নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

রাজিত বন্দোপাধ্যায়






সেদিনের বিসর্জন    
****************




              অনেক দিন পরে নদীর পাড়ে এল দীপ্ত । তার চুলে আচমকাই ঐ কাশ ফুলের রঙ লাগতে শুরু করেছে । আজ দশমী । একটু দূরে ঘাটে একের পর এক প্রতিমা এসে জড়ো হচ্ছে । সেই দিকে চাইতে ইচ্ছে করছে না । এখানে এই দিনটাতে না এলেই বোধকরি ভাল হত । নদীর সামান্য জল স্রোতের দিকে চেয়ে তার মনে হল । আরো দূরে রেল লাইনের অপর পারে নদী ঘেসে পার্বতী ঘাট । সেখানে মাথার উপর ফিকে নীল ধোঁয়ার দাগ । চিতা জ্বলছে ! হঠাৎ আবার সেই দিনটা তার মস্তিষ্কের ভিতর ছাইতে শুরু করল । ডাক্তার এটাকে প্রশ্রয় দিতে বারবার মানা করেছে তাকে । কিন্তু দীপ্ত বহু চেষ্টা করেও বিসর্জনের ঢাকের আওয়জটা কিছুতেই বন্ধ করতে পারল না । আস্তে আস্তে সিনেমার রূপালী পর্দায় ফুটে ওঠার মত স্পষ্ট হতে লাগল তা দীপ্তের ধূসর মগজে !  
-- শালা ! হারামখোর , রাজনীতি করছিস । বলেছিলাম ঐ পার্টিতে তোকে না থাকতে , শুনলি ? এই রামদেও কুত্তা কো ঘসিট কে লা তো ।  
রামদেও গেট খুলে কম্পাউন্ডের ভিতরে চলে এল । সবে মাত্র কোলকাতা থেকে আসা শারদ সংখ্যা খানা খুলেছে দীপ্ত ভট্টাচার্য । এতে তার একটা বড় গল্প ছেপেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক মন্ডলী । একটা বেসরকারী কলেজে ইংরেজী পড়ায় সে । রাজনীতিতে খুবই ইনভলবড্ । কিন্তু পাড়াটার জন্য , এলাকার জন্য এত দিনের এত সেবা কাজে এল না এই দূর্গা পূজোর দশমীর সকালে । সবাই ব্যস্ত , কেউ এগিয়ে এলো না । হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল উমাবতী । তার বৌ । তাকে রামদেও টেনে হিচড়ে গেটের দিকে নিয়ে যাবার ফাঁকে বারবার পায়ে পড়তে লাগল । কিন্তু গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে সরযূ লালা নির্বিকার ! রামদেও দীপ্তর কলার ধরা অবস্থায় হঠাৎ বলে উঠলে ,   
-- অরে বস ইসসে তো আচ্ছা হোগা ইসে না মার কর ইসকা বিবি কো হী লুট লেনা । একদম ঝকাস হ্যায় শালী । হ্যাঃ - হ্যাঃ - হ্যাঃ !!
-- তেরা দিমাগ ভী তো ঝকাস হ্যায় রামদেও । লা , তব উসে হী লা ।  
দীপ্ত কে ছেড়ে উমাবতী কে ধরতেই দীপ্ত ঝাপিয়ে পড়েছিল । রামদেও তাকে একটা নীট লাথি ঝাড়তেই তার মাথাটা ভয়ঙ্কর ভাবে লোহার গেটে লাগল । দীপ্ত জ্ঞান হারাতেই রামদেও ঝটপট উমাবতী কে উঠিয়ে নিল কাঁধে ।   
সমস্ত পাড়া কে স্বাক্ষী রেখে সেদিন প্রকাশ্যে যে বীভৎস ধর্ষণ কান্ডটি হয়েছিল , তা পরের দিন খবর কাগজের প্রথম পাতা দখল করেছিল । বিস্তারিত ভাবে ছেপেছিল দৈনিক গুলো । লোকেরা আড়ালে বলেছিল , একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক পার্টির টাকাই নাকি ছিল এই বিস্তারিত ভাবে খবর টি ছাপার পিছনে ! আসল কথা হল একটা প্যানিক ছড়ানো ।
               জ্ঞান ফিরতে সুমসান রাস্তার উপর উমাবতীর রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহটা দেখতে পেল দীপ্ত । তার দু চোখ শুকনো । লাল চোখে সে অতি কষ্টে উঠে গিয়েছিল সেখানে । সকালের আমেজ কেটে তখন সূর্য দীপ্তমান দেখাচ্ছিল । থানা পুলিশ করে যখন দেহটা বেরুল , তখন নিজের দলের গুটিকতক ছেলে ছাড়া আর কাউকে পেলনা সে । তার অনুরোধে কোন মিছিল বা শশ্মানে ভিড় জমালো না তার দল । বড় নেতারা কেবল অত্যন্ত লজ্জাকর ও বেদনার বলেই বিদায় করেছিল সংবাদ কর্মীদের সেদিন ।  
পড়ন্ত বেলায় পার্বতী ঘাটে অস্তি বিসর্জনের সময় অপর পারে আচমকাই বেজে উঠেছিল বিসর্জনের বাজনা ! অত ঢাকের প্রবল আওয়াজে হঠাৎ যেন কী হয়ে গেল দীপ্তর । অস্তির সরা সমেত সে পড়ে গেল খরকাইয়ের জলে । ওপারে আদিত্যপুরের ঘাটে তখন বেজে চলেছে ঢাক মহোৎসবে ।   
দীপ্তর জ্ঞান ফিরেছিল হাসপাতালের বেডে । এর মধ্যে এক সপ্তাহ যে কেটে গেছে সে জানে না । আর তারপরই তার মনরোগটা চাগিয়ে উঠেছিল কানে ঢাকের আওয়াজ শুরু হতেই সেদিনের ছবিটা ক্রমে ক্রমে সিনেমার পর্দার মত ফুটে উঠতে শুরু করত ! রাঁচীতে প্রায় বছর দেরেক চিকিৎসা করানোর পর ক্রমে সুস্থ হল ।  
হঠাৎ একটা পটকার বিকট আওয়াজে গড়ে উঠতে থাকা ছবিটা হারিয়ে যেতেই সচেতন হল দীপ্ত । ওদিকে তখন ঘাটে ঘাটে বিসর্জন শুরু হয়ে গিয়েছে । মা যাত্রা শুরু করে দিয়েছেন কৈলাসের দিকে । দীপ্ত হঠাৎই দু হাত জড়ো সেই চলে যেতে থাকা মা দূর্গার উদ্দেশ্যে মনে মনে বলতে লাগল , হে মা দূর্গা , এই জঘন্য রাজনীতি , রাজনৈতিক ইস্যু , ঐ মোমবাতির মিছিল , অভিমান , হিংসে , ধর্ষণ সব ,  সব কিছুরই বিসর্জন হয়ে যাক তোর প্রতিমার সাথে । শান্তি , সৌহার্দ , প্রেম আর অহিংসা দে মা , দিয়ে যা এই পতিতালয়ে !   

কোন মন্তব্য নেই: