নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

পিনাকি






কুকুর ও  মানুষের গল্প  

        


                                   ১

কেবিন থেকে বেরিয়ে , নার্সিং  হোমের  বারান্দায় দাঁড়িয়ে  দুচোখ  ভিজে  গেল  অব্যয়ার   রেলিং –এ হাত রেখে  সে   নিজেকে  শান্ত  করবার  চেষ্টা  করছে  ।  এই  মুহূর্তে  ভিতরে  ভয়ংকর  ঝড়  বইছে , সব  কিছু  উল্টো –পাল্টা  করে  দেবে  ! নিজেকে থামাতে  হবে  ।  সে  জানে  এই  সময়টুকু  নিজের  সাথে  লড়তে পাচ্ছে  না , গোটা রাত  তার জন্য  অপেক্ষা  করছে ।   শীততাপ  নিয়ন্ত্রিত  কেবিনের  ভিতর ,   নার্সিংহোমের  বিছানায়  যে   লোকটি  শুয়ে  রয়েছে ,  তার  সারা  শরীর  ব্যান্ডেজ , চ্যানেল  , নলে  বিদ্ধ । হুঁশ  এখনো  ফেরেনি  । সে   জানতেও পারবেনা  অব্যয়ার  যন্ত্রণার  গভীরতা ।   
দু’ চোখ  বেয়ে  নেমে  আসছে  জলের  ধারা । আঙুল  দিয়ে  মুছল ।   নিজেকে  শক্ত  করতেই  হবে  । সে  নিজের  মনে  নিজে  বলল -  এতো  ভেঙে পরলে  চলবে  না । প্রতিদিন  কত মানুষের জীবনে  দুর্ঘটনা  ঘটছে । তাদের  অনেকেই  আর সুস্থ জীবনে  ফিরতে পারেনা ; সংসারের  শেষ আর্থিক  সম্বলটুকু  চলে যায় !
অব্যয়াই  নিজেকে  সামলে  নিচ্ছে  । এখন ওর অনেক  কাজ  ।  ভিতরে কেবিনে  ভাঙাচোরা  দেহ  নিয়ে  ,  খাদ্যবহনকারী নলে  বিদ্ধ --  যে  মানুষটা ,  জীবন –মৃত্যু নিয়ে  লড়ছে ;  সেই মানুষটা জানতেও পারছে না --  তার   কেবিনের  বাইরেও  যুদ্ধের  আঁচ এসেছে ! দু’জন  মানুষ  এখন  পরিস্থিতিগত  ভাবে  আলাদা  অথচ  তাদের  ভিতরকার লড়াই  একই  কেন্দ্রে , আবার  এই  লড়াইয়ের  শেষে  জীবনের  গতিবিধিও একই  ভাবে  ঘুরবে । 
পিছনে  বছর  চল্লিশের  একজন  লোক  এসে  দাঁড়ালো ।  বলল – মিসেস  শুক্লা , ফিরবেন  তো ?
অব্যয়া  মাথা  তুলে  দেখল , নিবেদিতার  স্বামী ! এখন  আর অলকেশ বাবুকে  দেখলে  বিরক্তি  লাগেনা , এই  নার্সিংহোমেই  নিবেদিতা  ভর্তি রয়েছে ।  হয়ত  কাছাকাছি কেবিন  আছে  । অলকেশ  দেখতে  পেয়েছে  , তাই  কথা  বলতে এসেছে ।  এখন  মনের অবস্থা  এতটাই  এলোমেলো ,  কথা  বলতে  মন চাইছে  না । তাও  নিজেকে  জোর  করেই কিছুটা  একঘেয়ে  পরিবেশ থেকে  পালানোর তাগিদ  নিয়েই  , অব্যয়া  বলল – অলকেশ  , নিবেদিতা  কেমন  আছে  ?
নিবেদিতাকে  নিয়ে  বিন্দুমাত্র  ঘাঁটাঘাঁটি  করবার  ইচ্ছা   তার  নেই  ।  এই  বিষয়টা  নিয়ে  আর ভাবতেও    মন চাইছে  না । অব্যয়া  বলল – ওকে  নিয়ে  বিজি    রয়েছি , একদিনও  দেখা  করতে পারিনি  ।  খুব  লজ্জিত  । 
-লজ্জার  কিছু  নেই  । এতবড়  একটা  অ্যাক্সিডেন্টের  সব  ঝামেলা আপনাকেই  সামলাতে  হচ্ছে । এখানে  আপনাকে  সাহায্য  করবার মতন তেমন কেউ   নেই  ।  অফিস আর বাড়ি  সবটাই  আপনি সামলাচ্ছেন । আমি বুঝি  , মিসেস  শুক্লা ।  ও  দুঃখিত অভ্যাসবশত  আপনাকে  শুক্লা  সারনেমে  ডাকছি ।
-ভুল  কোথায় ?  বিয়ের পরে  মেয়েরা    শ্বশুর  বাড়ির  পদবী  ব্যবহার করে ।
-সে  ঠিকাছে ।  কিন্তু আমি জানি  , আপনি   বিবেক বাবুকে  ডিভোর্স  দেবেন ।

 কিছুক্ষণ চুপ থাকল ।  অব্যয়ার   হাতে  যে  রুমাল আছে  ,  কপালের  ঘাম  মুছল ।  বলল – দেখুন  অলকেশ  আপনি  আমার থেকে  এই  ব্যাপারে  এতো  শিওর  কেমন  ভাবে  জানিনা  ! দেখুন  কিছু  মনে  করবেন  না , এই নার্সিংহোমে  আমিই  বিবেকের  স্ত্রী ।  ভর্তির  সময়ে  যে  ফর্ম  ফিলাপ  করেছি , স্ত্রী  হিসেবে  আমার  নামই উল্লেখ  করা  আছে  । এখন  ডিভোর্স  নিয়ে  ভাবছি না । ওকে  সুস্থ  করে  তুলতে  হবে । যত  দ্রুত  সম্ভব । তারপর  না  হয়  ভাবা  যাবে ...
-আপনি  ভুল  বুঝলেন ।  দেখুন আপনাদের  ডিভোর্স  পেপারে  কিন্তু  বিবেক  বাবুর  সই আছে  । আর  ঘটনার  দিন  বিবেক শুক্লা  এই  নিয়ে  খুব  উল্লাসিত ছিলেন  ।
অব্যয়ার  গলা  শুকিয়ে  আসছে ।  খুব  কাঁদতে  চাইছে  ।  বুকের  ভিতর কষ্টের  গোলা আটকে  আছে  , দমবন্ধ  হয়ে  আসছে । বিবেক  তাকে  যে  অপমান  করেছে  তার  থেকেও , পুরুষের  কাছে  সকল  ভারতীয়  নারীর  ব্যবহার  এমনই !   সংবাদপত্রে  এত  খবর ছাপা  হয় , এত নারীর প্রতি  বঞ্চনার  কথা  বলা  হচ্ছে ---  সব  কিছু  সত্যি  বলে মন  মানতে  চায়না । অথচ  নিজের  জীবন  থেকে  বুঝতে  পারছে  ,  ভারতীয়  সংস্কৃতি  নারীকে  দেবী রূপে  পুজো  করলেও ,  মানুষ ভেবে  সম্মান  দেয়না  ! সে  এতটাই  অবজ্ঞার  পাত্র  ? নাকি  সিংহভাগ পুরুষই  ডিভোর্সের  সই  করে  তার   সঙ্গিনীকে  বলতে  ভুলে  যায় ,  বদলে  মদ্যপানের  আসরে  বুঁদ  হয়ে  থাকে  ।  সে  ঝগড়া  চায়নি । খোরপোষ  দাবি করেনি ।  বিবেকের  কাছ  থেকে  একফোঁটা  সম্মান  চেয়েছিল ।
এই  ছোট্ট  শব্দটা সামান্য , উচ্চারণ করতে  খুব  অল্প সময়  নষ্ট হয় ;  অথচ অনেকের  পুরো জীবনটাই  নষ্ট হয়ে  যায়  সামান্য  শব্দটার  বাস্তব   অনুভূতির জন্য  ।  অব্যয়া    তেমনই  কাঙাল । বিবেক  তাকে  কম কষ্ট  দেয়নি , তাই  নতুন করে  এমন ব্যবহার  খুব একটা   যন্ত্রণা দিচ্ছে  না ।  অলকেশের  মুখের ভাবে  নিজেকে  অপমানিত মনে হচ্ছে । চোখ  ফেটে যাবে দুঃখে ,  একফোঁটা জল  গড়াবে না ; কেননা  সে  জানে  তার  চোখের জল    অসহায়  নারীর  দুর্বলতাই  প্রমাণ  করবে । এই কয়েকদিনে , সে  বুঝে  গিয়েছে  বিবেকের  সাথে  রাগারাগি  করে  নতুন চাকরিতে  নিয়ে  সে  সেই সব  মানুষদের কাছে  চ্যালেঞ্জ  ছুঁড়ে  দিয়েছে  , যারা  নারীদের  এই   সময়েও   আর্থিক ভাবে  দুর্বল  দেখতে  চায় ।  অলকেশ  যেমনই  হোক , সেই  দলের  সার্থক প্রতিনিধি --- এটা  বুঝতে  অসুবিধা  হয়নি । 
মুখ  তুলে  অব্যয়া বলল -  আপনি  এখন  ফিরছেন ?
ঘাড়  নামিয়ে   অলকেশ  বাঁ –হাতে  ঝুলে  থাকা  ঘড়িতে  দেখল , বিকেল  ছটা । 
-হ্যাঁ , রাতে  আর আসবনা  আয়া আছে  ।  ডাক্তাররা  বলল , এখন  অবস্থা  ঠিকাছে । আগের  থেকে  অনেকটাই  ভালো ।  তাই  ভাবছিলাম   সাতদিন  ভালোই  টেনশনে কাটল  । 
অব্যয়া ভাবল , আজকে অলকেশের   সাথে  কথা  বলে  বিবেকের  আগামী  দিনের  পরিকল্পনার  জানবে । বিবেক   নিজের  মুখে  কিছু  বলেনি । তারা  ঠিক করেছে   আলাদাই  থাকবে  ।  বিবাহ বিচ্ছেদ ফাইল  করে । দীর্ঘ   সময়  বাদে  , দু’পক্ষকেই কাগজ  পাঠানো হয় ।  বিবেক  আগেই  সই করেছে । অব্যয়া স্বাক্ষর করেনি ।   এখন উল্টোটা  ভাবছে  ।  বিবেকের  দুর্ঘটনা যখন  ঘটল , তার  অবস্থা  দেখে  সে  সই করবার কথা  ভুলে  যায় । এখন সব  কিছু তাকেই  করতে হবে  ।  বিবেকের দুই ভাই এই  ঝামেলা  নেবে না  বলেছে ।  বৃদ্ধ মা   অপারগ । তাই স্ত্রী  হয়ে আইনি ভাবেই   সমস্ত দায়িত্ব  তুলে  নিয়েছে ।
এইসব  কথা  ভাবতেই  চখ চোখ জলে  ভরেছে ।  খেয়াল  করল ,  অলকেশ  বলল – চলুন , ক্যান্টিনে  গিয়ে  কফি  নিতে  -নিতে  কথা  বলা যাবে । এমনিতে  বাড়িতে  ফিরতে  ভালো লাগছে  না ।  নিবেদিতার  ফাঁকা   ঘরটা  দেখলেই , বুক  টনটন করে ওঠে ।


সন্ধ্যা  ছটায় ওরা , নার্সিং  হোম  থেকে  বেরিয়ে  উল্টো  দিকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত  ক্যাফেতে  ঢুকল ।  মুখোমুখি  বসে  রয়েছে ।  অলকেশ  কফি  আর হাল্কা স্নাক্সের  অর্ডার  দিল ।
শুরু  প্রথমে  অলকেশ  করল । - আপনার  প্ল্যান  কী ? 
অব্যয়া  বলল  -  জীবনটা  বড্ড  ভঙ্গুর । প্রতি  সময়ে  যে  কোন  স্বপ্ন  ভেঙে যেতে পারে  ।  এখন আর  পরিকল্পনা করিনা ।  জীবনকে  নিজের  মতনই  দেখতে  শিখছি ।  ভালোই লাগছে  ।  আগে  থেকে  প্ল্যান  করে  লাভ আছে  বলে  মনে  হয়না ।জীবনে যা  হবে  --- তা হবেই । তাকে  হতে  দেওয়া বা না- দেওয়া , আমাদের হাতে  নেই। তবে  সেই  হওয়াটা  হয়ে  যাওয়ার পর  , নিজেকে মানিয়ে  নিয়ে  এগিয়ে  চলাটাই জীবনের সংগ্রাম ।  লড়াই ।
-আপনি দেখছি  , জীবন নিয়ে  অনেক অভিজ্ঞ ।
-আগে ছিলাম না  । এখন  হয়েছি ।  অভিজ্ঞতা কম হলনা । পঁয়ত্রিশ  বছর  বয়স । 
-আপনি  চাকরি  করছেন ,  আপনার  চারপাশের  অনেকেই  মেনে  নিতে  পারেনি  ।  বিবেক বাবু  নিজেও  চাইতেন না।
-বিবেকের  চাওয়াটা  আমার কাছে  ইদানীং কোন  গুরুত্ব হারিয়েছে ।  সত্যি  বলতে  আজ  আমি শুধু মাত্র  নিজেকেই   গুরুত্ব  দিচ্ছি ।  আর  দিয়ে যাব ।  অন্যের বোঝা হতে  চাইনা । আর এর  জন্যই  নিজের  শিক্ষাগত  যোগ্যতা কে  ব্যবহার করছি ।  আমি  চাইনি আর্থিক  দিক  দিয়ে  বিবেকের  উপর  নির্ভর করতে । 
-আমি  জানি  । এতটুকু বুঝি  , আপনি  নিজের আত্মসম্মান  বিসর্জন দেবেন না । আর আপনি  বিবেকের    বিশ্বাস ভাঙবেন না ।
-আমি  এতকিছু  বুঝিনা  । জীবনে এখন  যেই সিদ্ধান্তে  আমি  এসেছি , সেখান  থেকে  ফিরে  যাব না । কিছুর  বিনিময়েও নয় ।


অলকেশ  কফিতে  চুমুক  দিয়ে  বলল – বিবেক  আর  নিবেদিতা একসাথে  থাকবে  ।  যদিও  আপাতত  তাদের  সুস্থতার  উপর  নির্ভর করছে । আমি  নিবেদিতাকে  ছেড়ে  দেব  ।  আমাদের  ডিভোর্স  শুধুই  আমার   সম্মতির  জন্য আটকে  ছিল  । আমি  সই করে  দিয়েছি ।  
অব্যয়া  তাকিয়ে  রয়েছে ।  অলকেশ একদিন  সকালে  নিজে  এসে  ,   বিবেককে  শাসিয়ে  গিয়েছিল ।  বউয়ের সাথে  অন্য  পুরুষের  সম্পর্ক  মেনে  নেবে না ।  বিবেকের  কথা সেই দিন  অব্যয়া  সরল   ভাবে  বিশ্বাস    নিয়েছিল  ।  মেয়েরা  যাকে  ভালোবেসে  ফেলে  , তাকে  সম্পূর্ণ  বিশ্বাস করে । ভারতীয়  মহিলাদের  এই  চারিত্রিক  দুর্বলতা  (বিশ্বাস  করাটা  যদি   নিজের   ক্ষতি  করে )তাদের  পুরুষেরা  ভালোভাবে  অপব্যবহার করে । বিবেকের  মতন  পুরুষরা  তাই  নির্ভাবনায়   নিজের  প্রেম  চালিয়ে  গিয়েছে ।   একজন   মানুষ  জীবনে  একাধিক  মানুষকে  ভালবাসতেই  পারে  ,এই   ভালোবাসাকে  পরকীয়া    বলা  যায় না  ;  তা  যখন মিথ্যার  আশ্রয় নিতে  থাকে --  তখনই পরকীয়া  হয়ে ওঠে ।  বিবেক  আর  নিবেদিতার  সম্পর্ক  ক্রমশই  তেমনই  দিকে  এগিয়েছে ।  তখনো  অলকেশ  সব  কিছু  জেনেও   নিজের  স্ত্রীর  প্রতি  শক্ত  হতে  পারেনি । আর  অব্যয়ি  ভেবেছে  এইবার তার সব  কিছু  না  মেনে  প্রতিবাদ  করবার কথা  ।  বিবেক অন্য  নারীর প্রতি  নিজের  সবটুকু   ঢেলে  দিয়েছে ,  তার  ভাগে  কিছুই  নেই  ।  অনেক  রাতে  বাড়ি  ফেরা  ,  দীর্ঘ  সময়  ধরে  বিবেকের  অবহেলা  --- সবকিছু  মেনে  নিয়েও  বাড়িতে  থেকেছে  অব্যয়ি ! কেন ? সবটাই চারপাশের  লোকনিন্দার  জন্য ? ভারতে  বিবাহিত  মহিলাদের  স্বামীর  ঘরে অত্যাচারিত  হওয়া তেমন একটা আলোড়িত  ঘটনা নয় , যতটা   বিবাহ বিচ্ছেদ  নেওয়া  । লাথি  খাও  ,  বিষ  খাও  ,  খিস্তি  খাও  --- তাও   স্বামীর  ঘরে  খাও ।  স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা  মানেই  , সে   অন্য  পুরুষের  ভোগের  বস্তু ; তাকে  সমাজের  বাকী  পুরুষেরা নিজের  চাহিদায়   ব্যবহার  করবে  ।   তাই  হয়ত অব্যয়া বিবাহ বিচ্ছেদ   এড়িয়ে  থাকতে চেয়েছে  ।   
চোখ  ভিজে  গিয়েছে । চোখের  পলকে   অতীতের  স্মৃতি  ভীড়  করছে  --    বিবেকের  জ্বর ছিল , সারারাত সে নিজে   না  ঘুমিয়ে মাথায় ভেজা কাপড়  দিয়েছিল  । এইসব ন্যাকামো  বড্ড  সেকেলে , একদিন  ঝগড়ায়  বিবেকে  বলেও  ছিল। 
অব্যয়ির  গলা  ভারি হয়ে  আসছে । সে  ঢোক  গিলে  বলল
-আপনি , নিবেদিতাকে  এতটাই  ভালোবাসতেন  যে তাকে  মেনে  নিতে চেয়েছিলেন । আর  এখন  মেয়েটার এইরকম অবস্থায় , সই করে  দিলেন  ! তাড়াহুড়ো  করলেন মনে  হল ।
অলকেশের  চোখ  দুটো  শক্ত   হয়ে  এলো । - দেখুন , ভালো  আমি এখনো বাসি । কিন্তু  নিবেদিতার পেটে  আপনার  স্বামীর   বাচ্চা ছিল ।   মানে    যদিও    দূর্ঘটনায়   সে  ভ্রূণ   নষ্ট  হয়ে গিয়েছে  ।   খুবই  দুঃখের ।   আপনি  আপনার স্বামীকে মাপ করে  দিলেও , আমি  নিবেদিতার সাথে  থাকতে  পারব না । সেইদিন   ওরা  একসাথেই  গাড়ি করে   আসছিল , দুজনেই  মদ্যপ  ছিল । দুর্ঘটনা  ঘটবার  পিছনে  সেটাও একটা কারণ । আর নিবেদিতা কনসিভ  করেছে – জেনেই  ওরা   হোটেলে  গিয়ে সেলিব্রেট করেছিল । খুব কাছের দু’একজন  ছিল । আমি তাদের একজনের   থেকেই জেনেছি । এইসব কিছু  জেনে , আমি নিবেদিতার  স্বামী হওয়ার  অভিনয় করব না । আর আমি চাইছি , কোর্ট  যেনও  অসুস্থতার ছুতোয়  ডিভোর্স  দিতে  দেরী  না  করে ।
অব্যয়া  খেয়াল  করছে , চোখের  কোণায় পাতলা  জলের রেখা নামছে   ; খুব সরু  আর আপাতাত  নিরীহ । এই  রেখা  আঙুলের  তলা  দিয়ে  মুছে  দিল ।  এমনটা  করল , কেননা  পাছে  অলকেশ  তাকে  দুর্বল  ভেবে  বসে ! 
গলা  শক্ত করে  বলল  - অলকেশ  আপনাকে  কে  বলল , আমি  বিবেককে  মাপ  করে  দেব ?  দেখুন  আমি  ডিভোর্স  দেব । আর  খুব তাড়াতাড়িই  তা  জানতে  পারবেন  ।
ঘড়িতে  সন্ধ্যা  সাতটা ।  ঘড়ির  দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়ি  বলল – আজ  উঠি ।
অলকেশ  বলল – ম্যাডাম    আপনার সিদ্ধান্ত  আপনার ।  তবে  আপনি  যদি  ডিভোর্স  দিয়েদেন  তাহলে  এখনই আমার  নিবেদিতার  হাত  থেকে  রেহাই  পেতে   সুবিধা  হয় । যদিও ওদিকে কেউ  কিছু   এখনো  বলেনি । তাও  যদি  নিবেদিতা  কর্মক্ষমতা  হারিয়ে  বিছানায়  শুয়ে  থাকে  । যদি  বিবেক  সুস্থ  হয়ে ওকে  ভুলে  যায় বা  বিবেকের  অবস্থাও  একই রকম থাকে  , হয়ত নিবেদিতার  বোঝা  আমাকেই টানতে হবে  । স্যরি , আমি   ঠিক তেমন  ভাবে  বলতে  চাইনি ।  মানে  বুঝতেই পারছেন , আমার  কিছু চাহিদা...

ঘাড়  ঘুরিয়ে   অব্যয়া  বলল – থাকুক  না , আমি  বুঝেই  গিয়েছি  । এতদিন  আপনি  নিবেদিতাকে  সহ্য করতেন কারণ ওর  মোটা  মাইনের   বেতনের  জন্য  । এখন  সে সব  নেই  যখন  বোঝা বইবেন কেন  ? আমার এইসব  ব্যাপারে  আলোচনা করতে  ভালো  লাগছে  না ।  তবে এতটুকু  বলব , আপনার  নিবেদিতার  উপর  যে  রাগ  রয়েছে আমার  বিবেকের  প্রতি  ঘৃণা  তার  থেকেও  বেশি । আমি   নিজের  সবটুকু  দিয়ে  ওকে  ভালবেসেছিলাম । আর বিবেকে  আমাকে  ঠকিয়েছে ! তাও আমি ওর  সাথে   জড়িয়ে আছি  , শুধুই  মানবিক কারণে । তবে  এটাও  হয়ত আর  বেশি  দিন  নয় । আসছি ...





                                   ২




নার্সিংহোম থেকে  বেরিয়ে , ক্যাব ভাড়া করে নিল । গাড়িটা  এলগ্রিন  রোডের  দিকে  এগিয়ে  চলেছে ।  অব্যয়া   ঘামছে ।  বিবেক  তাকে  ঠকিয়েছে , সে  এই  কষ্ট মেনে  নিলেও  নিজেকে  অসহায়  আর  প্রতারিত  ভাবতে  রাজি নয় । এটা  তার  নিজের  জীবন , এখানে  সে অন্য কোন মানুষের দ্বারা  চালিত  হবে  না । কোন  ভাবেই  নয় ।
নিজেকে  তাও কেন  ঠকাচ্ছে ?  এই  যে  প্রতিদিন  বিবেকের  মিথ্যা  পরিচয় নিয়ে  নার্সিং হোমে যাওয়া ,  সব  দায়িত্ব  নেওয়া  আবার  দিনের শেষে   বাড়ি  ফিরে  আসা  সেই  লোকটির প্রতি  প্রবল  ঘৃণা  নিয়ে  ! এমন  ভাবে  সে  নিজেই  ঠকছে ।  শেষ  একমাস  অনেক  কিছুই  ভেবেছে  , অলকেশের  মুখে  যখন  সব  কিছু জানতে পারল ,  নিজেকে  এক  মুহূর্তের জন্যও  বিবেকের  সাথে  দেখতে  রাজি  নয় ।
গাড়িটা  এসে  থামল । 


অব্যয়া  গাড়ি  থেকে  নেমে   টাকা   মিটিয়ে নিজের  ফ্ল্যাটের  দিকে  চলেছে । আজ  সে  বিবেকের  ফ্ল্যাটে  যায়নি । এই  এক কামড়ার  ফ্ল্যাটটা  নতুন  নিয়েছে ।  ব্যাঙ্কের  লোণ   নিয়ে  কিনেছে । এই একমাস  সে  এখান থেকেই  যাতায়াত করছে নার্সিং হোমে । অফিস যাচ্ছে ।   

কলিং  বেল টিপতেই   অম্বিকা  দেবী  দরজা খুললেন । তাঁকে  দেখে  অব্যয়ি  বলল -  মা , তুমি  ফোন করেছিলে ? আমি কথা  বলছিলাম  বলে ধরতে  পারিনি ।  অবশ্য  পরে  ফোন করতাম ।  ভাবলাম  বাড়িতে  এসেই  না  হয় বলব ।
-তুই হাতমুখ  ধুয়ে আয়  । আমি  ভিতরের  ঘরে    আছি ।  আজ বিনয়ের  বড়দিদি  ফোন করেছিল । ওর মায়ের সাথেও  কথা  হল । 
অব্যয়ার  শরীর জুড়ে ক্লান্তি । তারউপর  এইসব  কথা এখন  শুনতে  চাইছিল  না । সে  ইচ্ছা  করেই বলল –এখন নয়  ,অফিসের কাজ  আছে  । 


রাতে খাওয়ার  পর  নিজের  ঘরে  শুয়ে  আছে   । একপাশে  টেবিলল্যাম্প জ্বলছে , হাল্কা  আলো অব্যয়ির  মুখে  ম্যশ্চারাইজার  ক্রীমের  মতন  মেখেছে  ।  সেই দিকে  তাকিয়ে  অব্যয়া একটা  দৃশ্য  ভাবছিল ।    

বছর তিরিশের  এক  রমণী কাঁদছে । এখন  গভীর রাত  ।  পাতা  ঝরবার  শব্দ  শোনা যায় । চারপাশের আলো নিভে গিয়েছে ।   যে  রমণী কাঁদছে সে  কে ? অব্যয়া  এইসব  কিছু  খুব কাছ  থেকে  দেখছে ।  এই  রমণীর মুখ খুব চেনা । সে ঘোরের  মধ্যে  থাকে   ।  এটা  একটা  স্বপ্ন ,  অব্যয়া এই  সবপ্নে স্বপ্নে আগেও  থেকেছে ।  তা  অসম্পূর্ণ  ছিল ।  মেয়েটা  তার  বয়সী । মুখ  তুলে  বলল -  আমি  হেরে  গিয়েছি  । তুমি  কিন্তু হারবে না ।
অব্যয়া  বলল – মানে ? কি হারবার  কথা  বলছ ? আমি যে  হারতে  পারি , তা কেন  বললে ?
মেয়েটির  দুচোখ জলে  ভিজে  গিয়েছে ।  অব্যয়া  বুঝতে  পেরেছে  , সব  মেয়েরই   মুখ  কষ্ট পেলে  এমন হয়ে  যায় ।  মেয়েটি  কাঁদছে  কেন  ? এই কান্নার  অন্তরালে কোন  রহস্য  লুকিয়েছে  ! সে  এই স্বপ্নকে  কখনই  সম্পূর্ণ  দেখেনি । আজ দেখবে ?
মেয়েটি বলল – ওরা  আমায়  বলেছিল , আমি  অন্যায়ের  প্রতিকার চাইব না । এই সমাজে  পুরুষকে   শাস্তি দেওয়ার  অধিকার  শুধুই  পুরুষের । আমি নারী  , শুধু  প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি  ।
অব্যয়া   কিছুই  বুঝতে  পারল  না   ! এই মেয়ে যে ভাষায়  কথা  বলছে তা  বুঝতে  অসুবিধা  হচ্ছে  না, এই  পরিবেশ  তার  চেনা  নয় । 
-তুমি অত্যাচারিত ?
-আমি  নই  আমরাই  বঞ্চিত । আমাকে কেউ সুবিচার  দিতে  পারেনি । সকলেই  ফিরিয়ে  দিয়েছে  । কথা  দিয়েছে , অন্যায়ের  বিরুদ্ধে  আত্মত্যাগ  করলেই  দেবী  হয়ে যাব !
-দেবী !!
-সকলেই  দেবীর  প্রতিশ্রুতি  দিয়েছে  মানুষের নয় । আমি মানুষের সম্মান  পেতে চেয়েছি । তাই চোখে  ঘুম  নেই । সারা  দেহ  যন্ত্রণায়  ফেটে  যাচ্ছে ।
আচমকাই  ঘুম  ভেঙে  যেতে  অব্যয়া  উঠে  বসল । তার  বুক  ,  বোগল   ঘামে  ভিজে  গিয়েছে । এতক্ষণ  একটা  স্বপ্নই  দেখছিল । সে  ভাবছিল  এই   স্বপ্নের  মেয়েটিকে খুব  চেনা  মুখ  মনে  হচ্ছিল !





                                        ৩



এখন  রাত দুটো । আর তিনঘণ্টা । তারপরেই  ভোরের আলো  ফুটবে ।  পাখির  কোলাহল  শুরু  হবে  । একা , ক্লান্ত , নির্জন  রাস্তার বুকে  মানুষের পায়ের  শব্দ  শোনা  যাবে । বারান্দায়  দাঁড়িয়ে  থাকতেই অব্যয়ার  মন  চাইছে ।  সামনে  একা –একা   দাঁড়িয়ে  থাকা  লাইটপোস্টের   ম্রিয়মাণ  আলোর  দিকে  তাকিয়ে  খুব কাঁদতে ইচ্ছা  হচ্ছে । মায়ের সাথে  ঘুমাবার  আগে  কথা কাটাকাটি  হয়েছে ।  বিবেকের বাড়ির লোক  চাইছে  , বাকী জীবনটা  অব্যয়া  বিবেকের দায়িত্ব নিক।   কেননা বাকী জীবন বিবেকে  হয়ত সুস্থ  হয়ে উঠতে পারবে  না । অবশ্য  মিরাকেল ঘটতেই পারে। আর এটা  ঘটাবার   সাধ্য আছে  একমাত্র অব্যয়ার ---- অন্তত  বিবেকের বাড়ির  দিকের  লোকের  তাই  ধারণা । বিবেকের সম্পত্তির  মালিক  হবে  অব্যয়া । 
সে  অবশ্য  নিজে  এটা  চাইছে  না ।  বিবেককে আপাতত  সুস্থ  করবে । সাথে  নিজের  চাকরিও  চালিয়ে  যাবে ।  অব্যয়ার মা  , অম্বিকা  দেবী নিজেই  চাইছেন মেয়ে  এই  সম্পর্ক  মেনে  নেয় । এতে  মান থাকবে  কূলও         থাকবে  ।ভারতীয়  বিবাহিত  মহিলা  স্বামী পরিত্যক্তা হলে , সমাজ  অন্য   চোখে দেখে ।   মেয়েদের  স্বাধীনতা থেকে  তাদের  পরাধীন  সম্ভ্রম অনেক  বেশি  দামী  ।নির্ভরশীল  আশ্রয়  অনেক  বেশি  কাঙ্খিত  । 
অব্যয়া ভাবছিল ,  স্বপ্নে ভাসা –ভাসা  মেয়েটির  করুণ মুখ আর  অব্যয়ার  অসহায়তা  মিলে  যাচ্ছে ! এই মেয়েটির  সাথে  তার  কোন  সম্পর্ক  রয়েছে ?  এই স্বপ্নের  ভিতরের  গল্পটার তার  খুব   জানা । হ্যাঁ , ছোটবেলায়  মায়ের  মুখে  শোনা  । অব্যয়া    ভাবছে ...

রাতের পানপাত্র   থেকে  গভীর  নিস্তব্ধতা ক্রমশই  ছড়িয়ে  যাচ্ছে ।  একটি  মেয়ে  লেখার টেবিলে  মাথা ঝুঁকিয়ে  হলুদ আলোর  দিকে  তাকিয়ে  ভাবছে । সাদা কাগজ  নিয়ে  লিখতে  শুরু  করল   মায়ের  উদ্দেশ্যে ----   



এখন  চারপাশ  খুব শান্ত । তাই  তোমাকে  মনের কথা  খুলে  বলছি । তুমি ছোট   বেলায় আমাকে  একটা  গল্প  শুনিয়ে ছিল । পুরাণের  গল্প । এক  ব্রাহ্মণী কে   ঠকিয়েছে  তার  পুরুষ । সেই  পুরুষ   শেষে  রোগে  ভুগে  মারা যান ।  মৃত্যুর  পরেই    যমপুরীতে  ব্রাহ্মণের   বিচার  চলে ।  অভিশাপে  তাকে  শাস্তি পেতে  হয়েছিল ।  এদিকে ব্রাহ্মণী পত্নী   নিজের  উপর  ঘটে  চলা   অন্যায়ের  বিচার  চাইল না। সে  ভারতীয়  নারী ।  বিবাহিতা  । সে  কেমন  করে  স্বামীকে  ছাড়বে ! তার থেকে  নিজেই স্বামীর পাপ  মোচনের  জন্য  চেষ্টা করবে  । কাঁদছে ।  তারপর  নারদ  তাকে  যোগবলে  মৃত  স্বামীর   চিতায় এনে  হাজির  করে । ব্রাহ্মণ   পত্নী   সহমরণ  বেছে  নেয়  ।   এরপর  গল্প  এগিয়ে  চলে  । ব্রাহ্মণ   অভিশপ্ত  হয়ে কুকুরে  পরিণত হল ।   একসময়  সে  নিজের  পরিত্যাগ  করা পত্নীর   সতীত্বের   জোরেই     নিজের পাপ  মোচন করে  এবং  শিবের   খুব কাছের   ভক্ত  হয়ে  ওঠে  !  এখানেই   অব্যয়ার   প্রশ্ন  , সে  মেয়ে  এমন  আত্মত্যাগ   করল  তাঁর  স্থান   কোথায় ?  পত্নীর  প্রতি  যে  অবিচার  হয়েছে , শাস্তি  পত্নী  দেয়নি  , দেবতারাই  দিয়েছে । সমাজ  বা   পুরুষের   বিচার   পুরুষমুখী   সমাজ  করবে  কেন  ?   নারী নিজের  স্বামীকে    ত্যাগ  দিলনা  কেন  ?  সে  কি  স্বতন্ত্র  জীবন  বেছে  নিতে  ভয়  পেয়েছিল  ? নাকি  ভারতীয়  মূল্যবোধ চেয়েছে  নারীদের  চিরটাকাল   স্বামীমুখী  করে রাখতে  ! সেই রমণীই   স্বপ্নে  এসে    বলেছে  , আর  যেনও   অব্যয়ারা  পিছনে  না  হাঁটতে  থাকে  । সময়  এসছে  নতুন  রুপকথা রূপকথা লিখবার ।
অব্যয়া   মনে – মনে    বলল  ---   বিবেকের  সম্পত্তি  বা   সম্পর্ক --- কোনটির  প্রতিই  বিন্দু  মাত্র  মোহ  নেই ।  আমার  লোভ আমার  স্বতন্ত্র  পরিচয়ের  প্রতি  ।  এটাই  আমার  অস্তিত্ব । আমি হারব  না।   আমি জানি  তোমরা  আমাকে  মেনে  নিতে পারবে  না  , কেননা  তোমাদের ভারতীয়   মূল্যবোধে  যেখানে   নারী আসলে পুরুষমুখী – আমি মানতে পারব না  । কেননা  আমি আজকের  পরিবর্তিত  ভারতীয়  মূল্যবোধ ---   নারী  স্বতন্ত্র  ব্যাক্তি  । তার এই দিক তোমরা মানবে না ।  নারী   সত্ত্বা  আর   তোমাদের  একমাত্র  সন্তানের  দায়িত্ব  নিতে   গিয়ে  যে  টানাপোড়েন  , তাতে আমি  ক্লান্ত ।  আমার  মৃত্যুর জন্য   তোমরা  দায়ী নও । সে দায় , ভারতীয় পুরুষ কেন্দ্রীক  মূল্যবোধের ............ 

চিঠিটা  লিখবার  পর  , অব্যয়া  বাথরুমে গেল  । এখনো  মা  ঘুম  থেকে  জেগে  ওঠেনি ।   ভোর  হতে  দেরী  নেই  ।   আত্মহত্যা  করলে , পাশের থানা  থেকে  পুলিস  আসবে  তাড়াতাড়ি । পোস্ট মর্ডাম  ক্রতেও করতেও খুব বেশি  সময়  নেবেনা । সন্ধ্যার  মধ্যেই  সব  কিছু  শেষ ।
অব্যয়া   বাথরুম  থেকে  এসেই  , মায়ের  ঘরের  দিকে  গেল  । সত্তর  বছরের  মহিলাটি  ঘুমিয়ে  কাদা । মুখে  এক  অদ্ভুত  শান্তি ফুটে উঠেছে । মা  ধরেই  নিয়েছে , মেয়ে  শ্বশুর  বাড়ি  ফিরছে । আর স্বামী পরিত্যক্তা নয় । এই মেয়েই  যখন  মৃতদেহে  পরিণত হবে  ! অব্যয়া মুচকি  হাসল ...

এইবার  মরতে  হবে  । গলায়  ফাঁস  দিয়ে   ঝুলে  পড়বে । অফিসে  তার কাজের  খুব নাম হয়েছে । বিবেকের  বাকী  জীবনটা    বিছানায়  শুয়েই  কাটবে    , অব্যয়ার দয়ায়  বেঁচে থাকতে  কেমন লাগবে  ? যারা তাকে  সংসারে  বাতিল  নোট  ভেবেছিল --- তাদের  চোখে  আচমকাই  সে  লটারি । কেননা  স্বামীর  আশ্রয়ে নয় , স্ত্রী  নিজের আশ্রয়ে  স্বামীকে  বাঁচিয়ে  রেখেছে  । 
আচ্ছা  এখন  যদি  না আত্মহত্যা  করে , বেঁচে  থাকে  ! সে  দেবতা  হবে  নিশ্চিত । এই  কথাটুকু  ভাবতেই অব্যয়ার  খুব আনন্দ  হচ্ছে  ।  
অব্যয়া ভাবল এই এতকিছুর  বদলে  নিজের চাকরি  করবার  জেদ সে রাখতেই পারে । আর বাকীরা তা শুনতে  বাধ্য । অন্তত  এই কারণের জন্য  আত্মহত্যার  মতন  এত  ছোট একটা  সিদ্ধান্ত পাল্টানোই  যায় ।
  খুব  দ্রুত  গিয়ে   টেবিলের  উপর  রাখা  চিঠিটা  নিজের  হাতে  নিয়ে  নিল  । খুব  দ্রুত  সরিয়ে     ফেলতে  হবে ...

( গল্পে  বর্ণিত   পুরাণ  ঘটনা  ‘পদ্ম পুরাণ ’  - এ  সম্পূর্ণ  উল্লেখ    রয়েছে ।  আমি সামান্য  অংশ লিখলাম । মাধুর্য  নষ্ট হয়ে  থাকলে  ক্ষমা  করবেন ।  এর  বিষদ   বর্ণনা  পুরাণেই  পেয়ে  যাবেন ।  আমার লেখা  কোন  সম্প্রদায়কে  আঘাত  করে  থাকলে  ক্ষমা প্রার্থী ।  ) 

তাপসকিরণ রায়





কানামাছি



আসলে যা কিছু তোমার, তা তোমার নয়,
তোমার কিছুই করণীয় থাকে না
তুমি বললে, তাহলে গান ধরো না সেই, তোমার কর্ম তুমি কর মা--...
তবু ধর্ম কেন ভাঙে ?
ভগবান তা হলে কি চরিত্রবান চরিত্রহীনতার মাঝ দিয়েই বেড়ে উঠছে !
সহস্র পাপাচারের মাঝে এসে তুমি বলো, দেখো,
প্রভু ওর মুণ্ড যেন প্রথামত খড়্গের একাঘাতে মাটিতে লুটায়--  
ওরা এগিয়ে যায়।
সর্ব কর্মের অধিপতি তখন চোখে পট্টি বেঁধে কানামাছি খেলে  
নিজের শরীর থেকে সে টুকরো টুকরো অংশ ছড়িয়ে দেয়--
শিব দুর্গা কালী করালী হয়ে ওরা সং সেজে খেলা করে
আর অন্যদিকে ওরা এগিয়ে যায়--একটি একাকীত্ব নারীত্ব ধুলায় লুন্ঠিত হয়--
সে চিৎকার করে ওঠে, বাঁচাও বাঁচাও--
কেউ তখন শোনে না--কারণ স্বর্গের রঙ্গমঞ্চে তখন
ভগবান টুকরো টুকরো হয়ে কানামাছি খেলে বেড়াচ্ছে !

হেমন্ত সরখেল









আমার ছুটির দিনগুলি
                         



গতকাল রাত থেকেই কলম বুদুম্ মেরে বসে আছে। ভাবনারা ধাপ্পা-ধাপ্পা খেলছে ওর সাথে। আমার এই এক জ্বালা! সবাই আমার অথচ কেউ ই কারো সাথে সদ্ভাব রাখতে চায় না। টেনে হিঁচড়ে এক জায়গায় বসিয়ে কি আর পঞ্চায়েতী সম্ভব? নাকি সে প্রক্রিয়া মনোবাঞ্ছিত ফল প্রদান করে? একজনকে টেনে আনি তো অন্যজন মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে- ও! ওকে আগে টানলে! আমি বুঝি ফ্যালনা! চারিচক্ষুর ধারায় তিতিলাম শুধু আমি। ঐ যে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়-- আজ এটার প্রকৃত অর্থটা আমার কাছে পরিস্কার। ওদের নাটুকে অভিমানে আমার স্যালো আঁখি জুড়ে! আরে কথা শোন্ ক্ষ্যাাপারা- সকাল হতেই তো মস্তিষ্ককিটের দুর্দমনীয় আস্ফালন শুরু হয়ে যাবে। কি হে! কোথায় তোমার সৃষ্টরম্ভা? তোদের যদি এই অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে, তাহলে তো আমার ভূগোল বদলে যাবে!! ধুত্তেরি!! কতো আর পারা যায়!এতো তেল নেই বাপু! এমনিতেও ডি.এ. যৎসামান্যই, কাজে কাজেই রাধাও নাচবে না। ভাঁড় মে যাও।

                     মেখলী দুধ দিতে আসে। কাল আসে নি। ওর আদমী নেপাল গেছে, ফেরে নি। তাই গতকালকেরটা নিয়ে আজ হাজির। বাজার থেকে ফিরে দেখি, দুয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
'--- কি ভেলো? এনা কথিলা বইসল্ ছি?'
      পানে কালো কোশীর গেট তুলে বলল- ' কাইল আইব নই সকলিয়ে। মরদ নই রহে। তোরা দিক্কৎ ভ্যায় যেতে ন? ত্যায় চইল এলিয়ে। আয় তোরে টা দেবে। কম্মে ছে '। প্রায় তিন কিলোমিটার ওর বাড়ি আমার কোয়ার্টার থেকে। এবারে 'খাদের' দাম জি.এস.টির কল্যানে ওদের হাতের বাইরে যাবে। সম্পন্নরা হয়তো গহুম কাটবে, কিন্তু ওদের কি হবে বলা যায় না। হয়তো খেতে বসেই বেচে দেবে সবটা।সুদ টানতে থাকা আর কতো সম্ভব! তাই দুধ একদিন ও 'নাগা' করা যাবে না। আমার কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকাটা যত তাড়াতাড়ি ও শোধ করতে পারে এটা তারই প্রচেষ্টা। ওর বহু'র গায়ে পটুয়ার আগ ধরে গেল মাস তিনেক আগে। খবর পেয়ে ছুটলাম 'অস্পতাল'। সেখানের খরচগুলো তখন আমাকে সামলাতে হয়েছিল, এটা ন্যাচারাল, হতেই পারে। ওকে বলেছিলাম- ও আমারই মেয়ে, ভেবে নে না! তোকে এসব ফেরৎ দিতে হবে না। পেটে গামছা বাঁধবে তবু সম্মান খোয়াতে নারাজ ওরা সপরিবার। দুধ খাইয়ে, গহুম দিয়ে, খেতের সব্জী দিয়ে শোধের আপ্রাণ একটা বিনম্র প্রচেষ্টা আমার চোখে জল এনে দেয়! এই দেশই তো খুঁজতে বেড়োই আমি, দেশান্তরে।জানি, ওদের সময় বদলাবে না, বদলায় না। তাই বলে ও রাখি, প্রয়োজনে বলবি, লাজ করে কে কাম নই ছে। পইসা জরুরত পড়তে তো ল্যা যাইয়ো।
             মার্চের শেষ। তাই একটা গা ছাড়া ভাব সকাল থেকেই। পুরো কলোনীটা জুড়ে। সে দেবাদিদেব আজ সপরিবার বাড়ি যাচ্ছেন। তবে ওনার হাতে মাত্র একটা বাজারের ব্যাগ। বৌয়ের মাথায় সুটকেস। বাচ্চাদুটো পেছনে লেতুর দিয়ে। এখানে একটা কথা বহুল প্রচারিত। " বিহারী মরদ চলতে অগারি, কনিয়া পিছারী, সামান ল্যাকে। বঙ্গাল মে একার উল্টা হইছে। বচ্চা অউর সামান ল্যাকে মরদ পছারী পছারী 'লড়লে' যাইছে।" পার্থক্যটা এটা দ্যাখে, বোঝে ও হয় তো বা। সমাজের রীতি যা করায় সেটাই আবহমান কাল ধরে কোশীর ঠান্ডা স্রোতে মজ্জায় মজ্জায় পরিব্যপ্ত। আমি দেখি, বুঝতে চেষ্টা করি- এটাই কি সেই বৈচিত্র্য? অহিন্দীভাষী আমার জন্য এদের সম্মান প্রাণৈক্যের বোধ ছড়িয়ে দেয় শরীর মন জুড়ে। ওদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলি- এই আমার দেশ, দেশবাসী। সুখ, দুঃখ দিয়ে ঘেরা জীবনপথের পথিক। তোমাদের চলা যে ইতিহাস তৈরী করে তা কলম ছড়ায় না দিকে দিগন্তে। কোনো পথনাটিকা হয় না তোমাদের জীবন বদলে দিতে। না কেউ স্নাতকোত্তরে তোমাদের জানতে চায়! তবু তোমরা ইতিহাস গড়ে যাও, প্রতিনিয়ত, সংস্কারে, কৃষ্টিতে, দারিদ্রের দাসখতে, ধৈর্য্যের অন্নপূর্ণা হয়ে।

তাপস গুপ্ত





বুড়ো চাঁদ চোখ পালটায়ে



(অর্ক, সিদ্ধান্ত,দীপ্ত, দিয়ান,  অরিত্র, সৌরভ, তোমাদের পাহাড়ি রাতের সেই উদ্দাম অনুভূতির প্রকাশ...এই কবিতা..যদি হয়ে থাকে)

এবার পাহাড়ে মদ গিলে যা হয়েছিল
তুমি না সামলালে কি যে হতো,
হর হর বমির সঙ্গে ভেতরের জমা বাসি
শুধু মণিপুরী জয়েনে ভাসে কামু কাফকা,

ওই তো স্পষ্ট
দু দুটো বুড়িকে খুন করে
একদিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রোডিয়া
তলস্তয়ের দাড়িতে উকুন বাচ্ছে
তারপর দেখে সেগুলো সাইবেরিয়ার
ফ্যাকাসে বরফকুচি ট্রোজান বাগ;

ওফ্! কি যে হবে এখন এত ধোঁয়া মদে
সব তালগোল পাকাচ্ছে,
এই চাঁদিম পাহাড়ি ঠান্ডায়
যতবারই চন্দ্রাহত আমি কর্ডে টিউন বাঁধি
ততবারই এসে দাঁড়ায় অনুষ্কা,প্রিয়াঙ্কা ভাবনা
রোশনাই সোনিয়া(এই সোনিয়া আট বছর নির্বাসনে ছিল
রোডিয়া র সঙ্গে, ছামিয়া বিদায়কালে দিলজ্বলা নেচে
গববরের কাছে শ্রমনী মুদ্রায় চেয়েছিল ধনেখালি তাঁত
গব্বর ব্যস্ত ছিল মাছি মারায়, বেচারি আর বেচারা
যদি এ ওর পিঠ চুলকোতে পারতো…)
চাঁদ মেয়ে সব,
জোছনার জোনাকি এদের শরীরে খেলে,
কতবার চেয়েছি ধরতে ওই জোনাকি ফুলকি
আঙুল জমেছে হিম কামনায়,
সব নোট পথ খোঁজে ধ্রুব পদে,
তখনই কামনার গণ হিস্টিরিয়া
রক্তমাতনে আমাকে সব ভুলিয়েছে,
ও চাঁদ তুমি কেনো জোছনা হলে
অনুমুখ ডায়ামিটার এর লাভা উদগীরণ
তুমিও অহল্যা ব্যাসল্ট হলে!
বুড়ো চাঁদ চোখ পাল টায়ে কয়
আমি নিয়েন্থার্ডাল প্রেমিক পিতা
প্যাপিরাস পাতা রক্তে চুবিয়ে লিখেছিলাম
তারা , ইয়োর বডি ইজ আ ওয়ান্ডারল্যান্ড,
অদ্ভুত চোখ হেনে বৃহস্পতি বলেছিলেন,
এক বেদনাদীর্ণ পুরুষ পশু হয়ে ধ্বংস হতে চলেছে
ঈশ্বর শুধু তখন করতল ঘষেন,
গিটারের কর্ড ছিঁড়ে জয়েন টেনে
গন্ধর্ব জন মেয়ার বলে ওঠে
এ মায়াকোভস্কি ফুঁকছে...তুমি পালাও..।
আমি মেনেছি সেই দেব পুরুষের কথা!
হে নক্ষত্র সুন্দরি ,
গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সি ঘুরে
আমরা তো গেয়েছি জীবনের গান,
গিটারে খেলেছিল আঙ্গুল
বিস্ময় বিভূষিত তোমার শরীরে জীবনানন্দ
আমার গানের চরণে , সে এক বিপন্ন বিস্ময়;
যতবার বলেছে কবি বুড়ি চাঁদ,
ততবার বলেছি আমি হয়নি,
আমি ক্ষয় রোগী কিন্তু লিঙ্গান্তরিত হইনি,
তাছাড়া তারা মা হবে এবার!
তখন কবি চোখ পাল্টিয়ে কয়
পৃথিবী তোমার মা প্রেমিকা সহোদরা,
হে আচার্য মাতুল,
এবার এক আশ্চর্য উটের গ্রীবার মত
স্তব্ধতা এসে তোমায় গ্রাস করবে
মাত্র কয়েক মাইক্রো পলে!
তখনই জ্যোৎস্না চিরে দৈব বাণী শুনি
নিজের শিরায় তুমি বয়ে নিয়ে চলেছে অপেক্ষার নদী
ভালোবাসা স্থির হয়ে শুনছে,
ওয়েটিং ইন ভেইন,
তখনি আমি নিজেকে ভেঙে চুরে জানতে চাই
আই ডোন্ট ওয়ানা ওয়েট ইন ভেইন ফর ইয়োর লাভ,
কিন্তু তুমি যত দিন না আসছ,
আমার প্রেমিকা নারী
ঋতু পর ঋতু
আমি চাঁদ নক্ষত্র পুত্র
আই এম স্টিল ওয়েটিং দেয়ার।


(ঋণ স্বীকার: জীবনানন্দ, মায়াকোভস্কি, জন মেয়ার, বব মার্লে, আধুনিক বাংলা গান)



স্বরূপা রায়








এই রাত
*******




রাত এখন বেড়ে চলেছে,
নিঁঝুম হলো এই পৃথিবী।
ঘুমিয়ে পড়েছে সবকিছু,
শুধু জেগে আছি আমি।
মাঝে মাঝে স্তব্ধতা ভাঙছে,
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে।
পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি মারছে,
গাছের ডালের ফাঁকে।
চারিদিকে চলছে এখন,
আলো আঁধারের খেলা।
আকাশ জুড়ে বসেছে,
অজস্র তারার মেলা।
অন্ধকারে ফুটে উঠেছে,
হাজার জোনাকির আলো।
রাতের এরূপ দেখলে,
কে বলবে রাত হয় কালো!


আফরোজা সুলতানা






আফসানার অনুসন্ধান  


ইন্ডিয়া ব্যাটিং করতে  নেমেছে এবার । তাড়াতাড়ি রুটি বানিয়ে সপরিবারে খেলা দেখতে বসলো আফসানা । না , খেলা দেখার নেশায় নয় । ইমরানকে খোঁজার নেশায় । ইমরান আখতার , যার সাথে পত্র মিতালি হয়েছিল আফসানার আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে ।  তখন ইমরান স্টেট লেভেল ক্রিকেট খেলত । সময়ের সাথে কত যে ঠিকানা বদলাল দুজনের । তখন কোন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ছিল না । মোবাইল কিছু জনের হাতে বিলাসিতার আমেজ এনে দিত মাত্র ।

একে অপরকে না দেখা এই বন্ধুত্তের একসময় ইতি ঘটলো । তবু আফসানা আজও খোঁজে তাকে । টি.ভি.র মাধ্যমে । যদি সে ন্যাশনাল লেভেলে খেলার চান্স পেয়ে থাকে ।

খেলার শুরুতে তার উৎসাহটা শেষে পাল্টে যায় বিষণ্ণতায় , হতাশায় । আজও তাই হল । কত নতুন নতুন খেলোয়াড় সব । কিন্তু তার ইমরান কই ?
ডিনার করতে করতে সে শুনতে পেলো ম্যান অফ দা ম্যাচের নামটা । ঘোষিত হল শেখ হাসানুজ্জামানের নাম ।

শেখ হাসানুজ্জামান , যার কোন এক সময় ইমরান আখতার ছিল ছদ্মনাম !