নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

পবিত্র চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
পবিত্র চক্রবর্তী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বাতাসে বারুদের গন্ধ :পবিত্র চক্রবর্তী


                (এক)


বাতাসে একটা জোলো জোলো গন্ধ উঠছে । সেদিনও ঠিক এমনটাই ছিল । আর মেশানো ছিল তাজা বারুদের গন্ধ , পোড়া লাশের কূট ঘ্রাণ । সব মিলিয়ে বাতাসকে আরও ভারী করেছিল । দীর্ঘ ৪৮ বছরের কথাটা খবরের কাগজে কিছু লেখা পড়েই মনে পরে গেল জামাল সাহেবের । কর্মজীবন থেকে অবসর আর কিছুকাল পরেই । বিশেষ কিছু জমাতে পারেন নি যদিও । কেমন করেই বা জমাবেন ! সরকারী স্কুলের চাকরীটা এপার বাংলায় ৭১ এর পর এসে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পেয়েছিলেন । বয়স তখন ৩৫ ছুঁইছুঁই । সুলেখা লাল আন্দোলনে তখন ব্যাস্ত । ওরই ঠিক করে দেওয়া কানাগলির এক কামরা ঘরে শেষমেশ থাকতে শুরু করে যুবক জামাল ।
বিষয়টা যত সহজে লেখা হচ্ছে তা কিন্তু নয় । বাঙাল বাড়ীর মেয়ে সুলেখা । দেশ ভাগ হওয়ার পর বাবা এ দেশে চলে আসেন । কিন্তু তখনও সম্পর্কের,ভালো লাগার বাঁধ ভাঙে নি । সুতরাং যাতায়াত ছিলই । বাংলাদেশে মামা বাড়ীতে মাঝেমধ্যে যেত সুলেখা । আর ঠিক তখনই পরিচয় হয় জামালের সাথে । কলেজ পড়ুয়া দুজনাই । কেন জানি না  প্রথম দেখাতেই  ভালো লাগাটা ভালবাসায় পরিনত হয়ে যায় ।
সম্পর্কের বন্ধন দূরে থাকলেই হয়তো বেশী করে উপলব্ধি হয় । আর  এ দূরত্বটা কাঁটা তারের এপার আর ওপারের । ভিন্ন ধর্ম , দেশের । কিন্তু থামে নি তাদের অনুরাগের স্পর্শ । প্রথম প্রথম পার্টির কাজের নাম করে সুদূর কোচবিহারের বাংলাদেশ সীমান্তে যেখানে দুটি দেশের কাঁটা তার চলে গেছে ঠিক সেখানে বেড়ার এপার ওপার থেকে মনের কথা , হাতের ছোঁয়া চলত । যদিও সেটা বেশীদিন চলে নি , কারণ ৭১ এর মুক্তি আন্দোলন ।
সেদিন ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেছিল জামাল , “ যদি বল তাহলে আসবো কী চলে ?”
হাল্কা হেসে সুলেখা উত্তর দিয়েছিল , “ এসো না , আমি তো আছি ।“ বড় ভরসার কথা ‘ আমি তো আছি ‘ কথাটা ।


                             (দুই)


আপত্তি করে নি সুলেখার বাড়ীর কেউই । ছোট থেকেই কান্তিবাবু তার মেয়েকে একটু অন্য ভাবে মানুষ করতে চেয়েছিলেন ,হয়েও ছিল তাই । জামাল আর সুলেখার বিয়ে হয়ে যায় । ভালবাসার জন্য দেশকে ভুলে যায় নি জামাল । হ্যাঁ প্রথম দিকে কান্তিবাবু বা জামালের বাবার মনেও এই চিন্তাটা এসেছিল । কিন্তু আর যাই হোক জামালের আত্ম মর্যাদাটা একটু বেশীই ।
বিয়ের কয়েকদিন পর বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জামাল স্বাধীন বাংলাদেশে না ফিরে গেলেও এখান থেকে চেষ্টা করে গেছিলো পাশে থাকার । আজও করে ।
দেখতে দেখতে ছটি বছর কেটে যায় । সংসারের হাল কোন মতে চলে । জামাল বাংলার টিউশন করে আর সুলেখা রাজনীতি , ছাত্র আন্দোলনের ফাঁকে হাত মেশিনে ব্লাউজ বানায় । আর ঠিক এরই মধ্যে সন্তান । সুলেখা আর জামালের মেয়ে । নাম রাখে রূপকথা । রূপকথার মতই তো । না আছে কোন দেশের গণ্ডী , না আছে ধর্মের ঝাঁঝালো গন্ধ । রূপকথা সকলেরই ।
সময়ের তালে নদী যায় বয়ে । আর ক্রমে সেই বহমানতার সাথে মেশে বেশ কিছু তরতাজা রক্ত । সুলেখা তারই বলি হয় । জামাল রাজনীতি কোন কালেই বোঝে নি , বোঝার চেষ্টাও করে নি । তা বলে সুলেখাকে বাধা দেয় নি । সুলেখাও ধীরে ধীরে কোন ফাঁকে যে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে গেছিলো তা নিজেই বুঝে ওঠার আগেই ছিন্নভিন্ন করেছিল পুলিশের বুলেট । বুকটা রাতের অন্ধকারে হাহাকার করলেও সেই বুকেই মাথা রেখে ঘুমাতো রূপকথা । তবে অপুষ্টি আর জণ্ডিসে রূপকথার মৃত্যু শক্ত মুসলিম হৃদয়কে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছিল । কানাগলি ছেড়ে কয়েক মাস স্থান হয়েছিল মেন্টাল এসাইলামে ।
শেষ হয় জামালের অধ্যায় , ভালবাসার পর্ব ।




                     (তিন)

কাকারা বহুবার ফিরে যেতে বলেছিল জামালকে , নাহ জামাল এ অঞ্চল-সুলেখা-রূপকথা স্মৃতি মাখা একটুকরো জমি ছেড়ে যায় নি ।
“ ওরে পাগল একা বাঁচা যায় না , শাদিটা আবার কর “ কাকার কথায় অবাক চোখে তাকিয়েছিল কিছুক্ষন ।
অস্ফুট স্বরে বলে , “ বাঁচা যায় না বুঝি !” বাঁচার অর্থ যে হারিয়ে ফেলেছে সে একা থাকার অর্থই বা বোঝে কী করে ! বিয়ে হয় এদিকারই মেয়ে মাসূমার সাথে । সত্যি মাসূমার মত নিষ্পাপ । বাপের জমিজমা বেশ আছে পশ্চিমবাংলায় । দেখতে শুনতে মন্দ না , পড়াশুনা জানা । এত সুখ ! নাহ এত সুখ না । অর্থ দিয়ে হয়তো সব কেনা যায় না । দেহ কেনা গেলেও মন ! নাহ মনকে বিক্রী কোনদিনই করে নি মাসূমা । মাসূমা ডান হাত জন্ম থেকে অকেজো , পোলিওতে সরু ।
জামালের মত ছেলে যার হিন্দু স্ত্রী-কন্যা গত হয়েছে , মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল । এমন মানুষকে মন থেকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল সে । মনে মনে নিরাপদ হয়েছিল এই ভেবে যে আর যাই হোক এই মানুষটা ভালবাসতে জানে ।
বলা যায় একহাতেই মাসূমার সেবা আর বাপের পয়সার দৌলতে জামাল শুরু করে দ্বিতীয় অধ্যায় । যে বিয়ের আশাই ছেড়ে দিয়েছিল সেই মেয়ে এখন গর্ভবতী । জামাল সুস্থ অনেক । রাতে মাসূমার পেটের উপর কান পেতে আগামীর নড়াচড়া শোনে ।
বাচ্চাদের মত মুখে এক ঝলক হাসি । মাসূমার দিকে তাকিয়ে বলে , “ আসছে রূপকথা ।“
মাসূমা বোঝে জামালের হৃদয় । তাও সে তো সতন্ত্র । পাশ ফিরে খানিক অভিমান করে বলে , “ যদি ফারহান আসে ?” ফারহান আধুনিক , ভাগ্যবান । যদি ফারহান তার আধুনিক-নতুনের স্পর্শে সকল অতীতের কষ্টকে ভুলিয়ে দেয় ? নারী মনে ওঠে এই আশা বারবার ।
রূপকথা আসে নি ,এসেছিল ফারহান ।  সেও বড় হতে থাকে । জামাল ভালোবাসে কিন্তু প্রশ্রয় দেয় মাসূমা । না অন্যায় প্রশ্রয় নয় কিন্তু প্রচ্ছন্ন আবেগ ভাঙা ভালোবাসা ।



                       (  চার)


আজ বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ । মাধবীলতার গা দিয়ে জল চুঁইয়ে পরছে । স্কুল ছুটি । মাসূমা জামালের পাশে বসে চা খায় ।
“ বাড়ী আছেন ?” বাইরে কলিং বেলের শব্দ । বাইরে খানিকটা শোরগোল ।
মাসূমা উঠতে যাবে , জামাল ওকে হাতের ইশারায় বসতে বলে নিজেই দরজা খুলতে গেল ।
“ ফারহান আপনার ছেলে ?” পুলিশের কথা শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে ।
“ হ্যাঁ কিন্তু…” শুকনো গলায় জানতে চায় জামাল । মাসূমা এরই মধ্যে উঠে এসেছে । মুখে উৎকণ্ঠা । এখন যা অবস্থা চারিদিকে ।
“ থানায় চলুন । আপনার ছেলে আমাদের কাছে আছে ।“ পুলিশের কথায় গলা বেয়ে আসে কান্না মাসূমার ।
জামাল আকাশের দিকে আল্লার কাছে জানতে চায় মনে মনে “ কেন প্রতিবার আমারই সাথে ?”
জামাল একা আসে নি । ঠিক সেই আগের মতই মাসূমা তার একহাত দিয়ে জামালের হাত ধরে আছে । পুলিশের গাড়ী ছেড়ে দেয় । পিছনে পরে থাকে মাধবীলতা , ঘর ।




বড়বাবু মন্দ লোক নন বরং খাতির করেই বসালেন । হাসতে হাসতে বললেন , “ জব্বর ছেলে তৈরী করেছেন আপনারা মশাই । এতবড় কাজ করে ফেলল !”
জামালরা জানে ফারহান দস্যুর মত । কোন বাধাই সে মানে না , পড়াশোনায় তেমন মন কালেই ছিল না । করুণ চোখে তাকায় বড়বাবুর দিকে । খানিক পরে ছেলে আসে ।
“ একটু ফর্মাল জিজ্ঞাসা বাদ করেই ছেড়ে দেব । আসলে ও আজ খেলে আসার সময় বাসে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে ওদের পিছনে পিছনে ডেরা অবধি যায় । যখন বোঝে ওরা মানে জব্বর , আবু মিস্ত্রী মেট্রো ষ্টেশনে অ্যাটাক করার মতলব আঁটছে ঠিক তখনই ভয় না পেয়ে থানায় ফোন করে । আর ধরা পরে…। ব্রেভ বয় ।“
জামালের চোখে জল । মাসূমা বলে , “ ও তো তোমার রূপকথা গো । রূপকথারা কী খারাপ করতে পারে …।“
জামালের চোখে ভেসে ওঠে সেই ছোট্ট জামাল বাবার কাছে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আবৃতি করছে –
“ ধর্ম তুমি কোথায় থাকো
চুল , ত্বক না গোঁফের তলে ?
সত্যি তুমি থাকছো কোথায়
টাক , টিকি না দুই বগলে ?

ধর্ম তোমার কোথায় নিবাস
বোরখায় না লাল সিঁদুরে ?
ধর্ম কাকে দিচ্ছো মদত
মৌলবি না জাত হিঁদুরে ?

ধর্ম তুমি থাকছো কোথায়
চুল , দাড়ি না পৈতে গিঁটে ?
কোথায় তোমার আসল ঘাঁটি
মক্কায় না তারার পিঠে ?

ধর্ম তুমি কোথায় ঘোরো
বাবরিতে না রাম-দুয়ারে ?
ভাসছো নাকি শুনতে পেলাম
রাজনীতি আর ক্রোধ জোয়ারে ।

ধর্ম তুমি তৃপ্ত কিসে ,
কুরবানি না বলিদানে ?
কখন তুমি নাড়াও মাথা
আজান নাকি গীতার গানে ?

ধর্ম নাকি আড্ডা মারো
ব্লাডব্যাঙ্ক আর হোটেলগুলোয় ,
আড্ডা নাকি মারছো শুনি
কবরখানায় শ্মশান চুলোয় ;

ধর্ম তোমার ইচ্ছেটা কী
বিচ্ছেদ আর রক্তমাখা ?
স্রষ্টার সব সৃষ্টিকে কী
ধন্দ দিয়ে সরিয়ে রাখা ??”
                         ( সমাপ্ত )

পবিত্র চক্রবর্তী







আজব পুরাণের গপ্প
****************


                          ( ১)
       
সে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের কথা । তখন দুর্গা ঠাকুর বসন্তকালে সিংহের পিঠে চেপে বাপের বাড়ী আসতেন । সময়টাও ছিল খাসা । বসন্তের ছোঁয়ায় প্রকৃতি হরেকফুলে সেজে উঠত । মা মেনকা আর অন্যান্য সখীরা নানা ফুল তুলে এনে কত রকম সাজ বানাতেন । আহা কৈলাস দেখো , চারিদিকে বরফ আর বরফ ! কী আর করা বাপ-মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শীতের দেশে বিয়ে দিতে বাধ্য হন । সে যাইহোক যা হওয়ার হয়ে গেছে । বছরে এখন একটিবার মেয়েকে কাছে পেয়ে কত আদর করে , চুমু দেয় । আর দাদু প্রাচীনবর্হি সে তো আনন্দে দিশেহারা ।
একদিন সকালবেলা আঙুরের রস পান করতে করতে দেবী দুর্গা তার দুই বোন কদ্রু আর বিনতার সাথে সাধের ফুল বাগিচায় ঘুরছেন । দুর্গাকে কাছে পেয়ে ফুল গাছেদের শরীরেও খুশী । দেবীও তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন । কিন্তু কেন জানি না আজ সকাল থেকেই পার্বতীর মনটা কেন জানি না খারাপ । বড় বোন মশকরা করে জিজ্ঞেস করেন , “ হ্যাঁ রে পার্বতী ভোলানাথের জন্য মন খারাপ নাকী ?” দেবীর মুখে হাসি কিন্তু মনের কোথাও কী যেন না থাকার দুঃখ । এই বাগানেই বাসা বেঁধে থাকে নীলকণ্ঠ দম্পতি । পার্বতীর মনের কথা বুঝতে পেরে তারা টুঁই টুঁই করে গান গাইতে গাইতে বলে –
“ বাসন্তীর মনে বসন্ত নেই-
তাই তো মা হারিয়েছে খেই ।
শ্যামদেশে আছে এক বৃক্ষ-
ফুটলে ফুল যাবে সব দুঃখ ।”



                                  ২

প্রজাপতি দক্ষ চিন্তায় আকুল । কী এমন গাছ যা তার বাগিচায় নেই ? আর শ্যামদেশ সেটাই বা কোথায় ? সুপ্রাচীন দাদু প্রাচীনবর্হি নাতনীর মনের দুঃখের কথা জানতে পেরে প্রপিতামহ ব্রহ্মার আশ্রম ব্রহ্মলোকে যান । ব্রহ্মা বলেন “ দেখো বাছা প্রাচীনবর্হি আমি বিশ্বের সকল কিছু সৃষ্টি করলেও বয়েসের কারনের বর্তমানে কিছু স্মৃতি বিলোপ ঘটেছে । তুমি বরং বিষ্ণুলোকে যাও ।” 
প্রাচীনবর্হি সেখানেও যান । কিন্তু ভগবান বিষ্ণু তখন অনন্ত শয্যায় , ঘুম ভাঙানো যাবে না । অবশেষে নারদমুনির পরামর্শে ভারতবর্ষের পূর্ব দিকে শ্যামদেশ (বর্তমানের থাইল্যান্ড) থেকে আনা হয় শেফালি ফুলের গাছ । পরম যত্নে তা লাগানোও হল , কিন্তু ফুল বসন্ত শেষেও আর ফোটে না । এ যে বড় বিড়ম্বনা । 
                
                                   ৩

এদিকে রাবণের আক্রমনে সকল দেবকুল চিন্তিত । ভগবান বিষ্ণু তখন রাম অবতারে ধরায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাণপ্রিয় সীতাকে উদ্ধারের আশায় । কিন্তু পরাক্রমশালী রাবণকে বধ করা যে সহজ নয় তা জেনেই শরৎকালের এক সকালে কালিয়াদহের পাড়ে বসে একাগ্র চিত্তে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করে বসেন । এই সময় দেবকুলের ঘুমানোর সময় । কী আর করা দেবীকে রামের কাছে পাঠানো হল পরম শক্তি দেওয়ার জন্য । রাম দেবীকে একশো আটটা নীল পদ্মে পূজা দিলেন । একেই ঘুমের সময় কিন্তু একটা মিষ্টি গন্ধে দেবীর মুখ পরম আনন্দে ভরে উঠলো । তিনি দেখলেন , অনেক ফুলের মাঝে শ্বেত-স্বর্ণ কান্তি ক্ষুদ্র কিছু ফুল । দেবী শ্রীরামের কাছে জানতে চান , “ বৎস এহেন মধুর ফুল কোথায় পেলে ?” করজোড়ে রাম জানায় , “ দেবী এ ফুল এ দেশে কেবল আপনার পিতার বাগানে শরৎকালেই ফোটে । আপনার পিতামহ এনেছিলেন ।”
এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা । শোনা যায় এরপর থেকেই দেবী দুর্গা কেবলমাত্র প্রিয় শেফালি ফুলের জন্যই শরৎকালে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ী আসেন । রামকে আর সেই নীলকণ্ঠ পাখীকেও আশীর্বাদ করেন । ফলে রাম যুদ্ধে জয়ী হন আর নীলকণ্ঠ পাখী শরৎকালের দুর্গাপূজায় মায়ের সাথে খানিকটা পূজা পেয়ে থাকে ।
গপ্প শুনে আমার ভাগ্নী পটা তো দিব্যি খুশী । আমাকে বলল “ মামা এ গল্প কোথায় পেলে ? বন্ধুদের বলতে হবে তো ।”
আমি বললাম , “ খবরদার ! এ শুধু তোর আমার গপ্প , ‘ আজব পুরাণে ’এসব আছে লেখা ।।”



পবিত্র চক্রবর্তী




হারিয়ে যাওয়া সেই গান
******************



প্রবন্ধের শুরুতেই জানিয়ে রাখা সমীচীন যে আমি কোন গবেষক নই । প্রানের আনন্দে ও জানার আগ্রহে কিছু মনের কথা লিখি মাত্র । তাই ভুলের সম্ভাবনা যে একেবারেই থাকবে না তা কিন্তু নয় । মাতৃভাষা যেহেতু বাংলা এবং এই ভাষা নিয়ে দীর্ঘকাল ছাত্রের মত শিখে চলেছি তারই ফলশ্রুতি বর্তমান প্রবন্ধটি ।

সঙ্গীত তুমি কে ?

প্রথমেই জানা দরকার সঙ্গীত আসলে কী এবং এর সাথে গানের কী পার্থক্য ? সঙ্গীত হচ্ছে যে গীত সংগত হচ্ছে, অর্থ্যাত বাদ্য-যন্ত্র সংগত করে যে সুর বা গান পরিবেশিত হচ্ছে। সম-গীতকেও সঙ্গীত বলা যায়। সঙ্গীত পরিবেশিত হবার আগে এর কিছু অধ্যায় পরিবর্তিত হতে হয়। সঙ্গীতের প্রথম অধ্যায় হচ্ছে গীত বা গানের কথা, তারপর সেই গীত সুরের বলয়ের মধ্যে অধিষ্টিত করা, তারপর সেই সুরারোপিত গান কে বিভিন্ন বাদ্য-যন্ত্রের অনুষংগ দ্বারা আবদ্ধ করা এবং শেষ পর্যায় হচ্ছে কন্ঠ শিল্পী এবং যন্ত্রী দ্বারা সেই সঙ্গীত পরিবেশন করা। সুতরাং গীত হচ্ছে সঙ্গীতের প্রথম ধাপ যাকে আমরা গানের কথা বলে থাকি। কাব্য এবং গীত হচ্ছে ছন্দের ভিন্ন ধরন। কাব্য স্বতন্ত্র ভাবেই গতিশীল এর ছন্দের দ্বারা কিন্তু গীত, সুরারোপন ছাড়া গতিশীলতায় বর্তায় না। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন জাগে সঙ্গীতের উদ্ভব কী করে হল ? মানুষ কী প্রানের আদি অবস্থা থেকেই গান এবং অবশেষে সঙ্গীতের ধারায় উদ্বেলিত হতে লেগেছিল ?
সঙ্গীতের প্রাগৈতিহাসিক কাল
নানা গবেষকের মতানুসারে সংগীতের অস্তিত্ব অন্তত ৫৫,০০০ বছর আগে সম্ভাব্যভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল আফ্রিকায় এবং তখন থেকেই নানা বিবর্তন ঘটতে ঘটতে এটা একটা মৌলিক নিয়োজক হয়ে ক্রমেই মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক সংগীত, আরো একবার সাধারণভাবে বলা হয় আদিকালীন সংগীত, প্রাকসাহিত্যিক সংস্কৃতির সময়কালে প্রস্তুত সমস্ত সংগীতের এই নাম দেওয়া হয়েছিল, ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের অনেক দেরিতে কোথাও এর শুরু হয়েছিল। প্রায় সারা উইরোপে (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রাগৈতিহাসিক সংগীত অতীত সংগীত দ্বারা অনুসৃত হোত এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ইউরোপীয়-প্রভাবিত অঞ্চলে, এমনকি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলেও সংগীতের অস্তিত্ব ছিল।
ভারতীয় সংগীত হল বিশ্বের প্রাচীনতম সাংগীতিক ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটা।  সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার স্থাপত্য শিল্পের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তাতে নৃত্যশৈলী এবং সাংগীতিক যন্ত্রপাতি দেখা যায় (তার মধ্যে কয়েকটা দীর্ঘকাল ব্যবহার হয়না), যেমন সাত ছেঁদাওয়ালা বাঁশি। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো থেকে স্যার মর্তাইমার হুইলার  দ্বারা খননকার্য চালানোর সময় বিভিন্ন ধরনের তারের যন্ত্রাদি এবং আনদ্ধ তালবাদ্য উদ্ধার করা গিয়েছিল। ঋগ্বেদ বর্তমান ভারতীয় সংগীতের আকর গ্রন্থ, ছন্দ এবং গায়কীর ঢঙের সঙ্গে সাংগীতিক স্বরলিপি লেখা হোত। গোড়ার যুগের ভারতীয় সংগীত ঐতিহ্য বলছে তিনটে উচ্চারণ ভঙ্গি এবং কণ্ঠ সংগীত যেটা 'সামগান' নামে পরিচিত ('সাম' অর্থে সুর আর 'গান' অর্থে গাওয়া)।
ভারতীয় লোকসঙ্গীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
লোকসঙ্গীত বা লোকগীতি একটি প্রাচীন প্রবাহমান শিল্প। অতীতে তার শিকড়, বর্তমান ডালপালার বিস্তর, ভবিষ্যতে অজানিত সম্ভাবনা। পন্ডিতদের মতে প্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে (ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার, আসাম, রংপুর, দিনাজপুর এলাকা) বাস করতো নিগ্রোজাতি। এরপর আসে নব্য প্রস্তর যুগ। আসামের উপত্যাকা অতিক্রম করে আসে অস্টিক জাতীয় জনগোষ্ঠী, তারপর আসে দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়রা। এদের মিলিত স্রোতে ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যাকায় মানবসভ্যতার সূচনা হয়। এরাই লাঙ্গল দিয়ে চাষের প্রবর্তণ করেছে। সৃষ্টি করেছে ভাব, ভালোবাসা। সুখ, দুঃখ ভাগাভাগী করে তারা চলতে শিখেছে। যে হেতু চাষের প্রবর্তন করেছে তারা আবার এই চাষাবাদ নিয়েই হিংসা আত্ম কলহে মেতে উঠেছে প্রতিনিয়ত। আবার একক ভাবে কোন কাজ সমাধা করতে না পারলে দলীয়ভাবে তার সমাধা করেছে।
নেতৃত্বের জন্য তারা মারামারী বা কলহ করেছে ঠিকই কিন্তু কোন উৎসবে তারা এক হয়ে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠেছে একে অপরের সাথে। শাস্ত্রীয় ভাবে না হলেও সঙ্গীতের সাথে ছিলো ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। খুব প্রাচীনকালে ভারত উপমহাদেশের লোকসঙ্গীতের রুপ কেমন ছিলো তা আজ আর নিরুপন করার উপায় নাই। তবে বিভিন্ন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে এটা শ্বাচ্ছন্দেই বলা যায, বিগত সমাজ আজকের ধাচ ধরন অনুযায়ী যখন শ্রেণি বিভক্ত হয়নি বা নানান অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীতে থাকা বিশিষ্ট হয়নি তখন সব এলাকায় লোক সঙ্গীতের রুপ কমবেশী একই রকম ছিলো। তার সুর ছিলো মন্থর, শান্ত, ধীল লয় বিশিষ্ট। সেই সুরে যৌথ জীবনের সংগ্রাম, প্রেম, ভালবাসার আভাস পাওয়া যেত। নিশ্চয়ই তবে সে সংগ্রাম, ভালবাসা আজকের মতো অনেক ক্ষেত্রে উত্থাল সংক্ষুব্ধ, অস্থির, বে-মানান, অ-শালীন প্রকৃতির ছিল না। লোকসঙ্গীতের স্তর দুইটি ১.আদিম (প্রমিটিভ) সঙ্গীত. ২. লৌকিক (ফোক) সঙ্গীত। আমরা লোকসঙ্গীত বুঝতে চাইলে দ্বিতীয়টি বুঝবো।

কিছু লুপ্তপ্রায় লোক সঙ্গীত
সময়ের সাথে চলতে চলতে নদী যেমন পরিবর্তন করে দিক , কখনো হারিয়ে ফেলে তার দিক আবার কখনো বা মিসে যায় অনন্ত সাগরে । যে নদী ভুলেছে তার গতিপথ তাকে মনে রাখেই বা কতজন ! সেইরূপ যে সকল সঙ্গীত এককালে মানুষের মুখে মুখে বা প্রতি পার্বনে স্থান করে নিয়েছিল তা আজ সময়ের দাবীতে লুপ্ত । কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না তাদের ঐতিহ্য গাঁথা । বাংলায় লোকসঙ্গীতের অনেক গুলো রুপ আছে পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বিচিত্র, মনমুগ্ধকর সাজানো, গোছানো আছে কি না সন্দেহ। লোকগীতি বা লোকসঙ্গীত বলতে আমি শুধু সঙ্গীতাংশ আলোচনা করবো সাহিত্যাংশ নয়।
ভারতীয় অনেক সঙ্গীতাজ্ঞ লোকসঙ্গীতকে গোষ্ঠীর বা সম্মিলিত গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানে আমি তাদের মধ্যে কয়েকটিকে তুলে ধরার প্রয়াস করব ।
আইরির গান ঃ- আইরির গান অতি প্রাচীন গান। আইরি শব্দের অর্থ অরি, শত্র“। সেই শত্র“ বিষয়ক গানই আইরির গান। জানা গেছে সমাজের শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের গানই আইরির গান। গানের মাধ্যমে ঘৃণা জানাতো শোষিতরা। কোন কোন গানে পরোক্ষভাবে শোষকদের ঘৃণা করা হতো। ঠিক তেমনি একটি গান ।
আইরির গানের কথা
কথা : সংগ্রহ
সুর: প্রচলিত
আইরির দেইস আইরি ধর্মক কিছু থানরে
চৈতালি হিবানে কুগুলি কারে রাও
উঠে আইরি প্যাটের চিন্তা ধরি
হাতোত ধনুক শর অন্তরে ক্রোধ ভরের
যায় আইরি শিকার করিবার
ধায় আইরি হরিণ মারিবার
হিল্হিলা সোন্দারী বাও
ফর্কায় নেটু তর্পায় গাও রে ॥
এক চৈত্র মাসের সকালে কোকিল পাখী সুমধুর গান গেয়ে শুভ দিনের সূচনা করে। ঠিক সে সময়ে এক শত্র“ শিকারী পেটের চিন্তা করে ধনুক হাতে অন্তরে জিঘাংসা বৃত্তি নিয়ে বনে শিকার করতে যায়। সে বোঝেনা হরিণ, হরিণীর, কোকিলের কষ্ট। সে নিজের পেটের জন্য যে কাউকে হত্যা করে ।
আইরির গান সে সময় ভাল কাজের দিক নির্দেশনা দিয়ে ছিল। আইরির গানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আভাস পাওয়া যায়। এ গান এক সময় অবিভক্ত বাংলায় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা গেছে তবে এখন বিলুপ্ত। কি কি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হতো তা জানা যায়নি।
আগমণি গান ঃ- আগমণি গান বাংলাদেশে তেমন প্রচার লাভ করতে পারেনি। কিছুটা প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেছিলো। উত্তর বঙ্গে কোন এক সময় গাওয়া হতো। তবে ভারতের পশ্চিম বাংলায় এক সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তবে এখন তা প্রায় বিলুপ্ত। এ গান মূলত শরৎ কালে গাওয়া হয়ে থাকে। অনেকে মনে করতেন আগমনী গান শরৎকালীন গান।
এক সময় বাউল ধরণের গায়কেরা এ গান গেয়ে বেড়াতো। এখন অবশ্য এ গান তেমন একটা নজরে পড়ে না। গানগুলো ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক বা কোন ঘটনার উপর রচনা হতো। বাদ্যযন্ত্র হিসাবে তেমন কিছু থাকতো না একতারাই বেশি ব্যবহার করা হতো।আগমণি গানের কথা-
রচনা : সংগ্রহ
সুর : প্রচলিত
গিরি রাজার কন্যাগো উমা কেঁদে কেঁদে হলেন সারা
অশ্র“ ধারায় নদী বয়ে যায়
বছর একটি গেলো ঘুরে, বাপের বাড়ি যাবার তরে,
অভিমানে কথা কয়না গোসা ঘরে ধায়।
মর্ত্যলোকে গিরি রাজকে কহেন ডাকি
উমা বিহনে আমি কেমনে ঘরে থাকি।
আলাপনী গান ঃ- এ গান রুপ কথা, ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক বিষয় বস্তুর উপর গাওয়া হয়ে থাকে। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সময় ব্যাপক প্রচলিত ছিলো। ইহা কোন আনুষ্ঠানিকতার গান নয়। কোন বাড়ির বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বসিয়ে আলাপচারিতার মাধ্যমে গাওয়া হয়। এ গানের কোন তাল, লয় থাকে না। গাযক তার ইচ্ছোমতো গাইতে থাকেন এবং ছন্দের কোন মিল থাকেনা। অনেক সময় উপস্থিত রচনার মধ্যে গাওয়া হয়।
আসন হিসাবে থাকতো বাঁশের চাটাই। সকলে এই আসনে বসে তন্ময় হয়ে এ গান শূনতো। মুসলমানদের মধ্যে জোলা, কারিগরদের মধ্যে এ গান বেশি প্রচলন ছিলো। ঘটনাগুলো অনেকটা এ রকম কোন সওদাগর বানিজ্য করতে বিদেশে গেছে সেখানে কোন গ্রাম্য বালিকার সাথে তাঁর মন দেয়া নেয়া হয়েছে। আবার রাজপুত্রকে রাক্ষস খেতে গেছে, রাজপুত্র তরবারী দিয়ে রাক্ষসকে হত্যা করেছে ইত্যাদি।
আর হিন্দুদের মধ্যে দেখা যায় কোন রাজপুত্র শিকার করতে করতে গহিন বনের ভিতরে প্রবেশ করে দেখে অপুর্ব সুন্দরী এক রমনী গুহায় ঘুমে অচেতন হয়ে আছে। সোনর কাঠি, রুপার কাঠি দিয়ে তাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে রাজপুত্র আদি ইতিহস জানতে চায় এর মধ্যেই তাদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা জন্মে যায়। গাছ পালাকে সাক্ষী রেখে হাতের আঙ্গুল কেটে সিঁথির সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করে ফেলে। কথা বলার মধ্যে চলে আসে রাক্ষস, তখন যুদ্ধ হয় রাজপুত্রের সাথে। তাতে রাক্ষসকে পরাজিত করে রাজপুত্র। ঐ রাজকন্যাকে নিয়ে রাজপুত্র বাড়ি ফিরে। এ গান গুলো করে ছোটদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করা হতো বলে মনে করা হয়।
আলাপনী গানের কথা-
রচনা : সংগ্রহ
সুর : প্রচলিত
সুখে থাইকো থাইকো সুখেরে রাজপুত্র
সুখে থাইকোরে রাজকন্যা
যদি সতীর মুখের কথা সুপ্রভাতে ফলেরে
বাসরের প্রদীপ যেন সাত পুরুষে জ্বালায়রে ॥
আবিষ্কারের গান ঃ- বাংলা ভাষী লোকজন এক সময় শিক্ষা দীক্ষায় খুবই পিছিয়ে ছিলো। বলতে গেলে সমগ্র বিশ্বে এশিয়া মহাদেশের ভারতবর্ষই ছিলো পিছিয়ে। বিশ্ব ইতিহাসে ১৬৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৭০৫ খৃষ্টাব্দ ছিলো মহা আবিষ্কারের যুগ। তখন সমগ্র ইউরোপে চলছিলো নিত্য নতুন যান্ত্রিক আবিষ্কার। ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের পরে যখন এ দেশের ক্ষমতা বৃটিশদের হাতে চলে যায় তখন বেশ কিছু ইউরোপিয় যান্ত্রিক বাংলাদেশের (পঃবঙ্গ ও বাংলাদেশ) আসতে থাকে। সেই সব সামগ্রীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়তে থাকে এ দেশের জনমানসে। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ষ্টেশনের জনৈক কর্মচারী শ্রী স্যান্নাল (৭০) জানান, এগান মূলত: প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতিমনা লোকজনরাই প্রসারে সাহায্য করেছিলো। এ গান প্রচার করে বৃটিশ বিরোধী জনমত সৃষ্টি করা হতো।
বাদ্যযন্ত্র বলতে কিছুই থাকতো না। শ্রমিকদের মধ্যে সে সময় এ গানের যষ্টে জনপ্রিয়তা ছিলো। তবে এখন এ গান বিলুপ্ত।
আবিষ্কার গানের কথা
কথা: সংগ্রহ
সুর: প্রচলিত
দেখরে ইংরেজ বেটা কি কল বানাইছে
সাত সাগর পাড়ি দিয়া আমার দেশে আইসাছে
জঙ্গল কাইটা সড়ক দিছে
সেই সড়কে তার লাগাইছে
ঘন্টার খবর ঘন্টায় আনতাছে ॥
বোলান গান ঃ- বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পর থেকে শিবের গাজন উপলক্ষে বোলান গান গাওয়া শুরু হয়। বোলান গানের মূলত ৪টি প্রকার— দাঁড় বোলান, পালা বোলান, সখী বোলান ও শ্মশান বোলান। বঙ্গীয় শব্দকোষ থেকে জান যায় ‘বোলান’ শব্দের অর্থ সম্ভাষণ বা প্রবচন। মতান্তরে ‘বুলা’ বা ভ্রমণ থেকেও বোলান গানের উৎপত্তি হতে পারে বলে মনে করেন একদল লোক গবেষক। বোলান গান বা বোলান হল প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের লোকগান তথা বাংলার এক প্রাচীন লোকগান। বোলান গান বাংলার লোকস্কৃতির একট অনন্য অবদান। এক সময় বীরভূম,  নদিয়া বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোলান গান প্রচলিত ছিল।
বোলান গান একটি দল হিসাবে গাওয়া হয়। এই গান ঢোল এর বাজনার তালে গাওয়া হয়। ঢোল বাদকরা ঢোল বাজায় আর দলপতি গান করে। অনেক সময় এই গানের সঙ্গে নৃত্য শিল্পী থাকে যারা গানের তালে তালে নৃত্য করে। দলপতির সঙ্গে সহযোগিরাও গান করে। সহযোগিদের গান গাওয়াকে বলা হয় ধৌয়া তোলা। বোলানগান সামাজিন ও পৌরানিক বা দেবদেবীদের নিয়ে পালা আকারে উপস্থাপন করা হয়। পালা বাদার জন্য একজন থাকেন প্রতিটি দলে। দুর্গা ও শিবের বোলান পালা বেশ জনপ্রীয়। গাজনের অনুষ্ঠানে বোলান গান হিসাবে বোলান গান গাওয়া হয়।
পাতা গীত ঃ- ' পাতা '-র সাঁওতালি প্রতিশব্দ হল ' পরব ' বা উৎসব ; তাই আক্ষরিক অর্থে পাতা গীত একধরনের পরব গীত । মূলত সমাজের কয়েকটি যৌবনতাড়িত গোপন হৃদয়ঘটিত সংবাদ বা তথ্যকে কেন্দ্র করে পাতাগীতের বিষয়বস্তু গড়ে ওঠে। নারীমনের আদিম অনাবৃত প্রণয়-সুখের মুখরিত এই গানের ভাষা সহজ ও সরল হলেও, ভাবব্যঞ্জনা গভীর। এর সুরে ও অম্ল-মধুর কটাক্ষে ধামসা-মাদল নৃত্যের ঐকতানে তারা যৌবনরসের মাদকতায় মেতে ওঠে । এই গীত মূলত পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ পুরুলিয়ার দিকে গাওয়া হয়ে থাকে । যদিও বর্তমানে এই গানের খুব একটা চল আর লক্ষ্য করা যায় ।
চট্‌কা গান ঃ- চট্‌কা গান  উত্তরবঙ্গে প্রচলিত এক ধরণের লোকগীতি যা আসলে ভাটিয়ালি না ভাওয়াইয়া গানের অধপতিত বা অপভ্রংস রূপ।[ ভারতের কোচবিহার জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর জেলায় এই গানের জন্ম।[২]চট্‌কা মূলত তাল প্রধান সুরে রচিত। হালকা তাল ও ছন্দে পরিবেশন করা হয়। এই গানে লঘু তাল এবং জলদ লয় ব্যবহার করা হয়। সেই কারণে দরিয়া গানের মতো প্রলম্বিত সুরের বিন্যাসের ধীরস্থির ভাব পাওয়া যায় না। চটকা ভাওয়াইয়াতে বিশেষ ঢং-এর দোতরার বাদনশৈলী পাওয়া যায়।  দৈনন্দিন জীবনের নিতান্ত সাধারণ বিষয় এই গানের উপজীব্য। এই গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগত কারণে সাধারণত উত্তর বাংলার শিল্পী ছাড়া এ গানের সুরসংযোজনা সম্ভব হয় না।
চটকা গানের সংগীত রচনাকারেরা এই গানের মধ্য দিয়ে সাংসারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, মনোমালিন্য, সন্তান-সন্ততি কামনা, সংসার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি বিষয় ব্যক্ত করেন ।
জল ভরার গান ঃ- বাঙালী হিন্দু সমাজে  বিবাহের দিনে বর ও কনে উভয়কে বিবাহের আগে নিজ নিজ বাড়িতে স্নান করানোর জন্য বিজোড় সংখ্যায় (সাধারণত ৫, ৭, ৯ জন) সধবা মহিলারা একত্রে কলসী কাঁখে, বরণকূলা ও অন্যান্য বিবাহ-সম্পর্কিত সরঞ্জাম হাতে নিয়ে পুকুর বা নদীর ঘাটে জল আনতে যান; তখন তারা উলুধ্বনি ও শঙ্খ সহযোগে  এক ধরণের হালকা চালের চটুল অঙ্গের গান পরিবেশন করেন — যা জল ভরার গান  নামে পরিচিত। জল ভরার গান বাংলার পল্লী অঞ্চলের একধরণের ব্যবহারিক (functional) বা আনুষ্ঠানিক সংগীত। মূলত বাঙালী হিন্দুদের  বিবাহের বিভিন্ন স্ত্রী-আচার পালনের জন্য নদী বা পুকুর থেকে জল আনার সময়ে এয়োতি মহিলারা একত্রে এই গান গেয়ে থাকেন ।
এই গানের কথা প্রধানত রাধা-কৃষ্ণবিষয়ক তবে হালকা রসিকতাও এতে স্থান পায় এবং এই গান গাইবার রীতি কেবল স্ত্রী-সমাজেই সীমাবদ্ধ। এই ধরণের ব্যবহারিক সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য হল, এগুলি অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্যসময় গীত হয় না। এরূপ একটি গানের নমুনা —
"ওগো, সাঁঝের বেলা কে তোরে
         জল আনতে বলেছে।
কে, জল আনতে বইলাছে।
ঘরের জল বাইরে ফেলে
     যমুনার জল আনতে গেলে,
না জানি কোন কালার
          সনে প্রেম মইজাছে।
কে, জল আনতে বইলাছে ।"
চোর-চুন্নীর গান ঃ- চোর-চুন্নীর গান বা চোর-চোরনীর গান হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি , কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার  জেলার একটি বিশিষ্ট আঞ্চলিক লোকায়ত সঙ্গীতরীতি। এগুলি মূলত পশ্চিম ডুয়ার্সের গ্রামাঞ্চলের রাজবংশী  কৃষক সমাজের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত দলবদ্ধ গান ।
চোর-চুন্নীর গান মূলত গাওয়া হয় কার্ত্তিক মাসে; কালীপূজার পনেরো দিন আগে থেকে শুরু করে কালীপূজার রাত পর্যন্ত সমবেতভাবে। গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষকের (যারা এই অঞ্চলে গিরি/ধনী/দেওয়ানী নামে পরিচিত) পৃষ্ঠপোষকতায় এসময় গানের একটি দল গঠন করা হয়; তাঁর বাড়ির বাইরের অঙ্গনে নিয়মিত গানের তালিম চলে। দলে থাকেন একজন মূল গায়েন, তার দোহাররূপে দু'তিন জন সুকণ্ঠী সহগায়ক থাকেন। এদের মধ্য থেকে একজনকে 'চোর' ও আরেকজনকে 'চুন্নী' সাজানো হয়। এছাড়া, দলে থাকেন বাদকবৃন্দ; তারা আবহ সুর-সঙ্গতের জন্য দোতারা, খোল, বাঁশী, সারিঞ্জা, জুরি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে থাকেন।
গানগুলির শুরুতে সর্বসাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে চোর চক্রপতি ভগবান কৃষ্ণ ও স্থানীয় লৌকিক দেব-দেবীর বন্দনা গাওয়া হয়। এরপর চোর-চুন্নীর গায়করা চাপান ও উতোরের কিছু অংশ গেয়ে ছেড়ে দিলে দোহাররা তা ধরে বিস্তৃত করে দেন সম্মেলক সুরে।
গানে, চোর ধনী জোতদারের বাড়িতে চুরি করতে যাবার পূর্বমুহূর্তে তার স্ত্রী চুন্নীর কাছ থেকে বিদায় নেয়। দারিদ্রপীড়িত নিরাভরণা স্ত্রীকে অবস্থাপন্ন সুখী মানুষের স্ত্রীর মতো মূল্যবান অলঙ্কার ও পোশাক-প্রসাধনে সজ্জিত করার আকাঙ্ক্ষা তাঁর। তাই সে হাসিমুখে বিদায় চায়, এবং স্ত্রীকে নিশ্চিন্ত করতে নিজের চৌর্যকৌশলের নিপুণতার কথা বলে আশ্বস্ত করে। তাঁর স্বপ্ন, এইভাবে সে সংগৃহীত অর্থের বিনিময়ে নিকটস্থ কোনও গ্রামে চাষের জমি কিনবে; আর সম্পদের অধিকারী হলে 'চুন্নী'ও একদিন হয়ে উঠবে আর্থিক মর্যাদাপ্রাপ্ত ধনবানের স্ত্রী। চোরের সমস্ত আশ্বাস সত্ত্বেও চোরনী তাঁর স্বামীর জন্য শঙ্কিত ও ভাবিত। এভাবেই চোর-চুন্নীর গানের কাহিনিপট বিস্তৃত হতে থাকে। গানের মাধুর্যে গৃহস্থ কৃষক শ্রোতাবর্গ আপ্লুত হয়ে পারিতোষিক হিসেবে গায়কদের চাল, ডাল ও নগদ অর্থ প্রদান করে।
অবিভক্ত বাংলা তথা বর্তমানের বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক কারনবশত বিভক্ত হয়ে গেলেও এর আত্মা আজও এক । এর কারণ উক্ত লোকসঙ্গীতগুলো , তাদের শিকড় এতটাই গভীরে রয়ে গেছে যা সকল দেশ-কাল-পাত্রের উর্দ্ধে । যে সকল লোকসঙ্গীত বা গীতির কথা লিপিবদ্ধ করলাম সেগুলি ছাড়াও সমগ্র বাংলার নানা প্রান্তে রয়েছে কীর্তন , ঢপ গান , ঘেঁটু গান , ছাদ পেটানোর গান , উত্তম ঠাকুরের গান , বাদী গীত ইত্যাদি ।


 তথ্যসূত্র ঃ-
বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা ।
ভট্টাচার্য, আশুতোষ (১৯৫৪)। বাংলার লোক সাহিত্য়|তৃতীয় খণ্ড। কলকাতা ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – ডঃ সুকুমার সেন , আসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।
উইকিপিডিয়া



পবিত্র চক্রবর্তী

চিরাচরিত গল্পের বাইরে


সে সময়টা ছিল বৃষ্টি আর বিদ্যুতের সঙ্গমকাল ,
বিদ্যুতের মৃদু আদরের ডাকের কাছে মেঘের অভিমান
সব বাঁধ ভেঙেছিল । তুমি এমনই এক বিকালে প্রশ্ন
করেছিলে , বৃষ্টি আর বিদ্যুতের লিঙ্গ কী !! ভাবতে
ভাবতেই একটা বাজ বেশ তীব্রতা নিল , আর , তুমি
আশ্রয় নিলে আমার আধ-খোলা বুকে । প্রকৃতপক্ষে
এদের লিঙ্গ পরিচয় কাব্যে থাকলেও আমার কাছে
অর্থহীন । তোমার শরীরময় ভিজে গন্ধ , আমার বুকের
উষ্ণতা , এদের পরিচয় নারী-পুরুষ হলেও ,
ভয় আর আশ্রয় অপেক্ষা করে না লিঙ্গ পরিচয় দিতে ।

আজও নেমেছে বৃষ্টি । এখন আমার শরীর ভেজে
চিরাচরিত ছন্দে । তোমার ধুয়ে গেছে কবেই চুল্লির আগুনে । উষ্ণতার ভিন্নতা । স্মৃতি সময়ের অন্তরালে
জমায় পলি । খালি বুকে ভরাট ক্ষয়িষ্ণু চিহ্ন ।
সব কিছুর কী লিঙ্গ হয় ? বৃষ্টি তোমার বজ্র কোথায় ??

পবিত্র চক্রবর্তী

কৃষি কথা
**********




কোন এক গ্রীষ্মের দিনে -
যখন ধরিত্রী সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ একাকিনী ,
যখন , বিদ্ধস্তা - বিবস্ত্রআ -
ভালোবাসার শেষ জলটুকু শুষ্ক -
তখন তোমায়,সংকোচে সংগোপনে 
রোপণ করেছিলাম আলতো দুটি 
আঙুল দিয়ে ,আমার মনের মাটিতে ;


তারপর ! তারপর যখন তোমার কচি কলাপাতার মতো ছোট্ট দুটি হাত আমার নির্জীবতাকে সজীব করলো , তখন -
বিস্ময়ে বললাম -"এত প্রাণশক্তি কোথা হতে তুমি পেলে ?" উত্তর পেলাম না ;
অনুভব করলাম সেদিনকার নরম দুটি হাত অজস্র শাখায় বিভক্ত হয়ে -
গভীর শিকড় দিয়ে মাটির কোনো এক অতল থেকে শুষে নিচ্ছে বিন্দু বিন্দু ভালবাসা ।


এসব কবেকার কথা ; জীবনের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ,হয়তো শেষ বসন্তের শেষ হাওয়াকে নিচ্ছি প্রাণভরে  ।
একটা একটা করে কত সূর্য ডুবলো ,
অঙ্কুর হল মহীরূহ ; হলদে পাতায় কত কথা ;আমরা দুজনে কথা বলি,চিন্তা করি,
সবাই যেমন শেষ দিনে শেষ কথা বলে...।


সেইবার শরতে,তাকে দেখেছিলাম ভোরে সদ্য স্নাত হয়ে - কপালে চন্দনের ছোট্ট ছোট্ট ফোঁটা পরে মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিল ; আহা! কি ন্যাকাটাই না লাগছিল । নরম দুটি গালে হাত রেখে বলেছিলাম-" কি গো,অমন করে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?" সেদিন তোমার কি হাসি ;


খসে পড়ছিল চন্দনের ক্ষুদ্র টুকরো -
আমার মনের মাটিতে ! আর যখন চোখ খুললাম ; ওগুলো কখন অগোচরেই হলদে পাতায় হয়েছে পরিণত ।


হয়তো,কোনো একদিন প্রবল ঝড়ে ঝরে পড়ব আমরা - এই মাটি থেকে অন্য কোনো এক মাটিতে ! হয়তো সেদিনের রোপিত স্মৃতি হয়ে যাবে টুকরো টুকরো -
স্মৃতিগুলো সব বিস্মৃতি হয়ে যাবেই ।
তবুও থাকবো আমরা এরই মাঝে -
ধরার হৃদয় পিঞ্জরে ,
আমাদের ঝরে পরা স্মৃতির
নতুন বীজের মাঝে নব সূর্যের অপেক্ষায়॥