নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

সায়নদীপা পলমল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সায়নদীপা পলমল লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মাতৃরূপেন : সায়নদীপা পলমল






"ইয়া চন্ডী মধু কৈটভাদিদৈত্যদলনী

ইয়া মহিষোম্মুলিনী

ইয়া ধুম্রক্ষণচন্ডমুন্ডমথনী

ইয়া রক্তবীজাশনি..."




কাঁপা কাঁপা হাতে রেডিওর নবটা ঘোরাতেই ভেসে এলো সেই কালজয়ী কন্ঠস্বর। আজও এই গলাটা শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এখন টিভিতে অবশ্য অনেক রকমের মহালয়া হয়, অনেক রকমের গপ্পো দেখায় তাতে, কিন্তু সেসবে মন ভরে না মঞ্জুলা দেবীর। মহালয়ার দিন সকালে তাই এখনও তাঁর সঙ্গী ফিলিপসের এই রেডিও। বহু বছর আগে মানুষটা কিনেছিলেন এটা। সময়ের অভাবে মানুষটা টিভি, রেডিও কিছুই দেখার বা শোনার সুযোগ পেতেন না, কিন্তু তবুও এই যন্ত্রটা কিনেছিলেন শুধুমাত্র আজকের এই দিনটার জন্যই, মহালয়া শুনবেন বলে। আজকে মানুষটা নেই, পাঁচ বছর হল মঞ্জুলা দেবীকে ছেড়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে। মানুষটা নেই, কিন্তু পেছনে রেখে গিয়েছেন এই বাড়ি আর তাঁর অজস্র স্মৃতি। সেই স্মৃতিরই একটা অংশ এই যন্ত্রটাও।

    রেডিওর নবটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শব্দটা পরিষ্কার করলেন মঞ্জুলা দেবী। তারপর উঠে গিয়ে বসলেন খাটে। যদিও সবে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ, তবুও গা'টা শিরশির করছে। ইদানিং তো প্রায় রাতদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, তার ওপর বয়সও হচ্ছে। শীতটা তাই সহজেই কাবু করে ফেলতে পারে। একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন মঞ্জুলা দেবী। বাইরে থেকে শিউলির গন্ধ ভেসে আসছে ঘরে, একটা ঠান্ডা বাতাস ছড়িয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে। কয়েকটা পাখির ঘুম ভেঙে গিয়েছে ইতিমধ্যেই, তারাও শুরু করে দিয়েছে তাদের কলতান। সব মিলিয়ে মনটা বড় ভালো লাগছে মঞ্জুলা দেবীর। আর মাত্র এক সপ্তাহের অপেক্ষা, তারপরেই তাদের এই বাড়িটা গমগম করে উঠবে, এখান থেকেও ভেসে উঠবে আগমনীর সুর। এই বাড়ির পুজোটা বহু প্রাচীন, আগে অনেক জাঁকজমক করে হত, হলোই বা সিংহবাহিনী ঘট পুজো, তবুও আড়ম্বরের কিছু কমতি থাকতো না। কিন্তু সময়ের সাথে তো সবই পাল্টায়, জাঁকজমক কমে আসছিল ধীরে ধীরে, তারপর মানুষটার চলে যাওয়ার পর তো সেই আড়ম্বরের মাত্রা ঝপ করে নেমে গেছে অনেকখানি। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে, মঞ্জুলা দেবীকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল তারা কিন্তু উনিই এই বাড়িটা ছেড়ে যেতে রাজি হননি। প্রত্যেক বছর মহালয়ার পর থেকেই এক এক করে আসতে থাকে ওরা, শুরু হয়ে যায় পুজোর তোড়জোড়। যতই কমুক জাঁকজমক, তবুও নিজের বাড়ির পুজোর ব্যাপারই আলাদা।


    কখন যেন আবার ঘুম ধরে গিয়েছিল মঞ্জুলা দেবীর। টেলিফোনের ঝনঝন শব্দে ঘুম ভাঙল। এতো ভোরে কে ফোন করবে তাঁকে! তবে কি ছেলেমেয়েগুলোর কেউ আজই আসছে? ধীর পায়ে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলেন তিনি।

"হ্যালো কাকিমা, আমি নবারুণ বলছি।" নবারুণ মঞ্জুলা দেবীর শ্বশুরমশাইয়ের জ্যেঠতুতোদাদার নাতি। আগে সম্পর্কগুলো ভালোই ছিল, তারপর কালের নিয়মে ফাঁকা পড়ে গেছে সব। তিক্ততার সৃষ্টি না হলেও সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়ে যায় সম্পর্কগুলোও, নবারুণদের সাথেও তাই হয়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ সকাল সকাল নাবরুণের ফোন পেয়ে একটু অবাকই হলেন মঞ্জুলা দেবী। অবাক ভাবটাকে গোপন রেখে বললেন, "হ্যাঁ বাবা বল।"

"কাকিমা ঠাকুমা কাল রাতে মারা গেলেন।"

"সেকি! কখন?"

