নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

জন্ম লগ্ন : আমিনুল ইসলাম


উপত্যকায় উষ্ণতা বাড়লে পাপড়ি ঝড়ায় গোলাপ
কলাপাতার আন্দোলনে অনুভূত তোমার স্বত্তা
অনূদিত শব্দ সমন্বয়ে অথই চোখ উপছে পড়ে
পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনাই স্নায়ু জুড়ে উত্তাল।
ঢেউ আছড়ে পড়ে বুকে। বুকের গন্ধ শুকে ঘুমিয়ে পড়ে শিশু। জন্মদাগ আঁকা মায়ের জঠর,
আমার নখে মুখে লেগে আছে পাপের দুর্গন্ধ।
পুরুষ পশুত্ব ভুলিনি আজো, প্রত্যাশার প্রাচীর জুড়ে
গেঁথে থাকা আলপিন বেদনা জড়িয়ে রাখে।
ভয় ও শঙ্কা নিয়ে পেরিয়ে যায় কত শত মেয়েলি ১৮বছর।
আমি ৪৬শের কাঁচা পাকা চুলে মেলে ধরেছি বার বার
বারংবার শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির জন্ম লগ্ন।

চলেছি কোন পথে :- রাণা চ্যাটার্জী



যত বেশি স্বাধীনতা তত দেখছি এর অপব্যবহার।চায়ের দোকানে এঁটো বাসন মাজা ছেলেটার বাড়িতে ভাত ফুটানোর জোগাড় আছে কিনা ঠিক নেই,হকার দাদাটার কাল কি করে চলবে চিন্তায় নেই কপালে ভাঁজ কিন্তু পকেটে এন্ড্রয়েড মোবাইল আর ডেলি ফ্রি ডাটা মজুত। হোক আটা দামি বয়েই গেল,নেট দুনিয়ায় রগরগে ভিডিওর প্রতুলতা বুঁদ করে রেখেছে শিক্ষিত অশিক্ষিত ছোট বড় সকলকে। প্রকাশ্যে ঘুরছে যৌন উস্কানি ভিডিও রমরমা।অশ্লীলতার মোড়কে পণ্য জাত হচ্ছে নারী শরীর।এ যেন মগের মুলুক স্বাধীনতা,যখন যাকে খুশি যা খুশি ভাবে করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা আর বাধা পেলেই নোংরা তকমায় বিদ্ধ।

কি দেখতে হয় আর কি দেখার বয়স হয় নি এই লক্ষণ গন্ডি ধুয়ে মুছে সাফ। পরশু খবরে পড়লাম মফস্বল ছোট শহরে এক মধ্য বয়স্ক ঠান্ডা মাথায় প্রতিদিন বিভিন্ন বাড়ি ঢুকে মহিলাদের খুন করতেন আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন। শিশুদের মধ্যেও বাড়ছে ভয়ঙ্কর অপরাধ প্রবণতা।স্কুল বাচ্চা প্রায়শই ধর্ষণের শিকার,সদ্যজাত ঝলসে উঠছে লালসার আগুনে,বৃদ্ধা হোক মধ্যবয়সী সে হোক নান কিংবা ভিখারি সবাই টার্গেট এই নর পিশাচ আবহাওয়ায়।তবে কি  কোথাও  নিরাপদ নয় আমরা,আমাদের মহিলা,শিশু কন্যা মহল?

কিসের আমাদের বড়াই তবে?রুচি সংস্কৃতির দোহাই। দেওয়াল জুড়ে মনীষী দের বাণী নিভৃতে কাঁদে।সদা জাগ্রত প্রশাসন কি করবে মনের মধ্যে যদি অপরাধ প্রবণতার বিষাক্ত লেলিহান আষ্টেপৃষ্টে বাঁধে আমাদের। সম্প্রতি ফুলের মতো একরত্তি শিশু তিন বছরের টুইঙ্কেলকে যেভাবে নৃশংসতার সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় খুন করে  ফেলে দিয়ে যাওয়া হলো শিহরণ বয়ে গেল ঠান্ডা রক্ত স্রোতের।দেখ কেমন লাগে আর কত ভয়ঙ্কর হতে পারি আমরা এই বার্তা  প্রকাশ্যে খুল্লম খুল্লা ছোবল মারছে। "দেশ বাঁচাও বেটি বাঁচাও স্লোগানের ছত্রছায়ায় মা বাবার স্নেহ ভালোবাসায় হাসি খুশিতে বড়ো  হওয়া শিশু কন্যা যার বাড়ির  উঠোন জুড়ে  এখনো পাবে হরেক খেলনা বাটি,পুতুল ঘর কন্না। কানে বাজছে বাঁশি লাগানো জুতোর পিক পিক শব্দ।কিন্তু কোথাও নেই,হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গেল তাকে এক ডাস্টবিনে না চিনতে পারা ছিন্ন ভিন্ন  টুকরো হয়ে নৃশংশতার  স্মৃতি চিন্হ মেখে এক তাল রক্তাক্ত মাংস পিন্ড হয়ে।

মানুষ কখনো এভাবে ঐ টুকু বাচ্চা কে শ্রীখন্ডি করে মা বাবাকে শিক্ষা দিতে এতটা বীভৎসতার নজীর সৃষ্টি করতে কি  পারে ভাবতে অবাক লাগছে।কিন্তু কি অপরাধ মা বাবার? 
প্রায় দশহাজার টাকা ধার নিয়ে অভাবের সংসারে শোধ করে উঠতে পারছিল না  তারা। চেষ্টা চলছিলো যত জলদি  টাকা দিয়ে দিতে পারে হুমকি ভয় ,নোংরামি থেকে মুক্তি।কিন্তু কি পেলাম আমরা? অসহায় মা বাবাকে শিক্ষা দিতে তাদের তিন বছরের ফুলের শিশু টুইঙ্কেল কে তুলে নিয়ে গিয়ে চোখ,চুল উপড়ে, গায়ের চামড়া চেঁছে,শরীরের সব অঙ্গ বিকৃতি বা গায়েব করে ফেলে দিয়ে গেছে বাড়ির কাছে।শ্বাস নালি,কিডনি,যৌন অঙ্গ সব কিছু তছনছ যে আসলে সমাজের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসানো পেল্লাই চড়।

ভাবতে অবাক লাগে কোন মায়ের কোলে জন্মেছিল এই কুলাঙ্গার গণ, তাদের কি বাড়ি,পরিবার সন্তান বলে কিছুই নেই। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ কে ফোঁপড়া করে বহাল তবিয়তে দিন গুজরান কিছু মহান চোরের, আর সামান্য কিছু টাকা ধার নিয়ে এ এমন পাশবিক ঘটনার সাক্ষী হওয়া তাও নিজের সন্তানকে এভাবে দেখা কি যায় ,না সম্ভব কখনো?আবার আমরা মোমবাতি জ্বালাবো,শোক প্রস্তাব পাঠ করে মৌন মিছিলে হাঁটবো কিন্তু পারবো না সমাজটাকে নিরাপদ আশ্রয়ে মুড়ে রাখতে,এই সুন্দর সমাজকে ফুলের মতো শিশুদের বাসযোগ্য করে তুলতে । তাই আর কিছু চাইনা,স্তব্ধ হোক লোকদেখানি এই  প্রতিবাদ ,সহানুভূতি।

-হাজার ভগ্নাংশে! -শিবিনী বাগচী



শ‍্যাওলার আস্তরনে চাপা পড়ে গেছে,
গলা পচা সমাজের সস্তা নৈতিক বোধগুলো!

রোষের দাবানলের ঝাঁঝালো গন্ধে
মিশেছে মৃত‍্যুর হাহাকার!

মায়ের বুক থেকে উপড়ে নেওয়া
হৃদয়টাকে খন্ড দিয়েছে বার বার!

ছিনিয়ে নেওয়া মৃত‍্যুর অমোঘ
ছটফটানীর কাতরে ওঠা চিৎকারে -
মায়ের প্রসব কালীন যন্ত্রণা আছড়ে পড়ে!

যেন দূরন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনে
জলন্ত অঙ্গারে কয়লা ঠেলা আর্তনাদ;
আকাশ বাতাস করেছে তোলপাড়!

হিংস্রতার নগ্ন মূল‍্যবোধ নিকশ কালো অন্ধকারে,
নেশা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে
ভালো লাগা কোনাগুলোর পরতে পরতে!

খুঁড়তে খুঁড়তে একদিন হয়তো আমরাও খুঁড়ে ফেলবো
নরপিশাচদের অস্তিতকে খন্ড দিয়ে হাজার ভগ্নাংশে !!

