ভয়
অন্ধকারকে আমি ভয় পেতামনা
ছোটবেলায় ,সবাই বলত সৃষ্টিছাড়া মেয়ে--ছোট্টখাট্টো চেহারা --জেদী--হিংসুটে আর দস্যি-।বাবা নেই বলেই নাকি এমন আমি। সুন্দরী শান্তশিষ্ট দিদির কম হেনস্তা হয়নি এই দস্যির হাতে।বিনা নালিশে বেমালুম হজম করতো প্রশ্রয়ে। কতবার মা অন্ধকার চিলেকোঠায় বন্ধ করে রেখেছে ,আমি কাঁদিনি--চিৎকার করে ছড়া বলেছি,ভুলসুরে উৎকট গান গেয়েছি , একসময় ক্ষিধেয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি ধুলোমাখা মেঝের উপর।
অনেক রাত্রে ঠাকুমা আর দিদি এসে চুপিচুপি ডেকে তুলেছে।ঠাকুমা অধৈর্য হয়ে পদ্মাপারের ভাষায় ক্ষোভে ফেটে পড়তেন----'আপদ্ মাইয়াডা কাউরে ডরায়না !-জন্মাইয়া বাপেরে খাইসে-অহন আমাগো জ্বালাইয়া পোড়াইয়া খাইবো।" এরকম আলোর বিপরীতে নিজেকে স্থির রেখেই স্কুল পালাতে শিখলাম --সাইকেল নিয়ে সোজা দামোদরের পাড়ে। কতবার মাঝিদের পটিয়ে জেলেনৌকোয় চেপেছি । নদীর চড়ায় মড়া পোড়ানো দেখেছি, ক্ষেত থেকে তুলে নিয়েছি টাট্কা সবুজ কড়াইশুঁটি । কখনো রাস্তা থেকে তুলে এনেছি খোঁড়া কুকুরছানা, কখনো বা্চ্চা শালিখ।নিজের পুজোর জামা ভিখিরি মাকে দান করে চরম পিটুনি খেয়ে রাগে মায়ের মুর্শিদাবাদী সিল্কে কাঁচি চালিয়েছি নিষ্ঠুর উল্লাসে।কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো দেখেছে এই ছোট্টখাট্টো মেয়েটার সাংগঠনিক ক্ষমতা--এক ডাকে একটা জমায়েত --মিছিল। মারপিট, ঘেরাও, পিকেটিং ,স্লোগান, গনসংগীত ,স্ট্রিট্-কর্ণারিং ,পথনাটক, গ্রুপ থিয়েটার--জনপ্রিয়তার নেশা নেশা ঘোর। রাত করে বাড়ি ফেরা ছিল, ছিল ছেলেদের সাথে গ্রামে গ্রামে রাত কাটানো-।আত্মীয়রা বিদ্রুপ করে গেছে বাড়ি বয়ে--পাড়া প্রতিবেশীরা তকমা দিয়েছে-- "গেছো মেয়েছেলে" ,
"ছেলে চড়ানো মেয়ে" । নিজের ছেলেদের আমার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার উপদেশ দিয়েছে । আমি কিছুই গ্রাহ্য করিনি- -দরকারে পরে ওই বাড়িগুলোই আমার কাছে এলে মনে মনে হেসে কাজে লেগে পড়েছি । আমার নামে শুনতে শুনতে ধৈর্য্যহারা মা চড় মারতে উঠলে হাত চেপে ধরেছি,মায়ের অসহায় কান্না ও দুর্বল করতে পারেনি আমায় ।
হাসপাতালের মর্গ থেকে যখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা দিদির কাঁটাছেঁড়া শরীরটা আনতে গেলাম--কালসিটে পড়া হাত,ছ্যাঁকা লাগানো গাল, কপালের মাঝ বরাবর একটা সেলাই---কি বীভৎস একটা অন্য পৃথিবীর গন্ধ ঘরটায়-অন্ধকার ,স্যাঁতসেঁতে। একটা কালচে মুখ, নীল ঠোঁট নিয়ে শুয়ে আছে দিদি-ঠোঁটের কোণায় শুকিয়ে যাওয়া রক্ত।ওরা বললো দোতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে-। অথচ আমি তো জানি ক্রিটিক্যল প্রেগন্যান্সির কারণে বেডরেস্টের নিদান পাওয়া দিদির সাথে ওরা কি কি করেছে। না---তখনও ভয় পাইনি আমি ,বের করে এনেছি ওকে মর্গ থেকে । দাঁড়িয়ে থেকে পুড়িয়েছি ওর শরীরটা । তারপর
আইনি লড়াই--ওর হিংসুটি বোন শেষ দেখে ছেড়েছে এ অন্যায়ের ।
শুধু আজ যখন আইটি সেক্টর থেকে ভোর রাতে হা-ক্লান্ত আমি দরজা আনলক করে আমাদের ফ্ল্যাটটায় ঢুকলাম আর টানটান শূন্য বিছানাটা দেখলাম--আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো-এই প্রথমবার-।টেবিলের ওপর ল্যাপটপ, তার পাশে ফটোস্ট্যান্ডে তোর গত জন্মদিনে তোলা ছবিটা--তুই আমার মুখে কেকের ক্রিমগুলো মাখাচ্ছিস্ , আমি কপট বাঁচার ভঙ্গী তে মুখ আড়াল করছি--কি ভীষণ প্রাণ ছবিটায়। ঠিক সামনেই উপুড় করা "রিভার অব্ স্মোক" বইটা, যেন রাত জেগে পড়তে পড়তে এই মাত্র উঠে গেছিস-। তার পাশেই তোর শূণ্য কফিকাপটার তলায় সাদা একটা কাগজ কি ভয়ংকর শূণ্যতা নিয়ে পড়ে আছে আমারই জন্য--আমি হাতে তুলে নিলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে-।আমি জানি ওর বুকে লেখা অক্ষরগুলো--গত দু সপ্তাহ ধরে ওরা তোকে যন্ত্রণা দিয়েছে--অবশেষে ওদের থেকে তুই নিজেকে মুক্ত করেছিস--মুক্ত করেছিস এই একবছর তিনমাস বারোদিনের একত্র যাপন থেকে--।যে তুই একদিন আমাকে ছেড়ে ট্যুর এ যেতেও বায়না করতিস --কেমন আলগোছে সব ফেলে চলে গেলি --হঠাৎ উগ্র ,রুক্ষ মনে হতে থাকা এই জেদী মেয়েটাকে ফেলে এক নরম রূপকথার বুকে মাথা রাখবি বলে -। আস্ত একটা জীবন গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলি--দায়হীন, শর্তহীন--বিশ্বাসই হয়না যেন-সব তো পড়ে আছে ঠিক তেমনি-
-সকালে যেমন ছিল বেরোবার সময় -।কিন্তু এই সাদা কাগজ হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দস্যি মেয়েটা জানে কিভাবে ভিতর থেকে তাসের ঘরের মত ভেঙে যাচ্ছে তার সাহসের ইমারতটা--কি ভীষন এলোমেলো অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে জীবনভোরের আপোসহীন লড়াইগুলো । এই টিপটপ্ করে গুছিয়ে রাখা দেড়কামরার শূন্য লিভ ইন ফ্ল্যাটটার মধ্যে আমি অক্সিজেন পাচ্ছিনা।তোকে ছাড়া বাঁচবার ভয়ে আমার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে ।