ছেঁড়া পালকের ঠিকানা
১
হাওড়া স্টেশনের বাইরে ট্রলি নিয়ে প্রায় একঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে । বাইরে রোদ ।সকাল দশটা । সামনের রাস্তা দিয়ে অনবরত বিরামহীন জন স্রোত , ঠিক যেন নদীর জলধারা । এই স্রোতের একপাশেই অপেক্ষা করছে বনিতা । ট্রেন থেকে নেমেই এই শহর তার কাছে অপরিচিত হয়ে উঠেছে !
কুড়ি বছর আগে এখানেই সে এসে দাঁড়িয়েছিল ; সন্ধ্যা ছিল ; সূর্য ডুব দিয়েছে । কলকাতার আকাশে নিভে যাওয়া সূর্যের জন্য কেউ অপেক্ষা করেনা । এতো সময় নেই । বনিতা অপেক্ষা করেছিল । পাঁচ বছর আগে , সেইদিন সে একা ছিলনা । পাশে একজন ছিল । বনিতাকে নিয়ে ট্রেনের বগিতে বসিয়ে দিয়েছিল । ট্রেন ছাড়তে তখনো আধ ঘণ্টা বাকী , নিজের হাতে বাকী রাস্তা যাতে বনিতার ক্ষিধে না পায় – তারজন্য পাউরুটি , কলা , তিনটে ডিম আর জলের বোতল কিনে দিল । যাওয়ার সময় বনিতার চোখে জল ছিল ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে , বনিতা দেখল এখন দশটা কুড়ি ।এই সময় সামনে অনেক মানুষ নিজেদের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে । এদের দিকে তাকিয়ে মনে –মনে বলল – আজ শুধু আমিই কোন কাজ করব না !বনিতা ধাবিত উল্কাদের দিকে তাকিয়ে -- এক স্থির শান্ত গ্রহাণু হয়ে পর্যবেক্ষণ করছে ! জীবন চলমান । এখানে কেউই থামতে রাজী নয় । মেয়েটা ছুটে চলা মানুষের মুখে অদ্ভুত আলো দেখতে পায় । স্থির জীবন আসলে পরাজয়ের নাম ।
এখানে ছুটি কাটাতে আসেনি । শিলিগুড়িতে বনিতার নিজস্ব এন জি ও রয়েছে ; অনাথ পথ শিশু আর আশ্রয়হীন বয়স্ক মানুষের হয়ে কাজ করে । সেই সূত্রে নানা রকমের প্রোজেক্ট তাদের করতে হয় । এমনই একটা প্রোজেক্ট নিয়ে কলকাতার কিছু ব্যবসায়ী মহলের সাথে মিটিং হবে । তারাই গেস্ট রুমের ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিল ।বনিতা নিজেই সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে । একা-একা কাউকে না জানিয়ে কলকাতা ঘুরে বেড়ানোর একটা মজা রয়েছে । প্রায় কুড়ি বছর বাদে এই শহরে ফিরে আসা । এই শহরে শ্বাস নেওয়া । এই শহরের চীৎকার কান পেতে শুনে নেওয়া । এটাই জীবন । শিলিগুড়িতে বনি খুব পরিচিত । কলকাতায় ব্যবসায়ী মহল তাকে চিনলেও , শহরের মানুষের কাছে অপরিচিত । সে চাইছে , তিনদিনের ট্যুর তাকে কুড়ি বছর আগের মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যাক । সেই উন্মাদনা , উত্তেজনা , স্বপ্ন ---- এই সব কিছু আজও বনিতার কাছে খুব দামী ।
‘বনি ’--- চেনা স্বর কানে আসতেই , স্মৃতি থেকে ফিরে এলো বনিতা । হারিয়ে যাওয়া মন গুটিয়ে নিয়েছে । সামনে লম্বা মধ্যবয়সী উজ্জ্বল বর্ণের পুরুষ দাঁড়িয়ে । তার দিকে তাকিয়ে হাসল । বলল – দেরী হয়ে গেলো ! আসলে ...
বনিতা পুরুষটির দিকে তাকিয়ে বলল – থাক , ফোন করে আমায় যেতে বলনি , তাই ভাগ্য ভালো ।
-রেগে গেলে ?
- শিলিগুড়ি থেকে জার্নি করে আমি এমনিতেই ক্লান্ত । এখানে মানে এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে , আমার ঝগড়া করতে ভাল লাগছে না । প্লিজ গেস্ট হাউস ঠিক হয়েছে ?
-একদম । দু’দিন আগেই সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে । যেমন বলেছিলে , একদম অচেনা । তোমার রুমের জানলা থেকে দেখা যাবে সামনের সবুজ মাঠ , বাগান । লোকের ভিড় নেই । নির্জন গলি ।
-এখন আমরা যাব কোথায় ?
-সল্টলেক । আজ সারাদিন ঘুরব । তারপর গেস্ট হাউস ।
-মানে , এই ট্রলি নিয়ে ঘুরব !
-আচ্ছা তাহলে , আগে চলো গেস্ট হাউসে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর না হয় বাকী প্ল্যান ।
-গেস্ট হাউসটা কোথায় ?
-সল্টলেকে । অফিসের গাড়ি ইচ্ছা করেই আনিনি । আমি চাইছি আজ আমরা আমাদের কুড়ি বছর আগের জীবনটা উপলব্ধি করব । তাই দেখো হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে এসেছি !
বনি দেখল , ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে । সময় নষ্ট না করে দু’জনেই উঠে বসল ।
২
গাড়ি ছুটছে। কলকাতার রাস্তা , ফুটপাত , কোলাহল , দূষণ , বিজ্ঞাপন , স্বপ্ন , স্বপ্নবিলাসী মানুষের ছুটোছুটি নিয়ে ছুটে চলেছে । এত কিছু দেখে , বনিতা বলল – আবির , আমাদের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল ?
-রবীন্দ্রভারতী । বুধবার । বিচিত্র ভবনের সামনে । ভুলে যাইনি । মানুষ ভোরে সুন্দর স্বপ্ন দেখলে , ঘোরটুকু চোখে লেগে থাকে , দিনের শেষেও তা মুছতে পারেনা ।
-মুছতে চায়না । মানুষ খুব চালাক , ভালো স্বপ্ন মনে রেখে দেয় ।
-যেমন আমরা দিয়েছি !
কথাটা বলেই বনিতার হাতের নরম আঙুল গুলো , পুরুষটি নিজের হাত দিয়ে ধরল । চোখের ঈশারা করে বনিতা বুঝিয়ে দিল , এখন নয় ; ড্রাইভার আছে ।
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল - দিবাকর আমাদের কত বয়স হল ?
-আমার চল্লিশ । তোমারটা বলতে পারব না । দেখে কুড়ি -পঁচিশ মনে হয় ।
বলেই দিবাকর হাসল । বনিতা দিবাকরের দিকে তাকিয়ে বলল – আমি বুড়ি । মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি ।
দিবাকর পকেট থেকে সিগারেট বের করতেই , বনিতা চোখে নিজের আপত্তি বুঝিয়ে দিল । জানালা থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল - দিবু , শহরটা আর আগের মতন নেই ।
-পৃথিবীতে কখনই কোন জায়গা আগের মতন থাকেনা বনি । পরিবর্তন আসবেই । তবে এখনো শীতে গঙ্গার ধারে সদ্য যুগলেরা রোদ পোহায় । ময়দানে ভীড় হয় । ভিক্টোরিয়াতে কোন বেকার সাহসী যুবক তার সদ্য প্রপোজ করে আপন করে নেওয়া প্রেমিকার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে ।
-সে ঠোঁট নিশ্চই কাঁপে । জীবনের প্রথম চুমুটাও অনেকে ঠিক করে দিতে পারেনা । চুমু দিতে গিয়ে কামড়
হয়ে যায় !
দিবাকরের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল । কুড়ি আগের যুবক ,তার প্রথম চুমু ব্যর্থতার জন্য আজো লজ্জিত ; মেয়েটির বয়স এখন চল্লিশ , পাশে বসে আছে , সে ভুলতে পারেনি । কোন মেয়েই হয়ত প্রথম ভালোবাসার চুম্বনের স্মৃতি ভুলতে পারেনা ।
-তুমি সত্যি , এখানেই এইসব বলতে হত !
দিবাকরের দিকে তাকিয়ে বনিতা শব্দ করে হেসে উঠল । এতক্ষণ এমন এক বিস্ফোরণের জন্যই সময় অপেক্ষা করে ছিল । থুতনিতে হাত রেখে বলল - নদের চাঁদ নিমাই আমার । লজ্জা করছে না ? এদিকে একা পেলেতো নির্লজ্জের মতন সারা মুখ কামড়ে দাও ।
বলেই আবার হাসতে শুরু করল ।
গাড়ি সেক্টর ফাইভে ঢুকে পড়েছে । নিক্কোপার্ক কাছেই , ছোট্ট গলি । সেখান থেকে ঢুকছে । একটা তিনতলা রিসর্টের সামনে এসে থামল । গাড়ি থেকে নেমেই দিবাকর ট্রলি ব্যাগটা হাতে নিয়ে , ড্রাইভারকে টাকা দিতে গেলেই বনিতা বলল – এই ফেয়ারটা আমিই দেব । সারাদিনের দায়িত্ব তোমার ।
দিবাকরের দিকে তাকিয়ে বলল - সোনা , প্লিজ ইগোতে নিও না। এমন কথাই ছিল ।
-ঠিকাছে । মনে থাকে যেনও । তা ফ্রেশ হয়ে নাও । তারপর গল্প করা যাবে ।
বনিতা তাকিয়ে রয়েছে , তারপর নরম আঙুল চালিয়ে দিবাকরের এলোমেলো ঘাড়ের কাছে লুটিয়ে পড়া চুল ঠিক করে বলল – আজ অফিস থেকে ছুটি । আমি ছাড়বনা । কিছুতেই না।
-কিন্তু ?
-দিবা , আবার সেই কবে দেখা হবে ঠিক নেই । আজ গোটা দিন আমার সাথে থাকো । এখানে এসেছি শুধু তোমার সাথে কিছু সময় কাটাবো বলে । একদিন আমাকে সময় দিতে পারবে না ?
-তা নয় । কোম্পানি একটা বড় প্রোজেক্ট পেয়েছে । দিন-রাত আমরা স্টাফেরা চেষ্টা করে চলেছি । অন্তত এক ঘণ্টার জন্য , আমাকে ছাড়ও ডার্লিং । তারপর কথা দিচ্ছি লাঞ্চের পর বিছানায় তোমাকে পুষিয়ে দেব ।
দিবাকর ভীষণ দুষ্টু । কলেজের দিন গুলোতে সে এর থেকেও বেশি বেয়াদপ ছিল । অসভ্য ছিল । বর্বর ছিল। এমন হয়েছে , বৃষ্টির দিনে ; মেঘলা আকাশের নীচে সকলেই আকাশ ভাঙা বৃষ্টির ভয়ে আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত । ক্যান্টিনের পিছনে , ফাঁকা জায়গা দেখে --- দিবাকর দ্রুত চুমু খেয়ে নেয় ! বনিতা কিছু বুঝে উঠবার আগেই টের পায় থুতু মেখে গিয়েছে !ঠোঁট মুছে বলেছিল - অসভ্য ।
দিবাকর চুমু খায় না , দিবাকর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চোষে ।
পুরানো দৃশ্য ভাসতেই লজ্জা পেয়ে গেল । দিবাকর বলল – অনেক হয়েছে । রুমে খাবার আসবে ? নাকি গিয়ে খাবে ?
বনিতা হাসল । বলল – রুমেই ।
৩
হোম ডেলিভারির খাবার ভর্তি বাক্স গুলো কাঁচের টেবিলের উপর রয়েছে । পাশের বিছানায় ওরা শুয়ে আছে । দুজনেই নগ্ন । নরম সাদা বিছানার উপর দুই পুরুষ আর নারী শুয়ে রয়েছে । ঘড়িতে দুপুর তিনটে । বিছানার পাশে বিয়ারের বোতল ।
বনিতা চিত হয়ে শুয়েছে । দিবাকর তার বুকের উপর উপুড় হয়ে স্তনের খাঁজে নাক ঘষছিল । কিছুক্ষণ আগে জিভ দিয়ে স্তনবৃন্ত ভিজিয়ে দিয়েছিল । বনিতা হাত দিয়ে মাথার চুল টানছে । ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো ।
-বনি , তুমি এখনো সেই আগের মতন আছো !
-তুমিও । অথচ আমরা আর সেই আগের সময়ে নেই ।
-তোমার জন্য খারাপ লাগছে ।
কিছুক্ষণ বনিতা দিবাকরের দিকে তাকিয়ে বলল – যা হয়েছে , তা ভুলে যাও । আমিও গিয়েছি । জীবনে সবাই সব কিছু পায়না । সব কিছু পেলে, না পাওয়ার আক্ষেপই থাকবেনা । জীবনকে রোমাঞ্চকর রাখবার জন্য এই না-পাওয়া গুলোই অনুঘটকের কাজ করে । দিবা , আমরা দু’জনেই যখন এই এতটুকু পাওয়া নিয়ে বেঁচে রয়েছি , কেন আমাদের ব্যর্থতাকে স্বীকার করব ?
-আমার বাড়ির লোক তোমাকে মেনে নেবে না । তাই বিয়ে করলাম না । আমি জানি , তুমি বলবে আমাদের কিছু করবার ছিল না । সত্যিই ছিল না ? নাকি আমি কাপুরুষের মতন পালিয়ে গেলাম !
-পালিয়ে কেন যাবে ? বিশ্বাস করো আমি বিয়ে করিনি , তাতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই । এটা আমার নিজের ইচ্ছা । তোমার পরিবারের দায়িত্ব তুমি নিয়েছো । আমি জানি তুমি দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নও ।
দিবাকর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল । দু’জনের শরীর এই অনন্ত তৃপ্তিতে ভরে গিয়েছে । বনিতা গভীর নিঃশ্বাস নিল । ঘড়িতে চারটে কুড়ি । বন্ধ কাঁচের জানালার ওই পাড়ে সোনালী আলোর বিকেল । সবাই যেন অপেক্ষমান দর্শক , সুযোগ দিলেই ওদের জড়িয়ে ধরবে ।
দিবাকর বিছানা থেকে নেমে ট্রউজার পড়ে নিল । বনিতা পাতলা নাইটি পড়ে নিয়েছে ।
ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে , সিগারেট ধরিয়ে দিবাকর বলল - চারপাশে বিকেলের সুর ছড়িয়ে পড়ছে । পাখিরা সুর করে গেয়ে চলেছে । এদের মনে আমাদের মতন এতো জটিলতা নেই ।
পিছনে দাঁড়িয়ে বনিতা শুনছিল । কাঁধে হাত রেখে বলল – মানুষ এতো স্বাধীন নয় । তাকে অনেক হিসেব কষতে হয় , বুঝলে ?
মাথাটা দিবাকরের কাঁধে ছুঁইয়ে বলল - এই পাঁচ বছর আমরা এখানে দেখা করছি । তোমার বাড়ির লোক জানেনা । তুমি ভীতু নও । দেখো যারা অন্যকে কষ্ট দিতে পারেনা , তাই নিজের কষ্ট বুকে লুকিয়ে রাখে -- তাদের দুর্বল ভাবা ঠিক নয় । দায়িত্ব জ্ঞানহীন কাপুরুষ ভেবে নেওয়াটাও ঠিক নয় ।
-আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছো ?
