বিসর্জন
********
রেখা বেদে দের মেয়ে, তার বিয়ে টা হয়েছিল অনেক অল্প বয়সে।তার একটাই দুঃখ তার পেট থেকে নতুন জীবন এর জন্ম হয়নি। সে বন্ধ্যা। সবাই তাই বলে থাকে। তবে তার মনে হয় না। কেননা তার মাঝেও মীনরূপ জলদেব প্রকট হন প্রতি মাসে। তার তিননদী তেও বান ডাকে প্রতি মাসের তিন দিন।
আজকে সে এই কারণেই এসেছে বরেন্দ্র মহাস্থান এ। এখান নিশুম্ব নামের এক মহাতান্ত্রিক এর বাস সে শুনেছে, সবাই নাকি তার দেখা পায় না। তবে সে আশায় আছে, সে হয়ত পেয়ে যাবে। কেননা সে শুদ্র দেবতার পূজারী। নিশুম এর ন্যায়।
রেখা মেঠোপথে এগুচ্ছে তার মাথার উপরে একটা ঝুড়ি। সেই ঝুড়ির মাঝে নানা রকম এর জিনিস। সে এগুলো বিক্রি করে বিভিন্ন এলাকা তে।
সে আসতে আসতে পৌছাল একটা গড় এর কাছে। ঢিবির মত উঁচু হয়ে আচ্ছে গড়টি। এখান থেকেই নিশুম্ব এর এলাকা শুরু।
সে পূজা করে এক অজানা অন্ধকার দেবতার। তবে তার অনেক নাম ডাক। সন্তান চাইতে গিয়ে যারা তার দেখা পেয়েছে তারা কেউই নাকি খালি হাতে ফেরেনি।
“সেইডা তো ঠিক আছে, কিন্তক তান্ত্রিক এর কাছে যাওনের আগে শুইন্না লও সে কিন্তক সব কিছুর একটা কইরা দাম লয়”
সে গরীব বেদেনি। এরপরেও সে চলেছে তার কাছে।
সবার অপবাদ সইতে পারে না সে। তার আর ভালো লাগে না বন্ধ্যার এই অপবাদ। তার স্বামীকে শুনতে হয় হাটকুড়া নাম।
কিছু না বললেও তার মুখ দেখলে পারে বোঝা যায়। যে তার ভেতর টা ছিড়ে যায়।
এই কারণে তান্ত্রিক যা দাম চায়, সে দিয়ে দেবে,
সেটা যা-ই হোক না কেন।
যদিও তান্ত্রিক চরিত্রহীন নয়। তাকে ব্রহ্মচর্য এর সাধনা করতে হয়। এই কারণে যদি সে তার সমস্ত সম্পদ চেয়ে বসে তাও পিছে হটবে না সে।সে হয়ত চাইবে তার জীবন , সেটিও দিতে সে রাজি। যদি সন্তান এর জন্মের পর সে তাকে বলি দেয় সে হাসতে হাসতে বলি তে উঠবে।
সে ভাঙ্গা দেউল এর কাছে এল। এই দেউল টা সেই পৌরাণিক যুগ এর। মহাভারত এর যুগের রাজা পুণ্ড্রক বানিয়েছিল নাকি এটা।
এর মাঝে এখনও আঁধার সেই দেবতার পূজা করা হয়। যার পূজা পুণ্ড্রক করত।
দেউলটা শুন্য। ভেতরে কেউ নেই , শুধু ছুঁচোর বিষ্ঠা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে যেন নেই।
অন্ধকার এর একটা একটা করে স্তম্ভ যেন সবদিকে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে সে কোথায় পাবে সেই তান্ত্রিক কে। এটাই বুঝতে পারছে না।একদিকের ছায়া গুলো নাচছে যেন নাচতে নাচতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর অপর দিকেও ছায়ার নাচন দেখা যাচ্ছে। এই ছায়া গুলো কাঁপতে কাঁপতে ঘরের কোনাতে জড় হতে লাগলো , একটু পরে সে দেখতে পেল সেখানে ঘুলঘুলি এর কাছে একটা কৃষ্ণরঙের মানুষ বসে আছে। তার উপরে ছোঁয়া লেগেই ছায়া কাঁপছে।
সে গেল তার কাছে , সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিল সে।
তার ঠোঁট নড়ল না, কিন্ত স্পষ্ট বুঝতে পারল সে তার মনের ভেতরে কথা বলে চলেছে সে ,
“তুই হাটকুঁড়ে তাই লস কি?”
“হ স্বামীজী , হামি হাটকুঁড়া” সে বলল
“তোরে আমি বাচ্চা দিতে পারুম না, পারবি তুই, তুই পারবি, কিন্তক তোর মনের মইদ্ধে যে ভয় আছে তাক তাড়ান লাগবো, তুই তোর জন্য বাচ্চা আনবি ছাওয়াল আনবি, কিন্ত তোর বাচ্চা অইব, কাঁকড়ার বাচ্চার লাহান”
“এইটা কি কন”
“হ, যা কইতাছি মন দিয়া শোন। তুই এখান থেকএ গিয়া দীঘির জলে গা ধুইবি, তোর স্বামীরে নিয়া আইছস তো?”
