নববর্ষে একদিন
**********
"কিরে মা, এখনও ঘুমাসনি! রাত কয়টা বাজে? সেদিকে খেয়াল আছে!"
মায়ের প্রশ্নে মৌমিতার কাজের একাগ্রতা ভাঙে। সে হাত থেকে সাইনপেনটা রেখে মাথাটা উপরে উঁচিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- মা, আরেকটু। এই পোস্টারটায় রঙ করলেই আমার কাজ শেষ হবে।
- কিসের পোস্টার?
- কেন? তুমি কি ভুলে গেছো - আগামীকাল পহেলা বৈশাখ,বাংলা নববর্ষ। আমাদের স্কুল দিবসটি জাঁকজমকভাবে পালন করছে। আমরা সবাই তাতে মজা করবো।
মৌমিতাকে এমন উচ্ছল দেখে শারমিন খানমের খুব ভালো লাগে। মেয়ের কাছাকাছি বসে একে একে তার আঁকা সব ছবি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখেন। আবহমান বাংলার নানান ঘটনা তার অঙ্কনে ফুটে উঠেছে। মৌমিতা এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পারে তা তার জানা ছিল না। এরপর আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে মৌমিতার ছবি আঁকা দেখেন। এরপর মৌমিতা
সবকিছু গুছিয়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ রাখে। রাত সাড়ে বারোটা বাজে। মৌমিতা ব্যস্ত গলায় বলল,
- মা, আমার কাজ শেষ হয়েছে। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। সকাল সাড়ে ছয়টা বাজলে কিন্তু আমায় জাগিও।
- এতো সকালে কেন?
- আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে মেলায় একটি স্টল নিয়েছি। সেখানে আমরা বিভিন্ন ডিজাইনের দেশীয় পিঠাসহ রকমারি খাবার বিক্রি করবো।
- তো তোমাদেরকে কে রান্না করে দেবে?
- মা, আমরা যে খাবারগুলো বিক্রি করবো সেগুলো একটি দোকানে আজ অর্ডার করে এসেছি। কাল সকালেই সব পাবো। আর আমার বান্ধবী সবিতার মা হাতের তৈরি কয়েক আইটেম পিঠা তৈরি করে দেবেন। দোকানে নুডুলসের ব্যবস্থাও থাকবে। নুডুলস রান্না করে আনবে আমাদের আরেক বন্ধু দুর্জয়। আর নববর্ষকে ঘিরে সুন্দর সুন্দর পোস্টার তৈরি করা আমার দায়িত্বে পড়েছে।
- আচ্ছা মৌমিতা, বাংলা নববর্ষের মেলায় তোমাদের দোকানে দেখছি সব আইটেমই আছে। কিন্তু----।
মৌমিতা মায়ের মুখ থেকে কিন্তু কথাটা বের হতে না হতে কপালের ডানপাশে তর্জনীটা ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ করে বলল,
- ওহ্! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সকালবেলার পান্তা-ইলিশ! আমাদের স্টলের মূল আকর্ষণ কিন্তু ঐ পান্তা- ইলিশই। আমার বান্ধবী সোহেলীর মা পান্তা ভাত আর ইলিশ রান্না করবেন। এতো কাজের চাপে নববর্ষের মূল আকর্ষণকে ভুলে গেছি।
শারমিন খানম মেয়ের কথা শুনে মিটিমিটি হাসেন। তার মনে হতে থাকে, মৌমিতা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে আনন্দ পাচ্ছে। অথচ এর আগে ও নিজের কাজেও ফাঁকি দিয়ে মজা নিতো। আজ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক মৌমিতাকে পেয়ে মায়ের মন ভরে।
মৌমিতার রাতের ঘুম খুব ভালো হয়নি। মনের মধ্যে আগে থেকেই পহেলা বৈশাখের আমেজ আনাগোনা করছিল। খুব রাত করে ঘুমিয়েছে সে। সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতেই বালিশের পাশের মোবাইলটার ক্রিং ক্রিং আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার। ঘুম ঘুম চোখে হাতঘড়িটার দিকে এক নজর দেখে নিয়ে আলসেমি তাড়াতে রুমের মধ্যে এদিকওদিক পায়চারি শুরু করে।
এরপর সকালের নাস্তা সেরে মায়ের শাড়ি পরে মেলায় আসে সে।
সকাল দশটা বাজতে না বাজতে মেলা জমে উঠেছে। চারিদিকে বাংলা নববর্ষের উৎসবের আমেজ। সবার শরীরে বাঙালি পোশাক। মেয়েরা প্রায় শাড়ী পরেছে। আর ছেলেরা কেউ ফতুয়া, কেউ আবার লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্কুলমাঠের এককোণে নাগরদোলায় ছোট ছোট শিশুদের উচ্ছ্বাসে খুশির সুবাতাস বইছে। পাশেই চলছে ম্যাজিক শো। জাদুপ্রিয় ছেলেমেয়েরা জাদু দেখতে টিকিট কাউন্টারে ভীড় করছে।
কেউ কেউ মৃৎশিল্পের জিনিসপত্র, বাঁশি, রকমারি সামগ্রী কিনছে। কেউ আবার তীব্র গরমে স্টলে গিয়ে প্রাণভরে বাঙালি-খাবার খাচ্ছে।
মৌমিতা একটানা এগারোটা পর্যন্ত স্টলে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে সোহেলীকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছু দূরে কয়েকজন ক্লাসমেটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে ওরা।
একজন শিল্পী রঙ দিয়ে সবার গালে বাংলা নববর্ষের নানান নকশা আঁকছেন। সিরিয়াল নিয়ে ওরাও গালে নকশা আঁকায়। এরপর ঘুরে ঘুরে পছন্দের জিনিস কিনে নেয় ওরা।
এরিমধ্যে ওদের সামনে কয়েকজন শিক্ষককে ঘিরে আছে অনেকে। সবাই স্যারদের সাথে সেলফি তুলছে।
মৌমিতাকে দেখে মিন্টু স্যার বললেন,
- এই মৌমিতা, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
এদিকে এসো। আজ দূরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকার সময় নয়। আজ সবাই মিলে দূরত্ব ভুলে আনন্দ করবার দিন। আজকে আমরা কেউই শিক্ষক-শিক্ষার্থী নই। আজ আমাদের পরিচয়- আমরা বাঙালি।
স্যারের কথায় মৌমিতারাও সবার সাথে দাঁড়িয়ে সেলফিতে অংশ নেয়। সেলফি তোলা শেষে আবার স্টলের দিকে পা বাড়ায় ওরা। হঠাৎ সোহেলীকে উদ্দেশ্য করে মৌমিতা দুর্বল গলায় বলল,
- এই সোহেলী, আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। চল, শরবত খাবো।
- হ্যাঁ, আমারও তৃষ্ণা পেয়েছে। কিন্তু কীসের শরবত খাবি? এখানে তো অনেক আইটেমের শরবত দেখা যাচ্ছে।
- আমি বেলের শরবত খাবো। তুই কোনটা খাবি?
আমি তরমুজ আর লেবুর শরবত খাবো।
শরবত খেয়ে ওরা নিজেদের স্টলে ফিরে আসে। ততক্ষণে স্টলের প্রায় সব খাবার বিক্রি হয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে মেলায় মধ্যাহ্নভোজের বিরতি চলছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ আগে থেকে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারিদের জন্য খাবার রান্না করে রেখেছে। শিক্ষার্থীরা লাইনে দাঁড়িয়ে টোকন জমা দিয়ে দুপুরের খাবার গ্রহণ করছে। মৌমিতারা স্টল গুছিয়ে লাইন হয়ে খাবার গ্রহণ করে।
খাবার পর্ব শেষে শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেশের জারি-সারি, ভাটিয়ালী নানান বাংলা গানে উপস্থিত দর্শকদের মাতিয়ে রাখে।
এরপরপর মঞ্চে আসে ভাড়া করে আনা ব্র্যান্ড দল "অনির্বাণ" এর শিল্পী রিকি। দর্শকরা তুমুল করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানায়। রিকি তার ভরাট কন্ঠে পরপর তিনটি হিন্দী গান পরিবেশন করে। উপস্থিত দর্শকবৃন্দ নেচে গেয়ে তার গান উপভোগ করে। মৌমিতা, সোহেলীরা দর্শকসারির এককোণে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। মৌমিতা সোহেলীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
- দ্যাখ্ বন্ধুরা, আজ আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সারা বছর না পারি। অন্তত আজকের দিনের জন্য হলেও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির লালন করা উচিত। হৃদয়ে ধারণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। তোরা কি বলিস?
সবিতা গম্ভীর হয়ে বলল,
- তুই একদম ঠিক কথা বলেছিস, মৌমিতা। আজ বাংলা নববর্ষ। নববর্ষের অনুষ্ঠানে হিন্দী গান মানে বিদেশী সংস্কৃতি চর্চা করাটা আমার কাছেও খারাপ লাগছে। অথচ দ্যাখ্, সবাই কীভাবে উল্লাস করছে!
পাশ থেকে দুর্জয় বলে ওঠলো,
- এখানেই আমাদের সমস্যা। আমরা কোনকিছুর ভালোমন্দ বিচার বিবেচনা না করে আনন্দ পাই। এখানে যাদের নাচতে দেখছিস আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাদের অনেকেই গানের অর্থ পর্যন্ত ভালো করে বুঝে না। শুধু বাদ্যের তালে তালে মাতছে। আমার ভাবতে অবাক লাগছে, যারা গান গাইছে তারাও তো বাঙালি। আজকের দিনটির কথা মাথায় নিয়ে তাদেরও তো একবার ভাবা উচিত ছিল।
মৌমিতা অভিযোগের সুরে বলল,
- তাহলে শোন, গত বছর আমি আমার পরিবারের সাথে পাঁচদিনের ট্যুরে ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওদের দু/চারটি অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছি। কোথাও বাঙালি সংস্কৃতি আমার চোখে পড়েনি। আরও অবাক করা কথা কী জানিস, আমাদের দেশে যেখানে প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে ইন্ডিয়ান বিভিন্ন চ্যানেল চলে সেখানে ইন্ডিয়া গিয়ে যেটুকু দেখেছি তাদের কাউকে বাংলাদেশি কোন চ্যানেল ভুল করে দেখতেও দেখিনি। এটাই ওদের সাথে আমাদের পার্থক্য।
সোহেলী বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলল,
- তাহলে আয়, আজ থেকে আমরা শপথ করি। আমরা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিই ধারণ করবো। আমরাই শুরু করি। হয়তো একসময় দেখা যাবে আমাদের দল ভারী হচ্ছে।
সবাই তা সমর্থন করে হাতে হাত রেখে শপথ করলো। এরিমধ্যে মঞ্চে শুরু হয়ে গেলো স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিনয়ে নাটক "পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ"।
অল্প সময়ের মধ্য পুরো মঞ্চকে একটি সুসজ্জিত দোকানঘরে পরিণত করা হলো। দোকানের ক্যাশবাক্সের পাশে বসে আছেন একজন দোকানদার। দোকানের সম্মুখে দুই সারিতে কয়েকটি কলাগাছ রাখা হয়েছে। সেই গাছগুলোর সাথে ত্রিকোণাকার রঙিন কাগজ লাগানো হয়েছে। একটু পর একজন খরিদ্দার দোকানের গেইট পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন। দোকানদার তাকে সালাম জানিয়ে সুন্দর করে বসতে অনুরোধ করেন। তারা একে অন্যের মধ্য কুশল বিনিময় করেন। দোকানী ও খরিদ্দার পুরনো বছরের বকেয়া হিসাব করছেন। ততক্ষণে দোকানের একজন কর্মচারী মিষ্টি নিয়ে খরিদ্দারের সামনে দেন।
খরিদ্দার মিষ্টিমুখ করে দোকানীর বকেয়া পরিশোধ করেন। এরপর খরিদ্দার খুশিমনে দোকানীর সাথে হ্যান্ডশেক করে চলে যান।
মুহূর্তে দর্শকবৃন্দ তুমুল করতালির মাধ্যমে অভিনেতা-শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানায়।
মৌমিতারা নাটকটি দারুণ উপভোগ করে। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির চাক্ষুষ উপস্থাপনা উপস্থিত দর্শকের মনে পরিতৃপ্তিতে ভরে দেয়। সবশেষে মঞ্চ আসে স্কুলের প্রধানশিক্ষক। তিনি হাতঘড়িটার দিকে একনজর তাকিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন,
- আজ আমাদের বাংলা নববর্ষ। নববর্ষের এই শুভক্ষণে সবাইকে জানাই আবারো নববর্ষের শুভেচ্ছা। নিয়মিত পড়াশুনার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আজ আমরা নববর্ষের নতুন সাজে নিজেদের সাজিয়েছি। প্রাণভরে আনন্দ করেছি। পুরোপুরি বাঙালি হবার চেষ্টা করেছি। আশা করি আমাদের আজকের আয়োজন সবার কাছে ভালো লেগেছে। সকডল থেকে দুপুর। আবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। তাই এখনই আমাদের অনুষ্ঠানকে সমাপ্ত করতে হচ্ছে। আমি সকলের মঙ্গল কামনা করে আজকের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করছি।
মুহূর্তে দর্শকরা করতালির মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানায়।
অনুষ্ঠান শেষে যে যার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। মৌমিতারাও একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আপন গন্তব্যপথে ছুটছে।