-না । আমি বলছি , আমাকে ভালবাসছো এটাই অনেক । বিয়ে হলে আমরা এক সাথে থাকতে পারতাম।
-ভালোবাসার মর্যাদা পেতাম ।
দিবাকরের দিকে তাকিয়ে বলল – তারমানে , আমাদের প্রেমের স্বীকৃতি দেবে চারপাশের মানুষজন ! এই প্রেম আমাদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় , যতটা সমাজের কাছে ?
-আমি বলিনি । তবে তোমার জীবনে আমার পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল ।
-মানে ? দিবাকর আমাদের মেয়েদের এতটাই অসহায় ভাবো ? বিয়ে করলেই পাশে দাঁড়ানো হবে । সারাজীবন শুধুমাত্র পরস্পরকে ভালবেসে পথ চলা যাবে না ! তোমার নিজের আলাদা পরিবার আছে । জানি সেখানেও তোমার দায়বদ্ধতা রয়েছে । তুমি নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেই পারো । আমি আসব না ।
-আমার থেকে তুমি আলাদা হতে পারবে ? এত দিন চেষ্টা করেছি । ভুলতে পারিনি । তুমিও পারনি । আমি জানি , তুমি সব কিছু ছাড়তে চেয়েছিলে । আমিই পারলাম না !
-দেখো আমি জানি , তুমি আমাকে সম্মান করো । একজন ভালোবাসার মানুষ এই সম্মানটুকুই চায় তার কাছের জনের থেকে ।
-তুমি বলতে পারলে । খুব সহজেই বললে । শুধু আমি জানি , প্রতিদিন আমার ভিতরে ঝড় উঠছে । ভিতরটা তোলপাড় করে , লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে আমার নৈতিক যন্ত্রণা ।
-আমার ভালবাসনা ? তাই হয়ত , আমার ভালোবাসা তোমাকে শান্ত করতে পাচ্ছে না ।
দিবাকর দেখল , মেয়েটার চোখে চাপা যন্ত্রণা ।
বাইরে বিকেল ফুরিয়েছে । সন্ধ্যার আলো আকাশের বুকে মেখে রয়েছে এখনো ; এই রঙ একেবারে নিজের । বনিতার বুকে চাপা কষ্ট হচ্ছে । খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে । দিবাকর দেখল , দুচোখ ভরা প্রতীক্ষা ; এখনই হয়ত চোখের জল নেমে আসবে ! দিবাকর , নরম ফোলা গালে হাত দিয়ে বলল – তোমাকে ভালোবাসতে না পারলে এমন ভাবে ছুটে আসতাম সোনা ?
বনিতা আলতো করে দিবকরের বুকে মাথা রেখে বলল – ভিতরে চলো ...পাখিরা বাসায় ফিরছে ।
চোখ দুটো অভিমানী মেয়ের মতন । বোঝাই যায়না , এই মহিলা অনেক পুরুষেরই কাঙ্ক্ষিত ।
৪
রাত দশটা বাজতে দশ মিনিট বাকী । বিছানায় দিবাকরের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে ছিল বনিতা । আজ ওদের বাইরে ঘুরবার পরিকল্পনা ছিল , ভেস্তে গেল । বনিতাই বলল , বাইরে গিয়ে সময় নষ্ট করতে হবেনা। এই যে নিবিড় হয়ে , দু’জনেই বুকে বুক ঠেকিয়ে , দিবাকরের বুকে মুখ রেখে শুয়ে রয়েছে ; এক মুহূর্ত তৈরি হয় । অনেক মানুষ গোটা জীবনে এমন অনুভূতির জন্য অপেক্ষা করে থাকে !
বনিতা চেয়ারে বসে , সিগারেট ধরিয়ে পা বিছানার উপর দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল - তুমি টাকাটা চেকে না ক্যাশে নেবে ?
উল্টো দিকে পুরুষটি , যাকে এতক্ষণ দিবাকর বলছিল সে জুতোর ফিতে লাগিয়ে বলল – ম্যাডাম চেকেই দিন ।
-
তিরিশ হাজার চেকে , আর এক্সট্রা তিরিশ ক্যাশে দিচ্ছি ।
ছেলেটি বলল – অতিরিক্ত কেন ?
-আজ তুমি আমাকেই সময় দিয়েছো । দেখো ডিয়ার রাত বারোটা হয়েছে । তোমাকে দশটা পর্যন্ত থাকবার জন্যই হায়ার করা হয়েছিল ।
ছেলেটি মনে – মনে বলল – এমনিতেও এই ক্লাইন্টের সাথে থাকবার সময় , মানসিক চাপ এতটাই থাকে যে নতুন খরিদ্দারের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেনা । তাই সে আর কোন খরিদ্দারের কাছে যায় না ।
তার কাজ টাকার বিনিময়ে যৌন আনন্দ দেওয়া । যারা তাকে টাকা দিয়ে ভাড়া করেন , অনেক সময়ই মুডের উপর নির্ভর করতে হয় । যৌন আনন্দের সাথে মানসিক আনন্দ দিতে হয় । প্রথম যখন বনিতার সাথে কথা হয় ,আর পাঁচজন খরিদ্দারের মতনই ভেবেছিল । বনিতা এক অদ্ভুত শর্ত রাখে । অবশ্য এরজন্য সে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাবে । ব্যাপারটা হচ্ছে অনিমেশকে অন্য একটি চরিত্রে অভিনয় করতে হবে । শুধু অভিনয় করলেই হবেনা , বনিতা বর্মণকে বিশ্বাস করাতে হবে । আজথেকে পাঁচ বছর আগে বনিতার সাথে অনিমেশের পরিচয় ।
এই পাঁচবছর ধরে এই বিশেষ দিনটিতেই দিবাকরের চরিত্রে অভিনয় করে অনিমেশ । দিবাকরের মুখ দিয়ে যে কথা গুলো বলতে হয় , তা বনিতার লেখা চিত্রনাট্য । পাঁচ বছর একই চিত্রনাট্য বলতে –বলতে , অনিমেশ বুঝতে পেরেছে , সে নর্তক না হয়ে অভিনেতা হতে পারত ।
পাঁচ বছরে সে বনিতাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি , দিবাকর চরিত্রের পিছনের রহস্য । কেনই বা এই বিশেষ দিনেই দিবাকর ফিরে আসে ? আজ ঠিক করে নিল জিজ্ঞেস করবেই । যদিও খরিদ্দারকে কোন কিছুই ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করা যায় না , তাও আজ একটু সাহস নিয়ে অনিমেশ বলেই ফেলল ...
বনিতা চোখ বন্ধ করে , সিগারেটের শেষ ধোঁয়া ছেড়ে বলল – তাহলে নাছোড় বান্দা ? আমি আমার দুঃখ অন্যজনের কাছে ভাগ করতে রাজী নই । তুমি টাকার জন্য আমাকে সঙ্গ দিয়েছো । তাও আমি তোমাকে আজ বলব । তুমি একদিনের জন্য হলেও দিবাকর । আমার দিবাকর । আমি তোমার ঠোঁট , বুক , ঘামের গন্ধে ... আমার পাঁচ বছর আগের দিবাকরকে খুঁজে পেয়েছি ।
-দিবাকর কে ?
-আমার কলেজ প্রেম । বলতে পারো প্রথম আর শেষ প্রেম । আমাদের বিয়ে হয়নি । আমরা আজও প্রেমিক –প্রেমিকা। কলেজে প্রথম দেখা । যা অভিনয় করেছো , সব সত্যি । আমার লেখা চিত্রনাট্যে মনগড়া সংলাপ লেখা নেই । সবটাই জীবন থেকে নেওয়া ।
-আপনারা যখন পরস্পরকে এতো ভালোবাসতেন বিয়ে করলেন না !
-না। দিবাকরের বাড়ির লোক আমাকে মেনে নিতে চায়নি । আমি বাড়ি থেকে ওকে আলাদা করতে চাইনি । দিবাকর না চাইলেও , আমার চাপেই বাড়ির কথায় বিয়ে করতে হল ।
অনিমেশ বলল – তার মানে আপনি একা , আর দিবাকর বাবু এখন নিজের বউ সংসার নিয়ে আনন্দে রয়েছেন । আপনি এখনো তাঁর প্রেমে ডুবে রয়েছেন !
বনিতার দু’চোখ জলে ভেজা । নাক টানল । অনিমেশ দেখছিল । মেয়েটাকে কেন জানি আদর করতে ইচ্ছা করছে । দিবাকরের ঠোঁট দিয়ে নয় , অনিমেশ হয়ে ।
বনিতা বলল – অনিমেশ , তোমার সাথে প্রথম যেই বছর দেখা করলাম । তার একবছর আগেই দিবাকর আত্মহত্যা করেছিল ।
কথাটা শুনেই , অনিমেশ চমকে উঠল । গল্প আচমকাই গতিপথ পাল্টেছে !
বনিতা চোখ মুছে বলল – আমার কথায় বিয়ে করলেও , নিজেকে ঠকাতে পারেনি । আত্মহত্যা করবার আগের দিন আমরা এই রুমেই ছিলাম । এগারোটা পর্যন্ত । যাওয়ার আগে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেল । বলেছিল সে চলে গেলে , আমি যেন চিঠিটা পড়ি ।
-আপনি পড়েছিলেন ?
-সেই রাতে পড়া হয়নি । পড়ের দিন আমাদের কাছের বন্ধুদের থেকেই খবরটা পেলাম , দিবাকর বাড়িতেই ঘুমের ওষুধ খেয়েছে । ডাক্তার চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না।
কথা থামিয়ে , জল ঢালল গলায় । আবার বলতে শুরু করল – চিঠি খুলে দেখলাম , দিবাকর নিজেকে ঠকানোর যন্ত্রণা মেনে নিতে পাচ্ছিল না । নিজেকে কাপুরুষ আর দায়িত্বহীন ভাবছিল ।এই পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে দেবে । তার এই অবস্থার জন্য দিবাকরের চোখে আমিই দায়ি ।
অনিমেশ দেখল , বনিতা বাচ্চা মেয়ের মতন ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে । বনিতা বলল – সেই দিন থেকে ঠিক করলাম আমি নিজেই নিজেকে ঠকাবো । দিবাকর চিঠিতে লিখেছিল ---- সাহস থাকলে অন্য মানুষ কে দিবাকর ভেবে ভালবেসে দেখব । সত্যিই আমি পারিনি । ঠিক করলাম একদিন , ওর মৃত্যু দিনে নিজেকে ঠকাবই । দেখব , দিবাকর প্রতিদিন নিজের কাছে নিজে ঠকে যে যন্ত্রণা পেয়েছে , তার প্রায়শ্চিত্ত আমি আমার যন্ত্রণা দিয়ে করতে পারি । অনিমেশ দিবাকরের শেষ চিঠিতে উল্লেখ করা কথা কে মাথায় রেখেই আমার এই নাটকের চিত্রনাট্য । বিশ্বাস করো অনমেশ , আমি দিবাকরকে ভালো দেখতে চেয়েছিলাম ।
বনিতা কাঁদছে । মুখে দু’হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে –ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।
অনিমেশ ভাবছিল , পাখির দেহ থেকে যে পালক ছিঁড়ে যায় , তা সারা জীবন উড়ে চলে । পাখির কাছে ফিরে আসেনা । অনিমেশ চাইলেও দিবাকর হতে পারবেনা । বনিতা নিজেকে ঠকিয়েও , ছেঁড়া পালকের ঠিকানা খুঁজে পাবেনা............