নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

রবিবাসরীয় সংলাপ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রবিবাসরীয় সংলাপ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সুপারস্টার(প্রথম পর্ব) : সুকান্ত মন্ডল





বৈশাখ মাস ।  প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। চারিদিকে নির্জীবতার ছায়া । মাঠ -ঘাট চৌচির আর শুনশান । বিবর্ণ প্রকৃতিরানী। দুপুরের ঝলসানো প্রখর রোদ্রে , তুহিনের হাজার স্বপ্ন ও বিবর্ণতার রূপ পায়। নীলকণ্ঠপুরের তীব্র গরম ও বুঝতে পারছিল , সে খুবই কষ্টদায়ক ও একঘেয়েমি । কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না।  সময় হলেই একটা সবুজ পাতাতেও তার চিহ্ন থাকবে না। এখন তার সাম্রাজ্য,  তার রাজত্ব  । দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে জমিয়ে যখন একটা নীরব ঘুম দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তুহিনের বাড়ি থেকে চিৎকার শুনতে পেয়ে দেখল , তুহিনের বাবা  দরদরে ঘাম গায়ে রাগান্বিত অবস্হায় চোখ বড়ো বড়ো করে জুতো দিয়ে পিটছে ক্লাস ইলেভেনে পড়া ছেলেটিকে।                                আর পুরো নীলকণ্ঠপুর গ্রাম কাঁপিয়ে তুহিনকে গালিগালাজ  করছে - "এতো রোদ্রে তো পরিশ্রম করতে হয়নি।  মাথা ফাটাতে হয়নি। ভালোবেসে বাড়িতে থাকতে বলেছি। মাঠে ধান কাটতে নিয়ে যায়নি এক গ্লাস জল চেয়েছি এই যাচ্ছি বলে ,এক ঘন্টা কাটিয়ে দিল !  এদিকে বাবা- মা রোদে জ্বলে -পুড়ে মরছে দুটো ভাত জোগাড়ের তাগিদে,  আর সে জানোয়ার সিনেমা দেখায় মগ্ন। সিনেমার সুপারস্টার হবে !  ছাই আর কচু হবে ।    আরে ! সুপারস্টার তো তাদেরই বলে : বাস্তবে যারা বাবা -মাকে সাহায্য, সহানুভূতি  আর স্নেহ করে । পড়াশোনা তো গাছে উঠে গেছে কবেই। বাপের হোটেলে গোগ্রাসে দুটি গিলছে আর খালি টিভি আর টিভি।  এরকম ছেলে ঘরে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো, দূর হয়ে যায় না কেন "

  অন্যদিকে প্রতিপক্ষ তুহিন ও মারতে যাচ্ছিল বাবাকে ।  কোনোরকম তুহিনের মা দুজনকে সামলে নিয়েছিল। তুহিনের মেজাজি গলা তুহিনের বাবার মেজাজি গলার থেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল  , 'কি ভেবোছো টা কি ? তোমার টাকায় খাচ্ছি বলে দোষারোপ  করছো !'


(চলবে...)

দশচক্র (তিন) : সিদ্ধার্থ সিংহ








ফোন বাজলেই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে রিসিভার তোলে ঋজু। ওর ছেলে বাবি ক্লাস ফোরে পড়ে। ক’দিন হল ছেলেকে নিয়ে ও আর স্কুলে যাচ্ছে না। বউকে পাঠাচ্ছে। 
সপ্তাহখানেকও হয়নি ওর অফিসে একটা ফোন এসেছিল। ও-ই ধরেছিল। ফোনটা একটি মেয়ের। সে লেখালিখি করতে চায়। তাদের কাগজে লেখা দিতে হলে কী ভাবে পাঠাতে হবে, কাকে পাঠাতে হবে, মনোনীত হল কি না, ক’দিনের মধ্যে জানা যাবে, এই সব টুকিটাকি কথা সে জানতে চাইছিল। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ঋজুই দিচ্ছিল। হঠাত্‌ মেয়েটি ওর ফোন নম্বর চায়। ও বলে, এই নম্বরেই করবেন। সন্ধের দিকে করলে আমাকে পেয়ে যাবেন। কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। সে ওর অফিসের নয়, বাড়ির নম্বর চায়। ঋজু দেখেছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা দূরে ও যখন কোথাও যায়, কবি নয়, খবরের কাগজে কাজ করে শোনার পরেই অনেকে ওর কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর নেয়। কিন্তু কস্মিনকালেও কেউ ফোন করে না। এই মেয়েটিও সে রকমই একজন ভেবে, ও ওর বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে দিয়েছিল। আর তখনই ও জেনেছিল, মেয়েটির নাম শালিনী। তার পর থেকে দু’-একদিন ছাড়া ছাড়াই মেয়েটা ফোন করে। 
গলার স্বর খুব নরম। বাচ্চা বাচ্চা। মনে হয় ইলেভেন-টুয়েলভে পড়ে। গত পরশু যখন ফোন করেছিল, ঋজু ঘুমোচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে ফোন ধরতেই ও প্রান্ত থেকে শালিনী বলেছিল, কী মশাই ঘুমোচ্ছেন নাকি? 
— এই উঠলাম। হ্যাঁ, বলো। এত সকালে? 
— না, এমনিই করলাম। কোনও দরকার নেই। আসলে ভাইয়ের সঙ্গে দুধ আনতে বেরিয়েছি তো, দুধের ডিপোর পাশে নতুন একটা এসটিডি বুথ হয়েছে। দেখেই মনে হল আপনাকে একটা ফোন করি। তাই করলাম। কিছু মনে করলেন না তো? 
কেউ যে তাকে এমনি এমনি ফোন করতে পারে, এই ফোনটা না এলে সে জানতেই পারত না। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল সে। আর সেই খুশিতেই সারাটা দিন তার খুব ভাল কেটেছিল। 
লোকে বলে, কারও কারও মুখ দেখলে নাকি দিন খারাপ যায়। আবার কারও কারও মুখ দেখলে দিন ভাল যায়। কারও মুখ নয়, তার দিন ভাল করে দিয়েছিল শালিনীর ফোন। তাই তার পর দিন, মানে গত কাল একটু সকাল সকাল উঠে সে তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। যদি আজও করে! কিন্তু না। সাড়ে সাতটা-আটটা-সাড়ে আটটা বেজে গেল। সে ফোন করল না। এমনকী সারা দিনে অফিসেও একটা না। রাতে শোবার সময় ভেবেছিল, কাল সকালে নিশ্চয়ই ও ফোন করবে। তাই সকাল থেকে যত বার ফোন বেজে উঠেছে, ও প্রায় লাফিয়ে গিয়ে ফোন ধরেছে। এবং দেখেছে, সবই এর ওর তার ফোন। কিন্তু যার ফোনের জন্য ও অপেক্ষা করে আছে, তার কোনও পাত্তা নেই। ঘড়িতে তখন ন’টা বেজে গেছে। নাঃ, ও আজ আর ফোন করবে না! ঋজু স্নানে ঢুকে পড়ল। 
বেরিয়ে শোনে, একটা ফোন এসেছিল। 
— কার? 
ওর মা বললেন, রিনা গিরি বলে একটা মেয়ে ফোন করেছিল। 
— ও, রিনা গিরি! মানে আশিসের বউ। কী বলল? 
— কিছু বলেনি। শুধু বলল, কখন পাওয়া যাবে? তা আমি বললাম, আধ ঘণ্টা পরে করুন। ও স্নানে গেছে। 
ঋজু একটু বেলা করেই ব্রেক ফাস্ট করে। দুধ-মুড়ি খেতে খেতে ও শুনল, ফোন বাজছে। ফোনের কাছে মা। তাই ও আর উঠল না। এটা নিশ্চয়ই শালিনীর ফোন না! 
ফোন ধরেই মা বললেন, ঋজু, তোর ফোন। 
— আমার! এত দেরিতে ফোন করল! পড়ি কি মড়ি করে ছুটে গেল ও— হ্যাঁ, ঋজু বলছি। 
ও প্রান্ত থেকে একটা কোকিল কণ্ঠি ভেসে এল— আমি কণিকা রায় বলছি। চিনতে পারছেন? কাল আমরা একসঙ্গে দাঁতনে গিয়েছিলাম... 
— আরে, হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন। কাল ফিরতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? কেমন আছেন? এখন কোথায়? 
— আমি তো অফিসে। 
— এত সকালে? 
— সকাল কোথায়? পৌনে দশটা বাজতে চলল... 
— আপনাদের ক’টা থেকে? 
— আমাদের তো সাড়ে ন’টার মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। আমরা ডাইরেক্ট সিজিএমের সঙ্গে কাজ করি তো... 
— তাই নাকি? 
— আমরা তো আর আপনাদের মতো সাংবাদিক নই যে, বিকেল বেলায় অফিস। 
— বিকেলে শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু থাকতে হয় ক’টা পর্যন্ত, সেটা দেখুন। আপনারা তখন ঘুমোন। 
— অনেকে হয়তো ঘুমোয়, কিন্তু সবাই ঘুমোয় না। খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে কথা ক’টা বলল কণিকা। 
— কেন? আপনি কি জেগে থাকেন? 
— একদিন বেশি রাতে ফোন করে দেখবেন। 
— হ্যাঁ, আপনাকে বেশি রাতে ফোন করি, আর আপনার কর্তা সন্দেহ করা শুরু করুক, এত রাতে আমার বউকে ফোন করছে কে! 
— সন্দেহ করবে না। 
— কনফার্ম? 
— জানলে তো করবে। 
— মানে? 
— উনি অন্য ঘরে শোন। 
— ও। বলেই, একটু থেমে, অন্য প্রসঙ্গে যাবার জন্যই ঋজু বলল, একটু আগেই রিনা ফোন করেছিল। 
— কখন? 
— এই তো, মিনিট দশ-বারো আগে। 
— রিনা নয়, আমিই করেছিলাম। 
— আপনি? মা যে বললেন, রিনা গিরি... 
— হ্যাঁ, আমি রিনার নামই বলেছিলাম। আসলে আপনার বাড়ির কে কী রকম, আমি জানি না তো। কে আবার কী ভাববে, তাই রিনার নাম বলেছিলাম। এক দিন চলে আসুন না আমাদের বাড়িতে। 
— ওরেব্বাবা, আপনাদের বাড়ি তো সেই তেপান্তরের মাঠে। যেতে আসতেই সারা দিন লেগে যাবে। 
— মোটেও তা নয়। 
— আমি তো দু’-এক বার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে গেছি, জানি। 
— লাস্ট কবে এসেছেন? 
— বছর পনেরো আগে। 
— প... নে... রো...  ব... ছ... র... আগে! এখন এক বার এসে দেখুন... 
— আসলে সল্টলেক শুনলেই না গায়ে জ্বর আসে। লোকে যে কী ভাবে ওখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে, কে জানে! 
— ঠিক আছে, আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে হবে না। আপনি একদিন আপনার সময় সুযোগ মতো আমাদের অফিসে আসুন। 
— আপনার অফিসে যাবার জন্য আমার কোনও সময় সুযোগ লাগবে না। রোজই যেতে পারি। আমাদের অফিস থেকে টেলিফোন ভবন তো একটুখানি। 
— তা হলে আজকেই চলে আসুন। 
— আজকে! 
— হ্যাঁ, আজকে। 
— ঠিক আছে, দেখছি। 
— দেখছি না। চলে আসুন। নীচে এসে আমাকে একটা ফোন করে নেবেন। 
— আপনার নম্বরটা যেন কত? 
কণিকা শুধু অফিসের নম্বরই নয়, তার মোবাইল নম্বর, এমনকী বাড়ির ফোন নম্বরটাও দিয়ে দিল। ঝটঝট করে লিখে নিতে নিতে ঋজু বলল, বাড়ির নম্বরটা পেয়ে ভালই হল। রাতের দিকে অনেক সময় কাজের চাপ কম থাকে। তখন কথা বলা যাবে। আপনি ক’টা অবধি জেগে থাকেন? 
— করুন না। যখন খুশি করতে পারেন। 
— রাত বারোটায়? 
— বারোটা কেন? একটা, দুটো, তিনটে... যখন খুশি। 
— ফোন ধরবেন তো? 
— করেই দেখুন না... 
সে দিন সকালে শালিনী ফোন করার পর সারাটা দিন অদ্ভুত এক আনন্দে সারা শরীর যেমন চনমন করে উঠেছিল, আজও তেমনই এক আনন্দে ঋজুর মনপ্রাণ খুশিতে ভরে উঠল। 

তিন 

কয়েক সপ্তাহ আগে বিধান দত্তের সঙ্গে সুন্দরবন গিয়েছিল ঋজু। বিধানদা কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন। ফিচার লেখেন। বিখ্যাত লেখকের উত্তরসূরি.....


(চলবে )

রুহীর পুতুল : রাজিত বন্দোপাধ্যায়

    







                             ।। ৩ ।।   





            রুহী চোখ মেলে সিটে উঠে বসে মা কে সামনে না দেখতে পেয়ে চমকে উঠে আসে পাশে চাইল । তারপর দেখল মা তো ট্রেনের দরজার দিকে যাচ্ছে । সে তাড়াতাড়ি করে নেমে সেই দিকে চলতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল । বা পাশের একটা খালি সীটে সেই বড় বারবি ডল পুতুল টা শুয়ে ! তবে মাথাটা এখন আবার ন্যাড়া । বোধ হয় চুল ছিল এককালে , আজ আর নেই । তা হোক , এটা কে ফেলে গেল দেখতে হবে । সে এগিয়ে গিয়ে দু হাতে পরম যত্নে তুলে নিল পুতুলটাকে । রুহী কে অবাক করে দিয়ে জীবন্ত মানুষের মত পুতুল টা চোখ মিটমিটাল মনে হল তার ! মুখ টা হাসি হাসি । অঃ - অঃ - অঃ করে একটা খুব নীচু স্বরের আওয়াজও বুঝি শুনতে পেল সে । আশ্চর্য ! এ সত্যি জাদুর পুতুল !!  
-- রুহী ?   
মায়ের কড়া গলার ডাকে সে তড়বড় করে ট্রেনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল পুতুলটাকে কোলে নিয়ে । তার স্কুলের ব্যাগ মার হাতে । ওর হাতের পুতুল টা দেখে মায়ের সে কী রাগ ! কার না কার ! এখন যখন তখন সন্ত্রাসবাদীরা বাচ্চাদের খেলনাতেও বোমা ফিট করে দিচ্ছে , তখন কেন সে ওটা নিল ? মার প্রশ্নে কান্না এল রুহীর । সামনে দাঁড়ানো পুলিশ কাকু তার দিকে চেয়ে মিষ্টি কোরে হেসে বললে ,   
-- দেখি দেখি তোমার পুতুল টা । বাঃ বেশ তো ! পুলিশ কাকু পুতুল টা হাতে নিয়েই প্রথমে ভাল কোরে দেখে নিল সেটায় কোন বোমা টোমা আছে কিনা । তারপর জনে জনে জিজ্ঞাসা করে পুতুলের মালিক না পেয়ে রুহীর হাতেই ফিরিয়ে দিল । মা করুণ চোখে পুলিশ কাকুর দিকে চেয়ে বললে ,   
-- দেখুন দাদা ...     
তাকে শেষ করতে না দিয়ে পুলিশ কাকু বললে ,    
-- আরে না না দিদিমণি , ও আপনার মেয়েই নিয়ে যাক । কেউ যখন পাওয়া গেলনা । এতটুকু মেয়ে আপনার , দেখছেন না কত খুশী দেখাচ্ছে ওকে ।   
মা বললে ,   
-- পুলিশ কাকুকে ধন্যবাদ বল রুহী ।   
-- ধন্যবাদ কাকু ।    
পুলিশ কাকু তাকে আদর করেচলে যেতেই মা কড়া চোখে চেয়ে তাকে বললে ,   
-- বাড়ি চলো ।    
তারা দুজনে বাইরে বেরোবার গেটের দিকে রওনা হয়ে পড়ল ।   
                                                                            [ চলবে ]    

অপরাজিতা : দেবব্রত সেন



         
সুলেমান উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে মাঝে মাঝে এলাকার কিছু সমস্যা তুলে ধরেন সংবাদপত্রে। প্রবন্ধ আকারে। এছাড়াও ভালো ভালো লেখক ও কবির লেখা পড়ে, মতামত দিত। আজকে মনে পড়ছে তার কবি শ্রীজাত  বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই লাইন দুটো ----
            মানুষ হতে মানুষ আসে
                বিরুদ্ধতার হাতবাড়ায়
             আমিও মানুষ তুমিও মানুষ
                 তফাৎ শুধু  শিরদাড়ায়।।

এটাই ভাবছে সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ।  পরে সুলেমান উঠে দাঁড়াল, দুহাতের আঙ্গুল গুলো সংযোগ করে ঘারটা দুপাশে ঘুরিয়ে ফুটিয়ে নিল, বলল,, আচ্ছা শিবু  পুজা মা উঠিরে আইজ, কাইল দেখা করবাম তর মা 'য়ের লগে! বলতে বলতে উঠোন পেরবে এমন সময় পুজার মা মালতি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।আরে সুলেমান যে, কখন এয়েছো? সুলেমান বলল, প্রায় আধ ঘন্টারও বেশি হবে বৌদি।
আর বলিস না সুলেমান , মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যানের ছোটো মেয়েটার জন্মদিন,তাই আর ছাড়ল না, একটু যোগাড়টোগারে সাহায্য করতে হলো।কি করব শহরে বাবু কথা শুনতেই হবে! আর কাজ করেই তো খাই।
বউদি একটা কতাকই? রাগের কিছুই নাই কিন্তু? যেইডা মানবিক হেইডাই কমু! এর বেশি কমু না?
----কি বলবি সুলেমান বলেই ফেল? আমি হাত পা চোখ মুখে জল দিয়ে আসি আগে কেমন!
----- ঠিক আছে বউদি! আহ আগে! তারপর

এই সময় মনে পড়ে গেল, পুজার কলেজে ভর্তির সময় চেয়ারম্যান সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা। সেটাই ভাবতে লাগল সুলেমান। সেইদিন যখন পুজার কলেজে ভর্তির জন্য, কিছু সাহায্য চাইতে গেলাম চেয়ারম্যানের বাড়ি, চেয়ারম্যান সাহেব  যা নয় তাই বলল, আর দেখা করতে বলল,  মিউনিসিপালিটি অফিসে, সেখানও ঠেসা ঠেসি করছে, কখনও এর দিকে,,  কখনও আবার ওর দিকে দেখিয়ে দিয়ে বিষয়টা এরিয়ে যেতে চাইছে! মনে হয় চেনেও নাচেনার ভান ! আরে বাবা দিবি কিনা সেটাতো বল, সেটা বলছে না! না দিলে, না বলে দিলেই হত। আর গরীব অসহায় মানুষগুলানরে ওরকম করাই ওদের স্বভাব ! আসলে গরীব মানুষদের বলার লোক নাই, তাই এরম। শালার বিরোধি নেতারাও তো ওরকমই, তোর হয়ে কতা বলে ঠিকই যখন ভোটে জিতে ক্ষমতার গদিতে বসে, তখন তাড়াও একই পইন্থা করে বসে। মনে হচ্ছিল। একটা নিশ্বাস নিল সুলেমান, মনে মনে বলল, আর কারে ভালো কমু? কারেই বা বিশ্বাস করমু? এই দুনিয়ায় ভাল মাইনষি নাই কেন আছে, তবে হাতে গোনা শত করার অংকের মতন। হাজারে দশটা মিলে।

  সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতই হতে লাগল। ফাঁকা তিস্তা চরে মাঠে কিছু কুকুর শেয়াল তাড়া করছে। ঘেউঘেউ করে পিছু নিল কুকুরের একটি দল। ঘেউঘেউ আওয়াজে তা বোঝা গেল।

হাত-পা চোখেমুখে জলদিল পুজার মা মালতি। মুছতে মুছতে  হাই তুলছে , আহ্বা..... করে উঠল।আর বলছে, কি যেন বলছিলি সুলেমান। এবার বলো। চা, দিয়েছে পুজারা?  এই পুজা কাকুকে চা দিয়েছিস তো, মা?

পুজা রান্না ঘর থেকে বলল, হুম, মা। সে তখন কড়াইএ খুন্তি  নাড়ছে। পটল ভাজা করছে। ডাল একটু আগে হয়েছে! ডাল আর পটল ভাজা ভাত করছে পুজা! পুজার মা পুজাকে বলল, রান্না শেষ হয়েছে তো মা,! তোর কাকুটা আছে একসাথে খাই।

সুলেমান বলল,  না না বৌদি আমি কিন্তু খাব না!  তোমরা খাও। মালতি বলল, খাও কিরে এটা তো তোমার বাড়ি তাই না! বন্ধু থাকলে হয়তো, কত কত আনন্দ করতিস, গল্প করতিস! আর বলতিস বৌদি ভালো করে দুকাপ চা দিয়ে যাও তো! নাহলে কষা কষা খাসির মাংসের কথা! বলতিস আজ কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাব। তোর মনে আছে সুলেমান, একবার বিজয়াদশমীর হালযাত্রায়, তুমি বললে না আজ বৌদি কবজি ডুবিয়ে খেয়েছি, জীবনে স্মরণীয় থাকবে। এমনভাবে বলছে মালতি যেন তাদের পাশে বসেই গল্প শুনছে তার স্বামীও! আসলে কিন্তু তা নয়। এই সময় সুলেমান বলল, বৌদি ওসব থাক। ,। আসল কথায় আসি।কি জন্য ডাকছিলা হেই কথা কও। আসলে সুলেমানের মন এখনও কাঁদে বন্ধুর জন্য।

সুলেমান জাতে মুসলমান ঠিকই,  অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল রয়েছে! তার কাছে পুজার বাপের মতো  মনুষ্য ধর্ম ও কর্তব্যবোধ সমান ভাবে মেনে চলে। পুজাদের মতো অসহায় পরিবারটা পাশে সব সময় দাড়িয়েছে, শুধু আপন বন্ধু বলে নয়। শৈশব থেকে তিস্তা পাড়েই পুজার বাপ আর সে খেলা ধূলা, বড় হওয়া স্কুল জীবন কেটেছে!!

অস্বস্তির মধ্যে স্বস্তির বোধ আইতাছে বৌদি, দ্যাওয়াটাত মেঘ ভীড় করতাছে,  ঝর বৃষ্টি নামবে বুঝি , আইজ যাই বৌদি! অন্য একদিন আইমু। এহন তো আর সময় কম, জমিনে জল জমলে,  কাইল থেকে আবার রোয়া রোপন লাগবো, বিচন তুলতে হইব, জমি চাষ দেওনের লাগব। কি করব! সারা বছরের খাওয়া তো জোগাড় করন লাগব এইডাই সময় ! ও কত্তদিন হইল বৃষ্টি নাই!মাটি যারা যারা রোপন করছিল, তাদের জমিন মাটি ফাটা ফাটা হইছে!  আইলে ভালাই হয়।

----হুম! তাই তো রে সুলেমান। জীবনটা একটা চক্রকার, ঠিক যেমন গরমকাল পেরিয়ে বর্ষা, শরৎ যাবে হেমন্ত আসবে! শীত আসবে তারপর আবার বসন্ত, তারপর আবারও গ্রীষ্ম পেরিয়ে বরষা। কখনও জোয়ার, কখনও ভাটার!  জীবন চক্রে সবই থাকে আর যে মানুষ গুলো চলে যায়, সে আর আসে না ফিরে।  শুধু এটুকুই পার্থক্য।

....বৌদি হক কথা কইছ। এইটাই আল্লাহর বিধান।

......আল্লাহ আর ভগবান যাইহোক,  সবাই যেন বিধিবাম। এত দিন থেকে ভেসে সংসারটা আগলাচ্ছি, কই আছে? আহা করে হাই তুলে, চোখে জল পড়া আঁচলে মুছতে মুছতে বলল। বলল, আর ভগবান? আছে ওই বড়লোকের ঘরে!ওর  যা চায় তাই করতে পারে টাকার জোরে। বাদ দেয় সে সব সুলেমান।

আগে পুজা শিবুকে দেখল মালতি ! কারণ তাদের আড়াল করে আলোচনা হবে মনে হয়, শিবু তখন বিছানায় ঘুমিয়েছে,বেচারার খাওয়া হয়নি তখনও! মা আর সুলেমান কাকু গল্প করছে, তাই সে বিছানায় । পুজা কল পারে, হা পা ধুতে গেল।
মাসদুয়েক আগে একটা ছেলে এসেছিল, ছেলেটা সংবাদ পত্রে কাজ করে! আমার মনে হয় পেরেম টেরেম আছে, তুই একটু খোজ করে দেখিস তো সুলেমান! আমি মেয়ে মানুষ, আমার দ্বারা ওসব হবে নারে।
-----ও! হেই কথা। আমি একদিন শহরে গিয়েছিলাম, কি কাজে ঠিক মনে কইরতে পাচ্ছি  না! তবে, সে দিন ওরা রাজবাড়ী দীঘির পাশে বসে গল্প কইরছে। ভাবলাম থাক! এ বয়সে ছেলে মেয়েরা এরকমই করে। তারপর একদিন  ছেলেটার সঙ্গে দেখা কইরলাম৷ আলোচনা হল, বুজলাম ওরা দুজন দুইজনকে ভালোবাসে। তোমাকে বলাই হয়নি বৌদি। ওর বাড়ি গিয়েছি, বাড়ি শিলিগুড়ি, শিবমন্দিরের ওইদিক।

-----আমার ঠিক এই জায়গাটায় ভয় হচ্ছিল রে সুলেমান।

----ভয়ের কি আছে বৌদি? কওনে! বিয়ের কথাই আলোচনা কইরত  হইব।তোমার কি মত বৌদি?

----- আমি কিছু বুজে উঠতে পারছি নারে সুলেমান। ভাবছিলাম একটা ভালো মাস্টারি চাকরি ছেলে দেখে বিয়ে দেব! কি হল! আর কি ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

-----আমার মইতে বিয়ে ঠিক কইরা ফালাই ভালো। ভালোবাসা আছে ওদের মইধ্যে! তখন আবার কি না কি হয়!

......ঠিক আছে সুলেমান! তোর হেফাজতে দিলাম মেয়েটাকে। তুই যেটা ভালো বুজিস, সেটাই করিস।

----আমি আর কি বৌদি? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আইজ উঠি। দ্যেওয়াটাত মেঘ ছড়াইতেছে! যাই! বৃষ্টি আইবো।

বিয়ে তে মত দিল মালতিও। শুধু আলোচনা দুপক্ষের অর্থাৎ দুবাড়ির সময়ের অপেক্ষা। তারপর বিয়ে। চারহাতের ফার্স্ট ব্র্যাকেটক্লোস। পুজা তার বিয়ের ব্যাপারটা কলপাড় থেকে সব শুনল।পুজার মা মালতি পুজাকে ডাকল,  এই পুজা, পুজা তোর ভাইকে ডাক নারে মা। আয় রান্না ঘরে আয় খাওয়া দাওয়া  সেরে নিই।বৃষ্টি আসার আসার উপক্রম হয়েছে, তাড়াতাড়ি আয়।
শিবু ও পুজা রান্না ঘরে এল, পুজার মা থালা ভরা ভাত সাজিয়েছে তিনটে থালায়। খাওয়া হল সবার।

জোরদার বৃষ্টি শুরু হল, এদিকে আকাশটা ফুটছে চারাং চারাং করে, কোথাও হয়তো উল্কা পিন্ড খোসে পড়ল বুঝি। যে দিকটা পড়ে সেখানে কয়ে বলে যায়, একে বারে পুড়ে ঝলছে যায়! গতবছর এক বিকেলে সুলেমান দের নারকেল গাছটায় পড়েছিল, পোয়াল পুজিটা একবারে ছাই হয়ে গিয়েছিল, গোরু রাখার জায়গাটা ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল! সুলেমানদের কালো গাইটা তো সেই উল্কা পাতের শকে মারা যায়,,ও গাভীটা কি না ভালো ছিল। দিনে লিটার চারেক দুধ দিত! এখন দুধের যা অবস্থা গোয়ালরা অর্ধেক দুধে অর্ধেক জল মেশায়। ও শ্বশুর মশাই থাকতে আমাদের তিনটে বড়ো বড়ো জার্সি গোরু ছিল, সেই ভহাবহ বন্যায় দুটো গোরু কোথায় চলে গেল, ভেসে গিয়ে হয়তো কোথাও আশ্রয় পেয়েছে, কিংবা মারাও যেতে পারে! তবে বাড়ি  যে গাভীটা ছিল, সে অবশ্য ঠিক অবস্থায় ছিল, বেচারাটারও আমাদের সঙ্গে বাধে দিন কেটে ছিল,  না খাওয়া অবস্থায়! আর বাছুরটা জলে ভিজে জ্বরের দাপটে মারা গেল। কি কান্না? ও ।সে ভাবা যায়। ওরাও মায়াবি জীব। পরে কিন্তু বাছুর ছাড়াই দুধ দিত। ওই গোরু গুলো নাকি বাছুর ছাড়াই দুধ দেয়!

পুজার মা রা শুয়ে পড়ল! পুজার মালতি ভাবছে
সেদিনের কথা! পুজার বাবা থাকলে হয়তো বলত পুজার মা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়! কালকে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গতে লাগবে! শশীবাবুদের বাড়ি গিয়ে জমিতে হাল দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগবে! জমিতে ধান বুনতে হবে। এখন আর জমি কই? মানুষটা বেচে থাকলেও খেটে খেতেই হত। যা হয়, জমিদার বাড়ির দুর্দিন। আহ্া........।।

অপরাজিতা (দুই):দেবব্রত সেন






হয়তো টিনের চালের বাড়ি,দোচালা চৌয়ারি ঘর দুটো ইংরেজি এল এর মতো গঠন। যদিও ঘর গুলো অনেক পুরোনো, তবুও মোটামুটি ভালোই আছে।  আর  ডিতটা সিমেন্টে পাকা করা, বাড়িটা শতকরা অঙ্কের হিসেব করলে পাঁচ  পৌনেপাঁচ কাঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে। শহর লাগোয়া তিস্তা পাড়ের গ্রাম। বর্তমান বাড়িটার চেহারা গরীব গরীব বোঝালেও গাছগুলো আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যটা এরকম যে যেকোনো লোক বাড়িটার প্রেমে পড়ে যাবে। আর গ্রামের বাড়ি গুলো একটু ফাঁকা ফাঁকাই সাধারণত হয়ে থাকে।
পূজার মা শচীনকে বারান্দায় একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো বাবা, বসো। যা গরম পরেছে সহ্য করা যায় না বাবা। একটা টেবিল ফ্যান বের করে শচীনের কাছাকাছি রেখে ফ্যানের সুইচটা অন করে দিয়ে বলল, তুমি বাবা এখানে বিশ্রাম নাও আমি বরং ঠাকুর ঘরে ফুলজল দে আসি কেমন! 
-----ঠিক আছে মাসিমা। যাই বলুন মাসিমা প্রচন্ড রোদ্দুর পড়েছে, এই সময়টা বাইরে বেরোনোটা একপ্রকার সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।
পুজার মা ঠাকুর ঘরে গেল, আকাশটা তখন চুপচাপ, শুধু গরম আর গরম!  এই সময় একটা হালকা বাতাস এল, মে জুন মাসে যেরকম লু নামের গরম বাতাস বয় ঠিক সেরকম ভাবে শীতল বাতাস এল, আকাশটা যে দীর্ঘ নিশ্বাস নিল আর কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলি হাওয়ায় বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল, দুচারটে পায়রা ডানা ঝাপটে আঙিনা থেকে টিনের চালে গিয়ে বসল, দুজোড়া পাশাপাশি!চোখ বিনিময় করছে এরকমটা বোঝাচ্ছে,   মনে হয় যেন তারাও যুগল প্রেম করছে। আর শচীন একা একা সেটা ভোগ করল,  সে ভাবছে ইস যদি আমার জীবনে কখনও  এমন সময় আসে খুব রোমান্স হবে।শচীনের ইচ্ছে হল কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে চেয়ারটা নিয়ে বসি কিন্তু হল না, ততক্ষণে পূজার মা ঠাকুর ঘর থেকে বারান্দায় এল, শচীন একা বসে আছে।
বলল,  তো এখানে কোথায় এসছো ? আমি মাসিমা 
----হুম। 
......জানতেই পাচ্ছেন আমি সাংবাদিকতার মানুষ, খবর সংগ্রহে এখানে ওখানে যেতে হয়। জানো মাসিমা,  আপনাদের পাশে জমিদারপাড়ায় একটা নারী  নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তারই কিছু তথ্য সংগ্রহে এসেছি। তাড়াতাড়ি হয়েগেল তাই ভাবলাম একটু পূজার সঙ্গে দেখা করেই যাই।
-----না না  বাবা বেশ ভালো করেছো। পুজার মুখে তোমার সাংবাদিকতার কথা শুনেছি বাবা, তবে ......
এই বলে চুপ করল।
-----তবে কি মাসিমা? বলেন সংকোচন করবেন না।
আসলে কি, পূজা আর শচীনের মধ্যে যে প্রেম ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল সেটা পূজার মা ভালো করেই আন্দাজ করেছিল, তাই বোধহয় তবে করেই থেমে গেল। আর মনে মনে যাচাই করার চেষ্টা করছে। একটা মেয়ের ভবিষ্যতের বিষয়, এটা ছেলেখেলা নয়। আর যদি ভালোভাবে তাদের সম্পর্কটা মেনে না নেয়, তাহলে হয়তো কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে,পূজার বাপটা বেচে থাকলে হয়তো তাকে এসব বিষয়ে মাথা ঘামতে হত না।  সত্যিই তো প্রেম ভালোবাসা এরকম জিনিস সেটা উপর থেকে কিছুই বোঝা যায় না অন্তরের ভিতর প্রবেশ করে বুজে নিতে হয়। এটাই ভাবছে সে।আর এটাও ঠিক মেয়ে ও ওই ছেলেদের তো মন বলে কিছু আছে, সব থেকে বড় কথা কারও মন ভাঙা হচ্ছে  মন্দির ও মসজিদ ভাঙার সমান সমান।
পুজার মা বলল,  বলছিলেম বাবা কোন পত্রিকায় কাজ করো?
---- দৈনিক জনজাগরন পত্রিকায়! 
----আচ্ছা তুমি থাক, আমি একটু  ততক্ষণে লেবু সরবত করে আনি।
-----না না মাসিমা এসবের আবার কি প্রয়োজন?
----ধুর!  চুপ কর!  বসো দেখি
পূজার মা মালতি রায়! পুজা আর শিবু যখন তিন ও দেড় বছর বয়স, তখন তার স্বামী মারা গেছে। পূজার বাবারা ছিল তিন ভাই।কিন্তু তাড়া এখন কোলকাতাতে থাকে হঠাৎ যদি খবর নেয় নেয়, আর না  হলে যোগাযোগ বন্ধ, আসলে কি পুজার মা বিধবা আর ভরন পোষনের ব্যাপার তো রয়েইছে, হয়তো এলে বুঝি টাকা করি কিংবা অর্থ করি দিয়ে সাহায্য করতে হবে এই ভয়ে। আর বেচারা পুজার মা শহরের বাবুদের বাড়িতে কাজ করে আসছে ছেলেমেয়ে দুটোকে তো  মানুষ করতে হবে!সংসারটার ভরন পোষন করতে হবে, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে হবে! আর অর্থ সাহায্য লাগলে বাবুদের কাছেই নেয়, একটু গায়ে গতরে খেটে দেয়।  এখন ওরা অসহায় ঠিকই এককালে জমিদার ছিল পরিবারটা।   জমিদার বাড়ি মানুষ আজকে বাবুদের বাড়িতে খাটছে ....আসলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ---আজকে রাজা কালকে ফকির। ঠিক সেরকম।
পূজা স্নান ছেড়ে বেরিয়ে এল, স্নান করতে করতে সে সব শুনেছে, যে  শচীন তাদের বাড়িতে এসছে ও গল্প করছে!  তবুও সে শচীনকে বলল,  আরে শচীনদা কখন এলে? আসতে অসুবিধে হয়নি তো? 
----আরে না রে পাগলি!  তো কেমন আছিস? কলেজ যাবি বুঝি?
----- আরে বাপরে বাপ কোন ছেড়ে কোনটা বলি। আচ্ছা শচীনদা তুমিই বলো যে কখন এলে।
----- শচীন বা হাতের ঘড়িটার দিকে একবার তাকাল, দেখল দশটা চল্লিশ বাজে তখন। বলল, কুড়ি মিনিট হল রে। 
------ আমি ভালো আছি দাদা। এখন কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি।
-------বেশ ভালো তো!
তোমার জানি কিসে অনার্স?
বাংলায়।
এইসময় মালতি, কাচের গ্লাসে লেবু সরবত নিয়ে এল! বলল, এই নাও ধরো বাবা একটু সরবত। খেতে খেতে না হয় গল্প হবে। 
যেহেতু খাটুনি করে বানিয়েছেন মাসিমা তবে কিন্তু না খেলেই নয়, এক চুমু দিতেই বলে উঠল, আহ মাসিমা দারুণ হয়েছে, মনে হচ্ছে এখন একটু তৃপ্তি পেলাম, 
লেবু ও পুদিনা পাতার সরবত। দারুণ লাগছে।। আমরা বাইরে যা খাই মাসিমা। বাড়িতে তো লোক নেই! আর বাপ ভাই  ছাড়া কেউ নেই। মা ছিল,  দুবছর আগে আমাদের ছেলে চলে গেছে। এখন ভাই আমি আর বাবা।
গল্প করতে করতে বেলা গড়াতে চলল, গল্পেই যেন সবাই মজে গেছে। প্রায় ১টাই বাজে, ১২:৪৭ মিনিট। মালতি বলল,  তোরা গল্প কর দেখি, আমি একটু রান্না ঘর থেকে আসি।
এদিকে রান্না হয়েছে পূজাদের বাড়ির কত আগেই । এখন শুধু খাওয়ার পালা। আর খাওয়া সেরে যে যার কাজে যাব রোজকার মতো।  তার মধ্যে বাড়িতে কেউ এলে তাকে তো অতিথি বলাই যায়।
বারান্দার টেবিলে চলে এলো পূজার মা মালতির হাত বেয়ে সাজানো থালা ভরা ভাত আর বাটি ভরা সবজি। সঙ্গে  চুনোপুটি মাছের দুটো পদও!  রসুনপেয়াজ দিয়ে চটচটি আর মাছের টক আম দিয়ে। সে দিন শিবুই গেছে পাড়ার বন্ধুদের সাথে জাল নিয়ে! ভাগাভাগি করে আড়াই /তিনশ গ্রাম মাছ সে ভাগে পেয়েছে।
হয়তো খেতে চাইছিল না শচীনবাবু, ভাবছে চুনোপুটি মাছ, আর মাছের টক!! সে অনেক দিন হল খায়নি!  মা বেচে থাকতে সেই কবে খেয়ে ছিল। এখন দোকানের ভাত তরকারি ছাড়া উদ্ধার হয় না, পেট কামরায়। সব থেকে বড় কথা হল আজকে মায়ের মতো হাতের রান্না পেয়েছে সে, খেতে রাজি হল। এদিকে অতিথি যে তাই না খেয়ে ওঠা, এটা একরকম খারাপ ছাড়া কিছুই নয়।
সময় গড়াল অনেকটা,  তাই আর কারও কোথাও যাওয়া হল না, এতক্ষনে হয়তো পুজা কলেজে যেত, আর তার মা শহরেবাবুদের বাড়িতে থালাবাসন মাজা কিংবা রান্নার কাজে লেগে যেত, আর শিবুটা স্কুলে।


(চলবে..)

দশ চক্র ( দুই) : সিদ্ধার্থ সিংহ







হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে ঋজু আর পরমার্থ অপেক্ষা করছিল। ওরা একটু আগেই এসেছে। গত কাল রাত সাড়ে বারোটায় অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে যখন ড্রপ কারের জন্য অপেক্ষা করছে ঋজু, তখন হঠাত্‌ই পরমার্থ ওর কাছে এসে বলল, এই রে, আশিস তোমাকে বলতে বলেছিল। একদম ভুলে গেছি। কাল দাঁতনে একটা উত্‌সব আছে। সেখানে কবিতা পাঠেরও ব্যবস্থা আছে। ও তোমাকে বারবার করে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?
ঋজু কী ভাবছিল। ও কিছু বলছে না দেখে পরমার্থ ফের বলল, কাল তো তোমার অফ ডে। চলো না।
— কখন?
— কাল সকালে। সাতটার সময়। হাওড়া থেকে।

হাওড়া থেকে ঋজুর বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, চেতলায়। ওখান থেকে একটাই বাস। সতেরো নম্বর। কখন আসে কোনও ঠিক নেই। তাই হাতে একটু সময় নিয়েই ও বেরিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা পার হওয়ার আগেই দেখে বাস আসছে। ফলে সাতটা নয়, তার অনেক আগেই ও চলে এসেছে। এসে দেখে, অফিস থেকে অত রাতে বাড়ি গিয়েও এই সাতসকালেই সেই বিরাটি থেকে পরমার্থও এসে হাজির। ঘড়িতে তখনও সাতটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি।
ও সামনে আসতেই পরমার্থ বলল, চা খাবে?
— ওরা আসুক না। একসঙ্গে খাব। ট্রেন ক’টায়?
— তা তো জানি না। আশিস তো বলল, সাতটার সময় এখানে দাঁড়াতে।
— এখানেই বলেছে তো?
— হ্যাঁ রে বাবা...
— সাতটা তো প্রায় বাজে।
— এখনও বাজেনি। আসবে তো সেই সল্টলেক থেকে। সবার বাড়ি তো আর তোমার মতো হাওড়া স্টেশনের পাশে নয়, যে বাসে উঠলাম আর হাওড়ায় পৌঁছে গেলাম। চা খাবে? ওই তো আশিস...
ঋজু দেখল, শুধু আশিস নয়, ট্যাক্সি থেকে একে একে নামছে আরও তিন জন। তার মধ্যে দু’জন মহিলা।
আশিস কাজ করে আকাশবাণীতে। পরের সপ্তাহে রেডিওতে কী কী অনুষ্ঠান হবে, সেই অনুষ্ঠান-সূচি আনতে প্রত্যেক সপ্তাহে পরমার্থকে যেতে হয় ওর কাছে। আনন্দবাজারের যে দফতরে ও কাজ করে, সেখানে প্রুফ দেখা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ওই অনুষ্ঠান-সূচি এনে কম্পোজ করে দেওয়া ওর কাজ।
এই কাজ করতে করতেই আশিসের সঙ্গে ওর বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রেই পরমার্থ যেমন জেনেছে, ও লোকসঙ্গীত গায়। কবিতা লেখে। দুটো কবিতার বইও বেরিয়েছে। শুধু ও একাই নয়, ওর বউ রিনাও কবিতা লেখে। তেমনি আশিসও জেনেছে, পরমার্থও ইদানিং কবিতা লিখতে শুরু করেছে। অনেক কবির সঙ্গেই ওর আলাপ আছে। ওর মুখেই ঋজুর নাম শুনে আশিস বলেছিল, উনি কি আপনাদের অফিসে কাজ করেন নাকি?
— কেন, আপনি চেনেন?
আশিস বলেছিল, না, আলাপ নেই। তবে ওর অনেক কবিতা পড়েছি। উনি তো প্রচুর লেখেন। এত লেখেন কী করে? আপনার সঙ্গে ওনার কী রকম সম্পর্ক?
পরমার্থ বলেছিল, ভালই। ও তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছে।
— তাই নাকি? পারলে এক দিন নিয়ে আসুন না, জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

ঋজুকে সে কথা বলতেই ঋজু বলেছিল, ঠিক আছে এক দিন যাবখ’ন। কিন্তু আজ নয়, কাল নয়, করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। তাই পরমার্থ এক দিন ওকে বলল,


আরে বাবা চলো না, গেলে তোমার লাভই হবে। ও এখন অভিজ্ঞানটা দেখে। কবিতা পড়ার জন্য ওর পেছনে কত লোক ঘুরঘুর করে, জানো? আর ও নিজে থেকে তোমাকে ডাকছে, তুমি যাবে না? ওখানে কবিতা পড়লে পাঁচশো টাকা দেয়।
তাতেও খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না দেখে ঋজুকে প্রায় জোর করেই ও একদিন নিয়ে গিয়েছিল আকাশবাণীতে। সেই আলাপ। তার পর এই।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে সামলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের সামনে দিয়ে যেতে যেতেই আশিস বলল, চলে আসুন, চলে আসুন। দেরি হয়ে গেছে।
ও আগে আগে। পেছনে ঋজুরা। তারও পেছনে ট্যাক্সি থেকে নামা বাকি তিন জন।
কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না। টিকিট-ফিকিট কেটে ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। না। ট্রেনেও খুব একটা ভিড় নেই। ছুটির দিন। তাই ফাঁকা ফাঁকা। একটা খোপেই ওরা সবাই বসার জায়গা পেয়ে গেল। এ দিকের সিটে ঋজু, পরমার্থ আর ট্যাক্সি থেকে নামা কোর্ট-প্যান্ট পরা ওই ভদ্রলোক। বাকিরা উল্টো দিকের সিটে। ট্রেন ছাড়ার আগেই আশিস সবার সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দিল। কোর্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটাকে দেখিয়ে বলল, ইনি মহাদেব মোশেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বিবাহের ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক একটা বই লিখেছেন। এ ছাড়া ছড়া-টাড়াও লেখেন। আর ইনি হচ্ছেন কণিকা রায়। কলকাতা টেলিফোন্‌সে কাজ করেন। এখন টেলিফোন ভবনে, না? কণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন তার কাছে জানতে চাইল। তার পরে বলল, ক’দিন আগে ওর একটা সুন্দর কবিতার বই বেরিয়েছে। আর এর পরিচয় কী দেব, ইনি আমার গিন্নি, রিনা গিরি।
ঋজু মহাদেববাবুর দিকে তাকাল। মহাদেববাবু আর কণিকার কথাবার্তা দেখে হঠাৎ কেন জানি ঋজুর মনে হল, ওদের মধ্যে কোনও একটা সম্পর্ক আছে।


(চলবে )

রুহীর পুতুল : রাজিত বন্দোপাধ্যায়







।। ১ ।।




-- রুহী ? ... রুহী --- কোথায় গেল মেয়ে টা , একদন্ড যদি স্থির থাকে !    
মায়ের সহকর্মীদের সাথে কথা বলবার ফাঁকে রুহী মেন রোডের ফুটপাত সংলগ্ন বড় কাঁচ ঢাকা দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে । মার ডাক কানে এলেও নড়তে পারছে না । পুতুলটার চোখে চোখ পড়তেই তার মনে হল যেন জাদু আছে পুতুলটার চোখে । হঠাৎই ঐ চুল বিহীন ডল পুতুলটাকে ফুটপাতের পাশের বড় দোকানটার শোকেসে দেখে সে এগিয়ে এসেছিল । অনেদিন ধরে তার একটা বড় ডল পুতুলের শখ । অথচ মাথায় চুল নেই দেখে কিঞ্চিত অবাক হয়েই সে আকৃষ্ট হয়েছিল । মা ডাকছে , কিন্তু নড়তে পাড়ছে না সে । পুতুল টা তার মন নিশ্চই পড়তে পারছে , না হলে হঠাৎই তার মাথায় চুল গজাতে যাবে কেন ! নিজের বড় বড় পেলব দু চোখ মেলে সে শিহরিত হতে হতে দেখতে লাগল পুতুলটাকে । হঠাৎ মার ছায়া নিজের পাশে দেখে শোরুমের কাঁচে আঙ্গুল দিয়ে পুতুল টা দেখিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ স্বরে সে বললে ,  
-- মা , আমায় এই জাদু পুতুল টা কিনে দাওনা মা ।    
-- তোমার সব পুতুলই তো জাদু পুতুল লাগে । আমার কাছে অত পয়সা নেই বুঝেছো ? চল এখান থেকে ।   
মা তার হাত ধরে গজগজ করতে করতে হাঁটতে লাগল ।  
-- আমার হয়েছে যত জ্বালা । তিনি তো এই আদুরে মেয়ে আমার ঘাড়ে ফেলে কোথায় ডুব দিলেন । আর এবার ভুগে মর তুই ।   
রুহী কিন্তু তখনও মুগ্ধ দুই চোখে পিছু ফিরে দেখেই চলেছে ঐ দোকানটাকে ।     
                  
                                                                   [ চলবে ]

দশচক্র : সিদ্ধার্থ সিংহ





হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে ঋজু আর পরমার্থ অপেক্ষা করছিল। ওরা একটু আগেই এসেছে। গত কাল রাত সাড়ে বারোটায় অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে যখন ড্রপ কারের জন্য অপেক্ষা করছে ঋজু, তখন হঠাত্‌ই পরমার্থ ওর কাছে এসে বলল, এই রে, আশিস তোমাকে বলতে বলেছিল। একদম ভুলে গেছি। কাল দাঁতনে একটা উত্‌সব আছে। সেখানে কবিতা পাঠেরও ব্যবস্থা আছে। ও তোমাকে বারবার করে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?
ঋজু কী ভাবছিল। ও কিছু বলছে না দেখে পরমার্থ ফের বলল, কাল তো তোমার অফ ডে। চলো না।
— কখন?
— কাল সকালে। সাতটার সময়। হাওড়া থেকে।

হাওড়া থেকে ঋজুর বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, চেতলায়। ওখান থেকে একটাই বাস। সতেরো নম্বর। কখন আসে কোনও ঠিক নেই। তাই হাতে একটু সময় নিয়েই ও বেরিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা পার হওয়ার আগেই দেখে বাস আসছে। ফলে সাতটা নয়, তার অনেক আগেই ও চলে এসেছে। এসে দেখে, অফিস থেকে অত রাতে বাড়ি গিয়েও এই সাতসকালেই সেই বিরাটি থেকে পরমার্থও এসে হাজির। ঘড়িতে তখনও সাতটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি।
ও সামনে আসতেই পরমার্থ বলল, চা খাবে?
— ওরা আসুক না। একসঙ্গে খাব। ট্রেন ক’টায়?
— তা তো জানি না। আশিস তো বলল, সাতটার সময় এখানে দাঁড়াতে।
— এখানেই বলেছে তো?
— হ্যাঁ রে বাবা...
— সাতটা তো প্রায় বাজে।
— এখনও বাজেনি। আসবে তো সেই সল্টলেক থেকে। সবার বাড়ি তো আর তোমার মতো হাওড়া স্টেশনের পাশে নয়, যে বাসে উঠলাম আর হাওড়ায় পৌঁছে গেলাম। চা খাবে? ওই তো আশিস...
ঋজু দেখল, শুধু আশিস নয়, ট্যাক্সি থেকে একে একে নামছে আরও তিন জন। তার মধ্যে দু’জন মহিলা।
আশিস কাজ করে আকাশবাণীতে। পরের সপ্তাহে রেডিওতে কী কী অনুষ্ঠান হবে, সেই অনুষ্ঠান-সূচি আনতে প্রত্যেক সপ্তাহে পরমার্থকে যেতে হয় ওর কাছে। আনন্দবাজারের যে দফতরে ও কাজ করে, সেখানে প্রুফ দেখা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ওই অনুষ্ঠান-সূচি এনে কম্পোজ করে দেওয়া ওর কাজ।
এই কাজ করতে করতেই আশিসের সঙ্গে ওর বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রেই পরমার্থ যেমন জেনেছে, ও লোকসঙ্গীত গায়। কবিতা লেখে। দুটো কবিতার বইও বেরিয়েছে। শুধু ও একাই নয়, ওর বউ রিনাও কবিতা লেখে। তেমনি আশিসও জেনেছে, পরমার্থও ইদানিং কবিতা লিখতে শুরু করেছে। অনেক কবির সঙ্গেই ওর আলাপ আছে। ওর মুখেই ঋজুর নাম শুনে আশিস বলেছিল, উনি কি আপনাদের অফিসে কাজ করেন নাকি?
— কেন, আপনি চেনেন?
আশিস বলেছিল, না, আলাপ নেই। তবে ওর অনেক কবিতা পড়েছি। উনি তো প্রচুর লেখেন। এত লেখেন কী করে? আপনার সঙ্গে ওনার কী রকম সম্পর্ক?
পরমার্থ বলেছিল, ভালই। ও তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছে।
— তাই নাকি? পারলে এক দিন নিয়ে আসুন না, জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

ঋজুকে সে কথা বলতেই ঋজু বলেছিল, ঠিক আছে এক দিন যাবখ’ন। কিন্তু আজ নয়, কাল নয়, করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। তাই পরমার্থ এক দিন ওকে বলল, আরে বাবা চলো না, গেলে তোমার লাভই হবে। ও এখন অভিজ্ঞানটা দেখে। কবিতা পড়ার জন্য ওর পেছনে কত লোক ঘুরঘুর করে, জানো? আর ও নিজে থেকে তোমাকে ডাকছে, তুমি যাবে না? ওখানে কবিতা পড়লে পাঁচশো টাকা দেয়।
তাতেও খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না দেখে ঋজুকে প্রায় জোর করেই ও একদিন নিয়ে গিয়েছিল আকাশবাণীতে। সেই আলাপ। তার পর এই।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে সামলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের সামনে দিয়ে যেতে যেতেই আশিস বলল, চলে আসুন, চলে আসুন। দেরি হয়ে গেছে।
ও আগে আগে। পেছনে ঋজুরা। তারও পেছনে ট্যাক্সি থেকে নামা বাকি তিন জন।
কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না। টিকিট-ফিকিট কেটে ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। না। ট্রেনেও খুব একটা ভিড় নেই। ছুটির দিন। তাই ফাঁকা ফাঁকা। একটা খোপেই ওরা সবাই বসার জায়গা পেয়ে গেল। এ দিকের সিটে ঋজু, পরমার্থ আর ট্যাক্সি থেকে নামা কোর্ট-প্যান্ট পরা ওই ভদ্রলোক। বাকিরা উল্টো দিকের সিটে। ট্রেন ছাড়ার আগেই আশিস সবার সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দিল। কোর্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটাকে দেখিয়ে বলল, ইনি মহাদেব মোশেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বিবাহের ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক একটা বই লিখেছেন। এ ছাড়া ছড়া-টাড়াও লেখেন। আর ইনি হচ্ছেন কণিকা রায়। কলকাতা টেলিফোন্‌সে কাজ করেন। এখন টেলিফোন ভবনে, না? কণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন তার কাছে জানতে চাইল। তার পরে বলল, ক’দিন আগে ওর একটা সুন্দর কবিতার বই বেরিয়েছে। আর এর পরিচয় কী দেব, ইনি আমার গিন্নি, রিনা গিরি।
ঋজু মহাদেববাবুর দিকে তাকাল। মহাদেববাবু আর কণিকার কথাবার্তা দেখে হঠাৎ কেন জানি ঋজুর মনে হল, ওদের মধ্যে কোনও একটা সম্পর্ক আছে।
বেশ কিছু দিন আগে স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনে জটলা দেখে ও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জটলার মধ্যমণি মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রমহিলা। তাঁর অভিযোগ, তাঁর স্বামী এই কলেজে পড়ান। তাঁরই এক ছাত্রীর সঙ্গে তিনি প্রেম করেন। তাঁকে বহু বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাঁর বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে। তারা স্কুলে পড়ে। স্কুলের মাইনে পর্যন্ত উনি দিচ্ছেন না। সংসার খরচা তো নয়ই। সব ওই মেয়েটার পেছনে ঢালছেন। তাই শেষ পর্যন্ত উনি নাকি থানায় গিয়েছিলেন। থানা থেকেও ভদ্রলোককে ডেকে বলে দিয়েছে, যাতে তিনি ঠিকঠাক মতো সংসার করেন। বউয়ের গায়ে যেন হাত না তোলেন। অথচ তার পর থেকেই তিনি আর বাড়ি ফিরছেন না। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য উনি কলেজে এসেছিলেন। কিন্তু টিচার্স রুমের সামনে যেতেই উনি তাঁকে দেখতে পেয়ে যান। অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁকে ধাক্কা মেরে এক দৌড়। ভদ্রমহিলা এখন বলছেন, উনি এ দিকেই এসেছেন, আপনারা কেউ কি দেখেছেন? ঘিয়ে রঙের জামা পরা। কালো প্যান্ট। চোখে চশমা। মাথায় পাতলা-পাতলা চুল...
ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল ঋজুর। মহাদেববাবু আবার সে রকম নন তো! ঘরে বউ-ছেলেমেয়ে সব আছে। আর বাইরে এর সঙ্গে... এরা নিশ্চয়ই স্বামী স্ত্রী নন। ওঁর পদবি তো রায়। আর এঁর মোশেল।
টুকটাক কথা হচ্ছিল। ঋজু কথায় কথায় মহাদেববাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?
উনি বললেন, সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে।
— আর আপনি? কণিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ঋজু।
— আমিও সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে।
— ও। দু’জনেই কাছাকাছি থাকেন?
হঠাত্‌ মহাদেববাবু বলে উঠলেন, কাছাকাছি নয়, খুব কাছাকাছি। একই বাড়িতে। একই ঘরে। আসলে আমি ওর বাড়িতে থাকি।
কথাটা শুনে একটু থতমত খেল ঋজু। এত দিন ও শুনেছে, ছেলেরা মেয়েদের রক্ষিতা রাখে। এ তো উল্টো কেস। মেয়েটা এঁকে রেখেছে! নাকি মেয়েটা তাঁর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট চালায়! ঋজু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কী? ও তখন মনে মনে ওর মতো করে দুই আর দুইয়ে চার করার চেষ্টা করছে।
তখন আশিসই বলল, এখনও বুঝতে পারলেন না, ওরা কর্তা-গিন্নি। ওদের আনতে গিয়েই তো এত দেরি হয়ে গেল।
কণিকা বলল, আমার কোনও দোষ নেই। আমি তো আসব না বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু রিনা গত কাল রাতে এত বার করে বলল যে, না এসে থাকতে পারলাম না। আর তা ছাড়া ছুটির দিনে এত তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যাস নেই তো...
ওকে মাঝপথে থামিয়ে মহাদেববাবু বললেন, আমি কিন্তু তোমাকে সাড়ে পাঁচটায় ডেকে দিয়েছিলাম।

ট্রেন চলছিল। কথা হচ্ছিল। জানালা দিয়ে হুহু করে হাওয়া আসছে। কণিকার কপালের দু’দিক দিয়ে নামানো দুটো লকস বারবার ওর চোখের উপরে এসে পড়ছে। হঠাৎ মহাদেববাবু তাঁর কোর্টের ভিতর পকেট থেকে একটা ছোট্ট পকেট-বুক বার করে ঋজুর দিকে এগিয়ে দিলেন— এটা বহু দিন আগে বেরিয়েছিল। তখন ছড়াই লিখতাম। এখন আর সময় পাই না।
ঋজু উল্টেপাল্টে দেখছে। একটা পড়তে গিয়েই হুচোট খেল। প্রচ্ছদ দেখে মনে হয়েছিল ছোটদের বই। কিন্তু এ কী! বইটা বন্ধ করে আশিসের দিকে এগিয়ে দিল। আশিস বলল, এটা আমি আগেই দেখেছি।
শব্দ ক’টার মধ্যে বইটা হাতে নেবার সামান্যতম সম্ভাবনা না দেখে রিনার দিকে বাড়িয়ে দিল ঋজু। বইটা হাতে নিয়ে রিনা বলল, এটা আমার পড়া। যখন বেরিয়েছিল, তখনই উনি দিয়েছিলেন। এখনও বোধহয় বাড়িতে আছে।
পরমার্থ বলল, ঋজুর কিন্তু অনেকগুলো বই আছে। তার পর ঋজুর দিকে তাকিয়ে বলল, সঙ্গে আছে নাকি?
— হ্যাঁ, আছে বোধহয়। বলেই, কাঁধের ব্যাগ থেকে দুটো বই বার করল ঋজু। একটা গল্পের আর একটা কবিতার।
পরমার্থ গল্পের বইটা নিয়ে আশিসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, জানো তো, এই গল্পটা যখন সানন্দায় বেরোয়, তখন বিশাল হইচই হয়েছিল। ওর বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার মামলা হয়েছিল।
ঋজু একটু লজ্জার ভান করে বলল, না না। আমার একার নামে নয়। আমাদের পাঁচ জনের নামে পাঁচ কোটি। আমার নামে শুধু এক কোটি।
— তাই নাকি? কী হয়েছিল? মহাদেববাবু জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন।
পরমার্থ বলল, সে সময় তো সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এটা বেরিয়েছিল...
— তাই নাকি? ঋজুর দিকে তাকিয়ে মহাদেববাবু বললেন, কী হয়েছিল?
ঋজু বলল, আসলে আমি তখন সানন্দায় ফ্রিল্যান্স করি। মানে, লেখা ছাপা হলে টাকা পাই। না হলে, নয়। তো, সানন্দায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সিদ্ধার্থ সরকার আর অনিরুদ্ধ ধর ছিলেন আমার খুব কাছের মানুষ। তা, ওঁরা ঠিক করলেন, উত্তমকুমারকে নিয়ে একটা টিভি সিরিয়াল বানাবেন। তো, আমিও ভিড়ে গেলাম ওঁদের সঙ্গে। লেখালিখি তখন মাথায় উঠেছে। কিন্তু না লিখলে আমার চলবে কী করে? অনিরুদ্ধদাকে সে কথা বলতেই উনি বললেন, গল্প লিখতে পারবি? আমি তখন কবিতা ছড়া লিখি। তবু বললাম, পারব। উনি বললেন, তা হলে আজকে রাতের মধ্যেই একটা গল্প লিখে ফেল। কাল বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে পিটিএসে ধরিয়ে দিস। পিটিএস মানে, যেখানে কম্পোজ হয়। আমি বললাম, তুমি দেখবে না? উনি বললেন, তোর লেখা আবার দেখার কী আছে? ঠিক আছে, প্রুফে দেখে নেব। তার পর যখন লেখাটা ছেপে বেরোল, স্টলে খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, আশপাশের কোনও স্টলে সানন্দা নেই। সে দিনই বেলার দিকে লোকাল কাউন্সিলারের সঙ্গে আমার বাড়িতে এসে হাজির সৌগত রায়।
— কোন সৌগত রায়? আমাদের সৌগত রায়? অধ্যাপক?
পরমার্থ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কংগ্রেসের এমএলএ।
— তার পর?


ক্রমশঃ...

অপরাজিতা(প্রথম পর্ব) : দেবব্রত সেন






কতই বা বয়স বাপ মরা মেয়েটার, সবে স্কুল ছেড়ে কলেজে পা দিয়েছে। এরই মধ্যে আবার গোলাপের হাবুডুবু, রঙ্গিলা বাতাসের গুন গুন সূর। ভালোবাসার পরশপাথর ছুঁয়েছে, হৃদয়পূর্ণ কোকিল কোকিলা মন। মধু চন্দ্রিমার রাতে শশীবাবু যেমন একলা বসে থাকা রুপসীর ঘরে জানলা দিয়ে উকি মারে কিংবা কোনো এক দুপুরে ছায়া ঘেঁষা শ্রাবণী মেঘের বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধে শালিক জোড়াযুগলের অপরুপ রোমান্টিক দৃশ্যের মতো।  তার পর আর কি! বিয়ে -সংসার জীবন। মেয়ে মানুষের নাকি স্বামী ব্রত প্রধান ধর্ম।


১//সকালবেলা একনাগাড়ে মোবাইলটা বেজেই চলছে

সকালবেলা একনাগাড়ে মোবাইলটা বেজেই চলছে, ঘরটা শূন্য মানবহীন! শোনার কেউ নেই একলা বসে শুনছে ঘরটা। থাকলেও থাকতে পারে, তবে হয়তো যে যার কাজে ব্যাস্ত আছে ক্ষন, তাই বোধ হয় এরকম হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর, দশ সাড়ে দশটা নাগাদ হবে, একজন যুবকের বাইক এসে দাঁড়াল পূজাদের বাড়ির সামনে। এসেই দেখল কলিংবেল আছে! সে কলিংবেল টিপল। সঙ্গে সঙ্গে পূজার মা পূজাকে বলল, এই পূজা, পূজা কই গেলি মা! দ্যাখ না কে এল। পুজা তখন স্নান করছে, সে কলেজে যাবে! পূজা স্নান ঘর থেকে বলল, মা আমি স্নানে। তুমি যাও। আমি পারব না মা।
ঠিক এই সময়ে আবার কে এল বাবা আর পারছি না, ঠাকুর ঘর ফেলে আসতে হচ্ছে এই বলতে বলতে পূজার মা বাড়ির উঠান পেরিয়ে সদর দরজার কাছে এল এবং দরজা খুলে দেখল  বছর পচিঁশ ছাব্বিশের একজন যুবক, কাধে একটা ব্যাগ ঝোলানো, চোখে চশমা, গায়ের রং ফরসা আর লম্বা। সে দাড়িয়ে আছে কখন দরজা খুলবে তার অপেক্ষায়।

দরজা খোলার সাথে পুজার মা একটু হতভম্ব হল কারন এই ছেলেটা হঠাৎ করে, তাছাড়া ওনার ছেলের বন্ধু বান্ধব হলে না হয় হত কিন্তু ছেলের বয়স চৌদ্দ পনের হবে,  আর এই ছেলেটা এসে দাড়িয়ে আছে সে তো বয়সে অনেক বড়! পূজার মা গড় হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারল না, সে শুধু অবাক দৃষ্টিতে ভাবতেই লাগল। আত্মীয় স্বজন হলেও হতো কিন্তু সেই ছেলেটা অচেনা, কি আর বলবে?
এরম করতে করতে পূজার মা আমতো আমতো করে ছেলেটাকে বলল, আপনি কে বাপু? আপনাকে তো এর আগে দেখিনি?
------আপনি পুজার মা তো?
---- আজ্ঞে হুম, বলুন।
-----নমস্কার নেবেন মাসিমা, আমি শচীন বর্মন, বাড়ি শিলিগুড়ি শিব মন্দির এলাকায়।
-----সে কি মাসিমা পুজা আপনাকে আমার ব্যাপারে কিছু বলেনি?

পুজার মা একটু ঘাবরে গেলেন আর ভাবলেন বাইরের একটা অচেনা ছেলে আমাকে কিসব বলছে, বিষয়টা ভালো ঠেকছে না।
হুম মনে পড়েছে, কলেজে প্রথম প্রথম যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে পুজা একটি ছেলের কথা বলেছিল কিন্তু সে তো সাংবাদিকতার চাকরি করত! আলাপ হয়েছে পূজার কলেজে, কিন্তু সে আবার প্রেম করছে না তো?  আমাদের মতো গরিবের কপালে প্রেমট্রেম হজম হয় না বাবা, সে না হলেই ভালো হয়। এই ভাবে ভাবতে বলল, ও হ্যাঁ মনে পরেছে। আপনিই তাহলে সেই শচীন? আমি ভাবছি কোন, কোন শচীন! এসো বাড়ির ভেতর এসো।

শচীন পূজাদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেই দাড়িয়ে পড়ল, কারনটা কি! পুজা তাকে বলেছিল ওদের বাড়ির উঠানের উত্তর দিকে একটা নারকেল গাছ আর সেখানে বৈশাখ - জ্যৈষ্ঠে বাবুই পাখির দল বাসা বানিয়েছে, দেখতে লাগছে খুবই সুন্দর যেন সবুজ সবুজ কলসী ঝুলছে। অন্য দিকে উঠানে প্রবেশ করার মুহূর্তে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ, গাছে লালে লাল ফুলে ছেয়ে গেছে দেখলে চোখ জুড়োয়। আর পায়রা গুলো বাকুম বাকুম করে ডাকছে,  এ টিনের চাল থেকে ও চাল উড়ে যাচ্ছে। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। পুজার মা বলল, কি দেখছো বাবা? বারান্দায় চেয়ার টেনে বসো যাও।

হয়তো টিনের চালের বাড়ি,দোচালা চৌয়ারি ঘর দুটো ইংরেজি এল এর মতো গঠন। যদিও ঘর গুলো অনেক পুরোনো, তবুও মোটামুটি ভালোই আছে।  আর ডিতটা সিমেন্টে পাকা করা, বাড়িটা শতকরা অঙ্কের হিসেব করলে পাঁচ পৌনেপাঁচ কাঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে। শহর লাগোয়া তিস্তা পাড়ের গ্রাম। বর্তমান বাড়িটার চেহারা গরীব গরীব বোঝালেও গাছগুলো আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যটা এরকম যে যেকোনো লোক বাড়িটার প্রেমে পড়ে যাবে। আর গ্রামের বাড়ি গুলো একটু ফাঁকা ফাঁকাই সাধারণত হয়ে থাকে।

পূজার মা শচীনকে বারান্দায় একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো বাবা, বসো। যা গরম পরেছে সহ্য করা যায় না বাবা। একটা টেবিল ফ্যান বের করে শচীনের কাছাকাছি রেখে ফ্যানের সুইচটা অন করে দিয়ে বলল, তুমি বাবা এখানে বিশ্রাম নাও আমি বরং ঠাকুর ঘরে ফুলজল দে আসি কেমন!
-----ঠিক আছে মাসিমা। যাই বলুন মাসিমা প্রচন্ড রোদ্দুর পড়েছে, এই সময়টা বাইরে বেরোনোটা একপ্রকার সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।

পুজার মা ঠাকুর ঘরে গেল, আকাশটা তখন চুপচাপ, শুধু গরম আর গরম!  এই সময় একটা হালকা বাতাস এল, মে জুন মাসে যেরকম লু নামের গরম বাতাস বয় ঠিক সেরকম ভাবে শীতল বাতাস এল, আকাশটা যে দীর্ঘ নিশ্বাস নিল আর কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলি হাওয়ায় বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল, দুচারটে পায়রা ডানা ঝাপটে আঙিনা থেকে টিনের চালে গিয়ে বসল, দুজোড়া পাশাপাশি!চোখ বিনিময় করছে এরকমটা বোঝাচ্ছে,   মনে হয় যেন তারাও যুগল প্রেম করছে। আর শচীন একা একা সেটা ভোগ করল, সে ভাবছে ইস যদি আমার জীবনে কখনও এমন সময় আসে খুব রোমান্স হবে।শচীনের ইচ্ছে হল কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে চেয়ারটা নিয়ে বসি কিন্তু হল না, ততক্ষণে পূজার মা ঠাকুর ঘর থেকে বারান্দায় এল, শচীন একা বসে আছে।
বলল,  তো এখানে কোথায় এসছো ? আমি মাসিমা
----হুম।
......জানতেই পাচ্ছেন আমি সাংবাদিকতার মানুষ, খবর সংগ্রহে এখানে ওখানে যেতে হয়। জানো মাসিমা,  আপনাদের পাশে জমিদারপাড়ায় একটা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তারই কিছু তথ্য সংগ্রহে এসেছি। তাড়াতাড়ি হয়েগেল তাই ভাবলাম একটু পূজার সঙ্গে দেখা করেই যাই।
-----না না  বাবা বেশ ভালো করেছো। পুজার মুখে তোমার সাংবাদিকতার কথা শুনেছি বাবা, তবে ......
এই বলে চুপ করল।
-----তবে কি মাসিমা? বলেন সংকোচন করবেন না।

আসলে কি, পূজা আর শচীনের মধ্যে যে প্রেম ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল সেটা পূজার মা ভালো করেই আন্দাজ করেছিল, তাই বোধহয় তবে করেই থেমে গেল। আর মনে মনে যাচাই করার চেষ্টা করছে। একটা মেয়ের ভবিষ্যতের বিষয়, এটা ছেলেখেলা নয়। আর যদি ভালোভাবে তাদের সম্পর্কটা মেনে না নেয়, তাহলে হয়তো কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে,পূজার বাপটা বেচে থাকলে হয়তো তাকে এসব বিষয়ে মাথা ঘামতে হত না।  সত্যিই তো প্রেম ভালোবাসা এরকম জিনিস সেটা উপর থেকে কিছুই বোঝা যায় না অন্তরের ভিতর প্রবেশ করে বুজে নিতে হয়। এটাই ভাবছে সে।আর এটাও ঠিক মেয়ে ও ওই ছেলেদের তো মন বলে কিছু আছে, সব থেকে বড় কথা কারও মন ভাঙা হচ্ছে মন্দির ও মসজিদ ভাঙার সমান সমান।



(চলবে ...)

শ্রীময়ী(দ্বিতীয় পর্ব)

         







শ্যামল কুমার রায়, সহ শিক্ষক,
নবগ্রাম ময়না পুলিন বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়।




               দ্বিতীয় পর্ব 
               -----------------



     মাখন ফিরে এসে তিতলি কে প্রপোজ্ করল । অধ্যাপিকা তিতলি সলজ্জ হেসে বলল, " জানি না যাও ।" কিন্তু অবাঙালী তাও আবার মারোয়াড়ি পরিবারে মাছ ভাত খাওয়া বাঙালি মেয়ে? ছি!ছি!ছি!বেটা , মাখন, ইয়ে গলত হ্যায়।

আবার মেয়ে প্রফেসর তো কি হয়েছে? বংশ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে? একদিকে, এত বছরের জমানো কৃতজ্ঞতা, রক্ত ঋণ শোধ করার সময়ে মা বাবা কেউ বুঝল না । আর মাখন কে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করা যায়, শরীর দেওয়া যায়, তার ঔরসজাত সন্তানের মা হওয়া যায়, কিন্তু মনের জমির দখলীসত্ব কি করে দেবে , তিতলি? ওর মনের জমির মালিক যে একমাত্র, একমাত্র মাখন । সুতরাং আর কি? এক কাপড়ে তিতলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা মাখনের কর্পোরেট অফিসে। জ্যোতিষী শ্রী ঋষিকেশ শাস্ত্রী বলেছিলেন, " মাখনের বৃহস্পতি তুঙ্গী । " আর মাখনের ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ হবে। আমেরিকা যাওয়ার আগে মাখন তিতলি কে নিয়ে শাস্ত্রী আঙ্কেলের কাছে  গিয়েছিল । যোটক নিঃসন্দেহে রাজযোটক। কিন্তু রান অ্যাওয়ে ম্যারেজ। পরিনতি যখন জানাই ছিল, তখন তো আর সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই । তিতলি কে নিয়ে মাখন নিজের পাওয়া অফিসের ফ্ল্যাটে। প্রেমিক আর স্বামী কখনো এক হয় না , বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। তিতলি তাই অধ্যাপনা  সামলে স্ত্রী ধর্ম পালন করত। প্রকৃতির নিয়মে মাখন আর তিতলির কোল আলো করে এল সৌমদর্শন মুকেশ । সব অভিমান , জমানো ক্ষোভ, ব্যাথা নিমেষ উধাও হয়ে গেল নাতি হওয়ার আনন্দে। সম্পর্কটা শুধু আর তিতলি আর মাখনের মধ্যে রইল না, জোড়া লাগল দুটো পরিবারের মধ্যেও ।


(চলবে...)

ব এ বর্ণমালা ( অ - ক্ষ )(ষষ্ঠ পর্ব)





মাধব মন্ডল 
**********


কবি পরিচিতি:
সাংবাদিকতায় এম. এ.; বি.এড.।১৯৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত একফর্মার কবিতার বই ‘ছায়াপাত’।আনন্দবাজার ও বর্তমান পত্রিকার প্রশংসা পেয়েছিল।ছড়া এবং কবিতা নিয়ে লেখালেখি।বর্তমানে ফেসবুক ও বাংলা কবিতা.কম এ নিয়মিত লেখালেখি।রাজ্য সেচ দপ্তরে কর্মরত।ছোটদের একটি স্কুলের সম্পাদকও।১৯৬৮ এর মার্চে জন্ম।জন্মস্থান সুন্দরবন,বর্তমানে সোনারপুরে বাসস্থান ।




আমি জানি মাঝে মাঝে তুই বিপুল বিষাদী 
চুপচাপ হাঁটিস
তোর মুখ শুকিয়ে মরুভূমি
বাঁদিক বরাবর
ডানদিকেও একলা থাকিস।

কি করি কি করি ভাবতেই থাকি আর
এক আঁচলা বিদ্যাধরীর জল আনি
ছিটাই তোর চোখে মুখে
ক্ষণিকে শান্ত হোস
সাগরী ঢেউ ঝাঁপায় অন্তরে অন্তরে।

এবার আর তোকে কোল ছাড়া করবই না
সুর করে মেখে রাখি তাই কাজে অকাজে
তোর কানে সুর দেব
ঐ নদী দিয়ে দেব
রোদে জলে রাতে বেরাতে ওর বুকে নিঃশব্দ ঘুমাস।


কাল রাতটা কাল রাতের মতই কেটে গেল
রাত জাগা হুতোমেরা লজ্জা পেল শুধু
চারদিকে এত আলো
ঝলসে গেল অন্ধকারেরা
মানুষের মনেই তা`লে হুতোমের বাসা!

আজ ক'দিন হল
সত্যি কথা বলতে কি
আমি একা একাই তোর সঙ্গে কথা নিয়ে খেলছি
মাঝে মাঝে কি রাগাটাই রাগছিস
এহ বাহ্য
তোর রাগগুলোকেও খাচ্ছি সশব্দ!

কিন্তু কাল যে কি হল
আবছা আবছা একটা ছায়া নড়ছে চড়ছে
আমাকে ফিসফিস করে বলল
নে নে চল চল চল চল 
কি আশায় পড়ে আছিস পাগল!
অকস্মাৎ
অকস্মাৎ মর্মভেদী ডাক সন্তানের।

অতঃপর 
অতঃপর বাস্তবে ফিরি
বড় কি দেরি হয়ে গেল!
এখনও কি শীত শেষে কৃষ্ণরা নাচায়?
এখনও কি চড়াই পাখি কিচিমিচি ডাকে?
শিম ঝোপে ছাতার এসে বসে আর ছটপট করে?
অকস্মাৎ মর্মভেদী ডাক সন্তানের
কাল রাতটা কাল রাতের মতই কেটে গেল!


এইমাত্র শ্মশান থেকে ফিরছি
আসলে কি জানেন
খুব ছোট থেকেই ওর শরীরে এ বিষ ঢুকেছিল
আধুনিক চিকিৎসাও কোন কাজে এল না
অতঃপর সব শেষ!

অতঃপর সব শেষ হয়ে গেল
শ্মশানে যেতে যেতে শকুন বাচ্চার কান্না শুনি
একদল সমব্যথী রাস্তা-কুকুর সঙ্গ নেয়
ঐ তো শ্মশানের ছায়া ছায়া গাছ
একটি মাতাল গদগদ হল।

অতঃপর চিতার আয়োজন
ডোমকে চোলাই দিলাম পরিমাণ মত
শ্মশান শাসক নেতিয়ে পড়ল কিঞ্চিত পরে
একে একে সব সুতো ঐ চিতা খায়
সাক্ষ্মী শ্মশান পাখি,কুকুরের দল।

অতঃপর সেই মুহূর্ত!
ভূত্বকে ধুলোর উপর পদ্মাসনে আমি
হিঁচড়ে আনি শরীর থেকে নিজের একান্তকে
হায়, একি তোর হাল
মানুষকে ভালবেসে ভালবেসে!

দৃঢ় প্রত্যয়ে উঠে পড়ি
চিতার মধ্যে ঢুকি অতঃপর
আগুনকে ভালবেসে বলি
আঃ, কি শান্তি! কি শান্তি!
এই নাও আচ্ছন্নকে পরিমার্জনা কর।


হাঁটতে হাঁটতে শূন্যে ঝাঁপাচ্ছি
কাঁপাচ্ছি শরীর মন
হাঁপাচ্ছি একটু একটু
শূন্য দিচ্ছে ধরা তাও একটু একটু
বকুলের সময় এখন
এখানে অনেকেই আজ নিরাপদ।

যদিও ভূত্বকে সবাই নয় নিরাপদ
আপদ কংস সচল প্রকাশ্যে
শিশুরা ব্যঙ্গে ওখানে হাসে
যদিচ এখানে এখন অনেকেই নিরাপদ
এখানে এখন বকুলের সময় কিনা!



(চলবে...)