মুক্তি
****
****
নীলপাহাড় একটি ছোট্ট, সুন্দর, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার। সেখানেই জন্ম মুক্তির,নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র কন্যাসন্তান। বাবা ক্ষেতমজুর, হতদরিদ্র না হলেও দারিদ্রতা বর্তমান। মুক্তি নীলপাহাড় গ্রামের উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী এবং অত্যান্ত মেধাবী। গায়ের রং শ্যামলা,নয়ন তার মায়াবী, মুখাকৃতি লক্ষ্মীমন্ত। অনেকেই তাকে কখনো শ্যামা অথবা দস্যিকন্যে বলে ডাকে। ধানক্ষেত, আমবাগান,পুকুরপাড়, নদীর ধারে দাপিয়ে বেড়ানো তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্যে পড়ে। শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকে বাচ্চাদের সঙ্গে মাছ ধরে,কালবৈশাখীর রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে আম কুড়ানোর উদ্দেশ্যে, আবার বিচ্ছুদের সঙ্গে
লুকোচুরিও খেলে, গ্রামের বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলোও মুক্তিদিদি বলতে অজ্ঞান। মুক্তিদিদি ছাড়া তারাও যেন অসম্পূর্ণ, মুক্তিও ভীষণ ভালোবাসে ওদের।
গ্রামের মানুষের কাছে মুক্তি দস্যিকন্যা নামে পরিচিত। বাবামায়ের একমাত্র আদরের দুলালী সেইহেতু খুবই স্নেহের, নয়নের পুত্তলী।
তবে তার প্রকৃতি হলো জেদি, ন্যায়পরায়না,সাহসিনী,প্রতিবাদি নী, মুখরা। রুপে লক্ষ্মী নয়,কিন্তু গুনে সরস্বতী। কয়েকদিন হলো উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ হয়েছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই তার ফলাফল প্রকাশিত হবে।
ইতিমধ্যেই পাড়া প্রতিবেশীরা বলতে থাকে মুক্তির বিবাহের কথা। কিন্তু মুক্তি চায় পড়াশোনা করে স্বনির্ভর হতে। তার স্বপ্ন, জীবনে নিজের পরিচয়ে বাঁচবে, প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিবারে পুত্রসন্তানের অভাব দূর করবে, দারিদ্রতার অবসান ঘটাবে। শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্নের জালে এক বালতি জল ঢেলে বিবাহের আয়োজন শুরু হলো। বাবা-মার মুখ রাখতে অগত্যা রাজি হতে হলো, কিন্তু বাধ সাধলো যৌতুক। পাত্রপক্ষের দাবী পূরণ করার সামর্থ্য নেই মুক্তির বাবার। অন্যদিকে শ্যামলা মেয়ে হওয়ায় দুঃশ্চিন্তারও অবকাশ নেই। নিরুপায় হয়ে দাবী পূরণের অঙ্গীকার করেন, শেষ সম্বল ভিটেমাটি বন্ধক রাখেন। মুক্তিও বাধ্য হয়েই মেনে নেয় অদৃষ্টকে।
বিবাহের লগ্ন উপস্থিত,পাত্রপক্ষের দাবী অনুযায়ী নগদ দুইলক্ষ টাকা,তিনভরি গহনা ও মোটরবাইক যৌতুক দেওয়ার কথা। কিন্তু সময়ের স্বল্পতায় শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশহাজার টাকা জোগাড় করে উঠতে পারেননি কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা।
নির্ধারিত সময়ে মুক্তিকে আনা হলো ছাদনা তলায়, হঠাৎই বরপক্ষ বলে ওঠে, আগে যৌতুক কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেবে,তারপর বিবাহের যাবতীয় কার্য্যাদি সম্পন্ন হবে। ফলস্বরুপ, পঞ্চাশ হাজার টাকা কম পড়ল। মুক্তির হবুশ্বশুরমশাইয়ের দাবী পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যতীত এ বিবাহ দেবেন না। মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা হতে হবে এ কথা ভেবেই শিউরে ওঠেন মুক্তির বাবা মা প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। এতক্ষন মুক্তি নিরবে অবাকদৃষ্টিতে মুখে পান পাতা ঢেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসে দেখছিলো মানুষরুপী অর্থলোলুপ পিশাচের বহিঃপ্রকাশ। চারিদিকে তাকিয়ে অনেক খুঁজলো মানবতাকে। কোথায় সে ? সে কি বিসর্জিত! না, সভ্যতার নুড়িপাথরে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে?
