বিসর্জনের সুর
*************
"কি রে, আজ তোকে খুব খুশি খুশি লাগছে।" ত্রিদীব বললো অংশুমানকে।
"ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেছে, বাড়ি যাচ্ছি ভাই।" খুশি হয়ে বললো অংশুমান।
"তাই নাকি? আমার পরশুদিন থেকে।"
"তোদের তো নবরাত্রী আর দশেরা। আমাদের তো মহালয়া থেকে পূজো পূজো রব শুরু। প্রতি বছর মহালয়া থেকেই কত ব্যস্ত থাকতাম পাড়ার প্যান্ডেলে। এবার তো তাও সপ্তমীতে যাচ্ছি।"
"আমাদের নববাত্রী নয়দিন ধরে বাড়িতে পালন হয়। বাড়িতে এই সময় পরিবেশই আলাদা থাকে। এইবার প্রথম শেষদিন গিয়ে উপস্থিত হবো বাড়িতে।"
"আমাদের দায়িত্ব যে আজ দেশ ভাই!"
"সেটাই! একদিকে ভালো হয়েছে। নাহলে এই নয়দিন মাম্মি কত যে কাজ করায়!" বলে হেসে দিল ত্রীদিব। অংশুমানও হেসে ফেললো।
"তা ঠিক বলেছিস। আমার তো বাবা নেই। আর কোনো দিদি বা বোনও নেই। তাই মা বাজারে যেত দুর্গাপূজার আগে আমাকে নিয়েই। নিজের জামা কেনার সময় ঠিক আছে। বাকি সময় খুব বিরক্ত লাগতো!"
"সত্যি রে!"
"কিন্তু কষ্টও লাগে ভাবলে, এবার মাকে একা একাই সব করতে হয়েছে। আমার কথা তো সারাক্ষন ভাবেই।"
"আমাদের পরিবারের কষ্ট আমাদের থেকেই দ্বিগুন।"
"সেটাই!"
"আমার সেই গম্ভীর পাপা তো ফোন করলেই শুধু কাঁদে ফোনে।"
"আমার মাও তাই। তখন আরোও খারাপ লাগে।"
"আসলে আমাদের এক বছর মাত্র হয়েছে তো তাই অভ্যেস হয়নি বাবা-মায়ের। আসতে আসতে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর জিনিসপত্র গোছানো শেষ?"
"হ্যাঁ ভাই।"
"কখন বেরুবি?"
"এই আধ ঘন্টার মধ্যেই।"
"থোরা সা ভি হিলনা মাত।" একজন বন্দুকধারী মুখে কালো কাপড় বাঁধা জঙ্গী ত্রীদিব আর অংশুমানের পেছন থেকে মাথায় বন্ধুক ঠেকিয়ে বললো।
সাথে সাথে অংশুমান আর ত্রীদিব হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে, ওদের সেনা ক্যাম্পে জঙ্গীহানা পড়েছে।
অংশুমান চালাকি করে হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা বন্দুকটা নিতে গেলে জঙ্গী টের পেয়ে যায়, আর সাথে সাথে এক সেকেন্ডেরও দেরী হলো না। জঙ্গীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল অংশুমানের তাজা প্রাণ।
তেরো ঘন্টার জঙ্গী আর সেনার লড়াইয়ে পাঁচজন সেনার মৃত্যু ঘটলো। অংশুমানের মতো ত্রীদিবের তাজা প্রাণটাও অকালে চলে গেল।
দেবীর বিসর্জনের দিন অংশুমান আর ত্রীদিবের সাথে আরোও তিন জন শহীদ যুবকের মৃতদেহ এসে পৌঁছালো ওদের বাড়িতে। যেখানে মানুষ ব্যস্ত দুর্গামা চারদিন বাপের বাড়ি থাকার পরে ফিরে যাওয়ার দুঃখ নিয়ে। সেখানে পাঁচ মায়ের কোল খালি করে চলে গেল ছেলেগুলো।
আমাদের দেশে যেখানে একজন সেনার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেখানে উৎসব না মানানোটাই ভালো। আমরা যখন নতুন জামা কার কয়টা হলো, কার এখনো জুতো কেনা হলো না, কার অফিস এখনো বোনাস দিল না, কার সেল্ফিটা ভালো উঠলো না, পূজোর চারদিন বৃষ্টি হবে কিনা, দুর্গাপূজায় ঘোরার জন্য বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড পাবো কিনা বা কোন দুর্গা প্যান্ডেলের থিমটা ভালো, এই নিয়ে ব্যস্ত। তখন আমাদের দেশের সেনা পরিবার থেকে দূরে সীমান্তে দেশকে পাহাড়া দিচ্ছে। যাদের জন্য আমাদের বাড়িতে উৎসবের আলো ফুটছে৷ তাদের বাড়িতেই ছেলে বা মেয়ের শহীদ সংবাদে বাজে বিসর্জনের সুর।