মেলাখেলা
-----জীবনে বড় হতে হবে বাবা,মোবাইলে সময় নষ্ট ক''রো না।
-----মা আমি পড়েছি
-----অইটুকু পড়লে হবে না ।
-----;ঠিক আছে, কাল থেকে পড়বো
-----;কাল কাল করে কালে খাবে। আজকের কাজ আজকেই করো।
সমীরকে বুঝিয়ে বলছেন তার মা সোমা। জীবনে বড় হতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় বাবা। অনর্থক সময় নষ্ট করলে একদিন পস্তাতে হবে।
কিন্তু সমীর তিরিশ বছরে এখন প্রেমে পরেছে। তারপর আনলিমিটেড মোবাইল কল। শুধু মোবাইলের হেডফোন কানে লাগিয়ে কথা বলে চলে। অফুরন্ত কথা।
ওপাড় থেকে অভিমানের আওয়াজ ভেসে আসে।
----আর ফোন করো না কেন?
---ব্যস্ত ছিলাম
------ও আর আমার সাথে কথা বলাটা কাজ নয় বুঝি?
----না না তা বলছি না। মাকে নিয়ে মন্দিরে পুজো দিতে গেছিলাম।
---বেশ বেশ ভালো করেছো। কখন কেথায় দেখা হবে বলো।
----- বজরংবলির মন্দিরের কাছে। বেলা দশটায়।
বেশ তো ছিলো গ্রামের দিনগুলো। সংসারের অশান্তির ফলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তি পরিবারগুলো। এখন তারা শহরে বাস করছে। কিন্তু ভুলতে পারে না গ্রামের স্মৃতি।
তারপর মহিম পড়ার ঘরে বসলো। বই নিয়ে বসলে তার আর সময় জ্ঞান থাকে না। কখন যে সময়গুলো ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় বুঝতেই পারে না।
পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে পুরোনো দিনের কথা মনে পরে যায় তার। পরিবারের সবাই একসাথে একবার মেলায় যাওয়ার স্মৃতি মনে উঁকি দিচ্ছে বারেবারে।
গোরুর গাড়ি চেপে উদ্ধারণপুরের মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।
জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।
পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।
গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।
--- একটা তো, কিছু হবে না।
----- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।
তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।
গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।
মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।
জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।
তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।
বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।
মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।
তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।
মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।
মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে
তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।
ঘুরে ঘুরে লেখক অবধূতের আবক্ষ মূর্তি দেখলাম। শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।
এই উদ্ধারণপুরের মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি।
আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।
দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।
তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।
সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।
তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।
হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।
তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা।
আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো।
গোরুর গাড়ি বাড়িতে পৌঁছে গেলো।
আমি মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক।গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। বলতো,দাদু।
মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস,আই মিনে আয়। সুদপে,রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো।আবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা,জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিম
ধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে।আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।দাদুর পরম বন্ধু সিরাজুল চাচা বাড়িতে গেলেই মিষ্টিমুখ করাতেন। তার নাতি বিরাজুল আমার বড় উপকারি বন্ধু। মানুষের সংজ্ঞা ওই বাড়িতে গেলেই খুঁজে পাই।
তারপর সংসারের টানা পোড়েন।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতরন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।
উদ্ধারণপুরের শ্মশানে দাদুকে পোড়ানো হয়েছিলো। তখনও মেলার সময়। প্রচুর লোকজনের মিলনমেলা। মেলার মতোই মৃত্যুর পরেও সবাই মিলিত হয় এই উদ্ধারণপুরের মেলায়।
তারপর জীবনের আর এক পর্যায় শুরু হলো। আমার দিদি শোভা। তার জীবনে ঢেউ বেশিদিন টিকলো না। গর্জন স্তব্ধ হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়ি।
শোভা দিদির কপালের মাঝামাঝি একটা তিল তার মুখের শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছিলো । কিন্তু তার সিঁথির লাল শোভা একদিন সাদা হয়ে গেলো । অমাবস্যা র সেই রাত শেষ হতেই চাইছে না । ক্রমাগত একটা কান্নার আর্তনাদে দুই মেয়েকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার জীবনের গতিপথ । মাঝ সমুদ্রের দিক হারানো নাবিকের চুল ছেঁড়া চিন্তার মতো তার অপহৃত হৃদয় । শোভাদি মেরুদণ্ড সোজা রেখে তার বড়দার পরামর্শ মেনে যোগ দিলেন চাকরি জীবনে । আলো জাগলো আশার মনে । আমি তখন তেরো । শোভা দির রান্না আজও মুখে তৃপ্ত স্মৃতি জাগায় । শুনেছি অন্তরের আন্তরিকতায় সামান্য সব্জি অসাধারণ অমৃতের আস্বাদ আনতে পারে । খেয়ে চলে যেতাম আশ্রম পরিবেশে । আমার বড় আদরের শ্রদ্ধার বিরলতম বিদ্যালয় বিল্বশ্বর বিদ্যালয় । এক বটবৃক্ষের ছায়ায় শুরু হতো আমাদের প্রার্থনা সংগীত । অম্বুজাক্ষবাবুর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমাদের আজও পথ দেখায় । বিদ্যালয় অন্ত প্রাণ কোটিতে গুটি । শুধু স্মৃতি বয়ে বেড়ায় ভগ্মাবশেষ ।
বাড়ি ফিরে ফের মায়ের আঁচলের মতো শোভাদির অকৃত্রিম আদর ।মা তাকে নিজের বোনের স্নেহে মানুষ করেছিলেন ।
তারপর সুখে দুখে শোকে সময়ের চোরাপথে ঢুকে যায় সমগ্র ইতিহাস । মা বলতেন, কাল করবো বলে কোনো কাজ ফেলে রাখিস না । কালেই খেয়ে নেবে সব ।
মা আমার লড়াকু মহিলা । জীবনের অভাব অভিযোগ কোনোদিন তার হৃদয় ছুঁতে পারেনি । সেই হৃদয়ে ছিলো তালবোনা পুকুরের সাঁতরে তাল কুড়োনোর ছবি । নতুন পুকুর তর্ক করে এপাড় ওপাড় হওয়ার চির নতুন ছবি ।
সেইসব ছবি আজও মায়ের ঠোঁটে হাসির রেখায় চিত্রিত করে আমাদের নবহৃদয় ।
আজ বৃদ্ধা মা শুধু অপেক্ষার প্রহরে প্রহর গোনেন। চার ছেলেকে মানুষ করে মন যে ছেড়ে যেতে চায় না মায়ার আকর্ষণ । মানুষের পরমায়ু এত কম কেন? মা বলেন, ছেড়ে যেতে হয় বলেই তো জীবন মোহময়ী । তা না হলে ছন্দ পতন হয় যে ।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা মানব জীবন । কি করে , কে যে লিখেছেন সে রহস্য লুকিয়ে আছে লালনের গানে,জীবনের আনন্দে ।
আমার মেজদার নাম রিলীফ । জন্ম থেকেই মুক্তির টানে তার জীবনের উত্থান । প্রতিভার দৃষ্টি তাঁর আচার আচরণে । সে সংগীত ভালোবাসতো । সংগীতের সুরে সুরে সাজানো সংসারে সফল সাধক মানুষ । কথায় কথায় মানুষই দেবতা হয়ে যায় তার ভাবনায় । দাদা বলে, কোনোদিন দুঃখ ব্যাথাকে বড় করে দেখিস না গর্দভ । মনে মনে সুখ অনুভব করার নাম জীবন ।
বড়দা নিজের জীবনে কাজকে গুরুত্ব দেন বেশি । কথায় কথায় তার কথ্য ভাষা মনের অন্তস্থলের বন্ধ দরজার চাবিকাঠি । তিনি বলেন, টাকা পয়সা জীবনে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই ভালো । বেশি হলেই বিষ । মানুষকে ভালোবাসলেই যথেষ্ট । অভিনয় নয় । আন্তরিকতা একটা কুকুরও বোঝে ।
ছোটোভাই বাবু সকলের প্রিয় । বিপদে আপদে সকলের পাশে সতত জাগ্রত তার বিবেক । কোনো বিপদ তাকে চঞ্চল করতে পারে না । এ তো সাধকের লক্ষণ ।
আর আমি মানুষ হয়ে জন্মে এত ভালো পরিবেশে মানুষের কিছুই কি করতে পেরেছি?প্রশ্ন কুড়ে কুড়ে খায় তিন কুড়ির জীবন । আর কবে করবো মনের অপূর্ণ সাধ পূরণ। কত অভুক্তজন শুধু একমুঠো নুনভাত চায় । সমর্থ লোক যদি একটা মুখেও ক্ষুধার অন্ন জোটায় , তাহলেই যথেষ্ট ।
ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ
আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো । পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি । হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ । পায়ে হেঁটে । গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কয়ার । জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর । বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরী কে । তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো ।অমিত রান্না করতো খুব ভালো । পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম । ও শেফ হতে চেয়েছিলো । অনিন্দিতা বলে বান্ধবী টা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো । কিন্তু সব স্বপ্ন গুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো ।
অই বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে । রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে । অসীম গান করে,বিচ্ছু একতারা বাজায় । অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে । ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে । হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক।
আমার মা গল্প করতেন তার নতুন অভিজ্ঞতার কথা।
সব জা , একত্রে মিলিত হতো ননদ বা দেওরের বিয়েতে। একবার বাসু দেওরের বিয়েতে পুণ্যলক্ষী বৌদি ছেলে সেজেছিলো। প্যান্ট, জামা পরে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটা লাঠি নিয়ে অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলে বিয়ে বাড়িতে। সব জা রা প্যান্ট পরা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে যখন ভাশুরদের সামনে দাঁড়ালো,মাথা লজ্জায় নিচু করেছিলো পুরুষদল। তখনকার দিনে এটা একটা ভীষণ সাহসের ব্যাপার ছিলো। অভিনয়ের শেষে যখন জানতে পারলো প্রকৃত ঘটনা তখন সকলে হাসাহাসি আর চিৎকার শুরু করলো। নতুন বৌ বুঝতে পারতো একান্নবর্তী পরিবারের আনন্দ। বিয়ের শেষে যে যার চাকরীর জায়গায় চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা লাগতো। নতুন বৌ এর ভালো লাগতো না। স্বামী চলে যেতো চাকরীর জায়গায়। বাড়িতে মা, বাবা আর বেকার দেওরের দল। তারপর জলের ধর্মে যে কোনো পাত্রের আকার ধারণ করতো নতুন বৌ। বাবা,মায়ের সেবা,দেওরের খাওয়া, রান্নাবান্না সব নজরে রাখতে হতো নতুন বৌকে। প্রাণমন ছটফট করতো বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে রাজী করে শর্ত মেনে যেতে হতো বাবার বাড়ি। তখন পুরোনো মাটির গন্ধে নতুন বৌ ভুলে যেতো সব না পাওয়ার দুঃখ।