নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

প্রভাতী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রভাতী লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সুদীপ ঘোষাল






মেলাখেলা









-----জীবনে বড় হতে হবে বাবা,মোবাইলে সময় নষ্ট ক''রো না।
-----মা আমি পড়েছি
-----অইটুকু পড়লে হবে  না ।
-----;ঠিক আছে, কাল থেকে পড়বো
-----;কাল  কাল করে কালে খাবে। আজকের কাজ আজকেই করো।
সমীরকে বুঝিয়ে বলছেন তার মা সোমা। জীবনে বড় হতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় বাবা। অনর্থক সময় নষ্ট করলে একদিন পস্তাতে হবে।
কিন্তু সমীর তিরিশ বছরে এখন প্রেমে পরেছে। তারপর আনলিমিটেড মোবাইল কল। শুধু মোবাইলের হেডফোন কানে লাগিয়ে কথা বলে চলে। অফুরন্ত কথা।
ওপাড় থেকে অভিমানের আওয়াজ ভেসে আসে।
----আর ফোন করো না কেন?
---ব্যস্ত ছিলাম
------ও আর আমার সাথে কথা বলাটা কাজ নয় বুঝি?
----না না তা বলছি না। মাকে নিয়ে মন্দিরে পুজো দিতে গেছিলাম।
---বেশ বেশ ভালো করেছো। কখন কেথায় দেখা হবে বলো।
----- বজরংবলির  মন্দিরের কাছে। বেলা দশটায়।
বেশ তো ছিলো গ্রামের দিনগুলো। সংসারের অশান্তির ফলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তি পরিবারগুলো। এখন তারা শহরে বাস করছে। কিন্তু ভুলতে পারে না গ্রামের স্মৃতি।
তারপর মহিম পড়ার ঘরে বসলো। বই নিয়ে বসলে তার আর সময় জ্ঞান থাকে না। কখন যে সময়গুলো ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় বুঝতেই পারে না।
পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে পুরোনো দিনের কথা মনে পরে যায় তার। পরিবারের সবাই একসাথে একবার মেলায় যাওয়ার স্মৃতি মনে উঁকি দিচ্ছে বারেবারে।
গোরুর গাড়ি চেপে উদ্ধারণপুরের মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।
জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।
পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।
গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।
--- একটা তো, কিছু হবে না।
----- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।
তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।
গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।
মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।
জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।
তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।
বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।
মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।
তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।
মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।
মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে
তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো?  তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।
ঘুরে ঘুরে লেখক অবধূতের আবক্ষ মূর্তি দেখলাম। শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।
এই উদ্ধারণপুরের মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি।
আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের  শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।
দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।
তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।
সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।
তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।
হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।
তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে  নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা।
আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে  নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো  বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই  বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে,  ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো।
গোরুর গাড়ি বাড়িতে পৌঁছে গেলো।
আমি মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক।গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। বলতো,দাদু। 
মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস,আই মিনে আয়। সুদপে,রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো।আবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা,জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিম
ধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে।আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে  হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।দাদুর পরম বন্ধু সিরাজুল চাচা বাড়িতে গেলেই মিষ্টিমুখ করাতেন। তার নাতি বিরাজুল আমার বড় উপকারি বন্ধু। মানুষের সংজ্ঞা ওই বাড়িতে গেলেই খুঁজে পাই।
তারপর সংসারের টানা পোড়েন।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতরন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর  বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।  
উদ্ধারণপুরের শ্মশানে দাদুকে পোড়ানো হয়েছিলো।  তখনও মেলার সময়। প্রচুর লোকজনের মিলনমেলা। মেলার মতোই মৃত্যুর পরেও সবাই মিলিত হয় এই উদ্ধারণপুরের মেলায়।
তারপর জীবনের আর এক পর্যায় শুরু হলো। আমার দিদি শোভা। তার জীবনে ঢেউ বেশিদিন টিকলো না। গর্জন স্তব্ধ হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়ি।
শোভা দিদির কপালের মাঝামাঝি একটা তিল তার মুখের শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছিলো । কিন্তু তার সিঁথির লাল শোভা একদিন সাদা হয়ে গেলো । অমাবস্যা র সেই রাত শেষ হতেই চাইছে না । ক্রমাগত একটা কান্নার আর্তনাদে দুই মেয়েকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার জীবনের গতিপথ । মাঝ সমুদ্রের দিক হারানো নাবিকের চুল ছেঁড়া চিন্তার মতো তার অপহৃত হৃদয় । শোভাদি মেরুদণ্ড সোজা রেখে তার বড়দার পরামর্শ মেনে যোগ দিলেন চাকরি জীবনে । আলো জাগলো আশার মনে । আমি তখন তেরো । শোভা দির রান্না আজও মুখে তৃপ্ত স্মৃতি জাগায় । শুনেছি অন্তরের আন্তরিকতায় সামান্য সব্জি অসাধারণ অমৃতের আস্বাদ আনতে পারে । খেয়ে চলে যেতাম আশ্রম পরিবেশে । আমার বড় আদরের শ্রদ্ধার বিরলতম বিদ্যালয় বিল্বশ্বর বিদ্যালয় । এক বটবৃক্ষের ছায়ায় শুরু হতো আমাদের প্রার্থনা সংগীত । অম্বুজাক্ষবাবুর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমাদের আজও পথ দেখায় । বিদ্যালয় অন্ত প্রাণ কোটিতে  গুটি । শুধু স্মৃতি বয়ে বেড়ায় ভগ্মাবশেষ ।
বাড়ি ফিরে ফের মায়ের আঁচলের মতো শোভাদির অকৃত্রিম আদর ।মা তাকে নিজের বোনের স্নেহে মানুষ করেছিলেন ।
তারপর সুখে দুখে শোকে সময়ের চোরাপথে ঢুকে যায় সমগ্র ইতিহাস । মা বলতেন, কাল করবো বলে কোনো কাজ ফেলে রাখিস না । কালেই  খেয়ে নেবে সব ।
মা আমার লড়াকু মহিলা । জীবনের অভাব অভিযোগ কোনোদিন তার হৃদয় ছুঁতে পারেনি । সেই হৃদয়ে ছিলো তালবোনা পুকুরের সাঁতরে তাল কুড়োনোর ছবি । নতুন পুকুর তর্ক করে এপাড় ওপাড় হওয়ার চির নতুন ছবি ।
সেইসব ছবি আজও মায়ের ঠোঁটে হাসির রেখায় চিত্রিত করে আমাদের  নবহৃদয় ।
আজ বৃদ্ধা মা শুধু অপেক্ষার প্রহরে প্রহর গোনেন। চার ছেলেকে মানুষ করে মন যে ছেড়ে যেতে চায় না মায়ার আকর্ষণ । মানুষের পরমায়ু  এত কম কেন? মা বলেন, ছেড়ে যেতে হয় বলেই তো জীবন মোহময়ী । তা না হলে ছন্দ পতন হয় যে ।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা মানব জীবন । কি করে , কে যে লিখেছেন সে রহস্য লুকিয়ে আছে লালনের গানে,জীবনের আনন্দে ।
আমার মেজদার নাম রিলীফ । জন্ম থেকেই মুক্তির টানে তার জীবনের উত্থান । প্রতিভার দৃষ্টি তাঁর আচার আচরণে । সে সংগীত ভালোবাসতো । সংগীতের সুরে সুরে সাজানো সংসারে সফল সাধক মানুষ । কথায় কথায় মানুষই দেবতা হয়ে যায় তার ভাবনায় । দাদা বলে, কোনোদিন দুঃখ ব্যাথাকে বড় করে দেখিস না গর্দভ । মনে মনে সুখ অনুভব করার নাম জীবন ।
বড়দা নিজের জীবনে কাজকে গুরুত্ব দেন বেশি । কথায় কথায় তার কথ্য ভাষা মনের অন্তস্থলের বন্ধ দরজার চাবিকাঠি । তিনি বলেন, টাকা পয়সা জীবনে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই ভালো । বেশি হলেই বিষ । মানুষকে ভালোবাসলেই যথেষ্ট । অভিনয় নয় । আন্তরিকতা একটা কুকুরও বোঝে ।
ছোটোভাই বাবু সকলের প্রিয় । বিপদে আপদে সকলের পাশে  সতত  জাগ্রত তার বিবেক । কোনো বিপদ তাকে চঞ্চল করতে পারে না  । এ তো সাধকের লক্ষণ ।
আর আমি মানুষ হয়ে জন্মে এত ভালো পরিবেশে মানুষের কিছুই কি করতে পেরেছি?প্রশ্ন কুড়ে কুড়ে খায় তিন কুড়ির জীবন । আর কবে করবো মনের অপূর্ণ সাধ পূরণ। কত অভুক্তজন শুধু একমুঠো নুনভাত চায় । সমর্থ লোক যদি একটা মুখেও ক্ষুধার অন্ন জোটায় , তাহলেই যথেষ্ট ।
ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায়  আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন  শিক্ষার্থী প্রবাহ
আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো । পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি । হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ । পায়ে হেঁটে । গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কয়ার । জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো  সুন্দর । বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো  চোখের সুন্দরী কে । তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো ।অমিত রান্না করতো খুব ভালো । পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম । ও শেফ হতে চেয়েছিলো । অনিন্দিতা বলে বান্ধবী টা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো । কিন্তু সব স্বপ্ন গুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো ।
অই বন্ধুরা একত্রে  সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে । রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে । অসীম গান করে,বিচ্ছু একতারা বাজায় । অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে । ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে । হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক।
আমার মা গল্প করতেন তার নতুন অভিজ্ঞতার কথা।
সব জা , একত্রে মিলিত হতো ননদ বা দেওরের বিয়েতে। একবার বাসু দেওরের বিয়েতে পুণ্যলক্ষী বৌদি ছেলে সেজেছিলো। প্যান্ট, জামা পরে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটা লাঠি নিয়ে অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলে বিয়ে বাড়িতে। সব জা রা প্যান্ট পরা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে যখন ভাশুরদের সামনে দাঁড়ালো,মাথা লজ্জায় নিচু করেছিলো পুরুষদল। তখনকার দিনে এটা একটা ভীষণ সাহসের ব্যাপার ছিলো। অভিনয়ের শেষে যখন জানতে পারলো প্রকৃত ঘটনা তখন সকলে হাসাহাসি আর চিৎকার শুরু করলো। নতুন বৌ বুঝতে পারতো একান্নবর্তী পরিবারের আনন্দ। বিয়ের শেষে যে যার চাকরীর জায়গায় চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা লাগতো। নতুন বৌ এর ভালো লাগতো না। স্বামী চলে যেতো চাকরীর জায়গায়। বাড়িতে মা, বাবা আর বেকার দেওরের দল। তারপর জলের ধর্মে যে কোনো পাত্রের আকার ধারণ করতো নতুন বৌ। বাবা,মায়ের সেবা,দেওরের খাওয়া, রান্নাবান্না সব নজরে রাখতে হতো নতুন বৌকে। প্রাণমন ছটফট করতো বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে রাজী করে শর্ত মেনে যেতে হতো বাবার বাড়ি। তখন পুরোনো মাটির গন্ধে নতুন বৌ ভুলে যেতো সব না পাওয়ার দুঃখ।

শোভন মণ্ডল






আরণ্যক
       


অরণ্যের ভেতর পাখিদের কলকাকলি শোনা যায়
শিরশিরে হাওয়া বয়
কাঠবেড়ালির মতো পাইনের গা বেয়ে নেমে আসে
 সকালের রোদ

বুনোফুলগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তীব্র মাদক
নেশায় চুর হয়ে আমরা দু'জনে
পথ ধরেছি অজানা অরণ্যে

উঁচুনিচু পথ। ছড়ানো শুকনো পাতা
রাস্তা কাটছে বুনো ইঁদুরের সারি

এভাবে চলতে চলতে শেষ হয়ে যাবে বন
তার আগে থেমে যাক আমাদের সব ভুল- বোঝাবুঝি

সন্দীপ ভট্টাচার্য








প্রিতমা
      


     

এখন যে কথাটা বলতে চাইছি, তা হলো
আমি ভালো নেই।ছত্তিসগড়ের আদিবাসীদের মতো, সিমলিপালের ধনেশ পাখিদের মতো, শুক্লাদ্বাদশীর রাতে যমুনার  জলে তাজের প্রতিবিম্বের মতো আমিও ভালো নেই। তবুও তুমি চাইলে অথবা না চাইলেও আমার পাশে এসে বসো একবার। আর তাকাও আমার চোখের দিকে, একবার না ,লক্ষবার। ইচ্ছে না করলেও নাকে যেতে দাও তাড়া খাওয়া খরগোশের ঘামে ভেজা আঁশটে গন্ধ। এবার হাত রাখো আমার হাতে ,অদৃশ্য হয়ে যাক না হয় আজ আমার আমি। ওই আমি, আমাকে ক্লান্তি ছাড়া আর কিছুই দেয়না। তারপর মাঝের দূরত্ব টুকু শেষ হবার পরও যদি চাঁদ ঢেলে দেয় শুধুই উদাসীনতা, তবে সে নিষ্ঠুরতার দায়ভার আমাকে দিওনা প্রিতমা, মিছে হবে সে অভিমান এই কংক্রিট  দেওয়ালে। তাই লেবুপাতার সে গন্ধ জমিয়ে রেখো তোমার চিকন বুকে, আঁধার পেরোলেই আমি ঝাঁপ দেবো জ্যাকুজি উষ্ণতায়।

রাণা চ্যাটার্জী





পদস্খলন
                           




এ এক আশ্চর্য ডামাডোলের সন্ধিক্ষণে আমরা। পত্র-পত্রিকা, খবরে পড়ছি, দেখছি আর বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছে না! ছোট থেকে দেখে অভ্যস্ত চোখ,শুনে আসা যে,উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিগণ, নিজেদের গুণাবলী ও দক্ষতার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে,গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্করণে সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখেন। না জানি কেন এক গ্রহের ফেরে,তাঁদের পদক্ষলন ঘটছে, এর বেশ কিছু জ্বলন্ত উদাহরণ সম্প্রতি দেখছি আমরা।

কোনো সম্মানীয় পদ থেকে সংশ্লিষ্ট শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির  আকস্মিক সরে যাওয়া বেশ মানহানিকর ও  অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমরা এড়াতেও পারি না। আপন ভাস্বরে উজ্জ্বল থেকেও  উচ্চপদে আসীন বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গ ,কেমন  না জানি এক  ঝড়ের পূর্বাভাসে টলোমলো আজ। পদ্ম পাতায় জল যেমন ,তেমনি সত্য,মিথ্যার দোলাচলে আমাদের,আপামর ভারতবাসীর অপেক্ষা ওনাদের দিকে তাকিয়ে আসল ঘটনা যাচাইয়ে।

সম্প্রতি ' মিটু ' আন্দোলনের সুনামি ঝড় আছড়ে পড়েছে আমাদের ভারত বর্ষেও । কোনো না কোনো ভাবে যে সকল মহিলারা যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েও লোক লজ্জা,নিরাপত্তা,ভয়ের জন্য সে সব ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে বার বার পিছুপা হয়েছেন,সহ্য করেছেন মুখ বুজে। আজ অন্তত তারা একটা প্রতিবাদ করার সুবিধা জনক জায়গায় একত্রিত হতে পেরেছেন। এই আন্দোলনের জোয়ারে যে অনেক, গৌরবান্বিত পদ টলোমলো হয়েছে ও হবেও, পুর্বাভাস পাচ্ছি তা ,এই আন্দোলনের লেজের ঝাপটায় । সাধারণ জনমানসে ওনাদের প্রতি যে সম্মান বর্ষিত হয় তাতে যেন একটা চিড় ফাট দেখা যাচ্ছে যা বড়ো ফাটল তৈরির রসদ জোগাছে জনমানসে।এ এক সত্যিই অবিশ্বাসযোগ্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

দেখতে পাচ্ছি নামকরা স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিরাও কিভাবে ধরাশায়ী হচ্ছেন, সত্য তর্কে যাচ্ছি না তা প্রমাণিত হবে পরে কিন্তু এই যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সিনেমা দুনিয়ার তাবৎ রাজা-উজির এমন কি নিজের বাবা ও বাদ যাচ্ছেনা এই অভিযুক্তের তালিকা থেকে । কোনো এক সময় হয়তো গর্হিত কাজের মাসুল হিসাবে,ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই উচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি আজ দেরিতে হলেও তার কৃত কর্মের জন্য শাস্তি পাবেন তার সম্মান ও পদস্খলনে।

অপর আর এক  চাঞ্চল্যকর  ঘটনা, ভীষণ ভাবে জনমানসে রেখা পাত করেই চলেছে প্রত্যহ হেড লাইন নিউজে এই কদিন ধরে ।দেশের শীর্ষ কেন্দ্রীয় তদন্ত কারী সংস্থা সি.বি.আই এর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া গোলমাল ।একদম প্রকাশ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে পর্যবসিত হয়ে গেছে দুই প্রথম সারির সিবিআই অফিসারের ঝগড়া,কোন্দল।কিন্তু এতে কি হলো এটা কি ভেবে দেখেছেন ওনারা! যে ভরসা,বিশ্বাস ,সমীহ এই সংস্থা এত দিন ধরে জনগণের কাছ থেকে অজান্তেই তিল তিল করে আদায় করে এক মহিরুহতে পর্যবসিত হয়েছে,তার কি হলো! ঘুষ খাবার চক্করে ও উভয়ের প্রতি প্রকাশ্যে তিক্ততা বর্ষণে এই শীর্ষ শব্দের প্রতি,এই উচ্চ পদের প্রতি জনগণের ঘোর বিস্ময়ের জন্ম নিলো।এক লহমায় ঘটে গেল পদস্খলনের মতো ঘটনা আমাদের চোখে। কেন্দ্র সরকার অবশ্য লোকলজ্জার খাতিরে  এই মহান তদন্তকারী সংস্থার হৃৎ গৌরব ফেরাতে ওনাদের জলদি সরিয়ে সংকট দূরীভূত করার চেষ্টা করলেন কিন্তু  খুব সুবিধা জনক বাহবা কুড়াতে পারলো কই! বরং কেন্দ্রের তড়িঘড়ি সঠিক নিয়ম কানুন না মেনে সিদ্ধান্ত অতি সহজে  বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নামক সেরা পদটিরও পদস্খলন  ঘটালো।

সোমিনা ইয়াসমিন




জীবন্ত লাশ
              



জীবন্ত লাশের গল্প
জীবিত এখনো, তবে নিষ্প্রাণ- অবসন্ন,
অগনিত সূঁচবিদ্ধ দেহ।
ক্ষতবিক্ষত প্রতিটি শিরা- উপশিরা
পিনপতন নিস্তব্ধতায় শোনা যায় আর্ত-চিৎকার
সারিবদ্ধ  বেডে শোয়ানো জীবন্ত লাশ।
তারা কেউ -কেউ অর্ধমৃত, কেউ বা পাড়ি দিয়েছে পরপারে মাত্র কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানে।
আবার কারো বা চলে ধুক-ধুক  হৃদস্পন্দন।
প্রতিনিয়ত চলেছে জীবন -মরণ লড়াই,
প্রতিটি প্রশ্বাস যেন শ্রেষ্ঠসুখ,প্রতিটি নিঃশ্বাস যেনো ভীতির সঞ্চালন।
সময়ের বিড়ম্বনায় কেউ কারো নয়,লোভনীয় ভালো থাকার তাগিদে মরে মরে বেঁচে ওঠার   আকুল আহ্বান।

শুভম চক্রবর্তী





অপেক্ষা




চায়ের বাসন টা উলটাতেই দেখি শয়ে শয়ে হাজার হাজার পিপড়ে,
আমাকে ওদের মারতেই হবে,অপেক্ষার কৌতুহল আমার নেই।ভাবছি জলে ডুবিয়ে মারবো না আগুনে পুড়িয়ে,যন্ত্রনার তুল‍্য মূল্য হিসেব করছি,
ওমনি একটা বিড়াল আধময়লা বেসিন থেকে আমার দৃষ্টি টেনে নিয়ে গেলো ব‍্যালকনি তে,ব‍্যালকনি থেকে এক ঝাপ(নিসঙ্গ দুপুরে দু বার কাকের ডাক) -বিপরীত দোতালায় প্রেমিকা সুলভ কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে রীনা বারান্দায় পায়চারি করছে,কানে মোবাইল ফোন(এই বাড়িটাই আমার বাড়ি,এই বাড়িটাই আমার মামাবাড়ি,এই পাড়া,এই পঞ্চাশ একর আকাশ আমার পূর্বপুরুষের,তোকে গিলে খাবো ধরণের প্রবৃত্তি সূচক মনস্তত্ত্বের ব‍্যাকগ্ৰাউন্ড)কোনোদিন কোনো অপেক্ষা ছিল না টাইপ মুখভঙ্গি,
আমি চোখ উচিয়ে ওর মাথার উপর দিয়ে আকাশ টা দেখে নি,
ও দেখে নেয় আড়চোখে আমাকে,
না নিশ্চিতভাবে এখনো নীল ওর চোখদুটো আর আকাশ।
আসতে করে নামিয়ে রাখি চায়ের বাটি,তখনো গিজগিজ করছে পিপড়ে,(কোনো জীবন তুচ্ছ নয়-কোনো জীবন তুচ্ছ নয়-কোনো জীবন তুচ্ছ নয়! ধরণের বিদ্রুপ মূলক নেকা মনস্তত্ত্বের ব‍্যাকগ্ৰাউন্ড)
না আমার কোনো তাড়া নেই,
বাইরে তাকাই,রীনা তখনো দাড়িয়ে।
আমি 'রীনা ও আকাশের' মাঝে কোথাও একটা তাকিয়ে,
সবটাই কি আশ্চর্যরকম নীল-
দুপুর, দুপুর থেকে রীনার চোখ,চোখ থেকে আকাশ,আকাশ থেকে এক ঝাপ-বিড়াল টা আবার ফিরে এসেছে,(আমি বিড়ালের মতো ঝাপ দিতে পারিনা কেনো?)
রীনা তখনো দাড়িয়ে,পিপড়ে গুলো তখনো গিজগিজ করছে(আমরা বেচে আছি-আমরা বেচে আছি-আমরা বেচে আছি-আমরা বেচে আছি! ধরণের জটিল মনস্তত্ত্বের কমপ্লেক্স ব‍্যাকগ্ৰাউন্ড)।



কাজী জুবেরী মোস্তাক






চলছে সব রুটিন মাফিক 

 

এ শহরে রোজই রুটিন মাফিকই সূর্য ওঠে
ভগবানের খোঁজে সবাই মন্দির কিম্বা মঠে
রুটিন মাফিক ব্যাস্ত সবাই খোদার খোঁজে 
গীর্জাতেও জমেছে মানুষ ঈশ্বরের খোঁজে ৷

এ শহরে রোজই রুটিন মাফিক সকাল হয়
পোড়া কপাল বেকার ঘুরে অফিস পাড়ায় 
ক্ষুধার্ত তবুও খায়না মানিব্যাগ ফাঁকা বলে 
কর্পোরেট লোকগুলো ব্যাস্ত নিজ কর্মস্থলে ৷

এ শহরে রোজ রুটিন করে স্কুলবাস আসে 
বখাটে ছেলেগুলো রোজই স্বপ্ন দেখে বাঁচে
সময়ের মতোই আজকে চলে যাচ্ছে সময়
তবু বুকে আছে ঘুরে দাড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয় ৷

এ শহরে রোজ রুটিন মাফিক মৃত্যু আসে
আমার দরজায় যমদূত কখন যেন আসে
চিতা জ্বলে,গোড় খুড়ে কফিন প্রস্তুত সদা
আমার মৃত্যুতে চাইনা কারোই শোকগাথা ৷

এ শহরে রোজ রুটিন মাফিক ট্রেন আসে
চেনা অচেনা কতো মুখ স্বপ্ন দেখতে আসে
কোনঠাসা হয়েও পড়ে থাকে কতশত স্বপ্ন
তবুও সে লড়াই চলছে জীবন করে বিপন্ন ৷

মৌমিতা মিত্র







ছড়ানো আলোর কথকথা
---------------------------




মাথার অনেকটা ওপরে আলো ছড়িয়ে।
আল ধরে ধরে কাছে যেতেই, আলো
টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙতে থাকে।

টুকরোগুলো আগলে ধরে এক একটা মানুষ

আমিও হাত বাড়াই
একটা লোক --- তার হাত পা পাতার মত ছড়িয়ে---
ছায়া হয়ে উঠে আসে শুধু।
লোকটার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সময়ের দাগ।
কথা জমে জমে আজ ওর জিভ নড়ে না আর।
লোকটার দুটো চোখ আবছা।
ও স্মৃতি হারাতে চেয়েছে রোজ
একটু একটু করে।

সৌরভ ঘোষ




রুট চেঞ্জ




সন্ধ্যার পায়ের কাছে বিকেল নত জানু 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দূর...
জোনাকি আলোগুলো পাড়া ভাগ করে দেয়।

এখানে,
স্টিফ ড্রিঙ্ক,ভালো এসকর্ট 
হাফ কাপল অফ নাইস হার্ড ফাক,
দেন স্লিপ টিল নুন...
চলবে না।
কারণ এটা লাস্ট ভেগাস নয়। 
এখানে, 
পাখিরা সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে...

লাস্ট ভেগাস না হওয়ার দুঃখে
দাঁত ঠোঁট কামড়ায়,
জিভ কেঁপে কেঁপে মিমাংসা খোঁজে। 
কেন যে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু হল না?
উষ্ণ মন্ডল বড় বেহায়া...
কষিয়ে পাঞ্চ লাইন ছাড়তে ইচ্ছে করে...

রঙিন সংসার সামাজিক যাত্রাপালা,
নাগরিকের চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করতে করতে
জীবন ব্ল্যাকহোল ছেড়ে বেরোতেই পারে না।
সখগুলো যেন মরা অস্ট্রিচের গলায় বাঁধা হাঙ্গা

সুদীপ্ত বিশ্বাস






জংলী রাত


ব্যাঙ চললো ব্যাংককে আর
চিল চললো চাইনাতে
রাত দুপুরে গান ধরল
হাসনাবাদের হায়নাতে।

মৎস্য বলে, ‘বৎস শোনো,
চিংড়ি কোনও মাছই না।’
নেংটি বলে, ‘মাউস রে তোর
রঙ্গ দেখে বাঁচি না!’

হাঁড়ি নিয়ে হাঁড়িচাচা
যেই না গেল বাজারে
হোগলডুরির হুক্কা শেয়াল
উঠল ডেকে হাজারে।

ঘোঁত-ঘোঁতিয়ে বলল ঘোঁতু,
'আমায় কিন্তু ঘাঁটাস না
রাত দুপুরে ঘুমের সময়
চেঁচিয়ে গলা ফাটাস না।'

কঙ্গো থেকে কুমীর এল,
সোঁদরবনে সাঁতরে!
বাঘ বাবাজী উঠল হেঁকে,
'আমরা রাজার জাত রে।'

চাঁদনী রাতে চালতা গাছে
পেত্নি বাজায় করতাল
হেঁড়ে গলায় হাকিম হাঁকে,
'কালকে হবে হরতাল।'

এমন সময় তেঁতুল গাছে
ভূতের রাজা মামদো
রাত দুপুরে বায়না ধরে,
‘পেত্নি, মুঝে হাম দো!’

পেত্নি বলে, ‘মামদো রে তুই
ঘুমটা দিলি চটকে,
মটাশ করে এইবারে তোর
ঘাড়টা দেব মটকে।’

সুনন্দ মন্ডল





এক চক্ষু হরিণ


                  

    নীল দিগন্ত ছুঁয়েছে সমুদ্রের কোমর
      পাখিটার গান ভেসে আসে তীরে
    বট গাছের ফাঁকে সূর্যের ক্ষীন আভা
    মলিন বুক পেতেছে সবুজ চাদরে।

   রাজা ছিল এক সেদিনের আসন আঁকড়ে
   ‎পদ তলে হাজার অনুগত আর সহযোদ্ধা
   ‎রক্তের মদে মেতেছিল বনানীর কোলে
   ‎শিকারী হাতে মেপেছিল জ্ঞানের বোদ্ধা।

   খুন করেছিল পাপ হয়েছিল পাপী 
   ‎ভাগ নেয়নি কেউই তপের ফলযোগ
   ‎নিশ্চুপে থেমে গিয়েছিল রথের চাকা
   ‎ঘিরেছিল এক অনাগত মারন রোগ।

   চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব গিলে নিত যে
   হারাল বনের মাঝেই বাণ ভুলে শাপে
   এক চক্ষু হরিণ এর মতোই জীবন এখন
   কত সুখ হারিয়ে শুধু দুঃখটাকেই মাপে।

মোনালিসা নায়েক







মনের মেঘে একফালি রোদ
************************





তুই আসবি আশা নিয়ে–
বিকেলবেলার অস্তাচল লাল,
এলোমেলো শব্দগুলো পলকের ভুল থেকে জেগে ওঠে আস্কারায়!
সময়ের ছিদ্র বেয়ে নিঃশব্দের কষ্টগুলো--
হৃদয়ে বৃষ্টি জলের নকশা আঁকার প্রতীক্ষায়।
ফিকে হওয়া ইচ্ছেরা -
ডানা মেলুক হৃদয় আকাশে,
ঠিক যেমন গাংচিল ভেসে বেড়ায়–
সাদা মেঘের দেশে।
স্মৃতির জানালায় বিষাদী অভিমানী গল্প--
বিলীন হোক হৃদয় ভাঙা কাঁচবৃষ্টি হয়ে।
প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালমুক্ত নিঃসঙ্গতার ক্ষত,
চোখের তারায় বিস্মিত কৌতুক,
নিয়ে আছি আত্মসমর্পণের সেই ক্ষণ।
ভালোবাসার একফালি রোদ বেঁচে থাক চিরজীবন।

পিনাকি






কুকুর ও  মানুষের গল্প  

        


                                   ১

কেবিন থেকে বেরিয়ে , নার্সিং  হোমের  বারান্দায় দাঁড়িয়ে  দুচোখ  ভিজে  গেল  অব্যয়ার   রেলিং –এ হাত রেখে  সে   নিজেকে  শান্ত  করবার  চেষ্টা  করছে  ।  এই  মুহূর্তে  ভিতরে  ভয়ংকর  ঝড়  বইছে , সব  কিছু  উল্টো –পাল্টা  করে  দেবে  ! নিজেকে থামাতে  হবে  ।  সে  জানে  এই  সময়টুকু  নিজের  সাথে  লড়তে পাচ্ছে  না , গোটা রাত  তার জন্য  অপেক্ষা  করছে ।   শীততাপ  নিয়ন্ত্রিত  কেবিনের  ভিতর ,   নার্সিংহোমের  বিছানায়  যে   লোকটি  শুয়ে  রয়েছে ,  তার  সারা  শরীর  ব্যান্ডেজ , চ্যানেল  , নলে  বিদ্ধ । হুঁশ  এখনো  ফেরেনি  । সে   জানতেও পারবেনা  অব্যয়ার  যন্ত্রণার  গভীরতা ।   
দু’ চোখ  বেয়ে  নেমে  আসছে  জলের  ধারা । আঙুল  দিয়ে  মুছল ।   নিজেকে  শক্ত  করতেই  হবে  । সে  নিজের  মনে  নিজে  বলল -  এতো  ভেঙে পরলে  চলবে  না । প্রতিদিন  কত মানুষের জীবনে  দুর্ঘটনা  ঘটছে । তাদের  অনেকেই  আর সুস্থ জীবনে  ফিরতে পারেনা ; সংসারের  শেষ আর্থিক  সম্বলটুকু  চলে যায় !
অব্যয়াই  নিজেকে  সামলে  নিচ্ছে  । এখন ওর অনেক  কাজ  ।  ভিতরে কেবিনে  ভাঙাচোরা  দেহ  নিয়ে  ,  খাদ্যবহনকারী নলে  বিদ্ধ --  যে  মানুষটা ,  জীবন –মৃত্যু নিয়ে  লড়ছে ;  সেই মানুষটা জানতেও পারছে না --  তার   কেবিনের  বাইরেও  যুদ্ধের  আঁচ এসেছে ! দু’জন  মানুষ  এখন  পরিস্থিতিগত  ভাবে  আলাদা  অথচ  তাদের  ভিতরকার লড়াই  একই  কেন্দ্রে , আবার  এই  লড়াইয়ের  শেষে  জীবনের  গতিবিধিও একই  ভাবে  ঘুরবে । 
পিছনে  বছর  চল্লিশের  একজন  লোক  এসে  দাঁড়ালো ।  বলল – মিসেস  শুক্লা , ফিরবেন  তো ?
অব্যয়া  মাথা  তুলে  দেখল , নিবেদিতার  স্বামী ! এখন  আর অলকেশ বাবুকে  দেখলে  বিরক্তি  লাগেনা , এই  নার্সিংহোমেই  নিবেদিতা  ভর্তি রয়েছে ।  হয়ত  কাছাকাছি কেবিন  আছে  । অলকেশ  দেখতে  পেয়েছে  , তাই  কথা  বলতে এসেছে ।  এখন  মনের অবস্থা  এতটাই  এলোমেলো ,  কথা  বলতে  মন চাইছে  না । তাও  নিজেকে  জোর  করেই কিছুটা  একঘেয়ে  পরিবেশ থেকে  পালানোর তাগিদ  নিয়েই  , অব্যয়া  বলল – অলকেশ  , নিবেদিতা  কেমন  আছে  ?
নিবেদিতাকে  নিয়ে  বিন্দুমাত্র  ঘাঁটাঘাঁটি  করবার  ইচ্ছা   তার  নেই  ।  এই  বিষয়টা  নিয়ে  আর ভাবতেও    মন চাইছে  না । অব্যয়া  বলল – ওকে  নিয়ে  বিজি    রয়েছি , একদিনও  দেখা  করতে পারিনি  ।  খুব  লজ্জিত  । 
-লজ্জার  কিছু  নেই  । এতবড়  একটা  অ্যাক্সিডেন্টের  সব  ঝামেলা আপনাকেই  সামলাতে  হচ্ছে । এখানে  আপনাকে  সাহায্য  করবার মতন তেমন কেউ   নেই  ।  অফিস আর বাড়ি  সবটাই  আপনি সামলাচ্ছেন । আমি বুঝি  , মিসেস  শুক্লা ।  ও  দুঃখিত অভ্যাসবশত  আপনাকে  শুক্লা  সারনেমে  ডাকছি ।
-ভুল  কোথায় ?  বিয়ের পরে  মেয়েরা    শ্বশুর  বাড়ির  পদবী  ব্যবহার করে ।
-সে  ঠিকাছে ।  কিন্তু আমি জানি  , আপনি   বিবেক বাবুকে  ডিভোর্স  দেবেন ।

 কিছুক্ষণ চুপ থাকল ।  অব্যয়ার   হাতে  যে  রুমাল আছে  ,  কপালের  ঘাম  মুছল ।  বলল – দেখুন  অলকেশ  আপনি  আমার থেকে  এই  ব্যাপারে  এতো  শিওর  কেমন  ভাবে  জানিনা  ! দেখুন  কিছু  মনে  করবেন  না , এই নার্সিংহোমে  আমিই  বিবেকের  স্ত্রী ।  ভর্তির  সময়ে  যে  ফর্ম  ফিলাপ  করেছি , স্ত্রী  হিসেবে  আমার  নামই উল্লেখ  করা  আছে  । এখন  ডিভোর্স  নিয়ে  ভাবছি না । ওকে  সুস্থ  করে  তুলতে  হবে । যত  দ্রুত  সম্ভব । তারপর  না  হয়  ভাবা  যাবে ...
-আপনি  ভুল  বুঝলেন ।  দেখুন আপনাদের  ডিভোর্স  পেপারে  কিন্তু  বিবেক  বাবুর  সই আছে  । আর  ঘটনার  দিন  বিবেক শুক্লা  এই  নিয়ে  খুব  উল্লাসিত ছিলেন  ।
অব্যয়ার  গলা  শুকিয়ে  আসছে ।  খুব  কাঁদতে  চাইছে  ।  বুকের  ভিতর কষ্টের  গোলা আটকে  আছে  , দমবন্ধ  হয়ে  আসছে । বিবেক  তাকে  যে  অপমান  করেছে  তার  থেকেও , পুরুষের  কাছে  সকল  ভারতীয়  নারীর  ব্যবহার  এমনই !   সংবাদপত্রে  এত  খবর ছাপা  হয় , এত নারীর প্রতি  বঞ্চনার  কথা  বলা  হচ্ছে ---  সব  কিছু  সত্যি  বলে মন  মানতে  চায়না । অথচ  নিজের  জীবন  থেকে  বুঝতে  পারছে  ,  ভারতীয়  সংস্কৃতি  নারীকে  দেবী রূপে  পুজো  করলেও ,  মানুষ ভেবে  সম্মান  দেয়না  ! সে  এতটাই  অবজ্ঞার  পাত্র  ? নাকি  সিংহভাগ পুরুষই  ডিভোর্সের  সই  করে  তার   সঙ্গিনীকে  বলতে  ভুলে  যায় ,  বদলে  মদ্যপানের  আসরে  বুঁদ  হয়ে  থাকে  ।  সে  ঝগড়া  চায়নি । খোরপোষ  দাবি করেনি ।  বিবেকের  কাছ  থেকে  একফোঁটা  সম্মান  চেয়েছিল ।
এই  ছোট্ট  শব্দটা সামান্য , উচ্চারণ করতে  খুব  অল্প সময়  নষ্ট হয় ;  অথচ অনেকের  পুরো জীবনটাই  নষ্ট হয়ে  যায়  সামান্য  শব্দটার  বাস্তব   অনুভূতির জন্য  ।  অব্যয়া    তেমনই  কাঙাল । বিবেক  তাকে  কম কষ্ট  দেয়নি , তাই  নতুন করে  এমন ব্যবহার  খুব একটা   যন্ত্রণা দিচ্ছে  না ।  অলকেশের  মুখের ভাবে  নিজেকে  অপমানিত মনে হচ্ছে । চোখ  ফেটে যাবে দুঃখে ,  একফোঁটা জল  গড়াবে না ; কেননা  সে  জানে  তার  চোখের জল    অসহায়  নারীর  দুর্বলতাই  প্রমাণ  করবে । এই কয়েকদিনে , সে  বুঝে  গিয়েছে  বিবেকের  সাথে  রাগারাগি  করে  নতুন চাকরিতে  নিয়ে  সে  সেই সব  মানুষদের কাছে  চ্যালেঞ্জ  ছুঁড়ে  দিয়েছে  , যারা  নারীদের  এই   সময়েও   আর্থিক ভাবে  দুর্বল  দেখতে  চায় ।  অলকেশ  যেমনই  হোক , সেই  দলের  সার্থক প্রতিনিধি --- এটা  বুঝতে  অসুবিধা  হয়নি । 
মুখ  তুলে  অব্যয়া বলল -  আপনি  এখন  ফিরছেন ?
ঘাড়  নামিয়ে   অলকেশ  বাঁ –হাতে  ঝুলে  থাকা  ঘড়িতে  দেখল , বিকেল  ছটা । 
-হ্যাঁ , রাতে  আর আসবনা  আয়া আছে  ।  ডাক্তাররা  বলল , এখন  অবস্থা  ঠিকাছে । আগের  থেকে  অনেকটাই  ভালো ।  তাই  ভাবছিলাম   সাতদিন  ভালোই  টেনশনে কাটল  । 
অব্যয়া ভাবল , আজকে অলকেশের   সাথে  কথা  বলে  বিবেকের  আগামী  দিনের  পরিকল্পনার  জানবে । বিবেক   নিজের  মুখে  কিছু  বলেনি । তারা  ঠিক করেছে   আলাদাই  থাকবে  ।  বিবাহ বিচ্ছেদ ফাইল  করে । দীর্ঘ   সময়  বাদে  , দু’পক্ষকেই কাগজ  পাঠানো হয় ।  বিবেক  আগেই  সই করেছে । অব্যয়া স্বাক্ষর করেনি ।   এখন উল্টোটা  ভাবছে  ।  বিবেকের  দুর্ঘটনা যখন  ঘটল , তার  অবস্থা  দেখে  সে  সই করবার কথা  ভুলে  যায় । এখন সব  কিছু তাকেই  করতে হবে  ।  বিবেকের দুই ভাই এই  ঝামেলা  নেবে না  বলেছে ।  বৃদ্ধ মা   অপারগ । তাই স্ত্রী  হয়ে আইনি ভাবেই   সমস্ত দায়িত্ব  তুলে  নিয়েছে ।
এইসব  কথা  ভাবতেই  চখ চোখ জলে  ভরেছে ।  খেয়াল  করল ,  অলকেশ  বলল – চলুন , ক্যান্টিনে  গিয়ে  কফি  নিতে  -নিতে  কথা  বলা যাবে । এমনিতে  বাড়িতে  ফিরতে  ভালো লাগছে  না ।  নিবেদিতার  ফাঁকা   ঘরটা  দেখলেই , বুক  টনটন করে ওঠে ।


সন্ধ্যা  ছটায় ওরা , নার্সিং  হোম  থেকে  বেরিয়ে  উল্টো  দিকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত  ক্যাফেতে  ঢুকল ।  মুখোমুখি  বসে  রয়েছে ।  অলকেশ  কফি  আর হাল্কা স্নাক্সের  অর্ডার  দিল ।
শুরু  প্রথমে  অলকেশ  করল । - আপনার  প্ল্যান  কী ? 
অব্যয়া  বলল  -  জীবনটা  বড্ড  ভঙ্গুর । প্রতি  সময়ে  যে  কোন  স্বপ্ন  ভেঙে যেতে পারে  ।  এখন আর  পরিকল্পনা করিনা ।  জীবনকে  নিজের  মতনই  দেখতে  শিখছি ।  ভালোই লাগছে  ।  আগে  থেকে  প্ল্যান  করে  লাভ আছে  বলে  মনে  হয়না ।জীবনে যা  হবে  --- তা হবেই । তাকে  হতে  দেওয়া বা না- দেওয়া , আমাদের হাতে  নেই। তবে  সেই  হওয়াটা  হয়ে  যাওয়ার পর  , নিজেকে মানিয়ে  নিয়ে  এগিয়ে  চলাটাই জীবনের সংগ্রাম ।  লড়াই ।
-আপনি দেখছি  , জীবন নিয়ে  অনেক অভিজ্ঞ ।
-আগে ছিলাম না  । এখন  হয়েছি ।  অভিজ্ঞতা কম হলনা । পঁয়ত্রিশ  বছর  বয়স । 
-আপনি  চাকরি  করছেন ,  আপনার  চারপাশের  অনেকেই  মেনে  নিতে  পারেনি  ।  বিবেক বাবু  নিজেও  চাইতেন না।
-বিবেকের  চাওয়াটা  আমার কাছে  ইদানীং কোন  গুরুত্ব হারিয়েছে ।  সত্যি  বলতে  আজ  আমি শুধু মাত্র  নিজেকেই   গুরুত্ব  দিচ্ছি ।  আর  দিয়ে যাব ।  অন্যের বোঝা হতে  চাইনা । আর এর  জন্যই  নিজের  শিক্ষাগত  যোগ্যতা কে  ব্যবহার করছি ।  আমি  চাইনি আর্থিক  দিক  দিয়ে  বিবেকের  উপর  নির্ভর করতে । 
-আমি  জানি  । এতটুকু বুঝি  , আপনি  নিজের আত্মসম্মান  বিসর্জন দেবেন না । আর আপনি  বিবেকের    বিশ্বাস ভাঙবেন না ।
-আমি  এতকিছু  বুঝিনা  । জীবনে এখন  যেই সিদ্ধান্তে  আমি  এসেছি , সেখান  থেকে  ফিরে  যাব না । কিছুর  বিনিময়েও নয় ।


অলকেশ  কফিতে  চুমুক  দিয়ে  বলল – বিবেক  আর  নিবেদিতা একসাথে  থাকবে  ।  যদিও  আপাতত  তাদের  সুস্থতার  উপর  নির্ভর করছে । আমি  নিবেদিতাকে  ছেড়ে  দেব  ।  আমাদের  ডিভোর্স  শুধুই  আমার   সম্মতির  জন্য আটকে  ছিল  । আমি  সই করে  দিয়েছি ।  
অব্যয়া  তাকিয়ে  রয়েছে ।  অলকেশ একদিন  সকালে  নিজে  এসে  ,   বিবেককে  শাসিয়ে  গিয়েছিল ।  বউয়ের সাথে  অন্য  পুরুষের  সম্পর্ক  মেনে  নেবে না ।  বিবেকের  কথা সেই দিন  অব্যয়া  সরল   ভাবে  বিশ্বাস    নিয়েছিল  ।  মেয়েরা  যাকে  ভালোবেসে  ফেলে  , তাকে  সম্পূর্ণ  বিশ্বাস করে । ভারতীয়  মহিলাদের  এই  চারিত্রিক  দুর্বলতা  (বিশ্বাস  করাটা  যদি   নিজের   ক্ষতি  করে )তাদের  পুরুষেরা  ভালোভাবে  অপব্যবহার করে । বিবেকের  মতন  পুরুষরা  তাই  নির্ভাবনায়   নিজের  প্রেম  চালিয়ে  গিয়েছে ।   একজন   মানুষ  জীবনে  একাধিক  মানুষকে  ভালবাসতেই  পারে  ,এই   ভালোবাসাকে  পরকীয়া    বলা  যায় না  ;  তা  যখন মিথ্যার  আশ্রয় নিতে  থাকে --  তখনই পরকীয়া  হয়ে ওঠে ।  বিবেক  আর  নিবেদিতার  সম্পর্ক  ক্রমশই  তেমনই  দিকে  এগিয়েছে ।  তখনো  অলকেশ  সব  কিছু  জেনেও   নিজের  স্ত্রীর  প্রতি  শক্ত  হতে  পারেনি । আর  অব্যয়ি  ভেবেছে  এইবার তার সব  কিছু  না  মেনে  প্রতিবাদ  করবার কথা  ।  বিবেক অন্য  নারীর প্রতি  নিজের  সবটুকু   ঢেলে  দিয়েছে ,  তার  ভাগে  কিছুই  নেই  ।  অনেক  রাতে  বাড়ি  ফেরা  ,  দীর্ঘ  সময়  ধরে  বিবেকের  অবহেলা  --- সবকিছু  মেনে  নিয়েও  বাড়িতে  থেকেছে  অব্যয়ি ! কেন ? সবটাই চারপাশের  লোকনিন্দার  জন্য ? ভারতে  বিবাহিত  মহিলাদের  স্বামীর  ঘরে অত্যাচারিত  হওয়া তেমন একটা আলোড়িত  ঘটনা নয় , যতটা   বিবাহ বিচ্ছেদ  নেওয়া  । লাথি  খাও  ,  বিষ  খাও  ,  খিস্তি  খাও  --- তাও   স্বামীর  ঘরে  খাও ।  স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা  মানেই  , সে   অন্য  পুরুষের  ভোগের  বস্তু ; তাকে  সমাজের  বাকী  পুরুষেরা নিজের  চাহিদায়   ব্যবহার  করবে  ।   তাই  হয়ত অব্যয়া বিবাহ বিচ্ছেদ   এড়িয়ে  থাকতে চেয়েছে  ।   
চোখ  ভিজে  গিয়েছে । চোখের  পলকে   অতীতের  স্মৃতি  ভীড়  করছে  --    বিবেকের  জ্বর ছিল , সারারাত সে নিজে   না  ঘুমিয়ে মাথায় ভেজা কাপড়  দিয়েছিল  । এইসব ন্যাকামো  বড্ড  সেকেলে , একদিন  ঝগড়ায়  বিবেকে  বলেও  ছিল। 
অব্যয়ির  গলা  ভারি হয়ে  আসছে । সে  ঢোক  গিলে  বলল
-আপনি , নিবেদিতাকে  এতটাই  ভালোবাসতেন  যে তাকে  মেনে  নিতে চেয়েছিলেন । আর  এখন  মেয়েটার এইরকম অবস্থায় , সই করে  দিলেন  ! তাড়াহুড়ো  করলেন মনে  হল ।
অলকেশের  চোখ  দুটো  শক্ত   হয়ে  এলো । - দেখুন , ভালো  আমি এখনো বাসি । কিন্তু  নিবেদিতার পেটে  আপনার  স্বামীর   বাচ্চা ছিল ।   মানে    যদিও    দূর্ঘটনায়   সে  ভ্রূণ   নষ্ট  হয়ে গিয়েছে  ।   খুবই  দুঃখের ।   আপনি  আপনার স্বামীকে মাপ করে  দিলেও , আমি  নিবেদিতার সাথে  থাকতে  পারব না । সেইদিন   ওরা  একসাথেই  গাড়ি করে   আসছিল , দুজনেই  মদ্যপ  ছিল । দুর্ঘটনা  ঘটবার  পিছনে  সেটাও একটা কারণ । আর নিবেদিতা কনসিভ  করেছে – জেনেই  ওরা   হোটেলে  গিয়ে সেলিব্রেট করেছিল । খুব কাছের দু’একজন  ছিল । আমি তাদের একজনের   থেকেই জেনেছি । এইসব কিছু  জেনে , আমি নিবেদিতার  স্বামী হওয়ার  অভিনয় করব না । আর আমি চাইছি , কোর্ট  যেনও  অসুস্থতার ছুতোয়  ডিভোর্স  দিতে  দেরী  না  করে ।
অব্যয়া  খেয়াল  করছে , চোখের  কোণায় পাতলা  জলের রেখা নামছে   ; খুব সরু  আর আপাতাত  নিরীহ । এই  রেখা  আঙুলের  তলা  দিয়ে  মুছে  দিল ।  এমনটা  করল , কেননা  পাছে  অলকেশ  তাকে  দুর্বল  ভেবে  বসে ! 
গলা  শক্ত করে  বলল  - অলকেশ  আপনাকে  কে  বলল , আমি  বিবেককে  মাপ  করে  দেব ?  দেখুন  আমি  ডিভোর্স  দেব । আর  খুব তাড়াতাড়িই  তা  জানতে  পারবেন  ।
ঘড়িতে  সন্ধ্যা  সাতটা ।  ঘড়ির  দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়ি  বলল – আজ  উঠি ।
অলকেশ  বলল – ম্যাডাম    আপনার সিদ্ধান্ত  আপনার ।  তবে  আপনি  যদি  ডিভোর্স  দিয়েদেন  তাহলে  এখনই আমার  নিবেদিতার  হাত  থেকে  রেহাই  পেতে   সুবিধা  হয় । যদিও ওদিকে কেউ  কিছু   এখনো  বলেনি । তাও  যদি  নিবেদিতা  কর্মক্ষমতা  হারিয়ে  বিছানায়  শুয়ে  থাকে  । যদি  বিবেক  সুস্থ  হয়ে ওকে  ভুলে  যায় বা  বিবেকের  অবস্থাও  একই রকম থাকে  , হয়ত নিবেদিতার  বোঝা  আমাকেই টানতে হবে  । স্যরি , আমি   ঠিক তেমন  ভাবে  বলতে  চাইনি ।  মানে  বুঝতেই পারছেন , আমার  কিছু চাহিদা...

ঘাড়  ঘুরিয়ে   অব্যয়া  বলল – থাকুক  না , আমি  বুঝেই  গিয়েছি  । এতদিন  আপনি  নিবেদিতাকে  সহ্য করতেন কারণ ওর  মোটা  মাইনের   বেতনের  জন্য  । এখন  সে সব  নেই  যখন  বোঝা বইবেন কেন  ? আমার এইসব  ব্যাপারে  আলোচনা করতে  ভালো  লাগছে  না ।  তবে এতটুকু  বলব , আপনার  নিবেদিতার  উপর  যে  রাগ  রয়েছে আমার  বিবেকের  প্রতি  ঘৃণা  তার  থেকেও  বেশি । আমি   নিজের  সবটুকু  দিয়ে  ওকে  ভালবেসেছিলাম । আর বিবেকে  আমাকে  ঠকিয়েছে ! তাও আমি ওর  সাথে   জড়িয়ে আছি  , শুধুই  মানবিক কারণে । তবে  এটাও  হয়ত আর  বেশি  দিন  নয় । আসছি ...





                                   ২




নার্সিংহোম থেকে  বেরিয়ে , ক্যাব ভাড়া করে নিল । গাড়িটা  এলগ্রিন  রোডের  দিকে  এগিয়ে  চলেছে ।  অব্যয়া   ঘামছে ।  বিবেক  তাকে  ঠকিয়েছে , সে  এই  কষ্ট মেনে  নিলেও  নিজেকে  অসহায়  আর  প্রতারিত  ভাবতে  রাজি নয় । এটা  তার  নিজের  জীবন , এখানে  সে অন্য কোন মানুষের দ্বারা  চালিত  হবে  না । কোন  ভাবেই  নয় ।
নিজেকে  তাও কেন  ঠকাচ্ছে ?  এই  যে  প্রতিদিন  বিবেকের  মিথ্যা  পরিচয় নিয়ে  নার্সিং হোমে যাওয়া ,  সব  দায়িত্ব  নেওয়া  আবার  দিনের শেষে   বাড়ি  ফিরে  আসা  সেই  লোকটির প্রতি  প্রবল  ঘৃণা  নিয়ে  ! এমন  ভাবে  সে  নিজেই  ঠকছে ।  শেষ  একমাস  অনেক  কিছুই  ভেবেছে  , অলকেশের  মুখে  যখন  সব  কিছু জানতে পারল ,  নিজেকে  এক  মুহূর্তের জন্যও  বিবেকের  সাথে  দেখতে  রাজি  নয় ।
গাড়িটা  এসে  থামল । 


অব্যয়া  গাড়ি  থেকে  নেমে   টাকা   মিটিয়ে নিজের  ফ্ল্যাটের  দিকে  চলেছে । আজ  সে  বিবেকের  ফ্ল্যাটে  যায়নি । এই  এক কামড়ার  ফ্ল্যাটটা  নতুন  নিয়েছে ।  ব্যাঙ্কের  লোণ   নিয়ে  কিনেছে । এই একমাস  সে  এখান থেকেই  যাতায়াত করছে নার্সিং হোমে । অফিস যাচ্ছে ।   

কলিং  বেল টিপতেই   অম্বিকা  দেবী  দরজা খুললেন । তাঁকে  দেখে  অব্যয়ি  বলল -  মা , তুমি  ফোন করেছিলে ? আমি কথা  বলছিলাম  বলে ধরতে  পারিনি ।  অবশ্য  পরে  ফোন করতাম ।  ভাবলাম  বাড়িতে  এসেই  না  হয় বলব ।
-তুই হাতমুখ  ধুয়ে আয়  । আমি  ভিতরের  ঘরে    আছি ।  আজ বিনয়ের  বড়দিদি  ফোন করেছিল । ওর মায়ের সাথেও  কথা  হল । 
অব্যয়ার  শরীর জুড়ে ক্লান্তি । তারউপর  এইসব  কথা এখন  শুনতে  চাইছিল  না । সে  ইচ্ছা  করেই বলল –এখন নয়  ,অফিসের কাজ  আছে  । 


রাতে খাওয়ার  পর  নিজের  ঘরে  শুয়ে  আছে   । একপাশে  টেবিলল্যাম্প জ্বলছে , হাল্কা  আলো অব্যয়ির  মুখে  ম্যশ্চারাইজার  ক্রীমের  মতন  মেখেছে  ।  সেই দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়া একটা  দৃশ্য  ভাবছিল ।    

বছর তিরিশের  এক  রমণী কাঁদছে । এখন  গভীর রাত  ।  পাতা  ঝরবার  শব্দ  শোনা যায় । চারপাশের আলো নিভে গিয়েছে ।   যে  রমণী কাঁদছে সে  কে ? অব্যয়া  এইসব  কিছু  খুব কাছ  থেকে  দেখছে ।  এই  রমণীর মুখ খুব চেনা । সে ঘোরের  মধ্যে  থাকে   ।  এটা  একটা  স্বপ্ন ,  অব্যয়া এই  সবপ্নে স্বপ্নে আগেও  থেকেছে ।  তা  অসম্পূর্ণ  ছিল ।  মেয়েটা  তার  বয়সী । মুখ  তুলে  বলল -  আমি  হেরে  গিয়েছি  । তুমি  কিন্তু হারবে না ।
অব্যয়া  বলল – মানে ? কি হারবার  কথা  বলছ ? আমি যে  হারতে  পারি , তা কেন  বললে ?
মেয়েটির  দুচোখ জলে  ভিজে  গিয়েছে ।  অব্যয়া  বুঝতে  পেরেছে  , সব  মেয়েরই   মুখ  কষ্ট পেলে  এমন হয়ে  যায় ।  মেয়েটি  কাঁদছে  কেন  ? এই কান্নার  অন্তরালে কোন  রহস্য  লুকিয়েছে  ! সে  এই স্বপ্নকে  কখনই  সম্পূর্ণ  দেখেনি । আজ দেখবে ?
মেয়েটি বলল – ওরা  আমায়  বলেছিল , আমি  অন্যায়ের  প্রতিকার চাইব না । এই সমাজে  পুরুষকে   শাস্তি দেওয়ার  অধিকার  শুধুই  পুরুষের । আমি নারী  , শুধু  প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি  ।
অব্যয়া   কিছুই  বুঝতে  পারল  না   ! এই মেয়ে যে ভাষায়  কথা  বলছে তা  বুঝতে  অসুবিধা  হচ্ছে  না, এই  পরিবেশ  তার  চেনা  নয় । 
-তুমি অত্যাচারিত ?
-আমি  নই  আমরাই  বঞ্চিত । আমাকে কেউ সুবিচার  দিতে  পারেনি । সকলেই  ফিরিয়ে  দিয়েছে  । কথা  দিয়েছে , অন্যায়ের  বিরুদ্ধে  আত্মত্যাগ  করলেই  দেবী  হয়ে যাব !
-দেবী !!
-সকলেই  দেবীর  প্রতিশ্রুতি  দিয়েছে  মানুষের নয় । আমি মানুষের সম্মান  পেতে চেয়েছি । তাই চোখে  ঘুম  নেই । সারা  দেহ  যন্ত্রণায়  ফেটে  যাচ্ছে ।
আচমকাই  ঘুম  ভেঙে  যেতে  অব্যয়া  উঠে  বসল । তার  বুক  ,  বোগল   ঘামে  ভিজে  গিয়েছে । এতক্ষণ  একটা  স্বপ্নই  দেখছিল । সে  ভাবছিল  এই   স্বপ্নের  মেয়েটিকে খুব  চেনা  মুখ  মনে  হচ্ছিল !





                                        ৩



এখন  রাত দুটো । আর তিনঘণ্টা । তারপরেই  ভোরের আলো  ফুটবে ।  পাখির  কোলাহল  শুরু  হবে  । একা , ক্লান্ত , নির্জন  রাস্তার বুকে  মানুষের পায়ের  শব্দ  শোনা  যাবে । বারান্দায়  দাঁড়িয়ে  থাকতেই অব্যয়ার  মন  চাইছে ।  সামনে  একা –একা   দাঁড়িয়ে  থাকা  লাইটপোস্টের   ম্রিয়মাণ  আলোর  দিকে  তাকিয়ে  খুব কাঁদতে ইচ্ছা  হচ্ছে । মায়ের সাথে  ঘুমাবার  আগে  কথা কাটাকাটি  হয়েছে ।  বিবেকের বাড়ির লোক  চাইছে  , বাকী জীবনটা  অব্যয়া  বিবেকের দায়িত্ব নিক।   কেননা বাকী জীবন বিবেকে  হয়ত সুস্থ  হয়ে উঠতে পারবে  না । অবশ্য  মিরাকেল ঘটতেই পারে। আর এটা  ঘটাবার   সাধ্য আছে  একমাত্র অব্যয়ার ---- অন্তত  বিবেকের বাড়ির  দিকের  লোকের  তাই  ধারণা । বিবেকের সম্পত্তির  মালিক  হবে  অব্যয়া । 
সে  অবশ্য  নিজে  এটা  চাইছে  না ।  বিবেককে আপাতত  সুস্থ  করবে । সাথে  নিজের  চাকরিও  চালিয়ে  যাবে ।  অব্যয়ার মা  , অম্বিকা  দেবী নিজেই  চাইছেন মেয়ে  এই  সম্পর্ক  মেনে  নেয় । এতে  মান থাকবে  কূলও         থাকবে  ।ভারতীয়  বিবাহিত  মহিলা  স্বামী পরিত্যক্তা হলে , সমাজ  অন্য   চোখে দেখে ।   মেয়েদের  স্বাধীনতা থেকে  তাদের  পরাধীন  সম্ভ্রম অনেক  বেশি  দামী  ।নির্ভরশীল  আশ্রয়  অনেক  বেশি  কাঙ্খিত  । 
অব্যয়া ভাবছিল ,  স্বপ্নে ভাসা –ভাসা  মেয়েটির  করুণ মুখ আর  অব্যয়ার  অসহায়তা  মিলে  যাচ্ছে ! এই মেয়েটির  সাথে  তার  কোন  সম্পর্ক  রয়েছে ?  এই স্বপ্নের  ভিতরের  গল্পটার তার  খুব   জানা । হ্যাঁ , ছোটবেলায়  মায়ের  মুখে  শোনা  । অব্যয়া    ভাবছে ...

রাতের পানপাত্র   থেকে  গভীর  নিস্তব্ধতা ক্রমশই  ছড়িয়ে  যাচ্ছে ।  একটি  মেয়ে  লেখার টেবিলে  মাথা ঝুঁকিয়ে  হলুদ আলোর  দিকে  তাকিয়ে  ভাবছে । সাদা কাগজ  নিয়ে  লিখতে  শুরু  করল   মায়ের  উদ্দেশ্যে ----   



এখন  চারপাশ  খুব শান্ত । তাই  তোমাকে  মনের কথা  খুলে  বলছি । তুমি ছোট   বেলায় আমাকে  একটা  গল্প  শুনিয়ে ছিল । পুরাণের  গল্প । এক  ব্রাহ্মণী কে   ঠকিয়েছে  তার  পুরুষ । সেই  পুরুষ   শেষে  রোগে  ভুগে  মারা যান ।  মৃত্যুর  পরেই    যমপুরীতে  ব্রাহ্মণের   বিচার  চলে ।  অভিশাপে  তাকে  শাস্তি পেতে  হয়েছিল ।  এদিকে ব্রাহ্মণী পত্নী   নিজের  উপর  ঘটে  চলা   অন্যায়ের  বিচার  চাইল না। সে  ভারতীয়  নারী ।  বিবাহিতা  । সে  কেমন  করে  স্বামীকে  ছাড়বে ! তার থেকে  নিজেই স্বামীর পাপ  মোচনের  জন্য  চেষ্টা করবে  । কাঁদছে ।  তারপর  নারদ  তাকে  যোগবলে  মৃত  স্বামীর   চিতায় এনে  হাজির  করে । ব্রাহ্মণ   পত্নী   সহমরণ  বেছে  নেয়  ।   এরপর  গল্প  এগিয়ে  চলে  । ব্রাহ্মণ   অভিশপ্ত  হয়ে কুকুরে  পরিণত হল ।   একসময়  সে  নিজের  পরিত্যাগ  করা পত্নীর   সতীত্বের   জোরেই     নিজের পাপ  মোচন করে  এবং  শিবের   খুব কাছের   ভক্ত  হয়ে  ওঠে  !  এখানেই   অব্যয়ার   প্রশ্ন  , সে  মেয়ে  এমন  আত্মত্যাগ   করল  তাঁর  স্থান   কোথায় ?  পত্নীর  প্রতি  যে  অবিচার  হয়েছে , শাস্তি  পত্নী  দেয়নি  , দেবতারাই  দিয়েছে । সমাজ  বা   পুরুষের   বিচার   পুরুষমুখী   সমাজ  করবে  কেন  ?   নারী নিজের  স্বামীকে    ত্যাগ  দিলনা  কেন  ?  সে  কি  স্বতন্ত্র  জীবন  বেছে  নিতে  ভয়  পেয়েছিল  ? নাকি  ভারতীয়  মূল্যবোধ চেয়েছে  নারীদের  চিরটাকাল   স্বামীমুখী  করে রাখতে  ! সেই রমণীই   স্বপ্নে  এসে    বলেছে  , আর  যেনও   অব্যয়ারা  পিছনে  না  হাঁটতে  থাকে  । সময়  এসছে  নতুন  রুপকথা রূপকথা লিখবার ।
অব্যয়া   মনে – মনে    বলল  ---   বিবেকের  সম্পত্তি  বা   সম্পর্ক --- কোনটির  প্রতিই  বিন্দু  মাত্র  মোহ  নেই ।  আমার  লোভ আমার  স্বতন্ত্র  পরিচয়ের  প্রতি  ।  এটাই  আমার  অস্তিত্ব । আমি হারব  না।   আমি জানি  তোমরা  আমাকে  মেনে  নিতে পারবে  না  , কেননা  তোমাদের ভারতীয়   মূল্যবোধে  যেখানে   নারী আসলে পুরুষমুখী – আমি মানতে পারব না  । কেননা  আমি আজকের  পরিবর্তিত  ভারতীয়  মূল্যবোধ ---   নারী  স্বতন্ত্র  ব্যাক্তি  । তার এই দিক তোমরা মানবে না ।  নারী   সত্ত্বা  আর   তোমাদের  একমাত্র  সন্তানের  দায়িত্ব  নিতে   গিয়ে  যে  টানাপোড়েন  , তাতে আমি  ক্লান্ত ।  আমার  মৃত্যুর জন্য   তোমরা  দায়ী নও । সে দায় , ভারতীয় পুরুষ কেন্দ্রীক  মূল্যবোধের ............ 

চিঠিটা  লিখবার  পর  , অব্যয়া  বাথরুমে গেল  । এখনো  মা  ঘুম  থেকে  জেগে  ওঠেনি ।   ভোর  হতে  দেরী  নেই  ।   আত্মহত্যা  করলে , পাশের থানা  থেকে  পুলিস  আসবে  তাড়াতাড়ি । পোস্ট মর্ডাম  ক্রতেও করতেও খুব বেশি  সময়  নেবেনা । সন্ধ্যার  মধ্যেই  সব  কিছু  শেষ ।
অব্যয়া   বাথরুম  থেকে  এসেই  , মায়ের  ঘরের  দিকে  গেল  । সত্তর  বছরের  মহিলাটি  ঘুমিয়ে  কাদা । মুখে  এক  অদ্ভুত  শান্তি ফুটে উঠেছে । মা  ধরেই  নিয়েছে , মেয়ে  শ্বশুর  বাড়ি  ফিরছে । আর স্বামী পরিত্যক্তা নয় । এই মেয়েই  যখন  মৃতদেহে  পরিণত হবে  ! অব্যয়া মুচকি  হাসল ...

এইবার  মরতে  হবে  । গলায়  ফাঁস  দিয়ে   ঝুলে  পড়বে । অফিসে  তার কাজের  খুব নাম হয়েছে । বিবেকের  বাকী  জীবনটা    বিছানায়  শুয়েই  কাটবে    , অব্যয়ার দয়ায়  বেঁচে থাকতে  কেমন লাগবে  ? যারা তাকে  সংসারে  বাতিল  নোট  ভেবেছিল --- তাদের  চোখে  আচমকাই  সে  লটারি । কেননা  স্বামীর  আশ্রয়ে নয় , স্ত্রী  নিজের আশ্রয়ে  স্বামীকে  বাঁচিয়ে  রেখেছে  । 
আচ্ছা  এখন  যদি  না আত্মহত্যা  করে , বেঁচে  থাকে  ! সে  দেবতা  হবে  নিশ্চিত । এই  কথাটুকু  ভাবতেই অব্যয়ার  খুব আনন্দ  হচ্ছে  ।  
অব্যয়া ভাবল এই এতকিছুর  বদলে  নিজের চাকরি  করবার  জেদ সে রাখতেই পারে । আর বাকীরা তা শুনতে  বাধ্য । অন্তত  এই কারণের জন্য  আত্মহত্যার  মতন  এত  ছোট একটা  সিদ্ধান্ত পাল্টানোই  যায় ।
  খুব  দ্রুত  গিয়ে   টেবিলের  উপর  রাখা  চিঠিটা  নিজের  হাতে  নিয়ে  নিল  । খুব  দ্রুত  সরিয়ে     ফেলতে  হবে ...

( গল্পে  বর্ণিত   পুরাণ  ঘটনা  ‘পদ্ম পুরাণ ’  - এ  সম্পূর্ণ  উল্লেখ    রয়েছে ।  আমি সামান্য  অংশ লিখলাম । মাধুর্য  নষ্ট হয়ে  থাকলে  ক্ষমা  করবেন ।  এর  বিষদ   বর্ণনা  পুরাণেই  পেয়ে  যাবেন ।  আমার লেখা  কোন  সম্প্রদায়কে  আঘাত  করে  থাকলে  ক্ষমা প্রার্থী ।  )