শেষে কী পেয়েছো,,,,, সুরভী ইসলাম





না জানি কবে থেকে আমি,
একটি আস্ত মেঘের মুখ দেখিনি
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ,আমার বুকের
উপর কত দিন নামেনি।

সেই কবে যেন শিকড়গুলো
উপড়ে ফেলে ছিলো যে,
নতুন করে গাছ লাগাতে
আর ফেরেনি তো সে।

গরম লুএর ছোঁয়ায় আমার বুক ক্রমশ ফাটছে!
হাহাকার করছে যারা ঐ খালি পায়ে হাঁটছে ।
কেউ কি আটকাইনি তাদের,
নাকি ওরা কারও কথা শোনেনি?
বন জঙ্গল কাটছে বেদম,
এখনো কি কিছুই বোঝেনি?

নাজানি কবে থেকে,
আমি একটি পাখির মুখ দেখিনি।
সে যে দল বেঁধে সব রওনা দিয়েছিলো,
সেকি! এখনো তো তারা ফেরেনি ?
সকাল বিকেল দিঘির ধারে বসতো তারা এসে।
ওদের কথা শোনা যায়না আর,
গেছে দিঘির জলে ভেসে।

দিনের  পর দিন পৃথিবীটা আমার ,শুধু ব্যথায়  কাতরাচ্ছে ।
আমার বুকের  ভেতর গর্ত করে ,তারা এখোনো হাতড়াছে।

তেল ,কয়লা,সোনা,রুপা ,খুঁড়ছে সবাই , ভাবছেনা কেউ!!!
গলছে হিমবাহ ,ফুলছে সাগর,উঠছে সুনামি ঢেউ । । ।

কোন্ ভবিষ্যতের  কথা ভেবে সব এড়িয়ে তুমি  চলেছো?
একবার ঘুরে তাকিয়ে  দেখো পেছোনে কী তুমি ফেলেছো। ।

সেই সবুজের দেশ,শিতল হাওয়া,মিষ্টি  পাখির ডাক,
শেষ কবে শুনেছো,কবে বৃষ্টিতে ভিজেছো,বলো শেষে কী পেয়েছো? 

ঈশ্বর সব জানেন,,,, অযান্ত্রিক



ওই যে চৌখুপ্পি ঘর, বিস্কুটের মতো বারান্দা,ঠিক ওই খানেই,
ইস্কুল খুলেছেন আমার ঈশ্বর,
মানুষ ওখানে বাঁচার তরীকা শিখতে আসে,
লক্ষ্যে পৌঁছানো শিখতে আসেন।

সবার কাঁধের উপর রাখেন হাত,
বলেন সোজা করো পাঁজর ধনুক।
বলো কি দেখতে পাও, ঘর বাড়ি,
হাসপাতাল অফিস কাছারি।

শিষ্য বলে ওঠে সব ,সব দেখছি হে প্রভু,
ঈশ্বর বিস্মিত হন,তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানো হলোনা।
একজন আসেন ,বলেন আমি শুধু লক্ষ্য দেখছি,
পাখির নীল চোখ,খরগোশের লেজ,
তাহলে চালাও, ইচ্ছের তীর,
কেটে যাক বন্ধুর মাথা ,মায়ের কান্না ,
তুমি থামবেনা,ছুঁড়ে যাবে তীর।
তোমাকে লক্ষ্যে পৌঁছুতেই হবে,

হায়, ইশ্বর লক্ষ্য বোঝেন ,দুঃখ বোঝেন না।

অপমৃত্যু -সুকান্ত ঘোষ



চায়ের ভাঁড়ে দীর্ঘ একটা ফু দিয়ে খানিক্ষণ চুপ থেকে অনেকটা উষ্ণ বিস্ময় নিয়ে এবার রাহুল প্রশ্ন করল।

-"থিয়েটার ছাড়ছিস কেন?"

সমীর কোনো উত্তর দিলো না, আর্দ্র চোখে শুধু চুপ করে রইল।

-"কিরে, চুপ থাকিস না, বল।"

রাহুল আবার প্রশ্ন করল। সামনে থেকে এবার উত্তর এল।

-"এমনি...."

-"কী এমনি? '১৭ ই জুলাই'-তে তোর অভিনয় সবার খুব পছন্দ হয়েছিল। সবাই তো তোর কতো নাম করল, আর তুই কী না...."

-"সেটা তো ছোটো চরিত্র....."

-"মানে? ছোটো চরিত্র পেলি বলে দল ছেড়ে দিলি? অন্য দলে নাম লিখিয়েছিস বুঝি?"

-"না সেটা না...থিয়েটার আর করব না।"

-"সেটাই তো বলছি, করবি না কেন?"

-"এমনি..."

রাহুল ধৈর্যের মাত্রা খানিকটা সামলে পায়ের আঙুল কচলে, ভুরু দুটো ঘনিষ্ঠ করে আবার প্রশ্ন করল।

-"তোর কী হয়েছে বলতো? এই তো 'গাজনা চড়ের বাজনা' আর 'কপিকলে'-এ বড়ো দুটো চরিত্র পেলি, এমনকি স্যার বলেছেন পরের নাটকে তোকে লিড ক্যারেকটার দেবেন। এতো ভালো একটা সুযোগ সামনে, আর তুই বলছিস থিয়েটার ছেড়ে দিবি?"

-"হ্যাঁ..."

-"কী হ্যাঁ? তাহলে 'অনার্য বার্তা'-র কী হবে? সামনের মাসেই সো, অভিমন্যু কে করবে?"

-"জানি না.."

-"তার মানে সত্যিই থিয়েটার আর করবি না?"

-"হ্যাঁ"

-"তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?"

-"হ্যাঁ.."

-"ধুর্! সত্যি তোর মাথাটা গেছে, যা সাইক্রাটিস্ট দেখা, তোর সাথে কথা বলাই বেকার, যা খুশি কর.........."

এবার রাহুল ধৈর্য হারাল, চায়ের ভাঁড়াটা পোস্টের গোড়ায় সজোরে ছুড়ে আর কিছু শোনার অপেক্ষা না রেখে সোজা চলে গেল সদনের দিকে, রাহুলের কথা গুলো ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে হাওয়া মিলিয়ে গেল।

সেই ভাঁড়ের টুকরো গুলোর মতো না বলতে পারা কতগুলো টুকরো কথা কুড়িয়ে মনের এক পাশে তুলে রাখল সমীর। একাডেমীর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিঃশব্দে ভালোবাসা জানিয়ে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বুকে চেপে সোজা চলে গেল ক্যাথিড্রাল রোড ধোরে ময়দানের দিকে।

আজ সাত বছর হল সমীরের বাবা মারা গেছেন। এতোদিন মা সংসারের হাল টেনেছেন, ওদের দুবেলা খাইয়ে, পড়ালেখা শিখিয়ে বড়ো করেছেন। মা এখন অসুস্থ, তাই আর পারেন না। সমীরের একটা ভাই আছে, ওর থেকে দু-বছরের ছোটো, সে কাজ করে, সংসার চালায়। ওরা বেলগাছিয়ায় একচালা একটা টালির বাড়িতে ভাড়া থাকে। সংসারে সমীর বেশি টাকা দিতে পারেনা। থিয়েটার করে কতই বা ওঠে? অথচ যা পায় সবটাই নিঙ্গরে দেয়। তবুও কিছু মানুষের কাছে সমীর নিষ্ঠুর, তারা অগোচরে সমীরের নাম করে- "কোনো মুরোদ নেই। মা, ভাইকে খাটিয়ে মারে, কাজ নেই বাজ নেই খালি রং মেখে সং সাজা।" এসব কথায় সমীর নিষ্ক্রিয়। বুকের ভেতর এসব ভাঙা ভাঙা কষ্টের স্তূপ সাজিয়ে সে সারাক্ষণ অভিনয় করে, কী জীবন্ত সেই অভিনয়।

মামার হাত ধরে সমীরের থিয়েটারে আসা। সেই ১৩ বছর বয়স থেকে ও থিয়েটার করছে, মামার কাছেই অভিনয় শেখা। আজ আর মামা নেই। এই ৯ বছর সমীর থিয়েটারকে ভালোবেসে থেকেছে। এতোদিনে বেশ নাম-ডাক-খ্যাতি পেয়েছে। আর কতো মানুষ দেখেছে, কতো মানুষ সেজেছে, কতো শিক্ষা পেয়েছে, কতো অভিজ্ঞতা কুড়িয়েছে। আজ থেকে সে আর কিছু কুড়োতে যাবে না সেখানে। "থিয়েটার এবার ছাড়তে হবে।"

