আমার ছুটির দিনগুলি
গতকাল রাত থেকেই কলম বুদুম্ মেরে বসে আছে। ভাবনারা ধাপ্পা-ধাপ্পা খেলছে ওর সাথে। আমার এই এক জ্বালা! সবাই আমার অথচ কেউ ই কারো সাথে সদ্ভাব রাখতে চায় না। টেনে হিঁচড়ে এক জায়গায় বসিয়ে কি আর পঞ্চায়েতী সম্ভব? নাকি সে প্রক্রিয়া মনোবাঞ্ছিত ফল প্রদান করে? একজনকে টেনে আনি তো অন্যজন মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে- ও! ওকে আগে টানলে! আমি বুঝি ফ্যালনা! চারিচক্ষুর ধারায় তিতিলাম শুধু আমি। ঐ যে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়-- আজ এটার প্রকৃত অর্থটা আমার কাছে পরিস্কার। ওদের নাটুকে অভিমানে আমার স্যালো আঁখি জুড়ে! আরে কথা শোন্ ক্ষ্যাাপারা- সকাল হতেই তো মস্তিষ্ককিটের দুর্দমনীয় আস্ফালন শুরু হয়ে যাবে। কি হে! কোথায় তোমার সৃষ্টরম্ভা? তোদের যদি এই অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে, তাহলে তো আমার ভূগোল বদলে যাবে!! ধুত্তেরি!! কতো আর পারা যায়!এতো তেল নেই বাপু! এমনিতেও ডি.এ. যৎসামান্যই, কাজে কাজেই রাধাও নাচবে না। ভাঁড় মে যাও।
মেখলী দুধ দিতে আসে। কাল আসে নি। ওর আদমী নেপাল গেছে, ফেরে নি। তাই গতকালকেরটা নিয়ে আজ হাজির। বাজার থেকে ফিরে দেখি, দুয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
'--- কি ভেলো? এনা কথিলা বইসল্ ছি?'
পানে কালো কোশীর গেট তুলে বলল- ' কাইল আইব নই সকলিয়ে। মরদ নই রহে। তোরা দিক্কৎ ভ্যায় যেতে ন? ত্যায় চইল এলিয়ে। আয় তোরে টা দেবে। কম্মে ছে '। প্রায় তিন কিলোমিটার ওর বাড়ি আমার কোয়ার্টার থেকে। এবারে 'খাদের' দাম জি.এস.টির কল্যানে ওদের হাতের বাইরে যাবে। সম্পন্নরা হয়তো গহুম কাটবে, কিন্তু ওদের কি হবে বলা যায় না। হয়তো খেতে বসেই বেচে দেবে সবটা।সুদ টানতে থাকা আর কতো সম্ভব! তাই দুধ একদিন ও 'নাগা' করা যাবে না। আমার কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকাটা যত তাড়াতাড়ি ও শোধ করতে পারে এটা তারই প্রচেষ্টা। ওর বহু'র গায়ে পটুয়ার আগ ধরে গেল মাস তিনেক আগে। খবর পেয়ে ছুটলাম 'অস্পতাল'। সেখানের খরচগুলো তখন আমাকে সামলাতে হয়েছিল, এটা ন্যাচারাল, হতেই পারে। ওকে বলেছিলাম- ও আমারই মেয়ে, ভেবে নে না! তোকে এসব ফেরৎ দিতে হবে না। পেটে গামছা বাঁধবে তবু সম্মান খোয়াতে নারাজ ওরা সপরিবার। দুধ খাইয়ে, গহুম দিয়ে, খেতের সব্জী দিয়ে শোধের আপ্রাণ একটা বিনম্র প্রচেষ্টা আমার চোখে জল এনে দেয়! এই দেশই তো খুঁজতে বেড়োই আমি, দেশান্তরে।জানি, ওদের সময় বদলাবে না, বদলায় না। তাই বলে ও রাখি, প্রয়োজনে বলবি, লাজ করে কে কাম নই ছে। পইসা জরুরত পড়তে তো ল্যা যাইয়ো।
মার্চের শেষ। তাই একটা গা ছাড়া ভাব সকাল থেকেই। পুরো কলোনীটা জুড়ে। সে দেবাদিদেব আজ সপরিবার বাড়ি যাচ্ছেন। তবে ওনার হাতে মাত্র একটা বাজারের ব্যাগ। বৌয়ের মাথায় সুটকেস। বাচ্চাদুটো পেছনে লেতুর দিয়ে। এখানে একটা কথা বহুল প্রচারিত। " বিহারী মরদ চলতে অগারি, কনিয়া পিছারী, সামান ল্যাকে। বঙ্গাল মে একার উল্টা হইছে। বচ্চা অউর সামান ল্যাকে মরদ পছারী পছারী 'লড়লে' যাইছে।" পার্থক্যটা এটা দ্যাখে, বোঝে ও হয় তো বা। সমাজের রীতি যা করায় সেটাই আবহমান কাল ধরে কোশীর ঠান্ডা স্রোতে মজ্জায় মজ্জায় পরিব্যপ্ত। আমি দেখি, বুঝতে চেষ্টা করি- এটাই কি সেই বৈচিত্র্য? অহিন্দীভাষী আমার জন্য এদের সম্মান প্রাণৈক্যের বোধ ছড়িয়ে দেয় শরীর মন জুড়ে। ওদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলি- এই আমার দেশ, দেশবাসী। সুখ, দুঃখ দিয়ে ঘেরা জীবনপথের পথিক। তোমাদের চলা যে ইতিহাস তৈরী করে তা কলম ছড়ায় না দিকে দিগন্তে। কোনো পথনাটিকা হয় না তোমাদের জীবন বদলে দিতে। না কেউ স্নাতকোত্তরে তোমাদের জানতে চায়! তবু তোমরা ইতিহাস গড়ে যাও, প্রতিনিয়ত, সংস্কারে, কৃষ্টিতে, দারিদ্রের দাসখতে, ধৈর্য্যের অন্নপূর্ণা হয়ে।