জোয়ার এলেই নদী শব্দ তোলে ছলাৎ ছলাৎ ,
ছলাৎ ছলাৎ ....
সে শব্দ নদী-চর ছুঁয়ে ছুঁয়ে উঠে আসে
মাটির বাঁধ বরাবর ;
তার পর সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ে ,
ঢুকে পড়ে লোকালয়ে ,
বুকের ভিতর ;
আমার বুকের ভিতরের নদীতে জোয়ার-ভাঁটা ,
ছলাৎ ছলাৎ শব্দ .....
সে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারি জীবন-নৌকা ,
ভাটিয়ালি , আগমনিগান ;
আমি এখন অষ্টাদশী ;
আমি এখন স্কুল পেরিয়ে কলেজে ;
আমার মননে সোঁদামাটির ঘ্রাণ ;
সুন্দরী-গড়ান-হেতালের ছায়া ;
আমার মা এখনও শাঁখা-সিঁদুর বন্ধক রাখে
বনবিবি-দক্ষিণরায়ের কাছে ;
বাবা খাঁড়িপথে কাঁকড়া ধরতে গেলে ;
কত মানুষ যে বাঘের পেটে চলে গেল তার হিসাব নেই ;
হিসাব রাখেনা এ সুন্দরবন ;
কেবল হিসাব রাখে মা ,
বাবার বাড়ি ফেরার দিনের ;
বাবা বলেছে ----
তোকে মানুষ হতে হবে ,
একটা গোটা মানুষ , সম্পূর্ণ মানুষ ;
আর গড়তে হবে হাজার হাজার মানুষ ;
যারা বাঁচাবে এই জল-জংলার দেশ ,
বাদাবনের কাদাজল ;
জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে বাবা কাঁকড়া ধরেই বাড়ি ফেরে ;
জীবন নিয়েই বাড়ি ফেরে ;
একটা জীবন একটা পরিবার ;
একটা জীবন একটা স্বপ্ন , মানুষ গড়ার স্বপ্ন ;
আমাকে মানুষ হতে হবে ,
গোটা একটা মানুষ ;
গোটা একটা দেশ , ভারতবর্ষ ;
বাবা গল্প শোনায় , গল্প ....
দিনের গল্প , রাতের গল্প ;
সে গল্প জুড়ে মাঝি , বহরদার , রাতের শব্দ ,
পায়ের ছাপ , মানুষখেকো ...
বাবার গল্পে জাগে গঙ্গারিডি সভ্যতা ;
গল্পে জাগে শেষ হয়ে আসা এ সভ্যতা ;
জলের নীচে ব-দ্বীপ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ;
গুরু মশায়ের পাঠশালায় কোনো দিন যায়নি বাবা ;
অথচ , প্রকৃতির পাঠশালায় পাঠ নিতে নিতে
নিতে নিতে জেনে গেছে
জলের স্তর বাড়ছে উষ্ণায়নের ফলে ;
শেষ হয়ে আসছে এ জঙ্গল ,
এ ব-দ্বীপ , এ জনপথ , এ সভ্যতা ;
বাঁচাতে হবে ,
বাঁচাতে হবে আমাকে , আমাদের ...
জোয়ার এলেই নদী শব্দ তোলে ছলাৎ ছলাৎ ,
ছলাৎ ছলাৎ .....
মাঠে মাঠে এখন কাশফুল ,
জলাভূমিতে রঙবেরঙের শালুক ,
উঠানের বেড়াতে জড়িয়ে ফুটে থাকা অপরাজিতা ,
আর দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ
জানিয়ে দেয় পূজা আসছে ;
আর ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠছে ----
তং হি দুর্গে দশপ্রহরণ ধারিণী নমামি তাং....