নোটিশ বোর্ড

" নিকোটিন 2.0 এর নতুন প্রজেক্ট "ক থা হো ক" এর জন্য শীঘ্রই আপনার সেরা লেখাটি এক্ষুনি mail করুন nicotinemagz@gmail.com এ প্রতিদিন সকালবেলা প্রকাশিত হবে

ডায়েরির পাতা থেকে,, পায়েল ব্যানার্জি



আজ আমার জন্মদিন।সকালবেলা ছেলে একটা কেক এনেছিলো,সেটা কাটলাম।দুপুরে মিমি (ছেলের বউ) পায়েস বানিয়েছিল,আর আমার ছোট নাতিটা একটা পেন দিয়েছে আমাকে।ডায়েরি লিখতে ভালোবাসি জানে।মাঝে মাঝে এসে আমাকে বলে
"ও ঠাম্মি তুমি যখন দাদুর কাছে চলে যাবে আমায় তোমার ঐ নোটবুকটা দিয়ে যেও।আর তোমার লেখা গল্প কবিতার ডায়েরিটা।আমি তোমার লেখা গুলো ছাপাব।তোমার প্রচুর নাম হবে।"
আমি শুধু হাসি আর বলি হ্যাঁ দিয়ে যাবো দাদুভাই।খুব পাকা পাকা কথা।ওকে নিয়েই সারাদিন কাটে আমার।এখন ওই আমার কর্তা মশাই।

আজ আমি সত্তর বছরের প্রৌঢ়া।কোথা দিয়ে পলকে জীবন কেটে গেল বুঝতেও পারলাম না।পড়াশোনায় ছোটো থেকেই ভালো ছিলাম।গ্র্যাজুয়েট হবার আগে থেকেই ছেলে দেখা শুরু হয়ে গেলো।তারপরেই বিয়ে।বাবা- মা কে বলেছিলাম আরো পড়তে চাই,চাকরি করতে চাই তারপর বিয়ে করবো।বাবা বলেছিলেন না ভালো ছেলে পেয়েছি করে নে মা।আমাদের অবর্তমানে কে দেখবে তোকে?মা বলতো বিয়ের পর পড়াশোনা করিস শ্বশুর বাড়ি গিয়ে। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে পড়লাম বড় সংসার।তার উপর আবার বাড়ির বড় বউ ছিলাম সংসার সামলাতে সামলাতে পড়াশোনাটা ধোঁয়াশা হয়ে গেল।পুরো সংসারের সমস্ত দায়িত্ব আমার কাঁধে থাকলেও স্বাধীনতা কিছুই ছিল না আমার।বাড়িতে আমি বৌমা,জা,কাকী,মামী বেশি ছিলাম রঞ্জিতের (আমার বর)বউ কম ছিলাম।সামান্য রঞ্জিতের পাশে বসতেও পারতাম না কে কি ভাববে এই ভেবে।দিনের শেষে বিছানায় দুটো শরীর চাহিদা বসতো এক হতো।তারপরেই যে যার মতো সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে এপাস ওপাশ।মন দুটো যেন কর্পূরের মতো উবে যেতো।
                              তারপর বউ,বৌমা সমস্ত সম্পর্ক ফেলে মা হলাম।নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সব পালন করে বাচ্চাকে মানুষ করতে করতে কেটে গেলো সারাটা জীবন।নিজের শখ বলতে শুধু ছেলে কে কি করে বড় করবো মানুষ করবো।নিজের লেখার শখ ছিল খুব।সেটা আর চরিতার্থ হয়নি।আর তখন তো এখনকার মতো এত মুঠোফোনের ব্যবহার ছিল না।যে তার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেকে পৌঁছে দিতে পারবো।দায়দায়িত্ব আমার থাকলেও বাচ্চার কোনো ব্যাপারে ডিসিশন নেওয়ায় অধিকার আমায় দেওয়া হতো না কোনদিন,সব রঞ্জিত নিত।কোনোদিন আমিও প্রশ্ন তুলিনি নিজের অধিকার প্রসঙ্গে।ভেবেছিলাম ও তো বাবা যা করবে ভালোই হবে।দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলো ছেলে,বিদেশ গেলো পড়তে।নিজের ইচ্ছায় বিয়ে।ছেলের বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলাম রঞ্জিতের সাথে কাটাবো।ব্যাস ছেড়ে চলে গেলো আমাকে।ছেলে বউয়ের হাতে ফেলে রেখে।'আমাদের দুজনের'আর সময় কাটানো হলো না কোনোদিনই।পুরোপুরি ভাবে ছেলের ওপর নির্ভর করে দিন কাটাতে হয় এখন।না ছেলে বউ আমার খুবই ভালো তাদের নিয়ে অভিযোগ কিছুই নেই আমার।সারাদিন ছেলে বউ চাকরিতে বেরিয়ে গেলে নাতির সাথে ভালোই সময় কাটে আমার।ওই সব মুঠোফোনের দরকার ও হয়নি,আর ব্যবহারটাও ও ঠিক জানিনা ওই সব স্পর্শকাতর ফোনের।কিন্তু,তবুও দিনের শেষে কোথাও যেনো আমি একা।কিছু,টেলিভিশন সিরিয়াল আর আমি সন্ধ্যে থেকে একসাথে কাটাই।মাঝে মাঝে এই নীল রঙের ডায়েরিটার সাথে নিজের রাগ,দুঃখ,আবেগ,আক্ষেপ ভাগ করেনি।ছেলে বউ নিজের মতো সময় কাটায়, বাইরে ঘুরতে যায় ,সময় কাটায় নাতিও যায়,সারা বাড়িতে আমি একা।না,তারা তো তাদের মতো সময় কাটাবেই,সেই নিয়ে আক্ষেপ নেই আমার।আমি যা পাইনি,রঞ্জিতের সাথে সময় কাটাতে ,তারা তাই করুক আমি চাই।তারা আমাকেও নিয়ে যেতে চায় সাথে করে।কিন্তু,এখন যে আমি শরীরের অধীনতা শিকার করেছি।আমার শরীর আমার সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।এখন সারা শরীর শুধু ব্যাথার অধীনে।ভালো করে নড়তেই পারিনা।এবার গেলেই হয় সব ছেড়ে।কিন্তু, মৃত্যু যতো দিন না চাইবে আমায় নেবে না।সেখানেও আমার স্বাধীনতা নেই।মৃত্যুর ওপর তো কারুর হাত নেই।সে নিজে বড় স্বেচ্ছাচারী।বড় রাগ হয় মহাভারতের  ভীষ্মের ওপর যদি পারতাম অমন স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করতে।

আসল কিছু মেয়েদের সারাটা জীবন শুধু পরের অধীনতাতেই কেটে যায়।বিয়ের আগে ভাবি স্বাধীন আছি।কিন্তু,বাড়ি থেকে বেরোলেই সময় বেঁধে দেওয়া হয়,মনে করিয়ে দেওয়া হয় আমরা মেয়ে। বাড়ির বাইরে বিপদ নাকি পদে পদে!সন্ধ্যের পর বাড়ির বাইরে মানেই হাজার সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়।এখন অবশ্য সময় বদলেছে।তবুও কাগজের পাতায় যা পড়ি তাতে মনে হয় না মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে।আরও বেশি পরাধীন হয়েছে হয়তো।বিয়ের পর স্বামী সংসারের অধীনে থাকতে হয়।তারপর জীবনের কোন এক মোড়ে এসে বাচ্চাদের অধীনে  আসতে হয় ইচ্ছা অনিচ্ছাকৃত ভাবে।এই সমস্ত বাধা কাটাতে না কাটাতে 'রোগ 'হানা দেয় শরীর জুড়ে।আর তার কাছে মৃত্যু কাল অবধি মাথানত করে থাকতে হয়।
আমার মতো অনেকেই হয়তো এই অবস্থায় আছে।এই ভাবেই সাদরে গ্রহণ করে চলেছে জীবনটাকে।নিজের আক্ষেপ গুলো দূরে সরিয়ে রেখে,জীবনের এই শেষ বয়সে উপনীত হয়ে এখন শুধুই বলতে হয় যেভাবেই আছি 'ভালো আছি'।ছেলে,বৌমা,নাতি নিয়ে ভরা সংসারে বেশ কাটছে দিন গুলো।আজকে আরও একধাপ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলতে চাই এবার মৃত্যু চাই স্বাধীন হতে চাই সারা জীবনের মতো।
          রমলা।

                       

কোন মন্তব্য নেই: