নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

বিকাশ মন্ডল

  


"গণতন্ত্র ধর্ষণ"
**************



বিষাক্ত রক্তিম জেহাদ, নাস্তিক সমর্থকেরা সব মার্কসবাদী,
ঠোঁটকাটা স্লোগান, প্রতিবাদে হাতে নিয়ে মোমবাতি।
গণতন্ত্র প্রবঞ্চকের হাতিয়ার, ক্ষমতা জাহিরের আস্ফালন,
ইস্যু পেলেই রাস্তায় নামে, লোক দেখানো আন্দোলন।
রাজনীতির মূল সংজ্ঞা পাল্টেছে, লিপ্ত ওরা হানাহানিতে,
কখনও গোষ্টীদ্বন্দ্ব, তো কখনও মত্ত গদি নিয়ে টানাটানিতে।
দেশের মেয়ে ধর্ষিতা হয় রাত-দিন, ধর্ষকরা পায় না কোনো সাজা,
ছোট্ট ইস্যু পেলেই বনধ ডাকার নীতি, কারণ ওরাই দেশের রাজা।
নির্বাচনের আগে হাতে-পায়ে ধরে, দেখায় কত শত ছলনা,
জেতার পর পাঁচটা বছর হাতে পেলে, ওদের টিকিটি তখন মেলে না।
জনগণও বোতাম টেপে, কার হয়ে কে জানে দাদার না দিদির?
আদতে ওরাও জানে না, তবুও স্লোগান দেয় জয় হোক রাজনীতির।
তাই আতঙ্কের বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলে ব্যাসল্ট বুকে সাহস করো অর্জন,
রাজনীতির ভুতকে হাড়িকাঠে দাও বলি, ভয়কে করো বিসর্জন।

নিগার সুলতানা লিয়া





মা
***


প্রথম যেদিন তার সাথে পরিচয় হয়েছিল,  খুব অবাক হয়েছিলাম আমি৷  আর হ্যাঁ, অনেক ভয়ও পেয়েছিলাম৷ পাবই বা না কেন? কতই বা বয়স তখন আমার? কেবল ১২ কি ১৩ সপ্তাহ৷ সবে হাত পা নড়াচড়া শুরু করেছি তখন৷  একদিন আমার ছোট্ট আঙ্গুলখানি মুখে পুরে গভীর এক ভাবনায় ডুবে আছি৷ ভাবছি, শীতকাল তো এল বলে৷  আমার এই পানিভর্তি প্যারাস্যুটটাতে থেকে এই কনকনে শীত পার করব কীভাবে?

হঠাৎ তার ছোঁয়া পেলাম৷  একটা কোমল মায়ার আবেশে আমার ছোট্ট ভুবনখানি দুলে উঠল৷ ভীত-সন্ত্রস্ত আমি চুপসে এক কোণে সরে আসলাম৷  মৃদু কাঁপা কণ্ঠে বললাম, “কে? কে ওখানে?”
কেউ শুনতে পেল কিনা বুঝলাম না৷ কোনো জবাবও এল না৷ কান পাতলাম দেয়ালটায়৷ শুনতে পেলাম মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠে কে যেন বলছে, “জ্বী ম্যাডাম, আমি টুং বাবুর নড়াচড়া টের পাচ্ছি৷ এ এক অন্যরকম অনুভূতি৷ প্রথম মা হবার সবকিছুই অনেক উপভোগ করছি৷”

“অনুভূতি?” ভ্রূ কুঁচকে গেল আমার৷  এতদিন খুব মন খারাপ করে ভাবতাম, আমি বুঝি একা৷  কিন্তু না, এই যে বাইরের কে যেন আমাকে নিয়ে মিষ্টি অনুভূতি পাচ্ছে৷ মনটা প্রচণ্ড রকমের ভালো হয়ে গেল৷ হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি অ্যাঙরি বার্ডের গানটাতে নাচ শুরু করে দিয়েছি৷ নাচ শুরু হতেই বাইরের উনি হঠাৎ ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলেন মনে হল৷
“ইশশ ব্যাথা দিয়ে ফেললাম মনে হয়৷ সরি৷” নিজে নিজেই বললাম আমি৷ মানুষটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেল, আচ্ছা, উনার কী নাম দেওয়া যায়? এত নরম হাতে আদর করে আমায়...উমম... পমপম কিংবা তুলতুল? সেই থেকে পমপমের সাথে ভাবটা জমেই গেল বেশ করে৷

সেদিনের পর থেকে সে প্রায়ই আমার উপর হাত বুলায়৷ আমিও আমার ছোট্ট আঙ্গুলটা দিয়ে দিয়ে তাকে একটু ছুঁয়ে দিই৷ যেন খুব আপন মনে হয় তাকে৷ আমরা একসাথে “মাশা এণ্ড দ্য বিয়ার” কার্টুন দেখি৷ গল্প শুনি৷  আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প মেকু কাহিনী৷  প্রিয় কবিতা বীরপুরুষ৷ পমপম এতবার শুনিয়েছে যে আমি মুখস্থই করে নিয়েছি৷  ভাবছি কোনো একদিন টুপ করে প্যারাস্যুট থেকে বেরিয়েই বলব,  “এই আমি,আমি বলব৷ শুন তুমি চুপটি করে৷” সে নিশ্চয়ই খুব খুব অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকবে৷

পমপম একটা স্কুলে পড়ায়৷ একদিন শুনি স্কুলের বাচ্চারা নাকি আমার জন্য ছবি এঁকে, চকলেট নিয়ে এসেছে৷ শুনে তো আমার খুশিতে কান্নাই চলে আসল৷  বাইরের মানুষগুলো তাহলে এত ভালো?

পমপম আজ একটা নতুন গল্প বলেছে৷  আগের সব গল্প থেকে আলাদা৷ খুব আলাদা এক আবেগের গল্প৷ দেশে যুদ্ধের সময় বাচ্চাকে বাঁচাতে এক মায়ের জীবন দেবার গল্প৷ যুদ্ধ কী সেটা না বুঝলেও মা শব্দটা আমার হৃদয়ে গেঁথে গেল৷ “মা,মা,মা” বারবার আওড়ালাম আমি৷  এত মিষ্টি-মধুর শব্দটা তাহলে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?
আমার এই ছোট্ট আদুরে টুং নামটা খুব পছন্দের৷  পমপম মা এখন আমাকে এই নামেই ডাকে৷ আর আমি সাথে সাথে একটু নড়েচড়ে জ্বী বলি৷ তখন মা আমায় একটু আদর করে দেন৷
আজকে শুনলাম আমি নাকি মেয়ে বাবু৷ তারমানে আমার গলাটাও মায়ের মত মিষ্টি রিনরিনে হবে৷ কোমল মমতা মেশানো হাতটা চুড়িতে ভর্তি থাকবে মায়ের মতই৷  মা আজকাল আর স্কুলে যাননা৷  ব্যালকনিতে ক্লান্ত শরীরে ইজি চেয়ারটাতে বসে আমার জন্য লাল টুকটুকে একটা উলের লাল জামা বোনে আর আমায় গল্প শোনায়৷  আর আমি ভাবি লাল জামাটা পরে লাল, ক্লিপ পরে ঝুঁটি করে মায়ের স্কুলের বাচ্চাদের একদিন থ্যাঙ্কস দিয়ে আসব৷ ঐ ছবিগুলো দেখতে কত যে ইচ্ছে হয় আমার৷  এসব ভাবতে ভাবতে আঙ্গুলটা মুখে পুরেই ঘুমিয়ে গেলাম৷

হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার৷ মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল৷ মাকেও কেমন অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে৷  ভয়ে গুটিসুটি হয়ে কয়েকবার ডাকলাম মাকে৷  সাড়া দিলেন না৷ আদর করে বললেনও না “ভয় পাসনা টুং, আমাতো আছি৷”হঠাৎ খুব চিৎকার- চেচামেচি, ভাংচুরের শব্দ৷ কানে হাত দিতে বাধ্য হলাম৷ কিন্তু  “যৌতুক” “মেয়ে বাচ্চা” এরকম কয়েকটা শব্দ কানে এল৷ তবে কি, তবে কি বাইরের মানুষগুলো চায়না আমায়? কিন্তু..কিন্তু আমিতো না দেখেই ওদের ভালবেসে ফেলেছিলাম৷

হঠাৎ মাকে ওরা খাট থেকে ফেলে দেয়৷ এলোপাথাড়ি মারতে থাকে৷  আমার খুব ব্যথা লাগছে৷  এর চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্য৷ চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম, “প্লিজ,তোমরা আমার মায়ের সাথে এমন কোরোনা৷” হঠাৎ পাশ থেকে মহিলা কণ্ঠে কে যেন আগুনের কথা বলে উঠল৷ প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম আমি৷  ওরা মাকে টানতে টানতে বাড়ির উঠানে নিয়ে গেল৷ মা এই প্রথম মুখ খুললেন৷ “আমার জীবনের বিনিময়ে আমার টুংকে তোমরা বাঁচতে দাও, বাঁচতে দাও৷” হাসির রোল পড়ে গেল৷  অট্টহাসির গভীর ফাটলে পড়ে চাপা পড়ে গেল বাঁচার আকুতি-আর্তনাদ৷  একি? আমার এত গরম লাগছে কেন? আমার প্যারাস্যুটটা পুড়ে যাচ্ছে দ্রুত৷  রক্তের প্রবল স্রোত নাক মুখ দিয়ে ঢুকছে৷ আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার ৷  কেবল মায়ের মুখটা একটাবার দেখতে ইচ্ছে করছে...প্রচণ্ডভাবে৷

তারপর…. মেকু কাহিনীরা কাগজের পাতায় ধুলো ময়লায় মাখামাখি হয়৷  রিনরিনে সেই গানের সুরগুলো বিরহের সুর তোলে তানপুরায়৷ ছোট্ট লাল সেই উলের জামাটি ঝুল-কালি মেখে পড়ে থাকে চুলোর একপাশে৷  লাল-নীল রঙিন স্বপ্নগুলো সুতো কাটা ঘুড়ির মত মেঘের দেশ পাড়ি দিতে দিতে হয়ত ক্লান্ত হয়ে আটকে যায় সময়ের ডালে৷  কিন্তু এত বড় পৃথিবীটা আমাদের মত টুংদের আর চোখ মেলে দেখা হয় না৷ একটা নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে অনেকটা অভিমান নিয়ে খুব সন্তর্পণে চলে যেতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে৷  এ শুধু আমার মত কেবল কোনো নিরপরাধ প্রাণ কিংবা রঙিন স্বপ্নগুলোর বিসর্জন নয়, যুগে যুগে শাশ্বত নারীজন্মের পাপমোচনও৷  ধরার মানুষদের সে খোঁজ রাখার ফুসরতটুকু ও মেলেনা৷ কেননা, সত্যিই তো, এ জগতে কে কার?







হোসাইন শাহাদাত




জাতির বিবেক
----------------------------



জাতির বিবেক কি ঘুমিয়ে আছে?
ঘুম থেকে জাগ্রত করার দায়িত কাকে দিয়েছে?
ঘুম ভাঙলে জল খাবার কি খাবে?
খবরের কাগজে কি দেখতে চাইবে।
হাজারো প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে?

জাতির বিবেক কি বিবেক আছে?
নাকি বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী হয়ে
পরিবর্তনের জোয়ারে টালমাটাল করছে।
নাকি বিবেকহীনতার পুকুরে অবগাহন করছে।
নাকি অদৃশ্য কারাগারে আটকা পড়েছে?

জাতির বিবেকের হাতে হাতকড়া কেন?
পায়ে বেড়ি কে পরিয়েছে?
কোন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে?
কত ধারায় তার সাজা হয়েছে
নাকি পাল্টা-পাল্টি বন্ধুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে!
নাকি আমার আমির রাজ্যে গুম হয়েছে!

পিনাকি






ছেঁড়া পালকের  ঠিকানা 
 
                         


                        ১

হাওড়া স্টেশনের  বাইরে  ট্রলি  নিয়ে   প্রায় একঘণ্টা  দাঁড়িয়ে  আছে  ।  বাইরে  রোদ ।সকাল  দশটা । সামনের  রাস্তা  দিয়ে  অনবরত  বিরামহীন  জন স্রোত , ঠিক  যেন  নদীর  জলধারা । এই স্রোতের  একপাশেই অপেক্ষা    করছে  বনিতা  । ট্রেন  থেকে  নেমেই  এই  শহর    তার কাছে   অপরিচিত  হয়ে  উঠেছে !
 কুড়ি   বছর  আগে  এখানেই সে  এসে  দাঁড়িয়েছিল ;   সন্ধ্যা ছিল  ; সূর্য  ডুব দিয়েছে ।  কলকাতার  আকাশে  নিভে  যাওয়া  সূর্যের  জন্য  কেউ  অপেক্ষা  করেনা । এতো  সময় নেই  ।  বনিতা  অপেক্ষা  করেছিল । পাঁচ  বছর  আগে  ,   সেইদিন  সে  একা ছিলনা । পাশে  একজন  ছিল । বনিতাকে  নিয়ে  ট্রেনের   বগিতে  বসিয়ে দিয়েছিল  ।  ট্রেন  ছাড়তে   তখনো  আধ ঘণ্টা  বাকী  , নিজের হাতে  বাকী  রাস্তা  যাতে  বনিতার   ক্ষিধে  না  পায় – তারজন্য  পাউরুটি   , কলা , তিনটে  ডিম  আর   জলের  বোতল  কিনে  দিল । যাওয়ার  সময়  বনিতার  চোখে  জল ছিল । 
ঘড়ির  দিকে  তাকিয়ে  , বনিতা   দেখল  এখন  দশটা  কুড়ি ।এই সময়  সামনে  অনেক মানুষ   নিজেদের  গন্তব্যের দিকে    ছুটে চলেছে । এদের  দিকে তাকিয়ে  মনে –মনে  বলল – আজ  শুধু  আমিই  কোন কাজ করব না !বনিতা   ধাবিত  উল্কাদের  দিকে  তাকিয়ে -- এক  স্থির  শান্ত  গ্রহাণু হয়ে   পর্যবেক্ষণ  করছে ! জীবন  চলমান । এখানে  কেউই   থামতে  রাজী  নয় ।  মেয়েটা  ছুটে  চলা  মানুষের মুখে  অদ্ভুত আলো  দেখতে  পায় । স্থির  জীবন  আসলে পরাজয়ের নাম । 
এখানে  ছুটি  কাটাতে  আসেনি ।  শিলিগুড়িতে   বনিতার  নিজস্ব  এন জি ও  রয়েছে ;  অনাথ  পথ শিশু  আর   আশ্রয়হীন  বয়স্ক  মানুষের  হয়ে  কাজ করে  । সেই  সূত্রে  নানা রকমের প্রোজেক্ট  তাদের  করতে  হয় । এমনই  একটা  প্রোজেক্ট  নিয়ে  কলকাতার  কিছু  ব্যবসায়ী   মহলের  সাথে  মিটিং  হবে  ।   তারাই   গেস্ট  রুমের  ব্যবস্থা   করে  দিতে  চেয়েছিল ।বনিতা  নিজেই  সেই  প্রস্তাব  ফিরিয়ে  দিয়েছে  ।   একা-একা   কাউকে  না  জানিয়ে  কলকাতা  ঘুরে  বেড়ানোর  একটা  মজা  রয়েছে । প্রায়  কুড়ি  বছর বাদে এই শহরে  ফিরে  আসা  ।  এই  শহরে  শ্বাস  নেওয়া । এই  শহরের  চীৎকার কান পেতে  শুনে  নেওয়া । এটাই জীবন । শিলিগুড়িতে  বনি  খুব  পরিচিত । কলকাতায়  ব্যবসায়ী  মহল  তাকে  চিনলেও , শহরের  মানুষের  কাছে  অপরিচিত । সে চাইছে , তিনদিনের  ট্যুর  তাকে  কুড়ি  বছর  আগের   মুহূর্তে   ফিরিয়ে  নিয়ে  যাক । সেই  উন্মাদনা , উত্তেজনা , স্বপ্ন ----  এই সব  কিছু  আজও বনিতার  কাছে  খুব দামী । 
‘বনি ’---  চেনা স্বর কানে আসতেই , স্মৃতি থেকে  ফিরে  এলো বনিতা ।     হারিয়ে  যাওয়া মন  গুটিয়ে  নিয়েছে  ।  সামনে  লম্বা   মধ্যবয়সী  উজ্জ্বল  বর্ণের পুরুষ  দাঁড়িয়ে । তার  দিকে  তাকিয়ে  হাসল ।  বলল – দেরী  হয়ে  গেলো ! আসলে ...
বনিতা   পুরুষটির  দিকে  তাকিয়ে  বলল – থাক , ফোন  করে  আমায়   যেতে  বলনি , তাই  ভাগ্য  ভালো ।
-রেগে গেলে ?
- শিলিগুড়ি  থেকে   জার্নি  করে  আমি এমনিতেই  ক্লান্ত ।  এখানে  মানে  এই রোদের  মধ্যে  দাঁড়িয়ে  ,   আমার  ঝগড়া  করতে ভাল লাগছে  না । প্লিজ  গেস্ট  হাউস ঠিক  হয়েছে ?
-একদম ।  দু’দিন আগেই  সব  ব্যবস্থা  হয়ে  গিয়েছে । যেমন বলেছিলে , একদম অচেনা ।  তোমার  রুমের  জানলা থেকে  দেখা  যাবে সামনের   সবুজ মাঠ , বাগান ।  লোকের  ভিড়  নেই  ।   নির্জন  গলি ।
-এখন আমরা  যাব কোথায় ?
-সল্টলেক ।   আজ সারাদিন   ঘুরব ।  তারপর   গেস্ট হাউস ।
-মানে  , এই ট্রলি  নিয়ে  ঘুরব !
-আচ্ছা  তাহলে  , আগে  চলো  গেস্ট হাউসে  গিয়ে  ফ্রেশ  হয়ে  তারপর  না হয়     বাকী প্ল্যান ।
-গেস্ট হাউসটা  কোথায় ?
-সল্টলেকে । অফিসের  গাড়ি  ইচ্ছা  করেই  আনিনি  । আমি চাইছি  আজ আমরা  আমাদের  কুড়ি  বছর  আগের  জীবনটা  উপলব্ধি করব । তাই  দেখো  হলুদ  ট্যাক্সি  নিয়ে  এসেছি  !

বনি  দেখল , ট্যাক্সিটা  দাঁড়িয়ে  আছে  ।  সময়  নষ্ট  না  করে  দু’জনেই  উঠে  বসল ।




                               ২


গাড়ি  ছুটছে। কলকাতার  রাস্তা , ফুটপাত ,  কোলাহল , দূষণ , বিজ্ঞাপন ,  স্বপ্ন  , স্বপ্নবিলাসী  মানুষের   ছুটোছুটি    নিয়ে  ছুটে  চলেছে ।  এত  কিছু দেখে  , বনিতা  বলল – আবির , আমাদের  প্রথম  দেখা  কোথায়  হয়েছিল ?
-রবীন্দ্রভারতী । বুধবার ।  বিচিত্র  ভবনের  সামনে । ভুলে যাইনি । মানুষ ভোরে  সুন্দর  স্বপ্ন  দেখলে ,  ঘোরটুকু  চোখে  লেগে  থাকে  , দিনের  শেষেও  তা  মুছতে  পারেনা ।
-মুছতে চায়না । মানুষ খুব  চালাক , ভালো  স্বপ্ন  মনে  রেখে  দেয় ।
-যেমন আমরা দিয়েছি  !
কথাটা  বলেই  বনিতার  হাতের  নরম  আঙুল গুলো ,  পুরুষটি  নিজের  হাত দিয়ে   ধরল । চোখের ঈশারা  করে বনিতা বুঝিয়ে  দিল  , এখন  নয় ; ড্রাইভার  আছে ।
ছোট্ট নিঃশ্বাস  ফেলে  বলল -  দিবাকর  আমাদের  কত  বয়স  হল ?
-আমার  চল্লিশ  ।  তোমারটা  বলতে  পারব না । দেখে   কুড়ি  -পঁচিশ  মনে  হয় ।
বলেই  দিবাকর হাসল ।  বনিতা  দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – আমি  বুড়ি । মেয়েরা  কুড়িতেই  বুড়ি ।

দিবাকর পকেট  থেকে  সিগারেট   বের করতেই ,  বনিতা চোখে  নিজের  আপত্তি  বুঝিয়ে  দিল । জানালা থেকে  বাইরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল -   দিবু ,  শহরটা  আর আগের  মতন নেই ।
-পৃথিবীতে কখনই কোন  জায়গা  আগের  মতন  থাকেনা বনি । পরিবর্তন  আসবেই । তবে  এখনো  শীতে  গঙ্গার  ধারে  সদ্য  যুগলেরা রোদ পোহায় ।  ময়দানে ভীড়  হয় ।  ভিক্টোরিয়াতে  কোন  বেকার সাহসী  যুবক  তার  সদ্য  প্রপোজ   করে  আপন করে  নেওয়া  প্রেমিকার  ঠোঁটে  ঠোঁট  রাখে ।
-সে  ঠোঁট নিশ্চই  কাঁপে ।  জীবনের প্রথম  চুমুটাও অনেকে  ঠিক করে  দিতে  পারেনা ।  চুমু  দিতে  গিয়ে  কামড় 
হয়ে যায় !
দিবাকরের  ফর্সা মুখ লাল  হয়ে  গেল  ।  কুড়ি  আগের    যুবক  ,তার  প্রথম  চুমু  ব্যর্থতার জন্য  আজো লজ্জিত ; মেয়েটির  বয়স  এখন  চল্লিশ , পাশে  বসে আছে  , সে  ভুলতে  পারেনি  ।  কোন মেয়েই  হয়ত প্রথম  ভালোবাসার  চুম্বনের  স্মৃতি   ভুলতে পারেনা  । 
-তুমি সত্যি , এখানেই  এইসব বলতে হত !
দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বনিতা   শব্দ  করে  হেসে  উঠল । এতক্ষণ  এমন  এক  বিস্ফোরণের জন্যই  সময় অপেক্ষা  করে  ছিল ।   থুতনিতে  হাত রেখে  বলল -  নদের  চাঁদ  নিমাই আমার । লজ্জা  করছে না ?  এদিকে  একা  পেলেতো  নির্লজ্জের  মতন  সারা  মুখ  কামড়ে  দাও ।
বলেই  আবার  হাসতে  শুরু  করল । 

গাড়ি  সেক্টর  ফাইভে  ঢুকে  পড়েছে ।  নিক্কোপার্ক কাছেই  ,  ছোট্ট  গলি । সেখান  থেকে  ঢুকছে । একটা  তিনতলা  রিসর্টের   সামনে  এসে  থামল ।  গাড়ি  থেকে  নেমেই  দিবাকর  ট্রলি  ব্যাগটা  হাতে  নিয়ে  , ড্রাইভারকে  টাকা  দিতে  গেলেই  বনিতা  বলল – এই  ফেয়ারটা  আমিই  দেব । সারাদিনের  দায়িত্ব তোমার । 
দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল -  সোনা , প্লিজ   ইগোতে  নিও না।  এমন কথাই  ছিল  । 
-ঠিকাছে । মনে থাকে  যেনও । তা ফ্রেশ  হয়ে  নাও  । তারপর  গল্প করা যাবে ।
বনিতা  তাকিয়ে  রয়েছে , তারপর নরম আঙুল  চালিয়ে   দিবাকরের   এলোমেলো  ঘাড়ের  কাছে   লুটিয়ে পড়া  চুল ঠিক  করে  বলল – আজ  অফিস  থেকে  ছুটি । আমি ছাড়বনা ।  কিছুতেই না। 
-কিন্তু ?
-দিবা  , আবার  সেই  কবে  দেখা  হবে  ঠিক  নেই  ।  আজ  গোটা  দিন   আমার সাথে  থাকো ।  এখানে  এসেছি  শুধু  তোমার সাথে   কিছু সময়  কাটাবো  বলে । একদিন  আমাকে সময়  দিতে  পারবে না ?
-তা নয় । কোম্পানি  একটা  বড় প্রোজেক্ট  পেয়েছে । দিন-রাত  আমরা  স্টাফেরা  চেষ্টা  করে  চলেছি । অন্তত  এক ঘণ্টার জন্য  , আমাকে  ছাড়ও  ডার্লিং । তারপর  কথা  দিচ্ছি  লাঞ্চের  পর বিছানায়  তোমাকে  পুষিয়ে  দেব ।

দিবাকর ভীষণ  দুষ্টু ।    কলেজের  দিন গুলোতে  সে  এর থেকেও  বেশি  বেয়াদপ  ছিল  । অসভ্য  ছিল  । বর্বর  ছিল। এমন  হয়েছে , বৃষ্টির  দিনে  ; মেঘলা  আকাশের  নীচে  সকলেই  আকাশ  ভাঙা  বৃষ্টির  ভয়ে  আশ্রয়  খুঁজতে  ব্যস্ত । ক্যান্টিনের  পিছনে  ,  ফাঁকা  জায়গা দেখে  ---  দিবাকর  দ্রুত  চুমু  খেয়ে  নেয়  ! বনিতা  কিছু  বুঝে  উঠবার  আগেই  টের পায়  থুতু  মেখে  গিয়েছে  !ঠোঁট  মুছে  বলেছিল  - অসভ্য ।
  দিবাকর  চুমু  খায় না  , দিবাকর   ঠোঁটে  ঠোঁট  রেখে  চোষে । 
পুরানো    দৃশ্য  ভাসতেই  লজ্জা  পেয়ে  গেল  ।  দিবাকর  বলল – অনেক হয়েছে । রুমে খাবার আসবে  ? নাকি গিয়ে  খাবে ?
বনিতা হাসল । বলল – রুমেই ।
                                                           
                            ৩


হোম  ডেলিভারির   খাবার ভর্তি  বাক্স  গুলো কাঁচের  টেবিলের  উপর রয়েছে ।  পাশের বিছানায়  ওরা  শুয়ে  আছে । দুজনেই  নগ্ন । নরম  সাদা  বিছানার  উপর   দুই  পুরুষ  আর নারী  শুয়ে  রয়েছে । ঘড়িতে  দুপুর  তিনটে । বিছানার পাশে বিয়ারের  বোতল ।
বনিতা  চিত হয়ে  শুয়েছে   । দিবাকর  তার  বুকের  উপর  উপুড়  হয়ে  স্তনের   খাঁজে  নাক ঘষছিল । কিছুক্ষণ আগে  জিভ দিয়ে  স্তনবৃন্ত  ভিজিয়ে  দিয়েছিল ।  বনিতা হাত দিয়ে  মাথার চুল  টানছে ।  ঠোঁটে ঠোঁট  ছোঁয়ালো ।
-বনি , তুমি এখনো  সেই আগের  মতন  আছো !
-তুমিও ।  অথচ আমরা  আর সেই আগের সময়ে  নেই ।
-তোমার জন্য খারাপ লাগছে ।
কিছুক্ষণ  বনিতা দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – যা  হয়েছে , তা  ভুলে যাও । আমিও  গিয়েছি  । জীবনে  সবাই  সব  কিছু পায়না । সব  কিছু  পেলে,   না  পাওয়ার আক্ষেপই  থাকবেনা    । জীবনকে  রোমাঞ্চকর  রাখবার  জন্য  এই  না-পাওয়া গুলোই অনুঘটকের  কাজ  করে । দিবা , আমরা দু’জনেই  যখন  এই  এতটুকু পাওয়া নিয়ে  বেঁচে  রয়েছি , কেন  আমাদের ব্যর্থতাকে   স্বীকার করব ?
-আমার বাড়ির লোক তোমাকে  মেনে নেবে না । তাই  বিয়ে  করলাম  না । আমি জানি , তুমি  বলবে  আমাদের  কিছু  করবার  ছিল  না । সত্যিই  ছিল না ? নাকি আমি কাপুরুষের মতন  পালিয়ে  গেলাম !
-পালিয়ে  কেন যাবে ? বিশ্বাস করো  আমি  বিয়ে  করিনি  , তাতে আমার  বিন্দুমাত্র  দুঃখ নেই  । এটা আমার  নিজের  ইচ্ছা । তোমার পরিবারের দায়িত্ব  তুমি  নিয়েছো  । আমি জানি  তুমি  দায়িত্ব   থেকে  পালিয়ে  যাওয়ার মানুষ  নও ।
দিবাকর পাশ  ফিরে  শুয়ে  পড়ল ।  দু’জনের  শরীর  এই  অনন্ত  তৃপ্তিতে  ভরে  গিয়েছে । বনিতা গভীর নিঃশ্বাস   নিল ।  ঘড়িতে  চারটে কুড়ি । বন্ধ কাঁচের জানালার  ওই পাড়ে  সোনালী আলোর  বিকেল ।  সবাই  যেন অপেক্ষমান  দর্শক , সুযোগ  দিলেই  ওদের জড়িয়ে  ধরবে ।
দিবাকর  বিছানা থেকে  নেমে  ট্রউজার  পড়ে  নিল । বনিতা  পাতলা  নাইটি পড়ে  নিয়েছে ।


 ঘরের  দরজা খুলে  বারান্দায়  এসে  , সিগারেট  ধরিয়ে  দিবাকর বলল -   চারপাশে  বিকেলের সুর ছড়িয়ে পড়ছে । পাখিরা সুর  করে  গেয়ে  চলেছে । এদের   মনে  আমাদের  মতন  এতো জটিলতা  নেই ।
পিছনে  দাঁড়িয়ে  বনিতা  শুনছিল । কাঁধে হাত রেখে  বলল – মানুষ  এতো  স্বাধীন নয় । তাকে  অনেক  হিসেব  কষতে হয় , বুঝলে  ?
মাথাটা  দিবাকরের  কাঁধে  ছুঁইয়ে  বলল -  এই পাঁচ  বছর  আমরা এখানে  দেখা  করছি ।  তোমার  বাড়ির লোক  জানেনা । তুমি  ভীতু নও ।  দেখো   যারা অন্যকে   কষ্ট  দিতে  পারেনা , তাই  নিজের  কষ্ট বুকে  লুকিয়ে  রাখে  -- তাদের  দুর্বল  ভাবা  ঠিক নয় । দায়িত্ব জ্ঞানহীন কাপুরুষ  ভেবে নেওয়াটাও  ঠিক  নয় । 
-আমাকে সান্ত্বনা   দিচ্ছো  ? 
-না । আমি  বলছি , আমাকে  ভালবাসছো এটাই অনেক । বিয়ে  হলে  আমরা  এক সাথে  থাকতে  পারতাম।
-ভালোবাসার  মর্যাদা  পেতাম ।
দিবাকরের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – তারমানে  , আমাদের  প্রেমের  স্বীকৃতি  দেবে  চারপাশের  মানুষজন  ! এই প্রেম আমাদের   কাছে  ততটা  গুরুত্বপূর্ণ  নয় , যতটা  সমাজের  কাছে  ?
-আমি  বলিনি । তবে  তোমার  জীবনে  আমার পাশে  দাঁড়ানো দরকার  ছিল  ।
-মানে  ?  দিবাকর  আমাদের  মেয়েদের  এতটাই  অসহায়  ভাবো ?  বিয়ে  করলেই  পাশে  দাঁড়ানো  হবে  । সারাজীবন  শুধুমাত্র  পরস্পরকে  ভালবেসে   পথ চলা  যাবে  না ! তোমার  নিজের  আলাদা  পরিবার  আছে  । জানি সেখানেও  তোমার  দায়বদ্ধতা  রয়েছে ।  তুমি  নিজের বিবাহিতা  স্ত্রীকে  নিয়ে  থাকতেই পারো । আমি আসব না ।
-আমার থেকে  তুমি আলাদা হতে পারবে  ? এত দিন চেষ্টা করেছি । ভুলতে পারিনি । তুমিও পারনি । আমি জানি , তুমি সব কিছু  ছাড়তে  চেয়েছিলে । আমিই  পারলাম না !
-দেখো  আমি জানি , তুমি আমাকে সম্মান করো । একজন  ভালোবাসার  মানুষ  এই সম্মানটুকুই  চায় তার কাছের জনের  থেকে ।
-তুমি  বলতে পারলে । খুব সহজেই বললে । শুধু আমি জানি , প্রতিদিন  আমার ভিতরে ঝড় উঠছে । ভিতরটা তোলপাড় করে , লণ্ডভণ্ড করে  দিচ্ছে  আমার  নৈতিক যন্ত্রণা ।
-আমার ভালবাসনা  ? তাই হয়ত , আমার ভালোবাসা তোমাকে  শান্ত করতে পাচ্ছে  না ।

দিবাকর দেখল , মেয়েটার চোখে  চাপা  যন্ত্রণা ।



বাইরে  বিকেল  ফুরিয়েছে । সন্ধ্যার  আলো  আকাশের  বুকে  মেখে   রয়েছে  এখনো ; এই  রঙ একেবারে  নিজের  ।  বনিতার  বুকে  চাপা  কষ্ট  হচ্ছে  । খুব কাঁদতে ইচ্ছা  করছে ।  দিবাকর  দেখল ,  দুচোখ  ভরা প্রতীক্ষা ; এখনই হয়ত চোখের জল  নেমে  আসবে  ! দিবাকর  , নরম  ফোলা গালে হাত দিয়ে  বলল – তোমাকে  ভালোবাসতে   না পারলে  এমন  ভাবে  ছুটে  আসতাম  সোনা ?
বনিতা আলতো করে  দিবকরের  বুকে  মাথা  রেখে  বলল – ভিতরে  চলো ...পাখিরা বাসায় ফিরছে ।
চোখ  দুটো  অভিমানী মেয়ের  মতন । বোঝাই যায়না , এই মহিলা  অনেক  পুরুষেরই  কাঙ্ক্ষিত । 




                             ৪

 রাত  দশটা  বাজতে  দশ  মিনিট বাকী । বিছানায়  দিবাকরের  বুকের  উপর  মাথা  রেখে  শুয়ে  ছিল বনিতা । আজ ওদের  বাইরে  ঘুরবার  পরিকল্পনা  ছিল  , ভেস্তে  গেল  ।  বনিতাই  বলল , বাইরে  গিয়ে সময় নষ্ট করতে  হবেনা। এই  যে  নিবিড় হয়ে , দু’জনেই  বুকে  বুক  ঠেকিয়ে , দিবাকরের  বুকে  মুখ  রেখে  শুয়ে  রয়েছে ; এক মুহূর্ত  তৈরি    হয় । অনেক  মানুষ গোটা জীবনে  এমন  অনুভূতির  জন্য  অপেক্ষা  করে  থাকে  !

বনিতা  চেয়ারে  বসে , সিগারেট  ধরিয়ে  পা  বিছানার  উপর  দিয়ে  লম্বা  নিঃশ্বাস  ছেড়ে বলল -  তুমি টাকাটা  চেকে  না  ক্যাশে  নেবে  ?
উল্টো  দিকে  পুরুষটি , যাকে  এতক্ষণ  দিবাকর  বলছিল  সে  জুতোর  ফিতে  লাগিয়ে  বলল – ম্যাডাম  চেকেই  দিন । 
- তিরিশ  হাজার  চেকে  , আর  এক্সট্রা  তিরিশ  ক্যাশে  দিচ্ছি  । 

ছেলেটি  বলল – অতিরিক্ত  কেন ?
-আজ  তুমি  আমাকেই  সময়  দিয়েছো । দেখো  ডিয়ার  রাত  বারোটা  হয়েছে  । তোমাকে   দশটা পর্যন্ত থাকবার   জন্যই হায়ার  করা  হয়েছিল ।
 ছেলেটি মনে – মনে  বলল – এমনিতেও  এই ক্লাইন্টের   সাথে  থাকবার  সময়  , মানসিক চাপ এতটাই  থাকে  যে  নতুন  খরিদ্দারের  প্রতি  মনোযোগ  দিতে  পারেনা । তাই  সে   আর  কোন খরিদ্দারের কাছে  যায়  না । 
তার  কাজ   টাকার  বিনিময়ে  যৌন আনন্দ  দেওয়া । যারা  তাকে  টাকা  দিয়ে  ভাড়া করেন , অনেক  সময়ই মুডের উপর  নির্ভর করতে  হয় ।  যৌন  আনন্দের  সাথে  মানসিক  আনন্দ দিতে  হয় । প্রথম  যখন  বনিতার সাথে  কথা   হয় ,আর পাঁচজন   খরিদ্দারের মতনই  ভেবেছিল । বনিতা  এক অদ্ভুত  শর্ত রাখে  ।  অবশ্য এরজন্য সে  অতিরিক্ত  পারিশ্রমিক পাবে । ব্যাপারটা হচ্ছে  অনিমেশকে  অন্য একটি  চরিত্রে অভিনয়  করতে  হবে  ।  শুধু অভিনয় করলেই  হবেনা , বনিতা বর্মণকে  বিশ্বাস করাতে  হবে  । আজথেকে  পাঁচ  বছর  আগে  বনিতার  সাথে  অনিমেশের  পরিচয় ।
এই পাঁচবছর ধরে  এই  বিশেষ  দিনটিতেই  দিবাকরের  চরিত্রে  অভিনয়  করে  অনিমেশ । দিবাকরের  মুখ দিয়ে  যে কথা  গুলো  বলতে হয় , তা  বনিতার  লেখা  চিত্রনাট্য । পাঁচ  বছর  একই  চিত্রনাট্য বলতে –বলতে , অনিমেশ  বুঝতে পেরেছে , সে  নর্তক  না  হয়ে  অভিনেতা  হতে  পারত ।
পাঁচ  বছরে  সে  বনিতাকে  জিজ্ঞেস  করতে পারেনি ,  দিবাকর  চরিত্রের  পিছনের  রহস্য । কেনই বা  এই  বিশেষ  দিনেই  দিবাকর  ফিরে আসে  ? আজ ঠিক  করে  নিল  জিজ্ঞেস  করবেই ।  যদিও খরিদ্দারকে  কোন কিছুই  ব্যক্তিগত  কথা জিজ্ঞেস করা  যায় না , তাও আজ  একটু  সাহস  নিয়ে  অনিমেশ  বলেই ফেলল ...



বনিতা  চোখ  বন্ধ  করে , সিগারেটের   শেষ  ধোঁয়া  ছেড়ে  বলল – তাহলে  নাছোড় বান্দা ? আমি আমার দুঃখ   অন্যজনের কাছে  ভাগ  করতে  রাজী  নই । তুমি  টাকার জন্য  আমাকে  সঙ্গ  দিয়েছো । তাও আমি  তোমাকে  আজ  বলব । তুমি  একদিনের  জন্য  হলেও  দিবাকর । আমার দিবাকর । আমি  তোমার ঠোঁট ,  বুক  , ঘামের  গন্ধে ... আমার পাঁচ  বছর  আগের  দিবাকরকে  খুঁজে  পেয়েছি ।
-দিবাকর কে ?
-আমার  কলেজ প্রেম । বলতে পারো প্রথম আর শেষ প্রেম । আমাদের  বিয়ে  হয়নি ।  আমরা আজও                প্রেমিক –প্রেমিকা। কলেজে  প্রথম  দেখা । যা অভিনয় করেছো , সব  সত্যি । আমার লেখা  চিত্রনাট্যে  মনগড়া সংলাপ  লেখা নেই  ।  সবটাই জীবন থেকে  নেওয়া ।
-আপনারা  যখন  পরস্পরকে  এতো ভালোবাসতেন বিয়ে  করলেন না !
-না। দিবাকরের  বাড়ির লোক  আমাকে  মেনে  নিতে  চায়নি । আমি বাড়ি থেকে  ওকে  আলাদা  করতে  চাইনি । দিবাকর  না  চাইলেও ,  আমার চাপেই  বাড়ির কথায়  বিয়ে  করতে হল ।
অনিমেশ বলল – তার মানে  আপনি একা , আর দিবাকর বাবু  এখন  নিজের  বউ  সংসার  নিয়ে  আনন্দে  রয়েছেন । আপনি এখনো  তাঁর প্রেমে   ডুবে রয়েছেন !
বনিতার  দু’চোখ  জলে  ভেজা । নাক টানল । অনিমেশ  দেখছিল ।  মেয়েটাকে  কেন জানি আদর করতে ইচ্ছা  করছে । দিবাকরের ঠোঁট  দিয়ে  নয় ,  অনিমেশ হয়ে । 
বনিতা  বলল – অনিমেশ , তোমার  সাথে  প্রথম  যেই  বছর  দেখা  করলাম । তার একবছর  আগেই  দিবাকর  আত্মহত্যা  করেছিল ।

কথাটা  শুনেই ,  অনিমেশ  চমকে  উঠল । গল্প আচমকাই  গতিপথ  পাল্টেছে !
বনিতা  চোখ মুছে  বলল – আমার  কথায়  বিয়ে  করলেও , নিজেকে  ঠকাতে  পারেনি  । আত্মহত্যা করবার  আগের দিন আমরা এই  রুমেই  ছিলাম ।  এগারোটা পর্যন্ত । যাওয়ার  আগে  আমাকে  একটা  চিঠি  দিয়ে  গেল  ।   বলেছিল  সে  চলে গেলে  , আমি যেন চিঠিটা পড়ি । 
-আপনি  পড়েছিলেন ?
-সেই রাতে  পড়া  হয়নি ।  পড়ের  দিন আমাদের  কাছের  বন্ধুদের  থেকেই  খবরটা পেলাম  , দিবাকর   বাড়িতেই  ঘুমের  ওষুধ খেয়েছে । ডাক্তার  চেষ্টা করেও  বাঁচাতে পারল  না।
কথা  থামিয়ে  , জল ঢালল  গলায় । আবার  বলতে  শুরু  করল – চিঠি খুলে  দেখলাম , দিবাকর  নিজেকে  ঠকানোর যন্ত্রণা  মেনে  নিতে  পাচ্ছিল না  । নিজেকে  কাপুরুষ  আর  দায়িত্বহীন  ভাবছিল ।এই  পৃথিবী  থেকে  নিজেকে  সরিয়ে  দেবে  । তার  এই  অবস্থার  জন্য  দিবাকরের  চোখে  আমিই  দায়ি ।
অনিমেশ দেখল , বনিতা  বাচ্চা  মেয়ের  মতন  ফুঁপিয়ে কাঁদতে  শুরু  করেছে ।  বনিতা  বলল – সেই  দিন  থেকে  ঠিক করলাম  আমি  নিজেই  নিজেকে   ঠকাবো । দিবাকর  চিঠিতে  লিখেছিল  ----   সাহস  থাকলে  অন্য  মানুষ কে  দিবাকর  ভেবে  ভালবেসে  দেখব । সত্যিই আমি পারিনি । ঠিক করলাম  একদিন  , ওর মৃত্যু দিনে  নিজেকে  ঠকাবই ।  দেখব , দিবাকর  প্রতিদিন  নিজের কাছে  নিজে  ঠকে  যে  যন্ত্রণা পেয়েছে , তার  প্রায়শ্চিত্ত আমি  আমার  যন্ত্রণা  দিয়ে  করতে  পারি  । অনিমেশ  দিবাকরের  শেষ  চিঠিতে উল্লেখ  করা কথা কে  মাথায় রেখেই  আমার এই  নাটকের  চিত্রনাট্য । বিশ্বাস করো অনমেশ , আমি  দিবাকরকে  ভালো  দেখতে  চেয়েছিলাম ।

বনিতা  কাঁদছে ।  মুখে  দু’হাত দিয়ে  ফুঁপিয়ে –ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।
অনিমেশ  ভাবছিল , পাখির  দেহ থেকে   যে   পালক  ছিঁড়ে যায় , তা সারা  জীবন উড়ে  চলে  । পাখির কাছে  ফিরে  আসেনা । অনিমেশ  চাইলেও  দিবাকর  হতে পারবেনা ।  বনিতা  নিজেকে  ঠকিয়েও , ছেঁড়া পালকের  ঠিকানা খুঁজে  পাবেনা............ 

রাজীব লোচন বালা




"অন্ধকারে এ উৎসব"
  *****************

                     

আজ এ পৃথিবী ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময়, 
মা দুর্গা আসছে , আনন্দ বাড়ছে যার... আছে ।
আজ মহাপঞ্চমী , কত সুর- কত গান চারপাশে করি আকর্ণন ,আজও কিছু শব্দ শুনতে পাই, "ও দাদা কিছু দাও না" "কদ্দিন ধরে কিচ্ছুটি খাইনিগো"।

আজ উৎসব এসেছে, মনে দোলা দিয়ে যায় প্রেমিক প্রেমিকার,
আমার ঘর এখনো আঁধারে, মা আজও কান্না করে, বোন আজও ভিক্ষা মাগে।
কিঞ্চিৎ উৎসব দিয়ে  সব ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা আজ,
পাড়ায় পাড়ায়, কত ঘরে ঘরে , যার আছে....।

আজও সেই বড় প্যান্ডেলের সামনে দিয়ে অর্ধ নগ্ন  "মা" , একটা থালা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়
আর ভেতরে আরেক মা লক্ষ টাকার স্বর্ণখোচিত শাড়িতে বন্দিত হয়।
বাইরে আমার মা, রাস্তার পাশে ড্রেনের কাছে এসে খাবার খায়,
আর ভেতরে খাওয়ারের জোয়ার এসেছে, 
এখন হাত দেওয়া যাবে, কালকে ফেলে দেওয়া হবে।
সেই  খাবার  কুকুর- বেড়ালের সাথে খাচ্ছে দেখো "উৎসব" কতদিন ধরে।

আবার আমরা অনেক এগিয়ে, অনেক! এই গোলকের মহানপ্রাণী ,
ও সৌরভের মা , এবার তোর ছেলের ক'টা জামা হয়েছে?
এইতো দিদি, বেশী না মোটে দশ খানা, তোমার  মেয়ের থেকে  ছয় খানা কম্ 
ওওওওও... এত জামা নিয়ে কী করবে বলো সামনে আবার দিওয়ালি আসছে...তো
মেয়েটার ইচ্ছে হয়েছে, তাই মামা, কাকা, জ্যাঠা , দাদু, পিসি, বাবা, মা, সব্বাই মিলে দিয়েছে।

নিত্যদিন নতুন নূতন ..... আর আমার ছেলেটা ,বলেই মা কানতে কানতে  বললো ওও রাজশ, তাপস আর বারিণ,, ওদের উৎসব চুকে গেছে...
কত আশা করে বাড়ি এসেছিল, কত কিছু নিয়ে , এক উৎসব , তার মৃত্যু উৎসব হয়ে গেল..
সব তার মুছে গেছে, চিতাভষ্ম আজ শীতল হয়ে গেছে।

তোমাদের মশগুল জীবন পুজার আনন্দে ভালোই কাটছে।
আমার উৎসব মাটির ঘরে, শতশত মৃত্যুর অন্ধকারের শব বানায়....
মৃন্ময়ী আজ সাজসজ্জায়, চিন্ময়ী  রাস্তায় রাস্তায়
খুব ভালো উৎসব হচ্ছে কোটি টাকার লাল শরবতে আর বিছানায়।

উন্নতির আলোকসজ্জা রাস্তায় রাস্তায়, জীবন ভরে পেটে আগুন নিয়ে,
পুজোর দিনে সাজবে হাজারে হাজারে ,রঙে্র বাহারে
বিসর্জনে মায়ের মুখশ্রী জলের তলায়, কাকের বিষ্ঠায় কালো ছায়া,
চার- পাঁচ এদিনের আলো , আজকের অন্ধকারের উৎসবকে ভেঙ্গায়।

অক্ষয় কুমার সামন্ত





অসুখ
******



যেমন করে নদীর ব্যথার কথা
ঝড়ের রাতে বুঝতে পারে নদীর পাড়
তেমন করে অসুখ সহসা এসে
মৃত্যুর পথ চিনিয়ে দিয়ে গেছে।

অবহেলার সিঁড়িতে কতটুকু আর ওঠা যায়
কাজগুলোকে জমিয়ে জমিয়ে স্তূপের নীচে
চাপা পড়ে গেছি - শব্দ খুঁজি অক্সিজেনে
আমাকে থামিয়ে শেষ চিঠি লেখে কলম
তার না লেখা ব্যথার কালিতে।

অগোছালো সময় ঘড়ির কাঁটাকে
অবজ্ঞা করে হারিয়ে ফেলে গতি 
আর তার পিছনে আমি প্রবাহহীন --
বিছানায় শুয়ে শুয়ে মুমুর্ষু চোখে
ব্যর্থতাকে ফিরে ফিরে যোগ করি;
আর কি এক মোহে একটু ভালোবাসার জন্যে
গায়ে লেপ মুড়ি দিয়ে
শীতের রাতে নক্ষত্রের কপালে
আমার মৃত্যুচিহ্ন আঁকি।