"ওই ধরো রাত এগারোটা নাগাদ। মা বলল তোমায় জানিয়ে দিতে।"

    ফোনটা রেখে কাছের চেয়ারটায় বসলেন মঞ্জুলা দেবী। ফুল জ্যেঠিমা চলে গেলেন তবে! নিরানব্বই বছর বয়েস হয়েছিল, বিগত ছয় সাত বছর প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। নবারুণের মাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক করতে হয়েছে শ্বাশুড়ির। অবশেষে শান্তি পেলেন ফুল জ্যেঠিমা, শান্তি পেল বাকি মানুষগুলোও। তবুও কেন কে জানে কারুর মৃত্যু সংবাদ শুনলেই আমাদের ভেতরে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। ঘড়িটার দিকে তাকালেন মঞ্জুলা দেবী। ছ'টা পয়নতাল্লিশ। ডায়েরি দেখে মেয়ের নম্বরটা ডায়াল করলেন… সুইচ অফ। এখনও ঘুমোচ্ছে বোধহয়। মেয়ের নম্বরের নীচেই লেখা বড় নাতবৌ এর নম্বর। ওরাও কি ঘুমোচ্ছে! দেখাই যাক না। নম্বরটা ডায়াল করলেন মঞ্জুলা দেবী। একটু পরেই ধরল রিকিয়া, "হ্যালো ঠাম্মা বলো। তুমি ঠিক আছো তো?"

  "হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। তোমরা ঠিক আছো তো?"

"হ্যাঁ। তোমার নাতির কাল নাইট ডিউটি ছিল, এই ফিরল।"

"ওহ এবার তো তাহলে বিশ্রাম নেবে তো। তা বলছি দিদিভাই তোমাদের ফুল বড়মা মারা গেছেন কাল রাতে।"

  "তিনি কে ঠাম্মা?"

রিকিয়ার প্রশ্নে নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন মঞ্জুলা দেবী। সত্যিই তো মেয়েটা কি করে চিনবে ফুল জ্যেঠিমাকে! তিনি বললেন, "তুমি চিনবে না, আমাদের এক জ্যেঠিমা হতেন। তুমি দাদুভাইকে বলো, ও ঠিক বুঝতে পারবে।"

"আচ্ছা। কিন্তু ঠাম্মা আমাদের কি তবে অশৌচ?"

"হ্যাঁ, অশৌচ তো হবেই।"

"ওহ গড, তার মানে পুজো হবে না এ'বছর!"

রিকিয়ার কথা শুনে ব্যাপারটা মাথায় এলো মঞ্জুলা দেবীর, সত্যিই তো পনেরো দিনের অশৌচ তাদের, পুজোর আগে তো কাটবে না।

"হ্যাঁ দিদিভাই, পুজো আর কি করে হবে! তা তোমরা কবে আসবে?"

"পুজোই হবে না যখন গিয়ে কি করব! দেখি তোমার নাতিকে বলি।"

  নাতবৌ এর শেষ কথাগুলো যেন বুকে এসে তীরের মত বিঁধল মঞ্জুলা দেবীর। পুজো হবে না যখন তখন এসে কি করব….!


                                  ★★★★★


    "ও দিদিমণি কি ভাবছো?"

ছোট্ট পারুলের ডাকে সম্বিৎ ফিরল মঞ্জুলা দেবীর। কাল থেকে কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারছেন না তিনি। পুজো হচ্ছেনা শুনে ওরা কেউ আসতে রাজি হল না। মানছি অনেক ছুটি ম্যানেজ করে আসতে হয় ওদের, কিন্তু তা বলে একদিনও কি আসা যেত না? আচ্ছা ওদের কি একবারও মনে হল না এই বুড়িটা কিভাবে ওই শূন্য ঘরে কাটবে পুজোর চারটে দিন! সারা বছরের কথা এক, কিন্তু পুজোর দিনগুলোর কথা আলাদা। কার ভালো লাগে শূন্য ঘরে একাকী বসে থাকতে, যখন সারা বাংলার মানুষ মেতেছে আনন্দে!

"ও দিদিমণি কি হয়েছে তোমার?"

এবার উঠে এলো জগু। চোখের কোণে আসা ছোট্ট জলের ফোঁটাটাকে চট করে লুকিয়ে ফেললেন মঞ্জুলা দেবী। বললেন, "কই না তো। কি আবার হবে আমার?"

"কিছু একটা তো হয়েছে তোমার…" চোখ পাকিয়ে বলল বিন্দি। ওকে কোলে তুলে নিয়ে মঞ্জুলা দেবী বললেন, "তবে রে পাকা বুড়ি, আমার ওপর নজরদারি করা হচ্ছে! তা যেটা লিখতে দিলাম সেটা লেখা হয়েছে?"

"এই রে…" বলে জিভ কেটে বাচ্চাগুলো আবার যে যার বসে পড়ল খাতা কলম নিয়ে।

এই ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোই এখন মঞ্জুলা দেবীর জীবন। একসময় স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। বিয়ের পর শ্বাশুড়ি বলেছিলেন চাকরি ছাড়তে হবে, মঞ্জুলা দেবী রাজি হননি। বড় ছেলে হওয়ার পর তো চাকরি ছাড়ার জন্য চাপ আরও বাড়তে থাকে, সেই সময় ঘরে বাইরে সব দিক সামলাতে সামলাতে নিজেও হিমশিম খাচ্ছিলেন মঞ্জুলা দেবী। তখন তাঁরও মাথায় একবার আসে চাকরি ছাড়ার চিন্তা, কিন্তু এই সময় পাশে দাঁড়ান সেই মানুষটা। তিনি বলেন সবসময় মেয়েদেরই কেন স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে! সন্তান যখন দু'জনের তখন তাকে মানুষ করার দায়িত্বও দু'জনের। মানুষটার কথায় এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন মঞ্জুলা দেবী। শিক্ষকতা করা ছিল তাঁর ছোটবেলার স্বপ্ন, তাহলে শুধু শুধু সেই স্বপ্নকে কেন হারিয়ে যেতে দেবেন! মনের জোরকে সঙ্গী করে দাঁতে দাঁত চিপে এরপর তিনি সমানভাবে সামলে গেছেন ঘর বাইর দুটোই, মানুষ করেছেন চার ছেলেমেয়েকে। অবশ্য জীবনের এই যুদ্ধে প্রতিমুহূর্তে পাশে পেয়েছিলেন সেই মানুষটাকেও।

এরপর সময়ের নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, রিটায়ার করেছেন মঞ্জুলা দেবী, মানুষটা চলে গিয়েছেন তাঁকে ছেড়ে। এরপরেই অবশ্য মঞ্জুলা দেবীর মাথায় আসে এই চিন্তাটা। তাঁর বাড়ির কাছাকাছিই আছে বস্তিটা। ওখানের বাচ্চাগুলোকে দেখেছেন মিড-ডে-মিলের লোভে ইস্কুলে যায় ঠিকই কিন্তু পড়াশুনা তাদের শেখা হয়না আদৌ। বাড়িতে তো পড়াশুনা করার পরিবেশই নেই। তাই মঞ্জুলা দেবী নিজের পেনশনের টাকায় ওদের জন্য কিনে ফেলেন বই, খাতা, পেন্সিল। কেনেন একটা ব্ল্যাক বোর্ড আর চকও। তারপর প্রত্যেক সন্ধ্যেতে বস্তির সাত আটটা বাচ্চাকে পড়তে বসান নিয়মিত। বেশিরভাগ দিনই রাতের খাবারও খাইয়ে পাঠান। এই করে চলছে তাঁর দিন। অবশ্য ব্যাপারটা গোড়াতে এতোটা সহজ ছিলনা। প্রায় সপ্তাহ তিনেক নিয়মিত ওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাতে হয়েছে পড়াশুনো করার প্রয়োজনীয়তা। নতুন বই খাতা পেন্সিলের লোভ দেখাতে হয়েছে রীতিমতো। ফোনে তো মেয়ে ওনার কর্মকান্ডের কথা শুনেই রেগ আগুন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, "কি দরকার মা এসবের? বই পড়ো, গান শোনো, কোনো বয়স্কদের ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়ে যাও। সময় ঠিকই কাটবে, কিন্তু তা না করে এসব করার কি দরকার?"

মেয়ের কথা শুনে সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন মঞ্জুলা দেবী। এরপর থেকে মেয়ের কাছে আর এই প্রসঙ্গ তোলেননি কোনোদিনও। কিন্তু তিনি নিজে জানতেন তাঁকে কি করতে হবে। তাই তো হার মানেননি তিনি, অবশেষে বাচ্চাগুলো এক এক আসতে শুরু করেছিল তাঁর কাছে। আর এখন তো দিদিমণির ক্লাসে না এলে ওদের চলেই না।


    শুধু এখানেই থেমে থাকেননি মঞ্জুলা দেবী। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় একবার এক ক্যাম্পে গিয়ে শিখেছিলেন কিভাবে চিপস বানাতে হয়। এবার সেই বিদ্যেকেই কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। বস্তির কিশোরী মেয়েদের নিয়ে শুরু করেছিলেন চিপস বানানোর কাজ। প্রথম প্রথম উনি সম্পূর্ণ নিজের খরচে জিনিসপত্র কিনে আনতেন, তারপর মেয়েরা সেগুলো দিয়ে চিপস বানাতো। ওনার পরিচিত কিছু দোকানে সেই চিপসগুলো রাখতে শুরু করেন। লভ্যাংশ পুরোই দিয়ে দিতেন মেয়েগুলোকে। আস্তে আস্তে তাঁদের চিপসের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে লাভের পরিমাণও। এখন মেয়েরা নিজেরাই লাভের টাকা থেকে কাঁচামাল কেনে, ওদের সাথে যোগ দিয়েছে বাড়ির বউরাও। সব মিলিয়ে ওদের চিপসের ব্যবসা এখন বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এখন ওরা নিজেরাই সব কাজ করতে পারে, তবুও মাঝে মাঝে পরামর্শ নিতে আসে মঞ্জুলা দেবীর কাছে। উনি এখন ওই বস্তির সবার প্রিয় দিদিমণি। প্রথম দিকে বস্তির পুরুষেরা ওনার এই উদ্যোগকে মোটেও ভালো নজরে দেখেনি, নানান ভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করে ওনাকে। কিন্তু মঞ্জুলা দেবী কোনোদিনও হেরে পিছিয়ে আসতে শেখেননি, তাই তিনি দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই করে গিয়েছেন, অটল থেকেছেন নিজের সংকল্পে। অবশেষে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে ছেলেগুলো। এখন ওরা মঞ্জুলা দেবীকে যথেষ্ট সম্মান করে সকলে। রাস্তাঘাটে দেখতে পেলেই এগিয়ে আসে ওনাকে সাহায্য করতে।


     সব মিলিয়ে এদের নিয়ে মঞ্জুলা দেবীর চলে যাচ্ছে বেশ। তবুও পুজোর সময় বলে কথা! নিজের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিগুলোর জন্য বুকটা হুহু করে ওঠে। কিন্তু তাদের কি একবারও মনে পড়ে এই বুড়িটার কথা! তাদের কাছে তো পুজোর আনন্দটাই সব।


                                 ★★★★★


এবছর পুজো কমিটি থেকে কাছের বট গাছটায় একটা মাইক বেঁধে দিয়ে গেছে। ষষ্ঠীর দিন ভোর হতে না হতেই মাইকে ভেসে উঠল আগমনীর সুর…


"ইয়া দেবী সর্বভূতেষু

শক্তি রূপেন সংস্থিতা…"


গায়ে কাঁটা দেওয়া  মায়ের সেই স্তোত্র।  প্রত্যেকটা বাঙালীর মননে জড়িয়ে আছে এই মন্ত্র। বাঙালীর আবেগ, অনুভূতি সব কিছু জড়িয়ে এই পুজো…

গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন মঞ্জুলা দেবী। শিউলি গাছটার তলায় শ্বেত শুভ্র পাপড়ির সজ্জা, গাছটাও সাদায় সাদা, মাঝে মাঝে হালকা কমলা আলো। মৃদুমন্দ বাতাস দিচ্ছে বাইরে, বাতাসের সাথে ভেসে আসছে শিউলির সুবাস। পায়ে পায়ে তিনি এগিয়ে গেলেন শিউলি তলার দিকে। চাদরটা মেলে ধরে সংগ্রহ করতে লাগলেন শিউলি ফুল।

"এই টোপাই দেখ, তোর চেয়ে আমার ফুল বেশি…"

মঞ্জুলা দেবী দেখতে পেলেন গাছের তলায় প্রতিযোগিতায় মত্ত ছোটো নাতনি জুন আর নাতি টোপাই।

"দাদুভাই…" ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই আচমকা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা। হঠাৎ করে কান্না পেয়ে গেল মঞ্জুলা দেবীর। শিউলি গাছের গুঁড়িটা ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।


    ঘড়িতে এখন দশটা বাজে। বটগাছে লাগানো মাইকটার বোধহয় কিছু গন্ডগোল হয়েছে, চুপটি করে বসে আছে ঘন্টা দুয়েক। টিভিটা চালিয়ে দিয়ে সোফায় বসেছিলেন মঞ্জুলা দেবী। টিভিতে কি হচ্ছে সেদিকে মন নেই তাঁর। সেই যে সকালে একবার চা বিস্কুট খেয়েছিল তারপর থেকে আর কুটোটি কাটেননি দাঁতে। ইচ্ছে হয়নি। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। ছেলেমেয়েগুলোও পড়তে আসবে না এই কটা দিন। সবাই আনন্দ করবে পুজোয়। শুধু মঞ্জুলা দেবীই একা। কিন্তু হঠাৎ করে বাইরে একটা শোরগোলের আওয়াজ পেলেন তিনি, তারপরেই কেউ যেন বাইরের গেটটা খুলল। আশ্চর্য, এসময় কে আসতে পারে তাঁর কাছে! আজ তো কারুর আসার কথা নয়। উঠে গিয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পারুল, জগু, ঝিনটিদের দেখতে পেলেন এক সঙ্গে, ওদের পেছনে রুমকিরাও আছে। কি ব্যাপারটা কি, কোনো গন্ডগোল হল না তো! দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। নাহ, ওদের চোখমুখ দেখে তো গন্ডগোল বলে মনে হচ্ছেনা, বরং প্রত্যেকের মুখে একটা চাপা হাসি।

"কিরে তোরা আজ এই সকাল সকাল, কি ব্যাপার?"

"তুমি তো আমাদের এ বছর পুজোয় নেমতন্ন করতে ভুলে গিয়েছো তাই আমরা নিজেরাই চলে এলাম।" বলল ঋতু।

"ওরে পাগলী ভুলবো কেন? তোরাই তো ভুলে গিয়েছিস যে এ বছর আমাদের বাড়িতে পুজো হবেনা।"

"পুজো হবে না বললে তো চলবে না, পুজো যে হতেই হবে।"

কথাটা কে বলল তাকে দেখতে পেলেন না মঞ্জুলা দেবী, কিন্তু কন্ঠস্বরটা অতি পরিচিত ঠেকলো তাঁর কাছে।

"কে?" একটা দ্বিধা মিশ্রিত গলায় প্রশ্নটা করলেন তিনি। নাহ, তাঁর অনুমান ভুল ছিল না। ভীড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে এলো রিকিয়া।

"দিদিভাই তুমি!"

"হুঁ ঠাম্মা আমি…"

"আর শুধু রিকিয়াই নয়, আমরাও আছি।" কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে এলো প্রাঞ্জল, কিঞ্জল, শিঞ্জিনী, শিবাঙ্গি… মঞ্জুলা দেবীর চার অংশ। শুধু ওরাই নয় বৌমা, জামাই আর সব নাতি নাতনিরাও আছে।

মঞ্জুলা দেবী যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না, এমনটা তো সিনেমাতে হয়! চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে চোখ দুটো একবার ভালো করে মুছলেন তিনি। নাহ, ভুল হয়নি, ওরা সত্যিই দাঁড়িয়ে সামনে। দু'চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল মঞ্জুলা দেবীর গালে।

এগিয়ে এলো শিঞ্জিনী। মায়ের গলা জড়িয়ে বলল, "আয়াম সরি মা। আসলে পুজো হবে না শুনে আমরা এতটাই আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম যে ভেবেছিলাম এখানে এসে আর লাভ কি! ভুলেই গিয়েছিলাম পুজো হবেনা শুনে আমাদের যদি এতো কষ্ট হয় তাহলে তোমার মনের অবস্থা কি হবে! ভাগ্যিস রুমকি ফোন করেছিল আমায়।"

"রুমকি!" অবাক হয়ে মঞ্জুলা দেবী তাকালের গেটের কোণে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। গোটা বস্তির মেয়েদের যখন বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন মঞ্জুলা দেবী, তখন এই মেয়েটাই এগিয়ে এসেছিল সবার প্রথম। বলেছিল, "আমি তোমার কাজ শিকবো দিদিমণি, শেকাবে আমায়?" সেই থেকে রুমকি যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে গিয়েছে মঞ্জুলা দেবীর, দিদিমণির সব দিকে তার নজর। মেয়েটা কখন কে জানে লুকিয়ে লুকিয়ে শিঞ্জিনিকে ফোন করে বলেছে তার প্রিয় দিদিমণির মন খারাপের কথা!

