" মাঘ স্নান "
**********
বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে পৌষ সংক্রান্তি গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতিতে লোকাচারে পূর্ণ বিশেষ একটি পার্বণ । তাইত এই পার্বণের অনেক নাম -- মাঘস্নান ( মাঘবুর) , পৌষ সংক্রান্তি , হালন্তি , মকর সংক্রান্তি ।
পৌষ সংক্রান্তির প্রস্তুতি শুরু হত অনেক আগে থেকে।
পালাপার্বণ গুলো ছিল সে সময়ে সর্বস্তরের গ্রামীণ জীবনে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম । আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলের সক্রিয় অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যা ছিল অনাবিল আনন্দ যাপন । সহজ সরল আয়োজনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জীবনে নিয়ে আসতো আনন্দ ধারা । কৃষিনির্ভর জীবনে সকল উৎসব অনুষ্ঠান তাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো তারই প্রাকৃতিক উপকরণ কে অঙ্গীভূত করে নিয়ে ।
আজ থেকে বছর তিরিশ আগেও পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলের গ্রামগুলোতে চাষাবাদ হত চিরাচরিত প্রাচীন প্রথায় । লাঙ্গল জোয়াল আবাল চকম ( মই ) আচঁড়া কাঁচি কোদাল ইত্যাদি । ধান পাটের প্রজাতি দেশি , উচ্চ ফলনের লোভে সংকরায়ন থাবা গাড়েনি তখনও ।
আমন ধানের গাছগুলো আষাঢ় শ্রাবণ জুড়ে বর্ষার জলভেঙে দৈর্ঘ্যে প্রায় দশ বারো ফুট । দানির সময় মোটে তিন ফুট কেটে নিয়ে বাকি নাড়া হয়ে মাঠেই পড়ে থাকে । জ্বালানির কাজে লাগে আবার মাঠেই জ্বালিয়ে দিয়ে জমির উর্বরতা বাড়ানো হয় ।
পৌষ মাসের শুরু থেকেই আমাদের বাড়ির জোয়ান ছোকরারা প্রতি রাতে দল বেঁধে মাঠে যায় , নাড়া তুলে আনে । পূবের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের কলতলার কাছে বরি (কুল ) গাছের তলে জমা করে রাখে । সংগ্রহ দিনে দিনে বিশাল আকার ধারণ করে ।
পৌষের শেষের দিনগুলোতে শুরু হয় চালের গুঁড়ি কুটা, ঢেঁকি বা গাইল শেহাইড এ । খেজুরে গুড় , তিল্লাই (কদমা) বাতাসা কাঁঠালকুশি (গুড়ের মিষ্ট নিরেট চুঙের আকারে , ছোট ) ...কিনে আনা হয় বাজার থেকে।
সংক্রান্তির দিন ভোর রাত্রে তিনটা থেকে বাড়ির সব ছেলে ছোকরা জড় হয় কল পাড়ে । পূব পুকুরের দক্ষিণা ঘাটের জলবিভাজিকায় নাড়া দিয়ে জ্বালানো হয় আগুন । উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে সবাই , জানান দেয় জ্বলেছে আগুন , এসো করে নাও মাঘস্নান ।
মা ঠাকুমারাও শুরু করে দেয় পিঠে পুলি বানানোর প্রস্তুতি । আজ কত কাজ , রকমারি পিঠে পুলি পায়েস , উঠোন নাটমন্দিরে আলপনা ,স্নান সেরে নিয়ে ভোর ভোর , করে দিতে হবে নগর কীর্ত্তনের আয়োজন । এ বাড়ি থেকেই যে বেরোবে নগর কীর্ত্তন । তারপর হালন্তির রান্না লাউ কুল দিয়ে টক , তাতেই না হয় লাঙলের পূজা । এদিকে পুকুর ঘাটে ক্ষণে ক্ষণে ছেলেদের হল্লা শুনা যায় । ছেলেরা আগুন পোহায় , আগুনে অরণি ইন্ধন যোগায় , হলকে উঠে নাড়ার আগুন উৎসাহে হল্লা করে দ্বিগুন ।
বৌদি ঠাকুমা ঠিসারার (রঙ তামাশা) পাত্রীদের নিয়ে অশ্লীল ছড়া কাটে , উল্লাসে চেঁচায় --
" লাউ পাতা ঢুলা ঢুলা বাণীর মার পেটটা ফুলা " ,
" পূবের পাত্রঅ দেহিরে ভাই কাঁচির উপরে কাঁচি
গোপাল দাসে কাইজ্যা লাইগ্যা বেডি রে ডাহে চাচি " ,
পশ্চিমের পাতরঅ দেহি রে ভাই ঠ্যাডার ভিতরে ঠ্যাডা
কিরণবলার খেতার নিচে তিন চাইর বেডা " ।
যখন যে স্নান করতে আসে তাকে নিয়ে ছড়া কাটে সম্পর্ক অনুযায়ী । এক সময় স্নান শেষ হয় , সবাই ঘরে চলে আসে । পিঠে পায়েস দই চিড়া খেয়ে সবাই এসে জড় হয় নাট মন্দিরে । ঠাকুর প্রণাম করে খোল করতাল তাসা সহযোগে শুরু করে কীর্তন প্রভাতী সুরে --
" ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম রে ,
যে জন আমার গৌরাঙ্গ ভজে সে জন আমার প্রাণ রে ..."
বাড়ি ছেড়ে উত্তর মুখী হয় কীর্ত্তন । চারিপড়া থেকে পৌদ্দা হয়ে উত্তর পাড়ায় যায় । পৌদ্দা থেকে যুক্ত হয় দেবেন্দ্র দেব চিন্তা দেবেরা , যুক্ত হয় কিছু উৎসাহী মুসলিম ছেলে ছোকরাও । একে একে সাধুর বাড়ি সরকার ( নেহেরু) বাড়ি দাসদের বাড়ি করবাড়ি প্রতি বাড়িতেই নেচে নেচে কীর্ত্তন আর তার মাঝেই গৃহী ফুল বাতাসা কদমা ... দেন হরির লুট । যার ভাগ্যে যা জোটে , সন্তুষ্ট তাতে , কেউ কেউ কমলা লেবুও দিতেন লুটে ।
প্রবোধ দাসের বাড়িতে একটু বিরতি । পিঠে পুলি চা পান তামাক । আবার বেরিয়ে পড়ে নগর কীর্ত্তন । গৌরাঙ্গ দাস মূল সুর ধরে ঘরে ঘরে হরিনাম সুধা নিয়ে যায় । ফিরে আসে আবার চারিপাড়ার , শ্মশানে কীর্ত্তন চলে কিছু ক্ষণ , সেখান থেকে চারিপাড়ার ষোল ঘর হিন্দুর ঘরে ঘরে । সুর উঠে দাসেরা বাড়ির নাটমন্দিরে পরিশেষে ---
" নগর ভ্রমিয়া শেষে নিতাই এলেন ঘরে ...."
গান বুড়ি প্রমোদাসুন্দরী ধান্য দূর্বা দিয়ে বরণ করে নেন তাঁর প্রাণের গৌরাঙ্গ কে । পিঠে পুলি পায়েস পরিবেশন শেষে সাঙ্গ হয় নগর কীর্ত্তন ।
পকেট ভর্তি লুটের প্রসাদ আমিও চালান করি আমার গোপন সিন্ধুকে ।
তাই না আজ দিয়েছি খুলে
সকলের তরে !
লাঙল জোয়াল সহ সকল চাষের উপকরণ পরিষ্কার করে ধুয়ে এনে রাখা হয় নিকানো নাট মন্দিরের এক কোণে । লাউ পাতায় দুধভাত, লাউ বরির (কুল) টক দিয়ে পূজা হয় । রাধা কৃষ্ণের ভোগ লাগে , ভোগ যায় শ্মশানে পিঠে পুলি পায়েস নিরামিষ রন্ধনে ।
কাজের লোকেদের দেওয়া হয় পিঠে পায়েস ।
অনাড়ম্বর সহজে সরলে গ্রাম বাংলা গ্রামীন বিনোদন ,
আজও চলে হয়ত একটু ভিন্নতর সময়ের সাথে তাল দিয়ে ।
তবে চারিপড়া থেকে আর নগর কীর্ত্তন বেরোয় না , বেরোবেও না আর কোন দিন আর --
কাল হরণ করেছে সব , গান বুড়ি ধরে না গান ভোর রাত থেকে --
" সূর্য বংশে ভগীরথ আগে দেখাইয়া পথ তোমারে অনিল মহিতলে ...
সগর রাজার বংশ ব্রহ্ম শাপে হইল ধ্বংস ...
তোমারে আনিল মহিতলে ...."
তবে রাঢ়ের অজয় তীরে বসে মকর আসর , তীরবর্তী প্রতি গ্রামের আখড়া থাকে , কীর্ত্তন বাউল ভাটিয়ালি লোকগীতি গানে গানে মন মাতে , স্থায়ী বাউলের আখড়া তো আছেই । সব মিলিয়ে পাঁচশত । থাকা খাওয়ার চিন্তা নাই , কন্ঠ একটু সুরেলা হলে ত কথাই নাই ,গানও গাওয়া যায় নেচে দোতারা খমকে ।
বাঁশি বনে নয় মনেই বাজে ।
নিয়েছে যত দিয়েছেও কম নয় !!