ভাসান
******
আজ সারাদিন বিসর্জন। সপসপে শরীরে সারাদিন গঙ্গার ঘাটে। দুগগা মায়ের জলে ডোবা উলঙ্গ শরীর টেনে টেনে আঙ্গুল ফুলে যাবে। শরীরের খাঁজে জমবে পাঁক।মা তার নিজের সংসারে ফিরেছে আগেই। পুরুতরা পাঠিয়ে দিয়েছে। থেকে যাওয়া কাঠামোটা জলে দিতে হয়। জলে গলে যাওয়া মায়ের বেঁকা, খিচ খাওয়া শরীর টেনে তোলে রবি,পটা,মণির মতো অনেকে।
কুড়ি থেকে পঞ্চাশ এই দর যাচ্ছে এবছর।হাজার হাজার মা জলে ভাসছে। তার থেকে গোটা পঞ্চাশটা টেনে তুলতে পারলেই কেল্লা ফতে। আজকাল পুলিশ থেকে মেশিন দিয়ে বড় বড় ঠাকুরগুলো তোলে। সেগুলোতে হাত দেয়া যায় না। ছোট আর মাঝারি মাপের গুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি। খিস্তি খেউড়ও হয়।
মণির মা বলে যারা চলে যায় তাদের ফেরানো যায় না। যেমন ওর বাবা এই ঘাটেই দুগগা মায়ের সঙ্গে ভাসান গেছে। তখন তো আর মেশিন ছিল না। দশ বারোজন মিলে মায়ের পেল্লায় শরীর জলে ফেলত, টেনে তুলতো খড়-কাঠের বাঁধন। সেবার মায়ের গলে যাওয়া শরীরের সঙ্গে মণির বাপের শরীরটাও তুলে এনেছিল। পরের বছর মা ফের বাপের বাড়ি এল। মণির বাপটা আর এল না। কিছু সময় আর দুঃখ ফেলে গেল। মা টাতো কত সহজেই দুঃখের মধ্যে মিশে গেল। মণি, বোন আর ঠাকমা, তিনটে পেট চালানো চাই। মণি সেই থেকে কাজের ধান্দায় ঘোরে। যখন যেমন পারে। চালিয়ে তো এল বারটা বছর। আলো সে কিনবেই এটাই পিতিজ্ঞে।
বোনের হাতে টাকা ধরিয়ে জলে নামতে নামতে ঘাটের সিঁদুরখেলা দেখছে। বেশ লাগে মণির। সব মেয়েরা কেমন মা মা হয়ে যায়। শুব বিজয়া বলে যখন জড়াজড়ি করে মনে হয় দুনিয়ায় ঝগড়া বিবাদ কোন কিচ্ছু নেই। পাঁকে বসে যাওয়া পা টেনে তুলতে জান বেরোচ্ছে যেন। বড্ড কাহিল হয়ে পড়েছে। একটা ধাক্কা, মেশিনে ঝুলে থাকা মায়ের পা লেগে পড়ে গেল। গাদা হয়ে থাকা মায়ের কাঠ-খড়ের তলায় কে যেন কাঁদছে মনে হল। শুয়ে পরেছে মণি। দেখতে পাচ্ছে মেশিনে চড়ে ঝুলতে ঝুলতে মায়ের হাড়গোড় নেমে আসছে গাদায়, তার বুকে। ঐ আবার গোঙানির শব্দ। মটমট করে ভাঙছে কাঠামো, মা কাঁদছে। ভাসানের পরও মা বোধহয় কিছুটা থেকে যায়! শুয়ে শুয়ে থেকে যাওয়া মায়ের কাছে পেন্নাম ঠুকে চেয়ে নিল ভালো থাকা। একটা মাত্তর বোন একটা মাত্তর মা। ওদের ফুলতে থাকা ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। উফফ জমে ক্ষীর!
ধকলে যাওয়া শরীরে দুগগা মায়ের হাড়গোড়ের ওম। আরাম পেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরে মণি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন