নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

প্রেম প্রিজম : মহঃ ওলিউল ইসলাম






চিমনির ঠোঁটে জমে থাকা আরমান শুয়ে|
অভিমানের ধোঁয়ায় মিশে যাবে আকাশের পর্দায়|
ঠান্ডা আগুন তোমার ভালোবাসায়|
তারল্যের তোড়ে,
দৈর্ঘ্য বাড়াও তুমি|
তুমি আগুন চেয়েছো,--- ঠান্ডা আগুন পোড়াতে|
একটি গভীর যন্ত্রনার কোলে চাওয়া-পাওয়ার কৈশোর অভুক্ত,
তবুও দামাল|
পাতলা প্রাচীরে আটকে আছে
ক্ষমতার উষ্ণতা |
ফিরিঙ্গি সেজে ক্লান্ত তোমার যৌবন
ভালোবাসার তালিমে মুন্সীয়ানা নেই|
বৃদ্ধ ভাবনা ক্লান্ত এখন,
--চঞ্চলতার ঘরে|

নবজীবন :শ্যামাপদ মালাকার









আমাকে চিনতে পারছেন, আমি কে?--জানি, আপনি আমাকে ভুলে গেছেন। ভুলবেনই তো--পারিজাত নারীদের কি কম যাতয়াত ছিল--আপনার বৈঠকখানায়।
ঠিক আছে, এখনো চিনতে পারেননি তাই তো?
তবে আমার পরিচয়টা একটু দিই----
তারপর, দেবাদিদেব  শিবকে আমি খুব ভক্তি করতাম। সমাজিক নিয়মানুসারে তার ব্রত-উপোস করে আর পাঁচটা নারীর মতোই, গোপেশ্বরের চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট করে রাখতাম।
কিন্তু মহাকালও আমার প্রতি বিমুখ হলেন। বিবাহনামক সামাজিক একপ্রকারের রীতির শিকার হয়ে-- অপরিণীতা বয়সেই, শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে পিতার ভবন ত্যাগ করে চললাম।
সম্পূর্ণ অপরিচিত ঘর--অপরিচিত পুরুষ!
কিছু না বুঝে উঠার আগেই আমি 'মা' হয়ে গেলাম--যাকে একালে পুরুষেরা "ডানাকাটা পরী" বলে।
তখনও  আমি বুঝতে পারিনি, ভালবাসা কি, তবু নবজাতকের নাম রাখতে হবে---শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ছেলের নাম রাখলেন 'শুভ'।
বাপেরবাড়ি থেকেই আমি একটু জেদী হয়ে এসেছিলাম।
নিজে যা ভাল বুঝতাম-- তাই করতাম, তবু আত্মীয়স্বজনদের নিকট হতে স্নেহ-মায়া-আদরের কোনো ঘাটতি ছিল না।
অনেকদিন থেকে লোকমুখে শুনতাম, ট্রেশন পেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই নাকি রাধা-মাধবের  মন্দির। শুনেছি সেখানে গেলে প্রসাদ পায় অনেকেই।
সেই লোভে, মাঝে মাঝে রাধা-মাধবের পূজো দিতে আসতাম মন্দিরে।
লোকে শ্যামসুন্দর মন্দির বললেও--আমি বিশ্বেশ্বরের মন্দির মনে করতাম। তার প্রসাদ পাওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে কতটা যে আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, সে কথা পতিতপাবনই জানতেন।
আমার একমাত্র সন্তান শুভ-- সামাজিক অর্থে আমি 'এক ছেলের মা'। দীঘির মধ্যে  যেমন পদ্ম, তেমনই শ্বশুরবাড়ির উদ্যানে আমি।মাঝ আকাশে জ্বলন্ত অরুণিমার ন্যায়- পরমা সুন্দরী, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের রীতি তখন, দুএককথায় বর্ণনা করা সহজ ছিলনা।
থাক সে কথা- -
তারপর- তারপর শুভ, দামাল ছাড়িয়ে পা পা করে নিজের উঠোন অতিক্রম করল।
প্রকৃতির কি নিয়ম, সে কারু বাধ্য নয়-- সে আপন মনে পথ হাঁটে।
শুভ আরো একটু বড় হল। তার স্কুলজীবনের এক্সজাম শুরু হল। কিন্তু ছেলেটা এখন ভীতুই রয়ে গেছে। যাক সে কথা, সে সেদিন বায়না করল--"মা তুমি সঙ্গে চল, আমি একা যেতে পারবোনা।"
হঠাৎ মনে পড়ে যেতেই আমি তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, শুভ যে পথ দিয়ে এক্সজাম দিতে যাবে, সেই পথেই রাধা-মাধবের মন্দির।
ভাবলাম, এই সুযোগ কোনমতে হাতছাড়া করা যায় না--বিশ্বেশ্বরের প্রসাদ আমাকে পেতেই হবে।
কিন্তু যে আশা আর উদ্যম নিয়ে বেরোলাম, ততটা হয়ে আর উঠল কই!
শুভকে এক্সজাম হলে ঢুকিয়ে দিয়ে চিরপ্রবাহিণী গঙ্গার তীরে গিয়ে বসলাম--অত্যাধিক মানসিক চিন্তার কারণেই হোক,-- বা, দূরগামী বেগবতী গঙ্গার শীতল বায়ুর সংস্পর্শের কারণেই হোক---ক্লান্তিবশত সময়ের দিকে খেয়াল না থাকায়, প্রথমদিন বিশ্বেশ্বরের দর্শন হতে বঞ্চিত হলাম।
পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে, বিশ্বেশ্বর আমায় কৃপা করলেন।
শুভকে পরীক্ষার রুমে পৌচ্ছে দিয়ে, সরাসরি জগৎপিতার প্রাঙ্গণে গিয়ে উঠলাম।
কি শান্তি! কি প্রশান্তি! হৃদয় যেন পবিত্রতার গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
নাটমন্দির সাদাকাল পাথরে নির্মিত, নাটমন্দির লাগোয়া কয়েকটি সোপানের পর চারিপাশে নকশা করা রক্তাভ প্লেট--তারমধ্যে দুই-চারটি দেবদেবী অনায়াসে যাতায়াত করতে পারেন--এমনেই প্রশস্ত, যেন স্বর্গের কোনো গালিচা পাতা।
বিশ্বেশ্বরের সম্মুখভাগ যেন পালিশ করা একএকটি রুপার প্লেট---অপূর্ব কৌশলে বসানো--অবশ্যই নিখুত প্রশংসার দাবী রাখে!
বিভিন্ন দর্শনার্থী ও আগত সেবার্থীদের সমাগমে রাধা-মাধব প্রাঙ্গণ ও নাটমন্দির যেন বৃন্দাবনধাম হয়ে উঠেছে!।
কর্মচারীর সংখ্যা কম নয়, হাঁকে-ডাকে-নিয়মে-শাসনে  সারা মন্দির ভরপুর। আরতির পর মন্দির বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল--এবার হয়তো সেবার্থীরা প্রসাদ পাবেন।
যদিও জানি, মন্দিরের একটা নিয়ম আছে--নরম্যাল প্রসাদের চেয়ে স্পেশাল একটু মূল্য।
বিশ্বেশ্বরকে ডাকলাম--"হে প্রভূ! আমার পয়সা নেই। সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি--দুপুর যে গড়িয়ে গেল, তোমার প্রসাদ হতে কি আজ বঞ্চিত হবো!"
মনে হয়, আমার আর্তনাদ শ্যাম শুনতে পেলেন। অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠার আগেই চোখদুটো জলে ছলছল করে উঠল! অন্তর থেকে বেরিয়ে এল--হে বিশ্বনাথ! তুমি আছো---হে অনাথার নাথ! তুমি আছো--- তুমি না থাকলে, আজ আমি প্রসাদ পেতাম না!
শেষ পর্যন্ত আমি প্রসাদ পেলাম! কি শান্তি! কি তৃপ্তি! মনে হল, বরষার গঙ্গার মতোই আজ আমি কানায় কানায় পরিপূর্ণা!।
কিন্তু আনন্দের বেগ শমিত হতে না হতেই--কর্মচারীর মুখে শুনলাম, মন্দিরের যিনি কর্ণধার, যিনি মালিক--উনার সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করে যেতে বলেছেন।
বজ্রহত গাছের ন্যায় বসে পড়লাম। মালিক ডেকেছেন-- বারংবার কানে প্রতিধ্বনী হতে লাগল! তবে কি উনি টাকা চায়বেন? টাকা তো আমার নেই!
পুনরায় শ্যামকে ডাকলাম--হে প্রভূ! কেন আমার পরীক্ষা নিচ্ছো! আমার কাছে টাকা নেই--তুমি কি জানতে না? হে বিপদতারণ--কেন তুমি আমায় প্রসাদ দিলে?।
আমার কিছু বিলম্ব হওয়ায়--আবার ডেকে পাঠালেন।
বিপদভঞ্জনের উপর ভরসা রেখে, অপরাধিনীর মতোই মালিকের কক্ষে প্রবেশ করলাম- -
এবার মনে পড়েছে---আমি কে?।
প্রবেশ করতেই সারা অন্তঃকরণ যেন হিম হয়ে গেল। মনে হল, কোনো একটা দেওয়ালে এসি অন রয়েছে।
সদ্যমৃতলতা অল্প অল্প জলসঞ্চারে যেমন ধীরে ধীরে জীবিতা হয়ে উঠে, তেমনি আমারও শরীরে যেন মৃদু মৃদু প্রাণ ফিরে আসছে।
চেয়ার পাতা ছিল। উনি আমায় বসতে বললেন।কক্ষটি সু্বাসি গন্ধে টলমল। অনুভব করলাম, রুমে ফুলফর্মে এসি ছুটছে। মুখোমুখি বসলাম। ভাবছি, উনি প্রসাদের টাকা চায়লে---আমি কি বলবো?--- বলবো, প্রসাদ দেওয়ার আগে, টাকার কথা তো আমাকে বলেন নি---যদি বলতেন, আমি প্রসাদ খেতাম না। এরকম অনেক উত্তরই মনে মনে জাগছে।
আমি উনার দিকে না চাইলেও--অনুমান করছি, উনি আমাকে হা করে দেখছেন!। রুমটিতে কয়েকটি রাধা-শ্যামের ছবি ছাড়াও--এখানে সেখানে পূজোর নৈবিদ্য।
ভাবলাম, প্রসাদের টাকা চায়ছেন না কেন? মনে মনে প্রশ্ন জাগছে--সত্যিই কি শ্যাম আমাকে কৃপা করেছেন?
মনের মধ্যে এইরকম তর্কবিতর্ক চলছে।
রুমের ভিতর দুজনের মধ্যে যে নীরবতা গড়ে উঠেছিল--তা পুরুষকণ্ঠে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল।
তিনি বললেন--"প্রসাদ পেয়েছেন?"
এবার চিন্তে পেরেছেন--আমি কে?।
প্রসাদের কথা উঠতেই--আমি বললাম---হ্যাঁ--প্রসাদ পেয়েছি। এই প্রথম মুখ তুলে উনার পানে কয়েকদণ্ড তাকালাম। দেখলাম---সুপুরুষ বটে, গায়ের রং তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, দেহখানা বলিষ্ঠ-- এক কথায় সুদর্শন যুবক। সর্বাঙ্গে বিবিধ রত্নের অলঙ্কার, প্রতি আঙ্গুলে বহুমূল্যের একএকটি আঙটি। দুজনের মধ্যে পরিচয় বিনিময় চলছে।
এক সময়-- সময়ের দিকে তাকাতেই বাবুর পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল।
এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই---রাধামাধবের একটি ছবি, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-"আবার আসবেন- -
এবার চিন্তে পারছেন--আমি কে?
বাড়ি ফেরার পথে মনে হল, মানুষটি বেশ, উনার কত দয়া। এমন মানুষ একালে হয় না। মন্দিরের সব কর্মচারীরা উনাকে পিতার ন্যায় সম্মান করেন। নিশ্চয় উনার মধ্যে দয়া-করুণার শেষ নেই।
নির্দিষ্ট সময়ে শুভর এক্সজাম শেষ হল।
সংসারে কোনোদিন কোনোকিছুর অভাববোধ করিনি। শুভর বাবা-- যিনি আমার স্বামী, তার মতো মানুষ সংসারে খুব কমেই দেখা যায়। আমার প্রতি বিন্দুমাত্র তার অবহেলা ছিল না। অনবদ্য আমি তার স্নেহের ছায়ায় বাস করতাম। শ্বশুর ও শাশুড়িমায়ের তো কোনো তুলনা নেই, নিজের মেয়ের মতো বুকে আমায় আগলে রাখেন। প্রতিদানে আমিও উনাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ঘর সাজিয়ে রাখতাম। প্রকৃতপক্ষে- পিতার বাড়ি থেকে---শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত আমার জীবনে ভালবাসার কোনো অভাব ছিল না।
তবু যেন মনে হতো--
সংসারে চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই, জগৎকে যত দেবে সে ততই চাইবে। এই কারণে মাঝে মাঝে মনে হতো--কি যেন আমার নেই! পারিবারিক কারণে--অকারণে মন ভাল না লাগলে--মাঝে মাঝে রাধা-মাধবের মন্দিরে দুদণ্ড শান্তি পেতে ছুটে আসতাম।
নাটমন্দিরে একটু বসলেই--আমি সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতাম।
মন্দিরের সেই মালিক, কত দয়ালু, উনি আমাকে কত সম্মান করেন।
তখনও আমি বুঝতে পারিনি, ভালবাসা কি---কারণ আমি কখনো কারুকে ভালবাসিনি তো, তাই মনে হতো-- কেন উনার প্রটিটা কথা আমার কানে সর্বদা মন্ত্রের মতো বাজে! কেন উনাকে দেখলেই আমি শান্ত হয়ে যায়! উনি আমাকে এতোখানি যত্ন করেন কেন? এর অর্থ আমি সর্বদা খুঁজে বেড়াতাম।
জগৎ নিত্য, কাল নিত্য, আত্মা নিত্য, নিত্য নয় শুধু জগতের সামগ্রী। সে একদিন ধ্বংস হবে-- জগতে যা কিছু আছে-- সবেই একদিন ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে সমস্ত দেব বিগ্রহ,আর যিনি পরমাত্মা--পরমেশ্বর ভগবান, তিনিই শুধু যুগের সূচনার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দাপিয়ে বেড়াবেন!
সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম--
দিনটা ছিল, রাসপূর্ণিমা।
এই রাস দর্শনেরই জন্য নাকি--দেবাদিদেব মহাদেব গোপনে গোপীসেজে ধন্য হয়েছেন।
রাস শব্দের অর্থ সঙ্গীত বা নৃত্য।
রাসই জগৎ---জগতই রাস। এই রাসের জন্য পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ভগবান কোটি কোটি ভাগে বিভক্ত হয়ে, গোপীদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন।
আজ সেই দিন। চারিদিকে একটা সাজ সাজ রব--- আমি যাবো, আমি রাস দর্শন করবো-- আজ কত মানুষের সমাগম, আমি না গিয়ে কি থাকতে পারি?
শেষ পর্যন্ত আমাকে বেঁধে রাখতে কেউ পারেনি,  মধুসুদনকে স্মরণ করে--রাস দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
আমি এখন বিশ্বেশ্বরের প্রাঙ্গণে---নাটমন্দিরে।  সমস্ত প্রাঙ্গণ ও নাটমন্দির জুড়ে মানুষের ঢল। আরতি শুরু হয়েগেছে, রাস উৎসব আরাম্ভ হওয়ার আগে--এটাই শেষ আরতি।
উলু আর শঙ্খধ্বনীর মহাসমারোহে, মন্দির নিকটস্থশহরও আজ আনন্দে ভাসছে!
কিন্তু আমার মনে শান্তি কই? আমার মন কি চাইছে? কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? মনে হচ্ছে যেন এই ভীড়ে কে হারিয়ে গেছে-- তাকে আমি দেখতে পাচ্ছিনা কেন?।
শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম তাকে।
মন্দিরের এক কর্মচারী বলে গেলেন--"আপনাকে মালিক ডেকে পাঠিয়েছেন, উনার বৈঠকখানায় গিয়ে দেখা করুন।"
কথাটা শুনতে না শুনতেই ভেতরে অস্থিরতা ক্রমশ দ্বিগুণ হয়ে উঠল! বিলম্ব না করে, উনার ঘরে হাজির হলাম- -
কি, এবার চিনতে পারলেন--আমি কে?
আপনি আমায় সম্মান সহকারে বসার অনুমতি দিলেন।
প্রথম প্রণয়ের ভীরু কিশোরীর মতো আমি চেয়ারে বসলাম।
মনে মনে ভাবছিলাম--আমার মনে তো কোনো পাপ নেই, আমি রাধ-মাধবের রাস দর্শনে এসেছি।
আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম-- আপনি অভিজ্ঞ শিকারির মতো আমাকে ধরার জন্য জাল পাতছিলেন।
তবু আমি পালিয়ে যায় নি!
আপনি বললেন--"এই জান, তোমার আমার সম্পর্ক একজনমের নয়---তোমাকে দেখলে কেন আমি এত দুর্বল হয়ে যায়--তুমি বুঝতে পারনি?"
আমি সেদিন তোমার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমি সেদিন পালিয়ে যায় নি!
অঘটন ঘটতে বেশী সময় লাগেনা। তবু মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়--বেহিসাবী হয়ে যায়! তুমি আমার আরো সন্নিকটে এলে--আমি উন্মূলিত তরুর ন্যায় কখন যেন তোমার প্রশস্তবক্ষে আমার মাথা সংস্থাপন করে ফেলেছি---আমি বুঝতে পারিনি- - -
এবার মনে পড়েছে? আমি কে!
ললাটে--গণ্ডে--চিবুকে চুম্বন আঁকতে আঁকতে বললে--"তোমার আমার পরজনমে কোনো সাক্ষাৎ ছিল, তাই হয়তো এজনমে এমন করে পেলাম।"
আমার অন্তর কেঁপে উঠল! সহসা মনে হাজার প্রশ্নের আবির্ভাব হল-- আমি কি তবে বিশ্বেশ্বরকে ভালবাসিনে? মাধবকে বাহানা করে কি ইনার জন্যই মন্দিরে ছুটে আসতাম? আমার যে স্বামী-সন্তান বর্মান! ঠাকুর কি আমায় কখনো ক্ষমা করবেন?।
রাতের পর রাত জেগে জেগে উচিৎ-অনুচিত বিচার করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি হেরে গেলাম। বিশ্বেশ্বর  আমায় ত্যাগ করলেন---আমি নরকের পথে পা বাড়ালাম!।
তুমি আমার ইহকাল পরকাল হয়ে ভিতর থেকে জড়িয়ে ধরলে--আমি তোমায় ভালবাসলাম।
তোমার কথা চিন্তা করলে কি যে সুখ পেতাম আমি---একমাত্র অন্তর যামীই বুঝেছিলেন।
যখন তোমার নেশায় গৃহ আমার অরণ্য হয়ে উঠেছে--ঠিক সেই সময় থেকেই তুমি আমায় অল্প অল্প করে অবহেলা করতে লাগলে- -
এবারও চিনতে পারনি, আমি কে?।
তুমি যত আমার প্রতি অবহেলা শুরু করলে--ততই আমি নুকিয়ে নুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদলাম। প্রশ্নছিল--আমার অপরাধ কি? কোন অপরাধে আমাকে তুমি বঞ্চিত করছো? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ তুমি আমাকে কখনো দাওনি।
আমরা নারী বলে এতটা খেলনা নই! সত্য-মিথ্যা জানার আমাদেরও একটা সাধারণ শক্তি থাকে,
আজ আমি টের পেয়েছি--আমি শুধু একা নই--আমার মতো অনেক হতভাগী ঐ বৈঠকখানায় জীবন বিসর্জন করেছে!
নিজেকে ইশ্বর বলে মনে কর তাই না? আরে ইশ্বর সে--যে নারীকে কখন ঠকায় না!
ভগবান তো সে---যে নারীত্বকে সম্মান করেন!
বীর পুরুষরা কখন নারীর সাথে যুদ্ধ করেনা--
আদর্শ পুরুষরা কখন নারীহত্যা করেনা!
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বিধাতা আমাকে কৃপা করেনি--যদি শ্যাম আমাকে কৃপা করতো, প্রসাদের দাম আমাকে এভাবে শোধ করতে হতো না! তোমার মনে পড়ে? তুমি একদিন আমাকে বিনে পয়সায় বিশ্বেশ্বরের প্রসাদ দিয়েছিলে।
আমি কখন ভাবিনি, প্রসাদের দাম এভাবে মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে!।
আমি যে তোমাকে বড্ড ভালবাসি গো! এখনও তোমাকে আমি ভালবাসি!
কিন্তু এতোবড় সত্যটা তুমি সেদিন গোপন করেছিলে কেন?
আমিতো বার বার বলেছিলাম---দেখ, বিয়ে কর--বিয়ে করে একটা সংসার কর, কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি বলেছিলে--"আমি তোমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারি!"।
এবার বলতো, একটা বিবাহিতা নারীর জীবনে একটা অবিবাহিত ছেলের প্রণয়সংসর্গ হলে-- সেই নারীর চিন্তা কি কম!।
নিজের দিকটাও সেদিন  ভেবেছিলাম। আমি যে খুব একটা ভাল- তা নই! আমি নিজে বিবাহিতা জেনেও দিনের পর দিন তোমার অদম্য ইচ্ছার প্রতি মাথা নুইয়েছি।সেদিন আমার উচিৎ ছিল--তোমার গালে একটা থাপ্পড় মেরে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। কিন্তু আমি তা করিনি, আমি জানি-- আমার এই পাপের ক্ষমা নেই!
আমার মতো নারীরা কখন স্থায়ীসুখী হয় না, যদিও বা হয়--বিচ্ছিন্ন মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী---আমার কথা থাক।
আমি কি কম ভেবেছি? দিনে দিনে--মাসে মাসে---বছরে বছরে ভেবেছি--তুমি আমার জন্য এতোবড় ক্ষতি করতে চলেছো!
একটা অবিবাহিত পুরুষ যখন একটা বিবাহিতা নারীর জন্য সর্বস্বপণ করে বসে, সেই বিবাহিতা নারীর জীবনে আর কি পাওয়ার বাকি থাকে বলো? নিজেকে যতখানি ভাগ্যবতী মনে হয়---ততটা দুঃখিনীও মনে হয়।
জগতে যত রকমের পাপ আছে--সবচেয়ে বড়পাপ- স্বামীকে বঞ্চিত করে যে নারী পরপুরুষের জন্য পথ চেয়ে থাকে। ললাটে সেই বিষের সাগর নিয়েই-- তোমাকে ভালবাসলাম।
মনে মনে আরো পাপ আঁটলাম, এক নারীর দুই পুরুষ অবৈধ। তাই তোমার জন্য ওর প্রতি স্নেহ-মায়া-মমতা আস্তে আস্তে উপড়ে ফেলতে লাগলাম।
বিনিময়ে--দণ্ডে দণ্ডে, পলে পলে-- আলোতে অন্ধকারে ওর নির্যাতনের শিকার হতে লাগলাম। ভিতরে ভিতরে তোমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে-- শতবাহু প্রসারিত করে তোমার দিকে ঠেলে দিতে লাগল!
তুমি যদি বল, এটা আমার অন্যায়--মানলাম। কিন্তু তোমার দেখান পথেই তো আজ আমি পা বাড়িয়েছি, তোমার মনে আছে?
একদিন বলেছিল-"এক পুরুষের মধ্যে চিত্তবিনিময়ে বৈধতা বজায় থাকে।" তাই 'সে' কূলের নিশি ত্যাগকরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন একূলের তীর ছুঁই ছুঁই--তখন তুমি ভয় পেয়ে গেলে।
আমি অবাক! যে আমার জন্য অনায়াসে এতোবড় প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্থিরচিত্তে যন্ত্রণা সয়ে যেতে পারে--যে আমার জন্য পৃথিবীর সর্বস্ব নির্দ্বিধায় ত্যাগ করে পারে, সেই স্পর্শটুকুর জন্য- আমি আজ তার মুখোমুখি!
জিজ্ঞাসা করলাম-" কি, তুমি আমাকে চেয়েছিলে না? দেখ, সে আজ নরক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে বধ্যভূমিতে  হাজির! আমাকে চিনতে পারছো? আমি মালবিকা, যার জন্য পৃথিবীর সব সুখ-দুঃখ ত্যাগ করেছো!।
পরাজিত সৈনিকের মতো ধীরে ধীরে মুখতুলে যখন বললে-"মালবিকা, আমি বিবাহিত!"।
কথাটা শুনার সঙ্গে সঙ্গে চোখে বর্ষণ নামার আগেই--বুকের ভেতরে অনেক দূরে কোথায় যেন একটা বাজ পড়ল! তার প্রতিধ্বনি অন্তরের একূল-ওকূল সবকুল মচড়াতে মচড়াতে নির্জন প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে আমাকে যেন আছাড় মারতে লাগল!
বিধাতা জানে---কোন সৌদামিনীর আলো পথিক ভয় পায়! বিধাতা জানে--কোন বজ্রের ক্ষমতায় পাহাড় ফাটে!
বিধাতা জানে- কাকে কতটা অন্ধকারভরা নরক ছুঁড়ে দিতে হয়!
এ তুমি কি করলি গো! কোন জনমের প্রতিশোধ নিলে তুমি?
গাড়ী--বাড়ি--ধন--সম্পদ--প্রতিষ্ঠা--মর্য্যাদা তোমার তো সবেই আছে, তবে কিসের অভাবে আমার দুকূল কেড়ে নিলে?
তুমি যে বিবাহিত--এতোবড় সত্যটা কেন গোপন করেছিলে? আমি যে বড্ড ভালবাসি গো তোমা----
যখন শুনলাম তুমি বিবাহিত, তার বিষের জ্বালায় আমার সুখের নিশি যে চিরকালের মতো নীল হয়ে গেল!।
যেদিন আমার ললাটে চুম্বন এঁকেছিলে-সেদিন কি একটিবারও তোমার মনে হয় না--যে মালবিকা এজনমের সব সুখ-দুঃখ তোমার পায়ে জলাঞ্জালী দিল!
যেদিন মালবিকার চিবুকে প্রথম চুম্বন এঁকেছিল, সেদিন কি তোমার একটিবারও মনে হয়নি, যে---তোমার মালবিকা আর বেঁচে নেই--সে খুন হয়ে গেছে?
সত্যিকারের ভালবাসা তুমি কি করে বুঝবি বল? তোমার প্রমোদগৃহে অবিশ্রান্ত উর্ব্বসী-রম্ভার নৃত্যগীত,---আর বাসরঘরে মেনকার ঘন ঘন কটাক্ষবর্ষণ!।
যেদিন সত্যিকারে কোনো নারীকে ভালবাসবে--সেদিন বুঝবে--ঐশ্বর্য্য--সম্পদ--প্রতিষ্ঠা--ইমারত, ভালবাসার সামনে সব তুচ্ছ--সব তুচ্ছ!।
হে বিধাতা!তুমি কি আঘাতগুলো বেছে বেছে শুধু নারীদের জন্যই পুষে রেখেছ?
আমি যদি কোনো অপরাধে অপরাধিনী হই--তবে সেও সমান অপরাধে অপরাধী।
আজ কে আমাকে বাংশীধ্বনি শুনিয়ে ঘরের বাইরে এনেছে?
আজ কে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে দুকূল কেড়ে নিয়েছে?
আজ কে মিষ্টিকথার জাল বিছিয়ে আমাকে শিকার করছে?
কেন সে আঘাত করে আমার ভুল শুধরে দেয়নি?
কেন সে আমাকে ধর্ম শেখায় নি?
কেন সে পরজনমের লোভ দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করেছে?
তাই বললাম--হে বিশ্বেশ্বর! আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি--তবে সেও সমান অন্যায় করেছে--
আমার বিচার হলে---তার বিচার হবে না কেন?
আমার ধর্ম গেলে--তার ধর্ম যাবে না কেন?
হে পতিতপাবন! তোমার নিকটে তো সব সমান--তবে আজ এ বিভেদ কেন?
আমি বাঁচলে তোমার সৃষ্টি কি চলত না?
মানলাম। আমি যাকে ঠকিয়েছি তার জন্য শাস্তি যতবড়ই কঠিন হোকনা কেন--আমি বুক পেতে প্রায়শ্চিত্য করবো।
কিন্তু সেদিন আমি যাকে ভালবাসতাম--সে ভালবাসার মধ্যে তো কোনো ছলনা ছিল না! তবে তার প্রায়শ্চিত্ত্য আমি কেন করবো?
কেন রাত জেগে জেগে অবিশ্রান্ত চোখের জল ফেলবো?
হে রাধা-মাধব! তোমার পূজার থালার মধ্যে আমার কোন ছলচাতুরী ছিল না--কোন দুরভিসন্ধি ছিল না-- তবে কোন ধর্মশাস্ত্রবলে তোমার প্রাঙ্গণে গেলে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করি?
হে করুণাময়! তুমি যতবড়ই বিধাতা হও---এর হিসেব একদিন আমাকে দিতেই হবে!।
যখন আমি এইরকম একটি পরিস্থিতির শিকার হয়ে অকূল সাগরে পড়ে ডুবছি, সেই মুহূর্ত একজন লেখকের সঙ্গে আমার দেখা।
আমি ডুবে যাচ্ছি দেখে--সেই লেখক, আমার হাত ধরে টেনে তীরে তুললেন।
আমাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুললেন!
আমার এই অবস্থার কারণ, লেখক জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তখন এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, উনার কাছে ঔষধ চাইলাম, লেখক আমায় ঔষধ দিলেন--"ধর্মতত্ত্বের" প্রথম পর্ব।
প্রতিদিন একপাতা করে লেখক আমায় সেবন করালেন।
ধীরে ধীরে যখন অনুশীলনতত্ত্ব শেষ করলাম--তখন আমি অনেকখানি সুস্থ!।
আমার চোখের পর্দা সরে গেছে--এখন আমি কারুকে আর ভয় পাইনা।
আমি এখন নিজেই বিচার করতে পারি--কে সত্য---কে মিথ্যা--কে বিষ---কে অমৃত---কে ন্যায়---কে অন্যায়।
আমি এখন নিজে বিচার করতে পারি--কে সৎ--কে অসৎ---কোনটা ভালবাসা---আর কোনটা ছলনা।
আমি এখন ইচ্ছে মতো যেমন মরতে শিখেছি--- তেমনি ইচ্ছে মতো বাঁচতেও শিখেছি!।

উষ্ণতা : সুজাতা মিশ্র(সুজান মিঠি)





চায়ের ভাঁড়টা গরম ছিল বড়, হাতে নিয়েই ছেড়ে দিলাম ভয়ে,
দুহাত দিয়ে চেপে ধরে আমার উষ্ণতা, বললে, ‘কেমন তুমি মেয়ে?
দেখছ না ধোঁয়া উঠছে পুরো, দিতে হয় না বুঝি সময়?’
ঐটুকুটতেই কপালে তোমার দেখেছিলাম ভয়।

ট্রেনে কী ভীষণ ভিড় সেদিন, ঘামে গরমে প্যাচপ্যাচে পুরো
তারই মধ্যে কনুই এগিয়ে সুযোগ নিতে চাইলে এক বুড়ো।
ভিড় সরিয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলে জোরে,
‘কোথায় গেলেন মিডিয়া, রিপোর্ট ক্যামেরায় নিন ভরে।
বুড়োর শখে সুযোগ মাটি, এই আগলেছি আমার বুকে,
বলুন বলুন শ্লীলতার মাথা কামড়ে খাচ্ছি ভর্তি ট্রেনে সুখে!’

লজ্জায় তোমার নীল শার্টটায় মিশিয়ে নিলাম আমার বোজা চোখ,
সমবেত আওয়াজ শুনি ‘ভালোবাসার জয় হোক, ভালোবাসার জয় হোক।’
সেই বুড়োটা কোথায় গেল, লুকালো নাকি মেলাল সুর
দেখিনি আমি কিচ্ছুটি আর, তোমার ঘামে তখন আমি ভরপুর।
কানের উপর নরম সুরে আলগা আলোয় গেয়েছিলে হাসি
এই সুরে, কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি, ভালোবাসি ভালোবাসি।
প্রথম রান্নার পরে অধীর হয়ে শুনতে চাওয়া, ‘কেমন হয়েছে বলো না?’
চোখে মুখে আরাম এঁকে বলেছিলে, ‘ আমার ভালোবাসার রান্না।’
তোমার পরে খেয়ে আমার ঝালে নুনে অক্কা পাওয়ার দশা,
হাত মুছে আঁচলে আমার বলেছিলে হেসে, ‘এটাই ভালোবাসা’।

যেবার প্রথম এলো কোলে আমার মিষ্টি একরত্তি
তুমি বললে,  ‘আমি খুশি, ভীষণ খুশি ,আমার স্বপ্ন সত্যি।’

আমার দস্যি যখন আমার রান্নাঘরে  হামাগুড়ি
সেদিন আমি প্রথম শুনেছিলাম কেমন তুমি মিছরি ছুরি!
বিদেশ ট্যুরে প্রতিমাসে তোমার আছে এমন মত কত,
তোমার বন্ধু মধুমিতা কাঁদলো এসে খুব, বললো  ‘বৌদি বুকে বড় ক্ষত।’

ওকেও নাকি স্বপ্ন দিয়ে গন্ধ দিতে, নীল শার্টের বোতাম খুলে,
সেই বুড়োটা প্রতিবারেই আসত নাকি ওই ভাবেই কনুই তুলে।
নুনে-ঝালে রান্নাটাও ‘ভালোবাসা’ মধুমিতার বিশ্বাসী চোখ,
জানো তো, সামলাচ্ছি দস্যিটাকে, আর ওই মেয়েটা গাইছে ভারী শোক।

সেই অবধি একটা কথাই ভাবছি আমি, কেবল একটা কথা,
চায়ের ভাঁড়ের উষ্ণতায়, সব মেয়েতেই তুমি সমান কি পাও ব্যাথা??

ডাউন ট্রেন কর্ড লাইন লোকাল : অভিজিৎ দাসকর্মকার





...আরও
 নিম্নগামী হোতে চায় চোখের দৃশ্য-জল 
   মন বলে বস্তুটির পাশে উনকোটি প্রত্নস্বাক্ষর 

অক্ষরে অক্ষরে মনের আদর্শলিপি কথা বলে তবুও
আবশ্যিক কোন ডকুমেন্টস দেখতে পাচ্ছি না

     জ্যোৎস্নার সময়সীমায় চাতক পাখিটি
রংবদল করে
    
নির্ধারিত ভাবে আকাশ আর গিরগিটির পোশাক বদলে
      শীতকালের সকাল আর গ্রীষ্মের দুপুরে
      ডাহুক পাখি ডাকে
এবং 
    ১টি ঘোষণায়
ডাউন ট্রেন কর্ড লাইন লোকাল ৩৩ মিনিট লেটে চলার খবরে 
    গোটা পলাশ চত্তরের সরলরেখা
    জ্যামিতি বক্স হাতে ত্রিকোণমিতি করছে

অনিন্দ্য পালের এক গুচ্ছ কবিতা

      




    পরিবর্তন যদি ...




সব আলোই নিভে যায় কোন দিন কোন সময় 
নক্ষত্রও কেঁদে ওঠে মৃত্যু যন্ত্রনায় 
দেবতারাও বদলে ফেলে চামড়ার রঙ 
রামধনু হারিয়ে যায়, কানাগলির ঠিকানায় 

বদলে যায় পাতার সবুজ 
পলির গন্ধে মিশে যায় আদিম মৃত্যুর গন্ধ 
বদলে যেতে গিয়েও কি ফিরে আসে আবার 
নিরুত্তাপ বেঁচে থাকা, পাথর ভাঙার ছন্দ ?

পর্বতের শিখর ছুঁয়ে ভেবে নেওয়া সহজ 
উচ্চতা তোমাকে দিয়েছি সভ্যতার পদধূলি 
সমুদ্র পার হয়ে মনে হতে পারে 
পৃথিবী মাত্র এইটুকু, ক্যানভাস রঙ তুলি!

তবু মনে হয়, সব মহত্ত্ব ভালোবাসা যদি 
মূর্তি হয়ে দাঁড়াত, সভ্যতার মোড়ে মোড়ে 
সমস্ত রঙ যদি মিশে যেত এক হয়ে 
পোড়ামাটির থালায় 
হয়ত আবার তবে চৌচির আকাশ জুড়ে 
ফুটে উঠতো একটাই নীল 
 সব দেবতার পূজা হত একটাই সাদা মালায় ।









                 সম্মানার্থে    




এক পশলা আগুন অথবা তীক্ষ্ণ আকাশ 
নেমে এলো মেঘনাদের শরের মত 
কেঁদে উঠলো পৃথিবী
মাটি আর মা 
জঠরে আঘাত করে হত্যা করলো 
ভ্রূণ-সন্তান, 
সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দিলো বিষ 
হত্যা নয়, মুক্তি দিল
সঙ্গে দিল অবশিষ্ট আদর, আশীষ ।

এই দৃশ্যপট জ্যোতিষের কুষ্ঠিবিচার নয় 
অথবা নয় কোনো সময়ঢাকা ধূসর ইতিহাস 

কালক্রমে এ সব এখন ছাপার খবর 
পড়া হয়ে গেলে ফেলে দিতে হয় স্তূপের উপর 

তারপর শুরু হয় আবার তপ্ত লোকাচার 
এবং সময়ের উর্বর কোটরে বেড়ে ওঠে 
                             অবাধ্য ভ্রূণ আবার ...






                  দহন   




জলের কবরে আঁকুপাঁকু করে সূর্য 
আমাদের ও তো পাঁকাল মাছের জীবন 
মাথার উপরে আকাশ যেন ছেঁদা কৌটো 
আগুন ঝরে আগুন বয়ে আনে বাতাস বাহন,

আগুন রঙের ওড়নায় ঢাকা নিদমহল 
এত ক্ষোভ কেন, কেন রাগ এত বিশ্বপিতা?
না হয় করেছি লোভ, করতলে পিষেছি শিষ্ট-সবুজ 
তবু ভালোবাসা দেবে না এতটুকু, শুধুই উষ্ণতা! 

এভাবেই তো সয়ে আছি অভিশাপ-দহন 
তোমার তূণীরে দিবানিদ্রা যায় অলস শীতলতা...

যদিও রোজ ডুবে মরে, আত্মকেন্দ্রিক 
আগুনে দেবতা 
প্রশ্নহীন মাথা নেড়েও এঁকে রাখি জিজ্ঞাসা 
নতুন সকাল কি পাবো না কখনও ?
বেঁচে আছি , বেঁচে থাকি ...
বাকিটুকু হয়তো বা দুঃখ বিলাসিতা। 

গরম গরম :কিশলয় গুপ্ত





বাধ্য হয়ে শ্রাদ্ধ করি নিজের!
অমৃতফল লুকিয়ে আছে বীজে,
প্রমান ছাড়া আপ্তবাক্য মেনে-
বুকের ভিতর চালিয়েছিলাম ডি‌.জে.
সেই সুবাদে শব্দ আমায় খেলো,
সুর নেই-হারমোনিয়ামের বেলো;
হাজার বছর ফাটা থাকার হেতু
আমার ঘরে অসুর ধেয়ে এলো
বুকের উপর হাতটা রাখি ভিজে,
দাগ পড়েছে সাধের মনসিজে-
ভুল আমার,ভুল তোমার,সবার
বাধ্য হয়ে শ্রাদ্ধ করি নিজের