নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

অমৃতা রায় চৌধুরী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অমৃতা রায় চৌধুরী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

অমৃতা রায় চৌধুরী





সমাজ-পুরাণ




শৈশবের ছোট্ট পাড়া, শৈশবের বাড়ি,
বর্তমানে পুকুর ঘিরে নতুন ফ্ল্যাটের সারি।
ফ্ল্যাটের নতুন বারান্দাতে নতুন নতুন মুখ;
স্কোয়ার-ফিটের মাপা ঘরে একলা থাকার সুখ!
ছোটো ফ্ল্যাটে সবই মাপা 'রোদ-হাওয়া-জল',
মৃদু হাসি, চাপা কান্না, মাপা হট্টগোল ।
একই সাথে বাস করা আজ খেয়াল পুরাতন,
এখন শুধু দেখা হলে, মৃদু সম্ভাষণ -
ছোট্ট 'হ্যালো', হালকা হাসি, অল্প কথা বলা;
সযতনে দূরে থাকার জন্য এড়িয়ে চলা। 
একলা থাকতে চায় যে মানুষ, এক‌লা সংসার, 
একলা তুমি, একলা আমি, একলা চারিধার!
একলা থাকতে চাইতে চাইতে বাবা-মা'ও পর,
নানান মাপের বৃদ্ধাশ্রমই তাঁদের নতুন ঘর।
একবিংশ শতক আজ কানে দিয়েছে মন্ত্র; 
মানুষ এখন আবেগহীন, হৃদয়বিহীন যন্ত্র ।
সবখানেই প্রতিযোগিতা, সবাই প্রতিযোগী,
ত্যাগমন্ত্র জানে'না কেউ, সবাই চরম ভোগী।
হানাহানি ও হিংসা তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আজ,
ভালোবাসা-মমতা-স্নেহ'ই  শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ।। 

অমৃতা রায় চৌধুরী




"অপরাজিতা" 
***********





  
                                (১)
সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতার খবরটাগুলোতে চোখ পড়তেই নিজের মনেই শিউরে উঠল আকাশ। গোটা পাতা জুড়ে খুন-জখম-ধর্ষণের খবর।খবরগুলো পড়তে পড়তে আকাশের মনের মধ্যে এক অবাধ্য অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তার ধীরে ধীরে ছয় বছর আগের এক মুহূর্তের কথা মনে পড়ে যায়। 

"কি গো,তোমার পেপার পড়া হল? "....

হঠাৎ ভেসে আসা গলার আওয়াজে আকাশের চিন্তার সূত্রটা ছিন্ন হয়ে গেল। 

" এখনো এখানে বসে আছ? কফিটাও শেষ করনি?কত বেলা হয়ে গেল ! আজ মেয়েটার জন্মদিন। নাও ওঠো...অনেক আয়োজন বাকি। "

আকাশ এবার মুখ তুলে প্রথমাকে দেখল। ওর ব্যস্ততা,কথা,সারা ঘর জুড়ে ওর ছোটাছুটি দেখে মনে হল কে বলবে এই প্রথমাই বিয়ে-সংসার-সন্তান মানুষের চিন্তায় দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়ত। কিন্তু জীবনেঅপরাজিতা আসার পর সত্যিই তার পরশপাথরের ছোঁয়ায় সে নিজেও হয়ে উঠেছে আর একজন অপরাজিতা। 
                                 
                                (২)
প্রথমা আকাশকে লিস্ট ধরে কাজ বুঝিয়ে বাজারে পাঠাল। আজ সে খুব ব্যস্ত। মেয়েটা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। গুটিসুটি মেরে ওর পছন্দের টেডি বিয়ারটা জড়িয়ে শুয়ে আছে। ওকে দেখে প্রথমার মন খুশীতে ভরে উঠলো। ও আছে বলেই আজ প্রথমার সংসারটা টিকে আছে ;নাহলে আকাশের পরিবার তো তাকে প্রায়..... এই যুদ্ধে আকাশ ছাড়া কেউ তো তার পাশে থাকেনি। আজও সেই দিনটির কথা ভাবলে...... 

"মামমাম"....

কচি গলার আদুরে ডাক শুনে প্রথমা
পিছন ফিরে দেখল তার আদরের সোনামণি ছোটো ছোটো হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে দাঁড়িয়েছে।সে ঘুরতেই তার ছোটো ছোটো হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল আর প্রথমা তাকে কোলে তুলে গালে আদর করে বলল--"হ্যাপি বার্থডে, সোনা।"  

                                     (৩)
বাজার থেকে ফেরার পথে আকাশ একবার ফের দেখে নিল সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। সংসারের সব বিষয়ে প্রথমা খুব খুঁতখুঁতে আর মেয়ের ব্যাপারে তো অতি সাবধানী। অথচ বিয়ের পরপর তার ইচ্ছা- অনিচ্ছা ,ভাললাগা -মন্দলাগা---সব আকাশের একান্নবর্তী পরিবারের কঠোর নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে পড়েছিল। সেই প্রথমাই যেদিন সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐরকম সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেদিন আকাশের পৌরুষও প্রথমাকে বাহবা না দিয়ে পারেনি। সবার মত অগ্রাহ্য করে এককথায় সে তাদের আলাদা সংসার পেতেছিল। 

                                   (৪ )
প্রথমা অপরাজিতাকে আজ খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে।আকাশ ওর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মনে মনে বলে, "তোকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। অতীতের পুনরাবৃত্তি আমি আর হতে দেব না। শুধু সেই দিনটায় যদি আমরা বাইরে বের না হতাম...." ; ভাবতে ভাবতে তার অজান্তেই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এই অপরাধবোধের পাথর নিয়ে সে আজ দীর্ঘ ছয় বছর কাটিয়ে দিল।

                                 (৫) 
ছয় বছর আগের কথা। দুর্গাপূজার অষ্টমীর আলো ঝলমলে সন্ধ্যা। বাড়ির সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বের হলো। যদিও প্রথমা জ্বর গায়ে প্রথমে বের হতে চায়নি। সবাই জোর করায় অল্প সময়ের জন্য সে বের হতে রাজি হয়। বাড়িতে থেকে যায় আকাশের ছোটো ভাই, আদিত্য। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য সে শত অনুরোধেও সবার সাথে বের হয় না। রাস্তায় প্রথমার শরীর বেশী খারাপ লাগায় তারা দুজনে বাড়ি ফিরে আসে। এসে দেখে গোটা বাড়ি জুড়ে চলছে এক নারকীয় উল্লাস। আদিত্য ও তার এক বন্ধু অসুরের মতো এক অসহায় প্রায় অচৈতন্য মেয়ের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। সেই মেয়েটির আর্তনাদ নিশ্চয় পূজামন্ডপের  মাইকের আওয়াজে চাপা পড়ে গেছে। ঘরে ঢুকে ঐ দৃশ্য দেখে প্রথমার মাথা ঘুরে ওঠে। আদিত্য ও তার বন্ধু এই সুযোগে হতচকিত আকাশকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়।ঘরের মেঝে তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। 
                                   (৬)
"বসে আছ কেন? কিছু কর... ও যে মরে যাবে...  "--প্রথমার সুতীব্র চিৎকারে আকাশ সম্বিত ফিরে পায়। দুজনেই মেয়েটিকে নিয়ে ছুটে যায় প্রথমে হাসপাতালে ও পরে খবর দেয় পুলিশে।এই সময় গোটা পরিবার ওদের বিপক্ষে চলে গেলেও প্রথমার অনড় জেদের কাছে সবাই হার মানে। ধীরে ধীরে মেয়েটা প্রাণে বাঁচলেও মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলে।ওর ঠাঁই হয় সরকারী হোমে। এরপর একদিন সবাই মেয়েটির কথা ভুলে যায়, ভোলে না কেবল একজন -- প্রথমা। এইভাবে দেখতে দেখতে বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর সেই হতভাগীনির কোল জুড়ে আসে সন্তান, কিন্তু তাকে দেখার সুযোগ তার হয় না।সব অপমান, সকল বঞ্চনাকে সঙ্গী করে সে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে। 

বাচ্চাটির কি হবে? এই প্রশ্ন উঠতেই প্রথমা জানায়, "সে বড় হবে তার বাবা-মায়ের কাছে। সে হবে তাদের হৃদমাঝারের স্বর্ণকমল। সেই হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের অপরাজিতা।"

আজ পাঁচ বছর বাদে ওর হাসিমুখ , সহজেই সবাইকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা , ওর নিষ্পাপ সারল্য দেখে আকাশের বারবার মনে হয়, সমাজের সব ক্লেদাক্ততাকে সরিয়ে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বড় হয়ে ওঠা তাদের কন্যা তো সত্যিই 'অপরাজিতা''।সে শুধু জীবনযুদ্ধে জয়ী কোনো ভবিষ্যত মানবীই  নয়, সমাজের বুকে বেড়ে ওঠা  আরো অনেক  অপরাজিতার মনোবল।।