নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

|| এক বৃষ্টি রাতের ভোর || শুভঙ্কর গড়াই



- আচ্ছা , তোমার বৃষ্টি ভালো লাগে ?
- হুম , ভালো লাগে । রাতের বৃষ্টিটা বেশি পছন্দের,
আর তোমার ?
- আমার ! ,  আমার কাছে বৃষ্টি অনেকটা নেশার মতো,
বৃষ্টির ছন্দে নিজেকে মাতাল বলে মনেহয় ।
- দেখেছো বৃষ্টির দাপট যেনো আরো বাড়ছে ।
- হুম , মনেহয় বৃষ্টি আমাদের কথাগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছে ।
[ হঠাৎই প্রচন্ড মেঘ ডাকার শব্দ ]
- এভাবে কষে চেপে ধরলে যে , একি আমার প্রতি ভালোবাসা নাকি মেঘের গর্জনে ভয় ?
- হুম , আমার ভীষণ ভয় করে ।
- একি , এই যে বললে বৃষ্টি ভালোবাসা , তাহলে মেঘের শব্দে এত ভয় ?
- ও তুমি বুঝবে  না , সব ভালোবাসায় একটা ভয় ও থাকে ।
- আচ্ছা , তাই নাকি ? তা  এইযে তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো , তাহলে এই ভালবাসাতেও বুঝি ভয় আছে তোমার ।
- হ্যাঁ, আছে তো , খুব ভয় পাই ।
- সে কি , আমি কি তোমাকে ভয় দেখায় নাকি ?
- ধুর বোকা !  এ ভয় সে ভয় নয় ।
- তবে ?
- তবে , তবে এই পাগলটাকে সারাজীবন আগলে রাখতে পারার  ভয় ।
- মানে ?
- মানে , তুমি যখন বর্ডারে যাও তখন ভীষণ ভয় করে জানো !
- ধুর পাগলি , এতো কিসের ভয় । তোমার ভালোবাসা কি আর আমাকে মরতে দেবে ।
- এই একদম উল্টো পাল্টা কথা মুখে আনবেনা ।  একটা রাত তোমাকে কাছে পেয়েছি , কাল থেকে আবার দিন গোনা শুরু হবে ।
- তোমার এই খোলা চুলের গন্ধটা আমাকে পাগল করে জানো । সত্যিই আমি বড়ো অভাগা জানো , দিনের শেষে তোমাকে ছুয়ে দেখার জন্য অন্তরাত্মা টা ছট্ফট্ করে ।
- শুধুকি তোমার , আর আমার করেনা বুঝি ।
- এই তুমি কাঁদছো কেন ?
- ও কিছুনা , চোখে একটু জল এসেছে এই যা ।
- এই দেখো বোধ হয় কারেন্ট অফ হয়ে গেল । ড্রয়ারে একটা মোমবাতি আছে , দাঁড়াও ওটা জ্বেলে আসি ।
- দাঁড়াও , অন্ধকারে নেমো না , আমি ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বলছি ।
- কি দেখছো অমন করে , আরে ফ্ল্যাশটা অফ করো আমার তো মোমবাতি জ্বালা হয়ে গেছে ।
- ফুলের বাগান দেখছি প্রিয় । বহু দিনের কাঙ্খিত আমার একান্ত ফুলের বাগান ।
- উফফ , কি যে বলোনা তুমি ।
[ ফ্ল্যাশটা অফ করতেই সমস্ত ঘরটা মোমবাতির অগ্নিশিখার সোনালী আলোয় মেতে উঠলো ]
- দেখেছো বৃষ্টিটা কেমন নিজের তেজ সমান তালে ধরে রেখেছে ।
- হুম , হয়তো আমাদের এই মুহূর্তটাকে আরো ভালোবাসায় ভরিয়ে তোলার জন্য। হয়তো বৃষ্টি ও রাতের আকাশের সাথে প্রেমে মেতেছে ।
[ এর পর এক স্তব্ধতা , এই স্তব্ধতা যেনো দুটো শরীরের হাজার হাজার কথোপকথনের  একান্ত গোপণ পথ ।এই স্তব্ধতায় দুটি শরীরের আত্মা , দুটি শরীরের হৃদয় যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছে , দুটি ঠোঁটের এই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে যেনো মোমবাতির অগ্নি শিখাও লজ্জায় কেঁপে উঠছে । মোমবাতির আলোয় ঘরে এক অদ্ভুত মায়া সৃষ্টি হয়েছে , সেই মায়ার বাঁধনে দুটো শরীর অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দুটি শরীরের এতদিনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা সমস্ত ভালোবাসার ক্ষুধা যেনো পাকে পাকে গর্জে উঠছে । এই গর্জন বৃষ্টি ভেজা রাতের গর্জনের শব্দকে হার মানিয়ে আবার ঠোঁটের মিলনে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে । ঘরের দেওয়ালে মোমবাতির আলোয় যেন দুই নগ্ন দেহের ভালোবাসা মাখা আলপনা সৃষ্টি হয়েছে । ]

- তোমাকে এভাবেই আমার অন্তিম নিশ্বাস পর্যন্ত কাছে পেতে চাই । বলো , এভাবেই থাকবে তো আমার পাশে । থাকবে তো আমার হয়ে !

- হুম কথা দিচ্ছি অন্তিম নিশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব ।

[ অনেকটা রাত পেরিয়ে এসেছে , বৃষ্টির প্রতি ফোঁটা হীরক টুকরোগুলো ধীরে ধীরে আকৃতিতে ছোটো  হয়ে তেজ কমাচ্ছে । মেঘের দূর প্রান্ত থেকে মৃদু মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে ! ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই । কিছুক্ষণ পরেই  বৃষ্টি ভেজা পাখিগুলো ভোরার আলোয় কিচির মিচির শুরু করে দেবে । মেঘের বুক চিরে দূর প্রান্তে মৃত নদীর মতো ভোরের আলো উকি দিচ্ছে ।]

- এই তোমার পিঠের তলায় বোধহয় আমার ব্লাউজ টা আছে , একটু  পিঠটা তলোতো ।
- হুম , এই নাও ।
- এই শুনছো ঘড়িতে পৌনে পাঁচটা বাজে । আমি তোমার ব্যাগ রাতে গুছিয়ে রেখেছি , তোমার তো সাড়ে ছটায় ট্রেন আছে , তুমিও উঠে পড়ো এবার , আমি তোমার জন্য চা করে আনছি । ।


অটোওয়ালা : রাণা চ্যাটার্জী





অটোওয়ালার হাতে সত্তর টাকাটা এমন ভাবে গুঁজে দৌড় দিলেন পালবাবু  যেনো আর বেশি চাইতে পারার অবকাশ না পায় চালক ! অবশ্য অন্য কারণটাই প্রধান,ওই যে স্টেট বাসটা ছেড়ে যাচ্ছে সেটাকে  কোনরকমে ধরতেই হবে আজ । 

প্যাচ প্যাচে কাদায়,ভিড় ভাট্টার মধ্য দিয়ে ততক্ষণে এই একমাত্র অবলম্বন বাসটি গড়াতে গড়াতে গতি নিচ্ছে । 'আরে দাঁড়াও দাঁড়াও করতে করতে অফিস ব্যাগ ,বগলে ছাতা নিয়ে ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবেন কি তখনও রাস্তা ক্রশ করে উঠতে পারেন নি বাইক ,অটো ওলাদের লাগাতার  লাইনে। ভিড় যতো বাড়ছে , বাসটা না পাবার গ্লানি ভ্রু কুঞ্চনে ততো  ধীর্ঘ হচ্ছে  ইরিগেসন দপ্তরের পাল দার ! আর থামে প্যাসেঞ্জারে  উপচে পড়া বাস ! ভুঁড়ি মোটা ট্রাফিক পুলিশ , দুবার লাঠির বাড়ি মারতেই চাকা গতি বাড়িয়ে এলাকা ছাড়ার প্রস্তুতি । তবুও ছুটেই চলেছেন যদি সামনের মোড়ের যানজটে, আর একটু দাঁড়ায় বাসটা ! 

"আরে ও দাদা, ও দাদা দাঁড়ান দাঁড়ান ছুটবেন না "আশ্চর্য্য তো ,  সেই ছেড়ে আসা অটোওয়ালাটার গলা না ! " আচ্ছা বজ্জাত তো ,উঠে থেকে আশি টাকা নেবার কথা বলে আসছিল" কিন্তু সত্তরের বেশি এক পয়সা দেবো না জিদ করে ছিলো পাল দা , নেমে দিয়েওছে সেটা,তবুও কিনা পিছু ধাওয়া ! ছুটতে ছুটতে এই কথা গুলো ভাবছিলো আর নাহ্,  পারছি না ,ছেচল্লিশ টা বসন্ত পার করা পালদার বুকের ভেতর টা ধরাস ধরাস করছে ,এই বুঝি হৃৎপিণ্ড ছিটকে বেরিয়ে আসবে ! বাসের আশা ছেড়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়তেই সেই অটো ওয়ালার সক্কাল সক্কাল এক মুখ পান বজবজে গলা ! 

"আরে কি হয়েছে কি তোর ! তোকে তো ভাড়া মিটিয়েই এলাম "একটু ক্ষেকিয়েই কথা গুলো বলে ফেললো  পালদা  ! সকাল থেকেই তার মেজাজটা খিচড়ে দিয়েছে অফিসের বড়ো বাবুর একটা ফোন "হটাত নাকি ইন্সপেকসন আসছে , দশটার আগে অফিস আসতেই হবে !" অন্যদিন খেয়েদেয়ে , সাড়ে নটায় বেরিয়ে, পরের বাস ধরে পৌনে এগারোটায় পৌছানো অভ্যাস , তাই আজ এই ৮-৫০ এর স্টেটটা ধরার এত্তো তাড়া ছিলো , ! 

"আরে দাদা তুমি খামোখাই রাগ করছো আমার ওপর" হাতে খৈনি ডলতে ডলতে উজ্জ্বল মায়াবী চোখে তাকিয়ে কথা গুলো বললো অটোওয়ালা ছেলেটা । কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাল ঘাড় উঁচু করে ওর দিকে তাকাতেই সে বললো , 'দাদা বসো , আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি তোমায় , আরে চিন্তা করো না দাদা বসো ,কোথায় তোমার অফিস শুধু সেটা বলো "
অলরেডি সকালে চৌদ্দটাকার  পরিবর্তে সত্তর খসেছে , আবার অটোতে মিনিট চল্লিশের পথ মানে মিনিমাম দুশো ! এই চিন্তায় বিভোর হওয়ার আগেই অফিস ব্যাগটা ধরে , "আরে এসো তো , সে আমায় না হয় কিছু দিতে হবে না "বলে অটোতে বসিয়ে স্টার্ট দিলো ! 

চিরটা কাল এই সংখ্যাতত্বের আঁকিবুঁকি হিসাবে সংসার চালানোর মতো কঠিন কাজে  জর্জরিত, পা টিপে চলা  মধ্যবিত্ত এই ছাপোষা মানুষ পালদা।  আর না করেন নি মুখে , করার উপায় ও খুব একটা ছিলো না । এটাই তাকে স্বস্তি দিয়েছে যে বেশি টাকা লাগলেও , দশটার আগে অফিস পৌঁছে গেলে অন্তত তার ইমেজটা ঠিক থাকবে অথরিটির কাছে । এই ভাবতে ভাবতেই ক্যাঁচ করে আমতলা মোড়ে আটকে গেলো অটোটা , সামনে তীব্র জটলা , ভিড়ে থিকথিক করছে ! অটোওয়ালা ছেলেটি ,  নেমে পরিস্থতি বুঝে এসে জানালো, কেলো হয়েছে , একটু আগে স্টেটবাস টা এক পথচারি কে ধাক্কা মেরেছে , স্থানীয়রা পথ অবরোধে সামিল ! 
হে ভগবান , কি যে আছে কপালে একথা ভাবতেই অটোওয়ালার নিশ্চিন্ত অভয়বাণী "দাদা সবে নয়টা বেজে সতের মিনিট ঘড়িতে , আমি ভেতরের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি  আপনাকে , বিন্দাস বসুন চিন্তামুক্ত হয়ে ! "

"আচ্ছা কপালের গেরো লেগেছে তো আজ !তবে তো ওই স্টেট বাসটা না পেয়ে ভালোই হয়েছে ! অফিস পৌঁছানোর বারোটা 
বেজে যেত ,"এসব সাত পাঁচ ভাবনা ভাবতে ভাবতে গলি ,গলি তস্য গলি দিয়ে এগুতে লাগলো অটো।
কাউকে পেমেন্ট দিতে হলে ,সে বাস,ট্রেন অটো যাকেই হোক না কেনো ,অনেক আগে থেকে কিছুটা টাকা বের করে জামার পকেটে রেখে দেবার বহু পুরনো অভ্যাস পাল দার ।কিন্তু একি কাণ্ড ! প্যান্টের পকেটে  মানি ব্যাগ হাতড়ে তো চক্ষু চড়ক গাছ !কেবল রুমাল টা !তবে কি আনেন নি !উঁহু তা হয় কি করে ,সকালে নিজে ওখান থেকে সত্তর টাকাটা নিয়ে  মিটিয়েছেন ! তবে কি রাস্তায় পরে গেলো ! চুরি নয় তো ,আরে কি সর্বনাশ আজ ছাব্বিশ তারিখ,এল আই সি প্রিমিয়াম ৫৪৩৫ টাকা গুনে কালরাতে গুনে  মানিব্যাগে রেখেছেন ! এই সব স্বগতোক্তির মতো বিড় বিড় করছেন আর কল কল করে ঘামছেন পাল দা !

ইশ এই অটোওলাকেই কি বলবে !এত্তো হয়রানি করে বেচারা নিয়ে আসছে ।লজ্জায় ,সংকোচে কাঁচুমাচু মুখ করে থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ ভেতরে !

"আরে ও দাদা ,ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি ! আরে দেখুন এসে গেছি আপনার অফিস "বলে হাত ঘড়িটা পেছন করে দেখালো নয়টা বেজে আটচল্লিশ ! ছেলেটির স্বগর্ব ঘোষণায় আরো যেন থমকে গেলো পালদা ,ওকে কি যে উত্তর দেবে ! নিচে আড়ষ্ট ভাবে নেমে আমতা আমতা করে দু হাত জড়ো আর  মাথা নিচু করে পালদা বলছেন ,'ভাই আমার খুব বিপদ হয়ে গেছে ,মানি ব্যাগটা খোয়া গেছে " যেই এটা বলা শেষ হয়েছে "আরে মশাই একি করছেন দাঁড়ান দাঁড়ান ,এই নিন আপনার মানি ব্যাগ !আপনি সকালে নেমে যেতেই দেখি পেছনের সিটে ফেলে গেছেন ,আর সেই জন্যই আপনাকে পিছু পিছু "ও দাদা ,ও দাদা করে হেঁকে অস্থির হয়েছিলাম ।"এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামলো অটোওলা ! 

ব্যাগ টা হাতে নিয়ে পাল দা তখনও কল কল করে ঘামছেন ,যেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন !কেয়ারটেকার চাবির গোছা নিয়ে অফিসের মেন গেট খুলছে ,আর সামনে যেন সাক্ষাত ভগবান রূপে অটোওলা । একটা ৫০০ টাকা জোর করে হাতে গুঁজে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন নাছোড়বান্দা অটোওয়ালার কাছে ,কিছুতেই সে বেশি নেবেনা ।ছেলেটি দেড়শো নিয়ে বাকিটা ফেরত দিতে বাধা পেয়ে ,অবশেষে পাল দার পকেটে জোর করে ভরে দিলো বাকি টাকাটা ।অটো টা স্টার্ট দিতে দিতে বললো ,দাদা একটু সাবধানে হাঁটা চলা করবেন ,আর পারলে টিভি বাবু দের কাছে আমাদের ভালো দিকটাও অল্পবিস্তর বলবেন গো "

অফিসে নিজের টেবিলে পৌঁছে এক বুক শ্বাস নিলেন পাল দা ,হাত ঘড়িতে তখন নটা বেজে সাতান্ন মিনিট । রাত্রে গদ গদ হয়ে বড়ো বাবু মিত্র ফোনে খুশির খবর দিলো ,"ভায়া পার্টি দিচ্ছ কবে ,কতৃপক্ষ তো তোমার প্রমোশন দিচ্ছে শিগগিরি !"

পারুলের ফুলসজ্জা




                        (এক)


আজ পারুলের বিয়ে।তত্ত্ব এসেছে ওঝা বাড়ি থেকে। তত্ত্বের বহর দেখে বউ,ঝি দের চোখ ছানা বড়া।  পারুলের মা বলে-" জানি গো জানি, এমন না হইলে কি আর ওঝা দরের (ঘরের) বউয়ের গায়ে হলদি হয়। আমার পারুলটা জন্মাইছে ভাগ্য লয়ে। ব্যাগলোক(সবাই) শুধু শুধুটাই ওর লগে বর খুঁজে মরছিলা গো।"

কথাটা কিছুটা তাপসের মাকে খোঁচা দেওয়ার জন্যই বলা। জন্ম থেকে পারুলকে ঘরের বউ করার সাধ ছিল বড়। মনে মনে বলে পারুলের মা - "সম্পত্তি বলতে তো উই কয়েক বিঘা জমিন মাত্তর। এখনও বাপ দাদার তৈরি কাঁচা মাটির দরেই(ঘরেই) রয়। তাতে আবার তাপসের তিন বোন।ঝেঁটা মারি অমন সম্বন্ধের মুখে। নেহাত পারুলের নীচে আরও দুটো ঝি আছে বলে না রাজি হইছিলি। কিন্তু পাকা কথা হয়নাই। আর ওমনি এল বিপিন ওঝার সম্বন্ধটা। পারুলটা তো আর দেখতে মন্দ নয়। মোটের ওপর ভালই। গায়ের রঙ সাফা , নাক উঁচা , শরীর স্বাস্থ্যও মন্দ না  ।  নীচের দুই বোন তো কালি পেঁচি। মা মুখী।পারুলটা কি করে যে সুন্দরী হইল।বাপ তো কাকের মত কালো, ইয়া দামড়া চেহারা। "

সবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কলেজে পা রেখেছিল পারুল।তার মা বাবার ইচ্ছা ছিল তাকে কলেজটা পাশ করায়। 
ভাগ্যিস কলেজ পড়ানোর কথা মনে এসেছিল! নইলে আজ সে তাপসের মায়ের ঝিগিরি করত। অমন রাজরানি হওয়ার ভাগ্য নিয়ে আসা মেয়ে!-  ভাবলেই শিউরে ওঠে পারুলের মা। এখন তো শুধু বড় মেয়ের বিয়েই নয় ছোট দুটার বিয়ের খরচ খরচাও তুলে দেবে ওঝারাই। ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে তার ।   


তত্ত্ব নিয়ে আসা ছেলে ছোকরাদের উঠোনে চেয়ার পেতে বসানো হয়েছে। তাপসও এসেছে তাদের সঙ্গে। পারুলের না চাইতেও একবার চোখাচোখি হল। চোখ নামিয়ে নিয়েছে পারুল। পারুলের বাঁ চোখ ট্যারা, ওই লক্ষ্মী ট্যারা না গজ ট্যারা কি যেন বলে। গায়ের লোকে বলে পারুল যার ঘরে যাবে সোনা ফলবে।

বিপিনের কুষ্টিতে নাকি ফাঁড়া আছে, জলে ডুবে মরার ফাঁড়া। গনৎকার বলেছে লক্ষ্মী ট্যারা মেয়েকে বিয়ে করলে ফাঁড়া কেটে যাবে। বিপিনের ঠাকুমা যেচে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পারুলের সেদিন ইচ্ছে করেছিল বাম চোখটা মনসা কাঁটা দিয়ে গেলে দিতে।  
তখন সবে ফুটেছিল বুকে দুটো কুঁড়ি, বয়স ওই বারো হবে, বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে তাপস সজোরে হাত দিল সেই কুঁড়িতে।টনটনে ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছিল পারুল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল নোনা ধারা। তাপস ঠোঁট ছুইয়ে চুষে নিয়েছিল সেই জল। বলেছিল -" তুই তো মোরই বটে, তু যেদিন ডাগর হবু, সেদিন বুকে জাড়ায়ে সোহাগ করব। সেদিন দেখবি আর বথা হবে নি কো।"
 
পারুলকে রোজ কিমি তিনেক সাইকেল চালিয়ে স্টেশন গিয়ে ট্রেন ধরে কলেজে যেতে হয়।  এই তো সেদিনও পারুল স্টেশন যাওয়ার পথে সরাই দীঘির পাশে চিনুদের আখ খেতে শুয়ে থেকেছে তাপসের বুকে মাথা রেখে। তাপস বলে-" লিইখ্যা পইড়্যা তু মাস্টারনি হবু আর আমি জমিনে লাঙ্গল দিব, তু ছেলে পিলে মানুষ করবু আর আমি ধান ভাঙব। ই সব ভারী ভারী কাজ তোকে করতে দিব নারে পারুল।তু আমার লেখাপড়া জানা বউ বটে।"

আর যেই না বিপিনের সম্বন্ধ এল অমনি সেই ছেলে বলে কিনা -"রাঘব বোয়ালের সাথে লড়তে পারবনি রে পারুল, মোরা চুনোপুঁটি বটে। "

বাড়ি ফিরে পারুল সানন্দে হ্যাঁ বলেছে এই বিয়েতে।অবশ্য না বললেও বিয়ে হতই।পারুল ভাবে -সেই যখন শিকার হব তখন রাঘব বোয়ালেরি হই। শিকারো খুশি, শিকারিও। 
তাপস যে এত নির্লজ্জ হবে, বিপিন ওঝার গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে হাজির হবে পারুলের বাড়ি, এতটাও ভাবেনি পারুল। এতদিন ভীতু বলে যাকে ঠাহর হচ্ছিল আজ তাকে সরীসৃপ জ্ঞানে ঘৃনা হতে লাগল পারুলের।   

পুকুর পাড়ে সিল পেতে বসানো হয়েছে পারুলকে। লাল পাড়ের হলুদ জামদানী গায়ে, গলায় গাঁদার মালা, হাতে পায়ে ফুলের অলঙ্কার। সমস্ত দৃশ্য ভিডিও হচ্ছে। বিপিন লোক পাঠিয়েছে ভিডিও করার জন্য। 
এঁদো পুকুরে শেষ বারের জন্য ডুবে নেয় পারুল।পুকুরের জলে পাঁকের গন্ধটা তাকে আশৈশব ফেলে আসা দৌরাত্ম্যের কথা স্মরন করিয়ে দেয়। সেই পাঁকে হাত ডুবিয়ে প্যাঁকাল মাছ ধরা, দোলের দিনে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি , সেই গ্রীষ্মের দুপুরে কলার ভেলা ভাসিয়ে সতী বেহুলা সাজা, আরও আরও কতকি যে স্মৃতি জড়িয়ে! বিপিনের ঘরে আছে নাকি স্নান ঘর! সাদা পাথর বসানো স্নানঘরের দেওয়াল জুড়ে নীল ডলফিন মুখ তুলে চায়! ঘরের মাথায় নাকি ফোয়ারা লাগানো, কল মুড়লেই ঝিরঝির করে ঝরনার মত জল ঝরে! কাঙাল বুড়ি এসে এসব খবর দিয়ে গেছে তাদের ঘরে।পারুল একদিন বৈচি কুলের গাছেটার নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় ধরেছিল বুড়িকে।
-"ও কাঙাল দিদা...,   তোমার বিপনার সেনানঘরে আকাশ আছে? নীল নয়তো ঘন কালো মেঘে ছাওয়া আকাশ!"
কাঙাল বুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল-' আ মরন, মাগীর পেটে ঘি ভাত সইছে নি লা। '

একে একে শুভ দৃষ্টি, মালাবদল, সাতপাকে ঘোরা, সিঁদুর দান সম্পন্ন হল। শুভদৃষ্টির সময় পারুলের একবার যা চোখ গেল বিপিনের দিকে। বেঁটে- খাটো, মোটা মানুষ বিপিন।বয়স ওই পঁয়ত্রিশের আসে পাশে। মেদ বহুল মুখে বসন্তের দাগ।চোখ জোড়া রাঙা। দেখে বুকটা ছেৎ করে ওঠে পারুলের। চোখ নামিয়ে নেয় সে। মালুয়ার ভূষিমাল দোকানের পিছনে একবার বিপিনকে সে দেখেছিল হরির বউয়ের সাথে জড়াজড়ি করতে । সেই থেকে বিপিনকে তার বন্য শুয়োরের মত লাগে। আজ সেই শুয়োরের গলায় মালা দিল সে। ভাবতেই হাসি পেল। নিজেকে উপহাস্য করতে ইচ্ছে হল তার।        
  

ভোরের আলো ফোটার আগে, পাখিরা সব বাসা ছেড়ে যাওয়ার আগেই পারুলের বিদায় হল।পারুল কাঁদেনি একফোঁটা।মা বাপ বেচে দিয়েছে তাকে ভাল দরে। ওঝা বাড়ির বউ সে এখন। একফালি নিকানো মাটির উঠোনের দক্ষিন প্রান্তের গন্ধরাজ লেবুর গাছটা আড় চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। যাওয়ার আগে পারুল দুটো পাতা ছিঁড়ে নেয়।বড্ড গা গুলোচ্ছে। নিজের দ্বিগুন বয়সী লোকের শয্যা সঙ্গী হতে হবে তাকে!  বিপিনের একপাল চামচা এসেছে, তাপসটাও। তাপস ছুঁলে শরীর জুড়ে হাজার ভোল্টেজের কারেন্ট বয়ে যেত! 

গায়ের লোক ভিড় করে এসেছে নতুন বউ দেখার জন্য। এতদিন যাকে হারার বেটি বলে তাচ্ছিল্য ভরে দেখেছে সকলে, আজ বিপিনের বউ হওয়াতে তাদের চোখে সম্ভ্রম নাকি চাপা ইর্ষা বোঝা দায়। বিপিনের ভিটে বাড়িতে প্রবেশ করতেই পারুলের বুকটা ভয়ে হিম হয়ে যেতে লাগল। বিশাল এক প্রাচীরে ঘেরা বিপিনের কেল্লা। মনে হয় যেন গ্রাম থেকে অনেক অনেক যোজন দূরে এসে গেছে সে। বড় বড় আম কাঠাল, লিচু, নারকেল গাছে ঘেরা এক অট্টালিকা। বাইরের আলো, বাতাসের এখানে প্রবেশ নিষেধ। 
 ঘরের সামনে অযত্নে বেড়ে ওঠা  ঘাসের গালিচা । বিভিন্ন ফুলের গাছ, পাতাবাহার একসময় যত্ন করে লাগানো হয়েছিল মনে হয়। এখনো সেই যত্নটুকু বুকে নিয়ে অযত্নে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা  এখানে ওখানে। বাড়ির পিছনে এক 
পাড় বাঁধানো দীঘি, সবুজ তার জল । সেখানে সারি সারি সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে।  মাটির বিশাল উঠোন পেরোলে বাঁ দিক ঘেঁসে পাকার মূল ঘর। ঘরে সদস্য বলতে বিপিন আর তার ঠাকুমা। বুড়ির বামচোখ ছানি পড়ে কেমন ধূসর দেখায়। পৃথুলা চেহারা, মাংসল গাল দুটো বেগুনীর মত ফুলে থেকে ঝুলে পড়েছে, তাতে বসন্তের দাগ।পারুলের মনে হয় বিপিনটারও বুড়ো হলে এমন রুপ হবে।
 গাঁয়ের লোকে বলে বিপিনের মাকে নাকি এই বুড়ি আর তার ছেলে মিলেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বিপিন তখন হামা দিচ্ছে সবে। বিপিনের এক দিদি আছে, শহরে বিয়ে হয়েছে তার। বর উকিল। বিপিনের বাপ কর্কট রোগে মরেছে দুবছর আগে। বুড়ির  আদরে বিপিন এমন বখাটে। শিক্ষা বলতে নামসইটুকু। একাধিক ব্যবসা রয়েছে তাদের। বরফ ফ্যাকট্রি, মাছের ফিড ব্যবসা, চাল মিল। একার হাতে এসব চালানো অসম্ভব। তাই বাপ দাদার আমল থেকেই এই ঘরে গাঁয়ের ছেলে ছোকরার আসা যাওয়া।  বিপিনের চ্যালা সব।তাপস তো বিপিনের ডানহাত। বিপিনের কথায় ও হয়ত মানুষ খুন করতেও পারে।  যদি প্রথমেই জানত পারুল বিপিনের সম্পত্তি, তবে কি আর তার সাথে পিরিত করত! 

এক গামলা দুধে বর কনে হাত ডুবিয়ে খুঁজছে আংটি। স্ত্রী লোকাচার যত। পারুলের বেশ মজা লাগছে এই খেলায়। মেতে উঠেছে সে। বারবার বিপিনকে হারিয়ে আংটিখানা খুঁজে নিচ্ছে । গ্রামের বউরা সব খিলখিলিয়ে হাসছে বিপিনকে হারতে দেখে। 
কাঙাল বুড়ি তো বলেই ফেলল-" বাছা আর পারবুনি লো টিকতে। হারার বেটিই তোরে হারায়ে ছাড়ব। মুখপুড়ি যে কলেজে যাওয়া মেয়ে মানুষ লো। নেখা পড়া জানা মেয়ে মানুষ।ওই তোরে বশ করব দেখ।"

বিপিনের ঠাকুমা বলে-" আ মরন....., মেয়্যা মানুষ কলেজ যাক কি সগগে যাক, মরদের নীচেই মেয়্যার থান। আমার বিপিন কে কেউ জব্দ করতি পারব নি গো কাঙালের বউ।" 

পরপর দুবার পারুলের কাছে হারার পর বিপিনের জেদ চেপে গেল মনে। হাভাতে ঘর থেকে আনা বউকে আজ থেকে দাবিয়ে না রাখলে মাথায় উঠে নাচবে। আর বিপিন বউকে মাথায় তোলার মত ছেলে নয়। এবারো পারুলই পেল আংটি খানা হাতে। খুশির ঝিলিক খেলে গেল মুখে। কিন্তু তারপরেই দুধে দুবে থাকা হাতখানা সজোরে চেপে ধরল বিপিন।ছিনিয়ে নিল আংটি তার হাত থেকে। একনজর বিপিনের দিকে চাইল পারুল। চোখে তার ক্রুর দৃষ্টি।  সগর্বে আংটিখানা তুলে ছুড়ে দিল মেঝেতে বিপিন। তারপর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল সদরে। কেউ জানল না পারুলের পরাজয়ের রহস্য। 

বিয়ের পরের দিনই দিন- দুপুরে সাধারণত গ্রামে গঞ্জে বৌ ভাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলা হয়।নতুন বউ বিয়ের বাসি শাড়ি পরে, গুড়ো গুড়ো ঝরে যাওয়া চন্দন  আর থ্যাবড়ানো কপালের সিঁদুর নিয়েই গুটিসুটি মেরে  বসে বসে ঢুলতে থাকে। লোকজন এসে থালা, বাসন, গ্লাস, কেউ বা একশটা টাকা বউ এর হাতে গুঁজে দেয়। তবে বিপিনের ব্যাপার আলাদা। বৌভাত তাদের আজ রাতেই। 

বিপিনের ঠাকুমা নিদান দেয়-"ও  বৌ যা, কাপড় ছাইড়া, নাইয়া- ধুইয়া পায়েস চড়া দিকি উনুনে। মোদের বংশের রেয়াজ এটা বটে। নতুন বউ নিজের হাতে পায়েস রাইন্ধে আত্মীয়, কুটুম, গায়ের ব্যাগ লোক খাওয়াব।" পারুল মাথা ঝুকিয়ে ঢুকে যায় ঘরের ভেতরে।    

রাতে বৌভাতের আসরে সোনায় মোড়া পারুল বসে থাকে পুতুলের মত। লোক জন আসে -যায় কাতারে কাতারে। বৌভাতের পায়েসে দূধ চিনির হিসাব মেলেনি। শুনতে হয়েছে-" হাভাতে দোরের বিটি,   রাইন্ধতে শিখে নাই।"  খিদেয় পেট গুলিয়ে উঠছে পারুলের। বেগুনি ভাজার গন্ধ আসছে। মাঝে মাঝে মাংস কষার গন্ধ নাকে ঝাপটা মারছে। পেটটা বারবার গুলিয়ে উঠেছে। কেউ খেতে ডাকেনি। বাড়ির মেয়েরা পারুলের আগামী সৌভাগ্য নিয়ে চর্চায় ব্যস্ত। বিপিনের ঠাকুমার মুখ ভার। নতুন বউয়ের হাতের পায়েস বিস্বাদ, অমঙ্গলের লক্ষন সব। বিপিন সকাল থেকে বেপাত্তা। অনুষ্ঠানের সমস্ত দায়িত্ব তাপস আর দু এক জন বিপিনের সাগরেদের হাতে। সন্ধেবেলা কোথা থেকে আগমন হল বিপিনের। পরনে তার মেরুন রঙের জমকালো শেরওয়ানী৷ ঝুলটা একটু বেশীই লম্বা। অদ্ভুত কদাকার লাগছে বিপিনকে। পাশেই রানী কালারের জমির ওপর রুপোলী বুটির বেনারসি পরে সোনায় মোড়া জড়োসড়ো পারুল যেন ঢাকা পড়েছে বিপিনের কাছে।  

অনেক রাতে খাওয়ারের প্লেটের সামনে বসল পারুল আর বিপিন। সামনেই ক্যামেরাম্যান। বর কনের খাওয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী হচ্ছে। পারুলের এখন হুশ নেই। অষ্টাদশীর খিদে বড়ই বেশি। খিদের জ্বালায় গিলে ফেলছে সে যা পাচ্ছে পাতে। বিপিনের চোখ রাগে রাঙা হল। টেনে নেয় সে প্লেট পারুলের সামনে থেকে। তারপর বিপিন  কখন খাসির এক মস্ত টুকরো , কখনো রাজভোগ পারুলের মুখের সামনে ধরে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।    



৩                                         
কালরাত্রি তাই একা দোতলার নৈঋত কোনের ঘরে পারুল শুয়ে পড়ে পালঙ্কের কোন ঘেঁষে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাড়ির পিছনে সারি সারি সুপারি গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে। হালকা বাতাসে দুলতে থাকে, আলো আঁধারে বড় ভয়ংকর লাগে সে দৃশ্য।  যেন কোন একপেয়ে দানব হাতছানি দেয় দুলে দুলে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে পারুল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, রাত্রি তখন দুই প্রহর, দরজা খুলতেই টলতে টলতে বিপিন ঢুকে পড়ে ঘরে, জাপটে ধরে পারুলকে, মুখে তার দেশী চুল্লুর গন্ধ। ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করে পারুল। আত্মীয় স্বজন জড়ো হয় দরজার সামনে। মৃদু ভৎসনা আর অশ্লীল পরিহাসে বিপিনকে টেনে বার করে তারাই  ঘর থেকে।              
           

 পারুলের উদ্দেশ্য বলে- "ন্যাকা ষষ্ঠী, ভাতার পিরিত করতে আইলে আবার চিল্লে পাড়া জাগাইনো,  এতই যদি ভয় পেরানে তো বিয়া  কেনে কর বাপু।" 

পারুল শ্বাস নেয় জোরে। আজকের মত রেহাই পেল সে। কালরাত্রি,  এই রাত্রির যেন শেষ না হয়। সোহাগ রাত্রি সে চায়না আর। হায় কি ভুল করল সে!  তাপসের ওপর অভিমান নাকি প্রতিশোধ নিতে চাওয়া!  কেন সে পালিয়ে গেল না বাড়ি ছেড়ে! 

কালকের রাত ফুলসজ্জার রাত। তার শরীর ও মনের সবটুকু সুগন্ধ নিচড়ে নেবে বিপিন। অজগরের মত গিলে নেবে তার পুরো সত্ত্বা। সেই অজগরের বেষ্টনী যে কতখানি দমবন্ধকর, তা সে আজ ভালোই অনুভব করেছে! 
আচ্ছা, এ ভুলের কি কোন ক্ষমা নেই! সে কি ফিরে যেতে পারে না তার বাপের কুঁড়ে ঘরে! খেটে খাবে, তবু একটু খোলা আকাশ, নিজের শরীর আর মনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ, এটুকু কি খুব বেশি কিছু চাওয়া! পশুও তো বেঁচে থাকার এটুকু অধিকার পায়! 
 
হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল সে একলা ঘরে। একবার ভাবল খিড়কি খুলে ঝাপিয়ে পড়ে ঝুল বারান্দা থেকে বাঁধানো দীঘির পাড়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। হালকা বাতাসে সুপারি গাছগুলো নাগাড়ে দুলে চলেছে। লম্বা কান্ড পেরিয়ে ডগার কাছে তার ঝাকড়া পাতা আর সুপারির কাঁদি।তার উপরে ভরন্ত যৌবনা চাঁদ। আবছা ছায়া পড়েছে দীঘিরজলে। দুলছে ছায়া মৃদু মৃদু। পূর্ণ যৌবনা চাঁদের ছায়া জলে পড়ে তিরতির করে কাঁপছে। যেন বলছে তারা-" শেষ নয়, শেষ নয়। রুপ,রস গন্ধ যে আরও নেওয়া বাকি। থেমে যা কয়েক দন্ড। মরার জন্য হোস নে উতলা। শ্বাস নেওয়া যে বাকি তোর আরও কয়েক দন্ড। "
এঘরে আসার পর প্রথমবার সারি সারি  সুপারি  গাছগুলোকে তার বড় ভাল লেগে গেল। নিজের মনে হল। পারুল বলল-" বেশ তো যেদিন অমাবস্যা গিলে খাবেক চাঁদকে , সেদিন দেখবু  ঠিক মুই ঝাঁপ দেব ইখান থেকে। সিদিন দেখব তোরা কিরম মানা করু। " 
ধীরে ধীরে চারিধারের কালিমা নরম হচ্ছে। পূব আকাশে নিশ্চয়ই রাঙা রবি উঁকি দিয়েছে। পারুল তাকে দেখতে পাচ্ছে না। মনটা আবার ভারী হয়ে উঠল। আজ তার ফুলসজ্জা। আজ নাকি বড় আনন্দের দিন। হায় ঈশ্বর, মন্ত্রবলে বিপিনকে অন্তত আজকের জন্য তাপস বানিয়ে দাও।  
ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজনরা বিদায় নিচ্ছে। পারুলের ননদ স্বামী-ছেলে নিয়ে বিকাল বিকাল বেরিয়ে গেল। এরই মাঝে পারুলদের বাড়ির লালি গাই চরতে চরতে এপথ দিয়ে হেঁটে গেছে। ঘোমটায় ঢাকা পারুলকে দেখে দুদন্ড সে দাঁড়িয়েছিল মুখ তুলে।বিপিনদের বাড়ির মূল ফটক থেকে দেখা যাচ্ছিল লালিকে মোরাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে।  এ বাড়ির নারকেল গাছে বাসা বাঁধা লেজ চেরা ফিঙেটা ভারী পাজি। উড়ে গিয়ে বসল লালীর কুঁজে। গায়ে বারবার ঠক্কর দিয়ে বিরক্ত করতে লাগল তাকে। 

বিপিনের ঠাকুমা ভিতর থেকে ডাক ছাড়ল, -" ও বৌ, বলি ও হাভাতে ঘরের মায়্যা,  কি আক্কেলে ভর দুপুরে খাঁড়ায়ে আছ সদরে শুনি। নতুন বউয়ের যদি একটু লাজশরম রইত গো। "
পারুল ধীরে ধীরে ঢুকে গেল ভিতরে। লালি কিছুক্ষণ ফিঙের দৌরাত্ম্য সয়ে সয়ে তাকিয়ে রইল ঘাড় উঁচু করে সে দিকে। তারপর লেজের ঝাপটায় ফিঙেকে তাড়িয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেল বাড়ির পথে। 
বিপিনের সাঙ্গপাঙ্গরা  এসে ফুলসজ্জার বিছানা সাজিয়ে দিয়ে গেছে। সুগন্ধি রজনীগন্ধা আর গোলাপে মোড়া বিছানা। যাওয়ার সময় নমস্কার করল তারা পারুলকে । তাপস তখনও গোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে সাদা চাদরের ওপর পানপাতার মত চিহ্ণ আঁকতে ব্যস্ত। বিপিন অদূরে দাঁড়িয়ে গুটখার কষ লাগা দাঁত বার করে হেসে চলেছে কয়েকজন সাগরেদের সঙ্গে। তাপস এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল পারুলকে। পারুলের গায়ে কাটা দিল। একি নিজের পাপ লুকাতে বিপিনের চোখে সাধু সাজা! নাকি এই স্পর্শ নিতান্তই পরিহাস ছলে! গা জ্বালা করতে লাগল পারুলের। আজ নষ্ট হবে পারুল, রিক্ত হবে পারুল, ধর্ষিত হবে পারুল। বারে প্রেমিক পুরুষ!! নিজ হাতে রচনা করলে প্রেমিকার ধর্ষণ সজ্জা ফুলের মাধুরি দিয়ে!

সন্ধ্যা থেকে এই বিশাল বাড়ি যেন গিলতে আসছে পারুলকে। বিপিনের ঠাকুমা বাতের ব্যথায় কাতর। পড়ে রয়েছে বিছানায় পুটলির মত। বিপিন বিকাল বেলায় বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেছে মোরামের ধুলো  উড়িয়ে। ফিরবে হয়ত কালকের মত দুই প্রহরে চুল্লু গিলে। পিনুর মা রেঁধে বেড়ে গেছে। পারুল সন্ধে থেকে বসে রয়েছে তার জন্য বরাদ্দ বাড়ির নৈঋত কোনের ঘরটার পিছনে জানালার রেলিং ধরে। সামনে পাতা ফুলসজ্জা। বাইরের আলো আঁধারিতে সুপারি গাছগুলো আজও দুলছে, তবে গতকালের চেয়ে ধীরে। চাঁদ সামান্য যৌবন হারিয়েছে হয়ত। বোঝা যায় না। তবে এখন সুপারি গাছের মাথায় চড়েনি। বাতাস আজ একটু কম। আকাশ পরিস্কার। তবু মাঝে মাঝে দল ছাড়া সাদা মেঘ গিলে ফেলে পশ্চিম আকাশের সন্ধাতারাকে।  

চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে পারুলের। কত রাত ঘুমায়নি সে। দরজায় মৃদু টোকা, ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে সে। একি তাপস দাঁড়িয়ে যে! তাপস এগিয়ে এসে তাকে বুকে টেনে নেয় । দরজায় খিল পড়ে। গোলাপের পাঁপড়িতে ডুবতে থাকে পারুল। বিছানা থেকে রজনীগন্ধা তুলে নিয়ে মালা গাঁথে তাপস। মালা গাঁথা হলে পরিয়ে দেয় সে হার পারুলের গলায়। কি মিষ্টি গন্ধ। সুগন্ধে শরীর জুড়িয়ে যায় পারুলের। তাপসের বুকে মুখ ঘসে সে। তাপসের ঠোঁট দুটো ডুব দেয় পারুলের ঠোঁটে। গন্ধরাজ লেবু পাতার গন্ধ তাপসের মুখে। তাপসের বুকে নরম গোলাপের পাঁপড়ি। 
একটা ভটভট যান্ত্রিক শব্দ কানে বাজে, কাছে আসছে শব্দটা, সরে সরে যাচ্ছে তাপস। দুহাত সামনে প্রসারিত করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে পারুল।-" নিয়ে চ তাপস......., নিয়ে চ মোকে  দূরে........ অনেক দূরে। মুই যে আজন্ম রইছি তোর পথ চাঁহি ! "
বাইকের আওয়াজে ঘোর কাটে পারুলের।স্বপ্ন হারিয়ে যায়।  চেয়ে দেখে সে মোরাম পথ দিয়ে ছুটে আসছে বিপিনের বাইক। পিছনে বসে রয়েছে বিপিন।বাইক চালাচ্ছে তাপস। বাইকটা দ্রুত ঘরের সীমায় পৌঁছায়। জানালা থেকে উঠে এসে বারান্দায় উঁকি মারে পারুল। বিপিন টলতে টলতে চলেছে তাপসের কাঁধে ভর দিয়ে। বিকৃত গলায় চিৎকার করে গাইছে সে-" ফুলসজ্জা,,  আজ ফুলসজ্জা। "
তারপরেই তাপসকে টেনে নিয়ে যায় সে দিঘী পাড়ে। চুল্লুর বোতলে চুমুক লাগায়। চলতে থাকে মাতলামি। পারুল জানালায় বসে দেখতে থাকে সে দৃশ্য। পূর্ণ যৌবনা চাঁদ এখন সুপারি গাছের মাথায়। দীঘির জলে পড়েছে তার প্রতিবিম্ব। আজ প্রতিবিম্ব স্থির। বিপিনের কুকুর টা এসে ভুকতে থাকে। বিপিন লাথি মারে তার পিছনে। বলে-" শালা শান্তি নাই যেন,  ঘরের বউ এর মত ভুকে চলেছে পিছু পিছু। " তাপস দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাকে। তারপর গাড়ির হাতলে ঝুলে থাকা পলিথিনের ব্যাগ থেকে বার করে আর একটা বোতল। ঢকঢক করে গলায় ঢালে বিপিন।
-" ইচ্ছামত  গিলব বে আজ, মোর ফুলসজ্জা বলে কথা।কোন চাঁদু মোকে থামায় দেখি। বারো ভাতারি কলেজ যাইত নাঙের লগে , নাঙ খোঁজা বারকি দিব আজ শালীর। " 
বেসামাল বিপিন উঠে দাঁড়ায় টলতে টলতে। দীঘির পাড়ে দাঁঁড়িয়ে প্যান্টের জিপ খুলে হালকা হতে থাকে সে দীঘির সবুজ  জলে। হঠাৎ পিছন থেকে সজোরে এক লাথি , ছিটকে পড়ে বিপিন মাঝ দীঘিতে ।জলে হাবুডুবু খেতে থাকে সে। প্রবল আলোড়নে দীঘির জল উথাল পাথাল হতে থাকে। দুহাত তুলে বাঁচার আকুতি জানায়। তাপস নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ে। আর একজন উপরে জানলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সে ঘটনার সাক্ষী হয়। 
একসময় ঝুপ করে ডুবে যায় বিপিনের হাত আর মাথাটুকু জলে শেষ আলোড়ন তুলে ।  জলের সেই আলোড়নে পূর্ণ যৌবনা চাঁদের প্রতিবিম্ব কেঁপে কেঁপে সুপারি গাছের মাঝে বিলিন হয়। তাপস পকেট থেকে রুমাল বার করে চুল্লুর বোতল আর গাড়ির হ্যান্ডেল, ক্লাচ,  ব্রেকের কাছটা বেশ কয়েকবার মুছে নেয়।  একবার মুখ তুলে জানালার দিকে দেখে একবার। চকচক করে ওঠে পারুলের কালো কুচকুচে দুটো মনি। তাপসের মুখে ছলকে ওঠে বাঁকা হাসি।  জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে পার হয় সে দিঘী। তারপর পশ্চিম পাড়ের ঝোপঝাড় দ্রুত পায়ে দলে পাঁচিল টপকে মোরামের পথ ধরে সে।             
          

সেই রাতে বৃষ্টি এসেছিল : দীপঙ্কর ঘোষ









আমি গ্রামের একটি হাইস্কুলে চাকরি করি।বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব আঠারো কিমি।কিন্ত সমস্যা হল স্কুলে যাওয়ার কোনো বাস রুট নেই।অগত্যা আমাকে ছুটতে হয় আমার দু চাকায় ভর করেই।শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা,ওই দুই চাকাই ভরসা।যাবার পথে প্রকৃতি যেন ডানা মেলেছে তার আপন খেয়ালে।আগে ছিল কাঁচা মেঠো পথ।সম্প্রতি ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী গ্রামীন সড়ক যোজনায় পাকা রাস্তা হয়েছে।সেই কংক্রিটের রাস্তায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে অধঘন্টায় পৌঁছে যাই গন্তব্যে।রাস্তার দুপাশে কোথাও আনারস,কোথাও চায়ের বাগান।কোথাও সারি সারি বাঁশ বন।আর কোথাও কোথাও দেখা যায় মরসুমি বিভিন্ন শস্যের চাষ।

সেই বছর শীতকাল।মাঘ মাসের কনকনে শীতের দিন।খুব জাঁকালো শীত পড়েছে।এরই মধ্যে পরে গেল স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।ওইদিন সকাল ন'টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছে গেলাম।সারাদিন দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটল।খেলাধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সবশেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।আমরা শিক্ষকরা স্কুল থেকে বের হবো, ঠিক সেই সময় এলে ঝেপে বৃষ্টি।শীতকাল।এইসময় বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে।সুতরাং কারো কাছেই রেইন কোর্ট নেই।উপায় নেই, দাঁড়িয়ে যেতে হল।বৃষ্টি কখন থামবে?বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা।কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।মেঘের গর্জন বাড়তে লাগলো ক্রমশ।শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি যখন থামল,তখন ঘড়িতে রাত নয়টা।

বেরিয়ে পড়লাম।ভিজে রাস্তা।অন্ধকার,চারদিক শুনশান।একটা কুকুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।কোথাও একবিন্দু আলোর চিহ্ন নজরে পড়ছে না।একলা নির্জন পথে একা চলছি এতরাতে।এতবছর চাকরি হয়ে গেল,কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম।বাইক ছেড়েছি প্রায় আশি কিমি/ঘন্টা গতিতে।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিস্তা ক্যানেলের কাছে চলে এলাম।দূর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম ক্যানেলের ব্রিজটা যেখানে শেষ,সেই জায়গায় একটা আবছায়া,একটা ফ্যাকাসে মূর্তি।বুঝতে পারলাম কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।কাছাকাছি আসতেই হেড লাইটের আলোয় দেখলাম একটি কুড়ি-একুশ বছরের অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে।মেয়েটা এতই সুন্দর যে,এই ঘন অন্ধকারের মধ্যেও ওর গায়ের উজ্জ্বল রঙ একটা আলাদা মাত্রা এনেছে।মুখে যেন হাজার ওয়াটের আলোর ঔজ্জ্বল্য।কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগল,এই অন্ধকার নির্জন পথে একাকিনী একটি মেয়ে এখানে কি করছে?কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল, একটু লিফট পেতে পারি।এর পর আমাদের মধ্যে যে কথপোকথন হল তা এই প্রকার--
--এত রাতে আপনি একা এপথে?কোথা হতে এসেছেন আর যাবেনই বা কোথায়?
--আর বলবেন না ,গিয়েছিলাম কলেজে।রাস্তায় একটা পথ দুর্ঘটনায় প্রায় তিন ঘন্টা আটকে পড়েছি।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ পৌচ্ছেছি এখানে ওই যে পেছনে যে বাজারটা সেখানে।কিন্তু তারপর শুরু হল বৃষ্টি,আর এতক্ষনে থামল।এতরাতে এই পথে   যাবার মতো কোনো মাধ্যম নেই।তাই হাটতে শুরু করেছি।
--যাবেন কোথায়?
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটি আমাকেই জিজ্ঞাসা করলো–-আপনি কোথায় যাবেন,?
-- বিধাননগর যাবো।
শুনে মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে বলল,--
তাহলে আমি আপনার সাথে পারি।
--পারেন অবশ্যই।কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন সেটা তো বললেন না?
এবার মেয়েটি বলল,--চলুন না,আপনি নাম বললে চিনবেন না।
--বলেই দেখুন।
--দেরামারি মোড় থেকে...
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম--এটা না চেনার কি আছে,এই জায়গাটা তো আমার ফেরার পথেই পরে।
মেয়েটা কিছু বললাম না,শুধু মুখে দেখলাম একটা হাসি খেলে গেল।তারপর বাইকের পিছন সিটে উঠে বসে বললো---চলুন ,এখানে আর দেরি করবেন না।রাত অনেক হয়েছে।রাস্তাটাও ভালো নয়।
আমি বাইকে স্টার্ট দিলাম।ভিজে রাস্তা।অন্ধকারও আরো ক্রমশ গভীর হচ্ছে।ধীরে ধীরে বাইক চালাচ্ছি।আমি কৌতূহলের সঙ্গে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম যে,আপনি বললেন রাস্তাটা ভালো নয়।কেন?
সে কিছুই বললো না।কিছুক্ষন পর বললো শুনেছি এই রাস্তায় মাঝে মাঝেই ডাকাতি-খুন ইত্যাদি হয়ে থাকে।আর আপনি তো অনেক দূর যাবেন,শুনেছি এই রাস্তায় ভূতেরও উপদ্রব আছে।
আমি জোরে জোরে একচোট হাসলাম তারপর বললাম যে আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এসেও আপনি এই ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন?
মেয়েটি কিছুই বললো না ।
আমি এবার বললাম যে, হ্যা শুনেছি এই রাস্তায় ডাকাতি,-ফাকাতি হয়।তবে আমার কাছে কি-ই বা আছে।এই বলে হো হো করে হাসলাম।তবে মনের মধ্যে এতক্ষনে একটা ভয় উঁকি দিতে শুরু করেছে।শেষে না আবার ডাকাতের পাল্লায় পরি।গল্পে গল্পে প্রায় দুই-তিন কিমি পথ এগিয়ে গেছি।অনেকক্ষণ হলো মেয়েটা কোনো কথা বলছে না।কি ব্যাপার কিছু বলছেন না যে...
কোনো উত্তর এল না।
--ভয় পেলেন নাকি?
না কোনো সাড়া নেই।আমি ঘাড়টাএকটু ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।আমি তো অবাক!মেয়েটি কোথায়?
ব্রেক করলাম ।বাইক থেমে গেল।চারদিকে চেয়ে দেখলাম ।না,কেউ কোথাও নেই।আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।কি মনে হল বাইকটা ইউ-টার্ন করে আবার যে পথে এতক্ষন আসছিলাম,সেই দিকেই চললাম।মনের মধ্যে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগলো--মেয়েটি কোথায় গেল?
সন্দেহ হল পরে-টরে গেল নাকি?
আবার ভাবলাম বাইক তো খুব বেশি গতিতেও চালাইনি কিংবা এত বড় একটা মেয়ে পেছন থেকে পড়ে যাবে আর আমি বুঝতে পারবোনা--এও কি সম্ভব!যাইহোক,কিন্তু মেয়েটি কোথায়?এইগুলো ভাবতে আবার ক্যানেলটার সামনে পৌছালাম।অবাক কান্ড!যেখান থেকে মেয়েটিকে বাইকে তুলেছিলাম,মেয়েটি সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।আমি মেয়েটির সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে বললাম;-
আপনি এখানে কি করে এলেন?
--মানে?মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
--কিছুক্ষন আগে আপনি আমার বাইকে চড়লেন, বললেন আপনার বাড়ি সামনেই কোথায় যেন?আপনি লিফট চাইলেন।তারপর যেতে যেতে কত কথা হল!
মেয়েটি যেন আকাশ থেকে পড়লো আমার কথা শুনে!তারপর বলল--আপনার কাছে আমি লিফট চেয়েছিলাম সত্য,কিন্তু আপনি তো বললেন আপনি ওই পথে যাবেন না।আপনি চলে গেলেন।আর এখন আবার ফিরে এসে কি পাগলের প্রলাপ বকছেন।আমার মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল, সবকিছু এলোমেলো মনে হতে লাগলো।কেমন যেন সব তাল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আমি শান্তভাবে আবার বললাম--আপনিই তো বললেন এই রাস্তায় ডাকাত,ভুত কত কি!আর এখন বলছেন---
আমার কথা শেষ হতেই মেয়েটি হি হি করে হেসে উঠলো।আমি রাগত স্বরে বললাম--
যেতে চাইলে চলুন নয় তো থাকুন এখানে।এই বলে আমি গাড়ি স্টার্ট দিতেই মেয়েটি এসে বাইকে বসলো।

আবার চলতে শুরু করলাম।আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেল।বাজ পরা শুরু হয়েছে।অন্ধকার যেন গিলে ফেলতে চাইছে।এক কিমি এগোতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো।কিন্তু দাঁড়ানোর মতো কোনো জায়গা দেখতে পাচ্ছি না।বৃষ্টির বড় বড় ফোটায় বাইক চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।কোনো ক্রমে কয়েকশ মিটার এগিয়ে গেলাম।চা বাগানের একটা ছোট্ট টং ঘর দেখতে পেলাম।ইতিমধ্যেই ভিজে গেছি দুজনেই।ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলাম।ওই ঘরেই আশ্রয় নিলাম।অনেকক্ষন হল সিগারেটের খুব নেশা হয়েছে।পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম আছে একটা।কিন্তু দেশলাইটা জলের ছাটে ভিজে গেছে।অনেক কষ্টে সিগারেটটা ধরলাম।মেয়েটি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো।বললো ফেলুন।ফেলে দিলাম।অপেক্ষা দীর্ঘ হল।মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো--
জানেন এই রাস্তায় রাতের অন্ধকারে একটি খুব সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পাওয়া যায় বলে অনেকে বলে থাকেন।লোকে বলে,আসলে ওটা নাকি একটা ভূত!
একথা শুনে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।কেঁপে উঠল সারা শরীর।আমার মনে একটা কুচিন্তা এসে ভর করলো।এখন রাত আর আমি  একটা অত্যন্ত রূপসী একটি মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি জনশূন্য এক চা বাগানের টংঘরে।তাহলে কি?!!তীব্র শীতের মধ্যেও আমি ঘামছি। আমি হতভম্বের মতো মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।মেয়েটা বললো ,আমার দিকে এমন করে চেয়ে আছেন কেন!আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম আপনিও তো যথেষ্ঠ সুন্দরী।তাহলে...।আমার কথা শেষ না হতেই মেয়েটা  হা হা করে হেসে উঠল।বললো-আপনি কি আমাকে!আরে মশাই...
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,না না তেমন কিছু ভাবছি না।একটু মজা করছিলাম আর কি!আপনি কেন... ইতিমধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেছে আমি খেয়াল করিনি।মেয়েটি বললো,কি ব্যাপার, এখানেই থাকবেন নাকি?চলুন...
হ্যাঁ, চলুন বলে বাইকে এসে বসলাম দুজনে এবং চলতে লাগলো বাইক কখনো ধীরে, কখনো একটু জোরে।মাঝে মাঝে রাস্তার পাশের গাছ থেকে জল ছিটকে গায়ে এসে পড়ছে।ঠান্ডা লাগছে খুব।মেয়েটিও দেখছি ঠান্ডায় কাঁপছে এখন।কারো মুখেই কোনো কথা নেই।হঠাৎ একটা শব্দ হল।কিন্তু  কিসের বুঝতে পারলাম না।কিছুক্ষন যেতেই আবার একই শব্দ হল।এবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, শব্দটা কিসের,আপনি কিছু বুঝতে পারছেন?উত্তর পেলাম না।কিন্তু কাঁধে মেয়েটির হাতের স্পর্শ পেলাম।কি ব্যাপার ঘুমিয়ে গেলেন নাকি?না, তবুও কোনো উত্তর পেলাম না।বাইক থামিয়ে দিলাম।একি ব্যাপার আবার কোথায় গেল মেয়েটা!?ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।!কি হচ্ছে আমার সাথে!আমি ঘাবড়ে গেলাম।মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে,কোনো ভুতের খপ্পরে পড়লাম নাকি?ভাবছি মেয়েটাকে খুঁজতে যাবো, না চলে যাব সোজা।প্রথমে ভাবলাম চলেই যাই, যা হয় হোক।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এত রাতে এই নির্জন পথে একা একটি মেয়েকে ফেলে যাওয়া উচিত হবে না।অতঃপর আর সময় নষ্ট না করে বাইকটাকে ইউ-টার্ন করলাম।সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে কানে ভেসে এল--কি হল!আবার বাইক ঘোড়ালেন কেন!
আমি তো এবার একেবারে থ!নিজের চোখ না নিজের কান--কাকে বিশ্বাস করবো।পিছনে ফিরে দেখি মেয়েটা বাইকের সিটেই বসে আছে।আমি নিজের চোখ কচলে বললাম যে,আমি যে আপনাকে কতবার জিজ্ঞাসা করলাম ,শব্দটা শুনতে পেলেন!ওটা কিসের শব্দ!আপনি কোনো উত্তর দিলেন না।আর তারপর দেখলাম আপনি বাইকের সিটে নেই!
মেয়েটি যেন বিরক্ত হল আর বললো, কি যে হয়েছে আপনার!সেই থেকে কি সব আবোল তাবোল বলছেন।আমি আপনার সঙ্গেই বসে আছি আর আপনি আমাকে খুঁজতে যাচ্ছেন.... হা হা হা...
কি আর বলবো।চুপ করে গেলাম।কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা ছোট্ট গ্রামে এসে পৌছলাম।জিজ্ঞাস করলাম, আপনি তো এখানেই নামবেন বলেছিলেন?
--না।
--এই গ্রামেই তো আপনি থাকেন বলেছিলেন।
--না,মানে ঠিক এই গ্রামে না।
--তবে কোথায়।
--এখান থেকে তিন কিমি আগে যে বাঁশ বন আছে, ওই খানে।
--ওখানে তো শুধু বাঁশ বন।কোথাও তো বাড়িঘর দেখিনি।
--আছে,ওই বাঁশ বনের পেছন দিকে।আপনি হয়তো খেয়াল করেননি।
--হয়তো।
পাঁচ-সাত মিনিটেই বাঁশ বনের কাছে চলে এলাম।মেয়েটি বললো--আমাকে এখানে নামিয়ে দেন।চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম,কোনো বাড়িঘরের কোনো চিহ্ন নেই।আশেপাশে কোনো গ্রাম আছে বলেও মনে করতে পারছি না।চারদিক যেন অন্ধকারের সমুদ্রে ডুবে আছে।মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।একটা তাঁরাও দেখা যাচ্ছে না।আমি ওকে বললাম, এখানে কোথায় যাবেন?এখানে তো....
আমার কথা শেষ না হতেই বললো, আরে আছে ।আমি তো এই বাঁশ বনের পেছনেই থাকি।বললাম তো গ্রাম আছে ওখানে।এদিক থেকে দেখা যায় না।এই যে সামনে পথটা দেখতে পাচ্ছেন,ওই পথেই...
সামনে একটা পায়ে হাটা পথের চিহ্ন দেখতে পেলাম।
মেয়েটি নেমে গেল।কয়েক পা এগিয়ে গেল।তারপর থমকে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো।তারপর আবার ফিরে এলো।আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম।বললো,একটা কথা বলবো?
--বলুন
অনেক রাত হয়ে গেছে।আমি মেয়ে মানুষ একা যেতে একটু ভয় করছে।আর তাছাড়া, সামনে একটা মোড় আছে যেখানে রাতে মাতালদের আড্ডা বসে।তাই বলছিলাম যে,অনেকটাই তো সাহায্য করলেন যদি আর একটু করতেন।যদি আমাকে আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন,তবে খুব উপকার হত।
আমারও জায়গাটা ভালো লাগছে না।আর আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল যে, এই এত রাতে মেয়েটিকে এই বাঁশ বনে ছাড়া ঠিক হবে না।তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম।মেয়েটি নামার পর চলে যাইনি।সূতরাং, বাইকটা রাস্তার ধারে রেখে, লক করে আমি সেই হাঁটা পথে বাঁশ বনের ভেতরে যেতে লাগলাম।কোনো আলো নেই,কোনো শব্দ নেই।শুধু মাঝে মাঝে বাঁশ গাছের জল পড়ছে তার টুপটাপ শব্দ।আর আমাদের দুজনের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল হাঁটছি।কিন্তু না এখনো কোনো গ্রাম বা বাড়ি দেখা যাচ্ছে না।আমি মেয়েটিকে বললাম,কোথায়,আর কতদূর তোমার বাড়ি!
--সামনেই।
তারপর আবার আমরা চুপচাপ হাটতে থাকলাম।তারপর মেয়েটি বললো, আচ্ছা আমরা প্রায় দুঘন্টা একসাথে আছি অথচ আমরা কেউ একে অপরের নাম-পরিচয় জানি না।আপনার নামটা বলবেন?
--হ্যাঁ, অবশ্যই।আমি রাতুল।বিধাননগরে থাকি।এই হাপতিয়াতে স্কুলে চাকরি করি।
--ও আচ্ছা।আমার নাম বৃষ্টি।তারপর হঠাৎ বললো আচ্ছা, আপনি তো তখন পুরো গল্পটা শুনলেন না...
--কোন গল্পটা?
--ওই যে সুন্দরী মেয়ে!
--থাক, এই জঙ্গলের মধ্যে এখন আর ওগুলো শুনবো না।
--কেন!ভয় পাচ্ছেন?বলে হা হা করে অট্টহাসিতে বাঁশ বন কাঁপিয়ে দিল।
আমার আত্মসম্মান আহত হল।আমি বললাম ভয় পাবো কেন?ওই সব ভূত-টুতে আমি বিশ্বাস করি না।আচ্ছা, বলুন...
এরপর মেয়েটা বলতে শুরু করলো--
ওই যে সুন্দরী মেয়ের কথা বলেছিলাম শুনেছি প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে ওই হাপতিয়া ক্যানেলের ধারে ওকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।পুলিশের অনুমান ছিল তাকে খুন করা হয়েছিল।কেননা তার দেহে অজস্র ধারালো অস্ত্রের আঘাত  চিহ্নিত হয়েছিল।কিন্তু পুলিশ খুনিকে ধরতে পারেনি।এমনকি মেয়েটার মুখ এমন ভাবে থেতলে দেওয়া হয়েছিল যে প্রায় ১৫ দিন লেগেছিল ওই লাশ চিহ্নিত করতে।পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল,কিন্তু প্রমাণের অভাবে আদালত তাদের সম্মানের সঙ্গে নির্দোষ ঘোষণা করে।শোনা যায় ওই মেয়েটাই নাকি তার হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে রাতের অন্ধকারে ওই অপরাধীদের খুঁজে বেড়ায়।হয়তো শুনে থাকবেন ,এই সপ্তাহ দুয়েক আগে এই পথে একটা খুন হয়েছিল?
--হ্যাঁ, শুনেছিলাম বৈকি।যে খুন হয়েছিল তাঁর দেহেও নাকি অদ্ভুত এক ধরণের ক্ষত ছিল এবং তার মাথাটা নাকি থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল?পুলিশ তো এখনো খুনির সন্ধান পায়নি।
--পাবেও না।
--কি বললেন?
--কিছু না।
--না,আপনি কি করে বললেন পুলিশ খুনির সন্ধান পাবে না?
--কি করে পাবে?কোনো মানুষ খুনি হলে তো পুলিশ খুঁজে পাবে।
--এর মানে?আমি চমকে উঠে বললাম।
--মানে কিছু না।
--আপনাকে বলতেই হবে কি বলতে চাইছেন।
--আমি কিছুই বলতে চাইছি না।আসলে লোকজন তো বলে থাকে ওই মেয়েটাকে যারা খুন করেছিল খুন হওয়া লোকটা তাদেরই একজন এবং সেই মেয়েটাই নাকি তাকে হত্যা করে বদলা নিয়েছে।

আর এটা কি জানেন লাশটা কোথায় পাওয়া গেছে?
--না ।
--ঠিক এখন আমরা যেখানে আছি।এই এখানেই লাশটা পাওয়া গিয়েছিল।
আমি আঁতকে উঠলাম।কি বলেন?
--আচ্ছা, আপনি যদি কোনোদিন ওই সুন্দরী ভুতের পাল্লায় পড়েন?
--কথাটা শুনে আমার তো ঘাম ছুটে গেল?সামনে একটা ছোটো পাথর ছিল,তাতে হোঁচট খেয়ে পরে গেলাম।
এটা দেখে মেয়েটা এত জোরে  খিলখিল করে হেসে উঠল যে,বাঁশ বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে যেন সেই হাসির অনুরণন হতে লাগলো বারবার।মেয়েটি হাসি থামিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।ওই ভাবে হঠাৎ পরে যাওয়ায় পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম।মেয়েটার হাত ধরে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালাম।তখনও যেন সেই হাসির শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি।
মেয়েটি বললো চলুন।কিন্তু আমার এতটাই ব্যথা হচ্ছে যে,আমি ভালো ভাবে দাঁড়াতেই পারছি না।চলব কি করে!
আমি বললাম,আমি আর যেতে পারবো না।আপনি যান।আমি এখানেই আছি।আর কতদূর?
--এই তো প্রায় চলে এসেছি।
--তাহলে আশা করি আপনি এখন যেতে পারবেন?
--না,আমার ভয় করে।ওই যে বললাম না মাতালের দল...তারপর কাছে এসে বললো দেখি আপনার কোথায় লেগেছে...এই বলে আমার ব্যথার জায়গাটায় হাত দিল।কি অদ্ভুত কান্ড!মিনিট খানেকের মধ্যেই আমার ব্যথা উধাও।আমি হা করে মেয়েটির দিকে চেয়ে রইলাম।তারপর বললাম, ঠিক করে বলুন তো আপনি কে?
মেয়েটি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জবাব দিল, আমি বৃষ্টিইইইইই।সঙ্গে সঙ্গে বাঁশ বনের ভেতর থেকে অনুরণিত হতে লাগল,আমি বৃষ্টিইইইইই......আমি বৃষ্টিইইইইই......
--আপনি যদি সাধারণ কেউ হন,তাহলে আপনি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যথা কমে গেল কি করে?
মেয়েটা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে এবার বললো, আমার এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে,আপনার মাথাটা গেছে।শুনুন আপনি খুব শীঘ্রই কোনো সাইকাটিস্ট দেখান।বুঝলেন!!!আবার হেসে উঠল...আবার অনুরণন...
আমি বললাম,ঠিক আছে চলুন তাড়াতাড়ি।অনেক রাত হয়ে গেল।বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা হয়ে গেছে।হাঁটতে হাঁটতে এতটা সময় চলে গেছে কখন বুঝতেই পারিনি।মনে হল বাড়িতে একটা ফোন করা দরকার।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি পঁচিশটা মিসকল।কল করতে গেলাম।নেটওয়ার্ক নেই।ধুর ছাই বলে মোবাইলটা পকেটে রেখে দিলাম।
তারপর এগিয়ে যেতে লাগলাম।কিন্তু এখন কিছু অদ্ভুত শব্দ কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার।শব্দটায় আমার হৃদকম্পন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।আমার শরীর আর চলছে না।কিন্তু মেয়েটার এদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।সে আপন মনে এগিয়ে চলছে।দেখে মনে হচ্ছে ওর কোনো ভয়ডর কিছু নেই।এই যে এতরাতে একটা অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে, তবুও ও যেন নিশ্চিত।মনে মনে ভাবলাম,একটা মেয়ে এতটা সাহসী কি করে হতে পারে!
আমি বললাম,কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?
--না তো।কোথায় কোনো শব্দ তো নেই।
আমি চুপ হয়ে গেলাম।
আর একটু যাওয়ার পর মেয়েটি বলে উঠল, ওই যে সামনে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা আমার বাড়ি?
--কোথায়?আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না?
--আপনার চোখও গেছে!চোখটা ভালো করে মুছে, একবার বন্ধ করে,তারপর খুলুন এবং দেখুন।
আমি তাই করলাম।কি আশ্চর্য।এই তো কাছেই মোড়ের মাথায় কি সুন্দর একটা বাড়ি।কি অপূর্ব মায়াবী পরিবেশ।কি দূর্দান্ত!বাড়ি তো নয় যেন কোনো রাজপ্রাসাদ।কত আলোর খেলা।তাহলে কি আমার চোখটা গেল না কি?এত আলো তবুও আমি বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিলাম না।কিন্তু আশেপাশে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন?আর, আশেপাশেও তো কোনো বাড়িঘর দেখতে পাচ্ছি না।
বললাম,আচ্ছা আর তো কোথাও কোনো বাড়ি দেখতে পাচ্ছি না?
--থাকলে তো পাবেন?
--মানে?নেই..
--না
--আপনারাই শুধু এখানে থাকেন?
--শুধু আমি।
আমি যারপরনাই অবাক হয়ে বললাম,আপনি একা এই জঙ্গলের এই বিশাল প্রাসাদে থাকেন?আপনার কোনো অসুবিধা হয় না।আর আপনিই তো বললেন যে, মোড়ের মধ্যে মাতালের উৎপাত।আপনার ভয় লাগে?
--ধুর ছাড়ুন তো ওই সব কথা।
এই কথা বলে মেয়েটি আমার সামনে সামনে হাটতে লাগলো।,পাঁচ মিনিট হাঁটার পর দেখি, বাড়িটা যতদূরে ছিল এখনো ততটাই দূরে।আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা আবার ফিরে এল এবং আমার কান ঝালাপালা হতে লাগলো।আমার সমস্ত শরীরে যেন কিসের শীতল স্পর্শ পেলাম।কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না।পায়ের সানে দিয়ে একটা ইঁদুর দৌড়ে গেল।আমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।মেয়েটি অনেকক্ষণ কিছু বলছে না।শুধু হেঁটেই যাচ্ছে।আমিও তার পিচুপিছু হেটে চলেছি।যেন কোনো সুচতুর জাদুকরের জাদু আমার ওপর ভর করেছে।আমি শুধুই মেয়েটিকে অনুসরণ করে যাচ্ছি।কোনো কথা বলতে পারছি না।কথা বলতে গেলেই আমার কন্ঠ থেকে যেন একটা গোঙানি বেরিয়ে আসছে।কিছুক্ষন মেয়েটি দৌড়াতে শুরু করলো।আমিও তার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলাম।কতক্ষন যে দৌড়ালাম কিছুই বুঝতে পারলাম না।কিন্তু যতই দৌড়াই দেখি বাড়িটার দূরত্ব কোনোভাবেই কমছে না।একসময় আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল।আমি আর দৌঁড়াতে পারলাম না।আমি বসে পড়লাম চোখ বন্ধ করে।কতক্ষণ যে চোখ বন্ধ করে ছিলাম বুঝতে পারলাম না।যখন চোখ খুললাম দেখি আমি সেই রাজপ্রাসাদের একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভরপুর একটা ঘরে শুয়ে আছি।পাশে বসে আছে সেই মেয়েটি।আমার শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই।আমি উঠে বসলাম তারপর মেয়েটি বললো এখন কেমন  লাগছে শরীর?বাড়ি যেতে পারবেন না কি এখানেই রাতটা পার করে কাল সকালে বাড়ি    যাবেন?
আমি বললাম,না আমাকে বাড়ি যেতে হবে।তারপর বিছানা ছেড়ে মেয়েটির থেকে বিদায় নিয়ে আবার সেই বাঁশ বনের পথে বের হলাম।
কিছুটা এগিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম।আমার চক্ষু তো ছানাবড়া!কোথায় সেই রাজ প্রাসাদ?আমি চারদিকে চেয়ে দেখলাম।না,কোথাও কিছু নেই।চারদিকে শুধু বাঁশ বন আর সবটাই গভীর অন্ধকারে ঢাকা।আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল।ভয় যেন আমার গ্রাস করলো।আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে লাগলো।ক্রমশ যেন আমি অন্ধকারের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।তারপর  যখন আমার চোখ আবার আলো দেখলো তখন আমি হসপিটালের বেড়ে।জানতে পারলাম আজ সকালে কয়েকটি লোক আমাকে বাঁশ বনে অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পায় এবং আমাকে চিনতে পারে।বাড়িতে খবর দেয়।বাড়ির লোক আমাকে উদ্ধার করে এই হসপিটালে নিয়ে আসে।

তারপর যা শুনলাম তাতে আমার পরান মাঝি বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়।বাঁশ বনের যে জায়গা থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়,সেই জায়গা এবং আমার বাইক যেখানে রাখা ছিল সেখানে নাকি রক্ত দিয়ে লেখা ছিল--
আমিই সেই সুন্দরী মেয়ে যাকে এমনই এক বৃষ্টির দিনে চারজন মাতাল নৃশংস ভাবে আমাকে ধর্ষণ ও  হত্যা করেছিল।তারপর ফেলে গিয়েছিল ওই ক্যানেলে।আমি বদলা চাই।তাই বৃষ্টির রাতে আমি সেই ক্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।খুঁজি সেই অপরাধীদের।কিন্তু গতমাসে যে লাশটা পাওয়া গিয়েছিল এই বাঁশ বনে,সে আমার হত্যাকারী ছিল না।সেই রাতে আমি যথারীতি দাঁড়িয়ে ছিলাম শিকারের জন্য সেই সময় সে এই রাস্তায় আসে এবং নিজেই আমাকে লিফট দেয়।কিন্তু এই বাঁশ বনের সামনে এসে সে আমাকে একা পেয়ে আমার শ্লীলতা হানি করার চেষ্টা করে।আমি বিনিময়ে তাঁকে মৃত্যু দিই।তাই আজও পুলিশ খুনির সন্ধান পায়নি।আর কোনোদিন পাবেও না।
আজও শিকারের সন্ধানে ছিলাম।আপনার থেকে লিফটও নিলাম।কিন্তু কিছুটা পথ যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি অন্যরকম।আপনি তাদের মতো নন,মেয়ে দেখলেই যাদের জিভ লকলক করে।তাই একসময় আপনার বাইকে আমাকে দেখতে পাননি।তারপর যখন আপনি আবার ফিরে এলেন তখন মনে হল আপনি প্রকৃতই ভালো মানুষ,আপনাকে আমার কথা বলা যায়।তাই এতক্ষন....।যান আপনি বাড়ি ফিরে যান।আপনার কোনো ভয় নেই।তবে আমি তাদের কখনোই ছাড়বো না,যারা নিরীহ মেয়েদের একা পেয়ে নিজেদের জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে জানোয়ার হয়ে যায়।

নবজীবন :শ্যামাপদ মালাকার









আমাকে চিনতে পারছেন, আমি কে?--জানি, আপনি আমাকে ভুলে গেছেন। ভুলবেনই তো--পারিজাত নারীদের কি কম যাতয়াত ছিল--আপনার বৈঠকখানায়।
ঠিক আছে, এখনো চিনতে পারেননি তাই তো?
তবে আমার পরিচয়টা একটু দিই----
তারপর, দেবাদিদেব  শিবকে আমি খুব ভক্তি করতাম। সমাজিক নিয়মানুসারে তার ব্রত-উপোস করে আর পাঁচটা নারীর মতোই, গোপেশ্বরের চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট করে রাখতাম।
কিন্তু মহাকালও আমার প্রতি বিমুখ হলেন। বিবাহনামক সামাজিক একপ্রকারের রীতির শিকার হয়ে-- অপরিণীতা বয়সেই, শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে পিতার ভবন ত্যাগ করে চললাম।
সম্পূর্ণ অপরিচিত ঘর--অপরিচিত পুরুষ!
কিছু না বুঝে উঠার আগেই আমি 'মা' হয়ে গেলাম--যাকে একালে পুরুষেরা "ডানাকাটা পরী" বলে।
তখনও  আমি বুঝতে পারিনি, ভালবাসা কি, তবু নবজাতকের নাম রাখতে হবে---শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ছেলের নাম রাখলেন 'শুভ'।
বাপেরবাড়ি থেকেই আমি একটু জেদী হয়ে এসেছিলাম।
নিজে যা ভাল বুঝতাম-- তাই করতাম, তবু আত্মীয়স্বজনদের নিকট হতে স্নেহ-মায়া-আদরের কোনো ঘাটতি ছিল না।
অনেকদিন থেকে লোকমুখে শুনতাম, ট্রেশন পেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই নাকি রাধা-মাধবের  মন্দির। শুনেছি সেখানে গেলে প্রসাদ পায় অনেকেই।
সেই লোভে, মাঝে মাঝে রাধা-মাধবের পূজো দিতে আসতাম মন্দিরে।
লোকে শ্যামসুন্দর মন্দির বললেও--আমি বিশ্বেশ্বরের মন্দির মনে করতাম। তার প্রসাদ পাওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে কতটা যে আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, সে কথা পতিতপাবনই জানতেন।
আমার একমাত্র সন্তান শুভ-- সামাজিক অর্থে আমি 'এক ছেলের মা'। দীঘির মধ্যে  যেমন পদ্ম, তেমনই শ্বশুরবাড়ির উদ্যানে আমি।মাঝ আকাশে জ্বলন্ত অরুণিমার ন্যায়- পরমা সুন্দরী, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের রীতি তখন, দুএককথায় বর্ণনা করা সহজ ছিলনা।
থাক সে কথা- -
তারপর- তারপর শুভ, দামাল ছাড়িয়ে পা পা করে নিজের উঠোন অতিক্রম করল।
প্রকৃতির কি নিয়ম, সে কারু বাধ্য নয়-- সে আপন মনে পথ হাঁটে।
শুভ আরো একটু বড় হল। তার স্কুলজীবনের এক্সজাম শুরু হল। কিন্তু ছেলেটা এখন ভীতুই রয়ে গেছে। যাক সে কথা, সে সেদিন বায়না করল--"মা তুমি সঙ্গে চল, আমি একা যেতে পারবোনা।"
হঠাৎ মনে পড়ে যেতেই আমি তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, শুভ যে পথ দিয়ে এক্সজাম দিতে যাবে, সেই পথেই রাধা-মাধবের মন্দির।
ভাবলাম, এই সুযোগ কোনমতে হাতছাড়া করা যায় না--বিশ্বেশ্বরের প্রসাদ আমাকে পেতেই হবে।
কিন্তু যে আশা আর উদ্যম নিয়ে বেরোলাম, ততটা হয়ে আর উঠল কই!
শুভকে এক্সজাম হলে ঢুকিয়ে দিয়ে চিরপ্রবাহিণী গঙ্গার তীরে গিয়ে বসলাম--অত্যাধিক মানসিক চিন্তার কারণেই হোক,-- বা, দূরগামী বেগবতী গঙ্গার শীতল বায়ুর সংস্পর্শের কারণেই হোক---ক্লান্তিবশত সময়ের দিকে খেয়াল না থাকায়, প্রথমদিন বিশ্বেশ্বরের দর্শন হতে বঞ্চিত হলাম।
পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে, বিশ্বেশ্বর আমায় কৃপা করলেন।
শুভকে পরীক্ষার রুমে পৌচ্ছে দিয়ে, সরাসরি জগৎপিতার প্রাঙ্গণে গিয়ে উঠলাম।
কি শান্তি! কি প্রশান্তি! হৃদয় যেন পবিত্রতার গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
নাটমন্দির সাদাকাল পাথরে নির্মিত, নাটমন্দির লাগোয়া কয়েকটি সোপানের পর চারিপাশে নকশা করা রক্তাভ প্লেট--তারমধ্যে দুই-চারটি দেবদেবী অনায়াসে যাতায়াত করতে পারেন--এমনেই প্রশস্ত, যেন স্বর্গের কোনো গালিচা পাতা।
বিশ্বেশ্বরের সম্মুখভাগ যেন পালিশ করা একএকটি রুপার প্লেট---অপূর্ব কৌশলে বসানো--অবশ্যই নিখুত প্রশংসার দাবী রাখে!
বিভিন্ন দর্শনার্থী ও আগত সেবার্থীদের সমাগমে রাধা-মাধব প্রাঙ্গণ ও নাটমন্দির যেন বৃন্দাবনধাম হয়ে উঠেছে!।
কর্মচারীর সংখ্যা কম নয়, হাঁকে-ডাকে-নিয়মে-শাসনে  সারা মন্দির ভরপুর। আরতির পর মন্দির বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল--এবার হয়তো সেবার্থীরা প্রসাদ পাবেন।
যদিও জানি, মন্দিরের একটা নিয়ম আছে--নরম্যাল প্রসাদের চেয়ে স্পেশাল একটু মূল্য।
বিশ্বেশ্বরকে ডাকলাম--"হে প্রভূ! আমার পয়সা নেই। সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি--দুপুর যে গড়িয়ে গেল, তোমার প্রসাদ হতে কি আজ বঞ্চিত হবো!"
মনে হয়, আমার আর্তনাদ শ্যাম শুনতে পেলেন। অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠার আগেই চোখদুটো জলে ছলছল করে উঠল! অন্তর থেকে বেরিয়ে এল--হে বিশ্বনাথ! তুমি আছো---হে অনাথার নাথ! তুমি আছো--- তুমি না থাকলে, আজ আমি প্রসাদ পেতাম না!
শেষ পর্যন্ত আমি প্রসাদ পেলাম! কি শান্তি! কি তৃপ্তি! মনে হল, বরষার গঙ্গার মতোই আজ আমি কানায় কানায় পরিপূর্ণা!।
কিন্তু আনন্দের বেগ শমিত হতে না হতেই--কর্মচারীর মুখে শুনলাম, মন্দিরের যিনি কর্ণধার, যিনি মালিক--উনার সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করে যেতে বলেছেন।
বজ্রহত গাছের ন্যায় বসে পড়লাম। মালিক ডেকেছেন-- বারংবার কানে প্রতিধ্বনী হতে লাগল! তবে কি উনি টাকা চায়বেন? টাকা তো আমার নেই!
পুনরায় শ্যামকে ডাকলাম--হে প্রভূ! কেন আমার পরীক্ষা নিচ্ছো! আমার কাছে টাকা নেই--তুমি কি জানতে না? হে বিপদতারণ--কেন তুমি আমায় প্রসাদ দিলে?।
আমার কিছু বিলম্ব হওয়ায়--আবার ডেকে পাঠালেন।
বিপদভঞ্জনের উপর ভরসা রেখে, অপরাধিনীর মতোই মালিকের কক্ষে প্রবেশ করলাম- -
এবার মনে পড়েছে---আমি কে?।
প্রবেশ করতেই সারা অন্তঃকরণ যেন হিম হয়ে গেল। মনে হল, কোনো একটা দেওয়ালে এসি অন রয়েছে।
সদ্যমৃতলতা অল্প অল্প জলসঞ্চারে যেমন ধীরে ধীরে জীবিতা হয়ে উঠে, তেমনি আমারও শরীরে যেন মৃদু মৃদু প্রাণ ফিরে আসছে।
চেয়ার পাতা ছিল। উনি আমায় বসতে বললেন।কক্ষটি সু্বাসি গন্ধে টলমল। অনুভব করলাম, রুমে ফুলফর্মে এসি ছুটছে। মুখোমুখি বসলাম। ভাবছি, উনি প্রসাদের টাকা চায়লে---আমি কি বলবো?--- বলবো, প্রসাদ দেওয়ার আগে, টাকার কথা তো আমাকে বলেন নি---যদি বলতেন, আমি প্রসাদ খেতাম না। এরকম অনেক উত্তরই মনে মনে জাগছে।
আমি উনার দিকে না চাইলেও--অনুমান করছি, উনি আমাকে হা করে দেখছেন!। রুমটিতে কয়েকটি রাধা-শ্যামের ছবি ছাড়াও--এখানে সেখানে পূজোর নৈবিদ্য।
ভাবলাম, প্রসাদের টাকা চায়ছেন না কেন? মনে মনে প্রশ্ন জাগছে--সত্যিই কি শ্যাম আমাকে কৃপা করেছেন?
মনের মধ্যে এইরকম তর্কবিতর্ক চলছে।
রুমের ভিতর দুজনের মধ্যে যে নীরবতা গড়ে উঠেছিল--তা পুরুষকণ্ঠে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল।
তিনি বললেন--"প্রসাদ পেয়েছেন?"
এবার চিন্তে পেরেছেন--আমি কে?।
প্রসাদের কথা উঠতেই--আমি বললাম---হ্যাঁ--প্রসাদ পেয়েছি। এই প্রথম মুখ তুলে উনার পানে কয়েকদণ্ড তাকালাম। দেখলাম---সুপুরুষ বটে, গায়ের রং তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, দেহখানা বলিষ্ঠ-- এক কথায় সুদর্শন যুবক। সর্বাঙ্গে বিবিধ রত্নের অলঙ্কার, প্রতি আঙ্গুলে বহুমূল্যের একএকটি আঙটি। দুজনের মধ্যে পরিচয় বিনিময় চলছে।
এক সময়-- সময়ের দিকে তাকাতেই বাবুর পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল।
এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই---রাধামাধবের একটি ছবি, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-"আবার আসবেন- -
এবার চিন্তে পারছেন--আমি কে?
বাড়ি ফেরার পথে মনে হল, মানুষটি বেশ, উনার কত দয়া। এমন মানুষ একালে হয় না। মন্দিরের সব কর্মচারীরা উনাকে পিতার ন্যায় সম্মান করেন। নিশ্চয় উনার মধ্যে দয়া-করুণার শেষ নেই।
নির্দিষ্ট সময়ে শুভর এক্সজাম শেষ হল।
সংসারে কোনোদিন কোনোকিছুর অভাববোধ করিনি। শুভর বাবা-- যিনি আমার স্বামী, তার মতো মানুষ সংসারে খুব কমেই দেখা যায়। আমার প্রতি বিন্দুমাত্র তার অবহেলা ছিল না। অনবদ্য আমি তার স্নেহের ছায়ায় বাস করতাম। শ্বশুর ও শাশুড়িমায়ের তো কোনো তুলনা নেই, নিজের মেয়ের মতো বুকে আমায় আগলে রাখেন। প্রতিদানে আমিও উনাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ঘর সাজিয়ে রাখতাম। প্রকৃতপক্ষে- পিতার বাড়ি থেকে---শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত আমার জীবনে ভালবাসার কোনো অভাব ছিল না।
তবু যেন মনে হতো--
সংসারে চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই, জগৎকে যত দেবে সে ততই চাইবে। এই কারণে মাঝে মাঝে মনে হতো--কি যেন আমার নেই! পারিবারিক কারণে--অকারণে মন ভাল না লাগলে--মাঝে মাঝে রাধা-মাধবের মন্দিরে দুদণ্ড শান্তি পেতে ছুটে আসতাম।
নাটমন্দিরে একটু বসলেই--আমি সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতাম।
মন্দিরের সেই মালিক, কত দয়ালু, উনি আমাকে কত সম্মান করেন।
তখনও আমি বুঝতে পারিনি, ভালবাসা কি---কারণ আমি কখনো কারুকে ভালবাসিনি তো, তাই মনে হতো-- কেন উনার প্রটিটা কথা আমার কানে সর্বদা মন্ত্রের মতো বাজে! কেন উনাকে দেখলেই আমি শান্ত হয়ে যায়! উনি আমাকে এতোখানি যত্ন করেন কেন? এর অর্থ আমি সর্বদা খুঁজে বেড়াতাম।
জগৎ নিত্য, কাল নিত্য, আত্মা নিত্য, নিত্য নয় শুধু জগতের সামগ্রী। সে একদিন ধ্বংস হবে-- জগতে যা কিছু আছে-- সবেই একদিন ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে সমস্ত দেব বিগ্রহ,আর যিনি পরমাত্মা--পরমেশ্বর ভগবান, তিনিই শুধু যুগের সূচনার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দাপিয়ে বেড়াবেন!
সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম--
দিনটা ছিল, রাসপূর্ণিমা।
এই রাস দর্শনেরই জন্য নাকি--দেবাদিদেব মহাদেব গোপনে গোপীসেজে ধন্য হয়েছেন।
রাস শব্দের অর্থ সঙ্গীত বা নৃত্য।
রাসই জগৎ---জগতই রাস। এই রাসের জন্য পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ভগবান কোটি কোটি ভাগে বিভক্ত হয়ে, গোপীদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন।
আজ সেই দিন। চারিদিকে একটা সাজ সাজ রব--- আমি যাবো, আমি রাস দর্শন করবো-- আজ কত মানুষের সমাগম, আমি না গিয়ে কি থাকতে পারি?
শেষ পর্যন্ত আমাকে বেঁধে রাখতে কেউ পারেনি,  মধুসুদনকে স্মরণ করে--রাস দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
আমি এখন বিশ্বেশ্বরের প্রাঙ্গণে---নাটমন্দিরে।  সমস্ত প্রাঙ্গণ ও নাটমন্দির জুড়ে মানুষের ঢল। আরতি শুরু হয়েগেছে, রাস উৎসব আরাম্ভ হওয়ার আগে--এটাই শেষ আরতি।
উলু আর শঙ্খধ্বনীর মহাসমারোহে, মন্দির নিকটস্থশহরও আজ আনন্দে ভাসছে!
কিন্তু আমার মনে শান্তি কই? আমার মন কি চাইছে? কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? মনে হচ্ছে যেন এই ভীড়ে কে হারিয়ে গেছে-- তাকে আমি দেখতে পাচ্ছিনা কেন?।
শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম তাকে।
মন্দিরের এক কর্মচারী বলে গেলেন--"আপনাকে মালিক ডেকে পাঠিয়েছেন, উনার বৈঠকখানায় গিয়ে দেখা করুন।"
কথাটা শুনতে না শুনতেই ভেতরে অস্থিরতা ক্রমশ দ্বিগুণ হয়ে উঠল! বিলম্ব না করে, উনার ঘরে হাজির হলাম- -
কি, এবার চিনতে পারলেন--আমি কে?
আপনি আমায় সম্মান সহকারে বসার অনুমতি দিলেন।
প্রথম প্রণয়ের ভীরু কিশোরীর মতো আমি চেয়ারে বসলাম।
মনে মনে ভাবছিলাম--আমার মনে তো কোনো পাপ নেই, আমি রাধ-মাধবের রাস দর্শনে এসেছি।
আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম-- আপনি অভিজ্ঞ শিকারির মতো আমাকে ধরার জন্য জাল পাতছিলেন।
তবু আমি পালিয়ে যায় নি!
আপনি বললেন--"এই জান, তোমার আমার সম্পর্ক একজনমের নয়---তোমাকে দেখলে কেন আমি এত দুর্বল হয়ে যায়--তুমি বুঝতে পারনি?"
আমি সেদিন তোমার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমি সেদিন পালিয়ে যায় নি!
অঘটন ঘটতে বেশী সময় লাগেনা। তবু মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়--বেহিসাবী হয়ে যায়! তুমি আমার আরো সন্নিকটে এলে--আমি উন্মূলিত তরুর ন্যায় কখন যেন তোমার প্রশস্তবক্ষে আমার মাথা সংস্থাপন করে ফেলেছি---আমি বুঝতে পারিনি- - -
এবার মনে পড়েছে? আমি কে!
ললাটে--গণ্ডে--চিবুকে চুম্বন আঁকতে আঁকতে বললে--"তোমার আমার পরজনমে কোনো সাক্ষাৎ ছিল, তাই হয়তো এজনমে এমন করে পেলাম।"
আমার অন্তর কেঁপে উঠল! সহসা মনে হাজার প্রশ্নের আবির্ভাব হল-- আমি কি তবে বিশ্বেশ্বরকে ভালবাসিনে? মাধবকে বাহানা করে কি ইনার জন্যই মন্দিরে ছুটে আসতাম? আমার যে স্বামী-সন্তান বর্মান! ঠাকুর কি আমায় কখনো ক্ষমা করবেন?।
রাতের পর রাত জেগে জেগে উচিৎ-অনুচিত বিচার করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি হেরে গেলাম। বিশ্বেশ্বর  আমায় ত্যাগ করলেন---আমি নরকের পথে পা বাড়ালাম!।
তুমি আমার ইহকাল পরকাল হয়ে ভিতর থেকে জড়িয়ে ধরলে--আমি তোমায় ভালবাসলাম।
তোমার কথা চিন্তা করলে কি যে সুখ পেতাম আমি---একমাত্র অন্তর যামীই বুঝেছিলেন।
যখন তোমার নেশায় গৃহ আমার অরণ্য হয়ে উঠেছে--ঠিক সেই সময় থেকেই তুমি আমায় অল্প অল্প করে অবহেলা করতে লাগলে- -
এবারও চিনতে পারনি, আমি কে?।
তুমি যত আমার প্রতি অবহেলা শুরু করলে--ততই আমি নুকিয়ে নুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদলাম। প্রশ্নছিল--আমার অপরাধ কি? কোন অপরাধে আমাকে তুমি বঞ্চিত করছো? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ তুমি আমাকে কখনো দাওনি।
আমরা নারী বলে এতটা খেলনা নই! সত্য-মিথ্যা জানার আমাদেরও একটা সাধারণ শক্তি থাকে,
আজ আমি টের পেয়েছি--আমি শুধু একা নই--আমার মতো অনেক হতভাগী ঐ বৈঠকখানায় জীবন বিসর্জন করেছে!
নিজেকে ইশ্বর বলে মনে কর তাই না? আরে ইশ্বর সে--যে নারীকে কখন ঠকায় না!
ভগবান তো সে---যে নারীত্বকে সম্মান করেন!
বীর পুরুষরা কখন নারীর সাথে যুদ্ধ করেনা--
আদর্শ পুরুষরা কখন নারীহত্যা করেনা!
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বিধাতা আমাকে কৃপা করেনি--যদি শ্যাম আমাকে কৃপা করতো, প্রসাদের দাম আমাকে এভাবে শোধ করতে হতো না! তোমার মনে পড়ে? তুমি একদিন আমাকে বিনে পয়সায় বিশ্বেশ্বরের প্রসাদ দিয়েছিলে।
আমি কখন ভাবিনি, প্রসাদের দাম এভাবে মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে!।
আমি যে তোমাকে বড্ড ভালবাসি গো! এখনও তোমাকে আমি ভালবাসি!
কিন্তু এতোবড় সত্যটা তুমি সেদিন গোপন করেছিলে কেন?
আমিতো বার বার বলেছিলাম---দেখ, বিয়ে কর--বিয়ে করে একটা সংসার কর, কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি বলেছিলে--"আমি তোমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারি!"।
এবার বলতো, একটা বিবাহিতা নারীর জীবনে একটা অবিবাহিত ছেলের প্রণয়সংসর্গ হলে-- সেই নারীর চিন্তা কি কম!।
নিজের দিকটাও সেদিন  ভেবেছিলাম। আমি যে খুব একটা ভাল- তা নই! আমি নিজে বিবাহিতা জেনেও দিনের পর দিন তোমার অদম্য ইচ্ছার প্রতি মাথা নুইয়েছি।সেদিন আমার উচিৎ ছিল--তোমার গালে একটা থাপ্পড় মেরে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। কিন্তু আমি তা করিনি, আমি জানি-- আমার এই পাপের ক্ষমা নেই!
আমার মতো নারীরা কখন স্থায়ীসুখী হয় না, যদিও বা হয়--বিচ্ছিন্ন মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী---আমার কথা থাক।
আমি কি কম ভেবেছি? দিনে দিনে--মাসে মাসে---বছরে বছরে ভেবেছি--তুমি আমার জন্য এতোবড় ক্ষতি করতে চলেছো!
একটা অবিবাহিত পুরুষ যখন একটা বিবাহিতা নারীর জন্য সর্বস্বপণ করে বসে, সেই বিবাহিতা নারীর জীবনে আর কি পাওয়ার বাকি থাকে বলো? নিজেকে যতখানি ভাগ্যবতী মনে হয়---ততটা দুঃখিনীও মনে হয়।
জগতে যত রকমের পাপ আছে--সবচেয়ে বড়পাপ- স্বামীকে বঞ্চিত করে যে নারী পরপুরুষের জন্য পথ চেয়ে থাকে। ললাটে সেই বিষের সাগর নিয়েই-- তোমাকে ভালবাসলাম।
মনে মনে আরো পাপ আঁটলাম, এক নারীর দুই পুরুষ অবৈধ। তাই তোমার জন্য ওর প্রতি স্নেহ-মায়া-মমতা আস্তে আস্তে উপড়ে ফেলতে লাগলাম।
বিনিময়ে--দণ্ডে দণ্ডে, পলে পলে-- আলোতে অন্ধকারে ওর নির্যাতনের শিকার হতে লাগলাম। ভিতরে ভিতরে তোমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে-- শতবাহু প্রসারিত করে তোমার দিকে ঠেলে দিতে লাগল!
তুমি যদি বল, এটা আমার অন্যায়--মানলাম। কিন্তু তোমার দেখান পথেই তো আজ আমি পা বাড়িয়েছি, তোমার মনে আছে?
একদিন বলেছিল-"এক পুরুষের মধ্যে চিত্তবিনিময়ে বৈধতা বজায় থাকে।" তাই 'সে' কূলের নিশি ত্যাগকরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন একূলের তীর ছুঁই ছুঁই--তখন তুমি ভয় পেয়ে গেলে।
আমি অবাক! যে আমার জন্য অনায়াসে এতোবড় প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্থিরচিত্তে যন্ত্রণা সয়ে যেতে পারে--যে আমার জন্য পৃথিবীর সর্বস্ব নির্দ্বিধায় ত্যাগ করে পারে, সেই স্পর্শটুকুর জন্য- আমি আজ তার মুখোমুখি!
জিজ্ঞাসা করলাম-" কি, তুমি আমাকে চেয়েছিলে না? দেখ, সে আজ নরক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে বধ্যভূমিতে  হাজির! আমাকে চিনতে পারছো? আমি মালবিকা, যার জন্য পৃথিবীর সব সুখ-দুঃখ ত্যাগ করেছো!।
পরাজিত সৈনিকের মতো ধীরে ধীরে মুখতুলে যখন বললে-"মালবিকা, আমি বিবাহিত!"।
কথাটা শুনার সঙ্গে সঙ্গে চোখে বর্ষণ নামার আগেই--বুকের ভেতরে অনেক দূরে কোথায় যেন একটা বাজ পড়ল! তার প্রতিধ্বনি অন্তরের একূল-ওকূল সবকুল মচড়াতে মচড়াতে নির্জন প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে আমাকে যেন আছাড় মারতে লাগল!
বিধাতা জানে---কোন সৌদামিনীর আলো পথিক ভয় পায়! বিধাতা জানে--কোন বজ্রের ক্ষমতায় পাহাড় ফাটে!
বিধাতা জানে- কাকে কতটা অন্ধকারভরা নরক ছুঁড়ে দিতে হয়!
এ তুমি কি করলি গো! কোন জনমের প্রতিশোধ নিলে তুমি?
গাড়ী--বাড়ি--ধন--সম্পদ--প্রতিষ্ঠা--মর্য্যাদা তোমার তো সবেই আছে, তবে কিসের অভাবে আমার দুকূল কেড়ে নিলে?
তুমি যে বিবাহিত--এতোবড় সত্যটা কেন গোপন করেছিলে? আমি যে বড্ড ভালবাসি গো তোমা----
যখন শুনলাম তুমি বিবাহিত, তার বিষের জ্বালায় আমার সুখের নিশি যে চিরকালের মতো নীল হয়ে গেল!।
যেদিন আমার ললাটে চুম্বন এঁকেছিলে-সেদিন কি একটিবারও তোমার মনে হয় না--যে মালবিকা এজনমের সব সুখ-দুঃখ তোমার পায়ে জলাঞ্জালী দিল!
যেদিন মালবিকার চিবুকে প্রথম চুম্বন এঁকেছিল, সেদিন কি তোমার একটিবারও মনে হয়নি, যে---তোমার মালবিকা আর বেঁচে নেই--সে খুন হয়ে গেছে?
সত্যিকারের ভালবাসা তুমি কি করে বুঝবি বল? তোমার প্রমোদগৃহে অবিশ্রান্ত উর্ব্বসী-রম্ভার নৃত্যগীত,---আর বাসরঘরে মেনকার ঘন ঘন কটাক্ষবর্ষণ!।
যেদিন সত্যিকারে কোনো নারীকে ভালবাসবে--সেদিন বুঝবে--ঐশ্বর্য্য--সম্পদ--প্রতিষ্ঠা--ইমারত, ভালবাসার সামনে সব তুচ্ছ--সব তুচ্ছ!।
হে বিধাতা!তুমি কি আঘাতগুলো বেছে বেছে শুধু নারীদের জন্যই পুষে রেখেছ?
আমি যদি কোনো অপরাধে অপরাধিনী হই--তবে সেও সমান অপরাধে অপরাধী।
আজ কে আমাকে বাংশীধ্বনি শুনিয়ে ঘরের বাইরে এনেছে?
আজ কে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে দুকূল কেড়ে নিয়েছে?
আজ কে মিষ্টিকথার জাল বিছিয়ে আমাকে শিকার করছে?
কেন সে আঘাত করে আমার ভুল শুধরে দেয়নি?
কেন সে আমাকে ধর্ম শেখায় নি?
কেন সে পরজনমের লোভ দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করেছে?
তাই বললাম--হে বিশ্বেশ্বর! আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি--তবে সেও সমান অন্যায় করেছে--
আমার বিচার হলে---তার বিচার হবে না কেন?
আমার ধর্ম গেলে--তার ধর্ম যাবে না কেন?
হে পতিতপাবন! তোমার নিকটে তো সব সমান--তবে আজ এ বিভেদ কেন?
আমি বাঁচলে তোমার সৃষ্টি কি চলত না?
মানলাম। আমি যাকে ঠকিয়েছি তার জন্য শাস্তি যতবড়ই কঠিন হোকনা কেন--আমি বুক পেতে প্রায়শ্চিত্য করবো।
কিন্তু সেদিন আমি যাকে ভালবাসতাম--সে ভালবাসার মধ্যে তো কোনো ছলনা ছিল না! তবে তার প্রায়শ্চিত্ত্য আমি কেন করবো?
কেন রাত জেগে জেগে অবিশ্রান্ত চোখের জল ফেলবো?
হে রাধা-মাধব! তোমার পূজার থালার মধ্যে আমার কোন ছলচাতুরী ছিল না--কোন দুরভিসন্ধি ছিল না-- তবে কোন ধর্মশাস্ত্রবলে তোমার প্রাঙ্গণে গেলে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করি?
হে করুণাময়! তুমি যতবড়ই বিধাতা হও---এর হিসেব একদিন আমাকে দিতেই হবে!।
যখন আমি এইরকম একটি পরিস্থিতির শিকার হয়ে অকূল সাগরে পড়ে ডুবছি, সেই মুহূর্ত একজন লেখকের সঙ্গে আমার দেখা।
আমি ডুবে যাচ্ছি দেখে--সেই লেখক, আমার হাত ধরে টেনে তীরে তুললেন।
আমাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুললেন!
আমার এই অবস্থার কারণ, লেখক জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তখন এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, উনার কাছে ঔষধ চাইলাম, লেখক আমায় ঔষধ দিলেন--"ধর্মতত্ত্বের" প্রথম পর্ব।
প্রতিদিন একপাতা করে লেখক আমায় সেবন করালেন।
ধীরে ধীরে যখন অনুশীলনতত্ত্ব শেষ করলাম--তখন আমি অনেকখানি সুস্থ!।
আমার চোখের পর্দা সরে গেছে--এখন আমি কারুকে আর ভয় পাইনা।
আমি এখন নিজেই বিচার করতে পারি--কে সত্য---কে মিথ্যা--কে বিষ---কে অমৃত---কে ন্যায়---কে অন্যায়।
আমি এখন নিজে বিচার করতে পারি--কে সৎ--কে অসৎ---কোনটা ভালবাসা---আর কোনটা ছলনা।
আমি এখন ইচ্ছে মতো যেমন মরতে শিখেছি--- তেমনি ইচ্ছে মতো বাঁচতেও শিখেছি!।

মায়ের পরশ : বিকাশ দাস (বিল্টু )




রাত প্রায় একটা ছুঁয়েছে, চাঁদের আলো ক্ষীণ হয়ে মেঘের আনাগোনা চলছে ।ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে ।পূবের শ্মশান ঘাট থেকে শুধু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে" হরি বোল, বল হরি ।"আর আজ কুকুর গুলিও খুব বেহায়া। হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার জুড়ে দিচ্ছে ।এই সময় চয়নের গাড়ির শব্দ শোনা গেল ।গাড়ি বলতে একটা পুরানো বাইক, ওটাই বহু কষ্টে কিনেছে ।বাড়ির পাশের টার্নিং এর এখানে ঘোরাতে  গিয়ে পরে গেল। মা শব্দ শুনতে পেল ।বিড়বিড় করে মা বলা শুরু করলো", এ অমানুষ হয়ে গেল ।আমার হয়েছে যত জ্বালা !আজ হয়ত আবার গলায় ঢেলে এসেছে।"
চয়ন গাড়িটা তুলে আবার স্টার্ট দিয়ে বাড়ি আসলো ।চয়ন ভাবলো মা ঘুমিয়ে আছে ,তাই গাড়িটা তুলে ঘরে রাখা  ঢাকা খাবার খেতে বসলো ।
ভাত নিয়ে বসছে, হঠাৎ মার আগমন ।
"কিরে তুই আজও খেয়ে আসলি? আমি স্পর্ষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম , দেখলি তো কেউ তোর কথা ভাবে? আর আমি তো মা.. আমি পারিনা ,আমি পারিনারে -আর এভাবে থাকতে ?ভগবানও এমন আমায় নেয়ও না !"
চয়ন চুপ হয়ে শুনছিলো ।মার মুখোমুখি কথা বলতে ভয় হচ্ছিল। আজ একটু বেশিই খাওয়া হয়েছিল তার ।
"ঠিক আছে খেয়ে শুয়ে পর ... আমি মরলে বুঝবি  ?"
চয়ন আর খেতে পারলো না ।একটু বমি বমি আসছে ।আবার বমি করলে মা আরও সন্দেহ করবে তাই পকেটে রাখা গুটকা টা খেয়ে বাথরুম গিয়ে সিগারেট টা ধরানোর চেষ্টা করলো ।কিন্তু নেশা এত টাই ছিল যে ধরাতে পারছিলো না ।বহু চেষ্টার পরে সিগারেট টা ধরিয়ে ভাবতে লাগলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো ,"মা ,মা'গো আমি কি আর সাধে খাই? আমি যে আর পারিনা ঠিক থাকতে -?
মা তখনও ঘুমায়নি।
" কিরে চয়ন !যা বাবা এখন শুয়ে পর আর কত? আর পারিনা ।"
মার উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেট টা জলে চুবিয়ে দেয় ।
হ্যা মা...
রাত প্রায় দু 'টা তবুও ঘুম আসছিলো না, শুধু
শ্মশানের কাছ থেকে আসা" হরিবোল  বল হরি  "কানে বিঁধছিলো। তখনি চয়ন হারিয়ে গেল অতীতে।
হ্যা তারও ঘর ছিল, সংসার ছিল, ফুলের মতো ফুটফুটে একটা ভালোবাসার বাগান ছিল ।সেই বাগানের সব থেকে সুন্দর ফুল ছিল গোলাপী ।সেখানে কত সুন্দর খেলা হতো ,হাসি হতো ,অভিনয় হতো আর ভালোবাসাও ছিল ।হঠাৎ একদিন ঝড় আসলো ।বাগান তছনছ হয়ে গেল ।গোলাপী গোলাপ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। চয়ন আর্তনাদ করলো --কে শোনে তার কথা ?এর পরদিন চয়ন ঠিক বুজতে পেরেছিলো গোলাপ তো কীট ময় !সেই কীট তাকে ধ্বংস করে দিল ।
গোলাপী মারা যায় ,সুইসাইড করলো ।আর পুরো দোষ পড়লো চয়নদের উপরে। চয়নকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় অথচ যে গোলাপী তার প্রাণ তার ভালোবাসা সেই কিনা আগুনে জ্বলসে যাচ্ছে পারছিলো তার অন্তিম সময়ে উপস্থিত থাকতে ।

সকালে মা আগেই উঠে সিদ্ধ ভাত রাঁধতে শুরু করলো। মা জানে ছেলের সারাদিন খাওয়া হয়নি ।,আর মা এটাও জানে চয়ন তো ওরকম নয় ও তো পাড়ার সব থেকে ভালো ছেলে ।কাউকে দোষ দিয়েও লাভ নেই ?সব ওর কপাল! নাহলে প্রাইমারী চাকরিটা হয়েও হলো না  !ভাইভাতে আউট! এর থেকে দুঃখ কি আর আছে ?
মা ভাত রেঁধে চয়ন কে ডাকতে লাগলো ।
"চয়ন। কি'রে চয়ন ?--ওঠ বাবা। তোর ডিউটি আছেনা?--কিরে ওঠ !"
হ্যা মা...
চয়ন নিজেকে ঠিক করে ভাবতে একটু সময় লাগলো ।ভুলেই গেল রাতে কি হয়েছিল ?একটু মনে হওয়ায় নিজের প্রতি লজ্জা হলো ।ইস! মা কি ভাববে?
চয়ন উঠে ব্রাশ করে স্নানটা সেরে নিল। ঘড়িতে তখন আট টা, সাড়ে আট টায় তার ডিউটি ।আর আধ ঘন্টা সময়। বলা বাহুল্য চয়ন একটা কোম্পানির সুপারভাইজার ।
"এই ভাত বাড়া আছে খেয়ে নে--"
ভাত খাওয়া শেষ হওয়ার পথে মা চয়ন কে বললো ,
"কিরে বাবা, এভাবে আর চলে? এখন নতুন করে ভাব ;লোকে জানলে কি হবে? আর তোর দাদারাও নানান কথা বলছে। এখন একটা সংসার কর। আমি মেয়ে দেখি ।অন্তত আমায় একটু রেহাই দে ।আর আমার পেটের ব্যথাটা ক'দিন থেকে খুব বেড়েছে ।কখন কি যে হয় !"
মা --মা !ওসব বলো না ,তুমি না থাকলে আমি.. তুমি তো জানোই দাদারা দাদাদের মতো কাজে ব্যস্ত ।

চয়ন যেতে যেতে তাই ভাবছিলো কি করবে ?না মার কথাই শুনবে --
আজ কাজেও মন বসছিলো না ।খুব উদাসীন লাগছিল তাকে। দুপুরে লাঞ্চ এর খাওয়া শেষ করে মনে পড়লো মার তো পেটের ব্যথা ,তাই বাজারের MD ক্লিনিক থেকে কয়েকটা গ্যাসের ট্যাবলেট নিল ।সামনে মাসে বেতন পেয়ে মার জন্য একটা ভালো ডাক্তার দেখাবে আর মাকে বলেই দিবে," মা আর তোমার কষ্ট করতে হবেনা ,আমি নতুন জীবন শুরু করব ।"
  এসব ভেবে কিছুটা হাসি আসলেও মনের ভিতরের চাপা কান্না দাও দাও করে জ্বলছিল ।অন্তর থেকে কেউ যেন বলে উঠছিলো আমায় ক্ষমা করে দিও ,শুধু মার জন্যই... প্লিজ আমি শুধু তোমাকেই---
ডিউটি শেষ হওয়ার পরে আজ আর চয়ন কিছু খেলো না, মাকে আজ বলেই দিবে সব কথা,নতুন জীবন কথা--
তাই একটু আগেই বাড়ি আসার চেষ্টা করলো ।কোম্পানি থেকে গাড়িতে কুড়ি মিনিট পথ।কিছুদূর আসার পরে ফোন টা বেজে উঠলো ।প্ৰথম বার তুললো না ।আরও বাজছিলো ,গাড়িটা থামিয়ে ফোনের স্ক্রিনে লেখা বৌদির নাম্বারে ফোন !কি ব্যাপার যে বৌদির সাথে দু বছর থেকে কথা বন্ধ তার ফোন? ভাবলো নতুন কোন মতলব নাকি? তবে পরক্ষনেই মনে হলো ফোনটা ধরা যাক ।
ওই পাশে দাদার গলা ।
"চয়ন !চয়ন! চয়ন !তুই তাড়াতাড়ি আয়। মা খুব সিরিয়াস ।"
চয়ন ফোনটা কেটে খুব স্পিডে গাড়িটা ছাড়লো ,না মা তোমার কিছু হবেনা আমি আছি তো--
কি ব্যাপার এত লোক !

"চয়ন বাবা এসেছিস।"
মা তোমার কিচ্ছু হবেনা ।বলো কি হয়েছে? আমি ডাক্তার ডাকছি। ওই ছোটদা ,ছোটদা!গাড়িকে ফোন কর। অ্যাম্বুলেন্স ডাক না!
" বাবা ওসব করিস না ।আমি হয়ত আর বাঁচবো না। তুই মানুষ হ ।আর বল আর সংসার করবি ।"
 মা আমি সব রাজি ।
গাড়িও আসলো তখন।
"চয়ন আমায় একটু জল দিবি ?"
বৌদি !বৌদি !একটু জল আনো --
বৌদির হাতের গ্লাসটা সজোরে নিয়ে মার মুখে জল দিল ।
"আমি তৃপ্তি ,শান্তি পেলাম ।অয়ন চয়নকে দেখিসরে --আর আমায় তোর বাবার পাশেই রাখিস ,নিজের ভূমিতে তৃপ্তি..... পা...বো.... "

মা- মা- মা --মা...
আকাশ গুমরে উঠলো বাতাস আর্তনাদ করে উঠলো বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে পড়তে লাগলো ।মা চির ঘুমে--

রাত দু 'টার দিকে চয়ন শুধুই শুনছিলো সবাই জোরে জোরে বলছিলো ,"হরি বোল, বল হরি ---"

বাতাসে বারুদের গন্ধ :পবিত্র চক্রবর্তী


                (এক)


বাতাসে একটা জোলো জোলো গন্ধ উঠছে । সেদিনও ঠিক এমনটাই ছিল । আর মেশানো ছিল তাজা বারুদের গন্ধ , পোড়া লাশের কূট ঘ্রাণ । সব মিলিয়ে বাতাসকে আরও ভারী করেছিল । দীর্ঘ ৪৮ বছরের কথাটা খবরের কাগজে কিছু লেখা পড়েই মনে পরে গেল জামাল সাহেবের । কর্মজীবন থেকে অবসর আর কিছুকাল পরেই । বিশেষ কিছু জমাতে পারেন নি যদিও । কেমন করেই বা জমাবেন ! সরকারী স্কুলের চাকরীটা এপার বাংলায় ৭১ এর পর এসে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পেয়েছিলেন । বয়স তখন ৩৫ ছুঁইছুঁই । সুলেখা লাল আন্দোলনে তখন ব্যাস্ত । ওরই ঠিক করে দেওয়া কানাগলির এক কামরা ঘরে শেষমেশ থাকতে শুরু করে যুবক জামাল ।
বিষয়টা যত সহজে লেখা হচ্ছে তা কিন্তু নয় । বাঙাল বাড়ীর মেয়ে সুলেখা । দেশ ভাগ হওয়ার পর বাবা এ দেশে চলে আসেন । কিন্তু তখনও সম্পর্কের,ভালো লাগার বাঁধ ভাঙে নি । সুতরাং যাতায়াত ছিলই । বাংলাদেশে মামা বাড়ীতে মাঝেমধ্যে যেত সুলেখা । আর ঠিক তখনই পরিচয় হয় জামালের সাথে । কলেজ পড়ুয়া দুজনাই । কেন জানি না  প্রথম দেখাতেই  ভালো লাগাটা ভালবাসায় পরিনত হয়ে যায় ।
সম্পর্কের বন্ধন দূরে থাকলেই হয়তো বেশী করে উপলব্ধি হয় । আর  এ দূরত্বটা কাঁটা তারের এপার আর ওপারের । ভিন্ন ধর্ম , দেশের । কিন্তু থামে নি তাদের অনুরাগের স্পর্শ । প্রথম প্রথম পার্টির কাজের নাম করে সুদূর কোচবিহারের বাংলাদেশ সীমান্তে যেখানে দুটি দেশের কাঁটা তার চলে গেছে ঠিক সেখানে বেড়ার এপার ওপার থেকে মনের কথা , হাতের ছোঁয়া চলত । যদিও সেটা বেশীদিন চলে নি , কারণ ৭১ এর মুক্তি আন্দোলন ।
সেদিন ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেছিল জামাল , “ যদি বল তাহলে আসবো কী চলে ?”
হাল্কা হেসে সুলেখা উত্তর দিয়েছিল , “ এসো না , আমি তো আছি ।“ বড় ভরসার কথা ‘ আমি তো আছি ‘ কথাটা ।


                             (দুই)


আপত্তি করে নি সুলেখার বাড়ীর কেউই । ছোট থেকেই কান্তিবাবু তার মেয়েকে একটু অন্য ভাবে মানুষ করতে চেয়েছিলেন ,হয়েও ছিল তাই । জামাল আর সুলেখার বিয়ে হয়ে যায় । ভালবাসার জন্য দেশকে ভুলে যায় নি জামাল । হ্যাঁ প্রথম দিকে কান্তিবাবু বা জামালের বাবার মনেও এই চিন্তাটা এসেছিল । কিন্তু আর যাই হোক জামালের আত্ম মর্যাদাটা একটু বেশীই ।
বিয়ের কয়েকদিন পর বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জামাল স্বাধীন বাংলাদেশে না ফিরে গেলেও এখান থেকে চেষ্টা করে গেছিলো পাশে থাকার । আজও করে ।
দেখতে দেখতে ছটি বছর কেটে যায় । সংসারের হাল কোন মতে চলে । জামাল বাংলার টিউশন করে আর সুলেখা রাজনীতি , ছাত্র আন্দোলনের ফাঁকে হাত মেশিনে ব্লাউজ বানায় । আর ঠিক এরই মধ্যে সন্তান । সুলেখা আর জামালের মেয়ে । নাম রাখে রূপকথা । রূপকথার মতই তো । না আছে কোন দেশের গণ্ডী , না আছে ধর্মের ঝাঁঝালো গন্ধ । রূপকথা সকলেরই ।
সময়ের তালে নদী যায় বয়ে । আর ক্রমে সেই বহমানতার সাথে মেশে বেশ কিছু তরতাজা রক্ত । সুলেখা তারই বলি হয় । জামাল রাজনীতি কোন কালেই বোঝে নি , বোঝার চেষ্টাও করে নি । তা বলে সুলেখাকে বাধা দেয় নি । সুলেখাও ধীরে ধীরে কোন ফাঁকে যে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে গেছিলো তা নিজেই বুঝে ওঠার আগেই ছিন্নভিন্ন করেছিল পুলিশের বুলেট । বুকটা রাতের অন্ধকারে হাহাকার করলেও সেই বুকেই মাথা রেখে ঘুমাতো রূপকথা । তবে অপুষ্টি আর জণ্ডিসে রূপকথার মৃত্যু শক্ত মুসলিম হৃদয়কে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছিল । কানাগলি ছেড়ে কয়েক মাস স্থান হয়েছিল মেন্টাল এসাইলামে ।
শেষ হয় জামালের অধ্যায় , ভালবাসার পর্ব ।




                     (তিন)

কাকারা বহুবার ফিরে যেতে বলেছিল জামালকে , নাহ জামাল এ অঞ্চল-সুলেখা-রূপকথা স্মৃতি মাখা একটুকরো জমি ছেড়ে যায় নি ।
“ ওরে পাগল একা বাঁচা যায় না , শাদিটা আবার কর “ কাকার কথায় অবাক চোখে তাকিয়েছিল কিছুক্ষন ।
অস্ফুট স্বরে বলে , “ বাঁচা যায় না বুঝি !” বাঁচার অর্থ যে হারিয়ে ফেলেছে সে একা থাকার অর্থই বা বোঝে কী করে ! বিয়ে হয় এদিকারই মেয়ে মাসূমার সাথে । সত্যি মাসূমার মত নিষ্পাপ । বাপের জমিজমা বেশ আছে পশ্চিমবাংলায় । দেখতে শুনতে মন্দ না , পড়াশুনা জানা । এত সুখ ! নাহ এত সুখ না । অর্থ দিয়ে হয়তো সব কেনা যায় না । দেহ কেনা গেলেও মন ! নাহ মনকে বিক্রী কোনদিনই করে নি মাসূমা । মাসূমা ডান হাত জন্ম থেকে অকেজো , পোলিওতে সরু ।
জামালের মত ছেলে যার হিন্দু স্ত্রী-কন্যা গত হয়েছে , মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল । এমন মানুষকে মন থেকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল সে । মনে মনে নিরাপদ হয়েছিল এই ভেবে যে আর যাই হোক এই মানুষটা ভালবাসতে জানে ।
বলা যায় একহাতেই মাসূমার সেবা আর বাপের পয়সার দৌলতে জামাল শুরু করে দ্বিতীয় অধ্যায় । যে বিয়ের আশাই ছেড়ে দিয়েছিল সেই মেয়ে এখন গর্ভবতী । জামাল সুস্থ অনেক । রাতে মাসূমার পেটের উপর কান পেতে আগামীর নড়াচড়া শোনে ।
বাচ্চাদের মত মুখে এক ঝলক হাসি । মাসূমার দিকে তাকিয়ে বলে , “ আসছে রূপকথা ।“
মাসূমা বোঝে জামালের হৃদয় । তাও সে তো সতন্ত্র । পাশ ফিরে খানিক অভিমান করে বলে , “ যদি ফারহান আসে ?” ফারহান আধুনিক , ভাগ্যবান । যদি ফারহান তার আধুনিক-নতুনের স্পর্শে সকল অতীতের কষ্টকে ভুলিয়ে দেয় ? নারী মনে ওঠে এই আশা বারবার ।
রূপকথা আসে নি ,এসেছিল ফারহান ।  সেও বড় হতে থাকে । জামাল ভালোবাসে কিন্তু প্রশ্রয় দেয় মাসূমা । না অন্যায় প্রশ্রয় নয় কিন্তু প্রচ্ছন্ন আবেগ ভাঙা ভালোবাসা ।



                       (  চার)


আজ বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ । মাধবীলতার গা দিয়ে জল চুঁইয়ে পরছে । স্কুল ছুটি । মাসূমা জামালের পাশে বসে চা খায় ।
“ বাড়ী আছেন ?” বাইরে কলিং বেলের শব্দ । বাইরে খানিকটা শোরগোল ।
মাসূমা উঠতে যাবে , জামাল ওকে হাতের ইশারায় বসতে বলে নিজেই দরজা খুলতে গেল ।
“ ফারহান আপনার ছেলে ?” পুলিশের কথা শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে ।
“ হ্যাঁ কিন্তু…” শুকনো গলায় জানতে চায় জামাল । মাসূমা এরই মধ্যে উঠে এসেছে । মুখে উৎকণ্ঠা । এখন যা অবস্থা চারিদিকে ।
“ থানায় চলুন । আপনার ছেলে আমাদের কাছে আছে ।“ পুলিশের কথায় গলা বেয়ে আসে কান্না মাসূমার ।
জামাল আকাশের দিকে আল্লার কাছে জানতে চায় মনে মনে “ কেন প্রতিবার আমারই সাথে ?”
জামাল একা আসে নি । ঠিক সেই আগের মতই মাসূমা তার একহাত দিয়ে জামালের হাত ধরে আছে । পুলিশের গাড়ী ছেড়ে দেয় । পিছনে পরে থাকে মাধবীলতা , ঘর ।




বড়বাবু মন্দ লোক নন বরং খাতির করেই বসালেন । হাসতে হাসতে বললেন , “ জব্বর ছেলে তৈরী করেছেন আপনারা মশাই । এতবড় কাজ করে ফেলল !”
জামালরা জানে ফারহান দস্যুর মত । কোন বাধাই সে মানে না , পড়াশোনায় তেমন মন কালেই ছিল না । করুণ চোখে তাকায় বড়বাবুর দিকে । খানিক পরে ছেলে আসে ।
“ একটু ফর্মাল জিজ্ঞাসা বাদ করেই ছেড়ে দেব । আসলে ও আজ খেলে আসার সময় বাসে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে ওদের পিছনে পিছনে ডেরা অবধি যায় । যখন বোঝে ওরা মানে জব্বর , আবু মিস্ত্রী মেট্রো ষ্টেশনে অ্যাটাক করার মতলব আঁটছে ঠিক তখনই ভয় না পেয়ে থানায় ফোন করে । আর ধরা পরে…। ব্রেভ বয় ।“
জামালের চোখে জল । মাসূমা বলে , “ ও তো তোমার রূপকথা গো । রূপকথারা কী খারাপ করতে পারে …।“
জামালের চোখে ভেসে ওঠে সেই ছোট্ট জামাল বাবার কাছে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আবৃতি করছে –
“ ধর্ম তুমি কোথায় থাকো
চুল , ত্বক না গোঁফের তলে ?
সত্যি তুমি থাকছো কোথায়
টাক , টিকি না দুই বগলে ?

ধর্ম তোমার কোথায় নিবাস
বোরখায় না লাল সিঁদুরে ?
ধর্ম কাকে দিচ্ছো মদত
মৌলবি না জাত হিঁদুরে ?

ধর্ম তুমি থাকছো কোথায়
চুল , দাড়ি না পৈতে গিঁটে ?
কোথায় তোমার আসল ঘাঁটি
মক্কায় না তারার পিঠে ?

ধর্ম তুমি কোথায় ঘোরো
বাবরিতে না রাম-দুয়ারে ?
ভাসছো নাকি শুনতে পেলাম
রাজনীতি আর ক্রোধ জোয়ারে ।

ধর্ম তুমি তৃপ্ত কিসে ,
কুরবানি না বলিদানে ?
কখন তুমি নাড়াও মাথা
আজান নাকি গীতার গানে ?

ধর্ম নাকি আড্ডা মারো
ব্লাডব্যাঙ্ক আর হোটেলগুলোয় ,
আড্ডা নাকি মারছো শুনি
কবরখানায় শ্মশান চুলোয় ;

ধর্ম তোমার ইচ্ছেটা কী
বিচ্ছেদ আর রক্তমাখা ?
স্রষ্টার সব সৃষ্টিকে কী
ধন্দ দিয়ে সরিয়ে রাখা ??”
                         ( সমাপ্ত )

সুদীপ ঘোষাল






মেলাখেলা









-----জীবনে বড় হতে হবে বাবা,মোবাইলে সময় নষ্ট ক''রো না।
-----মা আমি পড়েছি
-----অইটুকু পড়লে হবে  না ।
-----;ঠিক আছে, কাল থেকে পড়বো
-----;কাল  কাল করে কালে খাবে। আজকের কাজ আজকেই করো।
সমীরকে বুঝিয়ে বলছেন তার মা সোমা। জীবনে বড় হতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় বাবা। অনর্থক সময় নষ্ট করলে একদিন পস্তাতে হবে।
কিন্তু সমীর তিরিশ বছরে এখন প্রেমে পরেছে। তারপর আনলিমিটেড মোবাইল কল। শুধু মোবাইলের হেডফোন কানে লাগিয়ে কথা বলে চলে। অফুরন্ত কথা।
ওপাড় থেকে অভিমানের আওয়াজ ভেসে আসে।
----আর ফোন করো না কেন?
---ব্যস্ত ছিলাম
------ও আর আমার সাথে কথা বলাটা কাজ নয় বুঝি?
----না না তা বলছি না। মাকে নিয়ে মন্দিরে পুজো দিতে গেছিলাম।
---বেশ বেশ ভালো করেছো। কখন কেথায় দেখা হবে বলো।
----- বজরংবলির  মন্দিরের কাছে। বেলা দশটায়।
বেশ তো ছিলো গ্রামের দিনগুলো। সংসারের অশান্তির ফলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তি পরিবারগুলো। এখন তারা শহরে বাস করছে। কিন্তু ভুলতে পারে না গ্রামের স্মৃতি।
তারপর মহিম পড়ার ঘরে বসলো। বই নিয়ে বসলে তার আর সময় জ্ঞান থাকে না। কখন যে সময়গুলো ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় বুঝতেই পারে না।
পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে পুরোনো দিনের কথা মনে পরে যায় তার। পরিবারের সবাই একসাথে একবার মেলায় যাওয়ার স্মৃতি মনে উঁকি দিচ্ছে বারেবারে।
গোরুর গাড়ি চেপে উদ্ধারণপুরের মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।
জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।
পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।
গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।
--- একটা তো, কিছু হবে না।
----- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।
তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।
গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।
মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।
জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।
তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।
বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।
মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।
তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।
মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।
মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে
তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো?  তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।
ঘুরে ঘুরে লেখক অবধূতের আবক্ষ মূর্তি দেখলাম। শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।
এই উদ্ধারণপুরের মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি।
আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের  শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।
দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।
তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।
সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।
তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।
হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।
তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে  নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা।
আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে  নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো  বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই  বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে,  ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো।
গোরুর গাড়ি বাড়িতে পৌঁছে গেলো।
আমি মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক।গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। বলতো,দাদু। 
মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস,আই মিনে আয়। সুদপে,রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো।আবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা,জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিম
ধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে।আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে  হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।দাদুর পরম বন্ধু সিরাজুল চাচা বাড়িতে গেলেই মিষ্টিমুখ করাতেন। তার নাতি বিরাজুল আমার বড় উপকারি বন্ধু। মানুষের সংজ্ঞা ওই বাড়িতে গেলেই খুঁজে পাই।
তারপর সংসারের টানা পোড়েন।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতরন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর  বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।  
উদ্ধারণপুরের শ্মশানে দাদুকে পোড়ানো হয়েছিলো।  তখনও মেলার সময়। প্রচুর লোকজনের মিলনমেলা। মেলার মতোই মৃত্যুর পরেও সবাই মিলিত হয় এই উদ্ধারণপুরের মেলায়।
তারপর জীবনের আর এক পর্যায় শুরু হলো। আমার দিদি শোভা। তার জীবনে ঢেউ বেশিদিন টিকলো না। গর্জন স্তব্ধ হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়ি।
শোভা দিদির কপালের মাঝামাঝি একটা তিল তার মুখের শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছিলো । কিন্তু তার সিঁথির লাল শোভা একদিন সাদা হয়ে গেলো । অমাবস্যা র সেই রাত শেষ হতেই চাইছে না । ক্রমাগত একটা কান্নার আর্তনাদে দুই মেয়েকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার জীবনের গতিপথ । মাঝ সমুদ্রের দিক হারানো নাবিকের চুল ছেঁড়া চিন্তার মতো তার অপহৃত হৃদয় । শোভাদি মেরুদণ্ড সোজা রেখে তার বড়দার পরামর্শ মেনে যোগ দিলেন চাকরি জীবনে । আলো জাগলো আশার মনে । আমি তখন তেরো । শোভা দির রান্না আজও মুখে তৃপ্ত স্মৃতি জাগায় । শুনেছি অন্তরের আন্তরিকতায় সামান্য সব্জি অসাধারণ অমৃতের আস্বাদ আনতে পারে । খেয়ে চলে যেতাম আশ্রম পরিবেশে । আমার বড় আদরের শ্রদ্ধার বিরলতম বিদ্যালয় বিল্বশ্বর বিদ্যালয় । এক বটবৃক্ষের ছায়ায় শুরু হতো আমাদের প্রার্থনা সংগীত । অম্বুজাক্ষবাবুর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমাদের আজও পথ দেখায় । বিদ্যালয় অন্ত প্রাণ কোটিতে  গুটি । শুধু স্মৃতি বয়ে বেড়ায় ভগ্মাবশেষ ।
বাড়ি ফিরে ফের মায়ের আঁচলের মতো শোভাদির অকৃত্রিম আদর ।মা তাকে নিজের বোনের স্নেহে মানুষ করেছিলেন ।
তারপর সুখে দুখে শোকে সময়ের চোরাপথে ঢুকে যায় সমগ্র ইতিহাস । মা বলতেন, কাল করবো বলে কোনো কাজ ফেলে রাখিস না । কালেই  খেয়ে নেবে সব ।
মা আমার লড়াকু মহিলা । জীবনের অভাব অভিযোগ কোনোদিন তার হৃদয় ছুঁতে পারেনি । সেই হৃদয়ে ছিলো তালবোনা পুকুরের সাঁতরে তাল কুড়োনোর ছবি । নতুন পুকুর তর্ক করে এপাড় ওপাড় হওয়ার চির নতুন ছবি ।
সেইসব ছবি আজও মায়ের ঠোঁটে হাসির রেখায় চিত্রিত করে আমাদের  নবহৃদয় ।
আজ বৃদ্ধা মা শুধু অপেক্ষার প্রহরে প্রহর গোনেন। চার ছেলেকে মানুষ করে মন যে ছেড়ে যেতে চায় না মায়ার আকর্ষণ । মানুষের পরমায়ু  এত কম কেন? মা বলেন, ছেড়ে যেতে হয় বলেই তো জীবন মোহময়ী । তা না হলে ছন্দ পতন হয় যে ।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা মানব জীবন । কি করে , কে যে লিখেছেন সে রহস্য লুকিয়ে আছে লালনের গানে,জীবনের আনন্দে ।
আমার মেজদার নাম রিলীফ । জন্ম থেকেই মুক্তির টানে তার জীবনের উত্থান । প্রতিভার দৃষ্টি তাঁর আচার আচরণে । সে সংগীত ভালোবাসতো । সংগীতের সুরে সুরে সাজানো সংসারে সফল সাধক মানুষ । কথায় কথায় মানুষই দেবতা হয়ে যায় তার ভাবনায় । দাদা বলে, কোনোদিন দুঃখ ব্যাথাকে বড় করে দেখিস না গর্দভ । মনে মনে সুখ অনুভব করার নাম জীবন ।
বড়দা নিজের জীবনে কাজকে গুরুত্ব দেন বেশি । কথায় কথায় তার কথ্য ভাষা মনের অন্তস্থলের বন্ধ দরজার চাবিকাঠি । তিনি বলেন, টাকা পয়সা জীবনে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই ভালো । বেশি হলেই বিষ । মানুষকে ভালোবাসলেই যথেষ্ট । অভিনয় নয় । আন্তরিকতা একটা কুকুরও বোঝে ।
ছোটোভাই বাবু সকলের প্রিয় । বিপদে আপদে সকলের পাশে  সতত  জাগ্রত তার বিবেক । কোনো বিপদ তাকে চঞ্চল করতে পারে না  । এ তো সাধকের লক্ষণ ।
আর আমি মানুষ হয়ে জন্মে এত ভালো পরিবেশে মানুষের কিছুই কি করতে পেরেছি?প্রশ্ন কুড়ে কুড়ে খায় তিন কুড়ির জীবন । আর কবে করবো মনের অপূর্ণ সাধ পূরণ। কত অভুক্তজন শুধু একমুঠো নুনভাত চায় । সমর্থ লোক যদি একটা মুখেও ক্ষুধার অন্ন জোটায় , তাহলেই যথেষ্ট ।
ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায়  আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন  শিক্ষার্থী প্রবাহ
আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো । পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি । হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ । পায়ে হেঁটে । গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কয়ার । জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো  সুন্দর । বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো  চোখের সুন্দরী কে । তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো ।অমিত রান্না করতো খুব ভালো । পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম । ও শেফ হতে চেয়েছিলো । অনিন্দিতা বলে বান্ধবী টা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো । কিন্তু সব স্বপ্ন গুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো ।
অই বন্ধুরা একত্রে  সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে । রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে । অসীম গান করে,বিচ্ছু একতারা বাজায় । অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে । ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে । হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক।
আমার মা গল্প করতেন তার নতুন অভিজ্ঞতার কথা।
সব জা , একত্রে মিলিত হতো ননদ বা দেওরের বিয়েতে। একবার বাসু দেওরের বিয়েতে পুণ্যলক্ষী বৌদি ছেলে সেজেছিলো। প্যান্ট, জামা পরে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটা লাঠি নিয়ে অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলে বিয়ে বাড়িতে। সব জা রা প্যান্ট পরা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে যখন ভাশুরদের সামনে দাঁড়ালো,মাথা লজ্জায় নিচু করেছিলো পুরুষদল। তখনকার দিনে এটা একটা ভীষণ সাহসের ব্যাপার ছিলো। অভিনয়ের শেষে যখন জানতে পারলো প্রকৃত ঘটনা তখন সকলে হাসাহাসি আর চিৎকার শুরু করলো। নতুন বৌ বুঝতে পারতো একান্নবর্তী পরিবারের আনন্দ। বিয়ের শেষে যে যার চাকরীর জায়গায় চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা লাগতো। নতুন বৌ এর ভালো লাগতো না। স্বামী চলে যেতো চাকরীর জায়গায়। বাড়িতে মা, বাবা আর বেকার দেওরের দল। তারপর জলের ধর্মে যে কোনো পাত্রের আকার ধারণ করতো নতুন বৌ। বাবা,মায়ের সেবা,দেওরের খাওয়া, রান্নাবান্না সব নজরে রাখতে হতো নতুন বৌকে। প্রাণমন ছটফট করতো বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে রাজী করে শর্ত মেনে যেতে হতো বাবার বাড়ি। তখন পুরোনো মাটির গন্ধে নতুন বৌ ভুলে যেতো সব না পাওয়ার দুঃখ।