নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

শুভঙ্কর রাহা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শুভঙ্কর রাহা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

স্নেহ : শুভঙ্কর রাহা



পাঁচ বছর হলো সে বাড়ি আসেনি। এই পাঁচ বছরে না এসেছে একটা ফোন, না এসেছে কোনো চিঠি, না কোনো খবর। প্রথম দিকে বেশ কয়েক মাস ফোনে চেষ্টা করা হতো, এখন সেই চেষ্টা প্রায় নেই বললেই চলে। এখন তো দেখছি বৌদি ঠিকঠাক সিঁদুর টুকুও মাথায় দেয় না।
জ্যাঠা আগে একাই চাষ করতো। একই জমির একদিকে লাগাত মুশুরি, একদিকে আলু আর পিঁয়াজ। আলু উঠলে পাট হতো। অন্য জমি গুলোতে ধান চাষ করতো। এখন আর পারে না। ছেলের চিন্তায় কিছুটা অকাল বার্ধক্য এসেছে। এখন বেশিরভাগ টা ভাগচাষী রাই চাষ করে, ফসল উঠলে ফসলের ভাগ আর টাকা মিলিয়ে যা হাতে আসে তাতে ওদের তিনজনের সংসারে বিলাসিতা না থাকলেও ভাতের অভাব নেই। জেঠি বরাবর ঘর-গৃহস্থালি, গরুর গোয়াল নিয়েই ব্যস্ত ছিল, আজও তাই। তবে গরু টা আর নেই তাকে বিক্রি করে একটা ছোটো ছাগল নিয়েছে, আর বাকি টাকা টা ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাখা আছে। ছাগল টাকে জেঠি আর বৌদি মিলে দেখা শোনা করে। বৌদি রোজ নিয়ম করে কাঁঠাল পাতা খাওয়ায় ছাগল টাকে।

বিকাল হলে বৌদি ছাদে ওঠে। আমাদের ছাদ আর বৌদি দের ছাদের মাঝে একমানুষ দূরত্ব। প্রথম প্রথম বৌদির ছাদে ওঠা টা আমাকে উৎসাহ দিত একরকম adrenaline rush বলা চলে। বৌদিকে দেখিয়ে দেখিয়ে ১০-২০ টা স্কিপ বেশি করতাম, পুশ আপের সংখ্যাও বেড়ে যেত। বৌদি সেটাকে কেমন ভাবে নিত তা আমার জানা নেই। কিছুদিন পর থেকে আর এমনটা করতাম না, আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম বৌদি কিছু বলতে চেয়েও ইতস্তত বোধ করে। তাই আমিই একদিন বৌদির কাছে জ্যেঠির শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে জানতে চেয়ে কথা শুরু করার চেষ্টা করলাম। পাশের বাড়ির জেঠিমার স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়ার মতো বোকা বোকা প্রশ্ন দিয়ে কথা বলার অজুহাত দেখে বৌদি তো আমাকে নিয়ে বেশ ঠাট্টা করলো। আমিও ব্যাপারটা উপভোগ করলাম।
তারপর থেকে রোজ বিকালেই বৌদির সাথে কথা হতো, নানান রকম কথা। সে কথা কত ডালপালা বিস্তৃত করে, আমি নিজেকে সামলে নিই। পাড়ার বয়জেষ্ঠ্য রা বাঁশ পেকে ট্যাস ট্যাস করার আগে তাকে কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়ে যায় জ্যাঠা কে। বন্ধুরা আমাকে ভ্রু তুলে,  মাথাটা হালকা বাঁ দিকে বেঁকিয়ে ইশারা করে। পাড়ার টাইম কলে জল আনতে গিয়ে শুনলাম ' ছেলেটার কি দোষ? ওই মেয়েছেলে টাই ফুসলেছে। আসল ব্যাপার হলো অভাবে স্বভাব নষ্ট। বাড়ির রোজগেরে পুরুষ যদি বাড়িতে না থাকে তাহলে যা হবার তাই হচ্ছে।'
আমি জলের জায়গাটা ভরে একবার থুতনি টা তুলে আবার সেটাকে নামিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

পাঁচ মিনিট,,,, শুভঙ্কর রাহা




বিয়ের দিন রীতিমত বর উঠে বসলো ঘরের চালে। শিউলি তার বরের উদ্দেশ্যে বলল-
"চালে থেইকে নামো তুমি, নিড়ানি খুঁইটে খাইয়াইবো আমি"।

বিয়ের দিনের কথা অনুযায়ী জমিতে নিড়ানি দিয়ে না হলেও ওই পাশের পাড়ার নকুল দত্ত মশাইয়ের বাড়িতে কাজ করে সংসারের কিছুটা সাহায্য করতো শিউলি রাজোয়ার। স্বামী রমানাথ তখনও আড়পেটে।
রাজমিস্ত্রি দলের প্রধান সেদিন বলল- ' রমা তুর তো দেখছি হাত ভালোই পাকা হইছে রে। ত রাজমিস্ত্রী হবি?'

সে দিন থেকে রমা রাজমিস্ত্রি। বউকে শুনিয়ে রেখেছে, ' বুঝলি শিউলি তুই আর কামিন খাটবিক লাই। উ দত্ত গিন্নি কে বইলে দিবি অন্য কামিন খুঁইজে লিতে।'
তারপর সেদিন তিনতলায় কাজ চলছিল গ্রামের হাইস্কুলের। সদ্য ডি. এম সাহেব এসে জমি ঠিক করে গেছিলেন। সুখ আর দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ভাড়ার বাঁশ খুলে পড়লো রমানাথের উপর। দুটো বড় পেরেকও ঢুকে গেল, একটা মাথায় আর একটা ডান কাঁধে।
ডাক্তারবাবু বললেন,' পাক্কা ছয় মাস বিশ্রাম'।

দু মাস গেল, তিন মাস গেল। ঘরে আর টাকা নেই। ডাক্তার, ওষুধে যে অনেক টাকা গেল। পেরেকের ক্ষতগুলো সেড়ে গেলেও ব্যাথা টা এখনো বেশ আছে। এদিকে বাজারে এখন থেকেই ধার বাড়ছে।
সুভাষ মুদি তো সেদিন বলেই উঠলো, ' চালের দাম টা কিন্তু বাকি আছে। সঙ্গে দুটো নুনের দাম পাই। '

শিউলির অনেক চাপ। একদিকে টাকা নেই। অন্য দিকে স্বামীর কামিন খাটার উপর নিষেধাজ্ঞা। যাকে বলে ধর্ম সংকট।

-' শিউলি রে। তুকে আমি উনেক কষ্ট দিয়ে ফ্যালছি রে। আমি যদি একটু ওপর পানে তাকাতাম তাইলে আর আমার ওপরে পইড়তো না। '
-' ছাড়ো ওইসব। তুমার তো ওষুধ ফুরাই যাইচ্ছে। এই টা তো কাল সকাল অবধি চইলবে'।

-'আর খাবো না রে। আর তো টাকাও নেই মুনে হয়।'

শিউলি রান্না ঘরে উঠে গিয়ে চোখের জল মোছে। তারপর ফিরে এসে বলে-
' তুমি ৫ মিনিট বসো। আমি আইসছি। '

ছুট্টে গেল শিউলি দত্ত গিন্নির কাছে। দত্ত গিন্নির উঠোন ঝেঁটিয়ে, উনুন নিকিয়ে, বাসন মেজে অগ্রিম ৫০০ টাকা নিয়ে ওষুধ কিনে বাড়ি এলো শিউলি। দত্ত গিন্নি কে কথা দিয়ে এলো কাজ না ছাড়বার।
এতক্ষণে প্রায় ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেছে।

- রমা বিছানায় শুয়ে বলে উঠল সেই কখন ৫ মিনিট বলে বেড়িয়েছিস। এই তোর সেই ৫ মিনিট? '


দিবস গুলি পালিত হয়:শুভঙ্কর রাহা




২৭ শে জুন ।
গত কয়েক বছরের মতো এইবছরেও দেবু দা সকাল সকাল পৌঁছে গেছেন Lilabati Orphanage এ। সাথে নতুন জামাকাপড়ের কয়েকটি সেট, হরেকরকম মিষ্টি ভরা কিছু প্যাকেট এবং একটা কেক।
পৌনে আটটায় প্রার্থনা সেরে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলো অদ্ভুত এক আনন্দ এবং নতুন কিছু চমকের আশায় দেবু দার কাছে এসে হাজির হলো। দেবু দা কেক কেটে সেই কেক , উপহার এবং মিষ্টি গুলো ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলোর মধ্যে ভাগ করে দিলেন।

ওখান থেকে বেরিয়ে অফিসরুমে এসে এক টুকরো কেক orphanage এর কর্তা সৌমিত্র বাবুকে দিয়ে দেবু দা বললেন, " সৌমিত্র বাবু এটা আপনার জন্য।"

সৌমিত্র বাবু কেকের টুকরো টা খাওয়া শেষ করে দেবু দা কে জিজ্ঞেস করলেন, " দেবব্রত বাবু, গত ৭ বছর ধরে আপনাকে দেখছি প্রতি ২৭ শে জুন আপনি এই ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু গুলোর সাথে দিনটি উদযাপন করেন। কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করি? "
-" আরে না না কিছু মনে কেন করব? অবশ্যই জিজ্ঞেস করুন। ", দেবু দা বললেন।
- " এই ২৭ শে জুনেই কেন? আজকের দিনটিতে কী হয়েছিল দেবব্রত বাবু? "

দেবু দা একটু থমকে গেলেন। চুপ করে নরম হয়ে যাওয়া চোখের কোনা দুটো মুছে দেবু দা বললেন," সৌমিত্র বাবু, তখন আমি কলেজের লাষ্ট ইয়ারের ছাত্র । আমার বাড়ির থেকে ২ টো গলি পাশেই সোহিনী থাকত। আমি বই-খাতা গুছিয়ে টিউশন যাই, সে দাঁড়িয়ে থাকে গলির মাথায়। উৎসুক চোখ, হেয়ার ব্যান্ডে ঢাকা ছোট চুল। ফ্রকের লেস আঙুলের মাঝে জড়াতে জড়াতে লক্ষ্য করে আমার চাপ দাড়ি বেয়ে নেমে আসা জল, লক্ষ্য করে কপাল থেকে গড়িয়ে আসা ঘামে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চশমার কাঁচ, অদক্ষ সাইকেল চালকের মতো কাঁপতে থাকা হাত, এককথায় সর্বাঙ্গ।

এভাবে একদিন আলাপ হলো। কথা হলো।
তারপর একদিন বিকেলে বাড়ি ফিরছি ওদের গলির সামনে দিয়ে। পথ আটকে বলে উঠলো, 'দেবু দা জানো আজ আমার জন্মদিন।'
আমি বললাম কি রে তুই? আগে জানাস নি কেন? আজ তো তোর দিন রে পাগলি। কী নিবি তুই বল?
ও বললো, ' দেবে যা চাইবো?'
আমি বললাম, আমার সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই।
ও বললো, ' দেবু দা আমাকে ওই অনাথ আশ্রম টায় নিয়ে যাবে? ওই নিষ্পাপ ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে আজ দিনটা কাটাব।'

আমি ওর এই মিষ্টি বায়না রেখে ওর মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছিলাম সেই প্রথম। শেষবারও বটে।
কারন তারপর তার না বলা বায়না টা আমি বুঝতে পারা সত্ত্বেও আমি মুখ ফুটে তাকে বলতে পারি নি।

শেষে আমাকে বলেছিল, "ভিতু তুমি একটা"।
তারপরেই দৌড়ে তার শেষ চলে যাওয়া।

সৌমিত্র বাবু আজই সেই ২৭ শে জুন। সোহিনীর জন্মদিন। ও তো একমাত্র মুখফুটে এটাই চাইতে পেরেছিল আমার থেকে। "

সৌমিত্র বাবু তখন হতভম্ব। মনে মনে ভাবছেন- এইভাবেও দিবস পালন করা যায়?
হ্যাঁ। আমাদের চেনা অচেনা পরিবেশের মধ্যেই এমন কতশত দিবস পালিত হয়। হ্যাঁ এইভাবেই দিবস গুলি পালিত হয়।