নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

সম্পাদকীয়


এবার মেঘে চাঁদ উঠেছে,জলের দরের খিদে,
কান্না লুকিয়েই সাজাবো পুজো,মিলনতিথি ঈদের।।

কঠিন সময় কাটছে না আর,এই দরিয়া হচ্ছে না যে পার,
মেঘ সরিয়েই ,আলো-ছায়া ,আসবে নতুন চাঁদ,খোদা'র।।

ধ্বংস হয়েও তাই ,ফিরে আসা যদি হয় ফের,
হেরে যাওয়া প্রতিটি মানুষও ,জেতে,আল্লার মুসাফির।।

ভালো থাকুন ,সুখে থাকুন ,ভালো রাখুন প্রিয় মানুষটিকে,
ফের দু কথা লিখবো আবার ,ফিরবো সবাই নিকোটিনে।।

সুস্থ্য থেকে ,যতটুকু দরকার ততটুকুই যাবো ঘরেই বাইরে,
কঠিন সময় ,তাই হাতে হাত রেখে চলতে হবে ভাইরে ।।


এবারের সংখ্যায় যারা লিখেছেন--

  নন্দিনী পাল
শুভঙ্কর  রাহা
কাজী জুবেরী মুস্তাক
অনিন্দ্য পাল
প্রীতম বিশ্বাস
রাহুল শীল
রিয়াজুল হক সাগর
অর্ঘ্যকমল পাত্র
রিঙ্কু মন্ডল
আর্য দাস
শোভন মন্ডল
রুমকি দেবনাথ
রাজা দেবরায়
শুভম চক্রবর্ত্তী
দেব জৈন
অভিজিৎ  দাস কর্মকার
পিনাকি কর্মকার
ইসমাইল মোল্লা
গোলাম রসুল
শ্যামল কুমার রায়
সুকুমার দাস
কিশলয় গুপ্ত
সুনন্দ মন্ডল
রিম্পা লাহা সুরাই
শিশির বিন্দু দত্ত
প্রীতি কর্মকার
জয়তোষ ঘোষ
মাসুদ হাসান
আরিফ মন্ডল ( পেঁচা)
আসামুদ্দিন সেখ
আস্তাইন বিল্লা
মান্নুজা খাতুন

     ধন্যবাদান্তে
নিকোটিন ওয়েব ম্যাগের সম্পাদকমন্ডলী 


একটি মেয়ের আত্মকথা : মান্নুজা খাতুন





আমি তার প্রেমে পড়ি বারবার
হ্যাঁ  তাকে মুগ্ধ  নেত্রে চেয়ে দেখেছি বহুবার৷

আজ মুক্তির প্রথমদিন দীর্ঘ বন্দিত্বের পর আমি আজ মুক্ত, মেয়ে বলেই সমাজ আমার পায়ে শেকল দিয়েছিল,  বই খাতা একদিন পুড়িয়ে দিয়েছিল, পথে ঘাটে বার বার আমায় অপমান করেছিল৷ আমার দাদা আমায় ভীষণ  বকেছিল,  বাবা চোখ রাঙিয়েছিল, সমাজ বলেছিল চৌকাঠের বাইরে এলে ভেসে যাবে কোথায় তা ঠাহর করতে পারবে না৷  ভুল তো আমি কিছুই করি নি সেদিন,  আমার ভুল ছিল আমি লেখাপড়া শিখেছিলাম,  আমার ভুল ছিল সমাজের আর মেয়েদের পড়তে শেখাচ্ছিলাম, বোঝাচ্ছিলাম কোনটা অন্যায় কোনটা ন্যায়,  তাদের প্রতিবাদী হতে শেখাচ্ছিলাম, আত্মনির্ভরশীল  হতে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ  সেটা ভালো চোখে নিল না,  আমাকে শাসিয়ে  গেল, বন্দিজীবন  কাঁটাতে হবে।  ঘরের বাইরে প্রায় ঘোরা ফেরা করে তারা৷  সেই থেকে আমি বন্দি। 

আজ প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল রাতের গভীরে ভাইয়ের ছদ্মবেশ এ ওই গ্রাম ত্যাগ করে শহরে এসেছি মামার বাড়িতে। এখানে অবশ্য সমাজ নামক কোনো যমদূত  নেই। এখানে সবাই মুক্ত।  মামার ছেলে মেয়ে সবাই ইংরেজি  পড়ে জুতো মোজা পরে, স্কুল - কলেজ যায় এখানে পড়াশোনার জন্য কোনো চোখ রাঙানি নেই।  এখানে এসে আমার ভয় ভীষণ  করছে কেননা মা আর ভাই একা আছে,  ভয় হচ্ছে ওই সমাজের লোকগুলোর কথা ভেবে তারা যদি আমাকে না পায় তবে কি তাদের প্রতি নির্যাতন  করে যদি। বাবা আমায় সান্ত্বনা  দিয়ে গ্রামে ফিরে গেল,   মামী অভয় দিল, মায়ের মতোই কাছে টেনে নিল। দিন কয়েকপরে মামা আমায় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। 

এই ১০বছরে আমি অনেক এগিয়ে এসেছি। একা স্বাধীন  জীবন যাপন করতে শিখেছি। শহরের অলিতে গলিতে বহুপথ হেটেছি।  কিন্তু আমি নিজের জন্ম স্থানে ফিরতে পারি নি এখনো।  আর কিছুদিন পরেই আমায় কলকাতা ছেড়ে মুম্বাইয়ে যেতে হবে   তাই মনে প্রানে চাইছি গ্রামের সেই পরিবেশ  এ মন খুলে ঘুরে বেড়াতে,  আমি চাইছি বাল্যবন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ  করতে। কিন্তু আমি জানি আমার স্বপ্ন ঠিক পুরন হবে না৷

হঠাৎ  আজ মামী একখানা চিঠি  এনে আমার হাতে দিল। মায়ের চিঠি অবশ্য লেখাটা বাবার।  মা তার দৈনন্দিন জীবনের সব কথায় ব্যক্ত করত। কিন্তু  আজ অন্য কথা লিখেছে আমার ছেলে বেলার বন্ধু সরলার বিয়ে।  সেই সরলা মা কে অনুরোধ  করেছে আমায় যেন চিঠি  লিখে ডেকে নেয়৷  চিঠির সাথে আর একটা চিঠি পেলাম সেটা সরলার। চিঠি দুটো পড়ে স্থির করলাম আমি গ্রামে ফিরব,,  সরলা অনেক কিছুই লিখেছে,গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা  নিয়েও, সেই আমিই একজন ডাক্তার হয়ে কি ভাবে নিজের গ্রামকে অন্ধকারে রাখব এই প্রশ্নই আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে বলছে৷ 

আজ ১০ বছর পর গ্রামে ফিরছি  তবে ছদ্মবেশ  এ নয় আমার চেনা রুপ নিয়েই।  সেই গ্রামের স্বাস্থ্যদপ্তরের ডাক্তার হয়ে।  স্বাস্থ্যদপ্তরে মহিলা ডাক্তার না থাকায় মেয়েরা বাড়িতেই সন্তান প্রসব  করত এতে অনেক সময় সন্তান প্রসবের পর নাড়ি ছেদের ভুলে মায়ের কিংবা সন্তানের মৃত্যু হয়,নতুবা রক্তপাতের কারনেও মৃত্যু হয়।  যাই হোক গ্রামে প্রবেশ করে মুগ্ধ  নেত্রে সব চেয়ে দেখছি,  আমাদের সেই বটতলা যেখানে খেলাধুলা করতাম,  সেই খোলা মাঠা,  সেই লুকিয়ে আমের বাগানে আম চুরি সবই মনে পড়ছে।  কিছুটা যেতেই গ্রামের মাতব্বর জগদীশ ভট্টাচার্য  এর সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন?  স্বাস্থ্য সংস্থার  নাম  বলাতে পথ দেখিয়ে দিল আর আশ্চর্য  হয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে চলে গেল। আমিও আরও অবাক হলাম যে আমায় চিনতে পারল না। 

যাই হোক স্বাস্থ্য  সংস্থার কেন্দ্র থেকে ফিরেই বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম মা বাবা ভাই এর সাথে আমার বন্ধু সরলা ও তার মাও অপেক্ষা  করছে৷ বাড়িতে সবাইকে প্রনাম করে একটু গল্প করে খেতে বসেছি যেই সেই সময় বাড়ির বাইরে কে বা কারা যেন বাবার নাম ধরে ডাকছে।  বাবা খাবার ফেলে রেখেই উঠে গেল,  মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল আমাকে লুকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু আমি মা কে বারণ করলাম এসবের দরকার নেই। 
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমিও দেখলাম জগদীশবাবু ছাড়াও আরও অনেকেই আছেন যারা আমাকে গ্রাম ছাড়া করাবার জন্য এসেছে।  কিন্তু আমি তো ফিরে যাবার জন্য আসি নি। এ গ্রাম আমার,  এই আমার জন্মস্থান কেন আমি ফিরে যাব?  তাদের কথার যথেষ্ট  প্রতিবাদ করলাম এবং তারা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে গেল।  আমার মা আমায় আবার ফিরে যাওয়ার অনুরোধ  করল৷ কিন্তু আমি তো ফিরে যাওয়ার জন্য আসি নি। 

পরের দিন বাবার সাথেই স্বাস্থ্য দপ্তরে গেলাম।  আমার কাজ বুঝে নেওয়ার পরও বাবা সেখানে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হয় নি ফিরে যেতে বললাম।  হ্যাঁ  খুব মনে আছে সেদিন আমার হাতে একটা কেস এসেছিল, তাতে আমি যথাযথ  সফল ছিলাম। একজন মহিলা ডাক্তার পেয়ে গ্রামের অনেক  মহিলায় নিশ্চিত  হয়েছে কিন্তু আমার প্রতি যাদের ব্যক্তিগত  আক্রোশ  তার খুশি হতে পারে নি। 

একের পর এক কেস আসতে থাকে,  আমিও আমার কাজ করতে থাকি । সরলার বিয়েও হয়ে গেছে কদিন আগেই৷  সেদিন তেমন কাজও ছিল না৷ বসে আছি বাইরের বারান্দায়  হঠাৎ  দেখি জগদীশবাবু এগিয়ে আসছে দলবল নিয়ে।  আমায় শাসিয়ে  যাচ্ছে গ্রাম ত্যাগ করতে,  আমাকে সেদিন কিছুই বলতে হয়নি যা বলার সেদিন গ্রামবাসীরাই বলেছিল।  প্রত্যেকেই আমার  পাশে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিবাদ করেছিল৷  জগদীশ বাবু ফিরে যায়। 

ঘন্টাখানেক  পরেই জগদীশবাবুর বাড়ির একটা ছোট ছেলে এসে জানাল তার দিদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে, তার মেয়ের ডেলিভারি  কেস আছে শুধু জগদীশবাবুর ভয়ে স্বাস্থ্য  কেন্দ্রে আনতে পারছে না।  আমি যাব কি যাব না এটা যখন ভাবছি তখন আমার পাশে যারা ছিল তারা জানাল যদি বিপদ  হয় তবে কি করবে? তারাও সাথে যাবে।  কিন্তু তাদের নিরস্ত করে একজন নার্স কে সাথে করে ঘরে এগিয়ে গেলাম। 

জগদীশবাবুর বাড়ির গেট এ পৌচ্ছেই বাঁধা পড়ল দারোয়ানের।  কিন্তু সে বাঁধাও টিকল না উপর থেকে জগদীশবাবুর স্ত্রী তা দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে পথ ছেড়ে দিতে বলল। 
গেট পেরিয়ে অন্দরমহলে  প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলাম জগদীশবাবুর রক্তাক্ত  চোখ,  আমার এই বাড়িতে উপস্থিতি  তার সহ্য হচ্ছে না,, একবার আমায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করল।  কিন্তু সে অনুরোধও টিকল না।  ওনার স্ত্রী প্রতিবাদ করল, তাকে পূর্ব ঘটনা ( ছেলের বউ এর মৃত্যু) মনে করিয়ে দিল,,  তখন একমাত্র মেয়েকে হারানর বেদনায় আর কিছু বলল  না৷ 

৩০ মিনিট  এর চেষ্টায়  আমি সে অপারেশনেও সফল হই।  সফল হওয়ার পর যখন নীচে নেমে এলাম জগদীশবাবুর স্ত্রী আমার কাছে তার স্বামীর ব্যবহার  এর জন্য ক্ষমা চাইল ও অনেক আশির্বাদ  করল।  আশির্বাদ  নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি তখন দেখি গেট এর সম্মুখে জগদীশবাবু দাঁড়িয়ে।  আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম  তার সে রক্তচক্ষু  নেই, সেই রাগ আর নেই,  যেন মাটির একটা  মানুষ ।  তার পুর্বভুলের জন্য ক্ষমা চান আমার কাছে।  ততক্ষণে  গ্রামের অন্যান্যরাও এগিয়ে এসেছি জগদীশ বাবুর বাড়ির দিকে বাবাও এলেন।  জগদীশবাবুর এ হেন আচরনে আমি ক্ষমা না করে পারলাম না। এবং তার মেয়ের জীবন বাচানোর জন্য বকশিস  দিতে চাইলে আমি নিজের জন্য না চেয়ে গ্রামের জন্য একটা স্কুল চাইলাম।  খুশি মনে তা মেনেও নিল।

আজ আমি বহুদিন পর মুক্তি পেয়েছি।  হেরে না গিয়ে জিতে গেছি।  খোলা মাঠে খুশি মনে ঘুরছি ফিরছি। আর গ্রামের জন্য কাজ করছি।

লাল শাড়ি : আস্তাইন বিল্লা




 সামনে ঈদ। আবার বাড়ির কর্তারও বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল।  হাত চালিয়ে কুঠার চালাচ্ছে রেণুকা বিবি।  তিন বছরের একটি শীর্ণ প্যাকাটির  মত একটা শিশু পেটের সঙ্গে  ন্যাকড়া দড়ি  দিয়ে বাঁধা । রোগাজীর্ণ শিশু কেঁদেই চলেছে। শিশুকে যেন যেন জীবনের কঠোরতর সংগ্রামের অবতীর্ণ করার প্রস্তুতি।  এখন থেকেই সহ্য ক্ষমতা করায়ত্ব না করলে চলবে কেন! জন্ম যে হয়েছে কঠিনের মধ্যে দিয়ে। এ যেন থামবার নয়।  পাশে বকের মত গলা তুলে ভাঙা পা ছড়িয়ে শুকনো তো কোনো ব্যাপার নয় । বরং দুর্গন্ধযুক্ত মাছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াতে ব্যস্ত  রেণুকার বড় ছেলে সুজন।  এদিকে পাড়ার পঞ্চায়েত মেম্বারের ছেলে সদ্য থার্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করেছে৷  বাপ খুশি হয়ে এন্ড্রয়েডে মোবাইলও কিনে দিয়েছে৷ দুনিয়ায় সব কিছু মুঠোয় এনেছে৷  এই তো সেদিন  রেণুকা তার স্বামীর সঙ্গে কত খোশগল্প করল,  এমনকি চুমুও খেল।  অবশ্য হারাণ মন্ডলের ছেলে কথা বলার দরুন দশ টাকা নিয়েছে৷  রেণুকার অভাব থাকা সত্ত্বেও টাকা খরচ করতে পিছুপা হয় নি। হাটে কাঠ বিক্রি করেই টাকা সংগ্রহ করেছিল।  পিছুপা হবেই বা কেন অত দূরের মানুষকে এত কাছে এনে দিয়েছে।  এ কি কম সৌভাগ্যের!
রেণুকার স্বামী থাকে মহারাষ্ট্রের নাসিকে।  এই কদিন পর ঈদে'ই ফেরার কথা৷ সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজে জোগানদার হিসাবে শ্রম দেয়৷  বিনিময়ে আড়াইশো টাকা।  অবশ্য এ কাজ তার ঠিক পোষায় না। তার পূর্বপুরুষেরা বনে-জঙ্গলে কাঠ কেটে জীবন যাপন অভ্যস্ত।   এদিকে আবার সরকার কাঠ কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি। সব মিলিয়ে তার মত উলুখাগড়ার এইসব  জোগানদার কাজ  পোষায় না বলে চলবে কেন!  সে-যে কপাল করে হা-ঘরে জন্মেছে। তাই হারাণ মন্ডলের ছোটভাইয়ের সঙ্গে নাসিকে যাওয়া। তার ছোটভাই ঠিকাদার।
রেণুকা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে কাঠ কাটতে থাকে হাঁপানি থাকা সত্ত্বেও ।  আর ভাবতে থাকে সুজনের আব্বা অনেক টাকা নিয়ে ফিরবে।  সামনে ঈদ।  কত গোছানো স্বপ্ন৷  সুজন এবং তার ছোটভাইয়ের জন্য নতুন জামা। তার নিজের আবার, অনেকদিনের স্বপ্ন, চুমকি বসানো ব্লাইজ এবং টুকটুকে লালরঙের তাঁতের শাড়ি।  তাদের সংসারে সবচেয়ে বড় ভাবনা সুজনের ভাঙা পা আর তার মায়ের হাঁপানি।  বাড়ির লোক বলেও গিয়েছেল।  বাড়ি ফিরে এসে কলকাতায় মস্ত বড় ডাক্তার  দেখাবে৷  এদিকে ঘরের দরমাও ভেঙে গেছে।  সেদিন ছোট ছেলেটাকে দরমার ফাঁক দিয়ে শেয়ালে টানছিল।  এইসব ভাবনার মধ্যেই ডাক দিয়ে ওঠে হারাণের ছেলে—
---অ সুজনের মা। তোমার ভাতার কালু যে ফির‍্যা আসে নাসিক থেক্যা।
এহেন খুশির সংবাদ শুনেই সুজনের মায়ের ঘাম কপালে রোদের আলো পড়ে চিকচিক করছে৷  ফর্সা গাল আপেলের মত লাল হয়ে ওঠেছে৷  কিন্তু পরক্ষণেই যখন হারাণের ছেলে বলে যে-
  ---দ্যাশে করুনা না কি যেন বালা আস্যাছে।  তাই লেবাররা নিজ দ্যাশে চল্যা আসছে । খবরে বলছে সরকার টেনও বন্ধ করে দিছে ।তাই পথে হাট্যা আসছে। 
এহেন কুশলে মহিলা  গম্ভীর অথচ শান্তস্বরে বলে –
---ও ক্যামন আছ? দেখন যাব না? 
--- না তাদের যে মোবাইল নাই।  দেখন যাইব না। 
হতাশ হয়ে মুখ নীচু করে অদৃশ্য ভবিষ্যতের আশঙ্কায়।  হঠাৎ করে মাথা ঘুরতে থাকে৷ খুঁটি ধরে বসে যায় কাদাযুক্ত ঘরের বারান্দায়৷  আর অঝোরে কাঁদতে থাকে।  সত্যি এতদিনের স্বপ্নও কাঁদতে থাকে রেণুকার সুরে সুরে। জগত সম্পর্কে সে যেন জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে।  এমত অবস্থায় মরার উপর খাড়ার ঘা।  পঞ্চায়েত পক্ষ মাইক নিয়ে ঘোষণা করতে থাকে এই মর্মে যে,  আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনারা নিরাপদ অবস্থানে আশ্রয় নিন। সাবধানে থাকুন ।গাছের তলায় থাকবেন না।  ইত্যাদি ইত্যাদি।  এ সব ঘোষণা কিছুই কানে যায় না রেণুকার৷ সে-যে স্বামী শোকে বিহ্বল। পাড়ার সকলেই যখন হইচই করতে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে তখনই হুঁশ ফেরে তার৷  জানতে আগ্রহী হয়ে পাশের বাড়ি সেরাজুলের বুকে জিজ্ঞাসা করে -'লোক সকলি কোতি যায়? '
তখন উগ্রভাবে সেরাজুলের বউ জবাব দেয় –
--- মাগির ঢং কত! গাঁয়ে কত কিছু উড়্যা গেল কিছুই যাননা বুঝি!  ঝড় গো। আল্লার ঝড় ।
একথা শুনে তাদের অনুকরণ করে দু'সন্তান নিয়ে হাঁটতে শুরু করে তখনই পিছন হাকতে হাকতে থাকে হারাণ মন্ডল।  চীৎকার বলে - ' ও রেণু'।  সে বরাবর নাম ধরে আদর করেই ডাকে৷  ডাকবেই বা না কেন!  এ পাড়ায় মধ্যে  কম সুন্দরী নয় কালুর বউ!।  শরীর খানা যেন দুধে আলতা মেশানো ।ঘুরে তাকাতেই হারাণ বলে ওঠে কাঁদো কাঁদো হয়ে –
---তোর ভাতার যে আর নাই। রাস্তায় লরিতে পিশে দিছেরে।  সে আর নাই। 
আর এ খবর শুনেই মূর্ছা যায় সে।  পেটে বাঁধা ছেলেটি জোরে কাঁদতে থাকে৷  সকলে ধরে নিয়ে যায় স্কুলের ব্লিডিং-এ।  সেখানে অজস্র ভিড়ে একপাশে জায়গা পাই  সেরাজুল এবং সেখানে দয়াকরে রেণুকার ব্যবস্থা করে দেয়।  সে স্বামীর শোকে প্রায় মৃত। ছেলেরা বাপ এবং ক্ষিধের যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের উপর কিল চড় মারতে থাকে৷  এ যেন নতুন উপদ্রব।  বিহ্বল অবস্থায় পড়ে  রেণুকা।  জগত সম্পর্কে সে যেন জ্ঞান হারা।  আর ক্ষিধে অবস্থায় ঘুমিয়ে গেছে দু'সন্তান।  আর গভীর রাতে হু হু করে বৃষ্টি আর ঝড় বইতে থাকে৷ সকলেই প্রায় নিজেদের পরিবারের খেয়ালে হই চই করতে থাকে স্কুল ব্লিডিং।  অথচ একজন নীরব জন্তুর মত কাতরাচ্ছে।  বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে সকালে আলো ফোটে।  তখন সেরাজুলের বউ গায়ে হাত দিয়ে ডাকে –
'ও কালুর বহু। তোমার ছেল্যারা কই!  ঝড়ে লইল না কি! 
রেণুকা কোনো উত্তর না দিয়ে সে শীর্ণ হাত তুলে আকাশে তুলে চীৎকার বলে উঠল –
ওই যে । যার জিনিস সে ফিরায়্যা লইছে। 
এ কথা বলেই মুখে ঘুরে ঘুমানোর ভান করে৷  কাপড়ের যে অর্ধেকাংশ শরীরে ছিল সেটাও ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে।  ঈশ্বর কি সবকিছু দেখলেন! না কি দেখেও চোখে বুঝে গা ঝাড়া দিলেন! তিন দিন পর রক্তমাখা কাপড়ে বাঁধা লাশ ফিরে এল রেণুকার কোলে । সে-যে স্বপ্ন দেখেছিল লাল শাড়ির।  আজ অথচ দেখ স্বামীর রক্তে লাল হয়ে ওঠেছে সাদা থান খানি।

গোদের উপর বিষফোঁড়া : আসামুদ্দিন সেখ


কাল খুশির ঈদ। অথচ গুটিকয়েক লোক ছাড়া কেউই খুশিতে নেই। কাবিলের বাবা কাল রাতে এসেছে সাতশো কিলোমিটার হেঁটে। বেচারা আর দাঁড়াতে পারছে না । প্যাকেট বন্দী জলের মতোই তার পা দুটি ফুলে আছে ‌। যেখানে কথা ছিল টাকায় পকেট ভর্তি থাকার , সেখানে কাবিলের বাবা এনেছে পকেট ভর্তি দুঃখ, হাহাকার, রক্ত ভেজা শরীর।

তিনমাস আগে কাবিলের ছোট বোন তার বাবাকে বলেছিল - বাবা এ বছর ঈদে একটা নতুন টু-পার্ট  কিনে দিও?
কাবিলের বাবা বলেছিল -  দেবো
তারপর বিদেশ যাত্রা । কিছুদিন যেতে না যেতেই পরিকল্পনাহীন লকডাউন। কাজ বন্ধ। কিছুদিন কাজ করে যা  টাকা হয়েছিল সেগুলোও সব শেষ হতে বসেছে সঞ্চিত রেশনের মতো।কি করবে কাবিলের বাপ, দিশাহারা পথিক এর মত একটা রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করে। কোনো পথ নাই ! তারপর কিছু সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে বাড়ির পথে হাঁটা। দীর্ঘ বারো দিন মরুভূমির বেদুইনদের মতো হাঁটার পর  স্বপ্নের বাড়িতে আসা।

কিন্তু এ আরেক বিপদ !  পরশুদিন কাবিলদের ছাদের চালা প্রচন্ড ঝড়ের তীব্র আস্ফালন এর সামনে পড়ে , ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত অবস্থা এখন কাফিরদের।
তার বাবারও স্বাস্থ্যের  অবনতি হয়েছে !

প্রলয়াতঙ্ক : আরিফ মন্ডল ( পেঁচা)


অর্ধ জাহান আজ ভয়ে কম্পিত,
মৃত্যুর ভয়ে আজ সবাই ইতস্তত।
ভাঙতে হবে সমস্ত ঝড়,
ধূলিকণা ও হওয়ার প্রবাহ কে উপেক্ষা করেই।
সামনে আসুক যত বাঁধা বিপত্তি,
জাগ্রত এ ধ্বংস রুপীর অহংকার শেষ করবো অচিরেই।
বুদ্ধির বলিয়ানে দেবো বলিদান
প্রতিষ্ঠিত করবো আবার মোদের আত্মসম্মান।

হারানো সেই দিন : মাসুদ হাসান



আমাদের একটা সুন্দর ভোর ছিল,
তবু প্রতিদিন
আমরা একটি আরও সুন্দর ভোরের খোঁজ করতাম।

আজ পৃথিবীর বড়ো অসুখ করেছে,
চারিদিকে শুধু বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শ্বাস নিতেও ভয় হয়।

নুতনের আশায় পুরাতন অজান্তেই হারিয়ে গেছে।
আমরা আজ আবার হারানো সেই দিনের খোঁজে।

পৃথিবির বুকে মৃত্যু মিছিল
শসান ঘাটে নির্জীব মানুষগুলির নীরব আর্তনাদ।
ম্যানচেস্টার, সবুজ নগরী, রাজধানী আপনাতে বাঁধ দিয়েছে।
পোপের শহর এখন শসান!
কসাই ডাক্তারগুলো ছাড়া স্বয়ং ঈশ্বরও ভীত স্তম্ভিত।

জারি হয়েছে অদৃশ্য এক দানবের শাসন ।
আমরা যেন এক সাজা প্রাপ্ত আসামী,
তীর্থের কাক আমরা চেয়ে আছি
শাসন মুক্ত এক অবাধ ভোরের দিকে ।

কবে আবার প্রাণ ছুবে মুক্ত বাতাস
হাত ছুবে তোমার জরাগ্রস্থ হাত,
হাঁটব আবার পায়ে দোলে শিশির ভেজা ঘাস।
          *********

শরীর : জয়তোষ ঘোষ



ঈদ উপলক্ষে বাজারে গিয়ে রফিকুল বাবু স্ত্রী ও একমাত্র কন্যার জন্য ভালো পোশাক কিনে ছিল । ফেরার পথে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অর্ধ উলঙ্গিনী নারী ও মাতৃ স্তনপানরত উলঙ্গ সন্তানকে দেখে সেগুলো দিয়ে দেয় ।বাড়িতে তার সন্তান অপেক্ষারত নতুন পোশাকের জন্য , রাস্তার অর্ধ উলঙ্গিনী শিশুটিকে জামাটি পরিয়ে দিয়ে নিজের শরীর ঢেকে নেয় নীরবে ।

তুলনা : প্রীতি কর্মকার




বছর চারের ছোট্টো শিশু হাঁটছে শত মাইল পথ,
ফিরতে হবে আপন গাঁয়ে পায়না খুঁজে বাঁচার পথ। 
আমার ছেলে সোনা মানিক এই তো বসে শোফায়,
মরে মরুক মজুরের পো, তাতে কি কিছু আসে যায়?

আরাম নেই, বিরাম নেই, হাঁটছে কেবল হাঁটছে,
কে বলেছিল অতো দূরে যেতে, কাজ কি নেই কাছে?
আমরা না হয় উচ্চ শিক্ষিত, বিদেশ মোদের ভাতঘর,
দেশে ফিরি বিমান চড়ে, আমরাই তো ভবিষ্যতের কারিগর।

আমার ছেলে লিটল স্টার, যত্নে মানুষ, ব্রাইট ফিউচার,
মজুরের ছেলে মজুর ছাড়া কি আর হবে, ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার?
ওরা তো রেললাইনেই ঘুমিয়ে পড়ে, বিপদ ওদের পদে পদে,
তাতে কি? আমি আমার ছেলে তো আছি বেশ নিরাপদে।

দুবেলা তো ভাত জোটেনা, বস্তিজুরে শুধু হাহাকার,
কাজ চাই, খাবার চাই, ওরা কি সবাই বেকার!!
মরলে বেকার করব কি আর, বেঁচেই বা ওরা করবে কী?
আমরাই তো বাঁচাই দেশ, আমরাই তো দেশ গড়ি।

মিছিমিছি জনসাধারণ মিছিল করো রাস্তা জুরে,
দুর্যোগে আর দুর্ভিক্ষে অমন কতই তো মানুষ মরে!
তাই বলে কি আমাদের তুলনা চলে ওদের সাথে?
আমরা আছি, আমরা থাকব, টাকায়, সুখে নিরাপদে।।

আমরা কি চা খাব না : শিশিরবিন্দু দত্ত



"আমরা কি চা খাবো না, খাবো না আমরা চা"----একই প্রশ্ন বা,  কথাকে দু'ভাবে বলার রীতিই তো অলংকার। আই মিন, সাহিত্যে যে #অলংকার পরানো যায় তা কোনো পার্থিব জুয়েলারি দোকানে পাওয়া যায়নি,যায় না কখনও। সে যাই হোক,  #মৃদুল_দেও কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে  এক উল্লেখযোগ্য ফিগার অফ স্পিচ। সদর্থকভাবেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন এই কথাটা মুখ ফসকে বলার কারণে।
          বাঙালির চা খাওয়াটা একটা দৈনন্দিন #স্টার্ট অফ আ ডে। দিন শুরুই হয় না চা না খেলে।

           বিশ্বে সর্বপ্রথম চা পানের প্রচলন করেন চীনের সম্রাট  #শেন_নাং প্রায় দুশো খ্রীস্টপূর্বাব্দে ।  কথিত আছে যে , একদিন তিনি বাগানে বসে গরম জল খাচ্ছিলেন। তখন একটি বুনো গাছ থেকে কিছু পাতা এসে  পড়ে ঐ জলের ওপর এবং সঙ্গে সঙ্গে জলের রঙ লালচে হয়ে যায়। তারপর তিনি সেই জল পান করেন। এভাবেই নাকি পানীয় জগতের মঞ্চে  উদ্যমী আবির্ভাব  ঘটে চায়ের।

            তবে এটাও শুনেছি, এই বাঙালির চা খাওয়া শেখাটা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ।  'বোস্টন টি পার্টি' বলে একটা  কথা পড়েছিলাম  হিস্ট্রি বইতে। তবে এটা ঠিক যে,  দার্জিলিংয়ের চা তার আগেই উৎপন্ন হতো কিন্তু সেই চায়ের স্বর্গীয় স্বাদ বাঙালিরা  এখনো সেই ভাবে পাওয়া হয়নি । কারণ,  দার্জিলিংয়ে  উৎপাদিত চা মোস্টলি বাইরের দেশে চলে যায়। #ছিটেফোঁটা যা পড়ে থাকে তা-ই   চোখ বুজে পান করে বাংলার  'সহনশীল' বাঙালিরা  দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়।

       চা খায় না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।  বাঙালির কাছে এমন একটি অমূল্য রসিক পানীয় যা শীত -গ্রীষ্ম -বর্ষা- সকাল-  বিকেল -সন্ধ্যা , এমনকি  দুপুরে বা,  #মাঝরাতেও কেউ কেউ চা খেতে পছন্দ করেন । তবে বেশিরভাগ লোকের কাছেই প্রভাতী চা সারাদিনের উদ্যম কর্মক্ষমতা ও #অনুপ্রেরণা বটে। সকালের চা না হলে আবার চা যদি মনপসন্দ না হয়,  তাহলে মনে হয় সারাটা দিন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায়।

           আমাদের চা খাওয়াটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে ঘটে।  সে সকাল হোক বা সন্ধ্যায়।  বাজারের চায়ের দোকান  দিয়েই আমাদের প্রাত্যহিকী শুরু করতে হয়  । #সৌমেন,  বিক্রম, বিপ্লব বা সুরজিৎ -শুকদেব ---চা পানের বিভিন্ন চরিত্র, নানারকম সঙ্গত। কখনো কখনো #আশিসদা,শ্যামলদা অথবা কমলদা চায়ের আড্ডা দিতে চলে আসে আমাদের ধূমকেতু কক্ষে। চা পানে পাই যেমন নানা রকম মানুষ রেগুলারলি, #চা-চরিত্র ও বিবিধ। আগে  লিকার চা,   যাকে বলে  র - চা এবং দুধ চা ছিল। এখন গ্রিন টি , লেমন টি , ব্ল্যাক টি,  ইনস্ট্যান্ট টি,  স্পাইস টি------ওহ্ যেন একান্নবর্তী  ফ্যামিলি অফ টি ।

              সে যাই হোক না কেন,   প্রত্যেকের চা পানের একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে  ।  প্রতিদিন একটি চা দোকানে একই মুখের সমারোহ। কেউ  #সিগারেট জ্বালিয়ে চা পান করেন। কেউ জোরে শব্দ করে চা পান করেন। কেউ  বাবু স্টাইল তো কেউ  #হাবু স্টাইল। কেউ পর পর দু'কাপ। মজার ব্যাপার হলো, চায়ের দোকানদার সব খদ্দেরদের  চা-চরিত্র  এক নিমেষে বলে দিতে পারেন ----- কে চায়ে  বেশি চিনি খান, কার কম চিনির চা চাই,  কার ডায়াবেটিস আছে  বা, কার হার্টের প্রবলেম । একবার এক #অভিভাবক আমাকে তাঁর বাড়িতে #চাপ্যায়ন করেছিলেন। এমন মিষ্টি দিয়ে চা বানিয়ে আমাকে পরিবেশন করেছিলেন যে সেখানেই আমি #দু'লাইন লিখে ফেললাম : এ তো চা নয়,  খাচ্ছি যেন দধি,  আমি চায়ে মিষ্টি বিরোধী।

             চায়ের স্বভাব চরিত্র যাই হোক না কেন, স্বাস্থ্যের দিক থেকে চা যথেষ্ট #উপকারী । নিয়মিত চা পান করলে শরীরে চনমনে ভাব আসে। শরীর-মনজুড়ে  ক্লান্তি দূর করে চায়ে বিদ্যমান ক্যাফেইন। এ ছাড়া, চায়ে অনেক বেশি #অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ।  তবে বিভিন্ন চায়ের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উপকারিতা।
কবীর সুমনের একটি  বিখ্যাত গান আছে : এক কাপ চায়ে আমি #তোমাকে চাই । চায়ের সাথে টা- র  একটা চিরন্তন প্রেম  রয়েছে।  কিন্তু  এই চায়ের সাথে বিশেষ 'তোমাকে ' চাওয়ার কী কোনো উচ্ছ্বাস আছে ---তা আমার এক উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন।

       #পরিশেষে বলি, বাঙালি  যত  আধুনিক ফ্যাশনে নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিক  বা সো কলড্ আপডেট করুক, চা-প্রীতি বাঙালীর কাছে চিরন্তন সত্য হয়ে থাকুক----- যা দেখে অন্তত এই বিশ্বখ্যাত জাতিটাকে এক ঝলকে চিনতে পারে আসমুদ্রহিমাচল।


উলোট পুরাণ: রিম্পা লাহা সুরাই



ঠিক এভাবেই সেদিন পিষেছিল চাকা ,
মরেছিল কিছু অমানুষ ;
রক্ত তাদের উল্লাসে ফেটে আজ ,
 নীরবতা চিরে ফিরুক সবার হুঁশ ।

তেত্রিশ কোটি শুধু নীরব দর্শক ,
সওয়ার বিকল রথে ,
বোধনের আগেই গিয়েছে ভাসান,
ওদের কান্না ভেজা পথে ।

দেবতাও আজ ফিরিয়েছে মুখ ,
বেজে গেছে পাঞ্চজন্য ;
অর্জুন আজ হারিয়েছে দিশা ,
পথ দেখাও হে কৃষ্ণ ।

ভাসছে পুঁথি , বাইবেল , কোরাণ
আবছা গীতার শ্লোক ,
ধর্ম জেহাদ সবটা ভুলে ,
অন্তরাত্মা জাগ্রত হোক ।

সমাজ ও উৎসব : সুনন্দ মন্ডল



সভ্যতার রোজনামচা
      লকডাউনে সমস্যা
      ‎        কাঠগড়ায় উৎসব

মানুষের মৃত্যু মিছিলে করোনা'র তীব্র হাসি।

সমাজের বাম পাঁজরে আঘাত!

পোড় খাওয়া পাখিটাও বলেছিল কোনোদিন,
সময় নগ্ন হবে একদিন,
উল্টে যাবে প্রকৃতি!

দেখো, কোথাও রুষ্ট আবহাওয়ায় ঝড়ের তান্ডব!

সমাজের ডান পাঁজরে হঠাৎ মোচড়।
                -------$-----

শর্ত : কিশলয়



প্রথম লড়াই বুকের দিকে আসে
তারপরেই পড়শী- বান্ধবী
ঝড়ের মতো জান্তব উল্লাসে
ফুঁসে ওঠে যমুনা, জাহ্নবী

মনকে বোঝাই পথের কথা গুলো
সময় কিছু কঠিন পরীক্ষা নিক
ঠিক হয়ে যাক একটা দুটো ভুলও
ঝড়কেও তুই মান্য করিস খানিক

বুকের ভিতর লড়াই পড়ুক জ্বরে
ছাই হয়ে যাক অকাল দাবানলে
যেমন হাড়ে নতুন নাটক করে
পুরুষ মানুষ প্রথম বাবা হলে

সকল লড়াই আচমকা যায় থেমে
জ্যান্ত হলে বুকের তাজা খুন
পায়ের কাছে শত্রু আসে নেমে
শান্তি টানে জ্বলন্ত আগুন

তবু জয় চাই, জয় : সকুমার দাস




তবু জয় চাই,  জয়
-- অনীশ্বর

অপেক্ষারত
মৃত্যুমিছিল! ভয়!
তন্দ্রাহত অন্ধকার, অন্ধকার করে তুলছে
সমস্ত দিব্যদৃষ্টি!

অনাহুত অতিথি, অবিরাম
আগল ভাঙছে, ভেতরে ঢুকবে বলে
দরজা সামলে সমস্ত শক্তি নিংড়ে
শিরা- উপশিরা টানটান করে
দাঁড়িয়ে আছি। ধ্বসে পড়ার ভয়
শক্তিহীন করে তুলছে ক্রমশঃ

রাগ ক্ষোভ দুঃখ ভয়, সব মিলমিশে
একাকার। কোনটা তুলে রাখি
ভবিষ্যতের জন্য...
জয়  জয়  জয়, জয়শক্তি অর্জন
 করতে করতে
অকস্মাৎ শক্তিহীন শক্তিশালী বিশ্ব,
প্রলাপধ্বস্ত, বিদ্ধ
কত ঠুনকো আমাদের শক্তি, অহঙ্কার
মেদবহুল আস্ফালন, --- সব অপলাপ
ভীতি-বাণীজ্যের অমোঘ দেউল
অসারত্ব বিলিয়ে যায়
মেরে বাঁচার আদিম কৌশল!

কে যেন
পাপ ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠা করে
অস্ফুট সংলাপে!
অনবদ্য করতালি
বিশ্বাস বিলুপ্ত করে
প্রশ্নহীন দীর্ঘশ্বাসে!

তবু জয় চাই, জয়
মানুষের জয়
জীবনের জয়
স্বপ্নের জয়, আর
দয়া দাক্ষিণ্য নয়---
বেঁচে থাকবার জন্য
জীবিকার জয়।


প্রেমিকা : শ্যামল কুমার রায়



   বছর পঁচিশ আগের তারুণ্যে ফিরে গেলেন ডঃ প্রিয়তোষ সান্যাল। একি কাকে দেখলেন আজ? সেই চেনা মুখ, চেনা হাসি। নিশ্চিন্তপুরের বিনোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি যাকে দেখতেন সে নয় তো? পিছনের বেঞ্চে বসা ক্লাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল চেহারার মেয়েটাকে তিনি বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতেন, তাঁর প্রথম ক্রাশ।
        খাতার মলাটে যার নাম তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে রাখতেন; যার হাসি তাঁর চোখে মনে লেগে থাকতো। এতো সেই ঊর্মি। হাঁ নিশ্চিত ঊর্মি। সেই সময়ও মুখ ফুটে বলতে পারলেন না, আজও চুপ থেকে গেলেন ব্লুমহার্ট স্কুলের আজকের রাশভারী প্রিন্সিপাল ডঃ সান্যাল। ঊর্মি এসেছে সিঙ্গেল পেরেন্ট হিসেবে মেয়ের ভর্তির জন্য ইন্টারভিউ দিতে।
                 চোখাচোখা প্রশ্ন দক্ষ হাতে সামাল দিয়ে চলেছেন মিসেস ঊর্মি ব্যানার্জী। মুখ ফস্কে ডেকে ফেললেন ' পুলু' বলে। পুলু হলো প্রিয়তোষের ডাক নাম, বন্ধুদের দেওয়া। ব্যাস, চোখাচোখি, মুচকি হাসি অষ্টাদশী প্রেমিকা ঊর্মি ফিরে এলো পুলুর কাছে।
               -----------------------------------

সাদা প্লেটে মৃত্যু : গোলাম রসুল



আকাশে পৃথিবীর প্রতিফলন
মৃত্যুর অববাহিকায় বয়ে যাচ্ছে  যে নদীটি আমারই দুঃখের মতো
শুকিয়ে গেছে কথা আর ছিঁড়ে গেছে আমার মুখের থেকে
হাওয়া শোকের পোশাক

মনুষ্য জাতি ডুবছে ঢেউয়ে
আর সন্ধ্যা নামছে
গলির মুখে  মায়ের কোলে সন্তান  স্তম্ভের মতো কাঁপছে রাত্রি
আমি রাত্রির কিছু জানি না
তাই প্রথম নক্ষত্রটিকে জিজ্ঞেস করি কি আছে  আমাদের ভাগ্যে

প্লাস্টার করা নিশি
অসংখ্য শামুকের মুখ
ঝনঝন করে বাজছে পাতাল
 ঝিঁঝিঁ পোকার ঐক্যতান
চোখের দৃষ্টিতে দ্রাঘিমা রেখা
ওপরে  কে বসে রয়েছে
কে চালাচ্ছে এ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি

একদিন চাঁদ ছিলো মানুষের মুখ
সে চাঁদ ডুবে গেছে সন্ধ্যায়
আকাশ ছিলো আরোগ্য
সেখানে ও ভারী পায়ের শব্দ
দূরবর্তী মেঘ বন্ধুর মতো
যদি বৃষ্টি নামে  সমুদ্রের মাঝে
তাও শুনতে পাবো না উচ্চারণ

আমাদের দেখার জন্যে
সাদা প্লেটে মৃত্যু
    __________________

খিদে : ইসমাইল মোল্লা


দেশ  জুড়ে  লকডাউন  নভেল করোনা
বলছে  নাকি  ঘরেই  থাকো  বাইরে  যেও  না 
দোকানদানি  রাস্তাঘাটে  লোক  মেলা  ভার
আমার  ঘরে  যে  ধিকিধিকি   জ্বলছে  অনাহার 
আমার  ঘরের  বছর আটেক  শুনেছে  রাস্তায়
বাপের নাকি  কাজ   বন্ধ   ইঁটের  ভাটায়
মায়ের  মুখে  চাপা  ভয় 
চলবে কেমন করে
ঘরে  যে মোটে  দশটা  টাকা
খাবার এতে মেলে !
বউটা মোটে পাঁচমাস
 মাসি বলে  ভালো খাবার চাই
বাপের  সুগার  ভীষণ  চড়া
বলতো দেখি  টাকা কোথায় পাই ?
বলছে  লোকে  মাস্ক  পড়ো 
 হাত ছুঁয়োনা হাতে
 জ্বলা  পেটে  বলতো দেখি
 মাস্ক  বাবু কিসের কাজে আসে ?
আমায়  তবে  নিয়ে চলো  ওই বাবুদের কাছে
বলবো  বাবু  দুবেলা ভাত  দে  না ওরে খেতে 
না  পারলে  মানব না  যা
সব  বলব   মিছে
বলতে পারিস  খিদের চেয়ে 
কোথায়  বড়  মহামারী আছে ?

গোপাল ভাঁড় : পিনাকি কর্মকার



বাংলাদেশের রসের রাজা, কি নাম বল তাঁর?
সমস্বরে বললে সবাই, তিনি গোপাল ভাঁড়।

নাদুসনুদুস গোপাল বাবু, টাকে ভরা মাথা ।
পেটটা যেন বটের গুঁড়ি, লম্বে খানিক নাটা।

কৃষ্ণনগর রাজার দেশ ,সেথায় তাঁর নিবাস।
রাজামশায়ের প্রিয়পাত্র, লোকটি তিনি খাস।

রসের রসিক ছিলেন তিনি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাঁর।
ধূর্ত গোপাল পেয়েছিলেন, রাজার সমাদর।

কৃষ্ণচন্দ্রের ভাগ্য ভালো, সঙ্গী এমন ব্যক্তি।
একা গোপাল বাড়িয়ে দিলেন, মহারাজের শক্তি।

যতই আসুক বিপদ আপদ, না থাক পাশে কেউ।
একাই একশ গোপাল ভাঁড়, সামলে দিতেন ঢেউ।

রসের রাজা গোপাল ভাঁড়, জন্ম নাপিত ঘরে।
হাস্যরসে মন মজিয়ে, বিখ্যাত দেশজুড়ে।।

স্পষ্টবক্তা ছিলেন তিনি, ছিলেন যুক্তিবাদী।
রাজার ভুলও ধরিয়ে দিতেন, পেলেন ভাঁড় উপাধি।

তাঁকে নিয়ে হাজার গল্প, মজার এবং ভালো।
ভূবনজুড়ে মজার ছলে, ছড়ায় জ্ঞানের আলো।

ছোট্ট বেলায় সব হারিয়ে, একা হলেন ভবে।
দুঃখ ব্যাথা লুকিয়ে রেখে, হাসিয়ে গেলেন সবে।

রসের রাজা জ্ঞানের রাজা, তিনিই গোপাল ভাঁড়।
ভূবনমাঝে যতই খোঁজ, তুলনা নেইকো তাঁর।

ডাউন ট্রেন কর্ড লাইন লোকাল: অভিজিৎ দাসকর্মকার



...আরও নিম্নগামী হোতে চায় চোখের দৃশ্য-জল। 

মন বলে বস্তুটির পাশে উনকোটি প্রত্নস্বাক্ষর_____

অক্ষরে অক্ষরে মননের আদর্শলিপি কথা বলে;  তবুও
আবশ্যিক কোন documents দেখতে পাচ্ছি না

জ্যোৎস্নার সময়সীমায় চাতক পাখিটি রংবদল করে।
     কালো।  বাদামি।  সাদা।
   
নির্ধারিত ভাবে আকাশ আর গিরগিটির পোশাক বদলে শীতকালের সকাল আর গ্রীষ্মের দুপুরে ডাহুক পাখি ডাকে। 

       সময়ক্ষণটির ছায়ার পিছনে আবদ্ধ হচ্ছি।

ডাকছে আর ভাঙছে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঈষদুষ্ণ শরীরী কারু-কোষ ।

ও বলা হয় নি, আজ নিরুত্তাপ ছিলো স্টালিনের স্বেদনজল।

এবং
    ১টি ঘোষণায়
ডাউন ট্রেন কর্ড লাইন লোকাল ৩৩ মিনিট লেটে চলার খবরে
      গোটা পলাশ চত্তরের সরলরেখা জ্যামিতি বক্স হাতে ত্রিকোণমিতি করছে_____

মানবিক ভেদাভেদ : দেব জৈন



শহরের রাজনীতি, দেশের জাতি-ধর্ম,
গরিবের স্থান পদতলে, কে-আর বোঝে তাদের মর্ম!
ক্ষুধার জ্বালায় প্রাণ ঝরে, করতে হয় তাদের ভিক্ষা;
কেউবা আবার ঘাম ঝরিয়ে, চালায় ভাড়ার রিক্সা।
ছেঁড়া পকেটে জোটে না কিছু, পেট কাদাঁয় রাত-দিন;
সাহেবের নাকি দিন ভালো আজ, দেখেছে সে শালিক তিন।
খাবারের খোঁজে ট্রেনে-বাসে, বাচ্চারাও করে ভিক্ষা;
শিক্ষিত দেশের বিবেকহীন মানুষ, অভাব তাদের শিক্ষা।
খাবারে আজ নুনটা বেশি, সাহেবের মেজাজ হয়েছে ক্ষীণ;
রাতের বেলা ভাত জোটেনি! গরিব হালটাচ্ছে ডাসবিন।
স্বার্থের দুনিয়ায় কেই বা বোঝে, গরিবের পেটের জ্বালা;
জীবনের সুখ লকার ভর্তি, লেগেছে তাতে তালা।
সমাজ আজ অশিক্ষিত, করেছে ধনী-গরীবের ব্যবধান;
মিশেছে গায়ে লাল রক্ত‌ তা ধনী, গরীবের সমান।
বাড়ি-গাড়ি ধনদৌলত, ধনীর হাতে আছে যে রত্ন;
ছেড়াঁ জামা-কাপড়, ধুলো মাখা গায়ে, গরিবেরাও দেখে স্বপ্ন!