নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুভম চক্রবর্তী





অপেক্ষা




চায়ের বাসন টা উলটাতেই দেখি শয়ে শয়ে হাজার হাজার পিপড়ে,
আমাকে ওদের মারতেই হবে,অপেক্ষার কৌতুহল আমার নেই।ভাবছি জলে ডুবিয়ে মারবো না আগুনে পুড়িয়ে,যন্ত্রনার তুল‍্য মূল্য হিসেব করছি,
ওমনি একটা বিড়াল আধময়লা বেসিন থেকে আমার দৃষ্টি টেনে নিয়ে গেলো ব‍্যালকনি তে,ব‍্যালকনি থেকে এক ঝাপ(নিসঙ্গ দুপুরে দু বার কাকের ডাক) -বিপরীত দোতালায় প্রেমিকা সুলভ কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে রীনা বারান্দায় পায়চারি করছে,কানে মোবাইল ফোন(এই বাড়িটাই আমার বাড়ি,এই বাড়িটাই আমার মামাবাড়ি,এই পাড়া,এই পঞ্চাশ একর আকাশ আমার পূর্বপুরুষের,তোকে গিলে খাবো ধরণের প্রবৃত্তি সূচক মনস্তত্ত্বের ব‍্যাকগ্ৰাউন্ড)কোনোদিন কোনো অপেক্ষা ছিল না টাইপ মুখভঙ্গি,
আমি চোখ উচিয়ে ওর মাথার উপর দিয়ে আকাশ টা দেখে নি,
ও দেখে নেয় আড়চোখে আমাকে,
না নিশ্চিতভাবে এখনো নীল ওর চোখদুটো আর আকাশ।
আসতে করে নামিয়ে রাখি চায়ের বাটি,তখনো গিজগিজ করছে পিপড়ে,(কোনো জীবন তুচ্ছ নয়-কোনো জীবন তুচ্ছ নয়-কোনো জীবন তুচ্ছ নয়! ধরণের বিদ্রুপ মূলক নেকা মনস্তত্ত্বের ব‍্যাকগ্ৰাউন্ড)
না আমার কোনো তাড়া নেই,
বাইরে তাকাই,রীনা তখনো দাড়িয়ে।
আমি 'রীনা ও আকাশের' মাঝে কোথাও একটা তাকিয়ে,
সবটাই কি আশ্চর্যরকম নীল-
দুপুর, দুপুর থেকে রীনার চোখ,চোখ থেকে আকাশ,আকাশ থেকে এক ঝাপ-বিড়াল টা আবার ফিরে এসেছে,(আমি বিড়ালের মতো ঝাপ দিতে পারিনা কেনো?)
রীনা তখনো দাড়িয়ে,পিপড়ে গুলো তখনো গিজগিজ করছে(আমরা বেচে আছি-আমরা বেচে আছি-আমরা বেচে আছি-আমরা বেচে আছি! ধরণের জটিল মনস্তত্ত্বের কমপ্লেক্স ব‍্যাকগ্ৰাউন্ড)।



পিনাকি






কুকুর ও  মানুষের গল্প  

        


                                   ১

কেবিন থেকে বেরিয়ে , নার্সিং  হোমের  বারান্দায় দাঁড়িয়ে  দুচোখ  ভিজে  গেল  অব্যয়ার   রেলিং –এ হাত রেখে  সে   নিজেকে  শান্ত  করবার  চেষ্টা  করছে  ।  এই  মুহূর্তে  ভিতরে  ভয়ংকর  ঝড়  বইছে , সব  কিছু  উল্টো –পাল্টা  করে  দেবে  ! নিজেকে থামাতে  হবে  ।  সে  জানে  এই  সময়টুকু  নিজের  সাথে  লড়তে পাচ্ছে  না , গোটা রাত  তার জন্য  অপেক্ষা  করছে ।   শীততাপ  নিয়ন্ত্রিত  কেবিনের  ভিতর ,   নার্সিংহোমের  বিছানায়  যে   লোকটি  শুয়ে  রয়েছে ,  তার  সারা  শরীর  ব্যান্ডেজ , চ্যানেল  , নলে  বিদ্ধ । হুঁশ  এখনো  ফেরেনি  । সে   জানতেও পারবেনা  অব্যয়ার  যন্ত্রণার  গভীরতা ।   
দু’ চোখ  বেয়ে  নেমে  আসছে  জলের  ধারা । আঙুল  দিয়ে  মুছল ।   নিজেকে  শক্ত  করতেই  হবে  । সে  নিজের  মনে  নিজে  বলল -  এতো  ভেঙে পরলে  চলবে  না । প্রতিদিন  কত মানুষের জীবনে  দুর্ঘটনা  ঘটছে । তাদের  অনেকেই  আর সুস্থ জীবনে  ফিরতে পারেনা ; সংসারের  শেষ আর্থিক  সম্বলটুকু  চলে যায় !
অব্যয়াই  নিজেকে  সামলে  নিচ্ছে  । এখন ওর অনেক  কাজ  ।  ভিতরে কেবিনে  ভাঙাচোরা  দেহ  নিয়ে  ,  খাদ্যবহনকারী নলে  বিদ্ধ --  যে  মানুষটা ,  জীবন –মৃত্যু নিয়ে  লড়ছে ;  সেই মানুষটা জানতেও পারছে না --  তার   কেবিনের  বাইরেও  যুদ্ধের  আঁচ এসেছে ! দু’জন  মানুষ  এখন  পরিস্থিতিগত  ভাবে  আলাদা  অথচ  তাদের  ভিতরকার লড়াই  একই  কেন্দ্রে , আবার  এই  লড়াইয়ের  শেষে  জীবনের  গতিবিধিও একই  ভাবে  ঘুরবে । 
পিছনে  বছর  চল্লিশের  একজন  লোক  এসে  দাঁড়ালো ।  বলল – মিসেস  শুক্লা , ফিরবেন  তো ?
অব্যয়া  মাথা  তুলে  দেখল , নিবেদিতার  স্বামী ! এখন  আর অলকেশ বাবুকে  দেখলে  বিরক্তি  লাগেনা , এই  নার্সিংহোমেই  নিবেদিতা  ভর্তি রয়েছে ।  হয়ত  কাছাকাছি কেবিন  আছে  । অলকেশ  দেখতে  পেয়েছে  , তাই  কথা  বলতে এসেছে ।  এখন  মনের অবস্থা  এতটাই  এলোমেলো ,  কথা  বলতে  মন চাইছে  না । তাও  নিজেকে  জোর  করেই কিছুটা  একঘেয়ে  পরিবেশ থেকে  পালানোর তাগিদ  নিয়েই  , অব্যয়া  বলল – অলকেশ  , নিবেদিতা  কেমন  আছে  ?
নিবেদিতাকে  নিয়ে  বিন্দুমাত্র  ঘাঁটাঘাঁটি  করবার  ইচ্ছা   তার  নেই  ।  এই  বিষয়টা  নিয়ে  আর ভাবতেও    মন চাইছে  না । অব্যয়া  বলল – ওকে  নিয়ে  বিজি    রয়েছি , একদিনও  দেখা  করতে পারিনি  ।  খুব  লজ্জিত  । 
-লজ্জার  কিছু  নেই  । এতবড়  একটা  অ্যাক্সিডেন্টের  সব  ঝামেলা আপনাকেই  সামলাতে  হচ্ছে । এখানে  আপনাকে  সাহায্য  করবার মতন তেমন কেউ   নেই  ।  অফিস আর বাড়ি  সবটাই  আপনি সামলাচ্ছেন । আমি বুঝি  , মিসেস  শুক্লা ।  ও  দুঃখিত অভ্যাসবশত  আপনাকে  শুক্লা  সারনেমে  ডাকছি ।
-ভুল  কোথায় ?  বিয়ের পরে  মেয়েরা    শ্বশুর  বাড়ির  পদবী  ব্যবহার করে ।
-সে  ঠিকাছে ।  কিন্তু আমি জানি  , আপনি   বিবেক বাবুকে  ডিভোর্স  দেবেন ।

 কিছুক্ষণ চুপ থাকল ।  অব্যয়ার   হাতে  যে  রুমাল আছে  ,  কপালের  ঘাম  মুছল ।  বলল – দেখুন  অলকেশ  আপনি  আমার থেকে  এই  ব্যাপারে  এতো  শিওর  কেমন  ভাবে  জানিনা  ! দেখুন  কিছু  মনে  করবেন  না , এই নার্সিংহোমে  আমিই  বিবেকের  স্ত্রী ।  ভর্তির  সময়ে  যে  ফর্ম  ফিলাপ  করেছি , স্ত্রী  হিসেবে  আমার  নামই উল্লেখ  করা  আছে  । এখন  ডিভোর্স  নিয়ে  ভাবছি না । ওকে  সুস্থ  করে  তুলতে  হবে । যত  দ্রুত  সম্ভব । তারপর  না  হয়  ভাবা  যাবে ...
-আপনি  ভুল  বুঝলেন ।  দেখুন আপনাদের  ডিভোর্স  পেপারে  কিন্তু  বিবেক  বাবুর  সই আছে  । আর  ঘটনার  দিন  বিবেক শুক্লা  এই  নিয়ে  খুব  উল্লাসিত ছিলেন  ।
অব্যয়ার  গলা  শুকিয়ে  আসছে ।  খুব  কাঁদতে  চাইছে  ।  বুকের  ভিতর কষ্টের  গোলা আটকে  আছে  , দমবন্ধ  হয়ে  আসছে । বিবেক  তাকে  যে  অপমান  করেছে  তার  থেকেও , পুরুষের  কাছে  সকল  ভারতীয়  নারীর  ব্যবহার  এমনই !   সংবাদপত্রে  এত  খবর ছাপা  হয় , এত নারীর প্রতি  বঞ্চনার  কথা  বলা  হচ্ছে ---  সব  কিছু  সত্যি  বলে মন  মানতে  চায়না । অথচ  নিজের  জীবন  থেকে  বুঝতে  পারছে  ,  ভারতীয়  সংস্কৃতি  নারীকে  দেবী রূপে  পুজো  করলেও ,  মানুষ ভেবে  সম্মান  দেয়না  ! সে  এতটাই  অবজ্ঞার  পাত্র  ? নাকি  সিংহভাগ পুরুষই  ডিভোর্সের  সই  করে  তার   সঙ্গিনীকে  বলতে  ভুলে  যায় ,  বদলে  মদ্যপানের  আসরে  বুঁদ  হয়ে  থাকে  ।  সে  ঝগড়া  চায়নি । খোরপোষ  দাবি করেনি ।  বিবেকের  কাছ  থেকে  একফোঁটা  সম্মান  চেয়েছিল ।
এই  ছোট্ট  শব্দটা সামান্য , উচ্চারণ করতে  খুব  অল্প সময়  নষ্ট হয় ;  অথচ অনেকের  পুরো জীবনটাই  নষ্ট হয়ে  যায়  সামান্য  শব্দটার  বাস্তব   অনুভূতির জন্য  ।  অব্যয়া    তেমনই  কাঙাল । বিবেক  তাকে  কম কষ্ট  দেয়নি , তাই  নতুন করে  এমন ব্যবহার  খুব একটা   যন্ত্রণা দিচ্ছে  না ।  অলকেশের  মুখের ভাবে  নিজেকে  অপমানিত মনে হচ্ছে । চোখ  ফেটে যাবে দুঃখে ,  একফোঁটা জল  গড়াবে না ; কেননা  সে  জানে  তার  চোখের জল    অসহায়  নারীর  দুর্বলতাই  প্রমাণ  করবে । এই কয়েকদিনে , সে  বুঝে  গিয়েছে  বিবেকের  সাথে  রাগারাগি  করে  নতুন চাকরিতে  নিয়ে  সে  সেই সব  মানুষদের কাছে  চ্যালেঞ্জ  ছুঁড়ে  দিয়েছে  , যারা  নারীদের  এই   সময়েও   আর্থিক ভাবে  দুর্বল  দেখতে  চায় ।  অলকেশ  যেমনই  হোক , সেই  দলের  সার্থক প্রতিনিধি --- এটা  বুঝতে  অসুবিধা  হয়নি । 
মুখ  তুলে  অব্যয়া বলল -  আপনি  এখন  ফিরছেন ?
ঘাড়  নামিয়ে   অলকেশ  বাঁ –হাতে  ঝুলে  থাকা  ঘড়িতে  দেখল , বিকেল  ছটা । 
-হ্যাঁ , রাতে  আর আসবনা  আয়া আছে  ।  ডাক্তাররা  বলল , এখন  অবস্থা  ঠিকাছে । আগের  থেকে  অনেকটাই  ভালো ।  তাই  ভাবছিলাম   সাতদিন  ভালোই  টেনশনে কাটল  । 
অব্যয়া ভাবল , আজকে অলকেশের   সাথে  কথা  বলে  বিবেকের  আগামী  দিনের  পরিকল্পনার  জানবে । বিবেক   নিজের  মুখে  কিছু  বলেনি । তারা  ঠিক করেছে   আলাদাই  থাকবে  ।  বিবাহ বিচ্ছেদ ফাইল  করে । দীর্ঘ   সময়  বাদে  , দু’পক্ষকেই কাগজ  পাঠানো হয় ।  বিবেক  আগেই  সই করেছে । অব্যয়া স্বাক্ষর করেনি ।   এখন উল্টোটা  ভাবছে  ।  বিবেকের  দুর্ঘটনা যখন  ঘটল , তার  অবস্থা  দেখে  সে  সই করবার কথা  ভুলে  যায় । এখন সব  কিছু তাকেই  করতে হবে  ।  বিবেকের দুই ভাই এই  ঝামেলা  নেবে না  বলেছে ।  বৃদ্ধ মা   অপারগ । তাই স্ত্রী  হয়ে আইনি ভাবেই   সমস্ত দায়িত্ব  তুলে  নিয়েছে ।
এইসব  কথা  ভাবতেই  চখ চোখ জলে  ভরেছে ।  খেয়াল  করল ,  অলকেশ  বলল – চলুন , ক্যান্টিনে  গিয়ে  কফি  নিতে  -নিতে  কথা  বলা যাবে । এমনিতে  বাড়িতে  ফিরতে  ভালো লাগছে  না ।  নিবেদিতার  ফাঁকা   ঘরটা  দেখলেই , বুক  টনটন করে ওঠে ।


সন্ধ্যা  ছটায় ওরা , নার্সিং  হোম  থেকে  বেরিয়ে  উল্টো  দিকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত  ক্যাফেতে  ঢুকল ।  মুখোমুখি  বসে  রয়েছে ।  অলকেশ  কফি  আর হাল্কা স্নাক্সের  অর্ডার  দিল ।
শুরু  প্রথমে  অলকেশ  করল । - আপনার  প্ল্যান  কী ? 
অব্যয়া  বলল  -  জীবনটা  বড্ড  ভঙ্গুর । প্রতি  সময়ে  যে  কোন  স্বপ্ন  ভেঙে যেতে পারে  ।  এখন আর  পরিকল্পনা করিনা ।  জীবনকে  নিজের  মতনই  দেখতে  শিখছি ।  ভালোই লাগছে  ।  আগে  থেকে  প্ল্যান  করে  লাভ আছে  বলে  মনে  হয়না ।জীবনে যা  হবে  --- তা হবেই । তাকে  হতে  দেওয়া বা না- দেওয়া , আমাদের হাতে  নেই। তবে  সেই  হওয়াটা  হয়ে  যাওয়ার পর  , নিজেকে মানিয়ে  নিয়ে  এগিয়ে  চলাটাই জীবনের সংগ্রাম ।  লড়াই ।
-আপনি দেখছি  , জীবন নিয়ে  অনেক অভিজ্ঞ ।
-আগে ছিলাম না  । এখন  হয়েছি ।  অভিজ্ঞতা কম হলনা । পঁয়ত্রিশ  বছর  বয়স । 
-আপনি  চাকরি  করছেন ,  আপনার  চারপাশের  অনেকেই  মেনে  নিতে  পারেনি  ।  বিবেক বাবু  নিজেও  চাইতেন না।
-বিবেকের  চাওয়াটা  আমার কাছে  ইদানীং কোন  গুরুত্ব হারিয়েছে ।  সত্যি  বলতে  আজ  আমি শুধু মাত্র  নিজেকেই   গুরুত্ব  দিচ্ছি ।  আর  দিয়ে যাব ।  অন্যের বোঝা হতে  চাইনা । আর এর  জন্যই  নিজের  শিক্ষাগত  যোগ্যতা কে  ব্যবহার করছি ।  আমি  চাইনি আর্থিক  দিক  দিয়ে  বিবেকের  উপর  নির্ভর করতে । 
-আমি  জানি  । এতটুকু বুঝি  , আপনি  নিজের আত্মসম্মান  বিসর্জন দেবেন না । আর আপনি  বিবেকের    বিশ্বাস ভাঙবেন না ।
-আমি  এতকিছু  বুঝিনা  । জীবনে এখন  যেই সিদ্ধান্তে  আমি  এসেছি , সেখান  থেকে  ফিরে  যাব না । কিছুর  বিনিময়েও নয় ।


অলকেশ  কফিতে  চুমুক  দিয়ে  বলল – বিবেক  আর  নিবেদিতা একসাথে  থাকবে  ।  যদিও  আপাতত  তাদের  সুস্থতার  উপর  নির্ভর করছে । আমি  নিবেদিতাকে  ছেড়ে  দেব  ।  আমাদের  ডিভোর্স  শুধুই  আমার   সম্মতির  জন্য আটকে  ছিল  । আমি  সই করে  দিয়েছি ।  
অব্যয়া  তাকিয়ে  রয়েছে ।  অলকেশ একদিন  সকালে  নিজে  এসে  ,   বিবেককে  শাসিয়ে  গিয়েছিল ।  বউয়ের সাথে  অন্য  পুরুষের  সম্পর্ক  মেনে  নেবে না ।  বিবেকের  কথা সেই দিন  অব্যয়া  সরল   ভাবে  বিশ্বাস    নিয়েছিল  ।  মেয়েরা  যাকে  ভালোবেসে  ফেলে  , তাকে  সম্পূর্ণ  বিশ্বাস করে । ভারতীয়  মহিলাদের  এই  চারিত্রিক  দুর্বলতা  (বিশ্বাস  করাটা  যদি   নিজের   ক্ষতি  করে )তাদের  পুরুষেরা  ভালোভাবে  অপব্যবহার করে । বিবেকের  মতন  পুরুষরা  তাই  নির্ভাবনায়   নিজের  প্রেম  চালিয়ে  গিয়েছে ।   একজন   মানুষ  জীবনে  একাধিক  মানুষকে  ভালবাসতেই  পারে  ,এই   ভালোবাসাকে  পরকীয়া    বলা  যায় না  ;  তা  যখন মিথ্যার  আশ্রয় নিতে  থাকে --  তখনই পরকীয়া  হয়ে ওঠে ।  বিবেক  আর  নিবেদিতার  সম্পর্ক  ক্রমশই  তেমনই  দিকে  এগিয়েছে ।  তখনো  অলকেশ  সব  কিছু  জেনেও   নিজের  স্ত্রীর  প্রতি  শক্ত  হতে  পারেনি । আর  অব্যয়ি  ভেবেছে  এইবার তার সব  কিছু  না  মেনে  প্রতিবাদ  করবার কথা  ।  বিবেক অন্য  নারীর প্রতি  নিজের  সবটুকু   ঢেলে  দিয়েছে ,  তার  ভাগে  কিছুই  নেই  ।  অনেক  রাতে  বাড়ি  ফেরা  ,  দীর্ঘ  সময়  ধরে  বিবেকের  অবহেলা  --- সবকিছু  মেনে  নিয়েও  বাড়িতে  থেকেছে  অব্যয়ি ! কেন ? সবটাই চারপাশের  লোকনিন্দার  জন্য ? ভারতে  বিবাহিত  মহিলাদের  স্বামীর  ঘরে অত্যাচারিত  হওয়া তেমন একটা আলোড়িত  ঘটনা নয় , যতটা   বিবাহ বিচ্ছেদ  নেওয়া  । লাথি  খাও  ,  বিষ  খাও  ,  খিস্তি  খাও  --- তাও   স্বামীর  ঘরে  খাও ।  স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা  মানেই  , সে   অন্য  পুরুষের  ভোগের  বস্তু ; তাকে  সমাজের  বাকী  পুরুষেরা নিজের  চাহিদায়   ব্যবহার  করবে  ।   তাই  হয়ত অব্যয়া বিবাহ বিচ্ছেদ   এড়িয়ে  থাকতে চেয়েছে  ।   
চোখ  ভিজে  গিয়েছে । চোখের  পলকে   অতীতের  স্মৃতি  ভীড়  করছে  --    বিবেকের  জ্বর ছিল , সারারাত সে নিজে   না  ঘুমিয়ে মাথায় ভেজা কাপড়  দিয়েছিল  । এইসব ন্যাকামো  বড্ড  সেকেলে , একদিন  ঝগড়ায়  বিবেকে  বলেও  ছিল। 
অব্যয়ির  গলা  ভারি হয়ে  আসছে । সে  ঢোক  গিলে  বলল
-আপনি , নিবেদিতাকে  এতটাই  ভালোবাসতেন  যে তাকে  মেনে  নিতে চেয়েছিলেন । আর  এখন  মেয়েটার এইরকম অবস্থায় , সই করে  দিলেন  ! তাড়াহুড়ো  করলেন মনে  হল ।
অলকেশের  চোখ  দুটো  শক্ত   হয়ে  এলো । - দেখুন , ভালো  আমি এখনো বাসি । কিন্তু  নিবেদিতার পেটে  আপনার  স্বামীর   বাচ্চা ছিল ।   মানে    যদিও    দূর্ঘটনায়   সে  ভ্রূণ   নষ্ট  হয়ে গিয়েছে  ।   খুবই  দুঃখের ।   আপনি  আপনার স্বামীকে মাপ করে  দিলেও , আমি  নিবেদিতার সাথে  থাকতে  পারব না । সেইদিন   ওরা  একসাথেই  গাড়ি করে   আসছিল , দুজনেই  মদ্যপ  ছিল । দুর্ঘটনা  ঘটবার  পিছনে  সেটাও একটা কারণ । আর নিবেদিতা কনসিভ  করেছে – জেনেই  ওরা   হোটেলে  গিয়ে সেলিব্রেট করেছিল । খুব কাছের দু’একজন  ছিল । আমি তাদের একজনের   থেকেই জেনেছি । এইসব কিছু  জেনে , আমি নিবেদিতার  স্বামী হওয়ার  অভিনয় করব না । আর আমি চাইছি , কোর্ট  যেনও  অসুস্থতার ছুতোয়  ডিভোর্স  দিতে  দেরী  না  করে ।
অব্যয়া  খেয়াল  করছে , চোখের  কোণায় পাতলা  জলের রেখা নামছে   ; খুব সরু  আর আপাতাত  নিরীহ । এই  রেখা  আঙুলের  তলা  দিয়ে  মুছে  দিল ।  এমনটা  করল , কেননা  পাছে  অলকেশ  তাকে  দুর্বল  ভেবে  বসে ! 
গলা  শক্ত করে  বলল  - অলকেশ  আপনাকে  কে  বলল , আমি  বিবেককে  মাপ  করে  দেব ?  দেখুন  আমি  ডিভোর্স  দেব । আর  খুব তাড়াতাড়িই  তা  জানতে  পারবেন  ।
ঘড়িতে  সন্ধ্যা  সাতটা ।  ঘড়ির  দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়ি  বলল – আজ  উঠি ।
অলকেশ  বলল – ম্যাডাম    আপনার সিদ্ধান্ত  আপনার ।  তবে  আপনি  যদি  ডিভোর্স  দিয়েদেন  তাহলে  এখনই আমার  নিবেদিতার  হাত  থেকে  রেহাই  পেতে   সুবিধা  হয় । যদিও ওদিকে কেউ  কিছু   এখনো  বলেনি । তাও  যদি  নিবেদিতা  কর্মক্ষমতা  হারিয়ে  বিছানায়  শুয়ে  থাকে  । যদি  বিবেক  সুস্থ  হয়ে ওকে  ভুলে  যায় বা  বিবেকের  অবস্থাও  একই রকম থাকে  , হয়ত নিবেদিতার  বোঝা  আমাকেই টানতে হবে  । স্যরি , আমি   ঠিক তেমন  ভাবে  বলতে  চাইনি ।  মানে  বুঝতেই পারছেন , আমার  কিছু চাহিদা...

ঘাড়  ঘুরিয়ে   অব্যয়া  বলল – থাকুক  না , আমি  বুঝেই  গিয়েছি  । এতদিন  আপনি  নিবেদিতাকে  সহ্য করতেন কারণ ওর  মোটা  মাইনের   বেতনের  জন্য  । এখন  সে সব  নেই  যখন  বোঝা বইবেন কেন  ? আমার এইসব  ব্যাপারে  আলোচনা করতে  ভালো  লাগছে  না ।  তবে এতটুকু  বলব , আপনার  নিবেদিতার  উপর  যে  রাগ  রয়েছে আমার  বিবেকের  প্রতি  ঘৃণা  তার  থেকেও  বেশি । আমি   নিজের  সবটুকু  দিয়ে  ওকে  ভালবেসেছিলাম । আর বিবেকে  আমাকে  ঠকিয়েছে ! তাও আমি ওর  সাথে   জড়িয়ে আছি  , শুধুই  মানবিক কারণে । তবে  এটাও  হয়ত আর  বেশি  দিন  নয় । আসছি ...





                                   ২




নার্সিংহোম থেকে  বেরিয়ে , ক্যাব ভাড়া করে নিল । গাড়িটা  এলগ্রিন  রোডের  দিকে  এগিয়ে  চলেছে ।  অব্যয়া   ঘামছে ।  বিবেক  তাকে  ঠকিয়েছে , সে  এই  কষ্ট মেনে  নিলেও  নিজেকে  অসহায়  আর  প্রতারিত  ভাবতে  রাজি নয় । এটা  তার  নিজের  জীবন , এখানে  সে অন্য কোন মানুষের দ্বারা  চালিত  হবে  না । কোন  ভাবেই  নয় ।
নিজেকে  তাও কেন  ঠকাচ্ছে ?  এই  যে  প্রতিদিন  বিবেকের  মিথ্যা  পরিচয় নিয়ে  নার্সিং হোমে যাওয়া ,  সব  দায়িত্ব  নেওয়া  আবার  দিনের শেষে   বাড়ি  ফিরে  আসা  সেই  লোকটির প্রতি  প্রবল  ঘৃণা  নিয়ে  ! এমন  ভাবে  সে  নিজেই  ঠকছে ।  শেষ  একমাস  অনেক  কিছুই  ভেবেছে  , অলকেশের  মুখে  যখন  সব  কিছু জানতে পারল ,  নিজেকে  এক  মুহূর্তের জন্যও  বিবেকের  সাথে  দেখতে  রাজি  নয় ।
গাড়িটা  এসে  থামল । 


অব্যয়া  গাড়ি  থেকে  নেমে   টাকা   মিটিয়ে নিজের  ফ্ল্যাটের  দিকে  চলেছে । আজ  সে  বিবেকের  ফ্ল্যাটে  যায়নি । এই  এক কামড়ার  ফ্ল্যাটটা  নতুন  নিয়েছে ।  ব্যাঙ্কের  লোণ   নিয়ে  কিনেছে । এই একমাস  সে  এখান থেকেই  যাতায়াত করছে নার্সিং হোমে । অফিস যাচ্ছে ।   

কলিং  বেল টিপতেই   অম্বিকা  দেবী  দরজা খুললেন । তাঁকে  দেখে  অব্যয়ি  বলল -  মা , তুমি  ফোন করেছিলে ? আমি কথা  বলছিলাম  বলে ধরতে  পারিনি ।  অবশ্য  পরে  ফোন করতাম ।  ভাবলাম  বাড়িতে  এসেই  না  হয় বলব ।
-তুই হাতমুখ  ধুয়ে আয়  । আমি  ভিতরের  ঘরে    আছি ।  আজ বিনয়ের  বড়দিদি  ফোন করেছিল । ওর মায়ের সাথেও  কথা  হল । 
অব্যয়ার  শরীর জুড়ে ক্লান্তি । তারউপর  এইসব  কথা এখন  শুনতে  চাইছিল  না । সে  ইচ্ছা  করেই বলল –এখন নয়  ,অফিসের কাজ  আছে  । 


রাতে খাওয়ার  পর  নিজের  ঘরে  শুয়ে  আছে   । একপাশে  টেবিলল্যাম্প জ্বলছে , হাল্কা  আলো অব্যয়ির  মুখে  ম্যশ্চারাইজার  ক্রীমের  মতন  মেখেছে  ।  সেই দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়া একটা  দৃশ্য  ভাবছিল ।    

বছর তিরিশের  এক  রমণী কাঁদছে । এখন  গভীর রাত  ।  পাতা  ঝরবার  শব্দ  শোনা যায় । চারপাশের আলো নিভে গিয়েছে ।   যে  রমণী কাঁদছে সে  কে ? অব্যয়া  এইসব  কিছু  খুব কাছ  থেকে  দেখছে ।  এই  রমণীর মুখ খুব চেনা । সে ঘোরের  মধ্যে  থাকে   ।  এটা  একটা  স্বপ্ন ,  অব্যয়া এই  সবপ্নে স্বপ্নে আগেও  থেকেছে ।  তা  অসম্পূর্ণ  ছিল ।  মেয়েটা  তার  বয়সী । মুখ  তুলে  বলল -  আমি  হেরে  গিয়েছি  । তুমি  কিন্তু হারবে না ।
অব্যয়া  বলল – মানে ? কি হারবার  কথা  বলছ ? আমি যে  হারতে  পারি , তা কেন  বললে ?
মেয়েটির  দুচোখ জলে  ভিজে  গিয়েছে ।  অব্যয়া  বুঝতে  পেরেছে  , সব  মেয়েরই   মুখ  কষ্ট পেলে  এমন হয়ে  যায় ।  মেয়েটি  কাঁদছে  কেন  ? এই কান্নার  অন্তরালে কোন  রহস্য  লুকিয়েছে  ! সে  এই স্বপ্নকে  কখনই  সম্পূর্ণ  দেখেনি । আজ দেখবে ?
মেয়েটি বলল – ওরা  আমায়  বলেছিল , আমি  অন্যায়ের  প্রতিকার চাইব না । এই সমাজে  পুরুষকে   শাস্তি দেওয়ার  অধিকার  শুধুই  পুরুষের । আমি নারী  , শুধু  প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি  ।
অব্যয়া   কিছুই  বুঝতে  পারল  না   ! এই মেয়ে যে ভাষায়  কথা  বলছে তা  বুঝতে  অসুবিধা  হচ্ছে  না, এই  পরিবেশ  তার  চেনা  নয় । 
-তুমি অত্যাচারিত ?
-আমি  নই  আমরাই  বঞ্চিত । আমাকে কেউ সুবিচার  দিতে  পারেনি । সকলেই  ফিরিয়ে  দিয়েছে  । কথা  দিয়েছে , অন্যায়ের  বিরুদ্ধে  আত্মত্যাগ  করলেই  দেবী  হয়ে যাব !
-দেবী !!
-সকলেই  দেবীর  প্রতিশ্রুতি  দিয়েছে  মানুষের নয় । আমি মানুষের সম্মান  পেতে চেয়েছি । তাই চোখে  ঘুম  নেই । সারা  দেহ  যন্ত্রণায়  ফেটে  যাচ্ছে ।
আচমকাই  ঘুম  ভেঙে  যেতে  অব্যয়া  উঠে  বসল । তার  বুক  ,  বোগল   ঘামে  ভিজে  গিয়েছে । এতক্ষণ  একটা  স্বপ্নই  দেখছিল । সে  ভাবছিল  এই   স্বপ্নের  মেয়েটিকে খুব  চেনা  মুখ  মনে  হচ্ছিল !





                                        ৩



এখন  রাত দুটো । আর তিনঘণ্টা । তারপরেই  ভোরের আলো  ফুটবে ।  পাখির  কোলাহল  শুরু  হবে  । একা , ক্লান্ত , নির্জন  রাস্তার বুকে  মানুষের পায়ের  শব্দ  শোনা  যাবে । বারান্দায়  দাঁড়িয়ে  থাকতেই অব্যয়ার  মন  চাইছে ।  সামনে  একা –একা   দাঁড়িয়ে  থাকা  লাইটপোস্টের   ম্রিয়মাণ  আলোর  দিকে  তাকিয়ে  খুব কাঁদতে ইচ্ছা  হচ্ছে । মায়ের সাথে  ঘুমাবার  আগে  কথা কাটাকাটি  হয়েছে ।  বিবেকের বাড়ির লোক  চাইছে  , বাকী জীবনটা  অব্যয়া  বিবেকের দায়িত্ব নিক।   কেননা বাকী জীবন বিবেকে  হয়ত সুস্থ  হয়ে উঠতে পারবে  না । অবশ্য  মিরাকেল ঘটতেই পারে। আর এটা  ঘটাবার   সাধ্য আছে  একমাত্র অব্যয়ার ---- অন্তত  বিবেকের বাড়ির  দিকের  লোকের  তাই  ধারণা । বিবেকের সম্পত্তির  মালিক  হবে  অব্যয়া । 
সে  অবশ্য  নিজে  এটা  চাইছে  না ।  বিবেককে আপাতত  সুস্থ  করবে । সাথে  নিজের  চাকরিও  চালিয়ে  যাবে ।  অব্যয়ার মা  , অম্বিকা  দেবী নিজেই  চাইছেন মেয়ে  এই  সম্পর্ক  মেনে  নেয় । এতে  মান থাকবে  কূলও         থাকবে  ।ভারতীয়  বিবাহিত  মহিলা  স্বামী পরিত্যক্তা হলে , সমাজ  অন্য   চোখে দেখে ।   মেয়েদের  স্বাধীনতা থেকে  তাদের  পরাধীন  সম্ভ্রম অনেক  বেশি  দামী  ।নির্ভরশীল  আশ্রয়  অনেক  বেশি  কাঙ্খিত  । 
অব্যয়া ভাবছিল ,  স্বপ্নে ভাসা –ভাসা  মেয়েটির  করুণ মুখ আর  অব্যয়ার  অসহায়তা  মিলে  যাচ্ছে ! এই মেয়েটির  সাথে  তার  কোন  সম্পর্ক  রয়েছে ?  এই স্বপ্নের  ভিতরের  গল্পটার তার  খুব   জানা । হ্যাঁ , ছোটবেলায়  মায়ের  মুখে  শোনা  । অব্যয়া    ভাবছে ...

রাতের পানপাত্র   থেকে  গভীর  নিস্তব্ধতা ক্রমশই  ছড়িয়ে  যাচ্ছে ।  একটি  মেয়ে  লেখার টেবিলে  মাথা ঝুঁকিয়ে  হলুদ আলোর  দিকে  তাকিয়ে  ভাবছে । সাদা কাগজ  নিয়ে  লিখতে  শুরু  করল   মায়ের  উদ্দেশ্যে ----   



এখন  চারপাশ  খুব শান্ত । তাই  তোমাকে  মনের কথা  খুলে  বলছি । তুমি ছোট   বেলায় আমাকে  একটা  গল্প  শুনিয়ে ছিল । পুরাণের  গল্প । এক  ব্রাহ্মণী কে   ঠকিয়েছে  তার  পুরুষ । সেই  পুরুষ   শেষে  রোগে  ভুগে  মারা যান ।  মৃত্যুর  পরেই    যমপুরীতে  ব্রাহ্মণের   বিচার  চলে ।  অভিশাপে  তাকে  শাস্তি পেতে  হয়েছিল ।  এদিকে ব্রাহ্মণী পত্নী   নিজের  উপর  ঘটে  চলা   অন্যায়ের  বিচার  চাইল না। সে  ভারতীয়  নারী ।  বিবাহিতা  । সে  কেমন  করে  স্বামীকে  ছাড়বে ! তার থেকে  নিজেই স্বামীর পাপ  মোচনের  জন্য  চেষ্টা করবে  । কাঁদছে ।  তারপর  নারদ  তাকে  যোগবলে  মৃত  স্বামীর   চিতায় এনে  হাজির  করে । ব্রাহ্মণ   পত্নী   সহমরণ  বেছে  নেয়  ।   এরপর  গল্প  এগিয়ে  চলে  । ব্রাহ্মণ   অভিশপ্ত  হয়ে কুকুরে  পরিণত হল ।   একসময়  সে  নিজের  পরিত্যাগ  করা পত্নীর   সতীত্বের   জোরেই     নিজের পাপ  মোচন করে  এবং  শিবের   খুব কাছের   ভক্ত  হয়ে  ওঠে  !  এখানেই   অব্যয়ার   প্রশ্ন  , সে  মেয়ে  এমন  আত্মত্যাগ   করল  তাঁর  স্থান   কোথায় ?  পত্নীর  প্রতি  যে  অবিচার  হয়েছে , শাস্তি  পত্নী  দেয়নি  , দেবতারাই  দিয়েছে । সমাজ  বা   পুরুষের   বিচার   পুরুষমুখী   সমাজ  করবে  কেন  ?   নারী নিজের  স্বামীকে    ত্যাগ  দিলনা  কেন  ?  সে  কি  স্বতন্ত্র  জীবন  বেছে  নিতে  ভয়  পেয়েছিল  ? নাকি  ভারতীয়  মূল্যবোধ চেয়েছে  নারীদের  চিরটাকাল   স্বামীমুখী  করে রাখতে  ! সেই রমণীই   স্বপ্নে  এসে    বলেছে  , আর  যেনও   অব্যয়ারা  পিছনে  না  হাঁটতে  থাকে  । সময়  এসছে  নতুন  রুপকথা রূপকথা লিখবার ।
অব্যয়া   মনে – মনে    বলল  ---   বিবেকের  সম্পত্তি  বা   সম্পর্ক --- কোনটির  প্রতিই  বিন্দু  মাত্র  মোহ  নেই ।  আমার  লোভ আমার  স্বতন্ত্র  পরিচয়ের  প্রতি  ।  এটাই  আমার  অস্তিত্ব । আমি হারব  না।   আমি জানি  তোমরা  আমাকে  মেনে  নিতে পারবে  না  , কেননা  তোমাদের ভারতীয়   মূল্যবোধে  যেখানে   নারী আসলে পুরুষমুখী – আমি মানতে পারব না  । কেননা  আমি আজকের  পরিবর্তিত  ভারতীয়  মূল্যবোধ ---   নারী  স্বতন্ত্র  ব্যাক্তি  । তার এই দিক তোমরা মানবে না ।  নারী   সত্ত্বা  আর   তোমাদের  একমাত্র  সন্তানের  দায়িত্ব  নিতে   গিয়ে  যে  টানাপোড়েন  , তাতে আমি  ক্লান্ত ।  আমার  মৃত্যুর জন্য   তোমরা  দায়ী নও । সে দায় , ভারতীয় পুরুষ কেন্দ্রীক  মূল্যবোধের ............ 

চিঠিটা  লিখবার  পর  , অব্যয়া  বাথরুমে গেল  । এখনো  মা  ঘুম  থেকে  জেগে  ওঠেনি ।   ভোর  হতে  দেরী  নেই  ।   আত্মহত্যা  করলে , পাশের থানা  থেকে  পুলিস  আসবে  তাড়াতাড়ি । পোস্ট মর্ডাম  ক্রতেও করতেও খুব বেশি  সময়  নেবেনা । সন্ধ্যার  মধ্যেই  সব  কিছু  শেষ ।
অব্যয়া   বাথরুম  থেকে  এসেই  , মায়ের  ঘরের  দিকে  গেল  । সত্তর  বছরের  মহিলাটি  ঘুমিয়ে  কাদা । মুখে  এক  অদ্ভুত  শান্তি ফুটে উঠেছে । মা  ধরেই  নিয়েছে , মেয়ে  শ্বশুর  বাড়ি  ফিরছে । আর স্বামী পরিত্যক্তা নয় । এই মেয়েই  যখন  মৃতদেহে  পরিণত হবে  ! অব্যয়া মুচকি  হাসল ...

এইবার  মরতে  হবে  । গলায়  ফাঁস  দিয়ে   ঝুলে  পড়বে । অফিসে  তার কাজের  খুব নাম হয়েছে । বিবেকের  বাকী  জীবনটা    বিছানায়  শুয়েই  কাটবে    , অব্যয়ার দয়ায়  বেঁচে থাকতে  কেমন লাগবে  ? যারা তাকে  সংসারে  বাতিল  নোট  ভেবেছিল --- তাদের  চোখে  আচমকাই  সে  লটারি । কেননা  স্বামীর  আশ্রয়ে নয় , স্ত্রী  নিজের আশ্রয়ে  স্বামীকে  বাঁচিয়ে  রেখেছে  । 
আচ্ছা  এখন  যদি  না আত্মহত্যা  করে , বেঁচে  থাকে  ! সে  দেবতা  হবে  নিশ্চিত । এই  কথাটুকু  ভাবতেই অব্যয়ার  খুব আনন্দ  হচ্ছে  ।  
অব্যয়া ভাবল এই এতকিছুর  বদলে  নিজের চাকরি  করবার  জেদ সে রাখতেই পারে । আর বাকীরা তা শুনতে  বাধ্য । অন্তত  এই কারণের জন্য  আত্মহত্যার  মতন  এত  ছোট একটা  সিদ্ধান্ত পাল্টানোই  যায় ।
  খুব  দ্রুত  গিয়ে   টেবিলের  উপর  রাখা  চিঠিটা  নিজের  হাতে  নিয়ে  নিল  । খুব  দ্রুত  সরিয়ে     ফেলতে  হবে ...

( গল্পে  বর্ণিত   পুরাণ  ঘটনা  ‘পদ্ম পুরাণ ’  - এ  সম্পূর্ণ  উল্লেখ    রয়েছে ।  আমি সামান্য  অংশ লিখলাম । মাধুর্য  নষ্ট হয়ে  থাকলে  ক্ষমা  করবেন ।  এর  বিষদ   বর্ণনা  পুরাণেই  পেয়ে  যাবেন ।  আমার লেখা  কোন  সম্প্রদায়কে  আঘাত  করে  থাকলে  ক্ষমা প্রার্থী ।  ) 

হেমন্ত সরখেল









আমার ছুটির দিনগুলি
                         



গতকাল রাত থেকেই কলম বুদুম্ মেরে বসে আছে। ভাবনারা ধাপ্পা-ধাপ্পা খেলছে ওর সাথে। আমার এই এক জ্বালা! সবাই আমার অথচ কেউ ই কারো সাথে সদ্ভাব রাখতে চায় না। টেনে হিঁচড়ে এক জায়গায় বসিয়ে কি আর পঞ্চায়েতী সম্ভব? নাকি সে প্রক্রিয়া মনোবাঞ্ছিত ফল প্রদান করে? একজনকে টেনে আনি তো অন্যজন মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে- ও! ওকে আগে টানলে! আমি বুঝি ফ্যালনা! চারিচক্ষুর ধারায় তিতিলাম শুধু আমি। ঐ যে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়-- আজ এটার প্রকৃত অর্থটা আমার কাছে পরিস্কার। ওদের নাটুকে অভিমানে আমার স্যালো আঁখি জুড়ে! আরে কথা শোন্ ক্ষ্যাাপারা- সকাল হতেই তো মস্তিষ্ককিটের দুর্দমনীয় আস্ফালন শুরু হয়ে যাবে। কি হে! কোথায় তোমার সৃষ্টরম্ভা? তোদের যদি এই অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে, তাহলে তো আমার ভূগোল বদলে যাবে!! ধুত্তেরি!! কতো আর পারা যায়!এতো তেল নেই বাপু! এমনিতেও ডি.এ. যৎসামান্যই, কাজে কাজেই রাধাও নাচবে না। ভাঁড় মে যাও।

                     মেখলী দুধ দিতে আসে। কাল আসে নি। ওর আদমী নেপাল গেছে, ফেরে নি। তাই গতকালকেরটা নিয়ে আজ হাজির। বাজার থেকে ফিরে দেখি, দুয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
'--- কি ভেলো? এনা কথিলা বইসল্ ছি?'
      পানে কালো কোশীর গেট তুলে বলল- ' কাইল আইব নই সকলিয়ে। মরদ নই রহে। তোরা দিক্কৎ ভ্যায় যেতে ন? ত্যায় চইল এলিয়ে। আয় তোরে টা দেবে। কম্মে ছে '। প্রায় তিন কিলোমিটার ওর বাড়ি আমার কোয়ার্টার থেকে। এবারে 'খাদের' দাম জি.এস.টির কল্যানে ওদের হাতের বাইরে যাবে। সম্পন্নরা হয়তো গহুম কাটবে, কিন্তু ওদের কি হবে বলা যায় না। হয়তো খেতে বসেই বেচে দেবে সবটা।সুদ টানতে থাকা আর কতো সম্ভব! তাই দুধ একদিন ও 'নাগা' করা যাবে না। আমার কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকাটা যত তাড়াতাড়ি ও শোধ করতে পারে এটা তারই প্রচেষ্টা। ওর বহু'র গায়ে পটুয়ার আগ ধরে গেল মাস তিনেক আগে। খবর পেয়ে ছুটলাম 'অস্পতাল'। সেখানের খরচগুলো তখন আমাকে সামলাতে হয়েছিল, এটা ন্যাচারাল, হতেই পারে। ওকে বলেছিলাম- ও আমারই মেয়ে, ভেবে নে না! তোকে এসব ফেরৎ দিতে হবে না। পেটে গামছা বাঁধবে তবু সম্মান খোয়াতে নারাজ ওরা সপরিবার। দুধ খাইয়ে, গহুম দিয়ে, খেতের সব্জী দিয়ে শোধের আপ্রাণ একটা বিনম্র প্রচেষ্টা আমার চোখে জল এনে দেয়! এই দেশই তো খুঁজতে বেড়োই আমি, দেশান্তরে।জানি, ওদের সময় বদলাবে না, বদলায় না। তাই বলে ও রাখি, প্রয়োজনে বলবি, লাজ করে কে কাম নই ছে। পইসা জরুরত পড়তে তো ল্যা যাইয়ো।
             মার্চের শেষ। তাই একটা গা ছাড়া ভাব সকাল থেকেই। পুরো কলোনীটা জুড়ে। সে দেবাদিদেব আজ সপরিবার বাড়ি যাচ্ছেন। তবে ওনার হাতে মাত্র একটা বাজারের ব্যাগ। বৌয়ের মাথায় সুটকেস। বাচ্চাদুটো পেছনে লেতুর দিয়ে। এখানে একটা কথা বহুল প্রচারিত। " বিহারী মরদ চলতে অগারি, কনিয়া পিছারী, সামান ল্যাকে। বঙ্গাল মে একার উল্টা হইছে। বচ্চা অউর সামান ল্যাকে মরদ পছারী পছারী 'লড়লে' যাইছে।" পার্থক্যটা এটা দ্যাখে, বোঝে ও হয় তো বা। সমাজের রীতি যা করায় সেটাই আবহমান কাল ধরে কোশীর ঠান্ডা স্রোতে মজ্জায় মজ্জায় পরিব্যপ্ত। আমি দেখি, বুঝতে চেষ্টা করি- এটাই কি সেই বৈচিত্র্য? অহিন্দীভাষী আমার জন্য এদের সম্মান প্রাণৈক্যের বোধ ছড়িয়ে দেয় শরীর মন জুড়ে। ওদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলি- এই আমার দেশ, দেশবাসী। সুখ, দুঃখ দিয়ে ঘেরা জীবনপথের পথিক। তোমাদের চলা যে ইতিহাস তৈরী করে তা কলম ছড়ায় না দিকে দিগন্তে। কোনো পথনাটিকা হয় না তোমাদের জীবন বদলে দিতে। না কেউ স্নাতকোত্তরে তোমাদের জানতে চায়! তবু তোমরা ইতিহাস গড়ে যাও, প্রতিনিয়ত, সংস্কারে, কৃষ্টিতে, দারিদ্রের দাসখতে, ধৈর্য্যের অন্নপূর্ণা হয়ে।