“হ ,কিন্তক স্বামীজী আপনার এলাকাত তো পুরুষ মানা, তাই আনি নাই”
“এরপরে তোর স্বামীর লগে তুই নরলীলা করবি”
“তোর বাচ্চা হইব , কিন্ত কাঁকড়ার বাচ্চার লাকান হইব”
“ওর কি দাঁড়া থাকব? তাইলে তো সবাই তারে দানো কইব!”
“আরে না ও কাঁকড়া হইব না, কাঁকড়া তো হইবি তুই” যা আর দেখতে পাইবি না আম্রে তুই, যা”
একমুঠো ধুলো নিয়ে তার দিকে ছুড়ে দিল সে।তার চোখ জ্বালা করে উঠল, চোখ বন্ধ করল সে, তবে চোখ খুলে সে দেখে যে আর কেউ নেই।
সে ফিরে এল, পরনের পোশাক নিয়েই নামল দীঘিতে, দীঘির পানি যেন কেমন আঁশটে একটা গন্ধ করছে যেন অনেক গাড় কিছু একটা পানিটা। এরপরে ডুব দিয়ে উঠল সে।
তার স্বামীর কুটির এর দিকে যাত্রা করল সে, এখানে এক বেনের কুটিরে আছে তারা , বেনে গেছে প্রাগজ্যোতিষ এ।
স্বামীর কাছে নিজেকে সঁপে দিল সে।
পরের দিন সকাল থেকেই, যেন নিজের মাঝে এক ধরণ এর পরিবর্তন এর ছোঁয়া পেতে শুরু করল সে, যেন কোন কিছু তার ভেতর থেকে টানছে, যেন কিছু একটা তার ভেতরে থেকে তার মাঝ থেকে বের হচ্ছে।
ধীরে ধীরে তার পেট স্ফিত হতে শুরু করল দুই তিন মাস এর মাঝেই, সবাই বুঝতে পারল সে মা হতে চলেছে।
তবে সে কিছুই বুঝতে পারল না তখনও, তবে তার মনে হত যেন খুব ধীরে ধীরে কিছু একটা তার ভেতর থেকে তার শক্তি কে শেষ করে ফেলছে।
তবে সেটা খুব বেশী না। এটা বুঝতে শুরু করল সে যখন থেকে ৬ মাস হতে লাগলো তার। তার পেট অস্বাভাবিক রকম এর ফুলে গেল। আর তার হাত পা গুলো যেন ছোট ছোট হয়ে গেল, সে সারাদিন শুয়ে থাকে বিছানার মাঝে,
এরপরেই শুরু হল শুকিয়ে যাওয়া, তার পেট এর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে যেন সবকিছু সেই নতুন প্রাণ গ্রহণ করে নিচ্ছে। সে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে, তার পেট টা খোলস এর মত বড় হতেই আছে, আছে, এখন তাকে দেখলে মনে হয় চার হাতি একটা কাঁকড়া। তান্ত্রিক এর ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হচ্ছে যেন ধীরে ধীরে।
যেদিন এর প্রসব এর সময় আসল, দাই ভয় পেয়ে গেল, কেননা তার দেহ কাগজ এর মত হয়ে গেছে, এত পাতলা চামড়া।
ধীরে ধীরে সে যখন তাকে একটু একটু করে বাচ্চাকে এই ধরা তে নিয়ে আসল, তারা পেট ফেড়ে বের হয়ে এল, একদম তার মত দেখতে একটা মেয়ে আর তার স্বামীর মত একটা ছেলে। রেখার মুখে হাসি নিয়েই সে ঢলে পড়ল চিরনিদ্রা এর কোলে।
সে সেভাবেই জন্মদিল তার সন্তান দের কে যেমন করে কাঁকড়া মা তার সন্তান জন্ম দেয়, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে, সে জানত এটাই হবে, এই কারণে সে এটা নিয়ে কখনই কিছুই বলেনি। তার শব কে পোড়াতে বা কবর দিতে রাজি হয়নি পুরোহিত মশাই, তিনি বলেন “এই কন্যা সাক্ষাৎ মাতৃ দেবী” তার শব মাটি ধারণ করতে সক্ষম হবে না, তার মাঝে এত শক্তি নেই, আমরা একে দেবীর ন্যায় বিসর্জন দেই মা গঙ্গার মাঝে, তিনিই তাকে দেখবেন,
নির্দিষ্ট দিনে লাল বেনারসি পরিয়ে তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হল জাহ্নবী এর তীর থেকে। ধীরে ধীরে সেও যেন আরেক দেবীর ন্যায় বিসর্জিত হল গঙ্গার মাঝে। আসলে মাতৃত্বই তো দেবীর ধর্ম, আর তার মন্ত্র বিসর্জন এর গান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন