১.
বিরক্তিকর নজরে তাকিয়ে আছি নার্সের দিকে। মা আর নাজিম ঢুকতে দিচ্ছে না এই নার্স। খুবই খারাপ আচারন করছে আমার পরিবারের সাথে। টাকা দিলেই নিশ্চয়ই ঢুকতে দেবে। আমি জানি আমার মার কাছে একটা ফুটো পয়সা নেই। হয়তো নাজিমকে নিয়ে আমার মা হেটে হেটে এসেছে এই হাসপাতালে। নাজিম আমার ছোট ভাই। বেশী নাহ প্রায়ই দু বছরের। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। এই জানুয়ারিতে বিশ হয়েছে। খুবই করুণ দৃষ্টিতে নার্সের কাছে অনুরোধ করছে নাজিম। 'আফা। আমরা এক্ষন যামু আর এক্ষণ আমু। প্লিস একটু ঢুকতে দেন।' আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। আমার কান্না দেখেও নরপশু নার্স ঢুকতে এখনও অনুমতি দেয়নি। ' টাকা চাই' এই আবেদন আমার পরিবারের কাছে করছে এই নার্স। মুখে না বললেও। তার এই আবেদন তার চোখের চাহনিতে থেকেই বুঝা যাচ্ছে। আমার ব্লাড ক্যান্সার। যাকে ল্যাটিন ভাষায় বলে লুকেমিয়া। এই রোগে আক্রান্ত আছি আমি। ওরা চলে যায়। নার্সের পোষাক পরিহিত এই পশুটি ঢুকতে দেয় নি আমার পরিবারকে। কিছুক্ষণ পর সেই নার্সটি একটা কাগজ হাতে আমার কাছে আসে।
আর আমি দেখি তার চোখে লাল। আমি নিশ্চিত প্রচন্ড কেঁদেছে সে। মুখে কান্নার দাগ।মেকাপ করা মেয়েদের কান্না করলে তার চোখে জল যেদিকে যেদিকে গড়িয়ে যায় সেদিকে সেদিকে মেকাপ ধুয়ে যায় আর দাগ হয়ে যায়। সেরকমটা হয়েছে এই নার্সটির ক্ষেত্রে। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, 'আপনি কান্না করছেন কেন?'
কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলে, 'আপনার আম্মা পাঠিয়েছে। '
আমার মা এইট ক্লাস পাশ। লিখতে ও পড়তে তিনি জানেন। আমি বললাম, ' ধন্যবাদ। আপনি কি এই চিঠিটা পড়েছেন?'
চুপ করে রইলেন তিনি। আর আস্তে চলে গেলেন। আমার বুঝতে বাকী রইলো না যে তিনি এই চিঠিটা পড়ে ইমোশনাল হয়ে গেছে। মেয়েদের আবেগ প্রচন্ড বেশী হয়। মেয়েটির আবেগের সাথে সাথে অহংকারও অনেক বেশী। আর আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।
' রাসেল,
বাবা তুই আমায় মাফ করে দে। তুই আমার বড় ছেলে কিন্তু তোকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। যেই সময় তোর বয়সী ছেলেপেলেরা আনন্দ উৎসব করতে ব্যাস্ত থাকে সে বয়সে তুই রাজ মিস্ত্রীর কাজ পর্যন্ত করেছিস।
আমার কোমরের ব্যাথা প্রচণ্ড বেড়েছে।বাড়ির থেকে বেরুতে পারছি না। প্রাকৃতিক কাজগুলো করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আর আমাদের টয়েলেটার উপর তোর আবু তাহের চাচা গাছ ভেঙে পড়েছে। তাই খুব অসুবিধায় আছি। সবাই বলছে তুই নাকি বেঁচে ফিরে আসতে পারবি না। তোর সময় নাকি সংকীর্ণ। আচ্ছা ওরা কি আল্লাহ? নাউজুবিল্লাহ। আজকালকার মানুষগুলো মানুষের মঙ্গল চায় না। যাইহোক তোর আব্বার রেখে যাওয়া সম্পত্তি মানে পিছেনের সুপারির বাগান গত সপ্তাহে বিক্রি করে দিয়েছি। মানিক মেম্বারের কাছে। মেম্বার সাহেব অর্ধেক টাকা দিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে আমি তোর হাসপাতালে ফীর অর্ধেক টাকা দিয়ে দিয়েছি। মেম্বার আর অর্ধেক টাকা নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে। টাকা দিতে চাচ্ছে না। নাজিমকে দুবার পাঠাইয়েছি কিন্তু দুবারই কোন গুরুত্ত্ব না দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। আমি একবার যাবো। এখানে আবার আমি দলিল তার নামে করে দিয়েছি তাই একটু সমস্যা। কতো বোকা আমি।তুই থাকলে এরকমটা হতো না। তুই মনে করিস না এই কথাগুলো আমি তোকে বলছি তোর টেনশন বাড়ানোর জন্য। এসব বলছি এর কারণ হলো তোর ভিতর বেঁচে থাকার স্পৃহা জাগানোর জন্য। যা তোর এখন দরকার।
কিন্তু কষ্টের ব্যাপার এই যে আজ তোর সাথে কথা বলতে পারলাম না। যাইহোক আমি এই নার্সকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তুইও করে দিস।আর লিখতে পারবো না নার্স কলমটা আর দিচ্ছে না।
ইতি
তোর মা '
আমি বাকরুদ্ধ। কিছু ভাবার জন্য মানসিক শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছি। পাশে থাকা ঔষধ আমি নিজে খেয়ে নিলাম। আজ নার্স খাওয়াওইনি। সে চিঠিটা দিয়ে কান্না করতে করতে চলে গেছে। ঔষধ খেয়ে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
২.
ঘুমের থেকে উঠে দেখি সকালে সেই নার্সটি বসে আছে আমার পাশে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে।পাশে ঘড়ি দিকে তাকিয়ে দেখি বিকাল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। নার্সটি নার্সে ইউনিফর্মে নেই। মনে হয় তার ডিউটির সময় শেষ।
' গুড আফটারনুন। ' আগ বাড়িয়ে বলল নার্স।
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ' কেমন আছেন নার্স?'
' আমার নাম নার্স না আমি নাম সুমনা। হ্যাঁ ভালো আছি। আপনার শরীরের কি অবস্থা? '
' সঠিক তথ্য আমি জানি না। ডাক্তারেরা ভালো জানে।।'
' এই নিন আপনার রশিদ।'
' কিসের রশিদ? ওহ সকালে আমার মা অর্ধেক টাকা জামা দিয়েছিলো সেই রশিদ নিশ্চয়ই।'
' নাহ। সেই রশিদতো আপনার মা নিয়েই গেছেন। আর এটা হলো আপনার বাকী টাকা মওকুফের রশিদ।'
' কি? বাকী টাকা মওকুফ হয়েছে। আমার মা কি বাকী টাকা মওকুফ করার জন্য আবেদন পত্র পাঠিয়েছে।এটা পাঠালেও তো টাকা মওকুফের কথা না। বাংলাদেশের হাসপাতাল ব্যাবস্থা এত ভালো হবার কথা না।'
' জ্বি না। আপনার মা কোন আবেদন করি নি। আসলে আমি...'
' আপনি? আপনিতো নার্স সামান্য নার্সের কথা রেখে এত টাকা মাফ করবে হাসপাতাল কৃতপক্ষ।'
' কোন কথা বলবেন না । আমি চোখের কথা বুঝতে পারি। আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে আমি পড়তে পারবো।প্রথমত আমি কোন প্রোফেশনাল নার্স না। আমার বাবা এই হাসপাতালের সিভিল সার্জন। তার কাছে পারমিশন নিয়ে আমি মওকুফ করেয়েছি। আপনার প্রশ্ন হলো আমি কেন নার্সের কাজ করি। উত্তর হলো আমার ভালো লাগে। এবার আপনার প্রশ্ন হলো সকালে আপনার কাছে আপনার পরিবারকে আসতে দেওয়া হয়নি কেন? প্রথমত আপনার দুর্দশা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিলো না। দ্বিতীয়ত আপনার মা তখন হসপিটাল বিল পে করে নাই। তাই অনুমতি ছিলো তাদের ঢুকতে দেওয়ার। আপনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন ব্যাক্তিগত স্বার্থের জন্য আমি তাদের ঢুকতে দেয়নি।'
কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম আমরা দুজনেই।
' আপনার জিবনের গল্প বলবেন। আমি লেখক। দেখি আপনার জীবন থেকে কোন গল্পের থিম পেতে পারি নাকি।' বেশ হাসি মুখে বলল সুমনা।
' শোনবেন? '
'হুম।'
' আমার নাম রাসেল। আমার বাবা মারা গেছে। আমি যখন এইটে পড়ি। বাবা থাকতে আমারদের পরিবারের তেমন উন্নতি ছিলো যে তা নয়। প্রতিদিন ভাত ডাল খেয়ে চলার মতো।
আমি অর্নাস শেষ বর্ষে আছি। ঘরে আয় করার মতো কেউ নেই তাই। আমি সংসারের হাল ধরি এসএসসি পাশের পড় থেকেই। কিন্তু তখনও মাও কাজ করতো বলে আমি হাফডে কাজ করলেই পরিবার কোন রকমে দিন কাটাতে পারতো। এইচএসসি পরীক্ষার সময় মা আমার পরীক্ষার ফী আর ফরম ফী এর জন্য দিনে কাজ করে আর রাতে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে টাকা ধারের জন্য। সে সময় ইট ভাঙতেন আমার মা। ইট নিয়ে আসা খুব কষ্টের কাজ। এটা কেবল পুরুষরাই করে সাধারণত। আমার মা ইট টানতে শুরু করলেন। পুরুষদের মাঝে কাজ করতে খুব কষ্ট হতো। পরীক্ষা মাঝখানে তিনি কোমরে ব্যাথা পেয়ে। বিছানার সঙ্গী হোন। তারপর থেকে আমার উপর চাপ বেড়ে যায়। প্রতিদিন কাজ যেতাম একটি কাপড়ের দোকানে। আমার পরীক্ষা চলাকালীন সময় আমি দোকানে যেতাম। যথাসময় পরীক্ষা দিয়ে। পরীক্ষাটা দিলাম পরে জানতেপারলাম আমি পাশ করেছি। তারপর আমি বেসরকারি ব্যাংকে ড্রাইভারের পদে চাকরী পেলাম। ভালোই চলছিলো কিন্তু ভাগ্যেতো আমার মনে হয় সুখ নেই তাই আবার আমি আক্রান্ত হলাম ব্লাড ক্যান্সারে।'
নিস্তব্ধতা কাজ করছে আমাদের ভিতরে।
৩.
আজ প্রায়ই একমাস পর হাসপাতাল আমাকে ডিসচার্জ করলো। আজ একমাসই আমার পরিবার আমাকে দেখতে আসে নাই। আমি ফোনে বা অন্যকোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয়নি। আমি ততটা চিন্তিত হইনি। আমি বুঝতে পারলাম আমার পরিবার টাকার ভয়ে আসতে পারছে না। হয়ত মেম্বার আমার মাকে ঠকিয়েছে। আসার সময় আমার কাছে অটো ভাড়া ছিলো না। সুমনার কাছে চাইতেই হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিলো।আমি আসার সময় খাবার নিয়ে আসি। আমি মৃত্যু থেকে বেঁচে এসেছি। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই হুমড়ি খাবে আমার মা।
বাড়ির সামনে এসে দেখি বাড়ি ঘেরাও করে রয়েছে হাজারো মানুষ। আমার সব আত্মীয় আমার বাড়িতে আসছে। উঠানে একটে খাটে একটা মৃতদেহ শুয়ে আছে।
আমি আরো কাছে যাই খাটে পাশে বসে বসে কাঁদছিলো নাজিম। আমাকে দেখতে পায় সে।
আর আমাকে বলল, ' ভাইয়া! মা কথা বলে না কেন?'