নোটিশ বোর্ড
বৃষ্টি:পবন কুমার সাহা
এ কবিতা তোমার জন্য নয় : মান্নুজা খাতুন
আজকের এ কবিতা তোমার জন্য নয় প্রিয়, ভয় পেও না
তোমাকে অপরাধী করব না, অভিশাপ দেব না৷
যেদিন প্রথম জেনেছিলাম তুমি আমাকে ভালবাসো
আমি নির্বাক হয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।
যেদিন প্রথম আমার হাতটি তোমার মুঠোর মধ্যে বন্দি করেছিলে
আমি পুলকিত হয়েছিলাম, সাথে লজ্জাও পেয়েছিলাম দ্বিগুন।
আর আজ নির্বাক ভাবেই দুর থেকে তোমাকে দেখে আসছি
কাছে যাবার সাহস নেই, নেই কোনো অধিকার
তবুও সম্মুখে এলেই সুযোগ খুঁজি আঁড়াল হতে দেখার।
সেদিনও দেখেছিলাম মঞ্চে হতে, ব্যস্ত ছিলে অনর্গল কথোপকথনে।
আজকের এ কবিতা তোমার জন্য নয় প্রিয় , ভয় পেও না
তোমাকে আর ভালোবাসার কথা বলব না,
ভালোবাসার মায়ায় ক্ষণে ক্ষণে জড়াব না
আমার সমস্ত স্বপ্ন আর আবেগ বামপাশের পার্লামেন্টে বন্দি রেখে
তোমায় উড়িয়ে দেব তুমি প্রান ছেড়ে বাঁচবে
মুক্ত বিহঙ্গের মতো খোলা আকাশের বুকে
আজকের এ কবিতা তোমার জন্য নয় প্রিয়, ভয় পেও না
কথা দিচ্ছি , তোমার কথা আর কাউকে বলব না,
বলব না রাতের আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা হোস্টেলের -
চারতলা বিল্ডিংয়ের সামনের সেই আকাশী বাড়িটিকেও
তুমি ভয় পেও না, তোমাকে ছোট করব না
বিন্দুমাত্র দোষ দেব না, আমাকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য অপরাধী করব না
সবটাই আমার ভাগ্য বলে মেনে নেব
ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়ে ভালোবাসার স্মৃতি আগলে বাকিটা পথ এগিয়ে যাব।
আজকের কবিতা তোমার জন্য নয় প্রিয়
আজকের কবিতা আমার জন্যেও নয়
আজকের এ কবিতা ভাঙাচোরা সেইসব মানুষদের জন্য
যারা পেয়েও হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনদের৷
বিঃ দ্রঃ -- ৩ নং ও ৪ নং লাইন দুটো সংগৃহিত।
আপনাদের উৎসাহ আমাকে আরো ভালো লিখতে শেখাবে
অভিশপ্ত : রফিকুল ইসলাম
মানবতাকে বিপন্ন করে জাতি হয়েছে বন্দি
স্বার্থের নীতিতে মগ্ন হয়ে করেছে সন্ধি
সংখ্যালঘুর নির্যাতনে শুনেনি কেউ কাঁদন
মানব শিশুর কান্নার আওয়াজে জাতিকে করেনি বাঁধন।
অভিশপ্ত পৃথিবীতে অভিশপ্ত আমরা
অভিশপ্ত আমাদের জগৎময়
জাতি আজ বিবেকহীন মস্তক ধরণীর বুকে
মানবতা সব অসহায়।
ফিলিস্তিনি, কাশ্মীর যখন অবরুদ্ধ ধরণীর বুকে
কারো কন্ঠস্বরে শুনা যায়নি প্রতিবাদে সোচ্চার
সংখ্যালঘু বার বার নির্যাতিত হয়েছে শোকে
ধরণীর বুকে ছিল না কারো হুংকার
অভিশপ্ত পৃথিবীতে অভিশপ্ত আমরা
অভিশপ্ত আমাদের জগৎময়।
ধিক্ষিত মানব কণ্ঠ অকণ্ঠিত জীবন
সংখ্যালঘু সব বন্দিশালায়
ধমনীতে দেখা যায়নি প্রতিবাদে সোচ্চার
মারণাস্ত্রে অঙ্কুরিত করে জাতির মাঝে করেছে আবাদ
মানবতা যখন বিপন্ন ধ্বংসের লিলা
স্বার্থের নীতিতে গড়ে তুলিনি প্রতিবাদ।
অভিশপ্ত পৃথিবীতে অভিশপ্ত আমরা
অভিশপ্ত আমাদের জগৎময়
দশের লাঠি পুড়বে যখন একা
নিরবতা যে ভাবায়
আদমের ঘরে জন্ম নিয়ে ছিল শিশু নিষ্পাপ
ধরণীর বুকে জাতি করেছে আজ তাকে বিভেদ
দানবের বেশে ধরণীর বুকে সবাই যে মগ্ন
পাপিষ্ঠে অভিশপ্ত পৃথিবী গুণতে হবে বিপদ
অভিশপ্ত পৃথিবীতে অভিশপ্ত আমরা
অভিশপ্ত আমাদের জগৎময়
আর্তনাদে কাঁদিবে ধরণীর বুক
শুনিবে শোকে হায় হায়
দানবের বেশে ধরণীকে বার বার করেছে আঘাত
সৃষ্টির মাখলুকাত হয়েছে সবাই আজ বিপন্ন
মানবের কল্যাণে উন্মোচন হউক সব সৃষ্টি
না হয় জীবনের পরতে বিপদ যে আসন্ন।
অভিশপ্ত পৃথিবীতে অভিশপ্ত আমরা
অভিশপ্ত আমাদের জগৎময়
মানবের নীড়ে বিবেকের কাঠগড়া
মুক্তি যেন পায়।
সম্পাদকীয়
এবার মেঘে চাঁদ উঠেছে,জলের দরের খিদে,
কান্না লুকিয়েই সাজাবো পুজো,মিলনতিথি ঈদের।।
কঠিন সময় কাটছে না আর,এই দরিয়া হচ্ছে না যে পার,
মেঘ সরিয়েই ,আলো-ছায়া ,আসবে নতুন চাঁদ,খোদা'র।।
ধ্বংস হয়েও তাই ,ফিরে আসা যদি হয় ফের,
হেরে যাওয়া প্রতিটি মানুষও ,জেতে,আল্লার মুসাফির।।
ভালো থাকুন ,সুখে থাকুন ,ভালো রাখুন প্রিয় মানুষটিকে,
ফের দু কথা লিখবো আবার ,ফিরবো সবাই নিকোটিনে।।
সুস্থ্য থেকে ,যতটুকু দরকার ততটুকুই যাবো ঘরেই বাইরে,
কঠিন সময় ,তাই হাতে হাত রেখে চলতে হবে ভাইরে ।।
এবারের সংখ্যায় যারা লিখেছেন--
নন্দিনী পাল
শুভঙ্কর রাহা
কাজী জুবেরী মুস্তাক
অনিন্দ্য পাল
প্রীতম বিশ্বাস
রাহুল শীল
রিয়াজুল হক সাগর
অর্ঘ্যকমল পাত্র
রিঙ্কু মন্ডল
আর্য দাস
শোভন মন্ডল
রুমকি দেবনাথ
রাজা দেবরায়
শুভম চক্রবর্ত্তী
দেব জৈন
অভিজিৎ দাস কর্মকার
পিনাকি কর্মকার
ইসমাইল মোল্লা
গোলাম রসুল
শ্যামল কুমার রায়
সুকুমার দাস
কিশলয় গুপ্ত
সুনন্দ মন্ডল
রিম্পা লাহা সুরাই
শিশির বিন্দু দত্ত
প্রীতি কর্মকার
জয়তোষ ঘোষ
মাসুদ হাসান
আরিফ মন্ডল ( পেঁচা)
আসামুদ্দিন সেখ
আস্তাইন বিল্লা
মান্নুজা খাতুন
ধন্যবাদান্তে
নিকোটিন ওয়েব ম্যাগের সম্পাদকমন্ডলী
একটি মেয়ের আত্মকথা : মান্নুজা খাতুন
আমি তার প্রেমে পড়ি বারবার
হ্যাঁ তাকে মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে দেখেছি বহুবার৷
আজ মুক্তির প্রথমদিন দীর্ঘ বন্দিত্বের পর আমি আজ মুক্ত, মেয়ে বলেই সমাজ আমার পায়ে শেকল দিয়েছিল, বই খাতা একদিন পুড়িয়ে দিয়েছিল, পথে ঘাটে বার বার আমায় অপমান করেছিল৷ আমার দাদা আমায় ভীষণ বকেছিল, বাবা চোখ রাঙিয়েছিল, সমাজ বলেছিল চৌকাঠের বাইরে এলে ভেসে যাবে কোথায় তা ঠাহর করতে পারবে না৷ ভুল তো আমি কিছুই করি নি সেদিন, আমার ভুল ছিল আমি লেখাপড়া শিখেছিলাম, আমার ভুল ছিল সমাজের আর মেয়েদের পড়তে শেখাচ্ছিলাম, বোঝাচ্ছিলাম কোনটা অন্যায় কোনটা ন্যায়, তাদের প্রতিবাদী হতে শেখাচ্ছিলাম, আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ সেটা ভালো চোখে নিল না, আমাকে শাসিয়ে গেল, বন্দিজীবন কাঁটাতে হবে। ঘরের বাইরে প্রায় ঘোরা ফেরা করে তারা৷ সেই থেকে আমি বন্দি।
আজ প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল রাতের গভীরে ভাইয়ের ছদ্মবেশ এ ওই গ্রাম ত্যাগ করে শহরে এসেছি মামার বাড়িতে। এখানে অবশ্য সমাজ নামক কোনো যমদূত নেই। এখানে সবাই মুক্ত। মামার ছেলে মেয়ে সবাই ইংরেজি পড়ে জুতো মোজা পরে, স্কুল - কলেজ যায় এখানে পড়াশোনার জন্য কোনো চোখ রাঙানি নেই। এখানে এসে আমার ভয় ভীষণ করছে কেননা মা আর ভাই একা আছে, ভয় হচ্ছে ওই সমাজের লোকগুলোর কথা ভেবে তারা যদি আমাকে না পায় তবে কি তাদের প্রতি নির্যাতন করে যদি। বাবা আমায় সান্ত্বনা দিয়ে গ্রামে ফিরে গেল, মামী অভয় দিল, মায়ের মতোই কাছে টেনে নিল। দিন কয়েকপরে মামা আমায় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল।
এই ১০বছরে আমি অনেক এগিয়ে এসেছি। একা স্বাধীন জীবন যাপন করতে শিখেছি। শহরের অলিতে গলিতে বহুপথ হেটেছি। কিন্তু আমি নিজের জন্ম স্থানে ফিরতে পারি নি এখনো। আর কিছুদিন পরেই আমায় কলকাতা ছেড়ে মুম্বাইয়ে যেতে হবে তাই মনে প্রানে চাইছি গ্রামের সেই পরিবেশ এ মন খুলে ঘুরে বেড়াতে, আমি চাইছি বাল্যবন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু আমি জানি আমার স্বপ্ন ঠিক পুরন হবে না৷
হঠাৎ আজ মামী একখানা চিঠি এনে আমার হাতে দিল। মায়ের চিঠি অবশ্য লেখাটা বাবার। মা তার দৈনন্দিন জীবনের সব কথায় ব্যক্ত করত। কিন্তু আজ অন্য কথা লিখেছে আমার ছেলে বেলার বন্ধু সরলার বিয়ে। সেই সরলা মা কে অনুরোধ করেছে আমায় যেন চিঠি লিখে ডেকে নেয়৷ চিঠির সাথে আর একটা চিঠি পেলাম সেটা সরলার। চিঠি দুটো পড়ে স্থির করলাম আমি গ্রামে ফিরব,, সরলা অনেক কিছুই লিখেছে,গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও, সেই আমিই একজন ডাক্তার হয়ে কি ভাবে নিজের গ্রামকে অন্ধকারে রাখব এই প্রশ্নই আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে বলছে৷
আজ ১০ বছর পর গ্রামে ফিরছি তবে ছদ্মবেশ এ নয় আমার চেনা রুপ নিয়েই। সেই গ্রামের স্বাস্থ্যদপ্তরের ডাক্তার হয়ে। স্বাস্থ্যদপ্তরে মহিলা ডাক্তার না থাকায় মেয়েরা বাড়িতেই সন্তান প্রসব করত এতে অনেক সময় সন্তান প্রসবের পর নাড়ি ছেদের ভুলে মায়ের কিংবা সন্তানের মৃত্যু হয়,নতুবা রক্তপাতের কারনেও মৃত্যু হয়। যাই হোক গ্রামে প্রবেশ করে মুগ্ধ নেত্রে সব চেয়ে দেখছি, আমাদের সেই বটতলা যেখানে খেলাধুলা করতাম, সেই খোলা মাঠা, সেই লুকিয়ে আমের বাগানে আম চুরি সবই মনে পড়ছে। কিছুটা যেতেই গ্রামের মাতব্বর জগদীশ ভট্টাচার্য এর সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন? স্বাস্থ্য সংস্থার নাম বলাতে পথ দেখিয়ে দিল আর আশ্চর্য হয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে চলে গেল। আমিও আরও অবাক হলাম যে আমায় চিনতে পারল না।
