নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

পাঁচ মিনিট,,,, শুভঙ্কর রাহা




বিয়ের দিন রীতিমত বর উঠে বসলো ঘরের চালে। শিউলি তার বরের উদ্দেশ্যে বলল-
"চালে থেইকে নামো তুমি, নিড়ানি খুঁইটে খাইয়াইবো আমি"।

বিয়ের দিনের কথা অনুযায়ী জমিতে নিড়ানি দিয়ে না হলেও ওই পাশের পাড়ার নকুল দত্ত মশাইয়ের বাড়িতে কাজ করে সংসারের কিছুটা সাহায্য করতো শিউলি রাজোয়ার। স্বামী রমানাথ তখনও আড়পেটে।
রাজমিস্ত্রি দলের প্রধান সেদিন বলল- ' রমা তুর তো দেখছি হাত ভালোই পাকা হইছে রে। ত রাজমিস্ত্রী হবি?'

সে দিন থেকে রমা রাজমিস্ত্রি। বউকে শুনিয়ে রেখেছে, ' বুঝলি শিউলি তুই আর কামিন খাটবিক লাই। উ দত্ত গিন্নি কে বইলে দিবি অন্য কামিন খুঁইজে লিতে।'
তারপর সেদিন তিনতলায় কাজ চলছিল গ্রামের হাইস্কুলের। সদ্য ডি. এম সাহেব এসে জমি ঠিক করে গেছিলেন। সুখ আর দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ভাড়ার বাঁশ খুলে পড়লো রমানাথের উপর। দুটো বড় পেরেকও ঢুকে গেল, একটা মাথায় আর একটা ডান কাঁধে।
ডাক্তারবাবু বললেন,' পাক্কা ছয় মাস বিশ্রাম'।

দু মাস গেল, তিন মাস গেল। ঘরে আর টাকা নেই। ডাক্তার, ওষুধে যে অনেক টাকা গেল। পেরেকের ক্ষতগুলো সেড়ে গেলেও ব্যাথা টা এখনো বেশ আছে। এদিকে বাজারে এখন থেকেই ধার বাড়ছে।
সুভাষ মুদি তো সেদিন বলেই উঠলো, ' চালের দাম টা কিন্তু বাকি আছে। সঙ্গে দুটো নুনের দাম পাই। '

শিউলির অনেক চাপ। একদিকে টাকা নেই। অন্য দিকে স্বামীর কামিন খাটার উপর নিষেধাজ্ঞা। যাকে বলে ধর্ম সংকট।

-' শিউলি রে। তুকে আমি উনেক কষ্ট দিয়ে ফ্যালছি রে। আমি যদি একটু ওপর পানে তাকাতাম তাইলে আর আমার ওপরে পইড়তো না। '
-' ছাড়ো ওইসব। তুমার তো ওষুধ ফুরাই যাইচ্ছে। এই টা তো কাল সকাল অবধি চইলবে'।

-'আর খাবো না রে। আর তো টাকাও নেই মুনে হয়।'

শিউলি রান্না ঘরে উঠে গিয়ে চোখের জল মোছে। তারপর ফিরে এসে বলে-
' তুমি ৫ মিনিট বসো। আমি আইসছি। '

ছুট্টে গেল শিউলি দত্ত গিন্নির কাছে। দত্ত গিন্নির উঠোন ঝেঁটিয়ে, উনুন নিকিয়ে, বাসন মেজে অগ্রিম ৫০০ টাকা নিয়ে ওষুধ কিনে বাড়ি এলো শিউলি। দত্ত গিন্নি কে কথা দিয়ে এলো কাজ না ছাড়বার।
এতক্ষণে প্রায় ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেছে।

- রমা বিছানায় শুয়ে বলে উঠল সেই কখন ৫ মিনিট বলে বেড়িয়েছিস। এই তোর সেই ৫ মিনিট? '


সুপারস্টার(প্রথম পর্ব) : সুকান্ত মন্ডল





বৈশাখ মাস ।  প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। চারিদিকে নির্জীবতার ছায়া । মাঠ -ঘাট চৌচির আর শুনশান । বিবর্ণ প্রকৃতিরানী। দুপুরের ঝলসানো প্রখর রোদ্রে , তুহিনের হাজার স্বপ্ন ও বিবর্ণতার রূপ পায়। নীলকণ্ঠপুরের তীব্র গরম ও বুঝতে পারছিল , সে খুবই কষ্টদায়ক ও একঘেয়েমি । কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না।  সময় হলেই একটা সবুজ পাতাতেও তার চিহ্ন থাকবে না। এখন তার সাম্রাজ্য,  তার রাজত্ব  । দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে জমিয়ে যখন একটা নীরব ঘুম দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তুহিনের বাড়ি থেকে চিৎকার শুনতে পেয়ে দেখল , তুহিনের বাবা  দরদরে ঘাম গায়ে রাগান্বিত অবস্হায় চোখ বড়ো বড়ো করে জুতো দিয়ে পিটছে ক্লাস ইলেভেনে পড়া ছেলেটিকে।                                আর পুরো নীলকণ্ঠপুর গ্রাম কাঁপিয়ে তুহিনকে গালিগালাজ  করছে - "এতো রোদ্রে তো পরিশ্রম করতে হয়নি।  মাথা ফাটাতে হয়নি। ভালোবেসে বাড়িতে থাকতে বলেছি। মাঠে ধান কাটতে নিয়ে যায়নি এক গ্লাস জল চেয়েছি এই যাচ্ছি বলে ,এক ঘন্টা কাটিয়ে দিল !  এদিকে বাবা- মা রোদে জ্বলে -পুড়ে মরছে দুটো ভাত জোগাড়ের তাগিদে,  আর সে জানোয়ার সিনেমা দেখায় মগ্ন। সিনেমার সুপারস্টার হবে !  ছাই আর কচু হবে ।    আরে ! সুপারস্টার তো তাদেরই বলে : বাস্তবে যারা বাবা -মাকে সাহায্য, সহানুভূতি  আর স্নেহ করে । পড়াশোনা তো গাছে উঠে গেছে কবেই। বাপের হোটেলে গোগ্রাসে দুটি গিলছে আর খালি টিভি আর টিভি।  এরকম ছেলে ঘরে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো, দূর হয়ে যায় না কেন "

  অন্যদিকে প্রতিপক্ষ তুহিন ও মারতে যাচ্ছিল বাবাকে ।  কোনোরকম তুহিনের মা দুজনকে সামলে নিয়েছিল। তুহিনের মেজাজি গলা তুহিনের বাবার মেজাজি গলার থেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল  , 'কি ভেবোছো টা কি ? তোমার টাকায় খাচ্ছি বলে দোষারোপ  করছো !'


(চলবে...)

