পর্দা ফাঁস
*********
বাড়ির অমতেই হোক আর অবশেষে ছেলের ভালোবাসায় সিলমোহর দিয়ে পাত্রী নির্বাচনে বিবাহের প্রস্তুতি শুরু করার পরই হবু শশুর মশাই ঢাক পেটাতে শুরু করলেন, "বৌমা দারুন বুদ্ধিমতী,কোনো এক কোচিং সেন্টারে রিসিপশনিস্ট পদে জব করেই নাকি আঠারো হাজার টাকা বেতন পান! " কথাটা এখনকার হলেও না হয় বটে কিন্তু দশ বছর আগে কোন মফস্বল শহরের কোচিং সেন্টারের বেতন এত ! শুনে হেঁচকি উঠলেও বাড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলাটা দারুন টেকনিক ,সবাই পারে না!
যেখানে সেই সময়ে সরকারি স্কুল টিচার এর মাইনে শুরু হতো আঠারো হাজারের কিছু বেশি দিয়ে! কিন্তু তাতে কি? উনার ঢাক পেটানোকে গ্রামের অনভিজ্ঞ মহল আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশি বিস্ময় চোখে "তাই নাকি ,আরে বাহ" বলেই খুশি সেখানে নীরব না থাকলে বদনাম জুটবে,হিংসা করছে বলে!
কিছু কিছু মানুষ এমন টা করে মানে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে বেশ মজা পান ।ভাবখানা এমন,"কেমন চমকে দিলাম ,বোকা হাঁদার দল কিচ্ছু টেরও পেলো না! কিন্তু সে বা তিনি এটা বোঝেন না ,যে তার সাধের ফোলানো বেলুন, ফুটো হলেই চুপসে যাবে । যে টুকু হৃৎগৌরব এসেছে, সেটাও লোক হাসি হয়ে গিয়ে পড়ে থাকবে রসকষহীন এড়িয়ে যাওয়া,বা গুরুজনদের বলা যায়না ,সামনে বলা উচিতও নয়, সেই অন্তঃসারশূন্য সমীহ টুকু।
বিয়ের পরে পরেই কোন এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম। নতুন জামাই পেয়ে বাড়ির কর্তা, সারাদিন যে কতবার, ফিরিস্তি দিলেন,রাজকীয় খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছেন বলে। খাওয়া-দাওয়া ,মাংস নাকি প্রচুর পরিমানে,এলাহী ব্যাপার ! রাজকীয় বিয়ে বাড়ির পরিবেশে এসে পড়েছি ভেবে বেশ গর্বিত হচ্ছিলাম কিন্তু ভুল ভাঙলো বাস্তবের ছবি কড়া নাড়াতে! · হলোটা কি তিন নম্বর ব্যাচ থেকে মাংসের টান! চার নম্বর ব্যাচ থেকে মিষ্টির কমতি শুরু হলো! আমরা যখন ছয় নম্বর ব্যাচে খেতে বসলাম, গোটা কয়েক শুকনো কচুরি ছাড়া কিছুই নেই !
এখানে আমি দোষের কথা বলছি না ,বিয়ে বাড়ির মত পবিত্র অনুষ্ঠানে এত লোককে খাইয়ে ভবিষ্যতের ভাঁড়ারে টান পড়ানোর কোনো মানেই হয় না ,কিন্তু তবু এই যে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা, বাস্তবের সঙ্গে এমন অসামঞ্জস্য এটা বোধহয় ঠিক নয়।
কোন কোন বাবা-মাকে দেখি, বাইরের লোকের সামনে ছেলে-মেয়ের দারুণ প্রশংসা করেন। সাবাস ,বলে পিঠ চাপড়ে দেন আবার এটাও দেখি যত ভালোই পড়াশোনা করুক না কেন,অনেক বাবা মা বেশিরভাগই নিন্দা করে ,বকা ঝকাও। ওনাদের উদ্দেশ্য একটাই যে,সন্তান যেন শেখে ,আরো ভালো করে পড়াশোনা করে ,মানুষের মতো মানুষ হয়।
কোন এক কাক,ভাইপোর ওকালতি পড়তে যাবার খবর, যেভাবে গ্রামের লোকের সামনে দিয়েছিলেন , বেশ মজাই লাগছিল শুনে ,"বাপরে বাপ, পাঠ্যক্রমে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিনা ভাগ্না হাইকোর্টের উকিল হয়ে গেছে !এমন বাড়িয়ে প্রচার সিনেমার গতিকেও হার মানায়!
ছোটবেলা থেকে বাড়িতে অনেক পত্রপত্রিকা, সৌজন্য সংখ্যা আসার সুবাদে অনেক গল্প পড়তাম সে সব স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও একটা অবাক করা মজার গল্প পড়েছিলাম ।লেখকের নামটা ঠিক মনে নেই তবে গল্পের নাম ছিল," রুপার বর মাস্টার"। সংক্ষেপে বিষয়টা ছিল," গ্রামের এক সাধারণ মেয়ের হঠাৎ বিয়ের সম্বন্ধ আসে মাস্টার পাত্রের সাথে ! চাকরির এমন আকালে,ভালো পাত্র হাত ছাড়া কি করা যায় ! তাই মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল রুপার।
অষ্টমঙ্গলায় বেড়াতে আসা জামাই কে ফুরসৎ পেয়ে,কেউ ইস্কুল টা কোথায় জানতে চাইতেই বিপত্তি। ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। জামাই ও অবাক,সে জানালো ,"স্কুল মানে?আমি তো ব্যান্ড পার্টির ব্যান্ড মাস্টার!!" এক্ষেত্রে অবশ্য বড় মিসান্ডারস্টান্ডিং ই দায়ী।ভালো পাত্র হাতের নাগালে চলে যায় পাছে, নানা প্রশ্নে! আবার পাত্রপক্ষ জানিয়েছেও ভাসা, ভাসা যে পাত্র মাস্টার! তবু তথ্যের অভাবে এত বড় অঘটন !
কখনো দেখি পাড়ার কোন বাড়ির গার্জেন, পাড়ার অন্যান্যদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথা ছোড়েন ! ভাবখানা এমন যেন,আমার ছেলে বা মেয়ে সোনার টুকরো আর বাকিরা দোষে ভরা!কিন্তু চোখ ,কান মাথা খেয়ে ,অধিক প্রশ্রয়ে সেই বাড়ির ছেলে বা মেয়ে, প্রেম-ভালোবাসা,প্রণয়ে জড়িয়ে অঘটন ঘটায় যখন ,মুখে কুলুপ এঁটে,খিল দিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে দেন সেই বাড়ির অভিভাবক গণ। কোন সমালোচনা করে বলছি না,রোমিও দাপটে ধোঁকা খাওয়া সত্যি খারাপ কিন্তু তা বলে বাকিরা সব খারাপ, আমি ভালো আর আমার দুধে ভাতে থাকা সন্তানরা সেরা,কেবল, এটা ঠিক নয়।
একবার বন্ধুর পিসির বাড়ির ছোটখাটো বারোয়ারি পুজোতে গিয়ে বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছিল।সামান্য আয়োজনের দু চারটে দোকান আসা মেলায় কোনো এক মধ্য বয়সী আধিকারিক জামাই ঘুরে ফিরে দেখছিলেন। কেউ কুশল কামনা করলেই ,তাদের ঘুরে ফিরে উত্তর দিচ্ছিলেন যে,ওনার ছেলে এবার,মাধ্যমিকের রেসাল্ট বেরুলে মেধা তালিকায় প্রথম না হলেও পাঁচের মধ্যে থাকবেন।
এতবার করে উনি ফাটা ক্যাসেট বাজাচ্ছিলেন ছেলের কি বলবো!গ্রামের সাদা সিধে সরল মুখের মানুষ গুলো চমকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন ওনাকে।এরই মাঝে ওনার ছেলেটি ,সমবয়সীদের সঙ্গে খেলতে খেলতে বাবার কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়ে জিলাবি কিনে, পিছন দিক দিয়ে একাই খেতে খেতে চলে গেল ! একা যে খেতে নেই ,ভাগ করে খেতে হয় কে শেখাবে ওকে? এটা ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। একা খেয়ে খেয়ে আর পিঠ চাপড়ানো প্রশংসা দেখেই বড় হয়ে ওঠা তার।
এই বিষয়ের উপর যত আলোকপাত করব,তার শেষ নেই।মানুষের চরিত্রের নানা দিক নগ্ন ভাবে ফুটে উঠতেই থাকবে । ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ জমানায় নিত্যনতুন অ্যাপের দৌলতে , সবাই এমন ঝাঁ-চকচকে নিজেদের ছবি আপলোড করে,বেশ দারুন লাগে। কিন্তু সে বা তিনির সঙ্গে বাস্তবের ছবির মিল থাকাটাও জরুরি।তবেই না আমার আমিতে আমার বাস! জানিনা বাপু এতে, মনের কনফিডেন্স ঠিক কতটা বাড়ে বরং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষনে এটা এক প্রকার হতাশা, ফুরিয়ে যাবার বহিঃপ্রকাশকেই ইঙ্গিত করে।
এইভাবে কখনো কেমন পর্দাফাঁসের বিষয় প্রকাশ্যে,গোপনে,মনের গহনে বেআব্রু হয়ে যায়।আজ মানুষের কিছু চেনা প্রকৃতির,এক ঝলক ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম ।এখানেই শেষ নয় আসলে এই আলোচনার সত্যিই কোন শেষ নেই।