নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

অভিজিৎ আচার্য্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অভিজিৎ আচার্য্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

।।জলছবি।। অভিজিৎ আচার্য্য





স্কুলের মাঠ তখনও থাকতো জলে ভরা। লম্বা ঘাস গুলো মাথা তুলে থাকতো জলের উপর। শ্যাওলা রঙের জলের উপর রোদ পরে এঁকে দিতো জলছবি। মাঠের উল্টো দিকেই রবীন্দ্র সেবা সমিতি, এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো ক্লাব। টালি দেওয়া এক চিলতে ঘরের পাশেই বাঁধা হতো বাঁশ। প্যান্ডেলের চূড়া ছুয়ে উড়ে যাচ্ছে পেঁজা মেঘ। আমি দুচোখে ধোরে রাখতাম সেই নীল আকাশের ছবি তারপর এক ছুটে পৌঁছিয়ে যেতাম উত্তরের জানলার ধারে, চোখ খুললেই আবার সেই ছবি হুবহু ফুটে উঠতো সামনে।
বাতাবি লেবু গাছটার নিচে খেলা শেষে গুছিয়ে নিচ্ছি সংসার হঠাৎ শুনতে পেতাম বুড়ির গলা। ও গোপাল। আমি সামনে গেলেই বুড়ি খুলে রাখত পায়ের চটি তারপর দু হাত বুলিয়ে দিত সারা গায়ে, আকাশের দিকে মুখ তুলে কি যেন বিরবির করে নিত তারপর। তার হাতের রেখা যেন ছুয়ে যেত আমার গাল, কপাল মিশে যেত লোহিত স্রোতে। প্রতি বারের মতন মা এসে বলতো খেয়ে যেও দুপুরে। আমি তার হাত ধরে বসিয়ে দিতাম বারান্দায়। ছোট্ট দুটো খঞ্জনি বের করে সে গেয়ে উঠতো "রাধে গোবিন্দ"। কানে কানে বলত এ খঞ্জনি তোমাকেই দিয়ে যাব গোপাল কেমন। আমি মাথা নাড়তাম। বারান্দার এক পাশে উনুনে মা রান্না করতো মাছ, ভাত, ডাল, তরকারি। পাশে ঠাকুমা বসে কেটে দিতো আনাজ আর বলতো তোমাদের গ্রামের কি খবর গো। বুড়ি শোনাত এক সবুজ গ্রামের কথা। গ্রামে আছে তার মা বাপ মরা নাতি, আর আছে একটা ছোট্ট বাড়ি, মাটির দেওয়াল, বেড়ার ধারে পুঁই ডাটা। সে গ্রামেও আসেন মা দুর্গা, সে গ্রামেও আকাশ হয় নীল, বাতাস লাগলে শিরশিরিয়ে ওঠে গা। আমি শুনতে থাকি গল্প আর মনে মনে ভাবি বুড়ির নাতির কথা। বুড়ি বলে ওঠে কি গোপাল যাবে নাকি আমাদের গ্রাম। আমি মাথা নাড়ি আবার। কিন্তু যাওয়া হয় না কোনোবারই। দুপুরের খাওয়া সেরে বুড়ি আবার হাত বুলিয়ে দেয় ওই ভাবেই তারপর হাঁটা দেয় আপন পথে। আমি দেখতে পাই একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে এঁকে বেঁকে, দুধারে তার সবুজ। হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁকে থেমে যায় পা। একটা নুইয়ে পরা মাটির ঘর, ঘরের সামনে নিকানো উঠোন, তুলসী তলা, ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসে "রাধে গোবিন্দ নাম"। আমি হাত বাড়িতে বলি কই আমার খঞ্জনি দাও। ঘুম ভেঙে যায়। জানলার ফাঁক খুঁজে এসে পরে আলোর রেখা। এ আলোতে উত্তাপ নেই আছে নরম আঁচ। ঢাকের আওয়াজ বলে যায় মা এসে গেছে মণ্ডপে।
বালি পুকুর এই সময় থাকে জলে টইটম্বুর। জল কম থাকলে কাছাকাছি ছিপ ফেললে বেলে মাছ ওঠে টপাটপ। আমরা দুই বন্ধু চড়ে বসি সবেদা গাছটার উপর। আজ কোন তাড়া নেই। স্কুল ছুটি। চেয়ে দেখি ঘোলাটে জলের উপর জেগে আছে মরা কাঠের মাথা আর তারউপর মাছরাঙা বসে তাকে চুপ চাপ। এই এস আই হসপিটাল হওয়ার সময় এই পুকুর খুড়ে ভরা হয়েছিল মাটি, বেরিয়ে ছিল সাদা বালি তাই নাম বালি পুকুর। ভরা পুকুরে চ্যাপ্টা পাথর খুঁজে তেরচা করে ছুড়ে দিলে সে দৌড় দিতো ব্যাঙের মতোন। জলের বুক চিড়ে ছুটে চলা পাথর লাফাতে লাফাতে হারিয়ে যেত সীমানায়, যে ভাবে হারিয়ে যায় লালচে সূর্যটা ওই মস্ত বাড়ি গুলোর পিছনে। আর আমি  অপেক্ষা করতেই থাকি বুড়ি আমায় খঞ্জনি দিয়ে যাবে বলে। শেষ বিকেলের গোলাপী আলো মিলিয়ে যেতে যেতে গান শুনিয়ে যেত নাম না জানা পাখি। আমরা লাফ দিয়ে নেমে আসতাম আকাশ থেকে মাটিতে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে জ্বলে উঠতো টিউবের আলো কোথাও সাদা, কোথাও সবুজ। ঝির ঝির বৃষ্টি নামলে সবুজ আলো ছিটিয়ে যেত রাস্তার বুকে। আমি দেখতে পেতাম বুড়ির গ্রাম আর শুনতে পেতাম বুড়ি বলছে ও গোপাল, এই খঞ্জনি আমি তোমায় দিয়ে যাব কেমন। আমি বলতাম তোমার নাতি রাগ করবে না, বেজে উঠতো ঢাক। রাত নামলে এক তারা ভরা আকাশ দেখা দিত, তারায় তারায় মা দুর্গার মুখ, তার হাতে কত অস্ত্র, দেখতাম ঢাকের সাথে কাঁসর বাজাচ্ছে একটা ছেলে, আমারই বয়সি। আমি দেখতাম বুড়ির নাতিকে। মা গুছিয়ে রাখতো পুরনো জামা প্যান্ট। দশমীর দিন সকালে ঢাক বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি আসতো ওরা। আমি এগিয়ে দিতাম পুরনো জামা, প্যান্ট আর দশটকা। ছেলেটার মুখে দেখেছিলাম হালাকা হাসি। আমি সেদিন খুব দৌড়িয়ে ছিলাম দুহাত ছড়িয়ে হাওয়াদের সাথে সাথে, শুধু পৌঁছাতে পারিনি বুড়ির গ্রামে। বুড়ি আমরা খঞ্জনি দিয়ে যায় নি। প্রতি বারের মতোন আমি অপেক্ষায় থাকি। ঢাক বেজে ওঠে, ওরা আসে বাড়ি বাড়ি কিন্তু বয়স বারে না ছেলেটার। আয়নায় খুঁজতে যাই কিন্তু  আমি আমায় পাইনা খুঁজে।