চোখ দুটো মুছলেন মঞ্জুলা দেবী; আর তখনই টোপাই বলে উঠল, "পিপি তুমি কেন বলছো পুজো হবে না? পুজো তো হবে।"

শিঞ্জিনী কোনো জবাব দেওয়ার আগেই মঞ্জুলা দেবী বললেন, "পুজো কি করে হবে দাদুভাই, আমাদের যে অশৌচ!"

"হুমম অশৌচে মাটির প্রতিমার পুজো করা মানা, কিন্তু জীবন্ত প্রতিমার পুজো করা তো মানা নয়।" পাশ থেকে কথাগুলো বলে উঠল বড় নাতি আকাশ।

"মানে?" অবাক গলায় জানতে চাইলেন মঞ্জুলা দেবী।

"মানে মা আমাদের কাছে জীবন্ত মা দশভূজা থাকতে আমরা কেন মাটির প্রতিমার পুজো করব বলতে পারো?" বলল কিঞ্জল।

"কিসব বলছিস তোরা!"

"ভাই ঠিকই বলেছে।" প্রাঞ্জল বলল, "আমি জানি মা আমি হওয়ায় পর থেকে ঘরে বাইরে কাজ সামলাতে কি পরিমাণ কষ্ট হয়েছে তোমার। পরিষ্কার মনে না থাকলেও ঠাকুমা কিভাবে তোমায় অপদস্থ করতে চাইত অল্প অল্প মনে পড়ে, ঠাকুমা সবসময় তোমায় খোঁটা দিত বাইরে চাকরি করা নিয়ে…"

"আহা এসব কথা আজ কেন! থাকনা এসব পুরোনো কথা।"

"না মা, থাকবে না। দাদাকে বলতে দাও। আমরা জানি তুমি কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করেছো আমাদের মানুষ করতে। দু'দিক সামলাতে নিজে অনেকসময় না খেয়ে ছুটেছ কিন্তু আমাদের না খাইয়ে রাখনি কোনো সময়। শুধু আমাদের কেন, বাড়ির প্রতিটা মানুষের মন জুগিয়ে চলতে হয়েছে তোমায়। সব মেয়েকেই হয়তো হয়, কিন্তু তারই মাঝে তুমি নিজের মনের কথাও শুনেছো। শত বিপত্তির মধ্যেও নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছো। কটা মেয়ে পারে এমনটা করতে!" কথাগুলো বলতে বলতে মাকে এসে জড়িয়ে ধরল শিবাঙ্গী। বড় জামাই রণিত কাছে এসে বলল, "শুধু কি তাই? মা এখন যে কাজটা করছে তা কি কম প্রশংসার যোগ্য? সেসময় মা তোমাদের মানুষ করেছেন, আর এখন এতোগুলো মানুষকে নতুন জীবনের দিশা দেখাচ্ছেন। মা সত্যিই স্বয়ং দশভূজা।"

"আর তাই তো এই দেবীপক্ষে আমরা ঠাম্মার পুজো করবো।" বলে উঠল জুন।

"ধ্যাত কি যে বলিস না দিদিভাই!" নাতনিকে ছদ্ম ধমক দিলেন মঞ্জুলা দেবী। রিকিয়া বলল, "বকলেও কোনো কাজ হবে না ঠাম্মা, এ বছর আমরা জীবন্ত মায়ের আরাধনা করব, কোনো বারণ শুনবো না তোমার।"

রিকিয়ার কথা শেষ হওয়া মাত্রই হৈহৈ করে সকলে এসে ঘিরে ধরল মঞ্জুলা দেবীকে। আর তৎক্ষণাৎ আবার বেজে উঠল পুজোর মাইকটা---


"ইয়া দেবী সর্বভূতেষু

শক্তি রূপেন সংস্থিতা…"



সায়নদীপা পলমল






আলোর স্পর্শ





মূল শহর থেকে কিছুটা ছাড়িয়ে জায়গাটা, তবে শহর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ঠিক বলা যায়না। শহরের বড় রাস্তা থেকেই একটা রাস্তা ভেঙে গিয়ে ঢুকে গিয়েছে এই দিকটায়, গেল বছরই পিচ হলো এই রাস্তাটা। আশেপাশের নিচু জমি গুলো এখন বাবুরা  কম দামে কিনে সব পেল্লাই বাড়ি হাঁকাচ্ছে তাই বোধহয় পাল্লা দিয়ে রাস্তার এই রূপ বদল। পিচ রাস্তাটা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই কালভার্টটা নজরে পড়ে, এতোই তার উচ্চতা যে অপর প্রান্তটা এদিক থেকে দেখা যায়না। কালভার্টের নীচ দিয়ে চলে গেছে একটা বড় খাল, হয়তো কোনোদিনও জল যেতো সেটা দিয়ে, এখন আগাছা আর আবর্জনাতেই প্রত্যেকটা দিন সমৃদ্ধ হয় সে। কালভার্টটা পেরোলে ওপারে প্রায় দুশো মিটার মত জায়গা বেওয়ারিশ অবস্থায় বিরাজমান। দু’শো মিটার… শুনতে সামান্যই কিন্তু ওই টুকু রাস্তাই পথচারীদের কাছে বিভীষিকাসম। বড় বড় হাঁ করে সে সদাই কাউকে গিলে নিতে প্রস্তুত, খুব সন্তর্পনে পেরোতে হয় সেখান। ওই দুশো মিটার রাস্তা পেরোলেই আবার সিমেন্ট ঢালা বাঁধানো রাস্তা গিয়ে শহরের মূল রাস্তার সাথে মিশেছে।  সিমেন্ট ঢালা রাস্তাটার এক পাশে রয়েছে উঁচু পাঁচিল ঘেরা একটা পরিত্যক্ত কারখানা আর অন্যপাশে কারখানার কর্মচারীদের জন্য নির্মিত বাসভবন। একসময় নাকি এই কারখানাটা রমরমিয়ে চলত, সেসব কথা শুনেছে বকুল। কিন্তু তার জন্মের পরে পরেই বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটা, তাই বকুলের কাছে কারখানার স্মৃতি বলতে এখন শুধু একটা নোনা ধরা বিশাল কাঠামো, স্থানে স্থানে যার দেওয়াল ফাটিয়ে ছোটো ছোটো আগাছার সঙ্গে জন্ম নিয়েছে অশ্বত্থ, বট। কারখানার বাসভবনগুলোতেও এখন আর কেউ থাকে না, তবে ইদানিং কিছু লোককে ঘরগুলোয় ঢুকতে দেখেছে বকুল। কিন্তু মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই মা এড়িয়ে যায়, বকুলকে বারণ করে ওদিকে যেতে।

   পিচ রাস্তা শেষে কালভার্টটার যেখানে শুরু সেখানেই রাস্তার একধারে বকুলদের ঝুপড়িটা। আগে এখানটায় শ্রমিকদের ছোটোখাটো একটা বস্তি ছিলো কিন্তু কারখানা বন্ধ হওয়ার পর সব এক এক করে উঠে যেতে যেতে এখন শুধু বকুলদের ঝুপড়িটাই রয়ে গেছে। বকুলের বাবাও কারখানায় কাজ করত, কাজ চলে যাওয়ার পর থেকে ভীষন মনমরা হয়ে থাকতো মানুষটা। তারপর একদিন হঠাৎ  বলল বড় রাস্তা দিয়ে যে ট্রাকগুলো আলু নিয়ে মহারাষ্ট্র যায় সেই ট্রাকগুলোয় চড়ে যাবে কাজের সন্ধানে, এই বলে সেই যে গেল আর ফিরলোনা কোনোদিনও। সে হয়ে গেল প্রায় বছর তিনেক আগের কথা। মা তারপর থেকে ঠিকে ঝি এর কাজ করে, কখনও আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার চালায়। বকুলের ভাইটাও আবার তার পরের বছরই মারা যায়। ভাইটার পা দুটো ছিল জন্ম থেকেই অকেজো, পায়ের পাতা দুটো গোড়ালির থেকে ছিলো উল্টানো আর কোনো আঙ্গুল ছিলো না পায়ে, তাই হাঁটতে পারতো না সে। সেবার কখন যেন সবার অলক্ষ্যে হামা দিয়ে দিয়ে ওই কালভার্টের দিকে চলে গিয়েছিল তারপর টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে একটা বড় ট্রাকের সামনে…

   পিচ রাস্তার ওদিকে একটা দোকানে রাখি ঝুলতে দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে বকুলের। ভাইটা যতদিন বেঁচে ছিলো এই দিনটায় সে নিয়ম করে ভোরে উঠে স্নান সেরে রাখি পরাতো ভাইকে। তাদের আড়ম্বরহীন জীবনে এই ছোট ছোট আনন্দ গুলোই ছিল একমাত্র বিলাসিতা। ভাইটা যাওয়ার পর সে বিলাসীতাটুকুও হারিয়েছে জীবন থেকে। রাখির দিনগুলো বড় কষ্ট হয় বকুলের, মনে পড়ে যায় ভাইটার হাতে রাখি বেঁধে দিলে সে কেমন আনন্দে চিৎকার করে মেঝেতে চক্কর কাটতো। ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে তার লালা ঝরে গড়িয়ে পড়ত গায়ে, বকুল পরম যত্নে নিজের জামার খুঁট দিয়ে মুছিয়ে দিতো ওর মুখ। ভাই চলে যাওয়ার পরও বকুল নিয়ম করে রাখি কিনেছে প্রতি বছর, গুছিয়ে রেখেছে ওর সাদা প্লাস্টিকের বাক্সটায়। মা বলে কেউ মারা গেলে নাকি ওই দূর আকাশে চলে যায়, বকুল ভাবে সেও যদি কোনোদিনও যেতে পারে ওই আকাশে তখন ভাইকে একসাথে পরিয়ে দেবে সব রাখিগুলো। ভাই নিশ্চয় খুব খুশি হবে। কিন্তু মাঝেমাঝেই আবার মনে প্রশ্ন জাগে দেখা হলে ভাই চিনতে পারবে তো তাকে!



পাঁউরুটির প্যাকেটগুলো বুকের কাছে চেপে ধরে সন্তর্পনে এগোচ্ছিল রাকেশ। অনেক চেষ্টা করছে চোখ মুখ স্বাভাবিক রাখার কিন্তু কিছুতেই পারছেনা, বুকের মধ্যে জমে থাকা ভয়টা নাড়াচাড়া দিচ্ছে মাঝেমাঝেই। সবাই কি ওকেই পায়! বারবার কেন ওকেই যেতে হয় খাবার আনতে! ওই রফিকটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া, ওরই উস্কানিতে দাদা রাকেশকে এরকম গরু গাধার মত খাটাচ্ছেন। তবে রাকেশেরও দিন আসবে ঠিক, তখন রফিক বুঝবে কত ধানে কত চাল।

