নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

উষ্ণতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
উষ্ণতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আর কিছুদিন :তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়








অনেকসময় ব্যয় করেছি বৃথা কাজে।
অপচয় ও অনেক আছে।
সময় বোধহয় রাগ করেছে।
বসন্ত ও বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
যাবার সময় বলেছিলো-" থেকো ভালো"।
এখন আমি তাদের খুঁজি ধূসর রাতে।
সব অঙ্কই শূন্য দেখি ধারাপাতে।
তাও যখন বাতাসে আজ ছাতিম ফুলের গন্ধ ভাসে।
আঁধার ফুঁড়ে চাঁদের আলোর জোছনা আসে।
মন দোতারায় ঠিক তখনই আনন্দেরই সুরটি বাজে।
তখন আমি নরম ঘাসের বুকেই আমার দুঃখ রাখি।
দিই মেলে ওই অলীক ডানা আকাশপথে।
আরো কিছু "সময়" থাকুক।
থাকুক মনে বসন্তদিন।
আর কিছুদিন।।

প্রহর : অজাত শত্রু





হাঁ করে আছি,আস্ত একটা চাঁদ "ঝলসানো রুটি"।

নিয়ন খুড়ে রাখি করব, আমার মৃত্যু শোকে
গীতা পড়ছে মহম্মদ, কৃষ্ণ নিয়েছে কাফন।

জলের দাগে কেটে যাক বাড়ির স্তর, ট্রাম,ইস্কাবন।

     বারুদ আর বুদ্ধিজীবী ,নিয়মমাফিক রুটিন।।

পৃথিবীর বুকে পেরক পুতে রেখে দিও ,প্রিয়,
দু এক ফোটা বৃষ্টি দাগ,হাতঘড়ি গুনেছ ট্রাফিকে।

পেরছি আস্ত একটা চাঁদ,সাপ।মুহূর্তরা হয়ে যায় ফিকে।।

পরজন্মের জন্য পান্তাভাত বেড়ে রাখি...
 
              মাছি কিংবা পাখী..



-:আদর বিকেল :- মল্লিকা দাস




অনুভূতিটা বরাবরই সুপ্ত রেখেছি তোমাতে
গহীন মনের খবর তবুও জেনে নিয়েছো বেশ ;
ভেজা বৃষ্টি বিকেলে ঠোঁটের স্পর্শ ঠোঁটে লেগে,
উষ্ণতা সেঁকেছিল সেদিন ভালোবাসার আবেশ...

সেদিন দুটো শরীর ভিজেছিল ভীষণ
ঘড়ির কাঁটার তখন নিরুদ্দেশী আস্তানা ;
সুখ হাতড়ানো ভেজা শার্টের গন্ধে,
বৈশাখী ঝড় চিঠি পাঠিয়েছিল আনমনা...

বারবার তোমার আঙ্গুল ছুঁয়ে আমার চিবুক-
লাজুক রঙের সোহাগ মেখে হলো ভীষণ দামী ;
দু'জোড়া চোখ খুঁজে নিয়েছিল ব্যস্ততা,
সিঁদুর রাঙা মেঘের মাঝে তখন সূর্য অস্তগামী...

এবার তবে ফিরতে হবে ব্যক্তিগত যাত্রাপথে,
বৃষ্টি-প্রেম বেঁচে নেওয়া, সুখের এই মুহূর্ততেই ;
মনের রিংটোন এ ভেসে আসে হঠাৎ -
" Abhi na jao chor kar, ke Dil abhi bhara nehi..."       
         
               


একটু উষ্ণতার জন্য :রাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়





একটু উষ্ণতার জন্যে বারবার 
অপদস্ত হয়েছি -- 
নিজের বন্ধু সজন ' আহারে '   
নামের করুণা বর্ষেছে ! 
একটু উষ্ণতার জন্যে -- 
ক্ষুন্নিবৃত্তি চাপা দিতে দিতে 
পৌঁছে গিয়েছি   
সিনিয়র সিটিজেনের কোঠায় !   
একটু উষ্ণতার জন্যে --   
আজও কেটে যায় প্রতিক্ষণ 
একাকী শৈত্য বাহিত বিছানায় !     
একটু উষ্ণতার জন্যে --
পেট কেটে কেটে খাটতে না পারা   
দিনের জন্য সঞ্চয়ের ঝোলায় -- 
গত পাঁচ বছরে   
পড়েছে দুই শতাংশের মার !   
আজ তাই শেষের পথে --   
আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত প্রতিটি মূহুর্ত্ব   
জীবনের রণে শৈত্যতার ঝড় ! 
আজো তাই -- 
একটু উষ্ণতার জন্যে জীবন   
ব্যাকুল মেহনত দিবার লোভে ।   
অথচ সামনে স্থবির হবার ডাক !   
এ জীবন রাজ কার্যের দান -- 
তাই আর প্রয়োজন নেই   
বলার তোমাকে সাবধান ।   
নীতির বস্তা ফেলে --   
এইবার একটু উষ্ণতার জন্যে   
হোক তোমার পুনর্জন্ম খান !!   


সখী ভালোবাসা কারে কয় : রিয়া ঘোষ





কেউ কি বলতে পারো,বুকের রক্ত  কতোটা শুকোলে  বৃষ্টি নামে দুচোখে?
কতোটা অভিমান জমলে হাড় হিম হয় রাতে...!

কেউ কি বুঝতে পারো,কতো কথা জমা হলে
ওষ্ঠ অসাড়তা খোঁজে  ?
কতো হাজার মরণ পেরিয়ে প্রেম কবিতা হয়ে ফোটে...! 

কেউ কি মাপতে জানো কতো টুকু ভালোবাসলে তবে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে?
কতোটুকু বিষ মিশলে পরে রক্ত ছলাৎ করে  বুকে  ..!

কতোটুকু ?
ঠিক কতোটুকু ?
জানো কেউ ? 
জানলে  শুধিও আমায়,
শুধিও একটিবার ...!

আমরা কৃষক: অঞ্জন দাস মহাপাত্র


 


  বাবুগো তোমারা থাকো ঠান্ডা ঘরে
  হিমেল হাওয়ার সুখে
  উফঃ কি গরম পড়েছে বলে,দেখাও
  বিরক্তির ভাব মুখে
   মাঠে আমরা থাকি সূর্য তাপে
    মুখ জ্বলে যায় শরীর কাঁপে
   ঘামের স্রোতে স্নান করি রোজ
    দিব্বি বাঁচি ধুঁকে ধুঁকে ।।
   তবু কষ্ট মোদের হয়না বাবু
   যাকনা শরীর জ্বলে
   দুঃখ যত সুখ হয়ে যায়
   সোনার ফসল ফলে
   আমাদের এই ক্লান্ত হাতে,
   ভাত তুলে দেই সবার পাতে;
   খুশির অশ্রু হৃদয় ভেজায়
  শক্তি জোগায় মনবলে
  তপ্ত দুপুরে দগ্ধ শরীর
   তাও আশাকে বাঁচাই বুকে।
   বাবুগো তোমরা থাকো ঠান্ডা ঘরে
   হিমেল হাওয়ার সুখে ।।

নির্বিষ খোলশ :কার্তিক ঢক্




রং চিনি না বলে, হলুদ বসন্তকে
মৌরীফুল ভাবতে পারিনি! 
কোজাগরী আকাশের নর্তকী-ডানায় কালপুরুষ  দেখি...

তোমার প্রোফাইল-পিক এ ট্রিম করা    ভ্রূ-কুঞ্চন দেখি--
লিপস্টিক হাসির হোম থিয়েটার বাজে।

জোয়ারের ডেড-বডি পড়ে থাকে
ভাটার পলিতে।
রাজপথ থেকে ভেঙে যায়
কতো যে অন্ধকার গলি।

রং না চেনাই,   পড়ে থাকে 
নির্বিষ সাপের রংহীন খোলশ। 

পুনর্জাত: সারিফ হোসেন





সহস্র স্মৃতির ব্যয়ভার তোমার-ই চরণে,
বসিয়া আছো তুমি হৃদয়-আসনে
আমার এই কলমে গল্প তোমার নিশীদিন 
উষ্ণতা বাড়িয়ে পুনঃআগমনে স্বাদরে গ্রহণ-- তোমায় নিকোটিন।।

বসন্ত সন্ধ্যায় সুমধুর স্বপ্ন শয়নে
একাকী হৃদয়ের কাব্য উড়ে বেড়ায় তোমারই বিচরণে।
লহ প্রণাম মোর, ধন্য করো এই তুচ্ছরে,
বাসিয়া ফেলেছি ভালো, মনেরই অগোচরে।। 

শক্তি দাও লিখি তোমার বিজয় উল্লাসের গল্পকথা,
লিখি হাজার প্রেমিকার বিরহের কথা।
মোহের মরিচীকায় ক্ষান্ত হোক ক্ষণিক মিলন,
নিকোটিনের জ্বালায় নিপাত যাক এই
            'শুষ্ক যৌবন'।।

চোখ: সুতনু হালদার






ভেজা শরীরে যখন বাড়ি ফিরলাম ঠিক তার আগে পর্যন্ত আমাকে অচেনা দুটো চোখের উত্তাপ ঘিরে ছিল, আগুন-জলের উচ্ছ্বাস অন্তঃস্থলের বিয়োজন চিনে নিতে ভুল করে না

ভুলের কথা যখন উঠলই তখন বলতে দ্বিধা নেই সমস্ত ভুলের অবয়ব জুড়ে থাকে রাশিকৃত মেঘ, ছাউনির আবডালে যুবতি কুয়াশারা ওৎ পেতে থাকলেও থাকতে পারে 

যে কোনো থাকা বা না থাকা যদি বারংবার পরিবর্তিত হয় তখন ধুলোরা ঢেউ তুলে খেলা করতে থাকে, জলে ভেজা শরীর দ্রুত লয়ে আলপথে হাঁটে...

লীনতাপে জর্জরিত চোখদুটির নিজস্ব উত্তাপ, তীব্র ঝলকানি, হৃৎপিণ্ড,যকৃত,ফুসফুসসহ সমস্ত প্রত্যঙ্গের বিপ্রতীপ কোণে বসে থাকা অনিয়তাকার বোধ অবশ করে দিতে দিতে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করে

সময়ের কাছে: জয়ীতা চ্যাটার্জী





সময়ের কাছে সময় এসে থামে, 
কখনো সে শীর্ণতোয়া নদী, 
কখনো পাহাড় ডিঙনো ঝরনার জল, 
বাতাসের কাছে সময়, সময় রাখে যদি। 

সময়ের বার্তা উড়ে গেছে পাখি হয়ে কত কাল, 
মনে রাখেনি  কোন অতীত, রাখেনি ভবিষ্য জাল
সময় সে যেন দূরন্ত এক কালবৈশাখী ঝড়, 
ডানা মেলে চলে যায় মানবীর মতো, ভেঙেচুরে স্মৃতিরঘর। 

কত অরন্য ঘুমিয়ে পড়েছে পাশ ফিরে, 
কত নগর তুমুল বৃষ্টিতে ঝুম, 
কত কথা ভাঙে পাহাড়ের কোলে, কিছু কথা 
ভেঙে ভেঙে আসে নীরবতা, রাতের আঁধারে নিঝুম। 

এমন নৈঃশব্দেও বাতাস কথা বলে, 
মরমর ধ্বনি লিখে যায় পাষানের তলে, 
কালপুরুষ মৃদু হাসে আয়নার কাছে, 
অবিনাশী  সময় হৃদয়েতে আছে, আছে সব রাখা আছে।।

পারুলের ফুলসজ্জা




                        (এক)


আজ পারুলের বিয়ে।তত্ত্ব এসেছে ওঝা বাড়ি থেকে। তত্ত্বের বহর দেখে বউ,ঝি দের চোখ ছানা বড়া।  পারুলের মা বলে-" জানি গো জানি, এমন না হইলে কি আর ওঝা দরের (ঘরের) বউয়ের গায়ে হলদি হয়। আমার পারুলটা জন্মাইছে ভাগ্য লয়ে। ব্যাগলোক(সবাই) শুধু শুধুটাই ওর লগে বর খুঁজে মরছিলা গো।"

কথাটা কিছুটা তাপসের মাকে খোঁচা দেওয়ার জন্যই বলা। জন্ম থেকে পারুলকে ঘরের বউ করার সাধ ছিল বড়। মনে মনে বলে পারুলের মা - "সম্পত্তি বলতে তো উই কয়েক বিঘা জমিন মাত্তর। এখনও বাপ দাদার তৈরি কাঁচা মাটির দরেই(ঘরেই) রয়। তাতে আবার তাপসের তিন বোন।ঝেঁটা মারি অমন সম্বন্ধের মুখে। নেহাত পারুলের নীচে আরও দুটো ঝি আছে বলে না রাজি হইছিলি। কিন্তু পাকা কথা হয়নাই। আর ওমনি এল বিপিন ওঝার সম্বন্ধটা। পারুলটা তো আর দেখতে মন্দ নয়। মোটের ওপর ভালই। গায়ের রঙ সাফা , নাক উঁচা , শরীর স্বাস্থ্যও মন্দ না  ।  নীচের দুই বোন তো কালি পেঁচি। মা মুখী।পারুলটা কি করে যে সুন্দরী হইল।বাপ তো কাকের মত কালো, ইয়া দামড়া চেহারা। "

সবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কলেজে পা রেখেছিল পারুল।তার মা বাবার ইচ্ছা ছিল তাকে কলেজটা পাশ করায়। 
ভাগ্যিস কলেজ পড়ানোর কথা মনে এসেছিল! নইলে আজ সে তাপসের মায়ের ঝিগিরি করত। অমন রাজরানি হওয়ার ভাগ্য নিয়ে আসা মেয়ে!-  ভাবলেই শিউরে ওঠে পারুলের মা। এখন তো শুধু বড় মেয়ের বিয়েই নয় ছোট দুটার বিয়ের খরচ খরচাও তুলে দেবে ওঝারাই। ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে তার ।   


তত্ত্ব নিয়ে আসা ছেলে ছোকরাদের উঠোনে চেয়ার পেতে বসানো হয়েছে। তাপসও এসেছে তাদের সঙ্গে। পারুলের না চাইতেও একবার চোখাচোখি হল। চোখ নামিয়ে নিয়েছে পারুল। পারুলের বাঁ চোখ ট্যারা, ওই লক্ষ্মী ট্যারা না গজ ট্যারা কি যেন বলে। গায়ের লোকে বলে পারুল যার ঘরে যাবে সোনা ফলবে।

