হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে ঋজু আর পরমার্থ অপেক্ষা করছিল। ওরা একটু আগেই এসেছে। গত কাল রাত সাড়ে বারোটায় অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে যখন ড্রপ কারের জন্য অপেক্ষা করছে ঋজু, তখন হঠাত্ই পরমার্থ ওর কাছে এসে বলল, এই রে, আশিস তোমাকে বলতে বলেছিল। একদম ভুলে গেছি। কাল দাঁতনে একটা উত্সব আছে। সেখানে কবিতা পাঠেরও ব্যবস্থা আছে। ও তোমাকে বারবার করে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?
ঋজু কী ভাবছিল। ও কিছু বলছে না দেখে পরমার্থ ফের বলল, কাল তো তোমার অফ ডে। চলো না।
— কখন?
— কাল সকালে। সাতটার সময়। হাওড়া থেকে।
হাওড়া থেকে ঋজুর বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, চেতলায়। ওখান থেকে একটাই বাস। সতেরো নম্বর। কখন আসে কোনও ঠিক নেই। তাই হাতে একটু সময় নিয়েই ও বেরিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা পার হওয়ার আগেই দেখে বাস আসছে। ফলে সাতটা নয়, তার অনেক আগেই ও চলে এসেছে। এসে দেখে, অফিস থেকে অত রাতে বাড়ি গিয়েও এই সাতসকালেই সেই বিরাটি থেকে পরমার্থও এসে হাজির। ঘড়িতে তখনও সাতটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি।
ও সামনে আসতেই পরমার্থ বলল, চা খাবে?
— ওরা আসুক না। একসঙ্গে খাব। ট্রেন ক’টায়?
— তা তো জানি না। আশিস তো বলল, সাতটার সময় এখানে দাঁড়াতে।
— এখানেই বলেছে তো?
— হ্যাঁ রে বাবা...
— সাতটা তো প্রায় বাজে।
— এখনও বাজেনি। আসবে তো সেই সল্টলেক থেকে। সবার বাড়ি তো আর তোমার মতো হাওড়া স্টেশনের পাশে নয়, যে বাসে উঠলাম আর হাওড়ায় পৌঁছে গেলাম। চা খাবে? ওই তো আশিস...
ঋজু দেখল, শুধু আশিস নয়, ট্যাক্সি থেকে একে একে নামছে আরও তিন জন। তার মধ্যে দু’জন মহিলা।
আশিস কাজ করে আকাশবাণীতে। পরের সপ্তাহে রেডিওতে কী কী অনুষ্ঠান হবে, সেই অনুষ্ঠান-সূচি আনতে প্রত্যেক সপ্তাহে পরমার্থকে যেতে হয় ওর কাছে। আনন্দবাজারের যে দফতরে ও কাজ করে, সেখানে প্রুফ দেখা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ওই অনুষ্ঠান-সূচি এনে কম্পোজ করে দেওয়া ওর কাজ।
এই কাজ করতে করতেই আশিসের সঙ্গে ওর বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রেই পরমার্থ যেমন জেনেছে, ও লোকসঙ্গীত গায়। কবিতা লেখে। দুটো কবিতার বইও বেরিয়েছে। শুধু ও একাই নয়, ওর বউ রিনাও কবিতা লেখে। তেমনি আশিসও জেনেছে, পরমার্থও ইদানিং কবিতা লিখতে শুরু করেছে। অনেক কবির সঙ্গেই ওর আলাপ আছে। ওর মুখেই ঋজুর নাম শুনে আশিস বলেছিল, উনি কি আপনাদের অফিসে কাজ করেন নাকি?
— কেন, আপনি চেনেন?
আশিস বলেছিল, না, আলাপ নেই। তবে ওর অনেক কবিতা পড়েছি। উনি তো প্রচুর লেখেন। এত লেখেন কী করে? আপনার সঙ্গে ওনার কী রকম সম্পর্ক?
পরমার্থ বলেছিল, ভালই। ও তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছে।
— তাই নাকি? পারলে এক দিন নিয়ে আসুন না, জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।
ঋজুকে সে কথা বলতেই ঋজু বলেছিল, ঠিক আছে এক দিন যাবখ’ন। কিন্তু আজ নয়, কাল নয়, করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। তাই পরমার্থ এক দিন ওকে বলল,
আরে বাবা চলো না, গেলে তোমার লাভই হবে। ও এখন অভিজ্ঞানটা দেখে। কবিতা পড়ার জন্য ওর পেছনে কত লোক ঘুরঘুর করে, জানো? আর ও নিজে থেকে তোমাকে ডাকছে, তুমি যাবে না? ওখানে কবিতা পড়লে পাঁচশো টাকা দেয়।
তাতেও খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না দেখে ঋজুকে প্রায় জোর করেই ও একদিন নিয়ে গিয়েছিল আকাশবাণীতে। সেই আলাপ। তার পর এই।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে সামলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের সামনে দিয়ে যেতে যেতেই আশিস বলল, চলে আসুন, চলে আসুন। দেরি হয়ে গেছে।
ও আগে আগে। পেছনে ঋজুরা। তারও পেছনে ট্যাক্সি থেকে নামা বাকি তিন জন।
কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না। টিকিট-ফিকিট কেটে ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। না। ট্রেনেও খুব একটা ভিড় নেই। ছুটির দিন। তাই ফাঁকা ফাঁকা। একটা খোপেই ওরা সবাই বসার জায়গা পেয়ে গেল। এ দিকের সিটে ঋজু, পরমার্থ আর ট্যাক্সি থেকে নামা কোর্ট-প্যান্ট পরা ওই ভদ্রলোক। বাকিরা উল্টো দিকের সিটে। ট্রেন ছাড়ার আগেই আশিস সবার সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দিল। কোর্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটাকে দেখিয়ে বলল, ইনি মহাদেব মোশেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বিবাহের ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক একটা বই লিখেছেন। এ ছাড়া ছড়া-টাড়াও লেখেন। আর ইনি হচ্ছেন কণিকা রায়। কলকাতা টেলিফোন্সে কাজ করেন। এখন টেলিফোন ভবনে, না? কণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন তার কাছে জানতে চাইল। তার পরে বলল, ক’দিন আগে ওর একটা সুন্দর কবিতার বই বেরিয়েছে। আর এর পরিচয় কী দেব, ইনি আমার গিন্নি, রিনা গিরি।
ঋজু মহাদেববাবুর দিকে তাকাল। মহাদেববাবু আর কণিকার কথাবার্তা দেখে হঠাৎ কেন জানি ঋজুর মনে হল, ওদের মধ্যে কোনও একটা সম্পর্ক আছে।
(চলবে )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন