নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

বিদ্যাসাগর,, তোমায় প্রণাম :অনোজ ব্যানার্জী




  ‎
ওরা কালো শকুনি,,চেনে শুধু ভাগাড়ের পচাগলা মাংস,, হীরের মর্ম কেমন করে বুঝবে? জহুরী তো নয়,যে জহর চিনবে! ওরা অসুর, ওরা নররাক্ষস, ওরা অর্থলোভী নরপিশাচ,,।। রাজনীতি,,    মানবকল্যানের নীতি।ওরা,, রাজনীতির কী জানে?? মানবজাতির কলঙ্ক ওরা,,কে ওদের মানে??
তাই ওরা স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে,,আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে করে সবকিছু ছারখার। তাই ওরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কার করেছে চুরি। ভেঙে দিয়েছে নির্মমভাবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মূর্তি। আগুন ধরিয়ে করেছে কত স্ফূর্তি। যে বিদ্যাসাগর  মহাশয়ের কৃপায় আমরা শিখেছি বর্ণমালা। যিনি বন্ধ করেছেন ঘৃণ্য সতীদাহপ্রথা। যিনি চালু করেছেন বিধবাবিবাহ। কোন দুর্নীতির কাছে কোনোদিনও তাঁর মাথা করেননি নিচু।
তিনি করুণাসাগর,,তিনি বিদ্যাসাগর। তিনি বাংলামায়ের প্রকৃত বীরসন্তান।বীরসিংহের সিংহশিশু। ভারতমাতার গর্ব। উচুমাথা তাঁর আমৃত্যু রেখেছিলেন উঁচু। গরীবের দুঃখে,কাঁদত তার কোমল হৃদয়। করতেন সেবা,অনাথ,,দীনহীন মানুষদের। বিদেশী ইংরেজদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন রুখে, বীরবিক্রমে। সমাজসংস্কারক, মহান পুরুষ তিনি। প্রকৃত সৎ,ভদ্র,,বজ্রের মত কঠোর,,কুসুমের মত কোমল ছিল তাঁর চরিত্র।
প্রকৃত ঈশ্বর তিনি।,,দেবতা,,ভগবান,
উপার্জিত অর্থের বেশিরভাগই দুহাতে করেছেন দান।  এই যুগে এই পৃথিবীতে কে আছেন এমন সুমহান??নারীশিক্ষা করেন প্রচলন  , করেছেন কত স্কুল,,কলেজ স্থাপন। দানসাগর তিনি,করেছেন কতকিছু অকাতরে দান।



ভারতমায়ের এই চরমতম দুর্দিনে,,হে ঈশ্বর,,হে ভারতরত্ন,,  হে সত্য-ধর্ম -মানবতার পূজারী,, তুমি এসো আবার ফিরে, এই ধরণীমায়ের কোল আলো করে। আমরা আছি বসে
তোমার অপেক্ষায়,। কবে আসবে তুমি??

সেই রাতে বৃষ্টি এসেছিল : দীপঙ্কর ঘোষ









আমি গ্রামের একটি হাইস্কুলে চাকরি করি।বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব আঠারো কিমি।কিন্ত সমস্যা হল স্কুলে যাওয়ার কোনো বাস রুট নেই।অগত্যা আমাকে ছুটতে হয় আমার দু চাকায় ভর করেই।শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা,ওই দুই চাকাই ভরসা।যাবার পথে প্রকৃতি যেন ডানা মেলেছে তার আপন খেয়ালে।আগে ছিল কাঁচা মেঠো পথ।সম্প্রতি ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী গ্রামীন সড়ক যোজনায় পাকা রাস্তা হয়েছে।সেই কংক্রিটের রাস্তায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে অধঘন্টায় পৌঁছে যাই গন্তব্যে।রাস্তার দুপাশে কোথাও আনারস,কোথাও চায়ের বাগান।কোথাও সারি সারি বাঁশ বন।আর কোথাও কোথাও দেখা যায় মরসুমি বিভিন্ন শস্যের চাষ।

সেই বছর শীতকাল।মাঘ মাসের কনকনে শীতের দিন।খুব জাঁকালো শীত পড়েছে।এরই মধ্যে পরে গেল স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।ওইদিন সকাল ন'টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছে গেলাম।সারাদিন দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটল।খেলাধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সবশেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।আমরা শিক্ষকরা স্কুল থেকে বের হবো, ঠিক সেই সময় এলে ঝেপে বৃষ্টি।শীতকাল।এইসময় বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে।সুতরাং কারো কাছেই রেইন কোর্ট নেই।উপায় নেই, দাঁড়িয়ে যেতে হল।বৃষ্টি কখন থামবে?বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা।কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।মেঘের গর্জন বাড়তে লাগলো ক্রমশ।শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি যখন থামল,তখন ঘড়িতে রাত নয়টা।

বেরিয়ে পড়লাম।ভিজে রাস্তা।অন্ধকার,চারদিক শুনশান।একটা কুকুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।কোথাও একবিন্দু আলোর চিহ্ন নজরে পড়ছে না।একলা নির্জন পথে একা চলছি এতরাতে।এতবছর চাকরি হয়ে গেল,কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম।বাইক ছেড়েছি প্রায় আশি কিমি/ঘন্টা গতিতে।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিস্তা ক্যানেলের কাছে চলে এলাম।দূর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম ক্যানেলের ব্রিজটা যেখানে শেষ,সেই জায়গায় একটা আবছায়া,একটা ফ্যাকাসে মূর্তি।বুঝতে পারলাম কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।কাছাকাছি আসতেই হেড লাইটের আলোয় দেখলাম একটি কুড়ি-একুশ বছরের অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে।মেয়েটা এতই সুন্দর যে,এই ঘন অন্ধকারের মধ্যেও ওর গায়ের উজ্জ্বল রঙ একটা আলাদা মাত্রা এনেছে।মুখে যেন হাজার ওয়াটের আলোর ঔজ্জ্বল্য।কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগল,এই অন্ধকার নির্জন পথে একাকিনী একটি মেয়ে এখানে কি করছে?কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল, একটু লিফট পেতে পারি।এর পর আমাদের মধ্যে যে কথপোকথন হল তা এই প্রকার--
--এত রাতে আপনি একা এপথে?কোথা হতে এসেছেন আর যাবেনই বা কোথায়?
--আর বলবেন না ,গিয়েছিলাম কলেজে।রাস্তায় একটা পথ দুর্ঘটনায় প্রায় তিন ঘন্টা আটকে পড়েছি।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ পৌচ্ছেছি এখানে ওই যে পেছনে যে বাজারটা সেখানে।কিন্তু তারপর শুরু হল বৃষ্টি,আর এতক্ষনে থামল।এতরাতে এই পথে   যাবার মতো কোনো মাধ্যম নেই।তাই হাটতে শুরু করেছি।
--যাবেন কোথায়?
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটি আমাকেই জিজ্ঞাসা করলো–-আপনি কোথায় যাবেন,?
-- বিধাননগর যাবো।
শুনে মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে বলল,--
তাহলে আমি আপনার সাথে পারি।
--পারেন অবশ্যই।কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন সেটা তো বললেন না?
এবার মেয়েটি বলল,--চলুন না,আপনি নাম বললে চিনবেন না।
--বলেই দেখুন।
--দেরামারি মোড় থেকে...
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম--এটা না চেনার কি আছে,এই জায়গাটা তো আমার ফেরার পথেই পরে।
মেয়েটা কিছু বললাম না,শুধু মুখে দেখলাম একটা হাসি খেলে গেল।তারপর বাইকের পিছন সিটে উঠে বসে বললো---চলুন ,এখানে আর দেরি করবেন না।রাত অনেক হয়েছে।রাস্তাটাও ভালো নয়।
আমি বাইকে স্টার্ট দিলাম।ভিজে রাস্তা।অন্ধকারও আরো ক্রমশ গভীর হচ্ছে।ধীরে ধীরে বাইক চালাচ্ছি।আমি কৌতূহলের সঙ্গে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম যে,আপনি বললেন রাস্তাটা ভালো নয়।কেন?
সে কিছুই বললো না।কিছুক্ষন পর বললো শুনেছি এই রাস্তায় মাঝে মাঝেই ডাকাতি-খুন ইত্যাদি হয়ে থাকে।আর আপনি তো অনেক দূর যাবেন,শুনেছি এই রাস্তায় ভূতেরও উপদ্রব আছে।
আমি জোরে জোরে একচোট হাসলাম তারপর বললাম যে আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এসেও আপনি এই ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন?
মেয়েটি কিছুই বললো না ।
আমি এবার বললাম যে, হ্যা শুনেছি এই রাস্তায় ডাকাতি,-ফাকাতি হয়।তবে আমার কাছে কি-ই বা আছে।এই বলে হো হো করে হাসলাম।তবে মনের মধ্যে এতক্ষনে একটা ভয় উঁকি দিতে শুরু করেছে।শেষে না আবার ডাকাতের পাল্লায় পরি।গল্পে গল্পে প্রায় দুই-তিন কিমি পথ এগিয়ে গেছি।অনেকক্ষণ হলো মেয়েটা কোনো কথা বলছে না।কি ব্যাপার কিছু বলছেন না যে...
কোনো উত্তর এল না।
--ভয় পেলেন নাকি?
না কোনো সাড়া নেই।আমি ঘাড়টাএকটু ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।আমি তো অবাক!মেয়েটি কোথায়?
ব্রেক করলাম ।বাইক থেমে গেল।চারদিকে চেয়ে দেখলাম ।না,কেউ কোথাও নেই।আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।কি মনে হল বাইকটা ইউ-টার্ন করে আবার যে পথে এতক্ষন আসছিলাম,সেই দিকেই চললাম।মনের মধ্যে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগলো--মেয়েটি কোথায় গেল?
সন্দেহ হল পরে-টরে গেল নাকি?
আবার ভাবলাম বাইক তো খুব বেশি গতিতেও চালাইনি কিংবা এত বড় একটা মেয়ে পেছন থেকে পড়ে যাবে আর আমি বুঝতে পারবোনা--এও কি সম্ভব!যাইহোক,কিন্তু মেয়েটি কোথায়?এইগুলো ভাবতে আবার ক্যানেলটার সামনে পৌছালাম।অবাক কান্ড!যেখান থেকে মেয়েটিকে বাইকে তুলেছিলাম,মেয়েটি সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।আমি মেয়েটির সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে বললাম;-
আপনি এখানে কি করে এলেন?
--মানে?মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
--কিছুক্ষন আগে আপনি আমার বাইকে চড়লেন, বললেন আপনার বাড়ি সামনেই কোথায় যেন?আপনি লিফট চাইলেন।তারপর যেতে যেতে কত কথা হল!
মেয়েটি যেন আকাশ থেকে পড়লো আমার কথা শুনে!তারপর বলল--আপনার কাছে আমি লিফট চেয়েছিলাম সত্য,কিন্তু আপনি তো বললেন আপনি ওই পথে যাবেন না।আপনি চলে গেলেন।আর এখন আবার ফিরে এসে কি পাগলের প্রলাপ বকছেন।আমার মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল, সবকিছু এলোমেলো মনে হতে লাগলো।কেমন যেন সব তাল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আমি শান্তভাবে আবার বললাম--আপনিই তো বললেন এই রাস্তায় ডাকাত,ভুত কত কি!আর এখন বলছেন---
আমার কথা শেষ হতেই মেয়েটি হি হি করে হেসে উঠলো।আমি রাগত স্বরে বললাম--
যেতে চাইলে চলুন নয় তো থাকুন এখানে।এই বলে আমি গাড়ি স্টার্ট দিতেই মেয়েটি এসে বাইকে বসলো।

আবার চলতে শুরু করলাম।আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেল।বাজ পরা শুরু হয়েছে।অন্ধকার যেন গিলে ফেলতে চাইছে।এক কিমি এগোতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো।কিন্তু দাঁড়ানোর মতো কোনো জায়গা দেখতে পাচ্ছি না।বৃষ্টির বড় বড় ফোটায় বাইক চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।কোনো ক্রমে কয়েকশ মিটার এগিয়ে গেলাম।চা বাগানের একটা ছোট্ট টং ঘর দেখতে পেলাম।ইতিমধ্যেই ভিজে গেছি দুজনেই।ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলাম।ওই ঘরেই আশ্রয় নিলাম।অনেকক্ষন হল সিগারেটের খুব নেশা হয়েছে।পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম আছে একটা।কিন্তু দেশলাইটা জলের ছাটে ভিজে গেছে।অনেক কষ্টে সিগারেটটা ধরলাম।মেয়েটি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো।বললো ফেলুন।ফেলে দিলাম।অপেক্ষা দীর্ঘ হল।মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো--
জানেন এই রাস্তায় রাতের অন্ধকারে একটি খুব সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পাওয়া যায় বলে অনেকে বলে থাকেন।লোকে বলে,আসলে ওটা নাকি একটা ভূত!
একথা শুনে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।কেঁপে উঠল সারা শরীর।আমার মনে একটা কুচিন্তা এসে ভর করলো।এখন রাত আর আমি  একটা অত্যন্ত রূপসী একটি মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি জনশূন্য এক চা বাগানের টংঘরে।তাহলে কি?!!তীব্র শীতের মধ্যেও আমি ঘামছি। আমি হতভম্বের মতো মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।মেয়েটা বললো ,আমার দিকে এমন করে চেয়ে আছেন কেন!আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম আপনিও তো যথেষ্ঠ সুন্দরী।তাহলে...।আমার কথা শেষ না হতেই মেয়েটা  হা হা করে হেসে উঠল।বললো-আপনি কি আমাকে!আরে মশাই...
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,না না তেমন কিছু ভাবছি না।একটু মজা করছিলাম আর কি!আপনি কেন... ইতিমধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেছে আমি খেয়াল করিনি।মেয়েটি বললো,কি ব্যাপার, এখানেই থাকবেন নাকি?চলুন...
হ্যাঁ, চলুন বলে বাইকে এসে বসলাম দুজনে এবং চলতে লাগলো বাইক কখনো ধীরে, কখনো একটু জোরে।মাঝে মাঝে রাস্তার পাশের গাছ থেকে জল ছিটকে গায়ে এসে পড়ছে।ঠান্ডা লাগছে খুব।মেয়েটিও দেখছি ঠান্ডায় কাঁপছে এখন।কারো মুখেই কোনো কথা নেই।হঠাৎ একটা শব্দ হল।কিন্তু  কিসের বুঝতে পারলাম না।কিছুক্ষন যেতেই আবার একই শব্দ হল।এবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, শব্দটা কিসের,আপনি কিছু বুঝতে পারছেন?উত্তর পেলাম না।কিন্তু কাঁধে মেয়েটির হাতের স্পর্শ পেলাম।কি ব্যাপার ঘুমিয়ে গেলেন নাকি?না, তবুও কোনো উত্তর পেলাম না।বাইক থামিয়ে দিলাম।একি ব্যাপার আবার কোথায় গেল মেয়েটা!?ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।!কি হচ্ছে আমার সাথে!আমি ঘাবড়ে গেলাম।মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে,কোনো ভুতের খপ্পরে পড়লাম নাকি?ভাবছি মেয়েটাকে খুঁজতে যাবো, না চলে যাব সোজা।প্রথমে ভাবলাম চলেই যাই, যা হয় হোক।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এত রাতে এই নির্জন পথে একা একটি মেয়েকে ফেলে যাওয়া উচিত হবে না।অতঃপর আর সময় নষ্ট না করে বাইকটাকে ইউ-টার্ন করলাম।সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে কানে ভেসে এল--কি হল!আবার বাইক ঘোড়ালেন কেন!
আমি তো এবার একেবারে থ!নিজের চোখ না নিজের কান--কাকে বিশ্বাস করবো।পিছনে ফিরে দেখি মেয়েটা বাইকের সিটেই বসে আছে।আমি নিজের চোখ কচলে বললাম যে,আমি যে আপনাকে কতবার জিজ্ঞাসা করলাম ,শব্দটা শুনতে পেলেন!ওটা কিসের শব্দ!আপনি কোনো উত্তর দিলেন না।আর তারপর দেখলাম আপনি বাইকের সিটে নেই!
মেয়েটি যেন বিরক্ত হল আর বললো, কি যে হয়েছে আপনার!সেই থেকে কি সব আবোল তাবোল বলছেন।আমি আপনার সঙ্গেই বসে আছি আর আপনি আমাকে খুঁজতে যাচ্ছেন.... হা হা হা...
কি আর বলবো।চুপ করে গেলাম।কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা ছোট্ট গ্রামে এসে পৌছলাম।জিজ্ঞাস করলাম, আপনি তো এখানেই নামবেন বলেছিলেন?
--না।
--এই গ্রামেই তো আপনি থাকেন বলেছিলেন।
--না,মানে ঠিক এই গ্রামে না।
--তবে কোথায়।
--এখান থেকে তিন কিমি আগে যে বাঁশ বন আছে, ওই খানে।
--ওখানে তো শুধু বাঁশ বন।কোথাও তো বাড়িঘর দেখিনি।
--আছে,ওই বাঁশ বনের পেছন দিকে।আপনি হয়তো খেয়াল করেননি।
--হয়তো।
পাঁচ-সাত মিনিটেই বাঁশ বনের কাছে চলে এলাম।মেয়েটি বললো--আমাকে এখানে নামিয়ে দেন।চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম,কোনো বাড়িঘরের কোনো চিহ্ন নেই।আশেপাশে কোনো গ্রাম আছে বলেও মনে করতে পারছি না।চারদিক যেন অন্ধকারের সমুদ্রে ডুবে আছে।মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।একটা তাঁরাও দেখা যাচ্ছে না।আমি ওকে বললাম, এখানে কোথায় যাবেন?এখানে তো....
আমার কথা শেষ না হতেই বললো, আরে আছে ।আমি তো এই বাঁশ বনের পেছনেই থাকি।বললাম তো গ্রাম আছে ওখানে।এদিক থেকে দেখা যায় না।এই যে সামনে পথটা দেখতে পাচ্ছেন,ওই পথেই...
সামনে একটা পায়ে হাটা পথের চিহ্ন দেখতে পেলাম।
মেয়েটি নেমে গেল।কয়েক পা এগিয়ে গেল।তারপর থমকে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো।তারপর আবার ফিরে এলো।আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম।বললো,একটা কথা বলবো?
--বলুন
অনেক রাত হয়ে গেছে।আমি মেয়ে মানুষ একা যেতে একটু ভয় করছে।আর তাছাড়া, সামনে একটা মোড় আছে যেখানে রাতে মাতালদের আড্ডা বসে।তাই বলছিলাম যে,অনেকটাই তো সাহায্য করলেন যদি আর একটু করতেন।যদি আমাকে আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন,তবে খুব উপকার হত।
আমারও জায়গাটা ভালো লাগছে না।আর আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল যে, এই এত রাতে মেয়েটিকে এই বাঁশ বনে ছাড়া ঠিক হবে না।তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম।মেয়েটি নামার পর চলে যাইনি।সূতরাং, বাইকটা রাস্তার ধারে রেখে, লক করে আমি সেই হাঁটা পথে বাঁশ বনের ভেতরে যেতে লাগলাম।কোনো আলো নেই,কোনো শব্দ নেই।শুধু মাঝে মাঝে বাঁশ গাছের জল পড়ছে তার টুপটাপ শব্দ।আর আমাদের দুজনের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল হাঁটছি।কিন্তু না এখনো কোনো গ্রাম বা বাড়ি দেখা যাচ্ছে না।আমি মেয়েটিকে বললাম,কোথায়,আর কতদূর তোমার বাড়ি!
--সামনেই।
তারপর আবার আমরা চুপচাপ হাটতে থাকলাম।তারপর মেয়েটি বললো, আচ্ছা আমরা প্রায় দুঘন্টা একসাথে আছি অথচ আমরা কেউ একে অপরের নাম-পরিচয় জানি না।আপনার নামটা বলবেন?
--হ্যাঁ, অবশ্যই।আমি রাতুল।বিধাননগরে থাকি।এই হাপতিয়াতে স্কুলে চাকরি করি।
--ও আচ্ছা।আমার নাম বৃষ্টি।তারপর হঠাৎ বললো আচ্ছা, আপনি তো তখন পুরো গল্পটা শুনলেন না...
--কোন গল্পটা?
--ওই যে সুন্দরী মেয়ে!
--থাক, এই জঙ্গলের মধ্যে এখন আর ওগুলো শুনবো না।
--কেন!ভয় পাচ্ছেন?বলে হা হা করে অট্টহাসিতে বাঁশ বন কাঁপিয়ে দিল।
আমার আত্মসম্মান আহত হল।আমি বললাম ভয় পাবো কেন?ওই সব ভূত-টুতে আমি বিশ্বাস করি না।আচ্ছা, বলুন...
এরপর মেয়েটা বলতে শুরু করলো--
ওই যে সুন্দরী মেয়ের কথা বলেছিলাম শুনেছি প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে ওই হাপতিয়া ক্যানেলের ধারে ওকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।পুলিশের অনুমান ছিল তাকে খুন করা হয়েছিল।কেননা তার দেহে অজস্র ধারালো অস্ত্রের আঘাত  চিহ্নিত হয়েছিল।কিন্তু পুলিশ খুনিকে ধরতে পারেনি।এমনকি মেয়েটার মুখ এমন ভাবে থেতলে দেওয়া হয়েছিল যে প্রায় ১৫ দিন লেগেছিল ওই লাশ চিহ্নিত করতে।পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল,কিন্তু প্রমাণের অভাবে আদালত তাদের সম্মানের সঙ্গে নির্দোষ ঘোষণা করে।শোনা যায় ওই মেয়েটাই নাকি তার হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে রাতের অন্ধকারে ওই অপরাধীদের খুঁজে বেড়ায়।হয়তো শুনে থাকবেন ,এই সপ্তাহ দুয়েক আগে এই পথে একটা খুন হয়েছিল?
--হ্যাঁ, শুনেছিলাম বৈকি।যে খুন হয়েছিল তাঁর দেহেও নাকি অদ্ভুত এক ধরণের ক্ষত ছিল এবং তার মাথাটা নাকি থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল?পুলিশ তো এখনো খুনির সন্ধান পায়নি।
--পাবেও না।
--কি বললেন?
--কিছু না।
--না,আপনি কি করে বললেন পুলিশ খুনির সন্ধান পাবে না?
--কি করে পাবে?কোনো মানুষ খুনি হলে তো পুলিশ খুঁজে পাবে।
--এর মানে?আমি চমকে উঠে বললাম।
--মানে কিছু না।
--আপনাকে বলতেই হবে কি বলতে চাইছেন।
--আমি কিছুই বলতে চাইছি না।আসলে লোকজন তো বলে থাকে ওই মেয়েটাকে যারা খুন করেছিল খুন হওয়া লোকটা তাদেরই একজন এবং সেই মেয়েটাই নাকি তাকে হত্যা করে বদলা নিয়েছে।

আর এটা কি জানেন লাশটা কোথায় পাওয়া গেছে?
--না ।
--ঠিক এখন আমরা যেখানে আছি।এই এখানেই লাশটা পাওয়া গিয়েছিল।
আমি আঁতকে উঠলাম।কি বলেন?
--আচ্ছা, আপনি যদি কোনোদিন ওই সুন্দরী ভুতের পাল্লায় পড়েন?
--কথাটা শুনে আমার তো ঘাম ছুটে গেল?সামনে একটা ছোটো পাথর ছিল,তাতে হোঁচট খেয়ে পরে গেলাম।
এটা দেখে মেয়েটা এত জোরে  খিলখিল করে হেসে উঠল যে,বাঁশ বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে যেন সেই হাসির অনুরণন হতে লাগলো বারবার।মেয়েটি হাসি থামিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।ওই ভাবে হঠাৎ পরে যাওয়ায় পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম।মেয়েটার হাত ধরে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালাম।তখনও যেন সেই হাসির শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি।
মেয়েটি বললো চলুন।কিন্তু আমার এতটাই ব্যথা হচ্ছে যে,আমি ভালো ভাবে দাঁড়াতেই পারছি না।চলব কি করে!
আমি বললাম,আমি আর যেতে পারবো না।আপনি যান।আমি এখানেই আছি।আর কতদূর?
--এই তো প্রায় চলে এসেছি।
--তাহলে আশা করি আপনি এখন যেতে পারবেন?
--না,আমার ভয় করে।ওই যে বললাম না মাতালের দল...তারপর কাছে এসে বললো দেখি আপনার কোথায় লেগেছে...এই বলে আমার ব্যথার জায়গাটায় হাত দিল।কি অদ্ভুত কান্ড!মিনিট খানেকের মধ্যেই আমার ব্যথা উধাও।আমি হা করে মেয়েটির দিকে চেয়ে রইলাম।তারপর বললাম, ঠিক করে বলুন তো আপনি কে?
মেয়েটি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জবাব দিল, আমি বৃষ্টিইইইইই।সঙ্গে সঙ্গে বাঁশ বনের ভেতর থেকে অনুরণিত হতে লাগল,আমি বৃষ্টিইইইইই......আমি বৃষ্টিইইইইই......
--আপনি যদি সাধারণ কেউ হন,তাহলে আপনি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যথা কমে গেল কি করে?
মেয়েটা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে এবার বললো, আমার এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে,আপনার মাথাটা গেছে।শুনুন আপনি খুব শীঘ্রই কোনো সাইকাটিস্ট দেখান।বুঝলেন!!!আবার হেসে উঠল...আবার অনুরণন...
আমি বললাম,ঠিক আছে চলুন তাড়াতাড়ি।অনেক রাত হয়ে গেল।বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা হয়ে গেছে।হাঁটতে হাঁটতে এতটা সময় চলে গেছে কখন বুঝতেই পারিনি।মনে হল বাড়িতে একটা ফোন করা দরকার।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি পঁচিশটা মিসকল।কল করতে গেলাম।নেটওয়ার্ক নেই।ধুর ছাই বলে মোবাইলটা পকেটে রেখে দিলাম।
তারপর এগিয়ে যেতে লাগলাম।কিন্তু এখন কিছু অদ্ভুত শব্দ কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার।শব্দটায় আমার হৃদকম্পন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।আমার শরীর আর চলছে না।কিন্তু মেয়েটার এদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।সে আপন মনে এগিয়ে চলছে।দেখে মনে হচ্ছে ওর কোনো ভয়ডর কিছু নেই।এই যে এতরাতে একটা অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে, তবুও ও যেন নিশ্চিত।মনে মনে ভাবলাম,একটা মেয়ে এতটা সাহসী কি করে হতে পারে!
আমি বললাম,কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?
--না তো।কোথায় কোনো শব্দ তো নেই।
আমি চুপ হয়ে গেলাম।
আর একটু যাওয়ার পর মেয়েটি বলে উঠল, ওই যে সামনে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা আমার বাড়ি?
--কোথায়?আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না?
--আপনার চোখও গেছে!চোখটা ভালো করে মুছে, একবার বন্ধ করে,তারপর খুলুন এবং দেখুন।
আমি তাই করলাম।কি আশ্চর্য।এই তো কাছেই মোড়ের মাথায় কি সুন্দর একটা বাড়ি।কি অপূর্ব মায়াবী পরিবেশ।কি দূর্দান্ত!বাড়ি তো নয় যেন কোনো রাজপ্রাসাদ।কত আলোর খেলা।তাহলে কি আমার চোখটা গেল না কি?এত আলো তবুও আমি বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিলাম না।কিন্তু আশেপাশে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন?আর, আশেপাশেও তো কোনো বাড়িঘর দেখতে পাচ্ছি না।
বললাম,আচ্ছা আর তো কোথাও কোনো বাড়ি দেখতে পাচ্ছি না?
--থাকলে তো পাবেন?
--মানে?নেই..
--না
--আপনারাই শুধু এখানে থাকেন?
--শুধু আমি।
আমি যারপরনাই অবাক হয়ে বললাম,আপনি একা এই জঙ্গলের এই বিশাল প্রাসাদে থাকেন?আপনার কোনো অসুবিধা হয় না।আর আপনিই তো বললেন যে, মোড়ের মধ্যে মাতালের উৎপাত।আপনার ভয় লাগে?
--ধুর ছাড়ুন তো ওই সব কথা।
এই কথা বলে মেয়েটি আমার সামনে সামনে হাটতে লাগলো।,পাঁচ মিনিট হাঁটার পর দেখি, বাড়িটা যতদূরে ছিল এখনো ততটাই দূরে।আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা আবার ফিরে এল এবং আমার কান ঝালাপালা হতে লাগলো।আমার সমস্ত শরীরে যেন কিসের শীতল স্পর্শ পেলাম।কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না।পায়ের সানে দিয়ে একটা ইঁদুর দৌড়ে গেল।আমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।মেয়েটি অনেকক্ষণ কিছু বলছে না।শুধু হেঁটেই যাচ্ছে।আমিও তার পিচুপিছু হেটে চলেছি।যেন কোনো সুচতুর জাদুকরের জাদু আমার ওপর ভর করেছে।আমি শুধুই মেয়েটিকে অনুসরণ করে যাচ্ছি।কোনো কথা বলতে পারছি না।কথা বলতে গেলেই আমার কন্ঠ থেকে যেন একটা গোঙানি বেরিয়ে আসছে।কিছুক্ষন মেয়েটি দৌড়াতে শুরু করলো।আমিও তার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলাম।কতক্ষন যে দৌড়ালাম কিছুই বুঝতে পারলাম না।কিন্তু যতই দৌড়াই দেখি বাড়িটার দূরত্ব কোনোভাবেই কমছে না।একসময় আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল।আমি আর দৌঁড়াতে পারলাম না।আমি বসে পড়লাম চোখ বন্ধ করে।কতক্ষণ যে চোখ বন্ধ করে ছিলাম বুঝতে পারলাম না।যখন চোখ খুললাম দেখি আমি সেই রাজপ্রাসাদের একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভরপুর একটা ঘরে শুয়ে আছি।পাশে বসে আছে সেই মেয়েটি।আমার শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই।আমি উঠে বসলাম তারপর মেয়েটি বললো এখন কেমন  লাগছে শরীর?বাড়ি যেতে পারবেন না কি এখানেই রাতটা পার করে কাল সকালে বাড়ি    যাবেন?
আমি বললাম,না আমাকে বাড়ি যেতে হবে।তারপর বিছানা ছেড়ে মেয়েটির থেকে বিদায় নিয়ে আবার সেই বাঁশ বনের পথে বের হলাম।
কিছুটা এগিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম।আমার চক্ষু তো ছানাবড়া!কোথায় সেই রাজ প্রাসাদ?আমি চারদিকে চেয়ে দেখলাম।না,কোথাও কিছু নেই।চারদিকে শুধু বাঁশ বন আর সবটাই গভীর অন্ধকারে ঢাকা।আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল।ভয় যেন আমার গ্রাস করলো।আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে লাগলো।ক্রমশ যেন আমি অন্ধকারের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।তারপর  যখন আমার চোখ আবার আলো দেখলো তখন আমি হসপিটালের বেড়ে।জানতে পারলাম আজ সকালে কয়েকটি লোক আমাকে বাঁশ বনে অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পায় এবং আমাকে চিনতে পারে।বাড়িতে খবর দেয়।বাড়ির লোক আমাকে উদ্ধার করে এই হসপিটালে নিয়ে আসে।

তারপর যা শুনলাম তাতে আমার পরান মাঝি বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়।বাঁশ বনের যে জায়গা থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়,সেই জায়গা এবং আমার বাইক যেখানে রাখা ছিল সেখানে নাকি রক্ত দিয়ে লেখা ছিল--
আমিই সেই সুন্দরী মেয়ে যাকে এমনই এক বৃষ্টির দিনে চারজন মাতাল নৃশংস ভাবে আমাকে ধর্ষণ ও  হত্যা করেছিল।তারপর ফেলে গিয়েছিল ওই ক্যানেলে।আমি বদলা চাই।তাই বৃষ্টির রাতে আমি সেই ক্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।খুঁজি সেই অপরাধীদের।কিন্তু গতমাসে যে লাশটা পাওয়া গিয়েছিল এই বাঁশ বনে,সে আমার হত্যাকারী ছিল না।সেই রাতে আমি যথারীতি দাঁড়িয়ে ছিলাম শিকারের জন্য সেই সময় সে এই রাস্তায় আসে এবং নিজেই আমাকে লিফট দেয়।কিন্তু এই বাঁশ বনের সামনে এসে সে আমাকে একা পেয়ে আমার শ্লীলতা হানি করার চেষ্টা করে।আমি বিনিময়ে তাঁকে মৃত্যু দিই।তাই আজও পুলিশ খুনির সন্ধান পায়নি।আর কোনোদিন পাবেও না।
আজও শিকারের সন্ধানে ছিলাম।আপনার থেকে লিফটও নিলাম।কিন্তু কিছুটা পথ যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি অন্যরকম।আপনি তাদের মতো নন,মেয়ে দেখলেই যাদের জিভ লকলক করে।তাই একসময় আপনার বাইকে আমাকে দেখতে পাননি।তারপর যখন আপনি আবার ফিরে এলেন তখন মনে হল আপনি প্রকৃতই ভালো মানুষ,আপনাকে আমার কথা বলা যায়।তাই এতক্ষন....।যান আপনি বাড়ি ফিরে যান।আপনার কোনো ভয় নেই।তবে আমি তাদের কখনোই ছাড়বো না,যারা নিরীহ মেয়েদের একা পেয়ে নিজেদের জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে জানোয়ার হয়ে যায়।

অসম : কৃপাণ মৈত্র







    মাঝি নদীতে ঝাঁঁপ দিতে পারিস?মোটা বকশিশ দেবো।
    নদীতে ষাঁঁড়াষাাঁড়ি বান ।পাক খেয়ে এক স্রোত  অপর স্রোতের পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে যাচ্ছে ।আবার কখনও কখনও পৃথিবীর বুক ঠেলে লাভা স্রোতের মতো লাফিয়ে ফুলে উঠেছে। দক্ষ মাঝি ছাড়া এমন বানে কেউ নৌকা বাইতে সাহস করে না ।বাবুর শখ হয়েছে বানে নদী কেমন উত্তাল হয় দেখেন।মাঝি কোন কৌশলে ঢেউএর ফনাগুলোকে বসে এনে তাদের মাথায় নাচে তা দেখেন  ।দাঁড় বাওয়া   আর হালের কেরামতি  যেন কোন  ধ্রুপদী সংগীতের তালে তালে  নৃত্য।   বাড়িতে অসুস্থ ছেলে। কেঁদে কেঁদে মায়ের চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে । দিগন্তে সূর্যটা ডুবলে মোহন মাঝির মন খারাপ হয়ে যায়। মহাজন' মাছের অর্ধেক ভাগ নেয়। বাকিটা তিনজনের মধ্যে ভাগ হয়। কয়েকশো জাল ভেদ করে কতটুকুই বা তাদের জালে ধরা পড়ে। বখরা পয়সায় প্রতিদিনের চাল ডাল সবজি ও কেনা হয়ে ওঠে না।
     মোহনমাঝি শক্ত করে কোমরে গামছা বাঁধে।
     -বাবু কত দেবেন?
     একটা পাঁচ'শ টাকার নোট দেখিয়ে বাবু বলেন, উঠে এলে আরো দেবো।
      মতিন এবং রাঘব  মোহনকে বাধা দিয়ে বলে, তোর বউ বাচ্চার কথা  তো একবার ভাব।
          মোহন স্থির দৃষ্টিতে বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, বাবু, যদি না ফিরি তো ওদেরকে দিয়ে দেবেন। বাচ্চাটা হয়তো বেঁচে যাবে।
   সূর্য তখন পাটে বসেছে ।সূর্যকে প্রণাম করে মোহন মৃত্যু গহ্বরে  ঝাঁপ দিল ।
      মতিন  এবং রাঘবের ঘৃণিত দৃষ্টির সামনে  বাবু তখন  শূন্যে সিগারেটের রিং বানাচ্ছেন ।

প্রেম প্রিজম : মহঃ ওলিউল ইসলাম






চিমনির ঠোঁটে জমে থাকা আরমান শুয়ে|
অভিমানের ধোঁয়ায় মিশে যাবে আকাশের পর্দায়|
ঠান্ডা আগুন তোমার ভালোবাসায়|
তারল্যের তোড়ে,
দৈর্ঘ্য বাড়াও তুমি|
তুমি আগুন চেয়েছো,--- ঠান্ডা আগুন পোড়াতে|
একটি গভীর যন্ত্রনার কোলে চাওয়া-পাওয়ার কৈশোর অভুক্ত,
তবুও দামাল|
পাতলা প্রাচীরে আটকে আছে
ক্ষমতার উষ্ণতা |
ফিরিঙ্গি সেজে ক্লান্ত তোমার যৌবন
ভালোবাসার তালিমে মুন্সীয়ানা নেই|
বৃদ্ধ ভাবনা ক্লান্ত এখন,
--চঞ্চলতার ঘরে|

নবজীবন :শ্যামাপদ মালাকার









আমাকে চিনতে পারছেন, আমি কে?--জানি, আপনি আমাকে ভুলে গেছেন। ভুলবেনই তো--পারিজাত নারীদের কি কম যাতয়াত ছিল--আপনার বৈঠকখানায়।
ঠিক আছে, এখনো চিনতে পারেননি তাই তো?
তবে আমার পরিচয়টা একটু দিই----
তারপর, দেবাদিদেব  শিবকে আমি খুব ভক্তি করতাম। সমাজিক নিয়মানুসারে তার ব্রত-উপোস করে আর পাঁচটা নারীর মতোই, গোপেশ্বরের চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট করে রাখতাম।
কিন্তু মহাকালও আমার প্রতি বিমুখ হলেন। বিবাহনামক সামাজিক একপ্রকারের রীতির শিকার হয়ে-- অপরিণীতা বয়সেই, শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে পিতার ভবন ত্যাগ করে চললাম।
সম্পূর্ণ অপরিচিত ঘর--অপরিচিত পুরুষ!
কিছু না বুঝে উঠার আগেই আমি 'মা' হয়ে গেলাম--যাকে একালে পুরুষেরা "ডানাকাটা পরী" বলে।
তখনও  আমি বুঝতে পারিনি, ভালবাসা কি, তবু নবজাতকের নাম রাখতে হবে---শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ছেলের নাম রাখলেন 'শুভ'।
বাপেরবাড়ি থেকেই আমি একটু জেদী হয়ে এসেছিলাম।
নিজে যা ভাল বুঝতাম-- তাই করতাম, তবু আত্মীয়স্বজনদের নিকট হতে স্নেহ-মায়া-আদরের কোনো ঘাটতি ছিল না।
অনেকদিন থেকে লোকমুখে শুনতাম, ট্রেশন পেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই নাকি রাধা-মাধবের  মন্দির। শুনেছি সেখানে গেলে প্রসাদ পায় অনেকেই।
সেই লোভে, মাঝে মাঝে রাধা-মাধবের পূজো দিতে আসতাম মন্দিরে।
লোকে শ্যামসুন্দর মন্দির বললেও--আমি বিশ্বেশ্বরের মন্দির মনে করতাম। তার প্রসাদ পাওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে কতটা যে আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, সে কথা পতিতপাবনই জানতেন।
আমার একমাত্র সন্তান শুভ-- সামাজিক অর্থে আমি 'এক ছেলের মা'। দীঘির মধ্যে  যেমন পদ্ম, তেমনই শ্বশুরবাড়ির উদ্যানে আমি।মাঝ আকাশে জ্বলন্ত অরুণিমার ন্যায়- পরমা সুন্দরী, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের রীতি তখন, দুএককথায় বর্ণনা করা সহজ ছিলনা।
থাক সে কথা- -
তারপর- তারপর শুভ, দামাল ছাড়িয়ে পা পা করে নিজের উঠোন অতিক্রম করল।
প্রকৃতির কি নিয়ম, সে কারু বাধ্য নয়-- সে আপন মনে পথ হাঁটে।
শুভ আরো একটু বড় হল। তার স্কুলজীবনের এক্সজাম শুরু হল। কিন্তু ছেলেটা এখন ভীতুই রয়ে গেছে। যাক সে কথা, সে সেদিন বায়না করল--"মা তুমি সঙ্গে চল, আমি একা যেতে পারবোনা।"
হঠাৎ মনে পড়ে যেতেই আমি তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, শুভ যে পথ দিয়ে এক্সজাম দিতে যাবে, সেই পথেই রাধা-মাধবের মন্দির।
ভাবলাম, এই সুযোগ কোনমতে হাতছাড়া করা যায় না--বিশ্বেশ্বরের প্রসাদ আমাকে পেতেই হবে।
কিন্তু যে আশা আর উদ্যম নিয়ে বেরোলাম, ততটা হয়ে আর উঠল কই!
শুভকে এক্সজাম হলে ঢুকিয়ে দিয়ে চিরপ্রবাহিণী গঙ্গার তীরে গিয়ে বসলাম--অত্যাধিক মানসিক চিন্তার কারণেই হোক,-- বা, দূরগামী বেগবতী গঙ্গার শীতল বায়ুর সংস্পর্শের কারণেই হোক---ক্লান্তিবশত সময়ের দিকে খেয়াল না থাকায়, প্রথমদিন বিশ্বেশ্বরের দর্শন হতে বঞ্চিত হলাম।
পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে, বিশ্বেশ্বর আমায় কৃপা করলেন।
শুভকে পরীক্ষার রুমে পৌচ্ছে দিয়ে, সরাসরি জগৎপিতার প্রাঙ্গণে গিয়ে উঠলাম।
কি শান্তি! কি প্রশান্তি! হৃদয় যেন পবিত্রতার গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
নাটমন্দির সাদাকাল পাথরে নির্মিত, নাটমন্দির লাগোয়া কয়েকটি সোপানের পর চারিপাশে নকশা করা রক্তাভ প্লেট--তারমধ্যে দুই-চারটি দেবদেবী অনায়াসে যাতায়াত করতে পারেন--এমনেই প্রশস্ত, যেন স্বর্গের কোনো গালিচা পাতা।
বিশ্বেশ্বরের সম্মুখভাগ যেন পালিশ করা একএকটি রুপার প্লেট---অপূর্ব কৌশলে বসানো--অবশ্যই নিখুত প্রশংসার দাবী রাখে!
বিভিন্ন দর্শনার্থী ও আগত সেবার্থীদের সমাগমে রাধা-মাধব প্রাঙ্গণ ও নাটমন্দির যেন বৃন্দাবনধাম হয়ে উঠেছে!।
কর্মচারীর সংখ্যা কম নয়, হাঁকে-ডাকে-নিয়মে-শাসনে  সারা মন্দির ভরপুর। আরতির পর মন্দির বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল--এবার হয়তো সেবার্থীরা প্রসাদ পাবেন।
যদিও জানি, মন্দিরের একটা নিয়ম আছে--নরম্যাল প্রসাদের চেয়ে স্পেশাল একটু মূল্য।
বিশ্বেশ্বরকে ডাকলাম--"হে প্রভূ! আমার পয়সা নেই। সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি--দুপুর যে গড়িয়ে গেল, তোমার প্রসাদ হতে কি আজ বঞ্চিত হবো!"
মনে হয়, আমার আর্তনাদ শ্যাম শুনতে পেলেন। অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠার আগেই চোখদুটো জলে ছলছল করে উঠল! অন্তর থেকে বেরিয়ে এল--হে বিশ্বনাথ! তুমি আছো---হে অনাথার নাথ! তুমি আছো--- তুমি না থাকলে, আজ আমি প্রসাদ পেতাম না!
শেষ পর্যন্ত আমি প্রসাদ পেলাম! কি শান্তি! কি তৃপ্তি! মনে হল, বরষার গঙ্গার মতোই আজ আমি কানায় কানায় পরিপূর্ণা!।
কিন্তু আনন্দের বেগ শমিত হতে না হতেই--কর্মচারীর মুখে শুনলাম, মন্দিরের যিনি কর্ণধার, যিনি মালিক--উনার সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করে যেতে বলেছেন।
বজ্রহত গাছের ন্যায় বসে পড়লাম। মালিক ডেকেছেন-- বারংবার কানে প্রতিধ্বনী হতে লাগল! তবে কি উনি টাকা চায়বেন? টাকা তো আমার নেই!
পুনরায় শ্যামকে ডাকলাম--হে প্রভূ! কেন আমার পরীক্ষা নিচ্ছো! আমার কাছে টাকা নেই--তুমি কি জানতে না? হে বিপদতারণ--কেন তুমি আমায় প্রসাদ দিলে?।
আমার কিছু বিলম্ব হওয়ায়--আবার ডেকে পাঠালেন।
বিপদভঞ্জনের উপর ভরসা রেখে, অপরাধিনীর মতোই মালিকের কক্ষে প্রবেশ করলাম- -
এবার মনে পড়েছে---আমি কে?।
প্রবেশ করতেই সারা অন্তঃকরণ যেন হিম হয়ে গেল। মনে হল, কোনো একটা দেওয়ালে এসি অন রয়েছে।
সদ্যমৃতলতা অল্প অল্প জলসঞ্চারে যেমন ধীরে ধীরে জীবিতা হয়ে উঠে, তেমনি আমারও শরীরে যেন মৃদু মৃদু প্রাণ ফিরে আসছে।
চেয়ার পাতা ছিল। উনি আমায় বসতে বললেন।কক্ষটি সু্বাসি গন্ধে টলমল। অনুভব করলাম, রুমে ফুলফর্মে এসি ছুটছে। মুখোমুখি বসলাম। ভাবছি, উনি প্রসাদের টাকা চায়লে---আমি কি বলবো?--- বলবো, প্রসাদ দেওয়ার আগে, টাকার কথা তো আমাকে বলেন নি---যদি বলতেন, আমি প্রসাদ খেতাম না। এরকম অনেক উত্তরই মনে মনে জাগছে।
আমি উনার দিকে না চাইলেও--অনুমান করছি, উনি আমাকে হা করে দেখছেন!। রুমটিতে কয়েকটি রাধা-শ্যামের ছবি ছাড়াও--এখানে সেখানে পূজোর নৈবিদ্য।
ভাবলাম, প্রসাদের টাকা চায়ছেন না কেন? মনে মনে প্রশ্ন জাগছে--সত্যিই কি শ্যাম আমাকে কৃপা করেছেন?
মনের মধ্যে এইরকম তর্কবিতর্ক চলছে।
রুমের ভিতর দুজনের মধ্যে যে নীরবতা গড়ে উঠেছিল--তা পুরুষকণ্ঠে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল।
তিনি বললেন--"প্রসাদ পেয়েছেন?"
এবার চিন্তে পেরেছেন--আমি কে?।
প্রসাদের কথা উঠতেই--আমি বললাম---হ্যাঁ--প্রসাদ পেয়েছি। এই প্রথম মুখ তুলে উনার পানে কয়েকদণ্ড তাকালাম। দেখলাম---সুপুরুষ বটে, গায়ের রং তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, দেহখানা বলিষ্ঠ-- এক কথায় সুদর্শন যুবক। সর্বাঙ্গে বিবিধ রত্নের অলঙ্কার, প্রতি আঙ্গুলে বহুমূল্যের একএকটি আঙটি। দুজনের মধ্যে পরিচয় বিনিময় চলছে।
এক সময়-- সময়ের দিকে তাকাতেই বাবুর পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল।
এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই---রাধামাধবের একটি ছবি, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-"আবার আসবেন- -
এবার চিন্তে পারছেন--আমি কে?
বাড়ি ফেরার পথে মনে হল, মানুষটি বেশ, উনার কত দয়া। এমন মানুষ একালে হয় না। মন্দিরের সব কর্মচারীরা উনাকে পিতার ন্যায় সম্মান করেন। নিশ্চয় উনার মধ্যে দয়া-করুণার শেষ নেই।
নির্দিষ্ট সময়ে শুভর এক্সজাম শেষ হল।
সংসারে কোনোদিন কোনোকিছুর অভাববোধ করিনি। শুভর বাবা-- যিনি আমার স্বামী, তার মতো মানুষ সংসারে খুব কমেই দেখা যায়। আমার প্রতি বিন্দুমাত্র তার অবহেলা ছিল না। অনবদ্য আমি তার স্নেহের ছায়ায় বাস করতাম। শ্বশুর ও শাশুড়িমায়ের তো কোনো তুলনা নেই, নিজের মেয়ের মতো বুকে আমায় আগলে রাখেন। প্রতিদানে আমিও উনাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ঘর সাজিয়ে রাখতাম। প্রকৃতপক্ষে- পিতার বাড়ি থেকে---শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত আমার জীবনে ভালবাসার কোনো অভাব ছিল না।
তবু যেন মনে হতো--
সংসারে চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই, জগৎকে যত দেবে সে ততই চাইবে। এই কারণে মাঝে মাঝে মনে হতো--কি যেন আমার নেই! পারিবারিক কারণে--অকারণে মন ভাল না লাগলে--মাঝে মাঝে রাধা-মাধবের মন্দিরে দুদণ্ড শান্তি পেতে ছুটে আসতাম।
নাটমন্দিরে একটু বসলেই--আমি সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতাম।
মন্দিরের সেই মালিক, কত দয়ালু, উনি আমাকে কত সম্মান করেন।
তখনও আমি বুঝতে পারিনি, ভালবাসা কি---কারণ আমি কখনো কারুকে ভালবাসিনি তো, তাই মনে হতো-- কেন উনার প্রটিটা কথা আমার কানে সর্বদা মন্ত্রের মতো বাজে! কেন উনাকে দেখলেই আমি শান্ত হয়ে যায়! উনি আমাকে এতোখানি যত্ন করেন কেন? এর অর্থ আমি সর্বদা খুঁজে বেড়াতাম।
জগৎ নিত্য, কাল নিত্য, আত্মা নিত্য, নিত্য নয় শুধু জগতের সামগ্রী। সে একদিন ধ্বংস হবে-- জগতে যা কিছু আছে-- সবেই একদিন ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে সমস্ত দেব বিগ্রহ,আর যিনি পরমাত্মা--পরমেশ্বর ভগবান, তিনিই শুধু যুগের সূচনার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দাপিয়ে বেড়াবেন!
সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম--
দিনটা ছিল, রাসপূর্ণিমা।
এই রাস দর্শনেরই জন্য নাকি--দেবাদিদেব মহাদেব গোপনে গোপীসেজে ধন্য হয়েছেন।
রাস শব্দের অর্থ সঙ্গীত বা নৃত্য।
রাসই জগৎ---জগতই রাস। এই রাসের জন্য পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ভগবান কোটি কোটি ভাগে বিভক্ত হয়ে, গোপীদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন।
আজ সেই দিন। চারিদিকে একটা সাজ সাজ রব--- আমি যাবো, আমি রাস দর্শন করবো-- আজ কত মানুষের সমাগম, আমি না গিয়ে কি থাকতে পারি?
শেষ পর্যন্ত আমাকে বেঁধে রাখতে কেউ পারেনি,  মধুসুদনকে স্মরণ করে--রাস দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
আমি এখন বিশ্বেশ্বরের প্রাঙ্গণে---নাটমন্দিরে।  সমস্ত প্রাঙ্গণ ও নাটমন্দির জুড়ে মানুষের ঢল। আরতি শুরু হয়েগেছে, রাস উৎসব আরাম্ভ হওয়ার আগে--এটাই শেষ আরতি।
উলু আর শঙ্খধ্বনীর মহাসমারোহে, মন্দির নিকটস্থশহরও আজ আনন্দে ভাসছে!
কিন্তু আমার মনে শান্তি কই? আমার মন কি চাইছে? কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? মনে হচ্ছে যেন এই ভীড়ে কে হারিয়ে গেছে-- তাকে আমি দেখতে পাচ্ছিনা কেন?।
শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম তাকে।
মন্দিরের এক কর্মচারী বলে গেলেন--"আপনাকে মালিক ডেকে পাঠিয়েছেন, উনার বৈঠকখানায় গিয়ে দেখা করুন।"
কথাটা শুনতে না শুনতেই ভেতরে অস্থিরতা ক্রমশ দ্বিগুণ হয়ে উঠল! বিলম্ব না করে, উনার ঘরে হাজির হলাম- -
কি, এবার চিনতে পারলেন--আমি কে?
আপনি আমায় সম্মান সহকারে বসার অনুমতি দিলেন।
প্রথম প্রণয়ের ভীরু কিশোরীর মতো আমি চেয়ারে বসলাম।
মনে মনে ভাবছিলাম--আমার মনে তো কোনো পাপ নেই, আমি রাধ-মাধবের রাস দর্শনে এসেছি।
আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম-- আপনি অভিজ্ঞ শিকারির মতো আমাকে ধরার জন্য জাল পাতছিলেন।
তবু আমি পালিয়ে যায় নি!
আপনি বললেন--"এই জান, তোমার আমার সম্পর্ক একজনমের নয়---তোমাকে দেখলে কেন আমি এত দুর্বল হয়ে যায়--তুমি বুঝতে পারনি?"
আমি সেদিন তোমার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমি সেদিন পালিয়ে যায় নি!
অঘটন ঘটতে বেশী সময় লাগেনা। তবু মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়--বেহিসাবী হয়ে যায়! তুমি আমার আরো সন্নিকটে এলে--আমি উন্মূলিত তরুর ন্যায় কখন যেন তোমার প্রশস্তবক্ষে আমার মাথা সংস্থাপন করে ফেলেছি---আমি বুঝতে পারিনি- - -
এবার মনে পড়েছে? আমি কে!
ললাটে--গণ্ডে--চিবুকে চুম্বন আঁকতে আঁকতে বললে--"তোমার আমার পরজনমে কোনো সাক্ষাৎ ছিল, তাই হয়তো এজনমে এমন করে পেলাম।"
আমার অন্তর কেঁপে উঠল! সহসা মনে হাজার প্রশ্নের আবির্ভাব হল-- আমি কি তবে বিশ্বেশ্বরকে ভালবাসিনে? মাধবকে বাহানা করে কি ইনার জন্যই মন্দিরে ছুটে আসতাম? আমার যে স্বামী-সন্তান বর্মান! ঠাকুর কি আমায় কখনো ক্ষমা করবেন?।
রাতের পর রাত জেগে জেগে উচিৎ-অনুচিত বিচার করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি হেরে গেলাম। বিশ্বেশ্বর  আমায় ত্যাগ করলেন---আমি নরকের পথে পা বাড়ালাম!।
তুমি আমার ইহকাল পরকাল হয়ে ভিতর থেকে জড়িয়ে ধরলে--আমি তোমায় ভালবাসলাম।
তোমার কথা চিন্তা করলে কি যে সুখ পেতাম আমি---একমাত্র অন্তর যামীই বুঝেছিলেন।
যখন তোমার নেশায় গৃহ আমার অরণ্য হয়ে উঠেছে--ঠিক সেই সময় থেকেই তুমি আমায় অল্প অল্প করে অবহেলা করতে লাগলে- -
এবারও চিনতে পারনি, আমি কে?।
তুমি যত আমার প্রতি অবহেলা শুরু করলে--ততই আমি নুকিয়ে নুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদলাম। প্রশ্নছিল--আমার অপরাধ কি? কোন অপরাধে আমাকে তুমি বঞ্চিত করছো? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ তুমি আমাকে কখনো দাওনি।
আমরা নারী বলে এতটা খেলনা নই! সত্য-মিথ্যা জানার আমাদেরও একটা সাধারণ শক্তি থাকে,
আজ আমি টের পেয়েছি--আমি শুধু একা নই--আমার মতো অনেক হতভাগী ঐ বৈঠকখানায় জীবন বিসর্জন করেছে!
নিজেকে ইশ্বর বলে মনে কর তাই না? আরে ইশ্বর সে--যে নারীকে কখন ঠকায় না!
ভগবান তো সে---যে নারীত্বকে সম্মান করেন!
বীর পুরুষরা কখন নারীর সাথে যুদ্ধ করেনা--
আদর্শ পুরুষরা কখন নারীহত্যা করেনা!
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বিধাতা আমাকে কৃপা করেনি--যদি শ্যাম আমাকে কৃপা করতো, প্রসাদের দাম আমাকে এভাবে শোধ করতে হতো না! তোমার মনে পড়ে? তুমি একদিন আমাকে বিনে পয়সায় বিশ্বেশ্বরের প্রসাদ দিয়েছিলে।
আমি কখন ভাবিনি, প্রসাদের দাম এভাবে মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে!।
আমি যে তোমাকে বড্ড ভালবাসি গো! এখনও তোমাকে আমি ভালবাসি!
কিন্তু এতোবড় সত্যটা তুমি সেদিন গোপন করেছিলে কেন?
আমিতো বার বার বলেছিলাম---দেখ, বিয়ে কর--বিয়ে করে একটা সংসার কর, কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি বলেছিলে--"আমি তোমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারি!"।
এবার বলতো, একটা বিবাহিতা নারীর জীবনে একটা অবিবাহিত ছেলের প্রণয়সংসর্গ হলে-- সেই নারীর চিন্তা কি কম!।
নিজের দিকটাও সেদিন  ভেবেছিলাম। আমি যে খুব একটা ভাল- তা নই! আমি নিজে বিবাহিতা জেনেও দিনের পর দিন তোমার অদম্য ইচ্ছার প্রতি মাথা নুইয়েছি।সেদিন আমার উচিৎ ছিল--তোমার গালে একটা থাপ্পড় মেরে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। কিন্তু আমি তা করিনি, আমি জানি-- আমার এই পাপের ক্ষমা নেই!
আমার মতো নারীরা কখন স্থায়ীসুখী হয় না, যদিও বা হয়--বিচ্ছিন্ন মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী---আমার কথা থাক।
আমি কি কম ভেবেছি? দিনে দিনে--মাসে মাসে---বছরে বছরে ভেবেছি--তুমি আমার জন্য এতোবড় ক্ষতি করতে চলেছো!
একটা অবিবাহিত পুরুষ যখন একটা বিবাহিতা নারীর জন্য সর্বস্বপণ করে বসে, সেই বিবাহিতা নারীর জীবনে আর কি পাওয়ার বাকি থাকে বলো? নিজেকে যতখানি ভাগ্যবতী মনে হয়---ততটা দুঃখিনীও মনে হয়।
জগতে যত রকমের পাপ আছে--সবচেয়ে বড়পাপ- স্বামীকে বঞ্চিত করে যে নারী পরপুরুষের জন্য পথ চেয়ে থাকে। ললাটে সেই বিষের সাগর নিয়েই-- তোমাকে ভালবাসলাম।
মনে মনে আরো পাপ আঁটলাম, এক নারীর দুই পুরুষ অবৈধ। তাই তোমার জন্য ওর প্রতি স্নেহ-মায়া-মমতা আস্তে আস্তে উপড়ে ফেলতে লাগলাম।
বিনিময়ে--দণ্ডে দণ্ডে, পলে পলে-- আলোতে অন্ধকারে ওর নির্যাতনের শিকার হতে লাগলাম। ভিতরে ভিতরে তোমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে-- শতবাহু প্রসারিত করে তোমার দিকে ঠেলে দিতে লাগল!
তুমি যদি বল, এটা আমার অন্যায়--মানলাম। কিন্তু তোমার দেখান পথেই তো আজ আমি পা বাড়িয়েছি, তোমার মনে আছে?
একদিন বলেছিল-"এক পুরুষের মধ্যে চিত্তবিনিময়ে বৈধতা বজায় থাকে।" তাই 'সে' কূলের নিশি ত্যাগকরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন একূলের তীর ছুঁই ছুঁই--তখন তুমি ভয় পেয়ে গেলে।
আমি অবাক! যে আমার জন্য অনায়াসে এতোবড় প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্থিরচিত্তে যন্ত্রণা সয়ে যেতে পারে--যে আমার জন্য পৃথিবীর সর্বস্ব নির্দ্বিধায় ত্যাগ করে পারে, সেই স্পর্শটুকুর জন্য- আমি আজ তার মুখোমুখি!
জিজ্ঞাসা করলাম-" কি, তুমি আমাকে চেয়েছিলে না? দেখ, সে আজ নরক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে বধ্যভূমিতে  হাজির! আমাকে চিনতে পারছো? আমি মালবিকা, যার জন্য পৃথিবীর সব সুখ-দুঃখ ত্যাগ করেছো!।
পরাজিত সৈনিকের মতো ধীরে ধীরে মুখতুলে যখন বললে-"মালবিকা, আমি বিবাহিত!"।
কথাটা শুনার সঙ্গে সঙ্গে চোখে বর্ষণ নামার আগেই--বুকের ভেতরে অনেক দূরে কোথায় যেন একটা বাজ পড়ল! তার প্রতিধ্বনি অন্তরের একূল-ওকূল সবকুল মচড়াতে মচড়াতে নির্জন প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে আমাকে যেন আছাড় মারতে লাগল!
বিধাতা জানে---কোন সৌদামিনীর আলো পথিক ভয় পায়! বিধাতা জানে--কোন বজ্রের ক্ষমতায় পাহাড় ফাটে!
বিধাতা জানে- কাকে কতটা অন্ধকারভরা নরক ছুঁড়ে দিতে হয়!
এ তুমি কি করলি গো! কোন জনমের প্রতিশোধ নিলে তুমি?
গাড়ী--বাড়ি--ধন--সম্পদ--প্রতিষ্ঠা--মর্য্যাদা তোমার তো সবেই আছে, তবে কিসের অভাবে আমার দুকূল কেড়ে নিলে?
তুমি যে বিবাহিত--এতোবড় সত্যটা কেন গোপন করেছিলে? আমি যে বড্ড ভালবাসি গো তোমা----
যখন শুনলাম তুমি বিবাহিত, তার বিষের জ্বালায় আমার সুখের নিশি যে চিরকালের মতো নীল হয়ে গেল!।
যেদিন আমার ললাটে চুম্বন এঁকেছিলে-সেদিন কি একটিবারও তোমার মনে হয় না--যে মালবিকা এজনমের সব সুখ-দুঃখ তোমার পায়ে জলাঞ্জালী দিল!
যেদিন মালবিকার চিবুকে প্রথম চুম্বন এঁকেছিল, সেদিন কি তোমার একটিবারও মনে হয়নি, যে---তোমার মালবিকা আর বেঁচে নেই--সে খুন হয়ে গেছে?
সত্যিকারের ভালবাসা তুমি কি করে বুঝবি বল? তোমার প্রমোদগৃহে অবিশ্রান্ত উর্ব্বসী-রম্ভার নৃত্যগীত,---আর বাসরঘরে মেনকার ঘন ঘন কটাক্ষবর্ষণ!।
যেদিন সত্যিকারে কোনো নারীকে ভালবাসবে--সেদিন বুঝবে--ঐশ্বর্য্য--সম্পদ--প্রতিষ্ঠা--ইমারত, ভালবাসার সামনে সব তুচ্ছ--সব তুচ্ছ!।
হে বিধাতা!তুমি কি আঘাতগুলো বেছে বেছে শুধু নারীদের জন্যই পুষে রেখেছ?
আমি যদি কোনো অপরাধে অপরাধিনী হই--তবে সেও সমান অপরাধে অপরাধী।
আজ কে আমাকে বাংশীধ্বনি শুনিয়ে ঘরের বাইরে এনেছে?
আজ কে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে দুকূল কেড়ে নিয়েছে?
আজ কে মিষ্টিকথার জাল বিছিয়ে আমাকে শিকার করছে?
কেন সে আঘাত করে আমার ভুল শুধরে দেয়নি?
কেন সে আমাকে ধর্ম শেখায় নি?
কেন সে পরজনমের লোভ দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করেছে?
তাই বললাম--হে বিশ্বেশ্বর! আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি--তবে সেও সমান অন্যায় করেছে--
আমার বিচার হলে---তার বিচার হবে না কেন?
আমার ধর্ম গেলে--তার ধর্ম যাবে না কেন?
হে পতিতপাবন! তোমার নিকটে তো সব সমান--তবে আজ এ বিভেদ কেন?
আমি বাঁচলে তোমার সৃষ্টি কি চলত না?
মানলাম। আমি যাকে ঠকিয়েছি তার জন্য শাস্তি যতবড়ই কঠিন হোকনা কেন--আমি বুক পেতে প্রায়শ্চিত্য করবো।
কিন্তু সেদিন আমি যাকে ভালবাসতাম--সে ভালবাসার মধ্যে তো কোনো ছলনা ছিল না! তবে তার প্রায়শ্চিত্ত্য আমি কেন করবো?
কেন রাত জেগে জেগে অবিশ্রান্ত চোখের জল ফেলবো?
হে রাধা-মাধব! তোমার পূজার থালার মধ্যে আমার কোন ছলচাতুরী ছিল না--কোন দুরভিসন্ধি ছিল না-- তবে কোন ধর্মশাস্ত্রবলে তোমার প্রাঙ্গণে গেলে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করি?
হে করুণাময়! তুমি যতবড়ই বিধাতা হও---এর হিসেব একদিন আমাকে দিতেই হবে!।
যখন আমি এইরকম একটি পরিস্থিতির শিকার হয়ে অকূল সাগরে পড়ে ডুবছি, সেই মুহূর্ত একজন লেখকের সঙ্গে আমার দেখা।
আমি ডুবে যাচ্ছি দেখে--সেই লেখক, আমার হাত ধরে টেনে তীরে তুললেন।
আমাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুললেন!
আমার এই অবস্থার কারণ, লেখক জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তখন এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, উনার কাছে ঔষধ চাইলাম, লেখক আমায় ঔষধ দিলেন--"ধর্মতত্ত্বের" প্রথম পর্ব।
প্রতিদিন একপাতা করে লেখক আমায় সেবন করালেন।
ধীরে ধীরে যখন অনুশীলনতত্ত্ব শেষ করলাম--তখন আমি অনেকখানি সুস্থ!।
আমার চোখের পর্দা সরে গেছে--এখন আমি কারুকে আর ভয় পাইনা।
আমি এখন নিজেই বিচার করতে পারি--কে সত্য---কে মিথ্যা--কে বিষ---কে অমৃত---কে ন্যায়---কে অন্যায়।
আমি এখন নিজে বিচার করতে পারি--কে সৎ--কে অসৎ---কোনটা ভালবাসা---আর কোনটা ছলনা।
আমি এখন ইচ্ছে মতো যেমন মরতে শিখেছি--- তেমনি ইচ্ছে মতো বাঁচতেও শিখেছি!।

উষ্ণতা : সুজাতা মিশ্র(সুজান মিঠি)





চায়ের ভাঁড়টা গরম ছিল বড়, হাতে নিয়েই ছেড়ে দিলাম ভয়ে,
দুহাত দিয়ে চেপে ধরে আমার উষ্ণতা, বললে, ‘কেমন তুমি মেয়ে?
দেখছ না ধোঁয়া উঠছে পুরো, দিতে হয় না বুঝি সময়?’
ঐটুকুটতেই কপালে তোমার দেখেছিলাম ভয়।

ট্রেনে কী ভীষণ ভিড় সেদিন, ঘামে গরমে প্যাচপ্যাচে পুরো
তারই মধ্যে কনুই এগিয়ে সুযোগ নিতে চাইলে এক বুড়ো।
ভিড় সরিয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলে জোরে,
‘কোথায় গেলেন মিডিয়া, রিপোর্ট ক্যামেরায় নিন ভরে।
বুড়োর শখে সুযোগ মাটি, এই আগলেছি আমার বুকে,
বলুন বলুন শ্লীলতার মাথা কামড়ে খাচ্ছি ভর্তি ট্রেনে সুখে!’

লজ্জায় তোমার নীল শার্টটায় মিশিয়ে নিলাম আমার বোজা চোখ,
সমবেত আওয়াজ শুনি ‘ভালোবাসার জয় হোক, ভালোবাসার জয় হোক।’
সেই বুড়োটা কোথায় গেল, লুকালো নাকি মেলাল সুর
দেখিনি আমি কিচ্ছুটি আর, তোমার ঘামে তখন আমি ভরপুর।
কানের উপর নরম সুরে আলগা আলোয় গেয়েছিলে হাসি
এই সুরে, কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি, ভালোবাসি ভালোবাসি।
প্রথম রান্নার পরে অধীর হয়ে শুনতে চাওয়া, ‘কেমন হয়েছে বলো না?’
চোখে মুখে আরাম এঁকে বলেছিলে, ‘ আমার ভালোবাসার রান্না।’
তোমার পরে খেয়ে আমার ঝালে নুনে অক্কা পাওয়ার দশা,
হাত মুছে আঁচলে আমার বলেছিলে হেসে, ‘এটাই ভালোবাসা’।

যেবার প্রথম এলো কোলে আমার মিষ্টি একরত্তি
তুমি বললে,  ‘আমি খুশি, ভীষণ খুশি ,আমার স্বপ্ন সত্যি।’

আমার দস্যি যখন আমার রান্নাঘরে  হামাগুড়ি
সেদিন আমি প্রথম শুনেছিলাম কেমন তুমি মিছরি ছুরি!
বিদেশ ট্যুরে প্রতিমাসে তোমার আছে এমন মত কত,
তোমার বন্ধু মধুমিতা কাঁদলো এসে খুব, বললো  ‘বৌদি বুকে বড় ক্ষত।’

ওকেও নাকি স্বপ্ন দিয়ে গন্ধ দিতে, নীল শার্টের বোতাম খুলে,
সেই বুড়োটা প্রতিবারেই আসত নাকি ওই ভাবেই কনুই তুলে।
নুনে-ঝালে রান্নাটাও ‘ভালোবাসা’ মধুমিতার বিশ্বাসী চোখ,
জানো তো, সামলাচ্ছি দস্যিটাকে, আর ওই মেয়েটা গাইছে ভারী শোক।

সেই অবধি একটা কথাই ভাবছি আমি, কেবল একটা কথা,
চায়ের ভাঁড়ের উষ্ণতায়, সব মেয়েতেই তুমি সমান কি পাও ব্যাথা??