বিপিনের কুষ্টিতে নাকি ফাঁড়া আছে, জলে ডুবে মরার ফাঁড়া। গনৎকার বলেছে লক্ষ্মী ট্যারা মেয়েকে বিয়ে করলে ফাঁড়া কেটে যাবে। বিপিনের ঠাকুমা যেচে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পারুলের সেদিন ইচ্ছে করেছিল বাম চোখটা মনসা কাঁটা দিয়ে গেলে দিতে।  
তখন সবে ফুটেছিল বুকে দুটো কুঁড়ি, বয়স ওই বারো হবে, বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে তাপস সজোরে হাত দিল সেই কুঁড়িতে।টনটনে ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছিল পারুল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল নোনা ধারা। তাপস ঠোঁট ছুইয়ে চুষে নিয়েছিল সেই জল। বলেছিল -" তুই তো মোরই বটে, তু যেদিন ডাগর হবু, সেদিন বুকে জাড়ায়ে সোহাগ করব। সেদিন দেখবি আর বথা হবে নি কো।"
 
পারুলকে রোজ কিমি তিনেক সাইকেল চালিয়ে স্টেশন গিয়ে ট্রেন ধরে কলেজে যেতে হয়।  এই তো সেদিনও পারুল স্টেশন যাওয়ার পথে সরাই দীঘির পাশে চিনুদের আখ খেতে শুয়ে থেকেছে তাপসের বুকে মাথা রেখে। তাপস বলে-" লিইখ্যা পইড়্যা তু মাস্টারনি হবু আর আমি জমিনে লাঙ্গল দিব, তু ছেলে পিলে মানুষ করবু আর আমি ধান ভাঙব। ই সব ভারী ভারী কাজ তোকে করতে দিব নারে পারুল।তু আমার লেখাপড়া জানা বউ বটে।"

আর যেই না বিপিনের সম্বন্ধ এল অমনি সেই ছেলে বলে কিনা -"রাঘব বোয়ালের সাথে লড়তে পারবনি রে পারুল, মোরা চুনোপুঁটি বটে। "

বাড়ি ফিরে পারুল সানন্দে হ্যাঁ বলেছে এই বিয়েতে।অবশ্য না বললেও বিয়ে হতই।পারুল ভাবে -সেই যখন শিকার হব তখন রাঘব বোয়ালেরি হই। শিকারো খুশি, শিকারিও। 
তাপস যে এত নির্লজ্জ হবে, বিপিন ওঝার গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে হাজির হবে পারুলের বাড়ি, এতটাও ভাবেনি পারুল। এতদিন ভীতু বলে যাকে ঠাহর হচ্ছিল আজ তাকে সরীসৃপ জ্ঞানে ঘৃনা হতে লাগল পারুলের।   

পুকুর পাড়ে সিল পেতে বসানো হয়েছে পারুলকে। লাল পাড়ের হলুদ জামদানী গায়ে, গলায় গাঁদার মালা, হাতে পায়ে ফুলের অলঙ্কার। সমস্ত দৃশ্য ভিডিও হচ্ছে। বিপিন লোক পাঠিয়েছে ভিডিও করার জন্য। 
এঁদো পুকুরে শেষ বারের জন্য ডুবে নেয় পারুল।পুকুরের জলে পাঁকের গন্ধটা তাকে আশৈশব ফেলে আসা দৌরাত্ম্যের কথা স্মরন করিয়ে দেয়। সেই পাঁকে হাত ডুবিয়ে প্যাঁকাল মাছ ধরা, দোলের দিনে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি , সেই গ্রীষ্মের দুপুরে কলার ভেলা ভাসিয়ে সতী বেহুলা সাজা, আরও আরও কতকি যে স্মৃতি জড়িয়ে! বিপিনের ঘরে আছে নাকি স্নান ঘর! সাদা পাথর বসানো স্নানঘরের দেওয়াল জুড়ে নীল ডলফিন মুখ তুলে চায়! ঘরের মাথায় নাকি ফোয়ারা লাগানো, কল মুড়লেই ঝিরঝির করে ঝরনার মত জল ঝরে! কাঙাল বুড়ি এসে এসব খবর দিয়ে গেছে তাদের ঘরে।পারুল একদিন বৈচি কুলের গাছেটার নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় ধরেছিল বুড়িকে।
-"ও কাঙাল দিদা...,   তোমার বিপনার সেনানঘরে আকাশ আছে? নীল নয়তো ঘন কালো মেঘে ছাওয়া আকাশ!"
কাঙাল বুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল-' আ মরন, মাগীর পেটে ঘি ভাত সইছে নি লা। '

একে একে শুভ দৃষ্টি, মালাবদল, সাতপাকে ঘোরা, সিঁদুর দান সম্পন্ন হল। শুভদৃষ্টির সময় পারুলের একবার যা চোখ গেল বিপিনের দিকে। বেঁটে- খাটো, মোটা মানুষ বিপিন।বয়স ওই পঁয়ত্রিশের আসে পাশে। মেদ বহুল মুখে বসন্তের দাগ।চোখ জোড়া রাঙা। দেখে বুকটা ছেৎ করে ওঠে পারুলের। চোখ নামিয়ে নেয় সে। মালুয়ার ভূষিমাল দোকানের পিছনে একবার বিপিনকে সে দেখেছিল হরির বউয়ের সাথে জড়াজড়ি করতে । সেই থেকে বিপিনকে তার বন্য শুয়োরের মত লাগে। আজ সেই শুয়োরের গলায় মালা দিল সে। ভাবতেই হাসি পেল। নিজেকে উপহাস্য করতে ইচ্ছে হল তার।        
  

ভোরের আলো ফোটার আগে, পাখিরা সব বাসা ছেড়ে যাওয়ার আগেই পারুলের বিদায় হল।পারুল কাঁদেনি একফোঁটা।মা বাপ বেচে দিয়েছে তাকে ভাল দরে। ওঝা বাড়ির বউ সে এখন। একফালি নিকানো মাটির উঠোনের দক্ষিন প্রান্তের গন্ধরাজ লেবুর গাছটা আড় চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। যাওয়ার আগে পারুল দুটো পাতা ছিঁড়ে নেয়।বড্ড গা গুলোচ্ছে। নিজের দ্বিগুন বয়সী লোকের শয্যা সঙ্গী হতে হবে তাকে!  বিপিনের একপাল চামচা এসেছে, তাপসটাও। তাপস ছুঁলে শরীর জুড়ে হাজার ভোল্টেজের কারেন্ট বয়ে যেত! 

গায়ের লোক ভিড় করে এসেছে নতুন বউ দেখার জন্য। এতদিন যাকে হারার বেটি বলে তাচ্ছিল্য ভরে দেখেছে সকলে, আজ বিপিনের বউ হওয়াতে তাদের চোখে সম্ভ্রম নাকি চাপা ইর্ষা বোঝা দায়। বিপিনের ভিটে বাড়িতে প্রবেশ করতেই পারুলের বুকটা ভয়ে হিম হয়ে যেতে লাগল। বিশাল এক প্রাচীরে ঘেরা বিপিনের কেল্লা। মনে হয় যেন গ্রাম থেকে অনেক অনেক যোজন দূরে এসে গেছে সে। বড় বড় আম কাঠাল, লিচু, নারকেল গাছে ঘেরা এক অট্টালিকা। বাইরের আলো, বাতাসের এখানে প্রবেশ নিষেধ। 
 ঘরের সামনে অযত্নে বেড়ে ওঠা  ঘাসের গালিচা । বিভিন্ন ফুলের গাছ, পাতাবাহার একসময় যত্ন করে লাগানো হয়েছিল মনে হয়। এখনো সেই যত্নটুকু বুকে নিয়ে অযত্নে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা  এখানে ওখানে। বাড়ির পিছনে এক 
পাড় বাঁধানো দীঘি, সবুজ তার জল । সেখানে সারি সারি সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে।  মাটির বিশাল উঠোন পেরোলে বাঁ দিক ঘেঁসে পাকার মূল ঘর। ঘরে সদস্য বলতে বিপিন আর তার ঠাকুমা। বুড়ির বামচোখ ছানি পড়ে কেমন ধূসর দেখায়। পৃথুলা চেহারা, মাংসল গাল দুটো বেগুনীর মত ফুলে থেকে ঝুলে পড়েছে, তাতে বসন্তের দাগ।পারুলের মনে হয় বিপিনটারও বুড়ো হলে এমন রুপ হবে।
 গাঁয়ের লোকে বলে বিপিনের মাকে নাকি এই বুড়ি আর তার ছেলে মিলেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বিপিন তখন হামা দিচ্ছে সবে। বিপিনের এক দিদি আছে, শহরে বিয়ে হয়েছে তার। বর উকিল। বিপিনের বাপ কর্কট রোগে মরেছে দুবছর আগে। বুড়ির  আদরে বিপিন এমন বখাটে। শিক্ষা বলতে নামসইটুকু। একাধিক ব্যবসা রয়েছে তাদের। বরফ ফ্যাকট্রি, মাছের ফিড ব্যবসা, চাল মিল। একার হাতে এসব চালানো অসম্ভব। তাই বাপ দাদার আমল থেকেই এই ঘরে গাঁয়ের ছেলে ছোকরার আসা যাওয়া।  বিপিনের চ্যালা সব।তাপস তো বিপিনের ডানহাত। বিপিনের কথায় ও হয়ত মানুষ খুন করতেও পারে।  যদি প্রথমেই জানত পারুল বিপিনের সম্পত্তি, তবে কি আর তার সাথে পিরিত করত! 

এক গামলা দুধে বর কনে হাত ডুবিয়ে খুঁজছে আংটি। স্ত্রী লোকাচার যত। পারুলের বেশ মজা লাগছে এই খেলায়। মেতে উঠেছে সে। বারবার বিপিনকে হারিয়ে আংটিখানা খুঁজে নিচ্ছে । গ্রামের বউরা সব খিলখিলিয়ে হাসছে বিপিনকে হারতে দেখে। 
কাঙাল বুড়ি তো বলেই ফেলল-" বাছা আর পারবুনি লো টিকতে। হারার বেটিই তোরে হারায়ে ছাড়ব। মুখপুড়ি যে কলেজে যাওয়া মেয়ে মানুষ লো। নেখা পড়া জানা মেয়ে মানুষ।ওই তোরে বশ করব দেখ।"

বিপিনের ঠাকুমা বলে-" আ মরন....., মেয়্যা মানুষ কলেজ যাক কি সগগে যাক, মরদের নীচেই মেয়্যার থান। আমার বিপিন কে কেউ জব্দ করতি পারব নি গো কাঙালের বউ।" 

পরপর দুবার পারুলের কাছে হারার পর বিপিনের জেদ চেপে গেল মনে। হাভাতে ঘর থেকে আনা বউকে আজ থেকে দাবিয়ে না রাখলে মাথায় উঠে নাচবে। আর বিপিন বউকে মাথায় তোলার মত ছেলে নয়। এবারো পারুলই পেল আংটি খানা হাতে। খুশির ঝিলিক খেলে গেল মুখে। কিন্তু তারপরেই দুধে দুবে থাকা হাতখানা সজোরে চেপে ধরল বিপিন।ছিনিয়ে নিল আংটি তার হাত থেকে। একনজর বিপিনের দিকে চাইল পারুল। চোখে তার ক্রুর দৃষ্টি।  সগর্বে আংটিখানা তুলে ছুড়ে দিল মেঝেতে বিপিন। তারপর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল সদরে। কেউ জানল না পারুলের পরাজয়ের রহস্য। 

বিয়ের পরের দিনই দিন- দুপুরে সাধারণত গ্রামে গঞ্জে বৌ ভাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলা হয়।নতুন বউ বিয়ের বাসি শাড়ি পরে, গুড়ো গুড়ো ঝরে যাওয়া চন্দন  আর থ্যাবড়ানো কপালের সিঁদুর নিয়েই গুটিসুটি মেরে  বসে বসে ঢুলতে থাকে। লোকজন এসে থালা, বাসন, গ্লাস, কেউ বা একশটা টাকা বউ এর হাতে গুঁজে দেয়। তবে বিপিনের ব্যাপার আলাদা। বৌভাত তাদের আজ রাতেই। 

বিপিনের ঠাকুমা নিদান দেয়-"ও  বৌ যা, কাপড় ছাইড়া, নাইয়া- ধুইয়া পায়েস চড়া দিকি উনুনে। মোদের বংশের রেয়াজ এটা বটে। নতুন বউ নিজের হাতে পায়েস রাইন্ধে আত্মীয়, কুটুম, গায়ের ব্যাগ লোক খাওয়াব।" পারুল মাথা ঝুকিয়ে ঢুকে যায় ঘরের ভেতরে।    

রাতে বৌভাতের আসরে সোনায় মোড়া পারুল বসে থাকে পুতুলের মত। লোক জন আসে -যায় কাতারে কাতারে। বৌভাতের পায়েসে দূধ চিনির হিসাব মেলেনি। শুনতে হয়েছে-" হাভাতে দোরের বিটি,   রাইন্ধতে শিখে নাই।"  খিদেয় পেট গুলিয়ে উঠছে পারুলের। বেগুনি ভাজার গন্ধ আসছে। মাঝে মাঝে মাংস কষার গন্ধ নাকে ঝাপটা মারছে। পেটটা বারবার গুলিয়ে উঠেছে। কেউ খেতে ডাকেনি। বাড়ির মেয়েরা পারুলের আগামী সৌভাগ্য নিয়ে চর্চায় ব্যস্ত। বিপিনের ঠাকুমার মুখ ভার। নতুন বউয়ের হাতের পায়েস বিস্বাদ, অমঙ্গলের লক্ষন সব। বিপিন সকাল থেকে বেপাত্তা। অনুষ্ঠানের সমস্ত দায়িত্ব তাপস আর দু এক জন বিপিনের সাগরেদের হাতে। সন্ধেবেলা কোথা থেকে আগমন হল বিপিনের। পরনে তার মেরুন রঙের জমকালো শেরওয়ানী৷ ঝুলটা একটু বেশীই লম্বা। অদ্ভুত কদাকার লাগছে বিপিনকে। পাশেই রানী কালারের জমির ওপর রুপোলী বুটির বেনারসি পরে সোনায় মোড়া জড়োসড়ো পারুল যেন ঢাকা পড়েছে বিপিনের কাছে।  

অনেক রাতে খাওয়ারের প্লেটের সামনে বসল পারুল আর বিপিন। সামনেই ক্যামেরাম্যান। বর কনের খাওয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী হচ্ছে। পারুলের এখন হুশ নেই। অষ্টাদশীর খিদে বড়ই বেশি। খিদের জ্বালায় গিলে ফেলছে সে যা পাচ্ছে পাতে। বিপিনের চোখ রাগে রাঙা হল। টেনে নেয় সে প্লেট পারুলের সামনে থেকে। তারপর বিপিন  কখন খাসির এক মস্ত টুকরো , কখনো রাজভোগ পারুলের মুখের সামনে ধরে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।    



৩                                         
কালরাত্রি তাই একা দোতলার নৈঋত কোনের ঘরে পারুল শুয়ে পড়ে পালঙ্কের কোন ঘেঁষে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাড়ির পিছনে সারি সারি সুপারি গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে। হালকা বাতাসে দুলতে থাকে, আলো আঁধারে বড় ভয়ংকর লাগে সে দৃশ্য।  যেন কোন একপেয়ে দানব হাতছানি দেয় দুলে দুলে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে পারুল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, রাত্রি তখন দুই প্রহর, দরজা খুলতেই টলতে টলতে বিপিন ঢুকে পড়ে ঘরে, জাপটে ধরে পারুলকে, মুখে তার দেশী চুল্লুর গন্ধ। ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করে পারুল। আত্মীয় স্বজন জড়ো হয় দরজার সামনে। মৃদু ভৎসনা আর অশ্লীল পরিহাসে বিপিনকে টেনে বার করে তারাই  ঘর থেকে।              
           

 পারুলের উদ্দেশ্য বলে- "ন্যাকা ষষ্ঠী, ভাতার পিরিত করতে আইলে আবার চিল্লে পাড়া জাগাইনো,  এতই যদি ভয় পেরানে তো বিয়া  কেনে কর বাপু।" 

পারুল শ্বাস নেয় জোরে। আজকের মত রেহাই পেল সে। কালরাত্রি,  এই রাত্রির যেন শেষ না হয়। সোহাগ রাত্রি সে চায়না আর। হায় কি ভুল করল সে!  তাপসের ওপর অভিমান নাকি প্রতিশোধ নিতে চাওয়া!  কেন সে পালিয়ে গেল না বাড়ি ছেড়ে! 

কালকের রাত ফুলসজ্জার রাত। তার শরীর ও মনের সবটুকু সুগন্ধ নিচড়ে নেবে বিপিন। অজগরের মত গিলে নেবে তার পুরো সত্ত্বা। সেই অজগরের বেষ্টনী যে কতখানি দমবন্ধকর, তা সে আজ ভালোই অনুভব করেছে! 
আচ্ছা, এ ভুলের কি কোন ক্ষমা নেই! সে কি ফিরে যেতে পারে না তার বাপের কুঁড়ে ঘরে! খেটে খাবে, তবু একটু খোলা আকাশ, নিজের শরীর আর মনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ, এটুকু কি খুব বেশি কিছু চাওয়া! পশুও তো বেঁচে থাকার এটুকু অধিকার পায়! 
 
হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল সে একলা ঘরে। একবার ভাবল খিড়কি খুলে ঝাপিয়ে পড়ে ঝুল বারান্দা থেকে বাঁধানো দীঘির পাড়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। হালকা বাতাসে সুপারি গাছগুলো নাগাড়ে দুলে চলেছে। লম্বা কান্ড পেরিয়ে ডগার কাছে তার ঝাকড়া পাতা আর সুপারির কাঁদি।তার উপরে ভরন্ত যৌবনা চাঁদ। আবছা ছায়া পড়েছে দীঘিরজলে। দুলছে ছায়া মৃদু মৃদু। পূর্ণ যৌবনা চাঁদের ছায়া জলে পড়ে তিরতির করে কাঁপছে। যেন বলছে তারা-" শেষ নয়, শেষ নয়। রুপ,রস গন্ধ যে আরও নেওয়া বাকি। থেমে যা কয়েক দন্ড। মরার জন্য হোস নে উতলা। শ্বাস নেওয়া যে বাকি তোর আরও কয়েক দন্ড। "
এঘরে আসার পর প্রথমবার সারি সারি  সুপারি  গাছগুলোকে তার বড় ভাল লেগে গেল। নিজের মনে হল। পারুল বলল-" বেশ তো যেদিন অমাবস্যা গিলে খাবেক চাঁদকে , সেদিন দেখবু  ঠিক মুই ঝাঁপ দেব ইখান থেকে। সিদিন দেখব তোরা কিরম মানা করু। " 
ধীরে ধীরে চারিধারের কালিমা নরম হচ্ছে। পূব আকাশে নিশ্চয়ই রাঙা রবি উঁকি দিয়েছে। পারুল তাকে দেখতে পাচ্ছে না। মনটা আবার ভারী হয়ে উঠল। আজ তার ফুলসজ্জা। আজ নাকি বড় আনন্দের দিন। হায় ঈশ্বর, মন্ত্রবলে বিপিনকে অন্তত আজকের জন্য তাপস বানিয়ে দাও।  
ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজনরা বিদায় নিচ্ছে। পারুলের ননদ স্বামী-ছেলে নিয়ে বিকাল বিকাল বেরিয়ে গেল। এরই মাঝে পারুলদের বাড়ির লালি গাই চরতে চরতে এপথ দিয়ে হেঁটে গেছে। ঘোমটায় ঢাকা পারুলকে দেখে দুদন্ড সে দাঁড়িয়েছিল মুখ তুলে।বিপিনদের বাড়ির মূল ফটক থেকে দেখা যাচ্ছিল লালিকে মোরাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে।  এ বাড়ির নারকেল গাছে বাসা বাঁধা লেজ চেরা ফিঙেটা ভারী পাজি। উড়ে গিয়ে বসল লালীর কুঁজে। গায়ে বারবার ঠক্কর দিয়ে বিরক্ত করতে লাগল তাকে। 

বিপিনের ঠাকুমা ভিতর থেকে ডাক ছাড়ল, -" ও বৌ, বলি ও হাভাতে ঘরের মায়্যা,  কি আক্কেলে ভর দুপুরে খাঁড়ায়ে আছ সদরে শুনি। নতুন বউয়ের যদি একটু লাজশরম রইত গো। "
পারুল ধীরে ধীরে ঢুকে গেল ভিতরে। লালি কিছুক্ষণ ফিঙের দৌরাত্ম্য সয়ে সয়ে তাকিয়ে রইল ঘাড় উঁচু করে সে দিকে। তারপর লেজের ঝাপটায় ফিঙেকে তাড়িয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেল বাড়ির পথে। 
বিপিনের সাঙ্গপাঙ্গরা  এসে ফুলসজ্জার বিছানা সাজিয়ে দিয়ে গেছে। সুগন্ধি রজনীগন্ধা আর গোলাপে মোড়া বিছানা। যাওয়ার সময় নমস্কার করল তারা পারুলকে । তাপস তখনও গোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে সাদা চাদরের ওপর পানপাতার মত চিহ্ণ আঁকতে ব্যস্ত। বিপিন অদূরে দাঁড়িয়ে গুটখার কষ লাগা দাঁত বার করে হেসে চলেছে কয়েকজন সাগরেদের সঙ্গে। তাপস এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল পারুলকে। পারুলের গায়ে কাটা দিল। একি নিজের পাপ লুকাতে বিপিনের চোখে সাধু সাজা! নাকি এই স্পর্শ নিতান্তই পরিহাস ছলে! গা জ্বালা করতে লাগল পারুলের। আজ নষ্ট হবে পারুল, রিক্ত হবে পারুল, ধর্ষিত হবে পারুল। বারে প্রেমিক পুরুষ!! নিজ হাতে রচনা করলে প্রেমিকার ধর্ষণ সজ্জা ফুলের মাধুরি দিয়ে!

সন্ধ্যা থেকে এই বিশাল বাড়ি যেন গিলতে আসছে পারুলকে। বিপিনের ঠাকুমা বাতের ব্যথায় কাতর। পড়ে রয়েছে বিছানায় পুটলির মত। বিপিন বিকাল বেলায় বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেছে মোরামের ধুলো  উড়িয়ে। ফিরবে হয়ত কালকের মত দুই প্রহরে চুল্লু গিলে। পিনুর মা রেঁধে বেড়ে গেছে। পারুল সন্ধে থেকে বসে রয়েছে তার জন্য বরাদ্দ বাড়ির নৈঋত কোনের ঘরটার পিছনে জানালার রেলিং ধরে। সামনে পাতা ফুলসজ্জা। বাইরের আলো আঁধারিতে সুপারি গাছগুলো আজও দুলছে, তবে গতকালের চেয়ে ধীরে। চাঁদ সামান্য যৌবন হারিয়েছে হয়ত। বোঝা যায় না। তবে এখন সুপারি গাছের মাথায় চড়েনি। বাতাস আজ একটু কম। আকাশ পরিস্কার। তবু মাঝে মাঝে দল ছাড়া সাদা মেঘ গিলে ফেলে পশ্চিম আকাশের সন্ধাতারাকে।  

চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে পারুলের। কত রাত ঘুমায়নি সে। দরজায় মৃদু টোকা, ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে সে। একি তাপস দাঁড়িয়ে যে! তাপস এগিয়ে এসে তাকে বুকে টেনে নেয় । দরজায় খিল পড়ে। গোলাপের পাঁপড়িতে ডুবতে থাকে পারুল। বিছানা থেকে রজনীগন্ধা তুলে নিয়ে মালা গাঁথে তাপস। মালা গাঁথা হলে পরিয়ে দেয় সে হার পারুলের গলায়। কি মিষ্টি গন্ধ। সুগন্ধে শরীর জুড়িয়ে যায় পারুলের। তাপসের বুকে মুখ ঘসে সে। তাপসের ঠোঁট দুটো ডুব দেয় পারুলের ঠোঁটে। গন্ধরাজ লেবু পাতার গন্ধ তাপসের মুখে। তাপসের বুকে নরম গোলাপের পাঁপড়ি। 
একটা ভটভট যান্ত্রিক শব্দ কানে বাজে, কাছে আসছে শব্দটা, সরে সরে যাচ্ছে তাপস। দুহাত সামনে প্রসারিত করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে পারুল।-" নিয়ে চ তাপস......., নিয়ে চ মোকে  দূরে........ অনেক দূরে। মুই যে আজন্ম রইছি তোর পথ চাঁহি ! "
বাইকের আওয়াজে ঘোর কাটে পারুলের।স্বপ্ন হারিয়ে যায়।  চেয়ে দেখে সে মোরাম পথ দিয়ে ছুটে আসছে বিপিনের বাইক। পিছনে বসে রয়েছে বিপিন।বাইক চালাচ্ছে তাপস। বাইকটা দ্রুত ঘরের সীমায় পৌঁছায়। জানালা থেকে উঠে এসে বারান্দায় উঁকি মারে পারুল। বিপিন টলতে টলতে চলেছে তাপসের কাঁধে ভর দিয়ে। বিকৃত গলায় চিৎকার করে গাইছে সে-" ফুলসজ্জা,,  আজ ফুলসজ্জা। "
তারপরেই তাপসকে টেনে নিয়ে যায় সে দিঘী পাড়ে। চুল্লুর বোতলে চুমুক লাগায়। চলতে থাকে মাতলামি। পারুল জানালায় বসে দেখতে থাকে সে দৃশ্য। পূর্ণ যৌবনা চাঁদ এখন সুপারি গাছের মাথায়। দীঘির জলে পড়েছে তার প্রতিবিম্ব। আজ প্রতিবিম্ব স্থির। বিপিনের কুকুর টা এসে ভুকতে থাকে। বিপিন লাথি মারে তার পিছনে। বলে-" শালা শান্তি নাই যেন,  ঘরের বউ এর মত ভুকে চলেছে পিছু পিছু। " তাপস দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাকে। তারপর গাড়ির হাতলে ঝুলে থাকা পলিথিনের ব্যাগ থেকে বার করে আর একটা বোতল। ঢকঢক করে গলায় ঢালে বিপিন।
-" ইচ্ছামত  গিলব বে আজ, মোর ফুলসজ্জা বলে কথা।কোন চাঁদু মোকে থামায় দেখি। বারো ভাতারি কলেজ যাইত নাঙের লগে , নাঙ খোঁজা বারকি দিব আজ শালীর। " 
বেসামাল বিপিন উঠে দাঁড়ায় টলতে টলতে। দীঘির পাড়ে দাঁঁড়িয়ে প্যান্টের জিপ খুলে হালকা হতে থাকে সে দীঘির সবুজ  জলে। হঠাৎ পিছন থেকে সজোরে এক লাথি , ছিটকে পড়ে বিপিন মাঝ দীঘিতে ।জলে হাবুডুবু খেতে থাকে সে। প্রবল আলোড়নে দীঘির জল উথাল পাথাল হতে থাকে। দুহাত তুলে বাঁচার আকুতি জানায়। তাপস নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ে। আর একজন উপরে জানলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সে ঘটনার সাক্ষী হয়। 
একসময় ঝুপ করে ডুবে যায় বিপিনের হাত আর মাথাটুকু জলে শেষ আলোড়ন তুলে ।  জলের সেই আলোড়নে পূর্ণ যৌবনা চাঁদের প্রতিবিম্ব কেঁপে কেঁপে সুপারি গাছের মাঝে বিলিন হয়। তাপস পকেট থেকে রুমাল বার করে চুল্লুর বোতল আর গাড়ির হ্যান্ডেল, ক্লাচ,  ব্রেকের কাছটা বেশ কয়েকবার মুছে নেয়।  একবার মুখ তুলে জানালার দিকে দেখে একবার। চকচক করে ওঠে পারুলের কালো কুচকুচে দুটো মনি। তাপসের মুখে ছলকে ওঠে বাঁকা হাসি।  জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে পার হয় সে দিঘী। তারপর পশ্চিম পাড়ের ঝোপঝাড় দ্রুত পায়ে দলে পাঁচিল টপকে মোরামের পথ ধরে সে।             
          

দীপান্বিতা সরকার এর গুচ্ছ কবিতা









বারাঙ্গনার ভাতৃসম কৃষ্ণ




আমি রোদ ছেটাতে চাই,
সমাজবিমুখ নিষিদ্ধপল্লির ওই ঘৃণ্য কালো ঝুপড়িতে,
তাজা ভ্রুণ রোপিতে চাই,
হাজারো রক্ত,অশ্রু ঝরা মাটিতে।
চিবুকে,ওষ্ঠে লালচে স্নেহ চাই,
হাসি চাই,গান চাই,শিল্প চাই,
মাথা নত করে চুলের খাঁজে,
যেন পরম আদরের ছোঁয়া পাই।
একঘর আলো চাই,
মেঘভাঙা উল্লাসের বৃষ্টি চাই,
সতেজ সমীরণে যেন বিঘ্ন নয়,
এক টুকরো হিমেল বিকেল চাই,
চায় দিতে সমাজকোষে কলঙ্কহীন ঠাঁই।
আমি মুঠোবন্দি জীবৎশক্তির দাপট আনতে চাই,
বারাঙ্গনার অন্তর্বাস হতে নোলকে,
বুকবন্দি নৃশংস আর্তনাদ শিরে স্থাপন করতে চাই,
দেবদূত রূপে শ্রীকৃষ্ণের ওই পালকে...






"স্নান"



স্নান পদ্মাসন, স্নান মাঙ্গলিক,
সারা'গায় লেগে তাজা চঞ্চল বুদবুদ 
হয়ে ওঠা লজ্জাবস্ত্রের বাঘছাল সঠিক।
ঘাড়ের তেলচিটে ময়লাতে-
থাবা বসায় পুরানো সিন্থল সাবান ভোররাতে,
কাঁধজোড়া মেরুদণ্ডের আল বেয়ে
ধুয়ে যায় কাম, ক্রোম, চিৎকার শ্লেষ,
শ্যাম্পুচুল জটা শুকিয়ে নেয় রোদ কমণ্ডলু দ্বেষ।
মাধবীলতার সুবাস ঢাকনায় শরীর ঝলমলিয়ে ওঠে ঝড়ে,
হাওয়া কেন জানি না গায়েব হয়ে যায়
ময়ূরকণ্ঠী রাষ্ট্রের থরে।
প্রস্তুতি তারপর ময়লা মাখার নোনাপদ্ম তটে,
হাঁটু, তলপেট, মস্তিষ্ক, ফুসফুসে তমসা-তামাসা বাজিয়ে ওঠে।
দেউলিয়া এ'জাতি স্নান করে কি রোজ!
স্নান পদ্মাসন, স্নান মাঙ্গলিক
বজ্জাতি ধোওয়া অতই সহজ!






"দায়"




এমন আজ বৈশাখের কনফারেন্সে, 
থান উড়ে যায় মৃতদেহ থেকে,
মেঘ বিরহ, প্রেম, সংকট, ব্যাথার শঙ্খচিল।
মানুষের কাঁচা বাড়িতে আজ ঢুঁ মারে অশ্রু মেরি-গো-রাউণ্ড ছলের অবিচারে,
এই শোঁ শোঁ শব্দের ঝড় বধির হয়ে যায়,
প্রতিটা আঘাত তোমরা ফিরে পাচ্ছো নেই সংশয়।
বাজ দেখেও সেদিন লেপটে ছিল যেহেতু নিষ্ঠুরতা,
একে একে সব অক্সিজেন ভাণ্ডারে ভেঙে গ্যাছে সৃষ্টির নিয়মানুবর্তিতা।
তাইতো শিশির আসছে ধেয়ে আশঙ্কার,
প্রস্তুত হয়ে নাও আকণ্ঠ ডুবে যাবে এ ভূ-সংসার।।





"শিমুল-বুনোগাঁদা"




পলাশ ঝরা বিকেল, কুসুম রঙা শাড়ি,
খোঁপায় সাজানো জুঁই, ধীর পায়ের চলনে ধ্বসে পড়া মনবাড়ি।
গেরুয়া দিন, বাউলের তান,
উড়ন্ত সমবেত খুশি আর বসন্ত স্লোগান;
ধুলো মাখা বাদামী অভিমুখ,মাড়ে বোঝাই কবিতার শাল,
শাবক কোকিল,নতুন প্রকাশ,
প্রেমিকের দিবসে দখিনা দোলার পাল...
অদূরের একবুক লাল-সবুজের অকৃত্রিম হাসি,
মহুয়ার ডালে ডালে,শিমুল-বুনোগাঁদা তোমায় ভালোবাসি...

আতপ-প্রেম :দেবাশ্রিতা চৌধুরী







থার্মোমিটারের ফারেনহাইটের মাত্রা
 সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে প্রেম।
উত্তর মেরুপ্রান্তে হাতে হাত রেখে
উষ্ণ চুম্বনেও শীতলতার হিম চাদর।

মরুপ্রান্তরে তীব্র উষ্ণতায় মরুদ্যানের
খোঁজে অসীম হাহাকার, জলীয়
ফলের আকুল আহ্বান খরখরে
জিহ্বাগ্ৰে কাতর পিপাসা 
আমাদের কর্কটক্রান্তি রেখার এপারে
শরীরে শরীরে উষ্ণতা অন্বেষণ।

একটুকরো উষ্ণতার জন্য উন্মুখ
তুমি আমি আর আমাদের মতো 
লিভিং অর্গানিজম।হে শীতলতা
তুমি থাকো ডাল লেকের বরফপিন্ডে,
উষ্ণতা আমাদের শরীরে মননে উজাড়
করে ঢেলে যায় ভালোবাসা আর ভালো লাগা...


।। অসহনীয় ।।রিঙ্কু মণ্ডল





ধরার সর্ব বেদনা সহিবারে পারি
অম্বর সম কুলিশ পরিলে পরুক।
তীব্র ঝড়ের তান্ডবে ভাঙে যদি বাড়ি
বৃষ্টির প্লাবন তবে মস্তকে ধরুক।
সুনামি আসিলে পাশে চিন্তা নাই তবু
চঞ্চল চিত্ত সেথায় রহিবে নিশ্চল।
মরুভূমির উত্তাপ আসিলেও কভু
চিন্তা ছাড়া স্বীয় প্রাণে রহিব সবল।

রহিয়াছে কিছু কিছু যন্ত্রণার দল
যেগুলো করিয়া থাকে মর্মাহত মোরে।
নিশিকালে অশ্রুধারা, তুল্য বহে নল
মূর্ছা হেতু বন্ধ চক্ষে নিদ্রা আসে জ্বরে।
গার্হস্থ্যের অভিপ্রায় যেই হেতু রহে
সেই হতে দুঃখ পেলে প্রাণে নাহি সহে।



আঘাত এবং মনুষ্যত্ব : সজীব বড়ুয়া বাপ্পী






আকাশের কালো মেঘ —
দূর থেকে দেখা হয় , 
কিন্তু কেন তাহা !
কেহই বুঝার চেস্টা করি না ।


ঠিক মন ভেঙ্গে পড়ে —
যখন কেউ আঘাত করে যায় । 
মানসিক চাপ প্রখর , 
রৌদ্রের চেয়ে প্রখর । 


এই বুঝি উঠে দাঁড়াবো , 
পারা হয় না । 
হেরে যায় বারে বারে , 
তবু এগিয়ে যাওয়ার জয়গান গায় । 


আমিত্ব নই —
জাগ্রত হউক মনুষ্যত্ব ।

ধর্ম : সন্দীপ দাস





কবরের নীচে ঘুমিয়ে আছে যারা , তারাও কি জানতো কোনদিন --- কবর তাদের পরিচয় লিখে দেবে একদিন ।
আগুনে শুয়ে পুড়েছিল যারা তারাও কি জানতো কোনদিন --- এই চিতা তাদের পরিচয় চিনিয়ে দেবে একদিন । অপারেশন টেবিলে যে কান্না ভাসিয়ে দিয়েছিল হাসপাতাল এর ফোর্থ ফ্লোর , সে টেবিল কি জানতো সেদিন , এ শিশুটি কার -----

ভগবান না আল্লাহর ?

তারপর আজানের শব্দ মিশে ভেসে এসেছিল রামায়ণের পাঠ তারই নতুন কানে । শিশুটি কেঁদে উঠেছিল না বুঝেই ---
শুধু পৃথিবী বুঝেছিল সেদিন , শৈশব তার কেঁদে ওঠে বারবার

ভগবান না আল্লাহর নামে ।

শিশুটি বড় হল । পদবি জুড়ে দিল পরিবার তার ওই ছোট্ট পিঠে । পরিচয় পেল সে ধর্মের খাতায় প্রথম বার ।

পৃথিবী চিনলো তাকে জীবনের এ দীর্ঘ পথ জুড়ে
মানুষ জানলো পরিচয় মানুষের

হিন্দু না মুসলমান ।

সেও রক্ত দিয়েছিল । সেও বহুবার মানুষকে ভালোবেসে
দাঁড়িয়েছিল এসে মানুষের পাশে .....
রক্তের ফোঁটায় সেদিন ধর্ম ছিলনা লেখা
সেবকের কর্মে সেদিন ধর্ম দেয়নি দেখা
তবু হিংসা , তবু নিষ্ঠুর রক্তপাত দেশজুড়ে রোজ আসে
মানুষের হাতে লেখা হয় ইতি
একটা জীবনের কথা ।

আর দূরে রাজনীতি হাসে বসে বরফের ডেরায়
মদিরা হাতে ওরা মজা নেয় আমাদের
আর আমরা ধর্মহীন লাশ হয়ে পড়ে থাকি কবরে
অথবা জ্বলন্ত চিতায় ।

ছাঁচের আদলে : ভগীরথ সর্দার








চারিদিকে স্তাবকতা জড়ানো ভোর
শিশিরের অজুহাতে মাখছি জল
কি গভীর তোমার শঠতা ।   বাড়ছে
আমি সমর্পনের গা-ঘেঁষে এসে
                                       দাঁড়ালাম।

কুমারী স্নানে রোদ পড়ে
জড়তা ভাঙছি ছাঁচের আদলে

তুমি মুখোশ পরে এসে স্বপ্ন দেখালে 

ক্লান্ত দুপুর ও রাখাল ছেলে....: কুনাল গোস্বামী





শূন্য উঠোনে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে কিছু মাটির খেলনা আর পুতুল 
তা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত ক্লান্ত দুপুর, 
দূরে কোথাও শোনা যায় হিংস্র সমুদ্রের অগণন উত্তাল ঢেউ'য়ে সর্বস্ব হারানো নাবিকের আর্তনাদ 
তাতে আর কিইবা আসে যায় নির্বাক নির্জন বালুকা তটের
দর্শকের আসনে বসে রঙিন চলচ্চিত্র দেখতে কারই না ভালো লাগে?
ভালো লাগে সবারই তো বটে!

ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, পরদে পরদে মাটির সুগন্ধ 
দু'দিকে সোনালী ধানক্ষেতের বুক চিড়ে ঐ দূরে এগিয়ে গেছে আলপথ
একমুঠো গোধূলির আলো তার ছোট্ট অন্ধকার কুঁড়ে ঘরে নিয়ে যাবার আশে
ছুটে চলে রাখাল সেই পথে
হঠাৎই বিস্ফোরণ ঘটে দিগন্তের শূন্য প্রান্তরে 
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ঘর ফেরা পাখিদের শব
সেই বিস্ফোরণের সাদা ধোঁয়ায় হারিয়ে যায় রাখাল ছেলে
তাতে কিইবা আসে যায় অন্ধকারের ;

সেই ক্লান্ত দুপুর, সেই রাখাল ছেলে এখনও হয়তো বর্তমান 
যেখানে হিংসা নেই, নেই কোনো ক্ষমতা লাভের লোলুপ দৃষ্টি 
যেখানে সেই ক্লান্ত দুপুরের কোলে মাথা রেখে নির্ভাবনায় ঘুমোতে পারবে সেই রাখাল ছেলে

শহর বড় কাঁদছে :সত্তাপ্রিয় বর্মন





শহরে ভালবাসা হারিয়ে গেছে, 
কেউ কাউকে ভালোবাসে না 
ওই কালো পিচ পুড়িয়ে দেয় মানুষের মন 
পরে থাকে রক্ত। 
দাঁড় কাকের দল রাস্তা জুড়ে মাংস পিন্ড নিয়ে 
কাড়াকাড়ি ক'রে ছড়িয়ে দেয় মৃত্যু জঞ্জাল - 
এসব দেখে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা 
কঙ্কাল গাছটিও শুকনো মুখ সরিয়ে নেয়। 
একলা মানুষ গুলো কান্না দিয়ে শহর গড়ে 
শহর বড় কাঁদছে
বিষন্ন ক্ষুধার্ত হৃদয়ে। 
একটু ভালোবাসা চাই, 
তুমি জানো? সত্যি জানো ভালোবাসতে?
তাহলে এসো, ভালোবাসো।
যে ভালোবাসার কোনো নাম হয় না, 
অখণ্ড সার্বজনীন এক ভালবাসা
যে ভালবাসা একদিন দিয়েছিল এ পৃথিবী আমায় 
যে ভালোবাসায় আমি আজ আর আমি নেই 
যে ভালোবাসায় শহরে রডোডেনড্রন ফুটতে পারে। 
তাকে খুঁজে পাচ্ছি না
হারিয়ে গেছে শহরের দুঃখে। 

প্রেমিকা : রবি মল্লিক




আষাঢ়ের তপ্ত দুপুর পেরিয়ে যখন বিকেলে
কৃষ্ণ কালো মেঘ জমাট বাঁধে গগন আঙিনায়;
বলাকা সারির ছুঁয়াছুঁয়ি খেলা,
দিঘির জলে হাঁসেদের মেলা,
আর স্নিগ্ধ শীতল উত্তাল বাতাস তোমার
আগমনের বার্তা দিয়ে যায় আমার জানালায়;
এই নিয়ে আমাদের সম্পর্কের মেয়াদ বছর পঁচিশ,
তবু আবিস্কার করেছি তোমায় সহস্র ভিন্ন রূপে!
খুঁজেছি তোমায় নতুন করে চেনার পথের হদিশ,
পেতেছি প্রেমের বাসা আমার হৃদয় দ্বীপে৷
                                                   
তোমার মেঘের কাজল পরা চোখের অপলক দৃষ্টি,
পাগলা হওয়ায় গাছগুলিতে উড়ন্ত কেশের বাহার,
বিদ্যুতে বুনট করা আঁচল,
মায়াবী চোখের চাউনি সজল
আর মেঘের ভেলায় চড়ে তোমার ভেসে যাওয়া,
মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রথম আলাপের উপহার;
আজও তুমি নবরূপে চিনিয়েছ নিজেকে আমার কাছে,
আঁচলে বিদ্যুতের সংখ্যাও বেড়েছে অনেকটাই!
রূপের নকশা এঁকেছি মন দিয়ে; ভুল হয়ে যায় পাছে
ক্যানভাসে পার্থক্য স্পট, ভিন্ন প্রায় সবকটাই৷