নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

আলো-ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। সতের ।।


সেইসময় ক্লাস ফোর কি ফাইভ পড়ি। এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নাম সৌমিত্র প্রসন্ন সরকার। বাবার বদলির চাকরি। তাই এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। বাবার সঙ্গে পরিবারও। সৌমিত্র আমাদের স্কুলে ছিল একবছরেরও কম। প্রচণ্ড অস্থিরে। যা মনে করত তাই করত। কারও কথা শুনত না। শিক্ষকের হাতে এইজন্যে তাকে প্রায়ই প্রচণ্ড মার খেতে হত। আমার সঙ্গেও তার বিশেষ কোনো যোগ ছিল না। তবুও তাকে মনে আছে আমার। যে আমি কত কত কথা মুহূর্তে ভুলে যাই, সেই আমি কি করে সৌমিত্রকে মনে রাখলাম! মনের কোন কোণে সে এতদিন পর্যন্ত বন্দি আছে। আর কেনই বা আছে? একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের সামনেই একটা দোকান ছিল। আমরা টিফিনবেলায় সেই দোকানে থেকে কুলের আচার কিনে খেতাম। একদিন টিফিনে আমি কুলের আচার খাচ্ছি। সৌমিত্র হঠাৎ এসে হাজির। আমি ওকে কুলের আচারের ভাগ দিলাম। এরপর সৌমিত্র বলেছিল, " আমি জানি তোর ভাগ আমি পাবই।" কেন বলেছিল তাও জানি না। আমার ওপর তার এমন কিছু জোর ছিল না যেখান থেকে সে এটা বলত পারে। তবে সৌমিত্রকে দেখে মনে হত সে কারও সঙ্গেই সম্পর্ক গভীর করতে চায় না। যেহেতু সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তাই তার কোথাও শিকড় গাড়া উচিত নয়। মনে হতো এটা সে রক্ত দিয়ে বিশ্বাস করত। এই মনে থাকাটা আমার কাছে সত্যিই রহস্যময়। হয়ত এটাই নিয়ম। কত কত কান্নার মধ্যে বর্ষায় রাস্তার ধারের একটা ফুটপাতে একটা কুকুরের কান্না যে কারণে আমৃত্যু মনে থাকে, সৌমিত্রও সেই কারণে আজও আমার মনে অমলিন।



।। আঠারো ।।

আরও একজনের নাম মনে আছে। যাকে আমি জীবনে কখনও চোখে দেখি নি, ছেলে কি মেয়ে তাও জানি না। নাম ওডোনেল ডিকস্টা। একজন পোর্তুগীজ। একটি পত্রিকার তরফ থেকে মাইকেলের জন্মদিনে তার কবরে কবিতা পড়তে গেছি। যখন কবরস্থানে গিয়ে পৌঁছলাম তার একটু আগেই একজনকে কবর দেওয়া হয়েছে। মাটি তখনও কাঁচা। বোর্ডে তার নাম লেখা। ওই নামটুকুর মধ্যে দিয়েই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। কবিতা পড়তে পড়তে আমি কেবলই পিছন ফিরে তার দিকে তাকাচ্ছি। মনে হচ্ছে সে যেন আমার কবিতা শুনছে। মনে হচ্ছে এযেন তার অনেক দিনের ইচ্ছা। হয়ত সে মাইকেলের ভক্ত। তার জন্মদিনে তো আর জন্মানো হল না। অবশ্য জন্মেছে কি না তাই বা কে জানে। তাই মাইকেলের জন্মদিনে মরে সে গুরুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায়। কবিতা শুনবে বলেই আজকের এই বিশেষ দিনে তার মরে যাওয়া। হয়ত এই স্বতন্ত্রতার জন্যেই ওডোনেল ডিকস্টাকে আমার পঁচিশ বছর পরেও মনে আছে


(ক্রমশ..)

আঁকা মানুষ :অনিন্দ্য পাল


শেষ হয়ে যাওয়া সময়টুকু পেরিয়ে এসেছি সবে
সব নাম-বেনাম বেরিয়ে গেছে শেষ নিঃশ্বাস হয়ে
আমার "আমি"র মুখে বারবার এঁকে রাখা সব মুখোশ
খরার আদরে ফাটাফুটি দোঁয়াশের মত চেয়ে আছে
আকাশের দিকে,
ধরো সেখানে ভেসে আছে একটাই মেঘ
অথবা অভিশাপ
বৃষ্টি হলে ,ধুয়ে যাবে রঙের পরত
না হলে , ধূসর গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিশে যাবে
আঁকা পরিচয়
স্তরে স্তরে গড়ে তোলা বল্মীক জীবন

এখন দেখছো এই সব শব যা চেয়ে দেখ
আকাশের দেওয়ালে ফুটে আছে নাম
আঁকা মানুষ ...

