নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আলো ছায়ার কথামালা :-হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





(চল্লিশ)


          আমাদের ছিল খড়ের চালের মাটির বাড়ি। দু দুটো ঘর। একটা ঘরের চালের খড় যোগাতেই বাবা হিমসিম খেয়ে যেত। তার ওপর আবার দুটো। এইজন্যেই প্রতি বছর একটা ঘরের খড় বদলানো হতো। সেই বছরই অন্য ঘরটির ছিল হতশ্রী অবস্থা।
          আমাদের ছিল রাত করে শোওয়ার অভ্যাস। তক্তাপোষে আমি বাবা পাশাপাশি শুয়ে। দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ আমার গায়ে এসে পড়ল জলের ফোঁটা। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি। জল গায়ে এসে পড়তে বুঝতে পারলাম, চালের পচা খড় ভেদ করে জল এসে পড়েছে আমাদের মশারির ওপর। সেখান থেকে আমার গায়ে। আজ আমার গায়ে, অন্যদিন বাবার গায়েও পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা গুটিয়ে নেওয়ার পালা। তা না হলে বৃষ্টিতে বিছানা ভিজে যাবে। বাকি সারাটা রাত আমি আর বাবা  বিছানা গুটিয়ে ঘরের এককোণে বসে। আমি কখনও ঘুমে ঢুলে পড়ছি, কখনও আবার বাবাও ঘুমে ঢুলছে। আসলে একঘন্টাও হয় নি শুয়েছি। মনে হচ্ছে শুতে না শুতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
          ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা দুজনে  বিছানা গুটিয়ে বসে। একদিনও বাবা এই ঘটনায় আমার কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন নি। বরং তিনি পরোক্ষে আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এটাই জীবন। এইভাবেই বাঁচতে হয়। আর সৌভাগ্যবানেরাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে। সেদিন থেকেই বুঝতে পেরেছি জীবনসংগ্রাম কাকে বলে।


                        

আলো ছায়ার কথামালা :হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





ঊনচল্লিশ



               তারকেশ্বর লাইন। মালিয়া স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমেই মনটা ভরে গেল। চারপাশ সবুজ। খোলা মাঠ। যেদিকেই তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়। যখন নামলাম তখন ঘড়িতে চারটে বেজে পনের। বেশ খানিকটা সময় বসে রইলাম চুপচাপ। কখনও স্টেশনটা দেখছি। কখনও দেখছি স্টেশনের চারদিক। এইসব জায়গায় এলেই একমাত্র মনে হয় সব কথা যেন বলা হয়ে গেছে। মনে হয় বোকারাই যেন কথা বলে। প্রকৃতির মতো মিতভাষী আর কে আছে ! নিঃশব্দে যেন সে কাজ করে যাচ্ছে । কথা বলতে গেলে তো ফাঁকি হয়ে যায়। আর তাছাড়া কিসের এতো কথা বলা। আমি তো নতুন কিছু বলতে পারব না। যা বলব তা যেন প্রকৃতি আগেই ছড়িয়ে রেখে দিয়েছে।
               মাঠের আল ধরে হেঁটে গেলাম। মুরগি, হাঁস, গরুর পাশ কাটিয়ে গিয়ে উঠলাম একটা প্রাইমারি স্কুলে। খুবই আন্তরিক ওখানকার মানুষজন। কবিতা পাঠ হল। অনুষ্টানের শেষে মুড়ি আর ফুলুরি। কী দারুণ তৃপ্তি করে খেলাম। এই খাওয়াটাই যদি আমার শহরে হতো তাহলে মোটেই এই আনন্দ পেতাম না।
               অনুষ্টান শেষ করে যখন স্টেশনে এসে পোঁছলাম তখন চারপাশে অন্ধকার নামছে। দূরে একটা মাঠে কিছু ছেলে দলবেঁধে ফুটবল খেলছে। ওই দলের মধ্যে আমি যেন আমাকেও দেখতে পেলাম। একটু পরেই বাড়ি ফিরব। বাড়িতে ঢোকার আগে পুকুরে নেমে হাত পা ধোব। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখব, বাবা দুয়ারে বসে পুঁথি লিখছে আর মা রান্নাচালায় বসে সন্ধের চা তৈরি করছে। সম্বিত ফিরলে দেখলাম চোখের কোলটা কখন যেন ভিজে গেছে।

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






আটত্রিশ


               প্রায় ত্রিশ বছর হল গৃহশিক্ষকতা করছি। কত যে অভিজ্ঞতা তা লিখলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের একটা বিশেষ আচরণ। গত দশ বছরে যেটা একটা মারাত্মক আকার নিয়েছে। প্রতি বছরই আমার মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী থাকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে পঁচানব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষককে জানায়। এর একটাই কারণ তারা প্রায় সবাই আবার একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা ফলাফল প্রকাশিত হলে মাত্র কুড়ি শতাংশ শিক্ষককে জানায়। এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথম যে কারণটা সবচেয়ে বড় কারণ সেটা হল, অনেক ছাত্রছাত্রীই অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে শিক্ষকদের নিয়মিত গুরুদক্ষিণা দেয় না। তাই শিক্ষককে ফলাফল জানাতে গেলে বাকি থাকা টাকা মেটাতে হবে, সেই কারণে এই পথ আর কেউ মারায় না। দ্বিতীয় কারণ, শিক্ষককে ছাত্রছাত্রীরা আজকাল আর কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না। পরীক্ষার ফলাফল সবার আগে যে শিক্ষককে জানান উচিৎ সেই শিক্ষা তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে পায় নি। আর তৃতীয় কারণ হল, বর্তমানে সবকিছুই তো অর্থের অঙ্কে কেনা যায়। তাই আজকের ছাত্রছাত্রীরাও টাকা দিয়ে শিক্ষাকে কিনতে শিখে গেছে। আসলে অভিভাবকদের শিক্ষায় এই শিক্ষা তারা ভালোই আয়ত্ব করে ফেলেছে।
               বারবার অভিভাবকদের কথা বলছি একটাই কারণে, অভিভাবকরা একটু সচেতন হলেই এই চিত্র পুরোপুরি বদলে যেতে পারে। গুরুদক্ষিণার প্রসঙ্গ উঠলেই অভিভাবকদের মুখের ভাষাই হল, " কেন ? আপনাকে দেয় নি ? আমি তো মাস শেষ হলেই নিয়মমতো আপনাকে টাকা দিয়ে গেছি ! " আমি জানি উনি ভুল বলছেন না। কিন্তু টাকা দিয়েই একজন অভিভাবকের দায়িত্ব শেষ ? শিক্ষকের সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ রাখতে হবে না ? আমি তো অর্ধেকের বেশি অভিভাবককে চিনিই না। এটা কেন হবে ? অভিভাবকরা যদি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখেন তাহলেই তো আর কোনো সমস্যা তৈরি হয় না। পড়া যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন শিক্ষকের কাছে তাঁর সন্তানের কোনো গুরুদক্ষিণা বাকি থাকল কি না সেটা ওনারা জানতে চাইবেন না ? বাকি যদি নাইবা থাকে, একটা শেষ সৌজন্য সাক্ষাৎকারও আশা করা যায় না ?
               পরীক্ষার ফলাফলের খবর সবাই পেয়ে যায়, একমাত্র শিক্ষক ছাড়া ! অথচ তিনিই আসল কাণ্ডারী। অভিভাবকরা তাঁর সন্তানকে কি শেখাচ্ছেন ? শিক্ষক----- যিনি সম্মানে সকলের আগে অথচ মান মর্যাদায় তাঁকে কোথায় রাখা হচ্ছে। তাহলে অভিভাবকরাই তাদের সন্তানদের শেখাচ্ছেন, প্রয়োজনে শিক্ষকের কাছে যাও আর আসল সময় তাঁকে ভুলে যাও। এরপরেও বাবা মাকে যদি তাঁর সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় তাহলে কি সেই সন্তানের বিরুদ্ধে বাবা মায়ের কোনো কিছু বলার মুখ থাকবে ? কারণ, দায় দায়িত্ব ভুলতে কে শিখিয়েছে ? দিনের পর দিন একটা অমানুষ প্রকৃতিকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে গেছি। আজকে তারই ফলভোগ করতে হচ্ছে।

আলো ছায়ার কথামালা. ... হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





।। ছত্রিশ ।।



               আজ ব্যানার্জী কেবিনে বসে আছি। হঠাৎ একটা কথা কানে এলো। কেবিনের শম্ভুদা একজনকে বলছে, "আপনার যদি দরকার হয় তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন না।" শম্ভুদার কথা শুনে লোকটির মন্তব্য ----- "সত্যি শম্ভু, তোর যেমন বুদ্ধি ! আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একজন রঙমিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলতে যাব ! তুই ওকে বল আমার বাড়িতে এসে একদিন কথা বলে যেতে।" দুজনের কাউকেই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধুমাত্র শম্ভুদার গলা চিনি বলে এতক্ষণ বুঝতে পারছিলাম যে ওটা শম্ভুদার গলা। এবার পিছনে ঘুরে না তাকিয়ে পারলাম না। হ্যাঁ, লোকটাকে আমি চিনি। কিন্তু ওনার যে এতবড় একটা গুণ আছে আমি জানতাম না।
               সত্যি মানুষ এখনও এসব ভাবে ! অনুপাতটা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। নিজের প্রয়েজনে একটা মানুষ আর একটা মানুষের সঙ্গে কথা বলবে তাও তার কত ভাবনা ! সত্যি, আমরা আর মানুষ হলাম না !



।। সাঁইত্রিশ ।।



               মহাশ্বেতা দেবীর একটা কথা খুব মনে পড়ে, "অকাজে ঘুরে না বেড়িয়ে বাড়িতে পড়বি, অনেক কাজ দেবে।" এখন এটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। ছাত্র পড়িয়ে যতটুকু সময় পাই পড়ি আর লিখি। কবিতা লিখতে এসে কত মানুষের সঙ্গে তো মিশলাম। শিক্ষকতার ত্রিশ বছরে আরও অনেক অনেক মানুষ। যাকেই নিজের মনে করে একটু কথা বলতে যাচ্ছি সে-ই ঘুরে গিয়ে নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিচ্ছে। তাই এখন নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়ে এসেছি। তবে অবশ্যই নিজেকে অন্যের থেকে উন্নতমানের মনে করে সরে আসা নয়। বরং ঠিক উল্টোটাই। আমিই ঠিক সকলের যোগ্য নই। তা না হলে সবাই হেসে খেলে কথা বলে দারুণভাবে বেঁচে থাকতে পারছে আর আমি পারছি না কেন ?

আলো ছায়ার কথামালা --- হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। পঁয়ত্রিশ ।।



               খুব ছোটবেলায় একা একাই সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। তার মানে এই নয় যে আমি কারও সঙ্গে মিশতে চাইতাম না বা মিশতে পারতাম না। আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক সব গুণই আমার ছিল। তবু একা একা থাকতে হলে আমার খুব একটা অসুবিধা হতো না। ছোটবেলায় আমাকে একা রেখে কেউ বাইরে গেলে অথবা এখনও যখন প্রয়োজনে একা থাকতে হয় তখন আমার তো বেশ ভালোই লাগে। তখন কলেজে পড়তাম, ট্রেনের জন্যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, ট্রেন আসতে দেরি করছে ; কত মানুষ কত কি বলছে। আমার বন্ধুরাই কত কিছু বলত। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। আমি একটুও বিরক্ত হতাম না। বরং ট্রেন আসতে দেরি হলে আমার বেশ ভালোই লাগতো। আমি বসে বসে কবিতা পড়তাম। তাই আমার কাছে কেউ ট্রেনের আসা নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করত না। কারণ ওরা জানতো, আমাকে বলে কিছু লাভ হবে না।
               একা একা থাকলে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারি। নিজের কোনো লেখা নিয়ে আরও গভীর চিন্তা ভাবনা করা যায়। সে যাই হোক, কোনো কিছু নিয়ে একবার ভাবনার গভীর জলে ডুবে গেলে আর দেখতে হবে না। তখন কে কোথায় আছে, আমিই বা কোথায় কি জন্যে বেরিয়েছি সব ভুলে যাই। তখন আমিই আমাকে সঙ্গ দিই। আমার কোনো ভালো লাগা নিয়ে আমিই আমাকে একটা বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যাই। এটা সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন জগৎ। এই জায়গায় কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই কারও জন্যে মনে কোনো অভাব বোধ জাগ্রত হয় না। আত্মমগ্নতার চূড়ান্ত স্তরে গিয়ে পোঁছানো যায়।

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





।। চৌত্রিশ ।।


               আজ আমার এক ছাত্রী আমার কাছে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে হাজির। একটা প্রশ্নের ঘা সামলাতে না সামলাতে আরও একটা। প্রশ্ন শুনেই বোঝা যায়, এগুলো তার মনে অনেক দিন ধরে চেপে রাখা কথার পাহাড়। তার প্রশ্নগুলোকে পর পর সাজিয়ে দিলে ঠিক এরকম দাঁড়ায় --------- " আচ্ছা মানুষ সবসময় তার প্রিয় জিনিসটাকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে পেতে উদ্যত হয় কেনো ? তার প্রিয় ফুলের গাছটিকে বাগানে এনে বসায়, প্রিয় রঙের জামা পড়তে পছন্দ করে, প্রিয়  খাবার খেতে পছন্দ করে, প্রিয় রঙের জিনিসের প্রতি তার একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে। এমন কি মানুষের ক্ষেত্রেও।  সে তার প্রিয় মানুষটিকে জীবনে পেতে চায়। প্রিয় জিনিস বা বস্তু বা মানুষটিকে, নিজের সব প্রিয় বিষয়গুলোকে নিজের করে পাওয়াটা কী খুব জরুরী ? "
               ভীষণ গরমের মধ্যে একটা মানুষ ঘরে ঢুকেই আগে সব জানলাগুলো খুলে দেয়। তারপর পাখাটা চালিয়ে দিয়ে মেঝেতে একটু বসে। ক্লান্তি বেশি থাকলে ঠাণ্ডা মেঝেতে সে শুয়েও পড়তে পারে। কিছুক্ষণ পরে স্নান করে সে বারান্দার ঠাণ্ডা হাওয়ায় এসে বসবে। এই যে মানুষটা বাড়ি ফিরে পর পর কাজগুলো করে গেল সবগুলোই তার ভালোলাগা। প্রিয় বলেই সবগুলোকে সে কাছে ডেকে নিল। শুধু তাই নয়, প্রিয় জিনিসগুলো তাকে ভালোও রাখলো।
               এবার একটু অন্য দিকে তাকাই। প্রিয় ফুল, প্রিয় পোশাক, প্রিয় খাবার ------ এগুলো তো আসলে খণ্ড খণ্ড আমি। এসবের যোগফলই তো সম্পূর্ণ আমি। এগুলো কেন প্রিয় ? কারণ এগুলো আমাকে ভালো রাখে। এগুলোর সংস্পর্শে আমি ভালো থাকি। আমার মাথার ওপর যে পাখাটা ঘুরছে, আমি চাইবো না পুরো গরমটায় পাখাটা আমার মাথার ওপর যেন সবসময় ঘোরে ? যে যে খাবারগুলো আমি ভালোবাসি আমি চাইবো না সারা বছর যেন আমি ওই খাবারগুলো খেতে পাই ?
               " নিজের সব প্রিয় বিষয়গুলোকে নিজের করে পাওয়াটা কী খুব জরুরী ? " ------- হ্যাঁ,  অবশ্যই জরুরী। তা যদি না হয় তাহলে তো ওই প্রচন্ড গরমের মধ্যে ক্লান্ত মানুষটার মাথার ওপর পাখাটা বন্ধ করে দিতে হয়। রৌদ্রদগ্ধ পথিক গাছের নিচে না দাঁড়িয়ে প্রখর রোদে দাঁড়িয়েই বিশ্রাম নিতে পারত। কিন্তু তা তো হয় না। সে তখন শীতলতাকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়।
               প্রতিটা মানুষ চায়, তার চারপাশে যেন সবসময় ইতিবাচক আবহাওয়ার প্রাধান্য থাকে। যদিও তা মানুষ পায় না কিন্তু যাত্রাটা সেদিকেই থাকে।

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। তেত্রিশ ।।


               বিকেলবেলা। গ্রামের একটি বাস স্টপেজ। একটা পাড়াই বলতে গেলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু মানুষ। একটা গাছের গোড়া গোল করে বাঁধানো। ঠিক তার পাশেই একটা ঠাকুরের বেদি। দু'একটা দোকান।
               রাস্তার ওপারে একটা টাইম কল। মুখ দিয়ে অনবরত জল পড়ে যাচ্ছে। বেশ জোরেই। আমি এ নিয়ে দু'এক কথা বলতেই দু'একজন কথা বলে উঠল। তারা বললো, কল বন্ধ করে কিছু করতে গেলে পাইপ ফেটে যাবে। আমি অন্য টাইমকলের কথা উল্লেখ করে বললাম, কেন, অন্যান্য কলের পাইপগুলো তো ফেটে যাচ্ছে না। ওরা বললো, এই কলটা অন্য জাতের। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
               একটা জিনিস লক্ষ্য করে আমি অবাক হলাম। আশে পাশে কত মানুষ। এদের মুখে একবারেও জন্যেও আমি জল নিয়ে কোনো কথা শুনলাম না। আমি নিজে থেকে বললাম কিন্তু কেউ ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না। একজন শুধু বললো, মুখে প্যাঁচ একটা লাগানো হয়েছিল কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই হাওয়া।
               নিজেরটুকু ছাড়া দেশের অন্য আর সকল কিছুকে আমার বলে দাবি করার ইচ্ছাটা এদেশের মানুষদের মধ্যে জন্মাল না কেন? শুধু তাই নয়, কৃত কর্মের জন্য মানুষের কোনো অপরাধবোধ নেই, লজ্জা তো কোন কালে ত্যাগ করে ফেলেছে।
               গ্রাম বলেই চিন্তাটা বেশি হয়। শহরের ইঁট কাঠ পাথরের মানুষ তো নয়। মাটির মানুষেরাও এসব নিয়ে ভাববে না ? আমরা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব ?
               ওখানে যতক্ষণ ছিলাম কি অস্বস্তিটাই না হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এখনই বাস চলে আসুক। আমি এখান থেকে পালিয়ে যাই।



(চলবে ..)

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়







।। একত্রিশ ।।

               ভোরে উঠতে আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে গরমকালের ভোর। ভোর মানেই একটা ঠাণ্ডার বাতাবরণ। একটা সুন্দর মিষ্টি হাওয়া দেয়। গরমকালের ভোরে ওই মিষ্টি হাওয়াটাই আরও মধুর হয়ে যায়। বেশিরভাগ মানুষই ওইসময় মাথার বা পায়ের জানলাটা খুলে দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। আমি কিন্তু উঠে পড়ি। এর প্রধান কারণ, ওইসময় চারপাশটা খুব চুপচাপ থাকে। মনে হচ্ছে সবদিক থেকে সবাই আস্তে আস্তে ঘুম থেকে জেগে উঠছে। এটা মনে মনে ভেবে নিয়ে চারপাশটা দেখলে চোখের সামনে সবকিছুই খুব কাছের বলে মনে হয়।
               ছোটবেলায় খুব ভোরে উঠেই পানপুকুরের পারে আমগাছতলায় ছুটতাম আম কুড়ানোর জন্যে। বেশিরভাগ দিনই আম পেতাম না কিন্তু তাতে বিরক্ত হতাম না। আসলে ভোরবেলা উঠে ভোরের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আমতলায় যাওয়াটাই আমার কাছে প্রধান ছিল। তাই আম পেলাম কি পেলাম না তাতে আমার কিছু যায় আসতো না।




।। বত্রিশ ।।



               বর্ষায় বৃষ্টির দিনগুলোতে আমার মোটেই ভালো লাগত না। মনে মনে খুব একা হয়ে যাই। এইজীবনের ফেলে আসা সময়ের মানুষজনরা আমার ভাবনার পথ আঁকড়ে ধরে। কত কত কথা যে মনে পড়ে যায় ------ অথচ আজ তারা কতদূরে। যে রোদ ছাড়া আমার একমুহূর্ত চলে না, সেই আকাশ আজ মেঘে ঢাকা। চাইতে পারি না আকাশের দিকে। মনে হয় আমি যেন তার গলা টিপে ধরেছি। সে ঠিক ঠিক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না। এই অস্বস্তি তখন আমার মধ্যেও কাজ করে। কিছুই ভালো লাগে না তখন।
               ছোটবেলায় বর্ষার সময় মাকে খুব জ্বালাতন করতাম। ঘুরতে ফিরতে মায়ের মুখের কাছে এসে বলতাম, " কিচ্ছু ভালো লাগছে না।" এক একসময় মা খুব রেগে যেত। সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার আগে মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, " মা রোদ উঠেছে ? " মা ' না ' বললেই একরাশ মন খারাপ নিয়ে পাশ ফিরতাম।


(চলবে...)

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়








।। ঊনত্রিশ ।।



               বছর পাঁচেক আগের কথা। আনাজ বাজারে মৃণালদার সঙ্গে দেখা। আমার বাজার করাটা যেন একটা যন্ত্রণার মতো। শুরু থেকেই শেষ হওয়ার কথা ভাবি। মৃণালদা কিন্তু ঠিক এর উল্টো। উনি বেশ ধরে ধরে সময় নিয়ে বাজার করেন। কি একটা বিষয়ে কথা হতে হতে আমি হঠাৎ বলে বসলাম, " আচ্ছা মৃণালদা, শেষ কবে মনের কথা কাউকে বলছেন ? "দেখলাম মানুষটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলেন। খুব কাছে দাঁড়িয়েও আমি যেন তাকে ছুঁতে পারছি না। " ঠিক বলেছ ভাই, অনেক দিন হলো কাউকে মনের কোনো কথা বলতে পারি না। " মনে হলো, উনি আরও কিছু বলতে চান। আমি আরও দু'একটা কথা বললাম, " একবার ভেবে দেখুন, বৌদির কোনো কথা বলার ইচ্ছা হলে আপনাকে বললেন। ভাইপো, ভাইঝির কোনো কথা বলার দরকার হলে ওরা আপনাকে বলবে। কিন্তু আপনি ? কোনো সুযোগ নেই। আপনাকে সব কথা বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখতে হবে। " দেখলাম, মৃণালদা চোখ বুজে। একটু পরেই দেখি উনি কাঁদছেন। আমি তো বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম। ভাবতেই পারি নি, কথাটা ওনাকে এতখানি আঘাত করবে।




।। ত্রিশ ।।


               রোজই ভাবি, আজকের রাতটা আর ঘুমাব না। সারাটা রাত লিখে পড়ে কাটিয়ে দেব। কিন্তু পারি না। ছ'টা বাজলে উঠতেই হবে। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো থাকে। রাত চিনেছি মায়ের কাছ। মাকে পড়ে কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যেত না। পড়তে পড়তে কত রাত হয়ে যেত। মা তবুও রাতের খাবার দিত না। এইভাবে পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে যেত। এই যে রাত জাগার অভ্যাস আজ পর্যন্ত তার সামান্যটুকুও কমে যায় নি বরং আরও অনেক বেড়ে গেছে। আসলে রাত হলে আমি নিজেকে যেন খুঁজে পাই। রাত আমাকে আমার কাছে এনে দেয়।


(চলবে..)

আলো ছায়ার কথামালা :হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





।। সাতাশ ।।




          ছোটবেলায় মাটি দিয়ে মূর্তি বানাতাম। তখন বোধহয় ক্লাস ফাইভে পড়ি। এঁটেল মাটি হবে সম্ভবত। একটা কাঠের ছোট্ট পাটার ওপর মূর্তিটা তৈরি করতাম। স্নান করে খেয়ে উঠে বসতাম। সেরকম বলার মতো কিছুই নয়। কাদাটাকে নিয়ে হাতের কায়দায় মোটামুটি একটা আকার দেওয়া। ঘন্টা খানেকের পরিশ্রমে কিছু একটা রূপ দেওয়ার চেষ্টা। কি হয়ে উঠত জানি না তবে কাজ শেষ হলে রান্নাঘরের চালে শুকোতে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। মূর্তি তৈরির দিনগুলোতে ঘুম থেকে উঠতে কি ভালো লাগতো। মনে হতো ঘুম থেকে উঠে যেন চোখের সামনে অন্য কিছু দেখব। রোদের ছোঁয়ায় মূর্তিটা যেন অন্য রূপ পেয়ে গেছে। কিন্তু দেখতাম অন্য ছবি। রোদ এসে মূর্তির মাটিটাকে পুরোপুরি ফাটিয়ে দিয়েছে ! মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। সঙ্গে সঙ্গে ওই ফাটা জায়গাগুলোতে মাটি লাগিয়ে দিতাম। তারপর ঘরে তুলে রাখতাম। পরের দিন দুপুরে আবার রোদে দিতাম। ঘুম থেকে উঠে আবার ফেটে যেতে দেখতাম। আবার ফেটে যাওয়া অংশটায় মাটি ধরাতাম। এত মাটি যে কোথায় যেত ! অথচ মূর্তিটা একটুও মোটা হতো না !



।। আঠাশ ।।


          আমাদের ঘরেই ছিল পথের পাঁচালীর হরিহর। আমার বাবা। বাবার সঙ্গে অনেক জায়গাতেই যেতাম। রাতের অনুষ্টানগুলো একটাও বাদ যেত না। বিয়ে বাড়ির অনুষ্টান থাকলে রাত দুটো আড়াইটে বেজে যেত। গ্রামের ধুলো ওঠা রাস্তা। বাবা আর আমি রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরছি। বাবার হাতে হ্যারিকেন। বাবা এমনিতেই বেশি কথা বলত না। রাতের রাস্তায় তো কথাই নেই। আমি আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাতকে পড়বার চেষ্টা করতাম। কোনো কোনো জায়গায় এসে বাবা দাঁড়াত। চারপাশ এতো চুপচাপ যে আমরা আমাদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। মুখে না বললেও বাবার আচরণেই স্পষ্ট হয়ে যায় ------ সেও রাতের সময়টুকু তার নিজের মতো করে রাতকে পড়ছে।


(চলবে...)

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়








।। পঁচিশ ।।


          অনেক বছর পরে ছোটবেলার হাত ধরে একটু বেরিয়েছিলাম আমার জন্মগ্রামের রাস্তা দিয়ে। আমি পায়ে পায়ে পথ ভুল করছি। কিছুতেই একটানা পথ চলতে পারছি না। কতবার যে থামতে হচ্ছে তা গুণে শেষ করা যাবে না। ভাগ্যিস ও সামনে ছিল তাই, না হলে যে কি হতো! নিজস্বতাকে কি কেউ এইভাবে খেয়ে নিতে পারে ? কিছুতেই চিনতে পারছিলাম না। শুধু বাড়ি আর বাড়ি। একটা গাছ নেই। ছোটবেলায় যাদেরকে খুব কাছ থেকে চিনতাম তারা আজ একজনও নেই। পথের মেজাজটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কতবার এই পথ ধরে হেঁটে গেছি। কত কষ্টয় গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি। কখনও বসেও পড়েছি। গাছকে জড়িয়ে সামনে তাকিয়েছি। প্রখর দুপুরে গাছ প্রকৃত পিতার মতো বিছিয়ে দিয়েছে তার ছায়া। আজ কোথায় তারা! মনে আজ স্বজন হারানোর বেদনা। যেদিকেই তাকাই সারি সারি বাড়ির বন্ধ দরজা। চারিদিকে শুধু সন্দেহ আর বিদ্বেষের বিষবাষ্প। মানুষগুলোও কত বদলে গেছে। এদের একজনকেও আমি ঠিক চিনি না। আগে রাস্তায় দাঁড়ালে কত লোক হাত বাড়াত। এখন সব জানলা দরজা বন্ধ। কোনো কোনো বাড়ির অনেক উঁচুতে একটা জানলা হয়ত খোলা। তাও সেখানে কোনো মুখ নেই। অন্ধকারের মতো একটা গর্ত হয়ে আছে।



।। ছাব্বিশ ।।


          জীবনের অনেকটা সময় আমার বিভিন্ন রেল স্টেশনে কেটে গেল। গ্রীষ্মের দুপুরগুলো তো অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছি। কেন এত ভালো লাগে রেল স্টেশন ? অনেক প্রশ্ন করেছি নিজেকে, কোনো উত্তর পাই নি। আজ বুঝতে পারি সে কেন এত প্রিয়। ছোটবেলা থেকে একা একাই থেকেছি নিজের মনে। কাউকে কখনও বিরক্ত করি নি। ছোটবেলায় জ্বর হলে সকলেই মাকে খোঁজে। আমি একা একা বিছানায় শুয়ে থাকতাম। মায়ের এই নিয়ে একটা কষ্ট ছিল। আসলে আমি চাইতাম না আমাকে নিয়ে সবাই খুব বেশি ভাবুক। আজও এই স্বভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। মানুষকে ভাবিয়ে তোলার মতো কোনো কাজই আমি করে উঠতে পারি নি।
          রেল স্টেশনে বসলে আমার মনে হয়, পৃথিবীর অনেক কিছু থেকে যেন নিজেকে বার করে আনতে পেরেছি। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আমি তখন নিজের মনে উড়ে বেড়াতে পারি।



(চলবে....)

আলো ছায়ার কথামালা :হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়




।। তেইশ ।।



          মানুষ মুখে বলে এক, আর যখন কাজ করতে যায় তখন করে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ। এটা দিনের বেশিরভাগ সময় করে বলে এটা তার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু করার নেই। চেষ্টা করলেও সেখান থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কারণ তার ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে সে এইসবেরই অনুশীলন করেছে। কিন্তু যখন সে বাইরে আসছে, মানুষের সঙ্গে মিশছে তখন সে নিজের একটা অন্যরকম ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইছে। আসলে সে তো জানে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। আসলে বাড়িতে যে জামাই পড়ুক, বাইরে একটা অন্যরকম ছাল দরকার হয়ে পড়ে। এটাও ঠিক সেরকম। খুব ঘনিষ্ঠ জন যখন এটা করে তখন এটা খুব কষ্ট হয়।
আমরা অসহায়। কিছু করার নেই। বাঁচতে তো হবে। তাই এসব মানুষদের নিয়েই পথ চলতে হবে। জীবন থেকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই, তাহলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।



।। চব্বিশ ।।


          প্রায় ত্রিশ বছর লেখালিখির সঙ্গে ঘর করার পর মনে হল, আমি লিখতে পড়তে দুটোই ভালোবাসি। লেখা ছাপানোর থেকে লেখা লিখতেই আমি বেশি খুশি হই। আমি সবসময় বলি, লিখে আমি যে আনন্দ পাই, সেই আনন্দ আমাকে কেউ কোনদিন দিতে পারবে না। এতদিন সাহিত্যের সঙ্গে ওঠাবসা করার পর বুঝতে পারলাম, এটা একটা এমন জগৎ যেখানে থাকে সম্পূর্ণ নিজের একটা পৃথিবী। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা যেখানে প্রবেশ করতে পারে না। ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসা যায়। কে কত বড় কবি সে তো সময় বলবে। কিন্তু একটা জিনিস পেয়েছি ------- হাজার না পাওয়ার মাঝেও নিজের মধ্যে পরিপূর্ণতার একটা স্বাদ। এজন্য সাহিত্যের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

আলো - ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। একুশ ।।




          একদিন এক কবিসম্মেলন থেকে রাতের ট্রেনে ফেরার সময় মনে হল, কতদিন বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হয় নি। কথাও হয় নি কতদিন। এরকম মাঝে মাঝেই মনে হয়। এমন নয়, কবিতা লেখার একটা ঘোরার মধ্যে আছি তাই এমন একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছে। এই মনে হওয়াটা ভীষণই স্বাভাবিক। নিজের মধ্যেই কেমন যেন একটা তালগোল পাকিয়ে যায়। কিছুতেই সেই জট ছাড়াতে পারি না। ভেতরে ভেতরে এত অস্থির হয়ে উঠি যে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারি না। জন্মগ্রামে থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টা দূরে থাকি। মনে হয় এক্ষুণি দূরত্বটা পেরিয়ে যাই।
          যে কথা মাকে বলা যায় তা তো আর কাউকে বলা যায় না। হয়ত বলা যায় কিন্তু শুনবে কে মায়ের মতো অত ধৈর্য্য ধরে ? কার অত সময় আছে ? তাই বলতেও পারি না। বুকের মধ্যে জমা হয়ে থাকে কত কথা। হঠাৎ যেদিন সন্ধেবেলা বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় সেদিন বই পড়তে, কবিতা লিখতে কিছুই ইচ্ছা করে না। চোখের সামনে ভাসে,  মা রান্না দুয়ারে বসে ভাত রান্না করে। ভাত ফোটার আওয়াজ শুনতে পাই। খিদে বাড়তে থাকে। রান্না দুয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকি। লম্ফর আলোয় মায়ের মুখের ঘাম চকচক করে। একসময় মা ভাত খেতে ডাকে। গরম ভাতের গন্ধ আর মায়ের মুখের হাসি। আমি ভাত খাই আর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কত বছর কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি। তাই মাঝেমাঝেই মাথাটা খুব ভারি হয়ে যায়, কিছুতেই তুলতে পারি না।



।। বাইশ ।।


          রথ এলেই মেজ জেঠিমার কথা খুব মনে পড়ে। আমাকে রথ দেখতে দিত পঞ্চাশ পয়সা। আর ছোটো ঠাকুমা দিত পঞ্চাশ পয়সা। তবে মেজ জেঠিমাই এই নিয়ম প্রথম চালু করে। আমার একটা মন আছে আর সেই মনও আনন্দ চায়। তাই কোনো মেলা উপলক্ষে আমার মতো একটা ছেলেকে পয়সা দেওয়া যেতেই পারে। এই এক টাকা নিয়ে আমি সেদিন রথের রাজা। আজ বড় হয়ে গিয়ে কত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পয়সা দিতে হয় কোনো মেলা উপলক্ষে। খুব আনন্দ পাই এসব দেওয়াতে। তবুও আজ খুব পেতে ইচ্ছা করে। আমি চাই কেউ মেলা উপলক্ষে আমাকেও পয়সা দিক। তবে এসব কথা তো কাউকে ভুলেও বলা যাবে না। কারণ খুব সহজেই সে আমাকে পাগল বলে চিহ্নিত করবে। মনে পড়ে, তখন মহাশ্বেতা দেবীর "বর্তিকা" পত্রিকাটি দেখাশোনা করি। বিকেল হয়ে গেছে। কাজ শেষ করে বাড়ি আসব এমন সময় দিদি আমাকে ঘরে ডেকে দশটা টাকার একটা নোট হাতে দিলেন বইমেলায় যাবার জন্য। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন।  সত্যিই আজ আমার জীবনে পয়সা দেবার মতো কোনো মানুষ নেই।




আলো-ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। উনিশ ।।

নদীর পাশে এসে একবার দাঁড়ালেই হলো। কত কথা যে মনে পড়ে যায়। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আমার সব হারানো অতীত নদীর শাখাপ্রশাখার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বরং এর উল্টোটাই। কিন্তু তবুও নদীর হাত ধরে আমি অনেক অনেক দূরে চলে যাই। আমার ফেলে আসা পথ। আসলে আমার জীবনের বেশিরভাগটাই নদীকে পাশে নিয়ে কেটেছে। ঠিক একইভাবে গাছের পাশে দাঁড়ালেও আমার অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। এক একটা পাতা খসে পরে আর আমিও একটু একটু করে পিছনে চলে যাই। আসলে গাছ নদী ----- এসবই এক একটা প্রবাহ। ঠিক মতো পা মেলাতে পারলে আমরা যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারি।


।। কুড়ি ।।

আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা শীতকালের পুরোটাই ঘুড়ি উড়িয়ে কাটাতাম। নভেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে আমাদের বাৎসরিক পরীক্ষা হয়ে যেত। এরপর দুপুর বিকেল জুড়ে চলত আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো। একসঙ্গে অনেকজন মিলে নয়। দুজন কি চারজনে আমরা কিছু খেয়েই বারোটা নাগাদ ধান কাটা মাঠে নেমে পড়তাম। একটু দূরে দূরে আমরা বসে পড়তাম যে যার নিজের নিজের ঘুড়ি নিয়ে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে, আমরা ঘুড়ি ওড়াতাম অথচ কাটাকাটি খেলতাম না। এইভাবেই আমাদের মনে ছোটবেলা থেকেই কেটে দেওয়া, ছিঁড়ে দেওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো স্থান পায় নি।

কবিতার চারপাশ : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






গত রাতেও আমার কবিতায় এসেছে
একটা চড়ুই, দক্ষিণের দুটো হলুদ বারান্দা,
একটা বিষন্ন নদী, বর্ষার বৃষ্টিতে ভেজা একলা রাস্তা
আজ সকালে তারা কোথাও নেই
কবিতার পথ ধরে আমি তাদের চিনি নি
তারা এমনই আসত নিজের নিজের গান নিয়ে
আমিও যে তাকে দু'একটা শোনাইনি তা নয়

নদী বিষন্ন না হলে ঢেউ চাইব কার কাছে ?
চড়ুই ছাড়া সকালের ক্যানভাসে কোনো রোদ নেই
বর্ষার একলা রাস্তার কাছেই তো জেনে নেব
বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে কতবার বসতে হবে

হঠাৎ করে এতটা ফাঁকা জায়গা দেখি নি তো আগে
বুঝতে পারছি না, ঠিক কোথায় দাঁড়াব
এরা সবাই আমার চারপাশে ছিল
আমরা যে খুব কথা বলেছি তা নয়
তবুও ওরা ছিল ওদের মতো করে ------- থাকতেই হয়, 
তা না হলে চোখ রাখব কোথায়?

আলো-ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। সতের ।।


সেইসময় ক্লাস ফোর কি ফাইভ পড়ি। এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নাম সৌমিত্র প্রসন্ন সরকার। বাবার বদলির চাকরি। তাই এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। বাবার সঙ্গে পরিবারও। সৌমিত্র আমাদের স্কুলে ছিল একবছরেরও কম। প্রচণ্ড অস্থিরে। যা মনে করত তাই করত। কারও কথা শুনত না। শিক্ষকের হাতে এইজন্যে তাকে প্রায়ই প্রচণ্ড মার খেতে হত। আমার সঙ্গেও তার বিশেষ কোনো যোগ ছিল না। তবুও তাকে মনে আছে আমার। যে আমি কত কত কথা মুহূর্তে ভুলে যাই, সেই আমি কি করে সৌমিত্রকে মনে রাখলাম! মনের কোন কোণে সে এতদিন পর্যন্ত বন্দি আছে। আর কেনই বা আছে? একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের সামনেই একটা দোকান ছিল। আমরা টিফিনবেলায় সেই দোকানে থেকে কুলের আচার কিনে খেতাম। একদিন টিফিনে আমি কুলের আচার খাচ্ছি। সৌমিত্র হঠাৎ এসে হাজির। আমি ওকে কুলের আচারের ভাগ দিলাম। এরপর সৌমিত্র বলেছিল, " আমি জানি তোর ভাগ আমি পাবই।" কেন বলেছিল তাও জানি না। আমার ওপর তার এমন কিছু জোর ছিল না যেখান থেকে সে এটা বলত পারে। তবে সৌমিত্রকে দেখে মনে হত সে কারও সঙ্গেই সম্পর্ক গভীর করতে চায় না। যেহেতু সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তাই তার কোথাও শিকড় গাড়া উচিত নয়। মনে হতো এটা সে রক্ত দিয়ে বিশ্বাস করত। এই মনে থাকাটা আমার কাছে সত্যিই রহস্যময়। হয়ত এটাই নিয়ম। কত কত কান্নার মধ্যে বর্ষায় রাস্তার ধারের একটা ফুটপাতে একটা কুকুরের কান্না যে কারণে আমৃত্যু মনে থাকে, সৌমিত্রও সেই কারণে আজও আমার মনে অমলিন।



।। আঠারো ।।

আরও একজনের নাম মনে আছে। যাকে আমি জীবনে কখনও চোখে দেখি নি, ছেলে কি মেয়ে তাও জানি না। নাম ওডোনেল ডিকস্টা। একজন পোর্তুগীজ। একটি পত্রিকার তরফ থেকে মাইকেলের জন্মদিনে তার কবরে কবিতা পড়তে গেছি। যখন কবরস্থানে গিয়ে পৌঁছলাম তার একটু আগেই একজনকে কবর দেওয়া হয়েছে। মাটি তখনও কাঁচা। বোর্ডে তার নাম লেখা। ওই নামটুকুর মধ্যে দিয়েই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। কবিতা পড়তে পড়তে আমি কেবলই পিছন ফিরে তার দিকে তাকাচ্ছি। মনে হচ্ছে সে যেন আমার কবিতা শুনছে। মনে হচ্ছে এযেন তার অনেক দিনের ইচ্ছা। হয়ত সে মাইকেলের ভক্ত। তার জন্মদিনে তো আর জন্মানো হল না। অবশ্য জন্মেছে কি না তাই বা কে জানে। তাই মাইকেলের জন্মদিনে মরে সে গুরুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায়। কবিতা শুনবে বলেই আজকের এই বিশেষ দিনে তার মরে যাওয়া। হয়ত এই স্বতন্ত্রতার জন্যেই ওডোনেল ডিকস্টাকে আমার পঁচিশ বছর পরেও মনে আছে


(ক্রমশ..)

আলো-ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





।। পনের ।।

গরমকালের ভোরবেলা একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার পরিবেশ। মা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে থাকত। আমি আস্তে আস্তে উঠে বাইরে পালাতাম। তখন সবেমাত্র একটু একটু আলো ফুটছ। উদ্দেশ্য আম কুড়ানো। কিন্তু সেটাই একমাত্র নয়। আসলে ভোরের আকাশ, ঠাণ্ডা বাতাস আর চারপাশের নির্জনতা আমাকে ভীষণভাবে টানতো। তাই যখন আমবাগানে গিয়ে দেখতাম আমার অনেক আগেই অনেকে আমতলা খুঁজে ফেলেছে তখন এতটুকু মনখারাপ হতো না। ভোরবেলা বাইরে আসতে পেরেছি এটাই যেন অনেক আনন্দের। কোনো কোনো দিন আমবাগানের ভেতরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম। চারপাশের মানুষজনদের আস্তে আস্তে জেগে ওঠা, পাখির ডাক ----- এসব কিছুর মধ্যে ভাসতে ভাসতে কখন যেন আমের কথা ভুলে যেতাম।



।। ষোল ।।


সন্ধে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ আস্তে আস্তে নির্জনতায় ডুবে যাওয়া, বাসায় ফেরা পাখিদের চিৎকার চেঁচামেচি। ঠিক এর পরেই কানে আসত কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। আর কান পেতে শুনতাম সন্ধের আবহসঙ্গীত। একটু পরেই শুরু হতো সন্ধের আরতি। দেখতাম মা হাতজোড় করে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কোনো দিন দেখতাম মা ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কাঁদছে। আজও যখনই কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ কানে আসে তখনই ভেতর থেকে আমাকে কে যেন টেনে ধরে। সন্ধের আবহসঙ্গীত আবিষ্ট হয়ে পড়ি। পার্থিব জগৎ থেকে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই।


(ক্রমশ...)

আলো-ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়







।। তেরো ।।

চৈত্র মাসের সন্ধেবেলা। হ্যারিকেন নিয়ে পড়তে গেছি। অর্ধেক পড়া হয়েছে। ঝড় উঠলো। একটু পরেই বৃষ্টি। সারাটা দুপুর বেশ গরম গেছে। এখন বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। সন্ধের একটু পরের বৃষ্টি চারপাশকে কেমন চুপচাপ করে দেয়। তার ওপর আবার গ্রাম। হ্যারিকেন নিয়ে বাড়ি ফিরছি। ব্যাঙ ডাকছে। রাস্তায় দু'একটা লোক। আমি প্রায় একাই। রাস্তার ধারে ধারে আমগাছ। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। ভয় যে একেবারেই করত না তা নয়। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত একটা ভালোলাগা বোধ। কতদিন হল ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁর ডাক কান থেকে সরে গেছে। আজ মনে হয় ওইগুলোই ছিল প্রকৃত গ্রামীণ জীবনের সঞ্চয় যা একটা মানুষকে ইঁট কাঠ পাথরের মাঝেও আমৃত্যু সবুজ রাখতে পারে।




।। চোদ্দ ।।

দেওয়ালীর রাতে প্রতিটা বাড়িতে মোমবাতি জ্বলছে। আমরা সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে দেখছি কোন বাতিগুলো নিভে গেছে। বাতি নিভে গেলেই আমরা সেগুলো নিয়ে নিতাম। নেভা বাতি তুলে নেওয়ার সময় খুব তাড়াতাড়ি ফুঁ দিয়ে একটা দুটো বাতি নিভিয়ে সেগুলোও হাতে তুলে নিতাম। যখন বাড়ি ফিরতাম মনে হতো রাজ্য জয়ের আনন্দ। বাতিগুলো পেয়ে যে কি আনন্দ হতো তা বলে বোঝাতে পারবো না। বছর ঘুরে গেলেও সেগুলোকে কাছ ছাড়া করতাম না। আজও ভাবলে বাতিগুলো মনকে উষ্ণ রাখে।

(কর্ম

আলো-ছায়ার কথামালা :হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





।। এগারো ।।

ছোটবেলায় রোদ উঠলে খুব আনন্দ হতো। হ্যাঁ, রোজ রোজ এই আনন্দ পেতাম। একনাগাড়ে তিন চার দিন বৃষ্টি হওয়ার পর মেঘলা আকাশ দেখে যখন খুব মন খারাপ সেই সময় সকালে ঘুম থেকে চোখ খুলেই মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, রোদ উঠেছে কিনা। মায়ের নেতিবাচক উত্তরে এত মনখারাপ হতো যে কী বলব! আমি আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। এত কষ্ট হতো যে মনে হতো আমার যেন কিছু হারিয়ে গেছে। আজও এই স্বভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি। বরং আরও বেড়েছে। কিন্তু আমি রোদ ভালবাসি কেন?? আমি দেখেছি রোদের আলোয় আমি নিজেকে পড়তে পারি। মেলে ধরতে পারি। মেঘলা দিনে আমার আলোর পৃথিবী ঢাকা পড়ে যায়। কারও মুখ দেখতে পাই না। মনের মানুষ ছাড়া থাকবো কি করে? মেঘলা দিনে আমার মনের মানুষ আভরণহীন। তাই তো এতো মনকষ্ট!


।। বারো ।।

সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। তখন একটা চার্মস সিগারেটের দাম ছিল পঁচিশ পয়সা। দুজনে পয়সা দিয়ে কিনতাম। তারপর অনেকটা সাইকেল চালিয়ে অনেক দূরে চলে যেতাম। ধরানোর আগে সিগারেটটা ভালো করে দেখতাম। আর মনে মনে ভাবতাম একটা সিগারেট একটা মানুষকে কত তাড়াতাড়ি বড় করে দেয়। সেই সময় কেউ যদি ছোট বলতো তাহলে এতো রাগ হতো না! আর কিছু বলতেও পারতাম না। তবে পঁচিশ পয়সার একটা সিগারেটের হাত ধরে আমি রোজ একটু একটু করে বড় হয়ে যেতাম।

(ক্রমশ...)

আলো-ছায়ার কথামালা :হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। নয় ।।

মানুষের পয়সা হলে কতরকম ভাবে মানুষ তার ব্যবহার করে।শিল্পী সুনীল দাসের কথা মনে পড়ে যায়। একদিন তাঁর চেতলার স্টুডিওতে বসে গল্প করছি। হঠাৎ সুনীলদা বলে উঠলেন, "জানো, আমার কিন্তু এখন অনেক পয়সা হয়েছে।" হঠাৎ এরকম একটা কথার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তাই কথাটা শুনেই আমি হেসে উঠলাম। উনি বলে চললেন ----- চারপাশ থেকে যদি আমার কানে আসে কেউ পড়াশোনা করতে পারছে না, সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে ডেকে পাঠাই। তারপর তার অসুবিধার কথা শুনে আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। টিভিতে যদি শুনতে পাই একটা ছাত্র তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা করতে পারছে না। আমি টিভি অফিসে ফোন করে তার পরিচয়টা জেনে নিই।" সুনীলদা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তাঁর কথাগুলো আজও মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করছে। সমাজের নিঃস্ব মানুষগুলোর জন্যে সুনীলদার মতো মানুষের যেন আরও পয়সা হয়।



।। দশ ।।

সেই কোন ছোটবেলা থেকে আমার মনে একটা প্রশ্ন খুব উঁকি দিত। একজন শিল্পী একটা ছবি কতদিন ধরে আঁকেন? এর উত্তর আমি নিজেও জানি। তাহলে প্রশ্ন করছি কেন? করছি এই কারণে যে আমি এই প্রশ্নের চিরাচরিত উত্তরের অতিরিক্ত কিছু শুনতে চাইছি। শিল্পীদের সঙ্গে আমার যখন ওঠা বসা শুরু হল তখন একদিন শানু লাহিড়ীকে এই প্রশ্ন করলাম। উনি বললেন, "অদ্ভুত প্রশ্ন তো! দেখো একটা ছবি আঁকতে অনেক সময় লাগে। বিভিন্ন জনের কাছে সেই সময় বিভিন্ন হয়। তবে আমারটা আমি বলতে পারি, আমি একটা ছবি তিনমাসে আঁকলেও, আসলে ওই ছবিটা আঁকতে আমার লেগেছে আসলে মাত্র তিন মিনিট। কারণ ওই সময়টুকুতে আমি আমার মধ্যে ছিলাম না। আর ওইসময় আমার হাত দিয়ে যা বেরিয়েছে সেগুলোই আগামী দিনে চিত্রমোদী দর্শকেরা আলোচনা করবে।" সত্যিই সৃষ্টির মধ্যে কতই না রহস্য আছে। য়ত শুনি ততই অবাক হয়ে যাই।


(ক্রমশ...)