নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

সত্যেন্দ্রনাথ নাইয়া




★চরৈবেতি★
************



বাঁচ্,নিজের মতো বাঁচ্,
নিজের খুশীতে থাক্,
ঘেরাটোপের বাইরে তুই
খুঁটে খুঁটে জগতের বাহার দেখ,
রাধা-রহিম-মেরী বলতে হবে না আর, ময়না!তুই স্বাধীন হলি আজ।

অবাক!খাঁচার বাইরে আসতে নারাজ!

বাবু!আমি বন্দীদশায় বেশ স্বাভাবিক,
মুক্তির স্বাদ আমাকে টানে না আর,
ওড়ার থেকে পড়ার ভয় করে গ্রাস,
জানি না মা-বাবা কোথায় আজ,
দলছুটকে কে বা নিতে চায়!
তার চেয়ে রাধা-রহিম-বুদ্ধ বলি,
চরৈবেতি।
পরজন্মে যদি মানুষ হতে পারি,
পরাধীনকে স্বাধীন,স্বাধীনকে পরাধীন
করার কারবারি।
চরৈবেতি।

ভেতরের ধূর্ত কাকটা ভ্যাংচায়,
সিংহটা লোলজিহ্বায়,
কামুক কুকুর ঘাম ঝরায়,
আমার কেমন চারপা গজিয়ে যায়,
চরৈবেতি...

গৌরাঙ্গ মণ্ডল




নিত্যনতুন প্রেমান্তর
******************



বাকল মোচন, শুকনো পাতা, ঝরে যাওয়া সবকিছু 
উল্টো পিঠে দিচ্ছে টহল কয়েকশো প্রেম। ঘাড় পিছু। 

খোলাই ছিল রাস্তা দু'দিক, পা চেপে যাও পাশ কেটে 
শব্দ পেলেই মৃতেরা ঠিক নেমে আসবে প্ল্যান চ্যাট-এ। 

তার চেয়ে বরং ন্যাংটো হয়ে ঘুম দি এসো। দীর্ঘায়ু। 
লক্ষ 'তুমি'র গর্ভ তুমি অনিন্দিতা প্রেম-স্নায়ু, 

উগড়ে দিচ্ছো!উগড়ে দিচ্ছো!কক্ষে কক্ষে কোপ, জানি
আমারও নেই অসুস্থ ভয়। ব্যাধির অনুসন্ধানী। 

কথার ভাঁজে বাঁধছি শুধু লারেলাপ্পা মস্করা, 
স্পর্শ মেশাও, পাল তুলেছে পেন্ডুলামের শিরদাঁড়া। 

সমস্তই তো স্রোতোস্বিনী চরের নীচে খলবলে, 
চুপসে চোখের দৃষ্টিপাতই টেম্পোরারি ফেল হলে। 

গতি! সে নয় প্রতীক্ষিতা, বহমন্দ্রে উদবায়ী, 
চরিত্রেরা বদলে প্রতি উপন্যাস ও অধ্যায়-ই.. 

আগলাবে না আ়ঁচল পেতে, মেঘ জমেছে এক মনে;
আমার হৃদয় কুরবানী দি নব্য প্রেমের অঙ্গনে।

কল্যাণ মণ্ডল




     হারিয়ে যাওয়া গান 
      ******************




হারিয়ে যাবো যেদিন অামি,
মনখারাপের হিমেল বাতাস
জানাবে খবর কাঁদবে তুমি ৷
খুঁজবে অস্তমিত সূর্যের রঙে ,
খবর নেবে শুকতারার কাছে
ছবি হয়ে ঝুলবো দেওয়ালে ৷
কাঁদবে তুমি বুকটা ধরে ,
গন্ধ হয়ে বইবো বাতাসে ৷
তারা হয়ে দেখবো তোমাকে,
বুঝবে সেদিন বিরহজ্বালা
শুকিয়ে যাবে বরণমালা ৷
গভীর রাতে স্বপ্ন ভেঙে চমকে উঠে
অনুভব করবে মায়ার ছোঁয়া ৷
এই তো ছিল অামার পাশে
বসেছিল কোলটি ঘেষে ৷
পাওয়ার অাশা ধরবে যখন
ভাঙবে তোমার মিছে স্বপন ৷
মুছবে যখন অশ্রুধারা
পড়বে মনে সোহাগপাড়া ৷
জ্বলবে চিতা মিটবে জ্বালা ,
হাসবো অামি কাঁদবে তুমি
রইবে পড়ে হিসাবখাতা ৷

সমীর সরকার





ছায়াপোড়া মন
************



গুল্ম ঘুমের কুশি
নরম হাওয়ার দোল ছোঁয়ায়

জলছবির আকর্ষ
চুঁইয়ে পড়ছে অর্বুদে

জড়া মুখ তুলে
বোঁটা খসা আলো
শিষ  কাটছে জলবাঁশি

ঠেস দুয়ার
কোদাল ছাটা অন্ধকার
আড়ষ্ট চোখ
এক দোয়াত হিমেল কুচো
উত্তুরে জানালা
ভাবডোবা খাগ সুদূর প্রান্তীয়

বাড়িয়ে হাত টানছে দাগ
 তোমার সেই অনুক্ষণ

কি করব বলো -

কথাঝরা গাছ আমার যে
 ছায়াপোড়া মন ...

ঝুমা চৌধুরী




চৌকাঠের ওপারে
***************


স্পর্শকাতর ইচ্ছা গুলোতে সাহসের প্রলেপ লাগিয়েছিলো

যে দলছুট মেঘ

তার কাছে হাত পেতে একদিন বৃষ্টি চেয়েছিলাম আমি

ঝড়ের বুকে হাত রেখে বলেছিলাম

"এলোচুল উড়িয়ে, বুকের আঁচল সরিয়ে

লজ্জাকে উড়িয়ে নিয়ে যা দেখি"

গুমোট বিকেল বললো, "তবে যে তুমি অশুচি হবে!"

অস্ত যাওয়া সূর্যের চোখে চোখ রেখে অহংকার দিয়েছিলাম ছুঁড়ে

বলেছিলাম,"বেশ, হোক আমার সর্বনাশ "

গভীর রাতের গল্প গুলো যদিও ছিলো বড়ো বেশী সংযত,

শরীরী গন্ধ উপেক্ষা করে,সোজা মনের গালে গাল ঘসলো!

আমি অস্থির হয়ে বলেছিলাম,"ওওও মেঘ,

তুমি অমন কেনো!!

মন ভিজলে ক্ষতি নেই,শরীর জবজবে হলেই দোষ!!"

মেঘের মুখে তখন জয়ের হাসি।

আজ আমার উঠান জুড়ে মেঘ ভেঙে ভীষন বৃষ্টি

আর আমি বারান্দার পাশ ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে

"ও মেঘ, আজ যে আমার ভীষন জ্বর!!"


                  

সোমনাথ দাস চান্দল্য




" মাঘ স্নান "
**********





         বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে পৌষ সংক্রান্তি  গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতিতে লোকাচারে পূর্ণ বিশেষ একটি পার্বণ । তাইত এই পার্বণের অনেক নাম -- মাঘস্নান ( মাঘবুর) , পৌষ সংক্রান্তি , হালন্তি , মকর সংক্রান্তি ।
পৌষ সংক্রান্তির প্রস্তুতি শুরু হত অনেক আগে থেকে।
পালাপার্বণ গুলো ছিল সে সময়ে সর্বস্তরের গ্রামীণ জীবনে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ।   আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলের সক্রিয় অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যা ছিল অনাবিল আনন্দ যাপন । সহজ সরল আয়োজনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জীবনে নিয়ে আসতো আনন্দ ধারা । কৃষিনির্ভর জীবনে সকল উৎসব অনুষ্ঠান তাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো  তারই প্রাকৃতিক উপকরণ কে অঙ্গীভূত করে নিয়ে ।
      আজ থেকে বছর তিরিশ আগেও পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলের গ্রামগুলোতে চাষাবাদ হত চিরাচরিত প্রাচীন প্রথায় । লাঙ্গল জোয়াল আবাল চকম ( মই ) আচঁড়া কাঁচি কোদাল ইত্যাদি । ধান পাটের প্রজাতি দেশি , উচ্চ ফলনের লোভে সংকরায়ন  থাবা গাড়েনি তখনও ।
আমন ধানের গাছগুলো আষাঢ় শ্রাবণ জুড়ে বর্ষার জলভেঙে দৈর্ঘ্যে প্রায় দশ বারো ফুট । দানির সময় মোটে তিন ফুট কেটে নিয়ে বাকি নাড়া হয়ে মাঠেই পড়ে থাকে । জ্বালানির কাজে লাগে আবার মাঠেই জ্বালিয়ে দিয়ে জমির উর্বরতা বাড়ানো হয় ।
      পৌষ মাসের শুরু থেকেই আমাদের বাড়ির জোয়ান ছোকরারা প্রতি রাতে দল বেঁধে মাঠে যায় , নাড়া তুলে আনে । পূবের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের কলতলার কাছে বরি (কুল ) গাছের তলে জমা করে রাখে । সংগ্রহ দিনে দিনে বিশাল আকার ধারণ করে ।
পৌষের শেষের দিনগুলোতে শুরু হয় চালের গুঁড়ি কুটা, ঢেঁকি বা গাইল শেহাইড এ । খেজুরে গুড় , তিল্লাই (কদমা) বাতাসা কাঁঠালকুশি (গুড়ের মিষ্ট নিরেট চুঙের আকারে , ছোট ) ...কিনে আনা হয় বাজার থেকে।

      সংক্রান্তির দিন ভোর রাত্রে তিনটা থেকে বাড়ির সব ছেলে ছোকরা জড় হয় কল পাড়ে । পূব পুকুরের দক্ষিণা ঘাটের জলবিভাজিকায় নাড়া দিয়ে জ্বালানো হয় আগুন । উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে সবাই , জানান দেয়  জ্বলেছে আগুন , এসো করে নাও মাঘস্নান ।
মা ঠাকুমারাও শুরু করে দেয় পিঠে পুলি বানানোর প্রস্তুতি । আজ কত কাজ , রকমারি পিঠে পুলি পায়েস , উঠোন নাটমন্দিরে আলপনা ,স্নান সেরে নিয়ে ভোর ভোর ,  করে দিতে হবে নগর কীর্ত্তনের আয়োজন । এ বাড়ি থেকেই যে বেরোবে নগর কীর্ত্তন । তারপর হালন্তির  রান্না লাউ  কুল দিয়ে টক , তাতেই না হয় লাঙলের পূজা । এদিকে পুকুর ঘাটে ক্ষণে ক্ষণে ছেলেদের হল্লা শুনা যায় । ছেলেরা আগুন পোহায় , আগুনে অরণি ইন্ধন যোগায়  , হলকে উঠে নাড়ার আগুন উৎসাহে হল্লা করে দ্বিগুন ।
বৌদি ঠাকুমা  ঠিসারার (রঙ তামাশা)  পাত্রীদের নিয়ে অশ্লীল ছড়া কাটে , উল্লাসে চেঁচায় --
  " লাউ পাতা ঢুলা ঢুলা বাণীর মার পেটটা ফুলা " ,
" পূবের পাত্রঅ  দেহিরে ভাই কাঁচির উপরে কাঁচি
গোপাল দাসে কাইজ্যা লাইগ্যা বেডি রে ডাহে চাচি " ,
পশ্চিমের পাতরঅ দেহি রে ভাই ঠ্যাডার ভিতরে ঠ্যাডা
কিরণবলার খেতার নিচে তিন চাইর বেডা " ।

  যখন যে স্নান করতে আসে তাকে নিয়ে ছড়া কাটে সম্পর্ক অনুযায়ী । এক সময় স্নান শেষ হয় , সবাই ঘরে চলে আসে । পিঠে পায়েস দই চিড়া খেয়ে সবাই এসে জড় হয় নাট মন্দিরে । ঠাকুর প্রণাম করে  খোল করতাল তাসা সহযোগে শুরু করে কীর্তন প্রভাতী সুরে --
" ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম রে ,
যে জন আমার গৌরাঙ্গ ভজে সে জন আমার প্রাণ রে ..."

    বাড়ি ছেড়ে উত্তর মুখী হয় কীর্ত্তন । চারিপড়া থেকে পৌদ্দা হয়ে উত্তর পাড়ায় যায় । পৌদ্দা থেকে যুক্ত হয় দেবেন্দ্র দেব চিন্তা দেবেরা , যুক্ত হয় কিছু উৎসাহী মুসলিম ছেলে ছোকরাও । একে একে সাধুর বাড়ি সরকার ( নেহেরু) বাড়ি দাসদের বাড়ি করবাড়ি  প্রতি বাড়িতেই নেচে নেচে কীর্ত্তন আর তার মাঝেই গৃহী ফুল বাতাসা কদমা ... দেন হরির লুট । যার ভাগ্যে যা জোটে , সন্তুষ্ট তাতে , কেউ কেউ কমলা লেবুও দিতেন লুটে ।
প্রবোধ দাসের বাড়িতে একটু বিরতি । পিঠে পুলি চা পান তামাক । আবার বেরিয়ে পড়ে নগর কীর্ত্তন । গৌরাঙ্গ দাস মূল সুর ধরে ঘরে ঘরে হরিনাম সুধা নিয়ে যায় । ফিরে আসে আবার চারিপাড়ার , শ্মশানে কীর্ত্তন চলে কিছু ক্ষণ , সেখান থেকে চারিপাড়ার ষোল ঘর হিন্দুর ঘরে ঘরে  । সুর উঠে দাসেরা বাড়ির নাটমন্দিরে পরিশেষে ---
" নগর ভ্রমিয়া শেষে নিতাই এলেন ঘরে ...."
গান বুড়ি প্রমোদাসুন্দরী ধান্য দূর্বা দিয়ে বরণ করে নেন তাঁর প্রাণের গৌরাঙ্গ কে । পিঠে পুলি পায়েস পরিবেশন শেষে সাঙ্গ হয় নগর কীর্ত্তন ।

পকেট ভর্তি লুটের প্রসাদ আমিও চালান করি আমার গোপন সিন্ধুকে ।
তাই না আজ দিয়েছি খুলে
সকলের তরে !

      লাঙল জোয়াল সহ সকল চাষের উপকরণ পরিষ্কার করে ধুয়ে এনে রাখা হয় নিকানো নাট মন্দিরের এক কোণে । লাউ পাতায় দুধভাত,  লাউ বরির (কুল) টক দিয়ে পূজা হয় । রাধা কৃষ্ণের ভোগ লাগে , ভোগ যায় শ্মশানে পিঠে পুলি পায়েস নিরামিষ রন্ধনে ।
কাজের লোকেদের দেওয়া হয় পিঠে পায়েস ।
  অনাড়ম্বর সহজে সরলে গ্রাম বাংলা গ্রামীন বিনোদন ,
আজও চলে হয়ত একটু ভিন্নতর সময়ের সাথে তাল দিয়ে ।
তবে চারিপড়া থেকে আর নগর কীর্ত্তন বেরোয় না , বেরোবেও না আর কোন দিন আর --
কাল হরণ করেছে সব , গান বুড়ি ধরে না গান ভোর রাত থেকে --
" সূর্য বংশে ভগীরথ আগে দেখাইয়া পথ তোমারে অনিল মহিতলে ...
সগর রাজার বংশ ব্রহ্ম শাপে হইল ধ্বংস ...
তোমারে আনিল মহিতলে ...."

 তবে রাঢ়ের অজয় তীরে বসে মকর আসর , তীরবর্তী প্রতি গ্রামের  আখড়া থাকে , কীর্ত্তন বাউল ভাটিয়ালি লোকগীতি গানে গানে মন মাতে , স্থায়ী বাউলের আখড়া তো আছেই । সব মিলিয়ে পাঁচশত । থাকা খাওয়ার চিন্তা নাই , কন্ঠ একটু সুরেলা হলে ত কথাই নাই ,গানও গাওয়া যায় নেচে দোতারা খমকে ।

   বাঁশি বনে নয় মনেই বাজে ।
নিয়েছে যত দিয়েছেও কম নয় !!