প্রথম চিঠি : ঈশিতা দেবনাথ



রূপকথার প্রথম চিঠি তার দিদির কাছে

প্রিয় দিদি,
অনেক দিন থেকেই তুই অনেক দূরে আছিস আমার থেকে, চাইলেও তোর কাছে পৌঁছতে পারছিনা তবে আমি না পৌঁছলেও আমার এই লেখা তোর কাছে পাঠাচ্ছি,

আমরা সব সময় ভাবি "আলো"-র কথা, সবসময় আলোর কামনা করি। জীবনে কখনো অন্ধকার নেমে আসুক সেটা চাইনা, কিন্তু এই চাওয়া না চাওয়ার মাঝে এটা ভুলেই যাই যে অন্ধকার না থাকলে আলোর অনুভব টা কোনো দিনই করতে পারতামনা, আলো আর অন্ধকার এর পার্থক্য করতে পারতাম না, জীবনের খারাপ দিন গুলো ভুলে ভালো দিন গুলো মনে করতে চাই,
তবে আমার মনে হয় আলোর পাশাপাশি জীবনে অন্ধকারের ও গুরুত্ব আছে।

অন্ধকার এ থাকতে থাকতে হাঁসফাঁস করে উঠতাম একটু আলোর জন্য, মনে হতো কেন যে  দিনের পরে রাত আসে....!!!
 মনে হতো কেন যে দিনের বেলায় পাওয়া স্বাধীনতা গুলো রাতের জন্য বরাদ্দ থাকেনা...!
আর প্রতিনিয়ত অন্ধকার কে দোষারোপ করে গিয়েছি,

কিন্তু আজ এই অন্ধকারই, হাজার আলোর মাঝে পাওয়া খুশির চেয়ে বেশি তৃপ্তি এনে দিলো,
আজ সন্ধ্যের অন্ধকার এ চলে যাওয়া সেই দিনের খুশি মনে করিয়ে দিলো,
 তোর মনে পরে.... যখন সন্ধে বেলায় তুই আর আমি বাজার এ যেতাম...তুই বেশিরভাগ সময় হেটে যেতে পছন্দ করতি, আর রাস্তায় সাইকেল নিয়ে হেটে যাওয়ার অভ্যেস টা তোর থেকেই পাওয়া। এখন একা রাস্তায় সাইকেল নিয়ে হাঁটলে তোর কথা খুব মনে পরে,
তুই আমাকে বলতি..."বোন...তুই কিন্তু কখনো প্রেম করতে যাসনা, প্রেম খুব খারাপ জিনিস" তখন অনেক গর্বের সাথে বলতাম "না রে....আমি ওসব প্রেম ট্রেম করবোনা...আমারতো কোনো ছেলেকেই ভালো লাগেনা..."
আজ যদিও সেসব ইতিহাস...তবুও বলবো সেইদিন টা অনেক শান্তির ছিলো, অনেক ভরসা, বিশ্বাস, অনেক স্বাধীনতা ছিল সেইদিন।
সেইদিনের সন্ধ্যে আর আজকের সন্ধ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই...তবে একটা জিনিস এর অনেক পরিবর্তন এসেছে...আমার মনের....
সেইদিন মন মুক্ত ছিল, সেদিন স্বাধীন ভাবে ভাবতে পারতাম, সেইদিন বাস্তবের কঠিনতা গুলো কে আন্দাজ করতে পারতাম না, সেই দিন পিছন ফিরে তাকিয়ে এটা মনে করতে হতোনা যে "আগেই ভালো ছিলাম"
কিন্তু আজ তা মনে হয়, আজ ভাবনার জন্যও আর কান্নার জন্যও কইফেত দিতে হয়,
আজ স্বাধীন ভাবে ভাবা আর কথা বলার কোনো সুযোগ নেই, সবটাই যে অভিজ্ঞতার দোষ তা নয়, কিছুটা বয়সের চালাকিও রয়েছে।

আজ জানিস তো খুব বেশি করে অনুভব করলাম ...আমাদের মাথার ওপর যে হাত গুলো সব সময় ভরসা দিয়ে গিয়েছে তাদের জীবনেও এমনই কোনো আকাঙ্খা জেগে থাকতো....এই রকমই বয়স আর পরিস্থিতির চাপে পরে সব বদলে গেছে,হয়তো বদলে ফেলতে হয়েছে!

তাদের আসার কাছে আমাদের চাওয়া গুলো অনেক ছোটো... কিন্তু তারা নিজেদের আশা গুলোর সাথে প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করে আমাদের পাশে থাকে, পাশে আছে, এমনকি থাকবেও।

তাই নিজের অস্তিত্ব টা কে সর্বশেষ করবার আগে তাদের কথা ভেবে পিছিয়ে আসাটা  বোকামি নয়......
একজন সন্তানের কর্তব্য, দায়িত্ব, ভালোবাসা...❤

হাঁদা : মাধব মণ্ডল



একমুখে মধু আর অন্যমুখে আর্সেনিক
নির্দ্বিধায় দু'টোই চাটছি মায়া যাদু!

টলছি বেতাল টলা মাটি আর ঘাসে
ঘাস মরে যায়, মাটিও কঁকাচ্ছে!

হাতের তালুতে খনার আঁচড়
দেখি কিনা বোবা বিস্ময়ে!

একেকটা আর্সেনিক বিস্ফোরণ
ছিন্ন ভিন্ন কথা রাখি চুপড়িতে

কথাগুলো না মরে আবার ডাকে
বিস্মরণের তুমি আবার জাগো

মধু নদী সাঁই সাঁই ছোটে
পাড়ে আমি একা হাঁদা!

নেমকহারাম : উজান উপাধ্যায়



আমার প্রেমিকা কবিতা লিখতে বসলেই
আমি হাঁ করে সামনে বসে যাই।

ওর বুকের ভিতরে কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরনোর মতো বেরিয়ে আসে দগ্ধ পাঁজরের গা থেকে পুড়ে যাওয়া রক্তদাগ।

আমি ওর মাথায় একবালতি দুধ ঢেলে দিই।

হঠাৎ রাখাল সেজে হাতে বাঁশি, মাথায় মুকুট।

আমি ওকে ধাক্কা দিতেই এবার খসখস করে বাবার গল্প লেখে।
এ সময়ে ও অহংকারী।

এবার উঠে গিয়ে দেওয়ালে ক্যালেন্ডার নাড়া দিতেই ওর চোখে ভয়ংকর একটা নেকড়ের ছবি।

আমি হেসে ফেলতেই ও রান্নাঘর থেকে সেদ্ধভাতের হাঁড়ি উপুড় করে গরম মাড় তুলে এনে ফ্যামিলি এলবামের ওপর ঢেলে দেয়।

করো কি কবি, বলতেই আমার প্রেমিকা দাঁত খিঁচিয়ে উঠে বসন্তসেনার মতো কোমর থেকে তরবারি বার করে।

গোটা দৃশ্যে চিতা, হাসপাতাল, এম্বুলেন্স, প্রমোটারের লোভী চোখ, সংবিধান ও নারী দিবসের চকচকে ডিজিটাল আলো-

এবার খুব গুছিয়ে চুম্বন দিতেই প্রিয়তমা অমাবস্যা, আর নেমকহারাম অন্ধকারকবিতার  পান্ডুলিপিরা পরস্পরের সমকামী হয়ে ওঠে।

চোখের সামনে এসব দেখছি, আর কফিকাপে জমিয়ে রাখছি গুপ্ত ঈর্ষা।

রাত পর্যন্ত অপেক্ষা, ঘুমিয়ে পড়লেই প্রেমিকার সব কবিতা আমার নামে ছেপে দেব।

না হলে তো ওর পুরুষালি বুকের ছাতি এ জীবনে দেখার সুযোগ মিলবে না।

কবিতা লেখা শেষ হতেই ও নীল আলো জ্বেলে একটার পর একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে জ্বলন্ত হাঁপড়ে-

এইবার খেলা শুরু-নপুংসকের।

আলো-ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





।। পনের ।।

গরমকালের ভোরবেলা একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার পরিবেশ। মা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে থাকত। আমি আস্তে আস্তে উঠে বাইরে পালাতাম। তখন সবেমাত্র একটু একটু আলো ফুটছ। উদ্দেশ্য আম কুড়ানো। কিন্তু সেটাই একমাত্র নয়। আসলে ভোরের আকাশ, ঠাণ্ডা বাতাস আর চারপাশের নির্জনতা আমাকে ভীষণভাবে টানতো। তাই যখন আমবাগানে গিয়ে দেখতাম আমার অনেক আগেই অনেকে আমতলা খুঁজে ফেলেছে তখন এতটুকু মনখারাপ হতো না। ভোরবেলা বাইরে আসতে পেরেছি এটাই যেন অনেক আনন্দের। কোনো কোনো দিন আমবাগানের ভেতরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম। চারপাশের মানুষজনদের আস্তে আস্তে জেগে ওঠা, পাখির ডাক ----- এসব কিছুর মধ্যে ভাসতে ভাসতে কখন যেন আমের কথা ভুলে যেতাম।



।। ষোল ।।


সন্ধে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ আস্তে আস্তে নির্জনতায় ডুবে যাওয়া, বাসায় ফেরা পাখিদের চিৎকার চেঁচামেচি। ঠিক এর পরেই কানে আসত কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। আর কান পেতে শুনতাম সন্ধের আবহসঙ্গীত। একটু পরেই শুরু হতো সন্ধের আরতি। দেখতাম মা হাতজোড় করে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কোনো দিন দেখতাম মা ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কাঁদছে। আজও যখনই কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ কানে আসে তখনই ভেতর থেকে আমাকে কে যেন টেনে ধরে। সন্ধের আবহসঙ্গীত আবিষ্ট হয়ে পড়ি। পার্থিব জগৎ থেকে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই।


(ক্রমশ...)