আমি তার প্রেমে পড়ি বারবার
হ্যাঁ তাকে মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে দেখেছি বহুবার৷
আজ মুক্তির প্রথমদিন দীর্ঘ বন্দিত্বের পর আমি আজ মুক্ত, মেয়ে বলেই সমাজ আমার পায়ে শেকল দিয়েছিল, বই খাতা একদিন পুড়িয়ে দিয়েছিল, পথে ঘাটে বার বার আমায় অপমান করেছিল৷ আমার দাদা আমায় ভীষণ বকেছিল, বাবা চোখ রাঙিয়েছিল, সমাজ বলেছিল চৌকাঠের বাইরে এলে ভেসে যাবে কোথায় তা ঠাহর করতে পারবে না৷ ভুল তো আমি কিছুই করি নি সেদিন, আমার ভুল ছিল আমি লেখাপড়া শিখেছিলাম, আমার ভুল ছিল সমাজের আর মেয়েদের পড়তে শেখাচ্ছিলাম, বোঝাচ্ছিলাম কোনটা অন্যায় কোনটা ন্যায়, তাদের প্রতিবাদী হতে শেখাচ্ছিলাম, আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ সেটা ভালো চোখে নিল না, আমাকে শাসিয়ে গেল, বন্দিজীবন কাঁটাতে হবে। ঘরের বাইরে প্রায় ঘোরা ফেরা করে তারা৷ সেই থেকে আমি বন্দি।
আজ প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল রাতের গভীরে ভাইয়ের ছদ্মবেশ এ ওই গ্রাম ত্যাগ করে শহরে এসেছি মামার বাড়িতে। এখানে অবশ্য সমাজ নামক কোনো যমদূত নেই। এখানে সবাই মুক্ত। মামার ছেলে মেয়ে সবাই ইংরেজি পড়ে জুতো মোজা পরে, স্কুল - কলেজ যায় এখানে পড়াশোনার জন্য কোনো চোখ রাঙানি নেই। এখানে এসে আমার ভয় ভীষণ করছে কেননা মা আর ভাই একা আছে, ভয় হচ্ছে ওই সমাজের লোকগুলোর কথা ভেবে তারা যদি আমাকে না পায় তবে কি তাদের প্রতি নির্যাতন করে যদি। বাবা আমায় সান্ত্বনা দিয়ে গ্রামে ফিরে গেল, মামী অভয় দিল, মায়ের মতোই কাছে টেনে নিল। দিন কয়েকপরে মামা আমায় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল।
এই ১০বছরে আমি অনেক এগিয়ে এসেছি। একা স্বাধীন জীবন যাপন করতে শিখেছি। শহরের অলিতে গলিতে বহুপথ হেটেছি। কিন্তু আমি নিজের জন্ম স্থানে ফিরতে পারি নি এখনো। আর কিছুদিন পরেই আমায় কলকাতা ছেড়ে মুম্বাইয়ে যেতে হবে তাই মনে প্রানে চাইছি গ্রামের সেই পরিবেশ এ মন খুলে ঘুরে বেড়াতে, আমি চাইছি বাল্যবন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু আমি জানি আমার স্বপ্ন ঠিক পুরন হবে না৷
হঠাৎ আজ মামী একখানা চিঠি এনে আমার হাতে দিল। মায়ের চিঠি অবশ্য লেখাটা বাবার। মা তার দৈনন্দিন জীবনের সব কথায় ব্যক্ত করত। কিন্তু আজ অন্য কথা লিখেছে আমার ছেলে বেলার বন্ধু সরলার বিয়ে। সেই সরলা মা কে অনুরোধ করেছে আমায় যেন চিঠি লিখে ডেকে নেয়৷ চিঠির সাথে আর একটা চিঠি পেলাম সেটা সরলার। চিঠি দুটো পড়ে স্থির করলাম আমি গ্রামে ফিরব,, সরলা অনেক কিছুই লিখেছে,গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও, সেই আমিই একজন ডাক্তার হয়ে কি ভাবে নিজের গ্রামকে অন্ধকারে রাখব এই প্রশ্নই আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে বলছে৷
আজ ১০ বছর পর গ্রামে ফিরছি তবে ছদ্মবেশ এ নয় আমার চেনা রুপ নিয়েই। সেই গ্রামের স্বাস্থ্যদপ্তরের ডাক্তার হয়ে। স্বাস্থ্যদপ্তরে মহিলা ডাক্তার না থাকায় মেয়েরা বাড়িতেই সন্তান প্রসব করত এতে অনেক সময় সন্তান প্রসবের পর নাড়ি ছেদের ভুলে মায়ের কিংবা সন্তানের মৃত্যু হয়,নতুবা রক্তপাতের কারনেও মৃত্যু হয়। যাই হোক গ্রামে প্রবেশ করে মুগ্ধ নেত্রে সব চেয়ে দেখছি, আমাদের সেই বটতলা যেখানে খেলাধুলা করতাম, সেই খোলা মাঠা, সেই লুকিয়ে আমের বাগানে আম চুরি সবই মনে পড়ছে। কিছুটা যেতেই গ্রামের মাতব্বর জগদীশ ভট্টাচার্য এর সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন? স্বাস্থ্য সংস্থার নাম বলাতে পথ দেখিয়ে দিল আর আশ্চর্য হয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে চলে গেল। আমিও আরও অবাক হলাম যে আমায় চিনতে পারল না।
যাই হোক স্বাস্থ্য সংস্থার কেন্দ্র থেকে ফিরেই বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম মা বাবা ভাই এর সাথে আমার বন্ধু সরলা ও তার মাও অপেক্ষা করছে৷ বাড়িতে সবাইকে প্রনাম করে একটু গল্প করে খেতে বসেছি যেই সেই সময় বাড়ির বাইরে কে বা কারা যেন বাবার নাম ধরে ডাকছে। বাবা খাবার ফেলে রেখেই উঠে গেল, মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল আমাকে লুকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু আমি মা কে বারণ করলাম এসবের দরকার নেই।
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমিও দেখলাম জগদীশবাবু ছাড়াও আরও অনেকেই আছেন যারা আমাকে গ্রাম ছাড়া করাবার জন্য এসেছে। কিন্তু আমি তো ফিরে যাবার জন্য আসি নি। এ গ্রাম আমার, এই আমার জন্মস্থান কেন আমি ফিরে যাব? তাদের কথার যথেষ্ট প্রতিবাদ করলাম এবং তারা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে গেল। আমার মা আমায় আবার ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করল৷ কিন্তু আমি তো ফিরে যাওয়ার জন্য আসি নি।
পরের দিন বাবার সাথেই স্বাস্থ্য দপ্তরে গেলাম। আমার কাজ বুঝে নেওয়ার পরও বাবা সেখানে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হয় নি ফিরে যেতে বললাম। হ্যাঁ খুব মনে আছে সেদিন আমার হাতে একটা কেস এসেছিল, তাতে আমি যথাযথ সফল ছিলাম। একজন মহিলা ডাক্তার পেয়ে গ্রামের অনেক মহিলায় নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু আমার প্রতি যাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ তার খুশি হতে পারে নি।
একের পর এক কেস আসতে থাকে, আমিও আমার কাজ করতে থাকি । সরলার বিয়েও হয়ে গেছে কদিন আগেই৷ সেদিন তেমন কাজও ছিল না৷ বসে আছি বাইরের বারান্দায় হঠাৎ দেখি জগদীশবাবু এগিয়ে আসছে দলবল নিয়ে। আমায় শাসিয়ে যাচ্ছে গ্রাম ত্যাগ করতে, আমাকে সেদিন কিছুই বলতে হয়নি যা বলার সেদিন গ্রামবাসীরাই বলেছিল। প্রত্যেকেই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিবাদ করেছিল৷ জগদীশ বাবু ফিরে যায়।
ঘন্টাখানেক পরেই জগদীশবাবুর বাড়ির একটা ছোট ছেলে এসে জানাল তার দিদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে, তার মেয়ের ডেলিভারি কেস আছে শুধু জগদীশবাবুর ভয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আনতে পারছে না। আমি যাব কি যাব না এটা যখন ভাবছি তখন আমার পাশে যারা ছিল তারা জানাল যদি বিপদ হয় তবে কি করবে? তারাও সাথে যাবে। কিন্তু তাদের নিরস্ত করে একজন নার্স কে সাথে করে ঘরে এগিয়ে গেলাম।
জগদীশবাবুর বাড়ির গেট এ পৌচ্ছেই বাঁধা পড়ল দারোয়ানের। কিন্তু সে বাঁধাও টিকল না উপর থেকে জগদীশবাবুর স্ত্রী তা দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে পথ ছেড়ে দিতে বলল।
গেট পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলাম জগদীশবাবুর রক্তাক্ত চোখ, আমার এই বাড়িতে উপস্থিতি তার সহ্য হচ্ছে না,, একবার আমায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করল। কিন্তু সে অনুরোধও টিকল না। ওনার স্ত্রী প্রতিবাদ করল, তাকে পূর্ব ঘটনা ( ছেলের বউ এর মৃত্যু) মনে করিয়ে দিল,, তখন একমাত্র মেয়েকে হারানর বেদনায় আর কিছু বলল না৷
৩০ মিনিট এর চেষ্টায় আমি সে অপারেশনেও সফল হই। সফল হওয়ার পর যখন নীচে নেমে এলাম জগদীশবাবুর স্ত্রী আমার কাছে তার স্বামীর ব্যবহার এর জন্য ক্ষমা চাইল ও অনেক আশির্বাদ করল। আশির্বাদ নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি তখন দেখি গেট এর সম্মুখে জগদীশবাবু দাঁড়িয়ে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম তার সে রক্তচক্ষু নেই, সেই রাগ আর নেই, যেন মাটির একটা মানুষ । তার পুর্বভুলের জন্য ক্ষমা চান আমার কাছে। ততক্ষণে গ্রামের অন্যান্যরাও এগিয়ে এসেছি জগদীশ বাবুর বাড়ির দিকে বাবাও এলেন। জগদীশবাবুর এ হেন আচরনে আমি ক্ষমা না করে পারলাম না। এবং তার মেয়ের জীবন বাচানোর জন্য বকশিস দিতে চাইলে আমি নিজের জন্য না চেয়ে গ্রামের জন্য একটা স্কুল চাইলাম। খুশি মনে তা মেনেও নিল।
আজ আমি বহুদিন পর মুক্তি পেয়েছি। হেরে না গিয়ে জিতে গেছি। খোলা মাঠে খুশি মনে ঘুরছি ফিরছি। আর গ্রামের জন্য কাজ করছি।