দেখা করতে পারবে?
-কাল?
-হুম।
-কিছু বলতে চাও?
-হ্যাঁ।
-কী?
-তোমায় সরি বলার আছে। আর সাথে আরও অনেক কিছু...
-সরি কেন বলবে?
-আমি জানি, আমি ভুল করেছি তাই। প্লিজ কাল একবার দেখা করবে?
-বেশ। করব।
-থ্যাঙ্কস। আমি কোথায় আসবে সেটা তোমার নম্বরে মেসেজ করে দেবো কাল সকালে। কেমন?
-হুম। আচ্ছা একটা কথা বলবে?
-হ্যাঁ, বলো...
-তুমি আমার এই নম্বরটা কোথায় পেলে?
-একটা নম্বর খুঁজে পাওয়া কি খুব কঠিন?
-বলো না...
-তোমার ফেসবুক থেকে পেয়েছি।
-আমার নম্বর তো পাবলিক করা নেই। তবে কি তুমি আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ডস লিস্টে আছো? অন্য নামে?
-না, আমার এক বান্ধবি আছে। ওর মোবাইলে তোমার ছবিটা দেখেছিলাম। চ্যাট হেডে তোমার একটা মেসেজ এসেছিল একবার। কেমন চেনা চেনা লেগেছিল। ভালো বুঝিনি। তারপর, ওর কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে তোমার প্রোফাইল অন করতেই তোমায় দেখি...
-আচ্ছা। আমার কোন বান্ধবি বলোতো?
-রিয়া। রিয়া দত্ত।
-ওহ আচ্ছা। আমার বান্ধবি নয়। অফিসের কলিগ। তেমন ক্লোজ নই আমরা। খুব দরকার ছাড়া তেমন একটা কথা হয় না। শিফটও আলাদা পড়ে।
-আচ্ছা। বুঝলাম। বাই দ্যা ওয়ে, তোমায় কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে প্রতিটা ছবিতে। আগের থেকে অনেক পাল্টে গিয়েছ...
-থ্যাঙ্কস।
-আর এখন ওয়েল সেটেল্ডও হয়েছ। অত বড় একটা সংবাদপত্রের নামকরা রিপোর্টার।
-থ্যাঙ্কস আগেন...
-মোস্ট ওয়েলকাম। এনিওয়ে, আমার মোবাইলে একদম চার্জ নেই। আজ রাখি, কাল অ্যাড্রেসটা মেসেজ করে দেবো। প্লিজ এসো।
-হ্যাঁ, আসব।
-আর... আই লাভ ইউ...
বলেই ফোনটা কেটে গিয়েছিল। শেষের তিনটে শব্দ শোনার পর কিছুক্ষণ, স্থির পাথরের মতন বসেছিল তিতাস। তারপর...তারপর বৃষ্টিঝরা প্রচণ্ড আবেগে ঝর ঝর করে ঝরে পড়েছিল সে...

সকালে ঘুম থেকে উঠেই, মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন দেখেছিল সে। সৌম অ্যাড্রেসটা মেসেজ করে দিয়েছে অলরেডি। লেখা ছিল, ওয়াটারসাইড ক্যাফে, হায়াত রিজেন্সি, সন্ধ্যা ৭ টা। এরপর শুধু অপেক্ষা রেখেছিল, সেই সময় টুকুর জন্য। সামনা সামনি দেখা হলে কী বলবে, কিভাবে বিহেভ করবে ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তায় অস্থির ছিল তিতাস। আবার মনে হয়েছিল, সে যেন খুব বেশি পাগলামি না করে ফেলে। তাই বারবার চেষ্টা করেছিল নিজেকে শান্ত করার।

এখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। এবার অস্বস্তি আর অধৈর্য একত্রিত রূপ নিয়ে দগদগে অসন্তোষ হয়ে উঠছে একটু একটু করে। এত দেড়ি কেন করছে সৌম? তবে কি আসবে না? তাহলে ফোন করল কেন? নাঃ আর ভালো লাগছে না এইভাবে। বুঝতে পারল একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়া খুবই প্রয়োজন। তাই ওয়াশরুম যাওয়ার পথে একটা টেবিলের পাশ কাটাতে গিয়ে দুই যুবকের কথাপকথনে কান গেল তিতাসের। ওদের মধ্যে একটি যুবক বলছে-
-আই ডোন্ট থিঙ্ক ধোনির কম্প্রমাইজ করা উচিত এখানে। হি হ্যাজ ট্যালেন্ট এই সব লোক’কে ওর একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। নাম্বার ফোরে নামুক আর একটা সেঞ্চুরি করে ওদের মুখে ঝামা ঘষে দিক।

ওয়াশরুমে গিয়ে মিররে নিজের মুখটা দেখতে দেখতে ছেলেটার এই কথাগুলো কানে বাজতে লাগল তিতাসের। তারপর হঠাৎ যেন, সারা শরীর ওর জ্বালা করে উঠল। কি করছে ও?  আজ থেকে বছর তিনেক আগে কলেজ লাইফে তৈরি হওয়া একটা প্রেম নিভে গিয়েছিল। এই সৌম তাকে একদিন ছেড়ে চলে গিয়েছিল। যেহেতু তখন তিতাস একটু স্বাস্থ্যবতী ছিল, তাই তার জন্যে কত টিটকিরিও দিয়েছে সৌম। কিন্তু এই ভালোবাসার প্রভাব এত বেশি ছিল তিতাসের মনে যে, কখনও সে তাতে কিছু মনে করেনি। তিতাস খুব ভালো করেই জানে সৌম এক কুৎসিত মানসিকতার পুরুষ। না, এদের পুরুষও বলা যায় না। প্রকৃত পুরুষ হলে কেউ কি একজন মেয়ে’কে সবার সামনে চড় মারতে পারে? সেদিন তো তিতাস কিছুই বলেনি, শুধু বলেছিল, সে একজন বড় জার্নালিস্ট হতে চায়। বাইরে বাইরে ঘুরতে চায়। আবর্জনা খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা সত্য উদঘাটন করতে চায়। সৌম বলেছিল এমন কাজ তাদের সংসারে নাকি শোভা পায়না। তিতাস একটু জোর করায়, অচেনা অজানা লোকের সামনে রেস্টুরেন্টে ওকে চড় মেরে চলে এসেছিল সে। তারপরেও, হ্যাঁ তারপরেও তিতাস ওকে ভালোবেসেছে। এতদিন। “ছিঃ আমার কি কোনো আত্মসম্মান বোধ নেই?” অস্ফুট স্বরে ককিয়ে উঠেছিল কথাগুলো। এতদিন তার কত বন্ধু তাকে বুঝিয়েছে, কিন্তু ও বোঝেনি। বারবার এক তরফা প্রেমে আগুনে পুড়িয়েছে নিজের গোটা মনটাকে। এখন ওয়াশরুমে নিজের দিকে দেখতে দেখতে তিতাস নিজে নিজেকে একটা প্রশ্ন করল, “ভালোবাসা না আত্মসম্মান?”

উত্তরটা খুঁজে নিতে এবার আর ভুল করল না তিতাস। বেশ কিছুটা সময় সে নষ্ট করেছে ঠিকিই তবে আজ তিতাস বুঝতে পেরেছে, যে এক তরফা প্রেমে আত্মসম্মান নগ্ন হয়, সে প্রেম আঁকড়ে ধরে কোনো লাভ নেই। তাই শারীরিক আর মানসিক সকল মেকআপ ধুয়ে ফেলে, ধীরে ধীরে নিজের টেবিলে এসে বসে পড়ল। আশপাশ আর একবার দেখে নিলো। না, অমানুষটা এখনও আসেনি। ভালো হয়েছে আসেনি। তিতাস কেনই বা এতকাল ওর অপেক্ষায় বসেছিল? কেনই বা এত সেজে আজ এসেছে ওর জন্য? সৌম তো ভালোও বাসে না ওকে। ফেসবুকে ওর ফোটো আর স্ট্যাটাস দেখে, হঠাৎ কোনো ইনফাচুয়েশনে হয়তো আবার ফিরে আসতে চায় সে। কিন্তু ওকে প্রশ্রয় দিলে আখেরে ক্ষতি তিতাসেরই হবে। যদি বিয়ে হয় তবে কি আর তখন এরকম টিপটপ সুন্দর থাকতে পারবে ও? সন্তানও আসবে, তখন কি আর সৌম ওর খেয়াল রাখবে? আবার যে ছেড়ে যাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? এমন মানুষ কোনো মেয়ের যোগ্য হতে পারে না। আজকাল যখন তিতাস সেজেগুজে রাস্তাঘাটে বেরোয় তখন বেশ ভালোভাবেই ওর চোখ অবলোকন করেছে কিভাবে ছেলে, যুবক, মধ্য বয়স্ক, বিবাহিত, অবিবাহিত , বৃদ্ধ সকলেই তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। যা প্রমাণ করে তিতাস সত্যই অতুলনীয়া সুন্দরী। আর কেবল সুন্দরীই নয়, সাথে সাথে খুবই ট্যালেন্টেড একজন ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিসম নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আর আজ সে একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের সাথে জড়িত। উচ্চ পদস্থ একজন জার্নালিস্ট। ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল। না, তিতাসের কোনো ছেলের অভাব হবে না। একজন ভালো মনের পুরুষ মানুষ সে নিশ্চই পাবে। এসব ভাবতে ভাবতে তিতাসের ফোনটা একবার কেঁপে উঠলো, তাতে ফ্ল্যাশ করছে সৌম নামটা। সৌম একটা মেসেজ পাঠিয়েছে যাতে লেখা, “গট স্টাক ইন দ্যা ট্রাফিক... ভেরি সরি। প্লিজ ওয়েট ফর টেন মিনিটস মোর...” মেসেজটা পড়ে, তিতাস উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে আর ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রিপ্লাইটা লিখে সেন্ড করল সৌমকে, যাতে লেখাছিল, “আত্মসম্মান সবার চেয়ে দামি... এক্স”। 

মোঃ মিজানুর রহমান



বেহায়া-০৯



নেহ মোরে দিলো ডাক
নাম ধরে দাঁড়কাক,
যাবে কুমার নদীতে 
একা ডিঙি বাইয়া,
ছুটেছি পিছু পিছু 
আমি যে অতিশয় বেহায়া।

হিসেবে কাঁচা যে 
করি কাজে শুধু ভুল,
ভাবনার বেড়াজালে
পাইনা না তো কোনো কূল।

সুপ্তিরা করে খেলা
নয়নের নয়নে,
বেহায়া মন স্যাঙাতের খোঁজে
দিবানিশি শয়নে স্বপনে।

বিনি সুতার ওড়াটা
ছেড়েছি দূর আকাশে,
হঠাৎ অনপেখিত বৃষ্টিতে
ঝলমলে আকাশটা ফ্যাকাশে।

পাইনা যে কোনো ভয়
মেঘের আড়ালে,
বেহায়া মন খুশি
প্রীতিজন প্রণয়ের দুটি হাত বাড়ালে।

সোমা দাস




পাথর 



শব্দগুলো জমতে জমতে যখন 
মাত্রা ছাড়ায়-
অলেখাগুলো যখন পূর্ণতা চেয়ে 
বেড়িয়ে আসতে চায় -

আমি তখন পাথর হয়ে উঠে
চোয়াল শক্ত করি! 

তুমি চলন্ত ট্রেনের ভিড় ঠেলে 
দরজা খুঁজে দাঁড়াও. . 
চোখে লেগে থাকে কুয়াশা মাখা 
সকালের প্রশান্তি , 
জনতার ভিড় ছোঁয়না তোমায়! 

তুমি নীলের দিকে চোখ রেখে 
তোমার অলেখাগুলোতে প্রাণ ঢেলে 
উড়িয়ে দাও মেঘের বুকে. . . 

তপন জানা




হিংসা বিষে 



হিংসা বাষ্পে ছেয়েছে আকাশ
   মাটির পৃথিবী রক্তাক্ত।
অমানবিকতার গরল গিলে
   মানব জাতি বিধ্বস্ত।
হিংসায় আজ উন্মত্ত পৃথিবী
   কেউ চায় না কারো ভাল
জীবশ্রেষ্ঠ হয়েও মানুষ
  মানুষের ই চিতা জ্বালো।
বিশ্বাসের কোন বালাই নাই
   প্রতারণার ফাদ পাতা।
স্বার্থসিদ্ধির নিষ্ঠুর খেলায়
   কে কাটে কার মাথা?
ধর্মের নামে দাঙ্গা করে
  গুলি বন্দুক বোম বারুদে।
হাজার অসহায় প্রান মরে
   স্বজন হারার দুঃখে কাদে।
মৃত্যু এখন দাড়িয়ে রাস্তায়
   খড়্গ নিয়ে হাতে।
সুযোগ পেলেই কাটবে গলা
  অন্যায় প্রতিবাদ না হয় যাতে।
মাতৃ জঠরে কাঁপছে  শিশু
   ভুমিষ্ঠ হবার ভয়ে।
ধরার বায়ু বারুদে ভরা
   সে বাঁচবে কি লয়ে?
সভ্যতার গায়ে অকাল আধার
  চন্দ্রকায়ায় রক্ত দাগ।
সূর্য ডোবে বারুদ স্তুপে
   সৃ‌ষ্টি স্রোতে ঘূর্ণি পাক।

রূপা রায়




কিছুক্ষণ(ভ্রমন কাহিনী)




নিউদিঘা থেকে সকাল আটটায় রওনা দিলাম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে গন্তব্য স্থল এক নতুন ম্যানগ্রোভ অরণ্য ঘেরা দ্বীপ।
তালসারি থেকে বারো কিলোমিটার দূরত্বে যার অবস্থান,  পথের দুপাশে দেবদারু গাছের দীর্ঘ রহস্য, মাঝে মাঝে রিসর্ট পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে বাংলা উড়িষ্যা র সীমানা বরাবর।
দেবদারুর রহস্য পেরিয়ে  চন্দনেশ্বর মন্দির কে বাঁ পাশে রেখে বড়ো রাস্তা ধরে সোজা পথ, তেমন ঘন জনবসতি দেখা যায় না , পথের দুপাশে মাঝে মাঝে রাস্তার উপর ঝুঁকে পড়া কাজুবাদাম এর গাছের পাতা, তার ফাঁকে হলুদ,  পেয়ারা ফলের মতন দেখতে তার নিচে সবুজ রঙের বাদাম উঁকি দিচ্ছে ।
রৌদ্র ছায়ার খেলার অদ্ভুত সৌন্দর্য প্রকৃতির বুকে,
একসময় বড়ো রাস্তা পার করে প্রবেশ করলাম আঁকাবাঁকা গ্রামের মেঠো পথ ধরে গত রাতের বৃষ্টি তে কোথাও কোথাও জল জমে আছে । বাংলা হোক বা উড়িষ্যা
ভারতবর্ষের সমস্ত গ্রামের ছবি বোধহয় এক, পথের দু পাশে বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও ধানের জমি কোন কোন জায়গায় কপি, ফুলের চাষ,
আরো একটু সামনে এগিয়ে দেখলাম বিস্তারিত তরমুজের ক্ষেত্র।
 সামনের পথ যত প্রশস্ত ততই নতুন দ্বীপের রহস্য উন্মোচন এর কৌতুহল!
বুকের ভেতর অজানা উদ্দীপনা, বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ, দু একটা চায়ের দোকান পার করে গাড়ি এসে থামলো এক বটগাছের ছায়ায়।
সকাল দশটা, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক আগন্তুক বললেন হাতে মাত্র এক ঘন্টা, তার মধ্যে ফিরতে হবে,
দারুণ উৎসাহে জানতে চাইলেও সময়ের জন্য জানা হলো না।
টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে পাঁচ মিনিট এর হাঁটা পথে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে,দুপাশে দেখলাম কিছু অজানা গাছ(ফেরার পথে  নাম জেনেছি লাম এরাই ম্যানগ্রোভ,  গ‍রাণ, হোগলা)
কোনক্রমে ছোট সেতু পার করে  মাঝি ভাইএর সহায়তায় বোর্ডে উঠলাম। শান্ত প্রবাহমান জলধারা দুপাশে শ্বাসমূল, ঠেসমূল যুক্ত কেয়া, গেওয়া, গোলপাতা সমৃদ্ধ বনরাশি,

মিনিট পনেরো পর স্পিড বোট নামিয়ে দিলো  মোহনার কাছাকাছি একটি দ্বীপে; যেখানে সুবর্ণরেখা সাগরে পড়েছে৷ অভিভূত নামনা জানা পাখির কলকাকলি, শহরের  ব‍্যস্ততা যাদের কাছে হার মানে,
সেই দ্বীপে নেমে প্রথম স্পর্শ করলাম ম্যানগ্রোভ সুন্দরী কে , তার ডালে আটকানো দোলনায় বসে ফিরে গেলাম শৈশবের দেশে ।
সময় খুব সংক্ষিপ্ত এই দ্বীপ পৃথিবীর বুকে জেগে থাকে মাত্র দিনে ছয় ঘন্টা, আমাদের হাতে মাত্র তিরিশ মিনিট, 
বোর্ড চালকের কড়া নির্দেশ ।
অতএব সময় নষ্ট না করে যতটা সম্ভব সৌন্দর্য আর অভিজ্ঞতা উপভোগ করা,
নরম পলিমাটি পায়ের গভীর ছাপ রেখে এগিয়ে যাওয়া সামনের দিকে। চারিপাশে ছড়ানো সাদা গাছের ডাল, মনে হবে শুকনো কাঠের বিক্ষিপ্ত পতন।কোন মানুষ রেখে যাইনি রাতের জোয়ার এদের উপহার দিয়ে গেছে,
সামনে কোন জনবসতি নেই, একটু এগিয়ে দেখলাম একজন মাঝবয়সী মহিলা  নীচু হয়ে কি সংগ্রহ করছে ,কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম প্রথমে আমার কথা বুঝলো না পরে ইশারা করতে যা বললো বাংলায় যার অর্থ শামুক, কাঁকড়া ধরছে, আর বেশ কিছুটা দূরে এদের কয়েকঘর বসতি ।  এভাবে যাদের জীবন যাপন, শহরের ঝাঁ-চকচকে জীবন সম্পর্কে যাদের তেমন কৌতূহল নেই তা ব‍্যস্ত মহিলা কে দেখেই বুঝলাম।
প্রশস্ত বালুরাশির মাঝে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে কপাল কুন্ডলার নবকুমার কে,
দূরে শোনা যাচ্ছে সাগরের গর্জন তবে বিস্তারিত কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে সে পথ।
সময় যেনো গন্ডী টেনে দিয়েছে ,সে ভুলে যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ সম্বিত ফিরে দেখলাম হাতে মাত্র সাযমিনিট আর অনেকদূর চলে এসেছি পায়ে পায়ে,
প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা দেখে এত অল্প সময়ে তৃষ্ণা মিটলো না।
শুনেছিলাম মহাদেশের সূর্য মুখীর  আঁতুরঘর , সময়ের অভাবে সেই ঘর দেখার স্বাদ অপূর্ণ রয়ে গেলো, 
যে পথে নরম মাটির গভীরে পায়ের ছাপ পড়েছিলো সেই পথেই ফিরে এলাম বোর্ডের কাছে,
রেখে এলাম বিচিত্রপুরের দ্বীপে আসা-যাওয়ার পদচিহ্ন।
দুপাশের ম্যানগ্রোভ পেরিয়ে স্পিড বোর্ড তীব্র গতিতে ফিরে চললো পরিচিত সভ‍্য পৃথিবীর দিকে।।


সুশান্ত সৎপতি





ছবি         



আমি একটি ইউক‍্যালিপ্টাস গাছের ছবি আঁকি।সে তো কোনো কুলীন গাছ নয়, রূপবান গাছ নয়, এমনকি তার গায়ে মাথায় মুনি ঋষির ছায়া নেই ,সে আমার কাছে কীএমন? জানতে চাইল প্রাচীন দেবদারু,আমি তখন তার পাশে দেবদারু টির ছবি আঁকি,পাছে প্রিয়শাল,সখী মহুয়ার অভিমান হয় তাদের‌ও আঁকি
আঁকতে আঁকতে পুরো একটা জংগল
এঁকে ফেলি ।তার পর পথ হারিয়ে ফেলি
অগত্যা সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করতে হয়,
অপেক্ষার প্রহর মাত্রই দীর্ঘ হয় ফলে ঘুমিয়ে পড়ি।

সায়নদীপা পলমল






আলোর স্পর্শ





মূল শহর থেকে কিছুটা ছাড়িয়ে জায়গাটা, তবে শহর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ঠিক বলা যায়না। শহরের বড় রাস্তা থেকেই একটা রাস্তা ভেঙে গিয়ে ঢুকে গিয়েছে এই দিকটায়, গেল বছরই পিচ হলো এই রাস্তাটা। আশেপাশের নিচু জমি গুলো এখন বাবুরা  কম দামে কিনে সব পেল্লাই বাড়ি হাঁকাচ্ছে তাই বোধহয় পাল্লা দিয়ে রাস্তার এই রূপ বদল। পিচ রাস্তাটা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই কালভার্টটা নজরে পড়ে, এতোই তার উচ্চতা যে অপর প্রান্তটা এদিক থেকে দেখা যায়না। কালভার্টের নীচ দিয়ে চলে গেছে একটা বড় খাল, হয়তো কোনোদিনও জল যেতো সেটা দিয়ে, এখন আগাছা আর আবর্জনাতেই প্রত্যেকটা দিন সমৃদ্ধ হয় সে। কালভার্টটা পেরোলে ওপারে প্রায় দুশো মিটার মত জায়গা বেওয়ারিশ অবস্থায় বিরাজমান। দু’শো মিটার… শুনতে সামান্যই কিন্তু ওই টুকু রাস্তাই পথচারীদের কাছে বিভীষিকাসম। বড় বড় হাঁ করে সে সদাই কাউকে গিলে নিতে প্রস্তুত, খুব সন্তর্পনে পেরোতে হয় সেখান। ওই দুশো মিটার রাস্তা পেরোলেই আবার সিমেন্ট ঢালা বাঁধানো রাস্তা গিয়ে শহরের মূল রাস্তার সাথে মিশেছে।  সিমেন্ট ঢালা রাস্তাটার এক পাশে রয়েছে উঁচু পাঁচিল ঘেরা একটা পরিত্যক্ত কারখানা আর অন্যপাশে কারখানার কর্মচারীদের জন্য নির্মিত বাসভবন। একসময় নাকি এই কারখানাটা রমরমিয়ে চলত, সেসব কথা শুনেছে বকুল। কিন্তু তার জন্মের পরে পরেই বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটা, তাই বকুলের কাছে কারখানার স্মৃতি বলতে এখন শুধু একটা নোনা ধরা বিশাল কাঠামো, স্থানে স্থানে যার দেওয়াল ফাটিয়ে ছোটো ছোটো আগাছার সঙ্গে জন্ম নিয়েছে অশ্বত্থ, বট। কারখানার বাসভবনগুলোতেও এখন আর কেউ থাকে না, তবে ইদানিং কিছু লোককে ঘরগুলোয় ঢুকতে দেখেছে বকুল। কিন্তু মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই মা এড়িয়ে যায়, বকুলকে বারণ করে ওদিকে যেতে।

   পিচ রাস্তা শেষে কালভার্টটার যেখানে শুরু সেখানেই রাস্তার একধারে বকুলদের ঝুপড়িটা। আগে এখানটায় শ্রমিকদের ছোটোখাটো একটা বস্তি ছিলো কিন্তু কারখানা বন্ধ হওয়ার পর সব এক এক করে উঠে যেতে যেতে এখন শুধু বকুলদের ঝুপড়িটাই রয়ে গেছে। বকুলের বাবাও কারখানায় কাজ করত, কাজ চলে যাওয়ার পর থেকে ভীষন মনমরা হয়ে থাকতো মানুষটা। তারপর একদিন হঠাৎ  বলল বড় রাস্তা দিয়ে যে ট্রাকগুলো আলু নিয়ে মহারাষ্ট্র যায় সেই ট্রাকগুলোয় চড়ে যাবে কাজের সন্ধানে, এই বলে সেই যে গেল আর ফিরলোনা কোনোদিনও। সে হয়ে গেল প্রায় বছর তিনেক আগের কথা। মা তারপর থেকে ঠিকে ঝি এর কাজ করে, কখনও আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার চালায়। বকুলের ভাইটাও আবার তার পরের বছরই মারা যায়। ভাইটার পা দুটো ছিল জন্ম থেকেই অকেজো, পায়ের পাতা দুটো গোড়ালির থেকে ছিলো উল্টানো আর কোনো আঙ্গুল ছিলো না পায়ে, তাই হাঁটতে পারতো না সে। সেবার কখন যেন সবার অলক্ষ্যে হামা দিয়ে দিয়ে ওই কালভার্টের দিকে চলে গিয়েছিল তারপর টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে একটা বড় ট্রাকের সামনে…

   পিচ রাস্তার ওদিকে একটা দোকানে রাখি ঝুলতে দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে বকুলের। ভাইটা যতদিন বেঁচে ছিলো এই দিনটায় সে নিয়ম করে ভোরে উঠে স্নান সেরে রাখি পরাতো ভাইকে। তাদের আড়ম্বরহীন জীবনে এই ছোট ছোট আনন্দ গুলোই ছিল একমাত্র বিলাসিতা। ভাইটা যাওয়ার পর সে বিলাসীতাটুকুও হারিয়েছে জীবন থেকে। রাখির দিনগুলো বড় কষ্ট হয় বকুলের, মনে পড়ে যায় ভাইটার হাতে রাখি বেঁধে দিলে সে কেমন আনন্দে চিৎকার করে মেঝেতে চক্কর কাটতো। ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে তার লালা ঝরে গড়িয়ে পড়ত গায়ে, বকুল পরম যত্নে নিজের জামার খুঁট দিয়ে মুছিয়ে দিতো ওর মুখ। ভাই চলে যাওয়ার পরও বকুল নিয়ম করে রাখি কিনেছে প্রতি বছর, গুছিয়ে রেখেছে ওর সাদা প্লাস্টিকের বাক্সটায়। মা বলে কেউ মারা গেলে নাকি ওই দূর আকাশে চলে যায়, বকুল ভাবে সেও যদি কোনোদিনও যেতে পারে ওই আকাশে তখন ভাইকে একসাথে পরিয়ে দেবে সব রাখিগুলো। ভাই নিশ্চয় খুব খুশি হবে। কিন্তু মাঝেমাঝেই আবার মনে প্রশ্ন জাগে দেখা হলে ভাই চিনতে পারবে তো তাকে!



পাঁউরুটির প্যাকেটগুলো বুকের কাছে চেপে ধরে সন্তর্পনে এগোচ্ছিল রাকেশ। অনেক চেষ্টা করছে চোখ মুখ স্বাভাবিক রাখার কিন্তু কিছুতেই পারছেনা, বুকের মধ্যে জমে থাকা ভয়টা নাড়াচাড়া দিচ্ছে মাঝেমাঝেই। সবাই কি ওকেই পায়! বারবার কেন ওকেই যেতে হয় খাবার আনতে! ওই রফিকটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া, ওরই উস্কানিতে দাদা রাকেশকে এরকম গরু গাধার মত খাটাচ্ছেন। তবে রাকেশেরও দিন আসবে ঠিক, তখন রফিক বুঝবে কত ধানে কত চাল।

   রাকেশ যখন চার বছরের তখন ওর মা ওকে ফেলে অন্য লোকের সঙ্গে পালিয়ে যায়, এরপর ঠাকুমার কোলেই মানুষ হতে থাকে সে। রাকেশের জীবনের একমাত্র ভালো স্মৃতি ওই ঠাকুমার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো, বাকি আর কিছুই মনে পড়ে না। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বাবা ওকে পিসির কাছে রেখে এসে আবার বিয়ে করেন। এদিকে পিসির বাড়িতেও কিছুদিনের মধ্যে শুরু হয় পিসিমশায়ের অত্যাচার, বেগার খাটুনি থেকে শুরু করে কারণে অকারণে জুটত মধ্যম। বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইলে বাবা তাকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেন, হয়তো নতুন সংসারে পুরোনো বোঝা টানতে চাননি আর। এই ভাবেই পিসির বাড়িতে সে কাটিয়েছিল কয়েকটা বছর, তারপর একদিন সুযোগ বুঝে পালায় সেখান থেকে। সেই শুরু, আজও রাকেশ ছুটে চলেছে ক্রমাগত। এই তেইশ বছরের জীবনে সে এটুকু বুঝে গেছে যে পৃথিবীতে ভালোবাসা, অনুভূতি এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই আদৌ, এগুলো বড়লোকেদের কল্পনামাত্র। এই পৃথিবীতে আছে শুধু লড়াই… ক্ষমতার লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই আর এই লড়াইতে জিততেই হবে তাকে।

  এসব কথা মনে হতেই মুখ থেকে একদলা থুতু ফেললো রাকেশ, আর তখনই একটা বাচ্চা মেয়ে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে।
“দাদা দুটো টাকা দেবে  মুড়ি কিনবো?”
“ফুট... রাস্তা ছাড়।”
“দাওনা দাদা দুটো টাকা, আমার মায়ের খুব জ্বর তাই মা কাজে যেতে পারেনি।”
“যা যা ওসব টাকা ফাকা হবে না আমার কাছে।”
“এমনি টাকা দিতে বলছিনা গো, তোমার কোনো কাজ থাকলে বলবে আমি করে দেবো।”
“আমার কাজ করে দিবি তোর এই দেড় ফুটের শরীরটা নিয়ে!” মুখটা বিকৃত করে হাসলো রাকেশ।
“হ্যাঁ গো সত্যি বলছি।”
“তা কি কাজ করবি শুনি?”
“যা বলবে, বাসন মাজা, কুটনো কাটা সব।”
“হুরর… আমার এসব দরকার নেই।”
“ও দাদা শোনো না…”
বাচ্চাটার কথা শুনতে শুনতেই কিছুটা দূরে পিচ রাস্তাটার দিকে চোখ গেল রাকেশের, একটা লোক কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে না ওদের দিকে! কে হতে পারে লোকটা! নাহ তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে। বাচ্চাটা বড্ড ভ্যানভ্যান করছে, ওর মুখ বন্ধ করতেই একটা পাঁউরুটির প্যাকেট ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ত্বরিৎ গতিতে পা চালালো রাকেশ। বাচ্চাটা অবাক হয়ে ওকে দেখলো পুরোনো কারখানার অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে।




সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টিটা নেমেছিলো, তারপর যত রাত বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার বেগ, সাথে শুরু হয়েছে নিদারুণ বজ্রপাত। বৃষ্টির তেজ, দমকা হাওয়া আর বজ্রপতন সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে বাড়ির টিনের চালটা উড়ে যাবে। বকুল তার এই ছোট্ট জীবনে এমন ভয়ঙ্কর দুর্যোগ আগে কখনও দেখেনি, যতবার বাজ পড়ছে ততবার কেঁপে উঠছে ওর বুক। মায়ের কোল ঘেঁষে চুপটি করে শুয়ে থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু সেটাও পারছেনা ঠিকমত, পেটের মধ্যে চলছে ছুঁচোর দৌরাত্ম। বিকেলের সেই দাদাটার কাছ থেকে পাওয়া পাঁউরুটিটা মাকে খাইয়ে দিয়েছিল, কিন্তু নিজের পেটে দানাপানি অবধি পড়েনি।

   আচমকাই বাইরের দরজাটা খুলে গেল সশব্দে, ছিটকিনিটা নড়বড়ে তাই বাইরে থেকে একটু জোরে দরজাটা ঠেললেই হলো… ভয় পেয়ে উঠে বসল বকুল, মাও কোনোমতে উঠলেন। একটা লোক ঢুকেছে দরজা দিয়ে, অন্ধকারে মুখ না দেখা গেলেও অবয়বটা স্পষ্ট। বকুলের মা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ওকে তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “কে?”
“চোপ একদম চোপ।” হিসহিসিয়ে বলল আগন্তুক। এতক্ষণে সে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে চলে এসেছে বকুলদের সামনে। লোকটার হাতে একটা ছোটো টর্চ, সেটা জ্বালতেই ওরা দেখতে পেল লোকটার মুখটা ঢাকা আর ডান হাতে ধরা একটা ধারালো ছুরি। লোকটা ছুরিটা বকুলের মায়ের সামনে উঁচিয়ে ধরে বললো কাউকে যদি বলেছিস আমি এখানে আছি তাহলে কিন্তু তোর এই বাচ্চাটা… কথাটা সম্পূর্ণ না করেই লোকটা ছুরিটা ঠেকিয়ে দিলো বকুলের গলায়। ওর মা আর্তনাদ করে উঠলেন, আর তৎক্ষণাৎ শোনা গেল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। লোকটা চোখের ইশারায় বকুলের মাকে দরজার দিকে যেতে বলে নিজে বকুলকে কাছে টেনে নিয়ে টর্চ নিভিয়ে সেঁধিয়ে গেল ঘরের এককোণে রাখা আবর্জনা ভর্তি বস্তাটার পেছনে।

   বকুলের মা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দুটো লোক হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো ভেতরে, ওদের আপাদমস্তক বর্ষাতিতে মোড়া।
“কেউ ঢুকেছে আপনার ঘরে?”
“ক্ক… কে ঢুকবে?”
“কেউ ঢুকেছে কিনা বলুন।”
“না… কিন্তু আপনারা কে? এতো রাতে আমার ঘরে…”
“আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন?”
“ভয় পাবোনা! আপনারা এভাবে…”
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা পুলিশ। কেউ ঢোকেনি যদি তাহলে একটু আগে আপনার ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল কেন?”
“চ্চ… চিৎকার! আ… আসলে আমার খুব জ্বর কদিন, গোটা গায়ে ব্যাথা তাই যন্ত্রনায় চিৎকার করে ফেলছি মাঝেমাঝে, হয়তো সেটাই শুনেছেন।”
“হুমম।” এই বলে ঘরের মধ্যে টর্চের আলোটা একবার ঘুরিয়ে নিয়ে তারা বলে, “আমরা এখন আসছি, কেউ এলে ঘরে ঢুকতে দেবেন না, কেমন?”
“আচ্ছা।”

  পুলিশের লোকদুটো চলে যায়, বকুলের মা দরজা লাগিয়ে দেওয়ার পরও কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে থাকে লোকটা তারপর বকুলকে নিয়ে সরে আসে বস্তার পেছন থেকে। আস্তে আস্তে  মুখের কাপড়টা সরায় সে, টর্চের আলোয় ওর মুখটা দেখে চমকে ওঠে বকুল।




ভোরের আলো বকুলদের বাড়িটাকে স্পর্শ করছে একটু একটু করে, পুরোপুরি আলো ফোটার আগেই পালাতে হবে রাকেশকে। বাচ্চাটা আর তার মা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে, রাকেশেরও তন্দ্রা মতন আসছিল কিন্তু ঘুমোলে তো তার চলবেনা। বাচ্চাটার ওপর প্রচন্ড রাগ উঠছে ওর, কাল এই চিংড়িটার সাথে কথা বলতে গিয়েই পুলিশের চরটার নজরে পড়ে গিয়েছিল সে। এটার গলাটা টিপে দিতে ইচ্ছে করছে রাগে কিন্তু এখন এসব ঝামেলা করে লাভ নেই। দলের সবার কি হল কে জানে! উঠে দাঁড়ালো রাকেশ, নাহ এবার তাকে বেরোতেই হবে। এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা টানতেই বাচ্চাটার গলা ভেসে এলো, “একটু দাঁড়াবে?”
চমকে উঠে পেছন ফিরল রাকেশ, ঘুমঘুম চোখে অনুরোধ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বাচ্চাটা। কালকে এটার জন্যই সব গন্ডগোল হলো কিন্তু আজ তাও কেন কে জানে ওর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল রাকেশ, ওই চোখ দুটোয় যেন কোন মায়া জড়িয়ে আছে!  বাচ্চাটা একগাল হেসে উঠে গেল তারপর তাক থেকে পেড়ে আনলো একটা কাগজের বাক্স। বাক্সটা খুলতেই চমকে গেল রাকেশ, সেটাতে ভর্তি রাখি। তার মধ্যে বেছে বেছে একটা রাখি বের করলো বাচ্চাটা। রাকেশ ওর মুখের দিকে তাকাতেই ও বললো, “কাল তুমি আমাকে যখন এমনি এমনিই পাঁউরুটিটা দিলে তখনই ভেবেছিলাম তোমাকে আজ রাখি পরাবো তোমার বাসায় গিয়ে কিন্তু আজ তো তুমিই আমার বাড়ি চলে এলে। জানো তো আমার ভাইটা মরে যাওয়ার পর থেকে কাউকে রাখি পরাইনি আমি, তুমি আমার দাদা হবে?”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো বাচ্চাটা, তারপর রাকেশের হাতটা টেনে নিয়ে বাঁধতে শুরু করলো রাখিটা, অপটু হাতে বাঁধতে গিয়ে গিঁট দিয়ে ফেললো সুতোটায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে রইল রাকেশ। কিন্তু রাখিটা বাঁধা শেষ হওয়া মাত্রই কারা যেন দরজা খুলে ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। রাকেশ দেখলো উর্দিধারী তিনজন পুলিশ।
“কাল ঠিকই দেখেছিলাম, কি ভেবেছিলি লুকিয়ে পালাবি?”
দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো বলতে বলতে একজন এসে মুঠো করে ধরে ফেলল রাকেশের হাতটা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রাকেশ এই মুহূর্তে যেন আর পালানোর তাগিদ অনুভব করছেনা, বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। জল ভরা চোখ নিয়ে বকুল হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে; আজ বহুবছর বাদে কান্না পাচ্ছে রাকেশেরও, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বকুলের মুখের মাঝেই ঠাকুমার মুখের আদল যেন আজ এতো বছর বাদে আবার ভেসে উঠছে রাকেশের সামনে, আজ এতো বছর বাদে তার ভেতর থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলে উঠছে : "অনেক হয়েছে, এবার থামা তোর এই মিথ্যে লড়াই। খুলে ফেল এই কালো মুখোশ, কারণ তুইও জানিস ভালোবাসা কারুর কল্পনামাত্র নয়, ভালোবাসা আছে আমাদের অস্তিত্বে মিশে…"

সুপ্রীতি বর্মন





সেই এক অনুকম্পার হাসি



চারিত্রিকহীনতা দস্যুবৃত্তি মুগ্ধতার ঝাপট পুরুষালী মেজাজে
স্বতন্ত্র ঝংকারে অহংফ্রেমে নিজস্বী চালে আটক দৈবীপুরুষ
তানপুরার নিতম্বে পোড়া রোদন শরীরী বিভঙ্গ খোঁজে।
প্রাক্তন ক্ষুধায় আকাল চুমুশতাব্দীর বিভাজন কালজয়ী সংগ্রাম পথে ঘাটে।
অশ্রুসিক্ত ইজেলে টানা হিঁজড়ায়
মন্দির প্রাঙ্গনে শূন্যতা প্রতিমায় ধ্বস।
অন্ধবৈরাগ্যের আঁচড়।

হরিতকী নিষ্ফলা জটে জট মণিকাঞ্চনে ভ্রম
শ্রীময়ীর প্যাঁকাল গতরে জেব্রাগতি বাচালতা
দৃষ্টি আকর্ষে ধর্তব্যে পরপুরুষ যখন তখন ম্লেচ্ছ
অলকার ধুন্ধুমার চোরাস্রোত তোমার পাগলামি
লক্ষ্মীর অন্তর্জলী কুলোর ঝাপটায় শকুন প্রিয়া
ক্যালকুলাসের অন্তর্ঘাতে বিবেক হাতড়ায় অন্ধের যষ্ঠি
মুখ থুবড়ে অনুশোচনার রোষানলে পাপস্খলন নৈব নৈব চ।

মরীচীকা রাজকীয় বৈভব পিছুটান মুদ্রাদোষে রতিক্রিয়া
লকলকে পুরুষালী অজগর গোগ্রাসে শরীরলতা
একছুটে পগার পার নিষ্কৃতি কর্তব্যের লেলিহান শিখা।
মদের বোতলে নেশার কামসমুদ্রের পেগ
তোমার শরীরী বিভঙ্গে ক্ষীণকায় আমার দধি।
নাভির নীচে উল্কাগভীরে সমর্পিত জরার শোকাশ্রু
স্বপ্ন সানগ্লাসের ঔদাসিন্যে কালোছোপ মড়কলাগা চিরহরিৎ শ্লথে যৌবনা নদী।।

কোজাগরী ঝুলন পূর্ণিমার কোটরে গুহ্য অবসাদ
প্রতিশ্রুতি নিঃশব্দ মিছিলে অগুন্তি নকসী কাঁথার মাঠে
কমলার স্বেচ্ছায় বনবাস।
জাজ্বল্যমান উৎসবের আঁচে প্রতিমার চোখে
নিষ্প্রদীপ অশ্রুসিক্ত কাজল।

পঙ্গু সেই হাত আলিঙ্গনে চৌচিড় ভাঙা সাইকেল
তোমার নির্বুদ্ধিতায় তেনাদের ভরে পড়ে যায় চেন অশৌচ গতি।
রইসি হাওয়ার নীচে গর্ভগৃহে ফাটাচাটা প্যান্টে
জোড়াতালি চৌক পাশায় পুতুলপ্রেম।
তোমার ললাটে অদৃশ্য চুম্বন চন্দনরোগ
ক্যালকুলাসের উপপাদ্যে বিলম্বিত লয়ে
সামঞ্জস্যে কষা নারকেল দড়িতে বোজা নাসারন্ধ্র।
মুক্তির নিঃশ্বাসে কোজাগরী ধাঁধা
পংক্তির শেষে অসমাপ্ত যতি।

চতুর্দিকে হৈ চৈ মণিকাঞ্চনের ফণায় বাসরে শঙ্খযোগ
নিজেকে মেলাতে থাকো দ্বিচারিতার স্নিগ্ধ মেরুদন্ডে
বাথরুমে প্রসাধনী সুগন্ধী সাবানের ঘেরাটোপে নিশ্চুপ যৌথ আত্মার সিঁড়ি উন্মীলন শতদলে
নিঃশব্দে রোদনে সিক্ত চুপকথা।

নির্মম মনুষ্যত্ব বাসের সিটে এসে বসে
প্রত্যাবর্তন পারভার্ট পশুত্ব।
বিকলাঙ্গ সহবাসে আরক্ত নতুন সহযাত্রী
অবলা মায়ের রুদালী শঙ্খে প্রার্থনার গুমোট কালঘামে
কপালে কালশিটের ভাঁজ নাগালের বাইরে
ব্যর্থ সেই হাঁকডাক অবরুদ্ধ শোকে মুহ্যমান মগ্নচৈতন্য।
অশ্রুধোয়া গোলাপ প্রশ্নে জর্জরিত এয়োস্ত্রী
মোহাবিষ্ট সংসার নিষিদ্ধ পাঁচিল লৌকিকতার
মুগ্ধ পরম্পরা অনিচ্ছার।।
স্বীকৃতির সৌকর্যে হতোদ্যম সিঁদুরী আলাপন
বৈধব্য অজন্মা জরায়ুুর চাতাল।।