সমীর নিজেকে প্রশ্ন করে। "এই ভাবে আর কত দিন?শেষে মা-ভাইকে না খাইয়ে মারবি? আরে আমাদের জীবনটা থিয়েটার নয়। এখানে অনেক নাটক নেই, এখানে শুধু একটাই নাটক, বেঁচে থাকার নাটক, খেয়ে-পোরে কোনো রকম বেঁচে থাকার নাটক। আর না, এবার স্টেজ ছেড়ে বাস্তবের অডিটোরিয়ামে নেমে আয়, আর দেখ যারা অন্ধকারে বসে আছে, এখন আর কেউ তোকে দেখছে না, তোকে কেউ চেনেই না, কে তুই? সবাই শুধু হা করে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখছে কতো গুলো রংচঙে মিথ্যা মানুষ আর তাদের মিথ্যা অভিনয়। স্টেজে তুই তাদের মতোই একটা মিথ্যা মানুষ, ওরা ওই মিথ্যা মানুষটাকে চেনে। গ্রিন রুমের এই সত্যি মানুষটাকে কেউ চেনে না। ওরা শুধু মিথ্যা ভালোবাসে, সত্যিটাকে কেবল অবজ্ঞা করে। কাজ কর, সংসার চালা, থিয়েটার নিয়ে বাঁচিসনা। ওটা মিথ্যা জীবন..."

"থিয়েটার ছেড়ে দেব? একদিন যে থিয়েটারের জন্য সব ছেড়ে এসেছিলাম আজ সেই থিয়েটার ছেড়ে দেব? কার জন্য?"

সমীরের মনের ভিতর একটা বর্ণহীন দ্বৈত-মানসিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। একদিকে অভাববোধ, সাংসারিক-বাস্তবতা, ঘরের অন্ধকার আর অন্যদিকে রঙ্গমঞ্চ, থিয়েটার, সটেজের আলো। সমীরের বুকের ভিতরটা শূন্য হয়ে আসে, এ কোথায় এসে পড়ল সে? আজ বাবার কথা খুব মনে পড়ছে তার। বাবার না থাকা আজ তাকে আরো বেশি একা করে তুলেছে। চোখের সামনে শুধু ভাসছে অসুস্থ মায়ের সেই আশার মুখ, "আমি না থাকলে ভাইটাকে দেখিস..." সমীর আর সামলাতে পারে না নিজেকে, বুকের ভিতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে সে। এতো একা সে কোনোদিন ছিল?

সেদিনের পরে আজ অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। সমীর সত্যিই থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে একটা সামান্য চাকরি করে, যা মাইনে পায় তাতে মোটের উপর শুধু সংসারটাই চলে যায়। ৯টা-১০টার ডিউটি। একই জায়গা, একই ঘর, একই চরিত্র, একই অভিনয়। আর কতো গুলো একই অস্পষ্ট মানুষ, কেউ কারোর সাথে তেমন কথা বলে না, সবাই চুপচাপ কেমন যেন নিজেদের মুঠো করে রাখে। সবকিছু কেমন গতানুগতিক। এসব আর সমীরের ভালো লাগেনা, তবুও সে বিরক্ত হয় না। আজ ও সেই সব পেয়েছে যা ও কোনোদিন চায়নি। এখন সমীর আরো বেশি একা। সে থিয়েটার ঠিকই ছেড়েছে কিন্তু অভিনয় ছাড়েনি, ছাড়তে পারেনি, সে এখনো অভিনয় করে চলেছে নিজের সাথে, ভালো থাকার অভিনয়, বেঁচে থাকার অভিনয়। আর হাতরে বেড়াচ্ছে নিজেকে, দৈনন্দিনের ভিড়ে যে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।

সমীরের মতো মধ্যবিত্ত কি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের জীবনেটা একটা রুক্ষ মস্ত রেল লাইনের মতো, দুটো লাইন সোজা গিয়ে একটা বিন্দুতে মিশেছে, যত এগোনো যায় বিন্দুটা তত সরে সরে যায়। গন্তব্যহীন একটা দীর্ঘ পথ, এই পথের কোনো শেষ নেই, সামনে যা পিছনেও তাই, অতীত যা ভবিষ্যতও তাই। চলার পথটাই শুধু আছে, একটা নিরবচ্ছিন্ন আশা আর কিছু বিষণ্ণ সংশয় নিয়ে হেঁটে যাওয়াই সার। অভাব, পরিস্থিতি আর বাস্তব এই ভাবেই গ্রাস করে কতো স্বপ্ন, ইচ্ছে আর আনন্দ। জীবনের সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে মিশে থাকা এই কদর্য অগ্রাহ্য রেল লাইনেই কাটা পড়ে কতো স্বপ্ন আর অভাব তাড়িত প্রতিভা। আর এই ভাবেই প্রতিনিয়ত অপমৃত্যু