রিয়া ভট্টাচার্য




তোমার আমার গল্প
 



যখন খোয়াবনামা মুচকি হাসে, আবদারসুতো আবেগী হয়ে জড়িয়ে নেয় পাকে পাকে। হিমরাতে যেভাবে শিশিরস্নাত হাঁটে পাথুরে পিচ রাস্তা, শেষবাস ফিরে যায় রাত্রিশেষে নিঃশব্দে ; ঠিক এই সড়কেই লেখা হয় তোমার আমার গল্প।

আপেক্ষিক পিছুটানে যখন পিঞ্জরে পোষ মানে উদাসীন জেদি পাখি, পরাশর বন্ধক রাখেন গলা মৎস্যকুমারীর কাছে............  
গলিত কুষ্ঠঘায়ে আঁকা হয় মরমিয়া চুমুর নিশান, বিপদসংকেত তুচ্ছ করে রাক্ষসপুরীর বন্দিনীদের জন্য রাত জাগে লালকমল - নীলকমল।  কিছু রূপকথা যেখানে হাসনুহানা হয়ে ফোটে; ঠিক সেই দেশেই লেখা হয় তোমার - আমার গল্প।

যেখানে অভিমান কিলিমাঞ্জেরো মেঘের মত ভিড় করে আসে, চিরহরিৎ বনানী নিমেষে পত্রশূন্য হয় অদেখা অভিশাপে। শ্রাদ্ধকালে পাকানো আলোচালের পিণ্ডের মত গলার মধ্যে দলাপাকিয়ে ওঠে বিস্বাদ কান্না, কুঁচকে ওঠা চাদরে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে অস্পর্শী আঘাতখতিয়ান। আপন প্রতিবিম্ব ভুষোকালি হয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকে আয়নায়, অশ্রুসিক্ত চোখ শেষ মিনতি জানায় প্রিয়াস্পদের দরবারে ; ঠিক সেইক্ষণে আর্তধ্বনি আখরে লেখা হয় তোমার - আমার গল্প।

বেহায়া ইচ্ছেরা যখন কল্পতরু হয়ে আঁকড়ে ধরে মৃত্তিকাকণা, শেষ চুম্বনের মত তৃষ্ণার্ত খড়খড়ে ঠোঁট শুষে নিতে চায় শেষ জলবিন্দু......
দেখা অদেখার মাঝখানে যখন কল্পনারা গড়ে তোলে স্বপ্নসেতু, বসন্তরাতে যখন দিগন্তপার হতে ভেসে আসে বিরহী কেকার বিষাক্ত নিঃশ্বাস। প্রত্যাখানের নীলে জর্জরিত প্রেমিক মন যখন ছটফট করে মৃত্যুকাঙ্ক্ষায়,   ভোরের স্নিগ্ধ সমীরণ যখন চাবুকসম আছড়ে পড়ে পিঠে ; ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে লেখা হয় তোমার - আমার গল্প।

যখন পাতাবাহার গাছের ফাঁকে মগ্নচিত্তে বাসা বোনে গতঝড়ে সর্বহারা বাবুইপাখি, যখন প্রেমিকার কোলে মুখ গুঁজে মায়ের গায়ের গন্ধ খোঁজে আদরকাড়া প্রেমিক.....
বলা না বলার মাঝখানে যেভাবে অজান্তেই গড়ে ওঠে ধূসর গলিপথ, নিঃসীম অন্ধকারে দেবদূতসম মুমূর্ষুকে ভরসা দেয় নাইটিঙ্গেলের লণ্ঠন। যখন ঝাপসা চোখ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ঠিক যেভাবে গরম ভাতের গন্ধ পেলে নেচে ওঠে ক্ষুধার্ত স্বাদকোরকেরা ; সেইখানে নিকানো মেঝেতে কাঠকয়লার কালিতে লেখা হয় তোমার - আমার গল্প।

আদপে সবাই বলে রূপকথা বাস্তব হয়না কখনো, কিন্তু জীবনের প্রতিটি বাঁকেই বাস্তবের অবগুণ্ঠনের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সে।
গল্প..... সেতো জীবনপথেরই নামান্তর। রাজা - রাণীর মিলন - বিরহের নিঃশব্দ আক্ষরিক অভিযান। আসলে গল্প সবার হয়না, সবাই সবার সাথে সুখীও হয়না। পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের একটা সম্পূর্ণ গল্প আছে, যা তার জীবনকাল বেয়ে চলে অনন্তের পথে; মসীচালনা করে কোনো রাজা বা রাণী। আর পুরাতন অসমাপ্ত গল্পগুলো! তারা পরিত্যক্ত হয় উইধরা ডাইরির পাতায়, কোনো হিমরাতে আগুন উৎসবে আত্মাহুতি দেবে বলে।।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য

                  




        
                            ভয় 






 অন্ধকারকে আমি ভয় পেতামনা
ছোটবেলায় ,সবাই বলত সৃষ্টিছাড়া মেয়ে--ছোট্টখাট্টো চেহারা --জেদী--হিংসুটে আর দস্যি-।বাবা নেই বলেই নাকি এমন আমি। সুন্দরী  শান্তশিষ্ট  দিদির কম হেনস্তা  হয়নি এই দস্যির হাতে।বিনা নালিশে বেমালুম  হজম করতো প্রশ্রয়ে। কতবার মা অন্ধকার চিলেকোঠায় বন্ধ করে রেখেছে ,আমি কাঁদিনি--চিৎকার করে ছড়া বলেছি,ভুলসুরে উৎকট গান গেয়েছি , একসময়  ক্ষিধেয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি ধুলোমাখা মেঝের উপর। 
অনেক রাত্রে ঠাকুমা আর দিদি এসে চুপিচুপি ডেকে তুলেছে।ঠাকুমা অধৈর্য  হয়ে পদ্মাপারের ভাষায় ক্ষোভে ফেটে পড়তেন----'আপদ্ মাইয়াডা কাউরে ডরায়না !-জন্মাইয়া বাপেরে খাইসে-অহন আমাগো জ্বালাইয়া পোড়াইয়া খাইবো।" এরকম আলোর বিপরীতে নিজেকে স্থির রেখেই স্কুল পালাতে শিখলাম --সাইকেল নিয়ে সোজা দামোদরের পাড়ে। কতবার মাঝিদের পটিয়ে জেলেনৌকোয় চেপেছি । নদীর চড়ায় মড়া পোড়ানো দেখেছি, ক্ষেত থেকে তুলে নিয়েছি টাট্কা সবুজ কড়াইশুঁটি । কখনো রাস্তা থেকে তুলে এনেছি খোঁড়া কুকুরছানা, কখনো বা্চ্চা শালিখ।নিজের পুজোর জামা ভিখিরি  মাকে দান করে চরম পিটুনি খেয়ে রাগে মায়ের মুর্শিদাবাদী সিল্কে  কাঁচি চালিয়েছি নিষ্ঠুর উল্লাসে।কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো দেখেছে এই ছোট্টখাট্টো  মেয়েটার সাংগঠনিক  ক্ষমতা--এক ডাকে একটা জমায়েত --মিছিল। মারপিট, ঘেরাও, পিকেটিং ,স্লোগান, গনসংগীত  ,স্ট্রিট্-কর্ণারিং ,পথনাটক, গ্রুপ থিয়েটার--জনপ্রিয়তার নেশা নেশা ঘোর। রাত করে বাড়ি ফেরা ছিল, ছিল ছেলেদের সাথে গ্রামে গ্রামে রাত কাটানো-।আত্মীয়রা বিদ্রুপ করে গেছে বাড়ি বয়ে--পাড়া প্রতিবেশীরা তকমা দিয়েছে-- "গেছো মেয়েছেলে" ,
"ছেলে চড়ানো মেয়ে" । নিজের ছেলেদের আমার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার উপদেশ দিয়েছে । আমি কিছুই গ্রাহ্য করিনি- -দরকারে পরে ওই বাড়িগুলোই আমার কাছে এলে মনে মনে হেসে কাজে লেগে পড়েছি । আমার নামে শুনতে শুনতে ধৈর্য্যহারা মা চড় মারতে উঠলে হাত চেপে ধরেছি,মায়ের অসহায় কান্না ও দুর্বল করতে পারেনি আমায় ।
হাসপাতালের মর্গ থেকে যখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা  দিদির কাঁটাছেঁড়া শরীরটা আনতে গেলাম--কালসিটে পড়া হাত,ছ্যাঁকা লাগানো গাল, কপালের মাঝ বরাবর একটা সেলাই---কি বীভৎস একটা অন্য পৃথিবীর গন্ধ ঘরটায়-অন্ধকার ,স্যাঁতসেঁতে। একটা কালচে মুখ, নীল ঠোঁট নিয়ে শুয়ে আছে দিদি-ঠোঁটের কোণায় শুকিয়ে যাওয়া রক্ত।ওরা বললো দোতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে-। অথচ আমি তো জানি ক্রিটিক্যল প্রেগন্যান্সির কারণে  বেডরেস্টের নিদান পাওয়া দিদির সাথে ওরা কি কি করেছে। না---তখনও ভয় পাইনি আমি ,বের করে এনেছি ওকে মর্গ থেকে । দাঁড়িয়ে থেকে পুড়িয়েছি  ওর শরীরটা । তারপর
আইনি লড়াই--ওর হিংসুটি বোন শেষ দেখে ছেড়েছে এ অন্যায়ের । 
শুধু আজ যখন আইটি সেক্টর থেকে ভোর রাতে হা-ক্লান্ত আমি দরজা আনলক করে আমাদের ফ্ল্যাটটায় ঢুকলাম আর টানটান শূন্য বিছানাটা দেখলাম--আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো-এই প্রথমবার-।টেবিলের ওপর ল্যাপটপ, তার পাশে ফটোস্ট্যান্ডে তোর গত জন্মদিনে তোলা ছবিটা--তুই আমার মুখে কেকের ক্রিমগুলো মাখাচ্ছিস্ , আমি কপট বাঁচার ভঙ্গী তে মুখ আড়াল করছি--কি ভীষণ প্রাণ ছবিটায়।  ঠিক সামনেই উপুড় করা "রিভার অব্ স্মোক"  বইটা, যেন রাত জেগে পড়তে পড়তে এই মাত্র উঠে গেছিস-। তার পাশেই তোর শূণ্য কফিকাপটার তলায়  সাদা একটা কাগজ কি ভয়ংকর শূণ্যতা  নিয়ে পড়ে আছে আমারই জন্য--আমি হাতে তুলে নিলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে-।আমি জানি ওর বুকে লেখা অক্ষরগুলো--গত দু সপ্তাহ ধরে ওরা তোকে যন্ত্রণা দিয়েছে--অবশেষে ওদের থেকে তুই নিজেকে মুক্ত করেছিস--মুক্ত করেছিস এই একবছর তিনমাস বারোদিনের একত্র যাপন থেকে--।যে তুই একদিন আমাকে ছেড়ে ট্যুর এ যেতেও বায়না করতিস --কেমন আলগোছে সব ফেলে চলে গেলি --হঠাৎ উগ্র ,রুক্ষ মনে হতে থাকা এই জেদী মেয়েটাকে ফেলে এক নরম রূপকথার বুকে মাথা রাখবি বলে -। আস্ত একটা জীবন গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলি--দায়হীন, শর্তহীন--বিশ্বাসই হয়না যেন-সব তো পড়ে আছে ঠিক তেমনি-
-সকালে যেমন ছিল বেরোবার  সময় -।কিন্তু এই সাদা কাগজ হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দস্যি মেয়েটা জানে কিভাবে ভিতর থেকে তাসের ঘরের মত ভেঙে যাচ্ছে তার সাহসের ইমারতটা--কি ভীষন এলোমেলো অর্থহীন   হয়ে যাচ্ছে জীবনভোরের আপোসহীন লড়াইগুলো । এই টিপটপ্  করে গুছিয়ে রাখা দেড়কামরার শূন্য লিভ ইন ফ্ল্যাটটার মধ্যে আমি অক্সিজেন পাচ্ছিনা।তোকে ছাড়া বাঁচবার ভয়ে আমার নিঃশ্বাস  আটকে যাচ্ছে ।


পায়েল খাঁড়া








দেওয়ালি




আলোয় আলোয় ঝলমল করছে মন্ডপ।বৈদ্যুতিন সজ্জা মাকড়সার জালের মতো শাখা ছড়িয়েছে রাতের কালচে দেওয়াল জুড়ে।চারপাশে পোড়া বারুদের গন্ধ আর থেকে থেকে শব্দ বাজির বিকট উল্লাস বুঝিয়ে দিচ্ছে আজটা অন্য পাঁচটা দিনের চেয়ে আলাদা।
অমাবস্যাটা অবশ্য পুরোদস্তুর লোপাট হয়নি।তার আপাতত ঠিকানা বড় রাস্তার উল্টো দিকে ফুটপাতের একচিলতে উদ্বাস্তু সংসারটায়।একটা টিমটিমে লুন্ঠনের আলো কোনো রকমে পাল্লা দিচ্ছে মধ্য কার্তিকের ঠান্ডার সাথে।তার বিষন্ন আভা একটা ফ্যাকাসে প্রশ্নচিহ্নএর মতো লেপে আছে শীর্ণ কচি মুখটায়।
"মা, আমাদের দেয়ালি কবে আসবে?"
"আসবে রে আসবে, একদিন ঠিক দেয়ালি আসবে --দেখিস; আর সেদিন চারদিক শুধ আলো আর আলো!"
সহসা একজোড়া বেপরোয়া তীক্ষ্ণ আলোয় ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।সেদিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অস্ফুটে বলে উঠল মেয়েটা-- "মা, ওই দেখ_দেয়ালি_আসছে....."
মায়ের আর্তনাদ হারিয়ে গেল উৎসব মুখর শহরের শব্দের ভিড়ে।


অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়






এক্স




অধৈর্য লাগছে বড্ড। সাথে অস্বস্তিও খুব। প্রায় মিনিট চল্লিশ হতে চলল তিতাস ক্যাফে’তে বসে আছে। সৌম আসবে আজ। অনেকদিন পর একটা আশার আলো দেখেছে আবার তিতাস। গতকাল রাতে ফোনটা আসার পর, বাঁধভাঙা নদীর মতন স্রোত ছুটিয়েছে তার দুচোখ। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও বেশ খানিকটা সময় চোখের উপর একটু ব্যথা ব্যথা ভাব টের পেয়েছিল সে। শরীরটা বেশ দুর্বলও লাগছিল ওর কিন্তু তাই বলে সৌমের সাথে ডেটিংটা মিস করা যায় না। আর তাও যখন এতগুলো বছর পর, তিতাস ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কটা জোড়া লাগানোর একটা রাস্তা পেয়েছে তখন প্রয়োজনে রামসেতু বানাতে হলেও তাকে আসতে হবে। তাই সেই প্রাক্তন প্রেমিকের চোখে মুগ্ধতা আর জৌলুস ফিরে পেতে, খুব করে সেজেছে আজ। মাস্কারা, আই লাইনার, আই শ্যাডো, নেল পলিশ, লিপ স্টিক আর সাথে সুগন্ধি পারফিউমের মিশ্রণে নিজেকে লোভনীয় করে তুলেছে যতটা সম্ভব। স্লিম চেহারাটা আরও আকর্ষণীও করে ফুটিয়ে তুলতে ব্ল্যাক কালারের অফ শোল্ডার ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়েছে তিতাস। অল্প একটু ফ্লেশ ফ্ল্যাশিং আর চোখ ধাঁধানো গায়ের রঙ দেখে নিশ্চয়ই সৌম চোখ ফেরাতে পারবে না ওর থেকে, এ বিশ্বাস তিতাসের আছে। যদিও এইভাবে সাজতে খুব একটা স্বচ্ছল নয় ও, তবু সে সেজেছে। একটি মাত্র মানুষের জন্য সেজেছে। শুধু এটা বোঝাতে যে একদিন যাকে সৌম ছেড়ে গিয়েছিল, সে এখন কতটা পাল্টে গেছে। আজও কি তিতাস যোগ্য হবে না? এত গুলো বছর পাগলের মতন ভালোবেসেছে সে। এক তরফা প্রেম। অনেকেই বলেছে, এ তোর বড্ড বাড়াবাড়ি। কিন্তু তারা তো আর বোঝেনি ওর যন্ত্রণাটা।

গতকাল রাত্রে তিতাস যখন রোজ রাতের মত মানসিক যন্ত্রণাগুলো ভেঙে ভেঙে ঘুমের পথে ছুটছিল, তখন বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা একটা অচেনা নম্বরে কেঁপে উঠল। তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে তিতাস অস্পষ্ট একটা “হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠের পুরুষালি গাম্ভীর্যে, তার ঘুম সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছিল।
-আমি সৌম বলছি।
ব্যস এটুকুই যথেষ্ট ছিল তিতাসের বুকে হড়কা বান ডাকতে। কোনো রকমে সামলে নিয়েছিল সে নিজেকে। তারপর...
-সৌম?
-হ্যাঁ। ভালো আছো?
-হুম
-ঘুমাচ্ছিলে?
-হুম
-সরি। আসলে একটু কথা ছিল...
তিতাসের ইচ্ছে করছিল সে চিৎকার করে বলে, একটু কেন তোমার যত ইচ্ছে তুমি কথা বলো। সারারাত ধরে বলো। তোমার কথা শোনার জন্য আমি যে বিরহ কাতর রাধা হয়ে এতদিন চাতকের মতন অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু সমস্ত শব্দ গলার কাছে কেবল আঁটকে আসতে লাগল আর অস্পষ্ট স্বরে সে বলল...
-হ্যাঁ
-দেখা করতে পারবে প্লিজ?
কথাটা শোনা মাত্রই তিতাসের মনে দপ করে একটা আশার আলো জ্বলে উঠেছিল। হয়তো আবার একবার গল্পটা শুরু হতে চলেছে, ঠিক যেখানে অসম্পূর্ণ হয়ে পড়েছিল, সেখান থেকে। তিতাস’কে চুপ থাকতে দেখে সৌম আবার বলল...
-হ্যালো, বলছি কাল একবার দেখা করতে পারবে?
-কাল?
-হুম।
-কিছু বলতে চাও?
-হ্যাঁ।
-কী?
-তোমায় সরি বলার আছে। আর সাথে আরও অনেক কিছু...
-সরি কেন বলবে?
-আমি জানি, আমি ভুল করেছি তাই। প্লিজ কাল একবার দেখা করবে?
-বেশ। করব।
-থ্যাঙ্কস। আমি কোথায় আসবে সেটা তোমার নম্বরে মেসেজ করে দেবো কাল সকালে। কেমন?
-হুম। আচ্ছা একটা কথা বলবে?
-হ্যাঁ, বলো...
-তুমি আমার এই নম্বরটা কোথায় পেলে?
-একটা নম্বর খুঁজে পাওয়া কি খুব কঠিন?
-বলো না...
-তোমার ফেসবুক থেকে পেয়েছি।
-আমার নম্বর তো পাবলিক করা নেই। তবে কি তুমি আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ডস লিস্টে আছো? অন্য নামে?
-না, আমার এক বান্ধবি আছে। ওর মোবাইলে তোমার ছবিটা দেখেছিলাম। চ্যাট হেডে তোমার একটা মেসেজ এসেছিল একবার। কেমন চেনা চেনা লেগেছিল। ভালো বুঝিনি। তারপর, ওর কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে তোমার প্রোফাইল অন করতেই তোমায় দেখি...
-আচ্ছা। আমার কোন বান্ধবি বলোতো?
-রিয়া। রিয়া দত্ত।
-ওহ আচ্ছা। আমার বান্ধবি নয়। অফিসের কলিগ। তেমন ক্লোজ নই আমরা। খুব দরকার ছাড়া তেমন একটা কথা হয় না। শিফটও আলাদা পড়ে।
-আচ্ছা। বুঝলাম। বাই দ্যা ওয়ে, তোমায় কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে প্রতিটা ছবিতে। আগের থেকে অনেক পাল্টে গিয়েছ...
-থ্যাঙ্কস।
-আর এখন ওয়েল সেটেল্ডও হয়েছ। অত বড় একটা সংবাদপত্রের নামকরা রিপোর্টার।
-থ্যাঙ্কস আগেন...
-মোস্ট ওয়েলকাম। এনিওয়ে, আমার মোবাইলে একদম চার্জ নেই। আজ রাখি, কাল অ্যাড্রেসটা মেসেজ করে দেবো। প্লিজ এসো।
-হ্যাঁ, আসব।
-আর... আই লাভ ইউ...
বলেই ফোনটা কেটে গিয়েছিল। শেষের তিনটে শব্দ শোনার পর কিছুক্ষণ, স্থির পাথরের মতন বসেছিল তিতাস। তারপর...তারপর বৃষ্টিঝরা প্রচণ্ড আবেগে ঝর ঝর করে ঝরে পড়েছিল সে...

সকালে ঘুম থেকে উঠেই, মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন দেখেছিল সে। সৌম অ্যাড্রেসটা মেসেজ করে দিয়েছে অলরেডি। লেখা ছিল, ওয়াটারসাইড ক্যাফে, হায়াত রিজেন্সি, সন্ধ্যা ৭ টা। এরপর শুধু অপেক্ষা রেখেছিল, সেই সময় টুকুর জন্য। সামনা সামনি দেখা হলে কী বলবে, কিভাবে বিহেভ করবে ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তায় অস্থির ছিল তিতাস। আবার মনে হয়েছিল, সে যেন খুব বেশি পাগলামি না করে ফেলে। তাই বারবার চেষ্টা করেছিল নিজেকে শান্ত করার।

এখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। এবার অস্বস্তি আর অধৈর্য একত্রিত রূপ নিয়ে দগদগে অসন্তোষ হয়ে উঠছে একটু একটু করে। এত দেড়ি কেন করছে সৌম? তবে কি আসবে না? তাহলে ফোন করল কেন? নাঃ আর ভালো লাগছে না এইভাবে। বুঝতে পারল একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়া খুবই প্রয়োজন। তাই ওয়াশরুম যাওয়ার পথে একটা টেবিলের পাশ কাটাতে গিয়ে দুই যুবকের কথাপকথনে কান গেল তিতাসের। ওদের মধ্যে একটি যুবক বলছে-
-আই ডোন্ট থিঙ্ক ধোনির কম্প্রমাইজ করা উচিত এখানে। হি হ্যাজ ট্যালেন্ট এই সব লোক’কে ওর একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। নাম্বার ফোরে নামুক আর একটা সেঞ্চুরি করে ওদের মুখে ঝামা ঘষে দিক।

ওয়াশরুমে গিয়ে মিররে নিজের মুখটা দেখতে দেখতে ছেলেটার এই কথাগুলো কানে বাজতে লাগল তিতাসের। তারপর হঠাৎ যেন, সারা শরীর ওর জ্বালা করে উঠল। কি করছে ও?  আজ থেকে বছর তিনেক আগে কলেজ লাইফে তৈরি হওয়া একটা প্রেম নিভে গিয়েছিল। এই সৌম তাকে একদিন ছেড়ে চলে গিয়েছিল। যেহেতু তখন তিতাস একটু স্বাস্থ্যবতী ছিল, তাই তার জন্যে কত টিটকিরিও দিয়েছে সৌম। কিন্তু এই ভালোবাসার প্রভাব এত বেশি ছিল তিতাসের মনে যে, কখনও সে তাতে কিছু মনে করেনি। তিতাস খুব ভালো করেই জানে সৌম এক কুৎসিত মানসিকতার পুরুষ। না, এদের পুরুষও বলা যায় না। প্রকৃত পুরুষ হলে কেউ কি একজন মেয়ে’কে সবার সামনে চড় মারতে পারে? সেদিন তো তিতাস কিছুই বলেনি, শুধু বলেছিল, সে একজন বড় জার্নালিস্ট হতে চায়। বাইরে বাইরে ঘুরতে চায়। আবর্জনা খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা সত্য উদঘাটন করতে চায়। সৌম বলেছিল এমন কাজ তাদের সংসারে নাকি শোভা পায়না। তিতাস একটু জোর করায়, অচেনা অজানা লোকের সামনে রেস্টুরেন্টে ওকে চড় মেরে চলে এসেছিল সে। তারপরেও, হ্যাঁ তারপরেও তিতাস ওকে ভালোবেসেছে। এতদিন। “ছিঃ আমার কি কোনো আত্মসম্মান বোধ নেই?” অস্ফুট স্বরে ককিয়ে উঠেছিল কথাগুলো। এতদিন তার কত বন্ধু তাকে বুঝিয়েছে, কিন্তু ও বোঝেনি। বারবার এক তরফা প্রেমে আগুনে পুড়িয়েছে নিজের গোটা মনটাকে। এখন ওয়াশরুমে নিজের দিকে দেখতে দেখতে তিতাস নিজে নিজেকে একটা প্রশ্ন করল, “ভালোবাসা না আত্মসম্মান?”

উত্তরটা খুঁজে নিতে এবার আর ভুল করল না তিতাস। বেশ কিছুটা সময় সে নষ্ট করেছে ঠিকিই তবে আজ তিতাস বুঝতে পেরেছে, যে এক তরফা প্রেমে আত্মসম্মান নগ্ন হয়, সে প্রেম আঁকড়ে ধরে কোনো লাভ নেই। তাই শারীরিক আর মানসিক সকল মেকআপ ধুয়ে ফেলে, ধীরে ধীরে নিজের টেবিলে এসে বসে পড়ল। আশপাশ আর একবার দেখে নিলো। না, অমানুষটা এখনও আসেনি। ভালো হয়েছে আসেনি। তিতাস কেনই বা এতকাল ওর অপেক্ষায় বসেছিল? কেনই বা এত সেজে আজ এসেছে ওর জন্য? সৌম তো ভালোও বাসে না ওকে। ফেসবুকে ওর ফোটো আর স্ট্যাটাস দেখে, হঠাৎ কোনো ইনফাচুয়েশনে হয়তো আবার ফিরে আসতে চায় সে। কিন্তু ওকে প্রশ্রয় দিলে আখেরে ক্ষতি তিতাসেরই হবে। যদি বিয়ে হয় তবে কি আর তখন এরকম টিপটপ সুন্দর থাকতে পারবে ও? সন্তানও আসবে, তখন কি আর সৌম ওর খেয়াল রাখবে? আবার যে ছেড়ে যাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? এমন মানুষ কোনো মেয়ের যোগ্য হতে পারে না। আজকাল যখন তিতাস সেজেগুজে রাস্তাঘাটে বেরোয় তখন বেশ ভালোভাবেই ওর চোখ অবলোকন করেছে কিভাবে ছেলে, যুবক, মধ্য বয়স্ক, বিবাহিত, অবিবাহিত , বৃদ্ধ সকলেই তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। যা প্রমাণ করে তিতাস সত্যই অতুলনীয়া সুন্দরী। আর কেবল সুন্দরীই নয়, সাথে সাথে খুবই ট্যালেন্টেড একজন ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিসম নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আর আজ সে একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের সাথে জড়িত। উচ্চ পদস্থ একজন জার্নালিস্ট। ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল। না, তিতাসের কোনো ছেলের অভাব হবে না। একজন ভালো মনের পুরুষ মানুষ সে নিশ্চই পাবে। এসব ভাবতে ভাবতে তিতাসের ফোনটা একবার কেঁপে উঠলো, তাতে ফ্ল্যাশ করছে সৌম নামটা। সৌম একটা মেসেজ পাঠিয়েছে যাতে লেখা, “গট স্টাক ইন দ্যা ট্রাফিক... ভেরি সরি। প্লিজ ওয়েট ফর টেন মিনিটস মোর...” মেসেজটা পড়ে, তিতাস উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে আর ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রিপ্লাইটা লিখে সেন্ড করল সৌমকে, যাতে লেখাছিল, “আত্মসম্মান সবার চেয়ে দামি... এক্স”।