   রাকেশ যখন চার বছরের তখন ওর মা ওকে ফেলে অন্য লোকের সঙ্গে পালিয়ে যায়, এরপর ঠাকুমার কোলেই মানুষ হতে থাকে সে। রাকেশের জীবনের একমাত্র ভালো স্মৃতি ওই ঠাকুমার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো, বাকি আর কিছুই মনে পড়ে না। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বাবা ওকে পিসির কাছে রেখে এসে আবার বিয়ে করেন। এদিকে পিসির বাড়িতেও কিছুদিনের মধ্যে শুরু হয় পিসিমশায়ের অত্যাচার, বেগার খাটুনি থেকে শুরু করে কারণে অকারণে জুটত মধ্যম। বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইলে বাবা তাকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেন, হয়তো নতুন সংসারে পুরোনো বোঝা টানতে চাননি আর। এই ভাবেই পিসির বাড়িতে সে কাটিয়েছিল কয়েকটা বছর, তারপর একদিন সুযোগ বুঝে পালায় সেখান থেকে। সেই শুরু, আজও রাকেশ ছুটে চলেছে ক্রমাগত। এই তেইশ বছরের জীবনে সে এটুকু বুঝে গেছে যে পৃথিবীতে ভালোবাসা, অনুভূতি এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই আদৌ, এগুলো বড়লোকেদের কল্পনামাত্র। এই পৃথিবীতে আছে শুধু লড়াই… ক্ষমতার লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই আর এই লড়াইতে জিততেই হবে তাকে।

  এসব কথা মনে হতেই মুখ থেকে একদলা থুতু ফেললো রাকেশ, আর তখনই একটা বাচ্চা মেয়ে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে।
“দাদা দুটো টাকা দেবে  মুড়ি কিনবো?”
“ফুট... রাস্তা ছাড়।”
“দাওনা দাদা দুটো টাকা, আমার মায়ের খুব জ্বর তাই মা কাজে যেতে পারেনি।”
“যা যা ওসব টাকা ফাকা হবে না আমার কাছে।”
“এমনি টাকা দিতে বলছিনা গো, তোমার কোনো কাজ থাকলে বলবে আমি করে দেবো।”
“আমার কাজ করে দিবি তোর এই দেড় ফুটের শরীরটা নিয়ে!” মুখটা বিকৃত করে হাসলো রাকেশ।
“হ্যাঁ গো সত্যি বলছি।”
“তা কি কাজ করবি শুনি?”
“যা বলবে, বাসন মাজা, কুটনো কাটা সব।”
“হুরর… আমার এসব দরকার নেই।”
“ও দাদা শোনো না…”
বাচ্চাটার কথা শুনতে শুনতেই কিছুটা দূরে পিচ রাস্তাটার দিকে চোখ গেল রাকেশের, একটা লোক কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে না ওদের দিকে! কে হতে পারে লোকটা! নাহ তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে। বাচ্চাটা বড্ড ভ্যানভ্যান করছে, ওর মুখ বন্ধ করতেই একটা পাঁউরুটির প্যাকেট ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ত্বরিৎ গতিতে পা চালালো রাকেশ। বাচ্চাটা অবাক হয়ে ওকে দেখলো পুরোনো কারখানার অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে।




সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টিটা নেমেছিলো, তারপর যত রাত বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার বেগ, সাথে শুরু হয়েছে নিদারুণ বজ্রপাত। বৃষ্টির তেজ, দমকা হাওয়া আর বজ্রপতন সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে বাড়ির টিনের চালটা উড়ে যাবে। বকুল তার এই ছোট্ট জীবনে এমন ভয়ঙ্কর দুর্যোগ আগে কখনও দেখেনি, যতবার বাজ পড়ছে ততবার কেঁপে উঠছে ওর বুক। মায়ের কোল ঘেঁষে চুপটি করে শুয়ে থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু সেটাও পারছেনা ঠিকমত, পেটের মধ্যে চলছে ছুঁচোর দৌরাত্ম। বিকেলের সেই দাদাটার কাছ থেকে পাওয়া পাঁউরুটিটা মাকে খাইয়ে দিয়েছিল, কিন্তু নিজের পেটে দানাপানি অবধি পড়েনি।

   আচমকাই বাইরের দরজাটা খুলে গেল সশব্দে, ছিটকিনিটা নড়বড়ে তাই বাইরে থেকে একটু জোরে দরজাটা ঠেললেই হলো… ভয় পেয়ে উঠে বসল বকুল, মাও কোনোমতে উঠলেন। একটা লোক ঢুকেছে দরজা দিয়ে, অন্ধকারে মুখ না দেখা গেলেও অবয়বটা স্পষ্ট। বকুলের মা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ওকে তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “কে?”
“চোপ একদম চোপ।” হিসহিসিয়ে বলল আগন্তুক। এতক্ষণে সে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে চলে এসেছে বকুলদের সামনে। লোকটার হাতে একটা ছোটো টর্চ, সেটা জ্বালতেই ওরা দেখতে পেল লোকটার মুখটা ঢাকা আর ডান হাতে ধরা একটা ধারালো ছুরি। লোকটা ছুরিটা বকুলের মায়ের সামনে উঁচিয়ে ধরে বললো কাউকে যদি বলেছিস আমি এখানে আছি তাহলে কিন্তু তোর এই বাচ্চাটা… কথাটা সম্পূর্ণ না করেই লোকটা ছুরিটা ঠেকিয়ে দিলো বকুলের গলায়। ওর মা আর্তনাদ করে উঠলেন, আর তৎক্ষণাৎ শোনা গেল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। লোকটা চোখের ইশারায় বকুলের মাকে দরজার দিকে যেতে বলে নিজে বকুলকে কাছে টেনে নিয়ে টর্চ নিভিয়ে সেঁধিয়ে গেল ঘরের এককোণে রাখা আবর্জনা ভর্তি বস্তাটার পেছনে।

   বকুলের মা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দুটো লোক হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো ভেতরে, ওদের আপাদমস্তক বর্ষাতিতে মোড়া।
“কেউ ঢুকেছে আপনার ঘরে?”
“ক্ক… কে ঢুকবে?”
“কেউ ঢুকেছে কিনা বলুন।”
“না… কিন্তু আপনারা কে? এতো রাতে আমার ঘরে…”
“আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন?”
“ভয় পাবোনা! আপনারা এভাবে…”
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা পুলিশ। কেউ ঢোকেনি যদি তাহলে একটু আগে আপনার ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল কেন?”
“চ্চ… চিৎকার! আ… আসলে আমার খুব জ্বর কদিন, গোটা গায়ে ব্যাথা তাই যন্ত্রনায় চিৎকার করে ফেলছি মাঝেমাঝে, হয়তো সেটাই শুনেছেন।”
“হুমম।” এই বলে ঘরের মধ্যে টর্চের আলোটা একবার ঘুরিয়ে নিয়ে তারা বলে, “আমরা এখন আসছি, কেউ এলে ঘরে ঢুকতে দেবেন না, কেমন?”
“আচ্ছা।”

  পুলিশের লোকদুটো চলে যায়, বকুলের মা দরজা লাগিয়ে দেওয়ার পরও কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে থাকে লোকটা তারপর বকুলকে নিয়ে সরে আসে বস্তার পেছন থেকে। আস্তে আস্তে  মুখের কাপড়টা সরায় সে, টর্চের আলোয় ওর মুখটা দেখে চমকে ওঠে বকুল।




ভোরের আলো বকুলদের বাড়িটাকে স্পর্শ করছে একটু একটু করে, পুরোপুরি আলো ফোটার আগেই পালাতে হবে রাকেশকে। বাচ্চাটা আর তার মা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে, রাকেশেরও তন্দ্রা মতন আসছিল কিন্তু ঘুমোলে তো তার চলবেনা। বাচ্চাটার ওপর প্রচন্ড রাগ উঠছে ওর, কাল এই চিংড়িটার সাথে কথা বলতে গিয়েই পুলিশের চরটার নজরে পড়ে গিয়েছিল সে। এটার গলাটা টিপে দিতে ইচ্ছে করছে রাগে কিন্তু এখন এসব ঝামেলা করে লাভ নেই। দলের সবার কি হল কে জানে! উঠে দাঁড়ালো রাকেশ, নাহ এবার তাকে বেরোতেই হবে। এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা টানতেই বাচ্চাটার গলা ভেসে এলো, “একটু দাঁড়াবে?”
চমকে উঠে পেছন ফিরল রাকেশ, ঘুমঘুম চোখে অনুরোধ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বাচ্চাটা। কালকে এটার জন্যই সব গন্ডগোল হলো কিন্তু আজ তাও কেন কে জানে ওর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল রাকেশ, ওই চোখ দুটোয় যেন কোন মায়া জড়িয়ে আছে!  বাচ্চাটা একগাল হেসে উঠে গেল তারপর তাক থেকে পেড়ে আনলো একটা কাগজের বাক্স। বাক্সটা খুলতেই চমকে গেল রাকেশ, সেটাতে ভর্তি রাখি। তার মধ্যে বেছে বেছে একটা রাখি বের করলো বাচ্চাটা। রাকেশ ওর মুখের দিকে তাকাতেই ও বললো, “কাল তুমি আমাকে যখন এমনি এমনিই পাঁউরুটিটা দিলে তখনই ভেবেছিলাম তোমাকে আজ রাখি পরাবো তোমার বাসায় গিয়ে কিন্তু আজ তো তুমিই আমার বাড়ি চলে এলে। জানো তো আমার ভাইটা মরে যাওয়ার পর থেকে কাউকে রাখি পরাইনি আমি, তুমি আমার দাদা হবে?”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো বাচ্চাটা, তারপর রাকেশের হাতটা টেনে নিয়ে বাঁধতে শুরু করলো রাখিটা, অপটু হাতে বাঁধতে গিয়ে গিঁট দিয়ে ফেললো সুতোটায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে রইল রাকেশ। কিন্তু রাখিটা বাঁধা শেষ হওয়া মাত্রই কারা যেন দরজা খুলে ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। রাকেশ দেখলো উর্দিধারী তিনজন পুলিশ।
“কাল ঠিকই দেখেছিলাম, কি ভেবেছিলি লুকিয়ে পালাবি?”
দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো বলতে বলতে একজন এসে মুঠো করে ধরে ফেলল রাকেশের হাতটা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রাকেশ এই মুহূর্তে যেন আর পালানোর তাগিদ অনুভব করছেনা, বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। জল ভরা চোখ নিয়ে বকুল হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে; আজ বহুবছর বাদে কান্না পাচ্ছে রাকেশেরও, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বকুলের মুখের মাঝেই ঠাকুমার মুখের আদল যেন আজ এতো বছর বাদে আবার ভেসে উঠছে রাকেশের সামনে, আজ এতো বছর বাদে তার ভেতর থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলে উঠছে : "অনেক হয়েছে, এবার থামা তোর এই মিথ্যে লড়াই। খুলে ফেল এই কালো মুখোশ, কারণ তুইও জানিস ভালোবাসা কারুর কল্পনামাত্র নয়, ভালোবাসা আছে আমাদের অস্তিত্বে মিশে…"