মা
***
প্রথম যেদিন তার সাথে পরিচয় হয়েছিল, খুব অবাক হয়েছিলাম আমি৷ আর হ্যাঁ, অনেক ভয়ও পেয়েছিলাম৷ পাবই বা না কেন? কতই বা বয়স তখন আমার? কেবল ১২ কি ১৩ সপ্তাহ৷ সবে হাত পা নড়াচড়া শুরু করেছি তখন৷ একদিন আমার ছোট্ট আঙ্গুলখানি মুখে পুরে গভীর এক ভাবনায় ডুবে আছি৷ ভাবছি, শীতকাল তো এল বলে৷ আমার এই পানিভর্তি প্যারাস্যুটটাতে থেকে এই কনকনে শীত পার করব কীভাবে?
হঠাৎ তার ছোঁয়া পেলাম৷ একটা কোমল মায়ার আবেশে আমার ছোট্ট ভুবনখানি দুলে উঠল৷ ভীত-সন্ত্রস্ত আমি চুপসে এক কোণে সরে আসলাম৷ মৃদু কাঁপা কণ্ঠে বললাম, “কে? কে ওখানে?”
কেউ শুনতে পেল কিনা বুঝলাম না৷ কোনো জবাবও এল না৷ কান পাতলাম দেয়ালটায়৷ শুনতে পেলাম মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠে কে যেন বলছে, “জ্বী ম্যাডাম, আমি টুং বাবুর নড়াচড়া টের পাচ্ছি৷ এ এক অন্যরকম অনুভূতি৷ প্রথম মা হবার সবকিছুই অনেক উপভোগ করছি৷”
“অনুভূতি?” ভ্রূ কুঁচকে গেল আমার৷ এতদিন খুব মন খারাপ করে ভাবতাম, আমি বুঝি একা৷ কিন্তু না, এই যে বাইরের কে যেন আমাকে নিয়ে মিষ্টি অনুভূতি পাচ্ছে৷ মনটা প্রচণ্ড রকমের ভালো হয়ে গেল৷ হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি অ্যাঙরি বার্ডের গানটাতে নাচ শুরু করে দিয়েছি৷ নাচ শুরু হতেই বাইরের উনি হঠাৎ ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলেন মনে হল৷
“ইশশ ব্যাথা দিয়ে ফেললাম মনে হয়৷ সরি৷” নিজে নিজেই বললাম আমি৷ মানুষটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেল, আচ্ছা, উনার কী নাম দেওয়া যায়? এত নরম হাতে আদর করে আমায়...উমম... পমপম কিংবা তুলতুল? সেই থেকে পমপমের সাথে ভাবটা জমেই গেল বেশ করে৷
সেদিনের পর থেকে সে প্রায়ই আমার উপর হাত বুলায়৷ আমিও আমার ছোট্ট আঙ্গুলটা দিয়ে দিয়ে তাকে একটু ছুঁয়ে দিই৷ যেন খুব আপন মনে হয় তাকে৷ আমরা একসাথে “মাশা এণ্ড দ্য বিয়ার” কার্টুন দেখি৷ গল্প শুনি৷ আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প মেকু কাহিনী৷ প্রিয় কবিতা বীরপুরুষ৷ পমপম এতবার শুনিয়েছে যে আমি মুখস্থই করে নিয়েছি৷ ভাবছি কোনো একদিন টুপ করে প্যারাস্যুট থেকে বেরিয়েই বলব, “এই আমি,আমি বলব৷ শুন তুমি চুপটি করে৷” সে নিশ্চয়ই খুব খুব অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকবে৷
পমপম একটা স্কুলে পড়ায়৷ একদিন শুনি স্কুলের বাচ্চারা নাকি আমার জন্য ছবি এঁকে, চকলেট নিয়ে এসেছে৷ শুনে তো আমার খুশিতে কান্নাই চলে আসল৷ বাইরের মানুষগুলো তাহলে এত ভালো?
পমপম আজ একটা নতুন গল্প বলেছে৷ আগের সব গল্প থেকে আলাদা৷ খুব আলাদা এক আবেগের গল্প৷ দেশে যুদ্ধের সময় বাচ্চাকে বাঁচাতে এক মায়ের জীবন দেবার গল্প৷ যুদ্ধ কী সেটা না বুঝলেও মা শব্দটা আমার হৃদয়ে গেঁথে গেল৷ “মা,মা,মা” বারবার আওড়ালাম আমি৷ এত মিষ্টি-মধুর শব্দটা তাহলে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?
আমার এই ছোট্ট আদুরে টুং নামটা খুব পছন্দের৷ পমপম মা এখন আমাকে এই নামেই ডাকে৷ আর আমি সাথে সাথে একটু নড়েচড়ে জ্বী বলি৷ তখন মা আমায় একটু আদর করে দেন৷
আজকে শুনলাম আমি নাকি মেয়ে বাবু৷ তারমানে আমার গলাটাও মায়ের মত মিষ্টি রিনরিনে হবে৷ কোমল মমতা মেশানো হাতটা চুড়িতে ভর্তি থাকবে মায়ের মতই৷ মা আজকাল আর স্কুলে যাননা৷ ব্যালকনিতে ক্লান্ত শরীরে ইজি চেয়ারটাতে বসে আমার জন্য লাল টুকটুকে একটা উলের লাল জামা বোনে আর আমায় গল্প শোনায়৷ আর আমি ভাবি লাল জামাটা পরে লাল, ক্লিপ পরে ঝুঁটি করে মায়ের স্কুলের বাচ্চাদের একদিন থ্যাঙ্কস দিয়ে আসব৷ ঐ ছবিগুলো দেখতে কত যে ইচ্ছে হয় আমার৷ এসব ভাবতে ভাবতে আঙ্গুলটা মুখে পুরেই ঘুমিয়ে গেলাম৷
হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার৷ মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল৷ মাকেও কেমন অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে৷ ভয়ে গুটিসুটি হয়ে কয়েকবার ডাকলাম মাকে৷ সাড়া দিলেন না৷ আদর করে বললেনও না “ভয় পাসনা টুং, আমাতো আছি৷”হঠাৎ খুব চিৎকার- চেচামেচি, ভাংচুরের শব্দ৷ কানে হাত দিতে বাধ্য হলাম৷ কিন্তু “যৌতুক” “মেয়ে বাচ্চা” এরকম কয়েকটা শব্দ কানে এল৷ তবে কি, তবে কি বাইরের মানুষগুলো চায়না আমায়? কিন্তু..কিন্তু আমিতো না দেখেই ওদের ভালবেসে ফেলেছিলাম৷
হঠাৎ মাকে ওরা খাট থেকে ফেলে দেয়৷ এলোপাথাড়ি মারতে থাকে৷ আমার খুব ব্যথা লাগছে৷ এর চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্য৷ চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম, “প্লিজ,তোমরা আমার মায়ের সাথে এমন কোরোনা৷” হঠাৎ পাশ থেকে মহিলা কণ্ঠে কে যেন আগুনের কথা বলে উঠল৷ প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম আমি৷ ওরা মাকে টানতে টানতে বাড়ির উঠানে নিয়ে গেল৷ মা এই প্রথম মুখ খুললেন৷ “আমার জীবনের বিনিময়ে আমার টুংকে তোমরা বাঁচতে দাও, বাঁচতে দাও৷” হাসির রোল পড়ে গেল৷ অট্টহাসির গভীর ফাটলে পড়ে চাপা পড়ে গেল বাঁচার আকুতি-আর্তনাদ৷ একি? আমার এত গরম লাগছে কেন? আমার প্যারাস্যুটটা পুড়ে যাচ্ছে দ্রুত৷ রক্তের প্রবল স্রোত নাক মুখ দিয়ে ঢুকছে৷ আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার ৷ কেবল মায়ের মুখটা একটাবার দেখতে ইচ্ছে করছে...প্রচণ্ডভাবে৷
তারপর…. মেকু কাহিনীরা কাগজের পাতায় ধুলো ময়লায় মাখামাখি হয়৷ রিনরিনে সেই গানের সুরগুলো বিরহের সুর তোলে তানপুরায়৷ ছোট্ট লাল সেই উলের জামাটি ঝুল-কালি মেখে পড়ে থাকে চুলোর একপাশে৷ লাল-নীল রঙিন স্বপ্নগুলো সুতো কাটা ঘুড়ির মত মেঘের দেশ পাড়ি দিতে দিতে হয়ত ক্লান্ত হয়ে আটকে যায় সময়ের ডালে৷ কিন্তু এত বড় পৃথিবীটা আমাদের মত টুংদের আর চোখ মেলে দেখা হয় না৷ একটা নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে অনেকটা অভিমান নিয়ে খুব সন্তর্পণে চলে যেতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে৷ এ শুধু আমার মত কেবল কোনো নিরপরাধ প্রাণ কিংবা রঙিন স্বপ্নগুলোর বিসর্জন নয়, যুগে যুগে শাশ্বত নারীজন্মের পাপমোচনও৷ ধরার মানুষদের সে খোঁজ রাখার ফুসরতটুকু ও মেলেনা৷ কেননা, সত্যিই তো, এ জগতে কে কার?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন