নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

ভালো থেকো : রৌনক









চলতি পথে সেই দেখা যে হলো,
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন,
ঝড়ের পূর্বে সব শান্ত হয়ে গেলো,
অতীতের কাছে বাকি আছে ঋণ।।

শেষের দেখায় কান্না ছিলো চোখে,
এখন হাসি ঝরে ঠোঁটের কোনে,
থমকে গেলাম হঠাৎ তোমায় দেখে,
নামলো শ্রাবন চোখের মধ্যিখানে।।

আকাশ তখন মেঘলা হয়ে আসে,
স্মৃতি থাকে বৃষ্টির প্রত্যেক ফোঁটায়,
সব ভুলে মন তোমাতেই ভাসে,
মৃত ইচ্ছে জ্যান্ত হয় হৃদয় আঙিনায়।।

পরনে লাল চোখে কাজল লাগছে বেশ,
হয়তো আজ প্রয়োজন নেই আমার,
গল্পটা হয়েছে অনেক আগেই শেষ,
মহোৎসবে মেতেছে দেশ তোমার।।

বছর আটেক গেলো বিচ্ছিন্ন হয়ে দুজন,
সময়ের হিসাব বলছে অনেক কথা,
গেলো দিনে ছিলাম তোমার স্বজন,
দিনের গভীরে সয়ে গেছি  ব্যথা।।

হাজার প্রশ্ন ঠোঁটের কোনে রয়,
উপাধি'তো প্রাক্তন দিয়েছে সমাজ,
ভীষণ জ্বরে মন, তোমার কথাই কয়,
খুশিতে ভরুক তোমার মনখারাপী সাঁঝ।।

বাতাস মেতেছে নতুন গানের সুরে,
রাজ্য আমার ধ্বংসের মুখে প্রায়,
গেলে অজুহাতের পাহাড় গড়ে,
ভাবি কি করে তোমায় মোছা যায়।।

ভালো থেকো তুমি তার ভালোবাসায়,
আমার ইচ্ছেদের মৃত্যু হোক তোমার সকল আশায়।।

               

পায়ে পায়ে বিকেল বেলা : বৈশাখী গোস্বামী





পায়ে পায়ে বিকেলবেলা,
পথ গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে
কে লেখে, কার কথা?
শুধু গল্প বলার ছুতোয়
আটকে গেছে বিকেল শেষের ঠোঁট
জমিয়ে রাখা মুঠোফোনের মুঠোয় ।
একটা দু'টো চলতি পথ
হালকা হওয়ার নেশায়,
পথ গড়িয়ে ফিরতি পথ
সরল নাকি ব্যস্তনুপাতিক হারে?
থমকে যাওয়া সমীকরণ শেষে
হাঁটতে থাকি মনখারাপের দেশে।

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়






।। তেত্রিশ ।।


               বিকেলবেলা। গ্রামের একটি বাস স্টপেজ। একটা পাড়াই বলতে গেলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু মানুষ। একটা গাছের গোড়া গোল করে বাঁধানো। ঠিক তার পাশেই একটা ঠাকুরের বেদি। দু'একটা দোকান।
               রাস্তার ওপারে একটা টাইম কল। মুখ দিয়ে অনবরত জল পড়ে যাচ্ছে। বেশ জোরেই। আমি এ নিয়ে দু'এক কথা বলতেই দু'একজন কথা বলে উঠল। তারা বললো, কল বন্ধ করে কিছু করতে গেলে পাইপ ফেটে যাবে। আমি অন্য টাইমকলের কথা উল্লেখ করে বললাম, কেন, অন্যান্য কলের পাইপগুলো তো ফেটে যাচ্ছে না। ওরা বললো, এই কলটা অন্য জাতের। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
               একটা জিনিস লক্ষ্য করে আমি অবাক হলাম। আশে পাশে কত মানুষ। এদের মুখে একবারেও জন্যেও আমি জল নিয়ে কোনো কথা শুনলাম না। আমি নিজে থেকে বললাম কিন্তু কেউ ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না। একজন শুধু বললো, মুখে প্যাঁচ একটা লাগানো হয়েছিল কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই হাওয়া।
               নিজেরটুকু ছাড়া দেশের অন্য আর সকল কিছুকে আমার বলে দাবি করার ইচ্ছাটা এদেশের মানুষদের মধ্যে জন্মাল না কেন? শুধু তাই নয়, কৃত কর্মের জন্য মানুষের কোনো অপরাধবোধ নেই, লজ্জা তো কোন কালে ত্যাগ করে ফেলেছে।
               গ্রাম বলেই চিন্তাটা বেশি হয়। শহরের ইঁট কাঠ পাথরের মানুষ তো নয়। মাটির মানুষেরাও এসব নিয়ে ভাববে না ? আমরা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব ?
               ওখানে যতক্ষণ ছিলাম কি অস্বস্তিটাই না হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এখনই বাস চলে আসুক। আমি এখান থেকে পালিয়ে যাই।



(চলবে ..)

দশচক্র : সিদ্ধার্থ সিংহ





হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে ঋজু আর পরমার্থ অপেক্ষা করছিল। ওরা একটু আগেই এসেছে। গত কাল রাত সাড়ে বারোটায় অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে যখন ড্রপ কারের জন্য অপেক্ষা করছে ঋজু, তখন হঠাত্‌ই পরমার্থ ওর কাছে এসে বলল, এই রে, আশিস তোমাকে বলতে বলেছিল। একদম ভুলে গেছি। কাল দাঁতনে একটা উত্‌সব আছে। সেখানে কবিতা পাঠেরও ব্যবস্থা আছে। ও তোমাকে বারবার করে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?
ঋজু কী ভাবছিল। ও কিছু বলছে না দেখে পরমার্থ ফের বলল, কাল তো তোমার অফ ডে। চলো না।
— কখন?
— কাল সকালে। সাতটার সময়। হাওড়া থেকে।

হাওড়া থেকে ঋজুর বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, চেতলায়। ওখান থেকে একটাই বাস। সতেরো নম্বর। কখন আসে কোনও ঠিক নেই। তাই হাতে একটু সময় নিয়েই ও বেরিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা পার হওয়ার আগেই দেখে বাস আসছে। ফলে সাতটা নয়, তার অনেক আগেই ও চলে এসেছে। এসে দেখে, অফিস থেকে অত রাতে বাড়ি গিয়েও এই সাতসকালেই সেই বিরাটি থেকে পরমার্থও এসে হাজির। ঘড়িতে তখনও সাতটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি।
ও সামনে আসতেই পরমার্থ বলল, চা খাবে?
— ওরা আসুক না। একসঙ্গে খাব। ট্রেন ক’টায়?
— তা তো জানি না। আশিস তো বলল, সাতটার সময় এখানে দাঁড়াতে।
— এখানেই বলেছে তো?
— হ্যাঁ রে বাবা...
— সাতটা তো প্রায় বাজে।
— এখনও বাজেনি। আসবে তো সেই সল্টলেক থেকে। সবার বাড়ি তো আর তোমার মতো হাওড়া স্টেশনের পাশে নয়, যে বাসে উঠলাম আর হাওড়ায় পৌঁছে গেলাম। চা খাবে? ওই তো আশিস...
ঋজু দেখল, শুধু আশিস নয়, ট্যাক্সি থেকে একে একে নামছে আরও তিন জন। তার মধ্যে দু’জন মহিলা।
আশিস কাজ করে আকাশবাণীতে। পরের সপ্তাহে রেডিওতে কী কী অনুষ্ঠান হবে, সেই অনুষ্ঠান-সূচি আনতে প্রত্যেক সপ্তাহে পরমার্থকে যেতে হয় ওর কাছে। আনন্দবাজারের যে দফতরে ও কাজ করে, সেখানে প্রুফ দেখা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ওই অনুষ্ঠান-সূচি এনে কম্পোজ করে দেওয়া ওর কাজ।
এই কাজ করতে করতেই আশিসের সঙ্গে ওর বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রেই পরমার্থ যেমন জেনেছে, ও লোকসঙ্গীত গায়। কবিতা লেখে। দুটো কবিতার বইও বেরিয়েছে। শুধু ও একাই নয়, ওর বউ রিনাও কবিতা লেখে। তেমনি আশিসও জেনেছে, পরমার্থও ইদানিং কবিতা লিখতে শুরু করেছে। অনেক কবির সঙ্গেই ওর আলাপ আছে। ওর মুখেই ঋজুর নাম শুনে আশিস বলেছিল, উনি কি আপনাদের অফিসে কাজ করেন নাকি?
— কেন, আপনি চেনেন?
আশিস বলেছিল, না, আলাপ নেই। তবে ওর অনেক কবিতা পড়েছি। উনি তো প্রচুর লেখেন। এত লেখেন কী করে? আপনার সঙ্গে ওনার কী রকম সম্পর্ক?
পরমার্থ বলেছিল, ভালই। ও তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছে।
— তাই নাকি? পারলে এক দিন নিয়ে আসুন না, জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

ঋজুকে সে কথা বলতেই ঋজু বলেছিল, ঠিক আছে এক দিন যাবখ’ন। কিন্তু আজ নয়, কাল নয়, করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। তাই পরমার্থ এক দিন ওকে বলল, আরে বাবা চলো না, গেলে তোমার লাভই হবে। ও এখন অভিজ্ঞানটা দেখে। কবিতা পড়ার জন্য ওর পেছনে কত লোক ঘুরঘুর করে, জানো? আর ও নিজে থেকে তোমাকে ডাকছে, তুমি যাবে না? ওখানে কবিতা পড়লে পাঁচশো টাকা দেয়।
তাতেও খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না দেখে ঋজুকে প্রায় জোর করেই ও একদিন নিয়ে গিয়েছিল আকাশবাণীতে। সেই আলাপ। তার পর এই।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে সামলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের সামনে দিয়ে যেতে যেতেই আশিস বলল, চলে আসুন, চলে আসুন। দেরি হয়ে গেছে।
ও আগে আগে। পেছনে ঋজুরা। তারও পেছনে ট্যাক্সি থেকে নামা বাকি তিন জন।
কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না। টিকিট-ফিকিট কেটে ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। না। ট্রেনেও খুব একটা ভিড় নেই। ছুটির দিন। তাই ফাঁকা ফাঁকা। একটা খোপেই ওরা সবাই বসার জায়গা পেয়ে গেল। এ দিকের সিটে ঋজু, পরমার্থ আর ট্যাক্সি থেকে নামা কোর্ট-প্যান্ট পরা ওই ভদ্রলোক। বাকিরা উল্টো দিকের সিটে। ট্রেন ছাড়ার আগেই আশিস সবার সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দিল। কোর্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটাকে দেখিয়ে বলল, ইনি মহাদেব মোশেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বিবাহের ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক একটা বই লিখেছেন। এ ছাড়া ছড়া-টাড়াও লেখেন। আর ইনি হচ্ছেন কণিকা রায়। কলকাতা টেলিফোন্‌সে কাজ করেন। এখন টেলিফোন ভবনে, না? কণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন তার কাছে জানতে চাইল। তার পরে বলল, ক’দিন আগে ওর একটা সুন্দর কবিতার বই বেরিয়েছে। আর এর পরিচয় কী দেব, ইনি আমার গিন্নি, রিনা গিরি।
ঋজু মহাদেববাবুর দিকে তাকাল। মহাদেববাবু আর কণিকার কথাবার্তা দেখে হঠাৎ কেন জানি ঋজুর মনে হল, ওদের মধ্যে কোনও একটা সম্পর্ক আছে।
বেশ কিছু দিন আগে স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনে জটলা দেখে ও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জটলার মধ্যমণি মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রমহিলা। তাঁর অভিযোগ, তাঁর স্বামী এই কলেজে পড়ান। তাঁরই এক ছাত্রীর সঙ্গে তিনি প্রেম করেন। তাঁকে বহু বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাঁর বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে। তারা স্কুলে পড়ে। স্কুলের মাইনে পর্যন্ত উনি দিচ্ছেন না। সংসার খরচা তো নয়ই। সব ওই মেয়েটার পেছনে ঢালছেন। তাই শেষ পর্যন্ত উনি নাকি থানায় গিয়েছিলেন। থানা থেকেও ভদ্রলোককে ডেকে বলে দিয়েছে, যাতে তিনি ঠিকঠাক মতো সংসার করেন। বউয়ের গায়ে যেন হাত না তোলেন। অথচ তার পর থেকেই তিনি আর বাড়ি ফিরছেন না। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য উনি কলেজে এসেছিলেন। কিন্তু টিচার্স রুমের সামনে যেতেই উনি তাঁকে দেখতে পেয়ে যান। অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁকে ধাক্কা মেরে এক দৌড়। ভদ্রমহিলা এখন বলছেন, উনি এ দিকেই এসেছেন, আপনারা কেউ কি দেখেছেন? ঘিয়ে রঙের জামা পরা। কালো প্যান্ট। চোখে চশমা। মাথায় পাতলা-পাতলা চুল...
ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল ঋজুর। মহাদেববাবু আবার সে রকম নন তো! ঘরে বউ-ছেলেমেয়ে সব আছে। আর বাইরে এর সঙ্গে... এরা নিশ্চয়ই স্বামী স্ত্রী নন। ওঁর পদবি তো রায়। আর এঁর মোশেল।
টুকটাক কথা হচ্ছিল। ঋজু কথায় কথায় মহাদেববাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?
উনি বললেন, সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে।
— আর আপনি? কণিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ঋজু।
— আমিও সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে।
— ও। দু’জনেই কাছাকাছি থাকেন?
হঠাত্‌ মহাদেববাবু বলে উঠলেন, কাছাকাছি নয়, খুব কাছাকাছি। একই বাড়িতে। একই ঘরে। আসলে আমি ওর বাড়িতে থাকি।
কথাটা শুনে একটু থতমত খেল ঋজু। এত দিন ও শুনেছে, ছেলেরা মেয়েদের রক্ষিতা রাখে। এ তো উল্টো কেস। মেয়েটা এঁকে রেখেছে! নাকি মেয়েটা তাঁর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট চালায়! ঋজু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কী? ও তখন মনে মনে ওর মতো করে দুই আর দুইয়ে চার করার চেষ্টা করছে।
তখন আশিসই বলল, এখনও বুঝতে পারলেন না, ওরা কর্তা-গিন্নি। ওদের আনতে গিয়েই তো এত দেরি হয়ে গেল।
কণিকা বলল, আমার কোনও দোষ নেই। আমি তো আসব না বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু রিনা গত কাল রাতে এত বার করে বলল যে, না এসে থাকতে পারলাম না। আর তা ছাড়া ছুটির দিনে এত তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যাস নেই তো...
ওকে মাঝপথে থামিয়ে মহাদেববাবু বললেন, আমি কিন্তু তোমাকে সাড়ে পাঁচটায় ডেকে দিয়েছিলাম।

ট্রেন চলছিল। কথা হচ্ছিল। জানালা দিয়ে হুহু করে হাওয়া আসছে। কণিকার কপালের দু’দিক দিয়ে নামানো দুটো লকস বারবার ওর চোখের উপরে এসে পড়ছে। হঠাৎ মহাদেববাবু তাঁর কোর্টের ভিতর পকেট থেকে একটা ছোট্ট পকেট-বুক বার করে ঋজুর দিকে এগিয়ে দিলেন— এটা বহু দিন আগে বেরিয়েছিল। তখন ছড়াই লিখতাম। এখন আর সময় পাই না।
ঋজু উল্টেপাল্টে দেখছে। একটা পড়তে গিয়েই হুচোট খেল। প্রচ্ছদ দেখে মনে হয়েছিল ছোটদের বই। কিন্তু এ কী! বইটা বন্ধ করে আশিসের দিকে এগিয়ে দিল। আশিস বলল, এটা আমি আগেই দেখেছি।
শব্দ ক’টার মধ্যে বইটা হাতে নেবার সামান্যতম সম্ভাবনা না দেখে রিনার দিকে বাড়িয়ে দিল ঋজু। বইটা হাতে নিয়ে রিনা বলল, এটা আমার পড়া। যখন বেরিয়েছিল, তখনই উনি দিয়েছিলেন। এখনও বোধহয় বাড়িতে আছে।
পরমার্থ বলল, ঋজুর কিন্তু অনেকগুলো বই আছে। তার পর ঋজুর দিকে তাকিয়ে বলল, সঙ্গে আছে নাকি?
— হ্যাঁ, আছে বোধহয়। বলেই, কাঁধের ব্যাগ থেকে দুটো বই বার করল ঋজু। একটা গল্পের আর একটা কবিতার।
পরমার্থ গল্পের বইটা নিয়ে আশিসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, জানো তো, এই গল্পটা যখন সানন্দায় বেরোয়, তখন বিশাল হইচই হয়েছিল। ওর বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার মামলা হয়েছিল।
ঋজু একটু লজ্জার ভান করে বলল, না না। আমার একার নামে নয়। আমাদের পাঁচ জনের নামে পাঁচ কোটি। আমার নামে শুধু এক কোটি।
— তাই নাকি? কী হয়েছিল? মহাদেববাবু জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন।
পরমার্থ বলল, সে সময় তো সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এটা বেরিয়েছিল...
— তাই নাকি? ঋজুর দিকে তাকিয়ে মহাদেববাবু বললেন, কী হয়েছিল?
ঋজু বলল, আসলে আমি তখন সানন্দায় ফ্রিল্যান্স করি। মানে, লেখা ছাপা হলে টাকা পাই। না হলে, নয়। তো, সানন্দায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সিদ্ধার্থ সরকার আর অনিরুদ্ধ ধর ছিলেন আমার খুব কাছের মানুষ। তা, ওঁরা ঠিক করলেন, উত্তমকুমারকে নিয়ে একটা টিভি সিরিয়াল বানাবেন। তো, আমিও ভিড়ে গেলাম ওঁদের সঙ্গে। লেখালিখি তখন মাথায় উঠেছে। কিন্তু না লিখলে আমার চলবে কী করে? অনিরুদ্ধদাকে সে কথা বলতেই উনি বললেন, গল্প লিখতে পারবি? আমি তখন কবিতা ছড়া লিখি। তবু বললাম, পারব। উনি বললেন, তা হলে আজকে রাতের মধ্যেই একটা গল্প লিখে ফেল। কাল বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে পিটিএসে ধরিয়ে দিস। পিটিএস মানে, যেখানে কম্পোজ হয়। আমি বললাম, তুমি দেখবে না? উনি বললেন, তোর লেখা আবার দেখার কী আছে? ঠিক আছে, প্রুফে দেখে নেব। তার পর যখন লেখাটা ছেপে বেরোল, স্টলে খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, আশপাশের কোনও স্টলে সানন্দা নেই। সে দিনই বেলার দিকে লোকাল কাউন্সিলারের সঙ্গে আমার বাড়িতে এসে হাজির সৌগত রায়।
— কোন সৌগত রায়? আমাদের সৌগত রায়? অধ্যাপক?
পরমার্থ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কংগ্রেসের এমএলএ।
— তার পর?


ক্রমশঃ...

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়







।। একত্রিশ ।।

               ভোরে উঠতে আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে গরমকালের ভোর। ভোর মানেই একটা ঠাণ্ডার বাতাবরণ। একটা সুন্দর মিষ্টি হাওয়া দেয়। গরমকালের ভোরে ওই মিষ্টি হাওয়াটাই আরও মধুর হয়ে যায়। বেশিরভাগ মানুষই ওইসময় মাথার বা পায়ের জানলাটা খুলে দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। আমি কিন্তু উঠে পড়ি। এর প্রধান কারণ, ওইসময় চারপাশটা খুব চুপচাপ থাকে। মনে হচ্ছে সবদিক থেকে সবাই আস্তে আস্তে ঘুম থেকে জেগে উঠছে। এটা মনে মনে ভেবে নিয়ে চারপাশটা দেখলে চোখের সামনে সবকিছুই খুব কাছের বলে মনে হয়।
               ছোটবেলায় খুব ভোরে উঠেই পানপুকুরের পারে আমগাছতলায় ছুটতাম আম কুড়ানোর জন্যে। বেশিরভাগ দিনই আম পেতাম না কিন্তু তাতে বিরক্ত হতাম না। আসলে ভোরবেলা উঠে ভোরের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আমতলায় যাওয়াটাই আমার কাছে প্রধান ছিল। তাই আম পেলাম কি পেলাম না তাতে আমার কিছু যায় আসতো না।




।। বত্রিশ ।।



               বর্ষায় বৃষ্টির দিনগুলোতে আমার মোটেই ভালো লাগত না। মনে মনে খুব একা হয়ে যাই। এইজীবনের ফেলে আসা সময়ের মানুষজনরা আমার ভাবনার পথ আঁকড়ে ধরে। কত কত কথা যে মনে পড়ে যায় ------ অথচ আজ তারা কতদূরে। যে রোদ ছাড়া আমার একমুহূর্ত চলে না, সেই আকাশ আজ মেঘে ঢাকা। চাইতে পারি না আকাশের দিকে। মনে হয় আমি যেন তার গলা টিপে ধরেছি। সে ঠিক ঠিক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না। এই অস্বস্তি তখন আমার মধ্যেও কাজ করে। কিছুই ভালো লাগে না তখন।
               ছোটবেলায় বর্ষার সময় মাকে খুব জ্বালাতন করতাম। ঘুরতে ফিরতে মায়ের মুখের কাছে এসে বলতাম, " কিচ্ছু ভালো লাগছে না।" এক একসময় মা খুব রেগে যেত। সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার আগে মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, " মা রোদ উঠেছে ? " মা ' না ' বললেই একরাশ মন খারাপ নিয়ে পাশ ফিরতাম।


(চলবে...)

আলো ছায়ার কথামালা : হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়








।। ঊনত্রিশ ।।



               বছর পাঁচেক আগের কথা। আনাজ বাজারে মৃণালদার সঙ্গে দেখা। আমার বাজার করাটা যেন একটা যন্ত্রণার মতো। শুরু থেকেই শেষ হওয়ার কথা ভাবি। মৃণালদা কিন্তু ঠিক এর উল্টো। উনি বেশ ধরে ধরে সময় নিয়ে বাজার করেন। কি একটা বিষয়ে কথা হতে হতে আমি হঠাৎ বলে বসলাম, " আচ্ছা মৃণালদা, শেষ কবে মনের কথা কাউকে বলছেন ? "দেখলাম মানুষটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলেন। খুব কাছে দাঁড়িয়েও আমি যেন তাকে ছুঁতে পারছি না। " ঠিক বলেছ ভাই, অনেক দিন হলো কাউকে মনের কোনো কথা বলতে পারি না। " মনে হলো, উনি আরও কিছু বলতে চান। আমি আরও দু'একটা কথা বললাম, " একবার ভেবে দেখুন, বৌদির কোনো কথা বলার ইচ্ছা হলে আপনাকে বললেন। ভাইপো, ভাইঝির কোনো কথা বলার দরকার হলে ওরা আপনাকে বলবে। কিন্তু আপনি ? কোনো সুযোগ নেই। আপনাকে সব কথা বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখতে হবে। " দেখলাম, মৃণালদা চোখ বুজে। একটু পরেই দেখি উনি কাঁদছেন। আমি তো বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম। ভাবতেই পারি নি, কথাটা ওনাকে এতখানি আঘাত করবে।




।। ত্রিশ ।।


               রোজই ভাবি, আজকের রাতটা আর ঘুমাব না। সারাটা রাত লিখে পড়ে কাটিয়ে দেব। কিন্তু পারি না। ছ'টা বাজলে উঠতেই হবে। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো থাকে। রাত চিনেছি মায়ের কাছ। মাকে পড়ে কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যেত না। পড়তে পড়তে কত রাত হয়ে যেত। মা তবুও রাতের খাবার দিত না। এইভাবে পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে যেত। এই যে রাত জাগার অভ্যাস আজ পর্যন্ত তার সামান্যটুকুও কমে যায় নি বরং আরও অনেক বেড়ে গেছে। আসলে রাত হলে আমি নিজেকে যেন খুঁজে পাই। রাত আমাকে আমার কাছে এনে দেয়।


(চলবে..)