দশচক্র (তিন) : সিদ্ধার্থ সিংহ








ফোন বাজলেই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে রিসিভার তোলে ঋজু। ওর ছেলে বাবি ক্লাস ফোরে পড়ে। ক’দিন হল ছেলেকে নিয়ে ও আর স্কুলে যাচ্ছে না। বউকে পাঠাচ্ছে। 
সপ্তাহখানেকও হয়নি ওর অফিসে একটা ফোন এসেছিল। ও-ই ধরেছিল। ফোনটা একটি মেয়ের। সে লেখালিখি করতে চায়। তাদের কাগজে লেখা দিতে হলে কী ভাবে পাঠাতে হবে, কাকে পাঠাতে হবে, মনোনীত হল কি না, ক’দিনের মধ্যে জানা যাবে, এই সব টুকিটাকি কথা সে জানতে চাইছিল। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ঋজুই দিচ্ছিল। হঠাত্‌ মেয়েটি ওর ফোন নম্বর চায়। ও বলে, এই নম্বরেই করবেন। সন্ধের দিকে করলে আমাকে পেয়ে যাবেন। কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। সে ওর অফিসের নয়, বাড়ির নম্বর চায়। ঋজু দেখেছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা দূরে ও যখন কোথাও যায়, কবি নয়, খবরের কাগজে কাজ করে শোনার পরেই অনেকে ওর কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর নেয়। কিন্তু কস্মিনকালেও কেউ ফোন করে না। এই মেয়েটিও সে রকমই একজন ভেবে, ও ওর বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে দিয়েছিল। আর তখনই ও জেনেছিল, মেয়েটির নাম শালিনী। তার পর থেকে দু’-একদিন ছাড়া ছাড়াই মেয়েটা ফোন করে। 
গলার স্বর খুব নরম। বাচ্চা বাচ্চা। মনে হয় ইলেভেন-টুয়েলভে পড়ে। গত পরশু যখন ফোন করেছিল, ঋজু ঘুমোচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে ফোন ধরতেই ও প্রান্ত থেকে শালিনী বলেছিল, কী মশাই ঘুমোচ্ছেন নাকি? 
— এই উঠলাম। হ্যাঁ, বলো। এত সকালে? 
— না, এমনিই করলাম। কোনও দরকার নেই। আসলে ভাইয়ের সঙ্গে দুধ আনতে বেরিয়েছি তো, দুধের ডিপোর পাশে নতুন একটা এসটিডি বুথ হয়েছে। দেখেই মনে হল আপনাকে একটা ফোন করি। তাই করলাম। কিছু মনে করলেন না তো? 
কেউ যে তাকে এমনি এমনি ফোন করতে পারে, এই ফোনটা না এলে সে জানতেই পারত না। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল সে। আর সেই খুশিতেই সারাটা দিন তার খুব ভাল কেটেছিল। 
লোকে বলে, কারও কারও মুখ দেখলে নাকি দিন খারাপ যায়। আবার কারও কারও মুখ দেখলে দিন ভাল যায়। কারও মুখ নয়, তার দিন ভাল করে দিয়েছিল শালিনীর ফোন। তাই তার পর দিন, মানে গত কাল একটু সকাল সকাল উঠে সে তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। যদি আজও করে! কিন্তু না। সাড়ে সাতটা-আটটা-সাড়ে আটটা বেজে গেল। সে ফোন করল না। এমনকী সারা দিনে অফিসেও একটা না। রাতে শোবার সময় ভেবেছিল, কাল সকালে নিশ্চয়ই ও ফোন করবে। তাই সকাল থেকে যত বার ফোন বেজে উঠেছে, ও প্রায় লাফিয়ে গিয়ে ফোন ধরেছে। এবং দেখেছে, সবই এর ওর তার ফোন। কিন্তু যার ফোনের জন্য ও অপেক্ষা করে আছে, তার কোনও পাত্তা নেই। ঘড়িতে তখন ন’টা বেজে গেছে। নাঃ, ও আজ আর ফোন করবে না! ঋজু স্নানে ঢুকে পড়ল। 
বেরিয়ে শোনে, একটা ফোন এসেছিল। 
— কার? 
ওর মা বললেন, রিনা গিরি বলে একটা মেয়ে ফোন করেছিল। 
— ও, রিনা গিরি! মানে আশিসের বউ। কী বলল? 
— কিছু বলেনি। শুধু বলল, কখন পাওয়া যাবে? তা আমি বললাম, আধ ঘণ্টা পরে করুন। ও স্নানে গেছে। 
ঋজু একটু বেলা করেই ব্রেক ফাস্ট করে। দুধ-মুড়ি খেতে খেতে ও শুনল, ফোন বাজছে। ফোনের কাছে মা। তাই ও আর উঠল না। এটা নিশ্চয়ই শালিনীর ফোন না! 
ফোন ধরেই মা বললেন, ঋজু, তোর ফোন। 
— আমার! এত দেরিতে ফোন করল! পড়ি কি মড়ি করে ছুটে গেল ও— হ্যাঁ, ঋজু বলছি। 
ও প্রান্ত থেকে একটা কোকিল কণ্ঠি ভেসে এল— আমি কণিকা রায় বলছি। চিনতে পারছেন? কাল আমরা একসঙ্গে দাঁতনে গিয়েছিলাম... 
— আরে, হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন। কাল ফিরতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? কেমন আছেন? এখন কোথায়? 
— আমি তো অফিসে। 
— এত সকালে? 
— সকাল কোথায়? পৌনে দশটা বাজতে চলল... 
— আপনাদের ক’টা থেকে? 
— আমাদের তো সাড়ে ন’টার মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। আমরা ডাইরেক্ট সিজিএমের সঙ্গে কাজ করি তো... 
— তাই নাকি? 
— আমরা তো আর আপনাদের মতো সাংবাদিক নই যে, বিকেল বেলায় অফিস। 
— বিকেলে শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু থাকতে হয় ক’টা পর্যন্ত, সেটা দেখুন। আপনারা তখন ঘুমোন। 
— অনেকে হয়তো ঘুমোয়, কিন্তু সবাই ঘুমোয় না। খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে কথা ক’টা বলল কণিকা। 
— কেন? আপনি কি জেগে থাকেন? 
— একদিন বেশি রাতে ফোন করে দেখবেন। 
— হ্যাঁ, আপনাকে বেশি রাতে ফোন করি, আর আপনার কর্তা সন্দেহ করা শুরু করুক, এত রাতে আমার বউকে ফোন করছে কে! 
— সন্দেহ করবে না। 
— কনফার্ম? 
— জানলে তো করবে। 
— মানে? 
— উনি অন্য ঘরে শোন। 
— ও। বলেই, একটু থেমে, অন্য প্রসঙ্গে যাবার জন্যই ঋজু বলল, একটু আগেই রিনা ফোন করেছিল। 
— কখন? 
— এই তো, মিনিট দশ-বারো আগে। 
— রিনা নয়, আমিই করেছিলাম। 
— আপনি? মা যে বললেন, রিনা গিরি... 
— হ্যাঁ, আমি রিনার নামই বলেছিলাম। আসলে আপনার বাড়ির কে কী রকম, আমি জানি না তো। কে আবার কী ভাববে, তাই রিনার নাম বলেছিলাম। এক দিন চলে আসুন না আমাদের বাড়িতে। 
— ওরেব্বাবা, আপনাদের বাড়ি তো সেই তেপান্তরের মাঠে। যেতে আসতেই সারা দিন লেগে যাবে। 
— মোটেও তা নয়। 
— আমি তো দু’-এক বার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে গেছি, জানি। 
— লাস্ট কবে এসেছেন? 
— বছর পনেরো আগে। 
— প... নে... রো...  ব... ছ... র... আগে! এখন এক বার এসে দেখুন... 
— আসলে সল্টলেক শুনলেই না গায়ে জ্বর আসে। লোকে যে কী ভাবে ওখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে, কে জানে! 
— ঠিক আছে, আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে না। আপনি একদিন আপনার সময় সুযোগ মতো আমাদের অফিসে আসুন। 
— আপনার অফিসে যাবার জন্য আমার কোনও সময় সুযোগ লাগবে না। রোজই যেতে পারি। আমাদের অফিস থেকে টেলিফোন ভবন তো একটুখানি। 
— তা হলে আজকেই চলে আসুন। 
— আজকে! 
— হ্যাঁ, আজকে। 
— ঠিক আছে, দেখছি। 
— দেখছি না। চলে আসুন। নীচে এসে আমাকে একটা ফোন করে নেবেন। 
— আপনার নম্বরটা যেন কত? 
কণিকা শুধু অফিসের নম্বরই নয়, তার মোবাইল নম্বর, এমনকী বাড়ির ফোন নম্বরটাও দিয়ে দিল। ঝটঝট করে লিখে নিতে নিতে ঋজু বলল, বাড়ির নম্বরটা পেয়ে ভালই হল। রাতের দিকে অনেক সময় কাজের চাপ কম থাকে। তখন কথা বলা যাবে। আপনি ক’টা অবধি জেগে থাকেন? 
— করুন না। যখন খুশি করতে পারেন। 
— রাত বারোটায়? 
— বারোটা কেন? একটা, দুটো, তিনটে... যখন খুশি। 
— ফোন ধরবেন তো? 
— করেই দেখুন না... 
সে দিন সকালে শালিনী ফোন করার পর সারাটা দিন অদ্ভুত এক আনন্দে সারা শরীর যেমন চনমন করে উঠেছিল, আজও তেমনই এক আনন্দে ঋজুর মনপ্রাণ খুশিতে ভরে উঠল। 

তিন 

কয়েক সপ্তাহ আগে বিধান দত্তের সঙ্গে সুন্দরবন গিয়েছিল ঋজু। বিধানদা কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন। ফিচার লেখেন। বিখ্যাত লেখকের উত্তরসূরি.....


(চলবে )

রুহীর পুতুল : রাজিত বন্দোপাধ্যায়

    







                             ।। ৩ ।।   





            রুহী চোখ মেলে সিটে উঠে বসে মা কে সামনে না দেখতে পেয়ে চমকে উঠে আসে পাশে চাইল । তারপর দেখল মা তো ট্রেনের দরজার দিকে যাচ্ছে । সে তাড়াতাড়ি করে নেমে সেই দিকে চলতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল । বা পাশের একটা খালি সীটে সেই বড় বারবি ডল পুতুল টা শুয়ে ! তবে মাথাটা এখন আবার ন্যাড়া । বোধ হয় চুল ছিল এককালে , আজ আর নেই । তা হোক , এটা কে ফেলে গেল দেখতে হবে । সে এগিয়ে গিয়ে দু হাতে পরম যত্নে তুলে নিল পুতুলটাকে । রুহী কে অবাক করে দিয়ে জীবন্ত মানুষের মত পুতুল টা চোখ মিটমিটাল মনে হল তার ! মুখ টা হাসি হাসি । অঃ - অঃ - অঃ করে একটা খুব নীচু স্বরের আওয়াজও বুঝি শুনতে পেল সে । আশ্চর্য ! এ সত্যি জাদুর পুতুল !!  
-- রুহী ?   
মায়ের কড়া গলার ডাকে সে তড়বড় করে ট্রেনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল পুতুলটাকে কোলে নিয়ে । তার স্কুলের ব্যাগ মার হাতে । ওর হাতের পুতুল টা দেখে মায়ের সে কী রাগ ! কার না কার ! এখন যখন তখন সন্ত্রাসবাদীরা বাচ্চাদের খেলনাতেও বোমা ফিট করে দিচ্ছে , তখন কেন সে ওটা নিল ? মার প্রশ্নে কান্না এল রুহীর । সামনে দাঁড়ানো পুলিশ কাকু তার দিকে চেয়ে মিষ্টি কোরে হেসে বললে ,   
-- দেখি দেখি তোমার পুতুল টা । বাঃ বেশ তো ! পুলিশ কাকু পুতুল টা হাতে নিয়েই প্রথমে ভাল কোরে দেখে নিল সেটায় কোন বোমা টোমা আছে কিনা । তারপর জনে জনে জিজ্ঞাসা করে পুতুলের মালিক না পেয়ে রুহীর হাতেই ফিরিয়ে দিল । মা করুণ চোখে পুলিশ কাকুর দিকে চেয়ে বললে ,   
-- দেখুন দাদা ...     
তাকে শেষ করতে না দিয়ে পুলিশ কাকু বললে ,    
-- আরে না না দিদিমণি , ও আপনার মেয়েই নিয়ে যাক । কেউ যখন পাওয়া গেলনা । এতটুকু মেয়ে আপনার , দেখছেন না কত খুশী দেখাচ্ছে ওকে ।   
মা বললে ,   
-- পুলিশ কাকুকে ধন্যবাদ বল রুহী ।   
-- ধন্যবাদ কাকু ।    
পুলিশ কাকু তাকে আদর করেচলে যেতেই মা কড়া চোখে চেয়ে তাকে বললে ,   
-- বাড়ি চলো ।    
তারা দুজনে বাইরে বেরোবার গেটের দিকে রওনা হয়ে পড়ল ।   
                                                                            [ চলবে ]    

অপরাজিতা : দেবব্রত সেন



         
সুলেমান উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে মাঝে মাঝে এলাকার কিছু সমস্যা তুলে ধরেন সংবাদপত্রে। প্রবন্ধ আকারে। এছাড়াও ভালো ভালো লেখক ও কবির লেখা পড়ে, মতামত দিত। আজকে মনে পড়ছে তার কবি শ্রীজাত  বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই লাইন দুটো ----
            মানুষ হতে মানুষ আসে
                বিরুদ্ধতার হাতবাড়ায়
             আমিও মানুষ তুমিও মানুষ
                 তফাৎ শুধু  শিরদাড়ায়।।

এটাই ভাবছে সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ।  পরে সুলেমান উঠে দাঁড়াল, দুহাতের আঙ্গুল গুলো সংযোগ করে ঘারটা দুপাশে ঘুরিয়ে ফুটিয়ে নিল, বলল,, আচ্ছা শিবু  পুজা মা উঠিরে আইজ, কাইল দেখা করবাম তর মা 'য়ের লগে! বলতে বলতে উঠোন পেরবে এমন সময় পুজার মা মালতি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।আরে সুলেমান যে, কখন এয়েছো? সুলেমান বলল, প্রায় আধ ঘন্টারও বেশি হবে বৌদি।
আর বলিস না সুলেমান , মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যানের ছোটো মেয়েটার জন্মদিন,তাই আর ছাড়ল না, একটু যোগাড়টোগারে সাহায্য করতে হলো।কি করব শহরে বাবু কথা শুনতেই হবে! আর কাজ করেই তো খাই।
বউদি একটা কতাকই? রাগের কিছুই নাই কিন্তু? যেইডা মানবিক হেইডাই কমু! এর বেশি কমু না?
----কি বলবি সুলেমান বলেই ফেল? আমি হাত পা চোখ মুখে জল দিয়ে আসি আগে কেমন!
----- ঠিক আছে বউদি! আহ আগে! তারপর

এই সময় মনে পড়ে গেল, পুজার কলেজে ভর্তির সময় চেয়ারম্যান সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা। সেটাই ভাবতে লাগল সুলেমান। সেইদিন যখন পুজার কলেজে ভর্তির জন্য, কিছু সাহায্য চাইতে গেলাম চেয়ারম্যানের বাড়ি, চেয়ারম্যান সাহেব  যা নয় তাই বলল, আর দেখা করতে বলল,  মিউনিসিপালিটি অফিসে, সেখানও ঠেসা ঠেসি করছে, কখনও এর দিকে,,  কখনও আবার ওর দিকে দেখিয়ে দিয়ে বিষয়টা এরিয়ে যেতে চাইছে! মনে হয় চেনেও নাচেনার ভান ! আরে বাবা দিবি কিনা সেটাতো বল, সেটা বলছে না! না দিলে, না বলে দিলেই হত। আর গরীব অসহায় মানুষগুলানরে ওরকম করাই ওদের স্বভাব ! আসলে গরীব মানুষদের বলার লোক নাই, তাই এরম। শালার বিরোধি নেতারাও তো ওরকমই, তোর হয়ে কতা বলে ঠিকই যখন ভোটে জিতে ক্ষমতার গদিতে বসে, তখন তাড়াও একই পইন্থা করে বসে। মনে হচ্ছিল। একটা নিশ্বাস নিল সুলেমান, মনে মনে বলল, আর কারে ভালো কমু? কারেই বা বিশ্বাস করমু? এই দুনিয়ায় ভাল মাইনষি নাই কেন আছে, তবে হাতে গোনা শত করার অংকের মতন। হাজারে দশটা মিলে।

  সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতই হতে লাগল। ফাঁকা তিস্তা চরে মাঠে কিছু কুকুর শেয়াল তাড়া করছে। ঘেউঘেউ করে পিছু নিল কুকুরের একটি দল। ঘেউঘেউ আওয়াজে তা বোঝা গেল।

হাত-পা চোখেমুখে জলদিল পুজার মা মালতি। মুছতে মুছতে  হাই তুলছে , আহ্বা..... করে উঠল।আর বলছে, কি যেন বলছিলি সুলেমান। এবার বলো। চা, দিয়েছে পুজারা?  এই পুজা কাকুকে চা দিয়েছিস তো, মা?

পুজা রান্না ঘর থেকে বলল, হুম, মা। সে তখন কড়াইএ খুন্তি  নাড়ছে। পটল ভাজা করছে। ডাল একটু আগে হয়েছে! ডাল আর পটল ভাজা ভাত করছে পুজা! পুজার মা পুজাকে বলল, রান্না শেষ হয়েছে তো মা,! তোর কাকুটা আছে একসাথে খাই।

সুলেমান বলল,  না না বৌদি আমি কিন্তু খাব না!  তোমরা খাও। মালতি বলল, খাও কিরে এটা তো তোমার বাড়ি তাই না! বন্ধু থাকলে হয়তো, কত কত আনন্দ করতিস, গল্প করতিস! আর বলতিস বৌদি ভালো করে দুকাপ চা দিয়ে যাও তো! নাহলে কষা কষা খাসির মাংসের কথা! বলতিস আজ কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাব। তোর মনে আছে সুলেমান, একবার বিজয়াদশমীর হালযাত্রায়, তুমি বললে না আজ বৌদি কবজি ডুবিয়ে খেয়েছি, জীবনে স্মরণীয় থাকবে। এমনভাবে বলছে মালতি যেন তাদের পাশে বসেই গল্প শুনছে তার স্বামীও! আসলে কিন্তু তা নয়। এই সময় সুলেমান বলল, বৌদি ওসব থাক। ,। আসল কথায় আসি।কি জন্য ডাকছিলা হেই কথা কও। আসলে সুলেমানের মন এখনও কাঁদে বন্ধুর জন্য।

সুলেমান জাতে মুসলমান ঠিকই,  অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল রয়েছে! তার কাছে পুজার বাপের মতো  মনুষ্য ধর্ম ও কর্তব্যবোধ সমান ভাবে মেনে চলে। পুজাদের মতো অসহায় পরিবারটা পাশে সব সময় দাড়িয়েছে, শুধু আপন বন্ধু বলে নয়। শৈশব থেকে তিস্তা পাড়েই পুজার বাপ আর সে খেলা ধূলা, বড় হওয়া স্কুল জীবন কেটেছে!!

অস্বস্তির মধ্যে স্বস্তির বোধ আইতাছে বৌদি, দ্যাওয়াটাত মেঘ ভীড় করতাছে,  ঝর বৃষ্টি নামবে বুঝি , আইজ যাই বৌদি! অন্য একদিন আইমু। এহন তো আর সময় কম, জমিনে জল জমলে,  কাইল থেকে আবার রোয়া রোপন লাগবো, বিচন তুলতে হইব, জমি চাষ দেওনের লাগব। কি করব! সারা বছরের খাওয়া তো জোগাড় করন লাগব এইডাই সময় ! ও কত্তদিন হইল বৃষ্টি নাই!মাটি যারা যারা রোপন করছিল, তাদের জমিন মাটি ফাটা ফাটা হইছে!  আইলে ভালাই হয়।

----হুম! তাই তো রে সুলেমান। জীবনটা একটা চক্রকার, ঠিক যেমন গরমকাল পেরিয়ে বর্ষা, শরৎ যাবে হেমন্ত আসবে! শীত আসবে তারপর আবার বসন্ত, তারপর আবারও গ্রীষ্ম পেরিয়ে বরষা। কখনও জোয়ার, কখনও ভাটার!  জীবন চক্রে সবই থাকে আর যে মানুষ গুলো চলে যায়, সে আর আসে না ফিরে।  শুধু এটুকুই পার্থক্য।

....বৌদি হক কথা কইছ। এইটাই আল্লাহর বিধান।

......আল্লাহ আর ভগবান যাইহোক,  সবাই যেন বিধিবাম। এত দিন থেকে ভেসে সংসারটা আগলাচ্ছি, কই আছে? আহা করে হাই তুলে, চোখে জল পড়া আঁচলে মুছতে মুছতে বলল। বলল, আর ভগবান? আছে ওই বড়লোকের ঘরে!ওর  যা চায় তাই করতে পারে টাকার জোরে। বাদ দেয় সে সব সুলেমান।

আগে পুজা শিবুকে দেখল মালতি ! কারণ তাদের আড়াল করে আলোচনা হবে মনে হয়, শিবু তখন বিছানায় ঘুমিয়েছে,বেচারার খাওয়া হয়নি তখনও! মা আর সুলেমান কাকু গল্প করছে, তাই সে বিছানায় । পুজা কল পারে, হা পা ধুতে গেল।
মাসদুয়েক আগে একটা ছেলে এসেছিল, ছেলেটা সংবাদ পত্রে কাজ করে! আমার মনে হয় পেরেম টেরেম আছে, তুই একটু খোজ করে দেখিস তো সুলেমান! আমি মেয়ে মানুষ, আমার দ্বারা ওসব হবে নারে।
-----ও! হেই কথা। আমি একদিন শহরে গিয়েছিলাম, কি কাজে ঠিক মনে কইরতে পাচ্ছি  না! তবে, সে দিন ওরা রাজবাড়ী দীঘির পাশে বসে গল্প কইরছে। ভাবলাম থাক! এ বয়সে ছেলে মেয়েরা এরকমই করে। তারপর একদিন  ছেলেটার সঙ্গে দেখা কইরলাম৷ আলোচনা হল, বুজলাম ওরা দুজন দুইজনকে ভালোবাসে। তোমাকে বলাই হয়নি বৌদি। ওর বাড়ি গিয়েছি, বাড়ি শিলিগুড়ি, শিবমন্দিরের ওইদিক।

-----আমার ঠিক এই জায়গাটায় ভয় হচ্ছিল রে সুলেমান।

----ভয়ের কি আছে বৌদি? কওনে! বিয়ের কথাই আলোচনা কইরত  হইব।তোমার কি মত বৌদি?

----- আমি কিছু বুজে উঠতে পারছি নারে সুলেমান। ভাবছিলাম একটা ভালো মাস্টারি চাকরি ছেলে দেখে বিয়ে দেব! কি হল! আর কি ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

-----আমার মইতে বিয়ে ঠিক কইরা ফালাই ভালো। ভালোবাসা আছে ওদের মইধ্যে! তখন আবার কি না কি হয়!

......ঠিক আছে সুলেমান! তোর হেফাজতে দিলাম মেয়েটাকে। তুই যেটা ভালো বুজিস, সেটাই করিস।

----আমি আর কি বৌদি? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আইজ উঠি। দ্যেওয়াটাত মেঘ ছড়াইতেছে! যাই! বৃষ্টি আইবো।

বিয়ে তে মত দিল মালতিও। শুধু আলোচনা দুপক্ষের অর্থাৎ দুবাড়ির সময়ের অপেক্ষা। তারপর বিয়ে। চারহাতের ফার্স্ট ব্র্যাকেটক্লোস। পুজা তার বিয়ের ব্যাপারটা কলপাড় থেকে সব শুনল।পুজার মা মালতি পুজাকে ডাকল,  এই পুজা, পুজা তোর ভাইকে ডাক নারে মা। আয় রান্না ঘরে আয় খাওয়া দাওয়া  সেরে নিই।বৃষ্টি আসার আসার উপক্রম হয়েছে, তাড়াতাড়ি আয়।
শিবু ও পুজা রান্না ঘরে এল, পুজার মা থালা ভরা ভাত সাজিয়েছে তিনটে থালায়। খাওয়া হল সবার।

জোরদার বৃষ্টি শুরু হল, এদিকে আকাশটা ফুটছে চারাং চারাং করে, কোথাও হয়তো উল্কা পিন্ড খোসে পড়ল বুঝি। যে দিকটা পড়ে সেখানে কয়ে বলে যায়, একে বারে পুড়ে ঝলছে যায়! গতবছর এক বিকেলে সুলেমান দের নারকেল গাছটায় পড়েছিল, পোয়াল পুজিটা একবারে ছাই হয়ে গিয়েছিল, গোরু রাখার জায়গাটা ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল! সুলেমানদের কালো গাইটা তো সেই উল্কা পাতের শকে মারা যায়,,ও গাভীটা কি না ভালো ছিল। দিনে লিটার চারেক দুধ দিত! এখন দুধের যা অবস্থা গোয়ালরা অর্ধেক দুধে অর্ধেক জল মেশায়। ও শ্বশুর মশাই থাকতে আমাদের তিনটে বড়ো বড়ো জার্সি গোরু ছিল, সেই ভহাবহ বন্যায় দুটো গোরু কোথায় চলে গেল, ভেসে গিয়ে হয়তো কোথাও আশ্রয় পেয়েছে, কিংবা মারাও যেতে পারে! তবে বাড়ি  যে গাভীটা ছিল, সে অবশ্য ঠিক অবস্থায় ছিল, বেচারাটারও আমাদের সঙ্গে বাধে দিন কেটে ছিল,  না খাওয়া অবস্থায়! আর বাছুরটা জলে ভিজে জ্বরের দাপটে মারা গেল। কি কান্না? ও ।সে ভাবা যায়। ওরাও মায়াবি জীব। পরে কিন্তু বাছুর ছাড়াই দুধ দিত। ওই গোরু গুলো নাকি বাছুর ছাড়াই দুধ দেয়!

পুজার মা রা শুয়ে পড়ল! পুজার মালতি ভাবছে
সেদিনের কথা! পুজার বাবা থাকলে হয়তো বলত পুজার মা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়! কালকে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গতে লাগবে! শশীবাবুদের বাড়ি গিয়ে জমিতে হাল দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগবে! জমিতে ধান বুনতে হবে। এখন আর জমি কই? মানুষটা বেচে থাকলেও খেটে খেতেই হত। যা হয়, জমিদার বাড়ির দুর্দিন। আহ্া........।।

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






আটত্রিশ


               প্রায় ত্রিশ বছর হল গৃহশিক্ষকতা করছি। কত যে অভিজ্ঞতা তা লিখলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের একটা বিশেষ আচরণ। গত দশ বছরে যেটা একটা মারাত্মক আকার নিয়েছে। প্রতি বছরই আমার মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী থাকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে পঁচানব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষককে জানায়। এর একটাই কারণ তারা প্রায় সবাই আবার একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা ফলাফল প্রকাশিত হলে মাত্র কুড়ি শতাংশ শিক্ষককে জানায়। এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথম যে কারণটা সবচেয়ে বড় কারণ সেটা হল, অনেক ছাত্রছাত্রীই অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে শিক্ষকদের নিয়মিত গুরুদক্ষিণা দেয় না। তাই শিক্ষককে ফলাফল জানাতে গেলে বাকি থাকা টাকা মেটাতে হবে, সেই কারণে এই পথ আর কেউ মারায় না। দ্বিতীয় কারণ, শিক্ষককে ছাত্রছাত্রীরা আজকাল আর কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না। পরীক্ষার ফলাফল সবার আগে যে শিক্ষককে জানান উচিৎ সেই শিক্ষা তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে পায় নি। আর তৃতীয় কারণ হল, বর্তমানে সবকিছুই তো অর্থের অঙ্কে কেনা যায়। তাই আজকের ছাত্রছাত্রীরাও টাকা দিয়ে শিক্ষাকে কিনতে শিখে গেছে। আসলে অভিভাবকদের শিক্ষায় এই শিক্ষা তারা ভালোই আয়ত্ব করে ফেলেছে।
               বারবার অভিভাবকদের কথা বলছি একটাই কারণে, অভিভাবকরা একটু সচেতন হলেই এই চিত্র পুরোপুরি বদলে যেতে পারে। গুরুদক্ষিণার প্রসঙ্গ উঠলেই অভিভাবকদের মুখের ভাষাই হল, " কেন ? আপনাকে দেয় নি ? আমি তো মাস শেষ হলেই নিয়মমতো আপনাকে টাকা দিয়ে গেছি ! " আমি জানি উনি ভুল বলছেন না। কিন্তু টাকা দিয়েই একজন অভিভাবকের দায়িত্ব শেষ ? শিক্ষকের সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ রাখতে হবে না ? আমি তো অর্ধেকের বেশি অভিভাবককে চিনিই না। এটা কেন হবে ? অভিভাবকরা যদি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখেন তাহলেই তো আর কোনো সমস্যা তৈরি হয় না। পড়া যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন শিক্ষকের কাছে তাঁর সন্তানের কোনো গুরুদক্ষিণা বাকি থাকল কি না সেটা ওনারা জানতে চাইবেন না ? বাকি যদি নাইবা থাকে, একটা শেষ সৌজন্য সাক্ষাৎকারও আশা করা যায় না ?
               পরীক্ষার ফলাফলের খবর সবাই পেয়ে যায়, একমাত্র শিক্ষক ছাড়া ! অথচ তিনিই আসল কাণ্ডারী। অভিভাবকরা তাঁর সন্তানকে কি শেখাচ্ছেন ? শিক্ষক----- যিনি সম্মানে সকলের আগে অথচ মান মর্যাদায় তাঁকে কোথায় রাখা হচ্ছে। তাহলে অভিভাবকরাই তাদের সন্তানদের শেখাচ্ছেন, প্রয়োজনে শিক্ষকের কাছে যাও আর আসল সময় তাঁকে ভুলে যাও। এরপরেও বাবা মাকে যদি তাঁর সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় তাহলে কি সেই সন্তানের বিরুদ্ধে বাবা মায়ের কোনো কিছু বলার মুখ থাকবে ? কারণ, দায় দায়িত্ব ভুলতে কে শিখিয়েছে ? দিনের পর দিন একটা অমানুষ প্রকৃতিকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে গেছি। আজকে তারই ফলভোগ করতে হচ্ছে।