যাই হোক স্বাস্থ্য সংস্থার কেন্দ্র থেকে ফিরেই বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম মা বাবা ভাই এর সাথে আমার বন্ধু সরলা ও তার মাও অপেক্ষা করছে৷ বাড়িতে সবাইকে প্রনাম করে একটু গল্প করে খেতে বসেছি যেই সেই সময় বাড়ির বাইরে কে বা কারা যেন বাবার নাম ধরে ডাকছে। বাবা খাবার ফেলে রেখেই উঠে গেল, মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল আমাকে লুকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু আমি মা কে বারণ করলাম এসবের দরকার নেই।
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমিও দেখলাম জগদীশবাবু ছাড়াও আরও অনেকেই আছেন যারা আমাকে গ্রাম ছাড়া করাবার জন্য এসেছে। কিন্তু আমি তো ফিরে যাবার জন্য আসি নি। এ গ্রাম আমার, এই আমার জন্মস্থান কেন আমি ফিরে যাব? তাদের কথার যথেষ্ট প্রতিবাদ করলাম এবং তারা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে গেল। আমার মা আমায় আবার ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করল৷ কিন্তু আমি তো ফিরে যাওয়ার জন্য আসি নি।
পরের দিন বাবার সাথেই স্বাস্থ্য দপ্তরে গেলাম। আমার কাজ বুঝে নেওয়ার পরও বাবা সেখানে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হয় নি ফিরে যেতে বললাম। হ্যাঁ খুব মনে আছে সেদিন আমার হাতে একটা কেস এসেছিল, তাতে আমি যথাযথ সফল ছিলাম। একজন মহিলা ডাক্তার পেয়ে গ্রামের অনেক মহিলায় নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু আমার প্রতি যাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ তার খুশি হতে পারে নি।
একের পর এক কেস আসতে থাকে, আমিও আমার কাজ করতে থাকি । সরলার বিয়েও হয়ে গেছে কদিন আগেই৷ সেদিন তেমন কাজও ছিল না৷ বসে আছি বাইরের বারান্দায় হঠাৎ দেখি জগদীশবাবু এগিয়ে আসছে দলবল নিয়ে। আমায় শাসিয়ে যাচ্ছে গ্রাম ত্যাগ করতে, আমাকে সেদিন কিছুই বলতে হয়নি যা বলার সেদিন গ্রামবাসীরাই বলেছিল। প্রত্যেকেই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিবাদ করেছিল৷ জগদীশ বাবু ফিরে যায়।
ঘন্টাখানেক পরেই জগদীশবাবুর বাড়ির একটা ছোট ছেলে এসে জানাল তার দিদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে, তার মেয়ের ডেলিভারি কেস আছে শুধু জগদীশবাবুর ভয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আনতে পারছে না। আমি যাব কি যাব না এটা যখন ভাবছি তখন আমার পাশে যারা ছিল তারা জানাল যদি বিপদ হয় তবে কি করবে? তারাও সাথে যাবে। কিন্তু তাদের নিরস্ত করে একজন নার্স কে সাথে করে ঘরে এগিয়ে গেলাম।
জগদীশবাবুর বাড়ির গেট এ পৌচ্ছেই বাঁধা পড়ল দারোয়ানের। কিন্তু সে বাঁধাও টিকল না উপর থেকে জগদীশবাবুর স্ত্রী তা দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে পথ ছেড়ে দিতে বলল।
গেট পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলাম জগদীশবাবুর রক্তাক্ত চোখ, আমার এই বাড়িতে উপস্থিতি তার সহ্য হচ্ছে না,, একবার আমায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করল। কিন্তু সে অনুরোধও টিকল না। ওনার স্ত্রী প্রতিবাদ করল, তাকে পূর্ব ঘটনা ( ছেলের বউ এর মৃত্যু) মনে করিয়ে দিল,, তখন একমাত্র মেয়েকে হারানর বেদনায় আর কিছু বলল না৷
৩০ মিনিট এর চেষ্টায় আমি সে অপারেশনেও সফল হই। সফল হওয়ার পর যখন নীচে নেমে এলাম জগদীশবাবুর স্ত্রী আমার কাছে তার স্বামীর ব্যবহার এর জন্য ক্ষমা চাইল ও অনেক আশির্বাদ করল। আশির্বাদ নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি তখন দেখি গেট এর সম্মুখে জগদীশবাবু দাঁড়িয়ে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম তার সে রক্তচক্ষু নেই, সেই রাগ আর নেই, যেন মাটির একটা মানুষ । তার পুর্বভুলের জন্য ক্ষমা চান আমার কাছে। ততক্ষণে গ্রামের অন্যান্যরাও এগিয়ে এসেছি জগদীশ বাবুর বাড়ির দিকে বাবাও এলেন। জগদীশবাবুর এ হেন আচরনে আমি ক্ষমা না করে পারলাম না। এবং তার মেয়ের জীবন বাচানোর জন্য বকশিস দিতে চাইলে আমি নিজের জন্য না চেয়ে গ্রামের জন্য একটা স্কুল চাইলাম। খুশি মনে তা মেনেও নিল।
আজ আমি বহুদিন পর মুক্তি পেয়েছি। হেরে না গিয়ে জিতে গেছি। খোলা মাঠে খুশি মনে ঘুরছি ফিরছি। আর গ্রামের জন্য কাজ করছি।
লাল শাড়ি : আস্তাইন বিল্লা
সামনে ঈদ। আবার বাড়ির কর্তারও বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল। হাত চালিয়ে কুঠার চালাচ্ছে রেণুকা বিবি। তিন বছরের একটি শীর্ণ প্যাকাটির মত একটা শিশু পেটের সঙ্গে ন্যাকড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা । রোগাজীর্ণ শিশু কেঁদেই চলেছে। শিশুকে যেন যেন জীবনের কঠোরতর সংগ্রামের অবতীর্ণ করার প্রস্তুতি। এখন থেকেই সহ্য ক্ষমতা করায়ত্ব না করলে চলবে কেন! জন্ম যে হয়েছে কঠিনের মধ্যে দিয়ে। এ যেন থামবার নয়। পাশে বকের মত গলা তুলে ভাঙা পা ছড়িয়ে শুকনো তো কোনো ব্যাপার নয় । বরং দুর্গন্ধযুক্ত মাছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াতে ব্যস্ত রেণুকার বড় ছেলে সুজন। এদিকে পাড়ার পঞ্চায়েত মেম্বারের ছেলে সদ্য থার্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করেছে৷ বাপ খুশি হয়ে এন্ড্রয়েডে মোবাইলও কিনে দিয়েছে৷ দুনিয়ায় সব কিছু মুঠোয় এনেছে৷ এই তো সেদিন রেণুকা তার স্বামীর সঙ্গে কত খোশগল্প করল, এমনকি চুমুও খেল। অবশ্য হারাণ মন্ডলের ছেলে কথা বলার দরুন দশ টাকা নিয়েছে৷ রেণুকার অভাব থাকা সত্ত্বেও টাকা খরচ করতে পিছুপা হয় নি। হাটে কাঠ বিক্রি করেই টাকা সংগ্রহ করেছিল। পিছুপা হবেই বা কেন অত দূরের মানুষকে এত কাছে এনে দিয়েছে। এ কি কম সৌভাগ্যের!
রেণুকার স্বামী থাকে মহারাষ্ট্রের নাসিকে। এই কদিন পর ঈদে'ই ফেরার কথা৷ সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজে জোগানদার হিসাবে শ্রম দেয়৷ বিনিময়ে আড়াইশো টাকা। অবশ্য এ কাজ তার ঠিক পোষায় না। তার পূর্বপুরুষেরা বনে-জঙ্গলে কাঠ কেটে জীবন যাপন অভ্যস্ত। এদিকে আবার সরকার কাঠ কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি। সব মিলিয়ে তার মত উলুখাগড়ার এইসব জোগানদার কাজ পোষায় না বলে চলবে কেন! সে-যে কপাল করে হা-ঘরে জন্মেছে। তাই হারাণ মন্ডলের ছোটভাইয়ের সঙ্গে নাসিকে যাওয়া। তার ছোটভাই ঠিকাদার।
রেণুকা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে কাঠ কাটতে থাকে হাঁপানি থাকা সত্ত্বেও । আর ভাবতে থাকে সুজনের আব্বা অনেক টাকা নিয়ে ফিরবে। সামনে ঈদ। কত গোছানো স্বপ্ন৷ সুজন এবং তার ছোটভাইয়ের জন্য নতুন জামা। তার নিজের আবার, অনেকদিনের স্বপ্ন, চুমকি বসানো ব্লাইজ এবং টুকটুকে লালরঙের তাঁতের শাড়ি। তাদের সংসারে সবচেয়ে বড় ভাবনা সুজনের ভাঙা পা আর তার মায়ের হাঁপানি। বাড়ির লোক বলেও গিয়েছেল। বাড়ি ফিরে এসে কলকাতায় মস্ত বড় ডাক্তার দেখাবে৷ এদিকে ঘরের দরমাও ভেঙে গেছে। সেদিন ছোট ছেলেটাকে দরমার ফাঁক দিয়ে শেয়ালে টানছিল। এইসব ভাবনার মধ্যেই ডাক দিয়ে ওঠে হারাণের ছেলে—
---অ সুজনের মা। তোমার ভাতার কালু যে ফির্যা আসে নাসিক থেক্যা।
এহেন খুশির সংবাদ শুনেই সুজনের মায়ের ঘাম কপালে রোদের আলো পড়ে চিকচিক করছে৷ ফর্সা গাল আপেলের মত লাল হয়ে ওঠেছে৷ কিন্তু পরক্ষণেই যখন হারাণের ছেলে বলে যে-
---দ্যাশে করুনা না কি যেন বালা আস্যাছে। তাই লেবাররা নিজ দ্যাশে চল্যা আসছে । খবরে বলছে সরকার টেনও বন্ধ করে দিছে ।তাই পথে হাট্যা আসছে।
এহেন কুশলে মহিলা গম্ভীর অথচ শান্তস্বরে বলে –
---ও ক্যামন আছ? দেখন যাব না?
--- না তাদের যে মোবাইল নাই। দেখন যাইব না।
হতাশ হয়ে মুখ নীচু করে অদৃশ্য ভবিষ্যতের আশঙ্কায়। হঠাৎ করে মাথা ঘুরতে থাকে৷ খুঁটি ধরে বসে যায় কাদাযুক্ত ঘরের বারান্দায়৷ আর অঝোরে কাঁদতে থাকে। সত্যি এতদিনের স্বপ্নও কাঁদতে থাকে রেণুকার সুরে সুরে। জগত সম্পর্কে সে যেন জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। এমত অবস্থায় মরার উপর খাড়ার ঘা। পঞ্চায়েত পক্ষ মাইক নিয়ে ঘোষণা করতে থাকে এই মর্মে যে, আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনারা নিরাপদ অবস্থানে আশ্রয় নিন। সাবধানে থাকুন ।গাছের তলায় থাকবেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব ঘোষণা কিছুই কানে যায় না রেণুকার৷ সে-যে স্বামী শোকে বিহ্বল। পাড়ার সকলেই যখন হইচই করতে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে তখনই হুঁশ ফেরে তার৷ জানতে আগ্রহী হয়ে পাশের বাড়ি সেরাজুলের বুকে জিজ্ঞাসা করে -'লোক সকলি কোতি যায়? '
তখন উগ্রভাবে সেরাজুলের বউ জবাব দেয় –
--- মাগির ঢং কত! গাঁয়ে কত কিছু উড়্যা গেল কিছুই যাননা বুঝি! ঝড় গো। আল্লার ঝড় ।
একথা শুনে তাদের অনুকরণ করে দু'সন্তান নিয়ে হাঁটতে শুরু করে তখনই পিছন হাকতে হাকতে থাকে হারাণ মন্ডল। চীৎকার বলে - ' ও রেণু'। সে বরাবর নাম ধরে আদর করেই ডাকে৷ ডাকবেই বা না কেন! এ পাড়ায় মধ্যে কম সুন্দরী নয় কালুর বউ!। শরীর খানা যেন দুধে আলতা মেশানো ।ঘুরে তাকাতেই হারাণ বলে ওঠে কাঁদো কাঁদো হয়ে –
---তোর ভাতার যে আর নাই। রাস্তায় লরিতে পিশে দিছেরে। সে আর নাই।
আর এ খবর শুনেই মূর্ছা যায় সে। পেটে বাঁধা ছেলেটি জোরে কাঁদতে থাকে৷ সকলে ধরে নিয়ে যায় স্কুলের ব্লিডিং-এ। সেখানে অজস্র ভিড়ে একপাশে জায়গা পাই সেরাজুল এবং সেখানে দয়াকরে রেণুকার ব্যবস্থা করে দেয়। সে স্বামীর শোকে প্রায় মৃত। ছেলেরা বাপ এবং ক্ষিধের যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের উপর কিল চড় মারতে থাকে৷ এ যেন নতুন উপদ্রব। বিহ্বল অবস্থায় পড়ে রেণুকা। জগত সম্পর্কে সে যেন জ্ঞান হারা। আর ক্ষিধে অবস্থায় ঘুমিয়ে গেছে দু'সন্তান। আর গভীর রাতে হু হু করে বৃষ্টি আর ঝড় বইতে থাকে৷ সকলেই প্রায় নিজেদের পরিবারের খেয়ালে হই চই করতে থাকে স্কুল ব্লিডিং। অথচ একজন নীরব জন্তুর মত কাতরাচ্ছে। বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে সকালে আলো ফোটে। তখন সেরাজুলের বউ গায়ে হাত দিয়ে ডাকে –
'ও কালুর বহু। তোমার ছেল্যারা কই! ঝড়ে লইল না কি!
রেণুকা কোনো উত্তর না দিয়ে সে শীর্ণ হাত তুলে আকাশে তুলে চীৎকার বলে উঠল –
ওই যে । যার জিনিস সে ফিরায়্যা লইছে।
এ কথা বলেই মুখে ঘুরে ঘুমানোর ভান করে৷ কাপড়ের যে অর্ধেকাংশ শরীরে ছিল সেটাও ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। ঈশ্বর কি সবকিছু দেখলেন! না কি দেখেও চোখে বুঝে গা ঝাড়া দিলেন! তিন দিন পর রক্তমাখা কাপড়ে বাঁধা লাশ ফিরে এল রেণুকার কোলে । সে-যে স্বপ্ন দেখেছিল লাল শাড়ির। আজ অথচ দেখ স্বামীর রক্তে লাল হয়ে ওঠেছে সাদা থান খানি।