পাত্রের পিতা যখন বললেন, এ বিয়ে হবে না ঠিক সেই মুহুর্তেই লাজ-লজ্জার তোয়াক্কা না করেই মুখের পানপাতা সরিয়ে গলার রক্ত গোলাপের মালা ছিন্নভিন্ন করে ছুঁড়ে মারলো পাত্রপক্ষের মুখে। মুক্তির এ হেন আচরণে বিবাহমন্ডপে উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা না বলেই বিয়ের মন্ডপ ত্যাগ করল মুক্তি। পাত্রপক্ষ লজ্জায়, ক্ষোভে ফিরে গেল। নাহ, এরপর মুক্তির আর সংসারটা করা হয়নি,উচ্চমাধ্যমিকে ফলাফল ঘোষনা হয়েছে,সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে, স্কলারশিপের টাকায় নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছে, পাড়ি দিয়েছে শহরে, প্রবেশ করেছে বৃহত্তর জগতে।
হ্যাঁ, দীর্ঘ সাধনার পর আজ আবার সে ফিরছে তার প্রিয় জন্মভূমি নীলপাহাড়ে। আজ সে শুধুই নীলপাহাড়ের দস্যিকন্যে নয়, নীলপাহাড়ের অহংকার,ঐতিহ্য,গর্ব। সে তারই বাল্যকালের বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস পদে আসীন, এক মুখ সাফল্যের হাসি আর আনন্দাশ্রু নয়নে। সামনে দাঁড়িয়ে গোলাপের মালা নিয়ে গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান ,লগ্নভ্রষ্টা মুক্তির হবুশ্বশুরমশাই,বরণ করে নিতে। আজ সে পেরেছে,নৃশংস পিশাচগুলোর যোগ্য জবাব দিতে।
মুক্তি বোধ হয় সত্যিই মুক্তি পেলো সংসারের সংকীর্ণ কূটনৈতিক বেড়াজাল থেকে। দেবী পক্ষের পদধ্বনি টের পাচ্ছে, সূচিত হচ্ছে নারীশক্তির। তার লক্ষ্য,নীলপাহাড়ের প্রত্যেক মেয়েই যেন মুক্তি পায়, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ও পনপ্রথার নির্মম অত্যাচার থেকে। সে তিলে তিলে গড়ে তুলছে তার প্রতিটি ছাত্রীকে এক একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র। একটু একটু করে তার স্বপ্ন স্বার্থক হচ্ছে, গড়ে তুলছে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাগ্য। শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি নারী সংগঠনও গড়ে তুলেছে, যার নাম "মুক্তি"।
জয় হোক মুক্তির, বাঙালীর প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্ম হোক মুক্তির,গড়ে উঠুক নিষ্কলুষ নারীসমাজ। মাথা তুলে দাঁড়াক প্রতিটি মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা। বন্ধ হোক কন্যাভ্রূণ হত্যা, চীরতরে বিদায় নারী নেবে নারী নির্যাতন। সভ্যতার নুড়িপাথরের তলায় ঘুমিয়ে পড়া মানবতা অন্তত এবার জেগে উঠুক, শতহস্তে ধারণ করুক শান দেওয়া মানবিক অস্ত্র।
লুকোচুরিও খেলে, গ্রামের বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলোও মুক্তিদিদি বলতে অজ্ঞান। মুক্তিদিদি ছাড়া তারাও যেন অসম্পূর্ণ, মুক্তিও ভীষণ ভালোবাসে ওদের।
গ্রামের মানুষের কাছে মুক্তি দস্যিকন্যা নামে পরিচিত। বাবামায়ের একমাত্র আদরের দুলালী সেইহেতু খুবই স্নেহের, নয়নের পুত্তলী।
তবে তার প্রকৃতি হলো জেদি, ন্যায়পরায়না,সাহসিনী,প্রতিবাদি
ইতিমধ্যেই পাড়া প্রতিবেশীরা বলতে থাকে মুক্তির বিবাহের কথা। কিন্তু মুক্তি চায় পড়াশোনা করে স্বনির্ভর হতে। তার স্বপ্ন, জীবনে নিজের পরিচয়ে বাঁচবে, প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিবারে পুত্রসন্তানের অভাব দূর করবে, দারিদ্রতার অবসান ঘটাবে। শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্নের জালে এক বালতি জল ঢেলে বিবাহের আয়োজন শুরু হলো। বাবা-মার মুখ রাখতে অগত্যা রাজি হতে হলো, কিন্তু বাধ সাধলো যৌতুক। পাত্রপক্ষের দাবী পূরণ করার সামর্থ্য নেই মুক্তির বাবার। অন্যদিকে শ্যামলা মেয়ে হওয়ায় দুঃশ্চিন্তারও অবকাশ নেই। নিরুপায় হয়ে দাবী পূরণের অঙ্গীকার করেন, শেষ সম্বল ভিটেমাটি বন্ধক রাখেন। মুক্তিও বাধ্য হয়েই মেনে নেয় অদৃষ্টকে।
বিবাহের লগ্ন উপস্থিত,পাত্রপক্ষের দাবী অনুযায়ী নগদ দুইলক্ষ টাকা,তিনভরি গহনা ও মোটরবাইক যৌতুক দেওয়ার কথা। কিন্তু সময়ের স্বল্পতায় শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশহাজার টাকা জোগাড় করে উঠতে পারেননি কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা।
নির্ধারিত সময়ে মুক্তিকে আনা হলো ছাদনা তলায়, হঠাৎই বরপক্ষ বলে ওঠে, আগে যৌতুক কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেবে,তারপর বিবাহের যাবতীয় কার্য্যাদি সম্পন্ন হবে। ফলস্বরুপ, পঞ্চাশ হাজার টাকা কম পড়ল। মুক্তির হবুশ্বশুরমশাইয়ের দাবী পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যতীত এ বিবাহ দেবেন না। মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা হতে হবে এ কথা ভেবেই শিউরে ওঠেন মুক্তির বাবা মা প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। এতক্ষন মুক্তি নিরবে অবাকদৃষ্টিতে মুখে পান পাতা ঢেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসে দেখছিলো মানুষরুপী অর্থলোলুপ পিশাচের বহিঃপ্রকাশ। চারিদিকে তাকিয়ে অনেক খুঁজলো মানবতাকে। কোথায় সে ? সে কি বিসর্জিত! না, সভ্যতার নুড়িপাথরে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে?
পাত্রের পিতা যখন বললেন, এ বিয়ে হবে না ঠিক সেই মুহুর্তেই লাজ-লজ্জার তোয়াক্কা না করেই মুখের পানপাতা সরিয়ে গলার রক্ত গোলাপের মালা ছিন্নভিন্ন করে ছুঁড়ে মারলো পাত্রপক্ষের মুখে। মুক্তির এ হেন আচরণে বিবাহমন্ডপে উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা না বলেই বিয়ের মন্ডপ ত্যাগ করল মুক্তি। পাত্রপক্ষ লজ্জায়, ক্ষোভে ফিরে গেল। নাহ, এরপর মুক্তির আর সংসারটা করা হয়নি,উচ্চমাধ্যমিকে ফলাফল ঘোষনা হয়েছে,সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে, স্কলারশিপের টাকায় নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছে, পাড়ি দিয়েছে শহরে, প্রবেশ করেছে বৃহত্তর জগতে।
হ্যাঁ, দীর্ঘ সাধনার পর আজ আবার সে ফিরছে তার প্রিয় জন্মভূমি নীলপাহাড়ে। আজ সে শুধুই নীলপাহাড়ের দস্যিকন্যে নয়, নীলপাহাড়ের অহংকার,ঐতিহ্য,গর্ব। সে তারই বাল্যকালের বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস পদে আসীন, এক মুখ সাফল্যের হাসি আর আনন্দাশ্রু নয়নে। সামনে দাঁড়িয়ে গোলাপের মালা নিয়ে গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান ,লগ্নভ্রষ্টা মুক্তির হবুশ্বশুরমশাই,বরণ করে নিতে। আজ সে পেরেছে,নৃশংস পিশাচগুলোর যোগ্য জবাব দিতে।
মুক্তি বোধ হয় সত্যিই মুক্তি পেলো সংসারের সংকীর্ণ কূটনৈতিক বেড়াজাল থেকে। দেবী পক্ষের পদধ্বনি টের পাচ্ছে, সূচিত হচ্ছে নারীশক্তির। তার লক্ষ্য,নীলপাহাড়ের প্রত্যেক মেয়েই যেন মুক্তি পায়, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ও পনপ্রথার নির্মম অত্যাচার থেকে। সে তিলে তিলে গড়ে তুলছে তার প্রতিটি ছাত্রীকে এক একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র। একটু একটু করে তার স্বপ্ন স্বার্থক হচ্ছে, গড়ে তুলছে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাগ্য। শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি নারী সংগঠনও গড়ে তুলেছে, যার নাম "মুক্তি"।
জয় হোক মুক্তির, বাঙালীর প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্ম হোক মুক্তির,গড়ে উঠুক নিষ্কলুষ নারীসমাজ। মাথা তুলে দাঁড়াক প্রতিটি মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা। বন্ধ হোক কন্যাভ্রূণ হত্যা, চীরতরে বিদায় নারী নেবে নারী নির্যাতন। সভ্যতার নুড়িপাথরের তলায় ঘুমিয়ে পড়া মানবতা অন্তত এবার জেগে উঠুক, শতহস্তে ধারণ করুক শান দেওয়া মানবিক অস্ত্র।